| 24 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

অতলস্পর্শ

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

অতলস্পর্শ প্রবাসী নীলার জীবন ও যাপনের পারিবারিক আখ্যান। তার অসুস্থ মাকে দেখভাল করে বোন অপলা যে মানসিক রোগী। মৃত ভাই ও বৈভব হারিয়ে বেঁচে থাকা জীবনের গল্প।


 

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com‘শুধুমাত্র বাড়ীওয়ালাদের ফ্ল্যাটগুলোতেই এরকম সিলিং এর চারদিক দিয়ে সুন্দর নকশা করে দেয় ডেভেলপাররা। আপনি তো আর ল্যান্ডলর্ড না, শুধু একটা ফ্ল্যাটইতো কিনেছেন, আপনার ফ্ল্যাটে কেন এরকম নকশা থাকবে?’ — লিফট থেকে বের হয়ে দরজার কাছে থামতেই ভিতর থেকে কথাগুলো কানে ভেসে এলো নীলা’র। ভাবলো, সেই একইরকম অহংকারী গলায় কথা বলার অভ্যাসটা এতটুকুও বদলায়নি তার ছোট বোনটার।

এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে একটুও দেরী না করে ছুটে এসেছে এই বাসায় মাকে দেখবে বলে। বাসার কাছাকাছি আসতেই মনটা এক অজানা বিষন্নতায় আক্রান্ত হতে শুরু করে নীলার। প্রতিবারই এটা হয় তার। চারদিকের সবুজ বেষ্টনী ভেঙে ভেঙে একটার পর একটা বহুতল বাসার উল্লম্ফনে, জন্ম থেকে পরিচিত সবুজ ছায়ায় ঢাকা পাড়াটার আমূল বদলে যাওয়া দেখতে দেখতে বাসায় ঢুকতেই কেয়ারটেকার ছেলেটা ব্যতিব্যস্ত হয়ে সালাম দিয়ে বললো, ‘ছোট ম্যাডাম দুইজন আপা’র সাথে একদম উপরের তলায় অনেকক্ষণ ধরে কথা বলছে।’
‘বাহ! ছোট ম্যাডাম কখন কোথায় থাকে প্রতিটা নড়াচড়ার খবরই এরা রাখে নাকি?’ ভাবলো নীলা। মায়ের ফ্ল্যাটে যেয়ে দরজা তালা দেয়া দেখে বুঝলো চাবি ছোট ম্যাডাম মানে তার ছোট বোন অপলা সাথে নিয়ে গেছে। চাবির খোঁজেই উপরে উঠে আসা।
দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকতেই অপলা তাকে দেখে একটু থমকালেও সাথে সাথেই আবার একদম স্বাভাবিক সুরেই বললো, ‘তুই এসে গেছিস? ভালোই হলো, আমি এদেরকে তোর এই ফ্ল্যাটটা দেখাতে নিয়ে এসেছি, এরাই কিনতে চায়।’

নীলা চার তলার মিসেস রেজার সাথে আরো একজন অপরিচিত ভদ্রমহিলাকে দেখতে পেল। হেসে এগিয়ে এসে মিসেস রেজা বললেন, ‘খুব ভালো হলো আপা, আপনার সাথেই দেখা হয়ে গেল।’ একটু হেসে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতে মিসেস রেজা বললেন, ‘পরিচয় করিয়ে দিই, ইনি আইরিন আপা, আমাদের পাঁচতলায় ভাড়া থাকেন, তার খুব ইচ্ছা আমাদের এখানে একটা ফ্ল্যাট কিনবেন, তো আপনার এই ফ্ল্যাটটা তো শুনেছি বিক্রি হবে, উনি অনেকদিন ধরে দেখতে চাচ্ছেন, এজন্য আজকে দেখাতে নিয়ে এলাম। আপনার এই ফ্ল্যাটটা তো আমাদের ফ্ল্যাটটার থেকে অনেক সুন্দর সেটাই অপলা আপাকে বলছিলাম। আমরা তো ডেভেলপারের কাছ থেকে কিনেছি আর আপনারা তো বাড়ীর মালিক ছিলেন, সেজন্যে মনে হয় আপনাদের গুলো একটু বেশী সুন্দর করে বানিয়েছে ডেভেলপাররা,’ হাসতে হাসতে বললেন মিসেস রেজা।

 


আরো পড়ুন: ক্ষমা মাহমুদের গল্প দোলাচাল


 

এতক্ষণে নীলা বুঝলো, অপলার ওভাবে বলার কারণ। সে আসলে অন্যদেরকে বুঝিয়ে দিতে চায় যে, ‘এই গোটা দশকাঠা জমির উপরে করা বাড়ির আসল মালিক ছিলাম আমরা। তুমি কোথাকার কে যে একটা ফ্ল্যাট কিনেই একেবারে বাড়িওয়ালা সেজে বসতে চাও?’ এ সেই অতি পরিচিত পুরনো অহংকার তার ছোট বোনের যা তার জীবনটাকে আজ একদম তলানিতে নিয়ে গিয়ে ঠেকালেও স্বভাবটা একটুও পাল্টায়নি। তবে এটা তো শুধু স্বভাব না, মনের অনেক গভীরে এই রোগ বাসা বেধে আছে একেবারে সেই ছেলেবেলা থেকেই, গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে ভাবলো অনীলা আহমেদ!

‘আপনি তো আজকে খুব ক্লান্ত আপা, অনেক দূর থেকে এসেছেন, আমরা একদিন বসি তাহলে বাড়িটা কেনার ব্যাপারে আপনার সাথে বিস্তারিত আলাপ করার জন্যে?’
আইরিন আপা’র কথা শুনে মুহূর্তে বাস্তবে ফিরলো নীলা। হেসে বললো, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমি তো আসলে আম্মাকে দেখতে এসেছি তবে সেই সাথে এই কাজটাও হয়ে গেলে তো ভালোই হয়।’ ওদের সাথে কথা শেষ করে দুই বোন নেমে এলো দোতালায়, অপলা যেখানে অসুস্থ মাকে নিয়ে একা বাস করছে বেশ অনেকগুলো বছর ধরে। পুরো দোতালাটা নিয়েই সে থাকে, দক্ষিণমুখো বাড়ি, সারাদিন আলো আর বাতাস মিলেমিশে পুরো বাড়িটার মধ্যে অল্পবয়সী প্রেমিক প্রেমিকা’র মত লুটোপুটি খেতে থাকে। যদিও ডেভেলপারের কাছ থেকে পাওয়া আরো দুটো ফ্ল্যাটের ভাড়া দিয়েই অপালা’র দিব্যি ভালোমত দিন চলে যাওয়ার কথা কিন্তু তাতেও তার অনুযোগের অন্ত নেই। প্রায়ই নিউইয়র্কে নীলাকে ফোন দিয়ে এখনও পর্যন্ত যথেষ্ট সুন্দর মুখটার একদম একশো আশি ডিগ্রী বিপরীত গলায় গোখরো সাপের মত হিস্ হিস্ করে বলে, ‘মায়ের জন্য আরো টাকা লাগবে, ইদানিং শরীর বেশী খারাপ হচ্ছে, ডাক্তার ও ওষুধের খরচ অনেক বেড়ে গেছে।’ তার মানে আরো টাকা পাঠাও অথচ নীলা তার ভাগের ভাড়া দেয়া ফ্ল্যাটগুলোর একটার ভাড়া পুরোটাই মায়ের জন্য দিয়ে রেখেছে।

চাবি দিয়ে অপলা দরজাটা খুলতেই ড্রইংরুমের দেয়ালে ঝুলানো আব্বার হাসিমুখের প্রথম জীবনের সেই প্রিয় বাঁধানো ছবিটা মুহূর্তে চোখের সামনে চলে এলো নীলা’র। দেশভাগের পর খালেদ সাহেবের পুরো পরিবার মুর্শিদাবাদ থেকে রাজশাহীতে চলে আসলেও তিনি কোলকাতায় রয়ে গিয়েছিলেন বাম রাজনীতির সাথে তার গভীর সম্পৃক্ততার কারণে। কিন্তু খুব বেশীদিন কোলকাতায় পুরো পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থেকে রাজনীতি চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। একটা অপারেশনে যেয়ে ধরা পড়ে সোজা জেলে। পুরো পরিবার যেন বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলো এই ঘটনায়। আত্মীয় স্বজন রাজশাহী আর ঢাকার নানা জায়গায় যে যেভাবে পেরেছে সম্পত্তি পাল্টা পাল্টি করে থিতু হয়েছে। হঠাৎ ঝড়ে উপড়ে পড়া গাছের মত নিজেদের জীবন সোজা করতেই হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে তারা তখন। কোলকাতায় খালেদ সাহেবের রাজনৈতিক জীবনের অতসব বাস্তব বিড়ম্বনা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করার মত কেউ ছিলনা, আর তার নিজেরও কেমন যেন ভিতরে ভিতরে একটা পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছিল। যে স্বপ্ন নিয়ে এই রাজনীতি’র সাথে জীবন জড়িয়ে পড়েছিল তা যেন একটু একটু করে ফিকে হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল স্বপ্নটা শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে, বাস্তবের মাটি খুঁজে পাচ্ছিলনা কোন কিছুই। ভেঙে পড়েছিলেন ভিতরে ভিতরে। অবশেষে মুচলেকা দিয়ে বের হয়ে চলে এলেন ঢাকায়।নতুন এই শহরে এসে একটু থিতু হয়েই কিছুদিনের মধ্যে একটা চাকরীতে ঢুকে বিয়ে শাদী করে পুরোমাত্রায় সংসার জীবন শুরু করেছিলেন।‌‌ তারও কিছু পরে একটু একটু করে বানিয়েছিলেন এই বাড়ীটা। এসব গল্প বাবার কাছে ছোট থেকে শুনতে শুনতে বড় হয়েছে নীলা।


আরো পড়ুন: গল্প মাকড়সার জাল


‘কিরে, বাইরেই থেকে যাবি, না ভেতরে ঢুকবি?’ অপলা’র শীতল গলার স্বর মুহূর্তেই নীলাকে আবার বাস্তবে ফেরালো। একটু ভালো করে তাকালো বোনের দিকে- চেহারায় সেই আগের জৌলুস না থাকলেও গম রঙা গায়ে ময়ূরকন্ঠী রং এর সালোয়ার কামিজে এখনও যথেষ্টই আকর্ষনীয়, সেই অতি ফ্যাশন সচেতন কেতাদুরস্থ ভাব একটুও কমেনি। শুধু একটু মেদবহূল হওয়া ছাড়া বয়স যে প্রায় অর্ধশতক পার করে ফেলেছে তা বোঝা একটু মুশকিলই বটে।
আম্মার ঘরে ঢুকে ধীরে ধীরে বিছানার পাশে বসে ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকালো নীলা। আম্মার একসময়ের টলটলে, মোলায়েম চেহারাটা ভেঙেচুরে একাকার। অপলা আদৌ আম্মার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সব করে বলে মনে হয়না। নীলার দেয়া টাকা পয়সাও সম্ভবত পুরোটা সে আম্মার পেছনে খরচ করেনা। আশেপাশে এত আত্মীয়-স্বজন তাদের, কিন্তু কারো সাথেই কোন যোগাযোগও রাখেনা। আম্মা এখন তার নিজের বাড়ীতেই অসহায় পুতুল হয়ে বেঁচে আছেন। ছোট মেয়েকে নিয়ে তার বরাবরই দুঃশ্চিন্তা ছিল কিন্তু এতোটা মনে হয় তিনি নিজেও ভাবেননি। জীবনের গল্পতো সবসময় দুয়ে দুয়ে চার হয়না। সেটা নিয়ে বিচার করতেও বসা যায়না। জীবনে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনায় কখনও কখনও মানুষ ‌শুধুই অসহায়ভাবে দাবা’র বোড়ে’র ভূমিকা পালন করে যায়, মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে নীলা। বাবা মারা যাওয়ার পরই অপালার বাড়াবাড়িটা শুরু হয়েছিল। মায়ের এই শেষ বয়সে এসে শুনতে হচ্ছিলো তার নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা যদিও শক্ত হাতে মা সামলেছিলেন সেই পরিস্থিতি। বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘তুমি এরকম করলে কোন সম্পত্তিই তোমাকে লিখে দেবনা।’ একথা শোনার পর জোঁকের গায়ে যেন নুন পড়েছিল। কিন্তু এখন সেই আম্মারও নিজের কোন শক্তি আর অবশিষ্ঠ নেই নিজের মেয়ের সাথে যুঝে ওঠার। আম্মার সময়কার কাজের বুয়াদের একজন এখনও রয়ে গেছে। গতবার নীলা যখন এলো তখন হাফিজা বুয়া চুপিচুপি তাকে বলেছিলো, ‘ছুডো আফা কিন্তু খালাম্মারে মাঝে মাঝে মাইর দেইগো আফা, সেই দৃশ্য সহ্য করণ যায়না। আমার কথা কইয়েন না আবার।’ নীলা কিছুই বলেনি; জানে, বলে কোন লাভ হবেনা। আম্মার এই অবস্থায় তার নিজের কাছেও আম্মাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।নীলা’র মনে হয় জন্ম থেকেই তার বোনটা যেন হায়েনা’র মত এক মন ভর্তি হিংসা নিয়ে এসেছিল পৃথিবীতে। মা টেবিলে খাবার দিলেই নিজেরটা দেখে নিয়ে তারপর নীলা আর নিলয় এর প্লেটের দিকে তাকাতো মা ওদেরকে বেশী দিলো কিনা সেটা বুঝতে। মাকে বলতো, ‘বড় মেয়েকে আর একমাত্র ছেলেকেই তো বেছে বেছে সব ভালো খাবারটা তুলে দাও।’ একমাত্র ভাই নিলয়কে খুব ভালোবাসলেও মাঝে মাঝে ওর ঈর্ষার হাত থেকে নিলয়ও রেহাই পেতনা। ভাইটার কথা মনে করতেই চায়না নীলা তবুও কাঁটার মত বিধেঁ থাকা এই কষ্ট থেকে থেকেই জানান দেয় যে, তাদের আদরের ছোট ভাইটা বড় গভীরভাবেই আছে এখনও তাদের জীবনে, এই এতবছর পরেও। নীলা’র পরিস্কার মনে পড়ে দিনটার কথা। ওর বিয়ের পরের দিন, অপলা ও অন্যান্য চাচাতো, খালাতো ভাই বোনেরা সবাই ওর শ্বশুর বাড়ীতে হৈচৈ করতে করতে দেখা করতে গেছে । নিলয়কে না দেখতে পেয়ে মাকে ফোন দিয়েছিল নীলা একটা উৎকন্ঠা থেকে। মা বললো, ‘ওতো বেরিয়েই গেলো তোর বাড়ীতে যাওয়ার জন্য।’ সেই শেষ, আর ফেরেনি বাড়িতে। বিয়ের কিছুদিন আগে থেকেই নীলা বুঝতে পারতো কিছু একটা পরিবর্তন ঘটে চলেছে তার ভাইটার। এত মেধাবী একটা ছেলে একটু একটু করে নিজেকে কোথায় হারিয়ে ফেলেছিল কে জানে! একা একা থাকতে চাইতো। মায়ের কাছে খুব ঘন ঘন টাকা চাইতো। কারণ জিজ্ঞাসা করলে পরিষ্কার কিছু জানাতো না। কিন্তু মাকে কয়েকবারই বলেছিল ‘আমাকে বিদেশে পাঠিয়ে দাও, এখানে ভালো লাগছেনা।’ একমাত্র ছেলেকে এত তাড়াতাড়ি বাইরে যেতে দিতে চায়নি মা-বাবা। লাশটা পাওয়া গিয়েছিল বাড়ীর কাছেই একটা নদীতে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে আত্মহত্যা বলা হলেও সেটা অসম্ভব মনে হয়েছিল সবার কাছে। নদীতে ঝাঁপ দেয়ার আগে মাথায় জোরে বাড়ি খাওয়ার উল্লেখ ছিল। নিলয়ের যে বন্ধুগুলোকে সন্দেহ হয়েছিলো আব্বার, তারা প্রত্যেকে নীলার বিয়েতে উপস্থিত ছিল কিন্তু বাড়ীর লোকজন কেউই তাদেরকে খুব ভালো করে চিনতো না। কেস তুলে নেয়ার জন্য অপরিচিত ফোন কল থেকে হুমকি আসতো। অপলাকে তুলে নিয়ে যাবে বলে হুমকি আসা শুরু হলে বাবা আর এগোনোর সাহস পাননি, ওখানেই থেমে গিয়েছিলেন।

ডেভেলপাররা যখন তাদের আগের বাড়ীটা ভেঙে এই নতুন বাড়ীটা করলো, তখন কিন্তু অপলা নিজেই আগে আগে বললো বাড়ীর নামটা নিলয়ের নামেই হবে। নীলা’র এখন মনে হয়, হয়তো এই ঘটনাগুলোও গভীর দাগ ফেলে গেছে অপলার মনে, আরো বাড়িয়ে দিয়েছে তার মনের এই অন্ধকার জগতের পরিসর। অনেক বছর পর্যন্ত সে একদম মানতে পারতো না যে ভাইটা আর নেই।এখনও এই প্রসঙ্গ উঠলে বলে ওঠে, ‘কেন আমাদের জীবনেই এরকম ঘটলো!’
কলিং বেলটা বেজে উঠলো। মনে হয় হাফিজা বুয়া ফিরলো। দরজা খোলার শব্দ ও অপালা’র রাগত স্বর ভেসে এলো ওদিক থেকে, ধমকাচ্ছে বেচারীকে। বাড়ীর কমন গার্ডকে কয়েকদিন আগে এক চড় লাগিয়েছে বলে শুনেছে নীলা। নীলা এখানে না থাকলেও তার ভাড়াটিয়ারা ফোনে তাকে অনেক কথাই জানায়। বাড়ীর মালিকানা এখন তার মতো আরো অনেকের সেটা যেন পলা’র মনেই থাকেনা বা মানতেই চায়না।

‘দেখোতো কি শুরু করেছে পলা,’ মা বলেছিলো বাবাকে। ‘এত ভালো একটা প্রস্তাব কিন্তু পলা বলছে, যে ছেলের মা আছে তাকে সে বিয়ে করবেনা। পাগলামীরও একটা সীমা আছে। কোথা থেকে তারজন্য মা ছাড়া ছেলে বিয়ের জন্য কেউ খুঁজে এনে দেবে!’ তিতিবিরক্ত হয়ে বলেছিল মা। একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব এসে গড়াগড়ি খেয়েছে বাড়ীতে অথচ সব প্রস্তাব নাকচ করে দিত প্রত্যেকটার কোন না কোন খুঁত বের করে। বিয়ে নিয়ে তার এই অদ্ভুত আচরণে বাড়ীর লোকেরাও ততদিনে উদ্বিগ্ন আর আত্মীয় স্বজনেরা বিরক্ত হওয়া শুরু করেছিল।

বিয়ের পরেও চাকরীটা নীলা চালিয়েই যাচ্ছিল। ততদিনে নীলা’র প্রথম সন্তান ধ্রুব কোল জুড়ে এসেছে। এই সময়টাতেই নীলা’র স্বামী জাফরও আমেরিকায় তার বোন থাকার সুবাদে অভিবাসন প্রক্রিয়াটা শুরু করে জোরে শোরে। ধ্রুব’কে মায়ের তদারকিতে রেখে যেন চাকরীটা চালিয়ে যেতে পারে,সেজন্যে নীলা তখন কিছুদিন মায়ের বাসায় এসে থাকা শুরু করলো।

অপলাকে তখন কেন জানি জাফরের সাথে অতিরিক্ত মেশামিশি করতে দেখতো নীলা। শালী-দুলাভাইয়ের সম্পর্কটা যেন কখনও কখনও মাত্রা ছাড়িয়ে যেতো। নীলা ভাবতে চাইতো তার নিজেরই কোথাও ভুল হচ্ছে। জাফরের সাথে ছয় বছরের সম্পর্কের পর তারা বিয়ে করেছে। বিয়ের দু’বছরের মাথাতেই অসীম বিস্ময় আর গভীর বিষাদ নিয়ে দেখেছিলো, জাফর, যার শিক্ষা, ব্যক্তিত্ব, সুক্ষ্ম রুচি তাকে মুগ্ধ করে রাখে সেই মানুষ অবিশ্বাস্যভাবে একটা স্থুল ভাঁড়ে পরিণত হয়ে অপলা যেভাবে যা বলছে তার সাথে সেটাতেই তাল দিয়ে যাচ্ছে। একদিন অফিস থেকে ফিরতেই বাবা এসে বললেন, ‘কি হচ্ছে এসব, তুমি অফিসে গেলেই জাফর পলাকে নিয়ে বাইরে বের হয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝেই… তুমি কি কিছুই খেয়াল করছো না?’ নীলার নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছিলো সেদিন। চুপচাপ বসেছিলো ওরা ফেরত আসা পর্যন্ত। জাফরের চোখে অন্যকিছু দেখেছিল সেদিন নীলা। ঐদিনই মায়ের বাসা থেকে চলে এসেছিল। তার বছর খানেকের মধ্যেই আমেরিকায় চলে আসার আগ পর্যন্ত আর জাফরকে নিয়ে মায়ের বাসা মুখোও হয়নি। ব্যাপারটা এমন নয় যে অপলা কোনদিনও জাফরকে বিয়ে করতো, নীলা সেটা পরিষ্কার ভাবেই জানে। তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এই ঘটনা নিয়ে গন্ডগোল বেঁধে যেন সম্পর্কটা ভেঙে যায় সেটাই ছিল অপালার চাওয়া। চোখের সামনে নীলার সুখী জীবন ছিল তার কাছে অসহ্য। অপলা সফল হয়েছিল বৈকি! জাফর পরে তার কাছে ক্ষমা চাইলেও এই জীবনে আর কখনই জাফরের উপর সেই বিশ্বাস আর ফেরত আসেনি নীলার‌।

‘তুইতো আমেরিকায় ছেলে মেয়ে নিয়ে মহা আনন্দে আছিস। আর এদিকে আমি মাকে দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেছি! এই বাড়ীতে কতগুলো আজেবাজে লোক ফ্ল্যাট কিনে ভেবেছে তারা কি যেন হয়ে গেছে। কেউ আমাকে মানতে চায়না। ইদানিং তো এরা আমাকে মিটিংগুলোতেও ডাকেনা। কিন্তু ওরা তো জানেনা যে পৃথিবীর কত জায়গায় আমার কত সুনাম। ভূটানে আমার নামে একটা রাস্তা তৈরী হয়েছে, তুই জানিস? প্রধানমন্ত্রী নিজে কিছুদিন আগে আমাকে এইজন্যে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন, তোকে না সেদিনই ফোনে এটা আমি জানালাম?’ কখন জানি মায়ের ঘরে ঢুকে কি কি যেন অপলা বলে যেতেই থাকে, নীলা সেসব আর শুনতে পায়না। ওর কানে ভেসে আসে নিলয় যেন বলছে, ‘আপা বাবাকে বলো আমাকে বিদেশে পাঠিয়ে দিক, তাহলে আমি বেঁচে যাই।’ কিন্তু ওকে সময়মত বিদেশে পাঠানো আর হয়নি। মাকে একবার বাবার সাথে কথা বলতে শুনেছিল, ‘পলাকে মনে হয় একবার সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার।’ বাবা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আরে না! আস্তে আস্তে বয়সের সাথে সাথে ভালো হয়ে যাবে, চিন্তা করোনা।’

মায়ের চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো পাশের বাসার চিত্রা’দের বড় বড় মেহগনি আর শিরিষ গাছে ভর্তি বড় দোতালা বাসাটা এখনও তেমনই রয়ে গেছে, ডেভেলপার নামক অজগরের গ্রাস বানাতে পারেনি এখনও বাসাটাকে। ওদের ছাদে সারি দিয়ে সাজিয়ে রাখা লাল, সাদা, বেগুণী, গোলাপী, হলুদ রং এর বাগানবিলাসের রঙিন কাগজের মত পাতাগুলো যেন চারপাশের বিবর্ণ পৃথিবীটাকে বাতিল করে দিয়ে এক অদ্ভুত রঙিন জগৎ তৈরী করে রেখেছে। আকাশের অনেক উঁচুতে একটা বড় চিল বিশাল ডানা মেলে রাজকীয় এক ভঙ্গিতে যেন বাতাস কেটে কেটে ভেসে ভেসে নীচের পীড়িত পৃথিবীর দিকে কৌতুকভরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।

মায়ের শুকিয়ে যাওয়া গোলাপের পাপড়ির মত নিশ্চল মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ সেই কত আগের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ক্লাসে ‘হ্যামলেট’ পড়ানোর কথা মনে হলো… চোখের সামনে যেন ভেসে উঠলেন আশরাফ স্যার, একটু দুলে দুলে ক্লাসে তাদের বলে চলেছেন … ‘দ্যাখো, আমাদের মধ্যে কত শত মানুষ মনের কত রকম বিচিত্র ভাবনা নিয়ে যে চারপাশে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা কি আমরা কিছু জানতে পারি! যদি তার কিছুটাও জানা যেতো তাহলেও পৃথিবীর টিকে থাকা কিন্তু মুশকিলই ছিল! কিন্তু বাইরে থেকে দেখলে কিন্তু আমরা সবাই স্বাভাবিক…’
মিটমিট করে হাসতে হাসতে স্যার আরো কি কি যেন বলেই যাচ্ছেন… নীলা আর কিছু শুনতে পায়না।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত