গীতরঙ্গ চিঠি সংখ্যা: চিঠি দিও প্রতিদিন । গোলাম কিবরিয়া
প্রযুক্তির বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের ফলে এই যুগে ডাক বিভাগের গুরুত্ব যে অনেক কমে এসেছে তা বলাই বাহুল্য। তারপরও সামাজিক যোগাযোগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে ডাক ব্যবস্থা এখনও অপরিহার্য। কালের বিবর্তনে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন তথা আধুনিক পদ্ধতির উদ্ভব হওয়ায় এখন আর প্রিয়জনের কোনো খবরের জন্য ডাকপিয়নের পথ চেয়ে থাকতে হয় না।
তবে এককালে চিঠির প্রতি ছিল মানুষের অন্যরকম এক আবেগ। গানে, সাহিত্যে, শিল্পের বিভিন্ন শাখায় চিঠির প্রতি আবেগের সে পরিচয় পাওয়া যায়।
আধুনিক ডাক ব্যবস্থা শুরুর আগেই মানুষ কবুতরের মাধ্যমে পত্র পাঠাত। ভারত উপমহাদেশে সম্রাট শের শাহ ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করেন, তা আজ সর্বজনবিদিত। আবার এই পত্রই যখন ব্যক্তিক আবেদন অতিক্রম করে শিল্প সৌকর্যের মাধ্যমে সর্বজনীন রূপ নেয়, তখন তা পত্রসাহিত্যে পরিণত হয়। পত্রসাহিত্যের জন্ম আধুনিককালে। বাংলা গদ্যের সঙ্গে পত্রসাহিত্যের রয়েছে জন্মলগ্ন সম্পর্ক। পুরোনো পারস্য, চীন, ভারত, রোমেও চিঠি চলাচলের সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। রোল্যান্ড হিল ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ডাকটিকিট মুদ্রা আবিস্কারের পর চিঠি সর্বজনীন ভাষা পায়। বিখ্যাত ব্যক্তি বা সাহিত্যিকের লেখা পত্র ও অমূল্য সম্পদে পরিণত হয়। এসব পত্রের ভেতর লেখকের ভাবনা, সমাজচিন্তা, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে। পাশ্চাত্য সাহিত্যিকদের মধ্যে কিটস, জর্জ বার্নার্ড শ, ওয়ালপোল, লর্ড টেনিসন, কুপার, লুকাস প্রভৃতির রচিত পত্রগুলো আমাদের কাছে ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলা ভাষার কিছু বিখ্যাত কবি-লেখক তাদের পত্র সংকলন প্রকাশের পর তা সাহিত্য মর্যাদাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তাদের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিলাতের পত্র, স্বামী বিবেকানন্দের পত্রাবলী, নবীন চন্দ্র সেনের প্রবাসের পত্র, অন্যতম। বাংলা পত্রসাহিত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে। তার উল্লেখযোগ্য পত্রসাহিত্যের গ্রন্থগুলো হলো- জাপান যাত্রী, রাশিয়ার চিঠি, য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র, পথে ও পথের প্রান্তে ইত্যাদি। কবির অন্যতম জনপ্রিয় ও বিখ্যাত পত্রসাহিত্য হলো ছিন্নপত্র। চিঠির জন্য কবির ব্যাকুলতার তীব্রতা প্রকাশ পেয়েছে মানসীর ‘পত্রের প্রত্যাশা’ কবিতায়। এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বারবার বলছেন, চিঠি কই, চিঠি কই, কই চিঠি। একইভাবে চিঠির জন্য ব্যাকুলতা লক্ষ্য করা যায় শিশু কাব্যগ্রন্থের ‘ব্যাকুল’ কবিতায়। চিঠি নামে কবিতাটি আছে পূরবীতে।
আমাদের কবি-সাহিত্যিকরাও তাদের গল্প আর কবিতায় চিঠিকে দিয়েছেন অনেক আবেগী রূপ। শঙ্খনীল কারাগার উপন্যাসের ছোট ভাই খোকাকে লেখা রাবেয়ার দীর্ঘ করুণ চিঠি, মৃত্যু ক্ষুধার আনসারকে লেখা রুবির আবেগময় চিঠি, ডিয়ার জনকে লেখা সাভানার ‘গুড বাই’ চিঠি, শেষের কবিতার লাবণ্যকে লেখা অমিত রায়ের কবিতার চিঠি পাঠকের হৃদয়ে গভীর দাগ কেটে গেছে।
বাংলা সাহিত্যের আরও অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পত্রোপন্যাস হলো- শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ক্রোঞ্চমিথুন, বনফুলের ‘কষ্টিপাথর’, বুদ্ধদেব গুহর মহুয়ার চিঠি, চান ঘরে গান, সবিনয় নিবেদন, নিমাই ভট্টচার্যের ‘মেমসাহেব, প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রিয়তমাষু অন্যতম।
চিঠি বা পত্র নিয়ে বিখ্যাতদের অনেক উক্তি রয়েছে। এই যেমন কবি সুকান্ত বলেন, কত চিঠি লেখে লোকে, কত সুখে প্রেমে, আবেগে, স্মৃতিতে কত দুঃখে ও সুখে। জেমস হাওয়েল বলেন, প্রেম হচ্ছে বন্ধুত্বের জীবন এবং চিঠি হচ্ছে প্রেমের জীবন। পত্র নিয়ে এমন বহু বাণী পাওয়া যায় বিখ্যাতদের কথায়।
নানা নথিপত্রের প্রমাণ বিচারে দেখা যায় ২৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রাচীন মিসরের বিভিন্ন অঞ্চলে ডাক ব্যবহার করা হতো। এখন সেটা কুরিয়ার সার্ভিস, ঠিক এই আদলে। এরপর থেকে সময়ের প্রয়োজনে নানা বিবর্তনে ডাক তার সমৃদ্ধির শীর্ষ সোপানে পৌঁছে। পৃথিবীর প্রাচীনতম কার্যকর যোগাযোগ ব্যবস্থা এই উপমহাদেশে গড়ে ওঠে ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে। তাদের ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বোম্বাই মেল শিরোনামে মাদ্রাজ-কলকাতায় অফিস খুলে এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। লর্ড ক্লাইভের শাসনামলে ১৭৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মার্চ ‘পোস্টাল প্ল্যান’ নামে এক ব্যবস্থার সূত্রপাত করেন। তারিখ-সন হিসাব কষে দেখা গেছে, ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মার্চ কলকাতায়, ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে মাদ্রাজ এবং ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে মুম্বাইয়ের সেবা সাধারণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তখন থেকে পোস্ট অফিস সেবা কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে ওঠার নিদর্শন পাওয়া যায়। শুরু হয় সেবার পরিধি বিস্তৃতকরণ। সৃজন হয় ঐতিহাসিক রানার, ডাকপিয়ন থেকে পোস্টমাস্টার জেনারেল পর্যন্ত পদ-পদবি। এ দেশেই প্রায় ১৫০ বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ ডাক ব্যবস্থা। ১৮৫৪ সালে সর্বভারতীয়ভাবে উপমহাদেশে ‘ডাকটিকিট’ ব্যবস্থা প্রচলনের পর ডাকের গতিপ্রকৃতি বদলে যায়। আলাদা স্বতন্ত্র রূপ লাভ করে। শুরু হয় রেলওয়ে ডাক। পোস্ট কার্ড ব্যবস্থা চালু হয় ১৮৭৯ সালে। বিমানে করে ডাক চালু হয় শুরু থেকেই ১৯১১ সালে।
প্রাচীনতম গ্রন্থে যেমন ডাক যোগাযোগ সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যায়, তেমনি হাল আমলের গল্প-কবিতা, সাহিত্য, লোকগাথা জনপ্রিয় অনেক গানে ডাক একটি প্রভাবী ভূমিকা পালন করে। সমৃদ্ধ ইতিহাসের ডাক ‘সেবাই আদর্শ’ স্লোগান নিয়ে ২০ জুলাই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়। স্বাধীন দেশে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে বিমান মল্লিকের ডিজাইন করা ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়।
‘রানার! রানার! ভোর তো হয়েছে- আকাশ হয়েছে লাল আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল?’
কবি সুকান্ত আবেগী ভাষায় ডাকপিয়নের কঠিন সময়কেই যেন তুলে ধরেছেন। প্রযুক্তির বিবর্তনে চিঠির জগৎ হারাতে বসলেও চিঠির প্রতি মানুষের আবেদন যেন এখনও কমেনি।
