আসুন, গল্পটা খুঁড়ে খুঁড়ে দেখি
শুধু ভিড় বলে নয়। জেএফকে এয়ারপোর্ট এতটাই ছড়ানো, তার এতগুলো টার্মিনাল আর অসংখ্য গেট যে আগে থেকে বলা থাকলেও পরিচিত দুজনের মোলাকাত হওয়া মুশকিল। শুধু আচমকাই দেখা হতে পারে। হয়েছিলও তাই। এত গুলো বছর! দুই যুগের বেশি। তবু চিনে ফেললাম।
ওকে এখানে এভাবে দেখবো সেটা তো আশা করিনি। চোখ পরিচিত কাউকে খুঁজছিল না। যথেষ্ট টায়ার্ড, সারাদিন একটার পর একটা ক্লায়েন্ট মিটিং ছিল। অন্যদিন লোকজন তাও যা একটু আধটু দেখি, ইতিউতি চাই। ইন্টারেস্টিং কাউকে দেখতে পেলে ভাল করে নজর করি, এমন কি আড়ি পেতে লোকের কথাও শুনি। ওই লেখার সময় রসদ হয় আর কি। কিন্তু আজ একদমই হতক্লান্ত। সেই কোন সকালের ফ্লাইট ধরেছিলাম। অন্য মানুষের জীবন কোনভাবেইউতসাহিত করছিল না। কোনমতে ল্যাপটপের ব্যাগটা পাশে ফেলে হয়তো চোখ বুঁজে ফেলতাম কিছুক্ষণের জন্য। পরের ফ্লাইট এখনো ঘণ্টা দুয়েক। যথেষ্ট সময়। কিন্তু সেই সময়েই খুঁজে পেলাম আমুকে।
(সত্যি বলতে এই দেখাটা হঠাৎও হয়নি, এয়ারপোর্টেও নয়। দেখাটা ট্রেনে হয়েছে লিখতে পারতাম, ভেবেওছিলাম একবার। ট্রেনে খোলা জানালা দিয়ে হাওয়া এসে কপালের চুলগুলো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে কয়েক গুচ্ছ চোখে এসে পড়ছে তুহিনার। হ্যাঁ ওর আসল নাম তুহিনা। কিন্তু গল্প লিখতে গিয়ে মনে হল এমন একটা নাম কেমন যেন শীতলতা নিয়ে আসবে এই চরিত্রে যেটা ও কখনই ছিল না। নামের মাধ্যমে চরিত্রকে চিহ্নিত করার এই সুবিধাটা লেখকের থাকে। যা বলছিলাম, ট্রেনে হঠাত দেখা হওয়াটা অনেকবার ঘটেছে ছোট গল্পে। এমন কি কবিতাতেও। গতানুগতিক হয়ে যেতো। তাই বাতিল করতে হয়েছিল।
ফিরে দেখার শুরু হয়েছিল ফেসবুকে। হঠাৎ নয়, ওর নাম দিয়েই সার্চ করেছিলাম। ইন বক্সে মেসেজ পাঠিয়েছিলাম অনেকদিন বাদে। শেষ যেবার কলকাতায় এলাম, সেদিন সামনা সামনি দেখা হয়েছিল ওর গানের স্কুলে। পঁচিশ বছর পরের তুহিনার চেহারাটা কি রকম হতে পারে তার একটা স্পষ্ট ধারনা ছিল আমার।
আচ্ছা, কেন এমনভাবে কাহিনী সূত্রটা বলে দিচ্ছি?
আমার এক পাঠিকা জিজ্ঞেস করেছিলেন একদিন, এই যে গল্প লেখেন; এসব কি আপনার নিজের চোখে দেখা? আসলে এরকম অনেকেই করেন। ছায়া পিসি কি সত্যিকারের কোন মানুষের আদলে? বাচ্চু মামা? আরলিন সালভাতোরে? কিংবা ইমন আলি? ‘আমরা তারা চিনতাম’ গল্পটা তো আপনারই ছোটবেলা, এরকম জোরের সঙ্গেও বলেছেন কেউ বা। তার মানে পাঠকের সব সময়ে শুধু গল্প পড়লেই হয় না, গল্পের তথ্যসূত্র জানতেও ইচ্ছা করে। খুঁড়ে দেখতে ইচ্ছে করে লেখকের জীবন। তাই ভাবলাম, দেখি না একটা গল্প লিখতে লিখতেই চরিত্রের পিছনের আসল মানুষদের সামনে নিয়ে এলে কি দাঁড়ায়। পাঠকের অনুসন্ধিতসাপূর্ণ করতে গিয়ে গল্পটা চটকে যায় না কি গল্পের একটা সমান্তরাল উপাদান হয়ে ওঠে?
লিখছি এখন, পরে কেটে বাদ দিলেও দিতে পারি। কে জানে!)
খুঁজে পেলাম ওর হাসির জন্য। হয় এরকম কিছু লোকের। কারো যেমন মুখের মধ্যে চোখ দুটো ভাসতে থাকে মাঝ সমুদ্রে পাল তোলা জাহাজের মত। একবার দেখলে ভোলা যায় না। আমুর হাসি অমনিধারা, তবে অন্য রকম। এমনভাবে শুধু আমুই হাসতে পারত। কখনই শুধু দাঁত দিয়ে হাসত না তো আমু। চোখ দিয়ে, ভুরু দিয়ে এমন কি হাসি আটাকানোর চেষ্টায় যে বাঁ হাতটাকে ঠোঁটের সামনে আনত, সেই হাতের আঙ্গুলগুলোও সমস্বরে হাসত। অনাবিল। ওইভাবে আর কেউ হাসে না, দেখি নি তো কাউকে। কারো হাসিতে এইভাবে চারদিকে আলো ছড়ায় না।
(এটা একদম সত্যি। জাদু শব্দটা অতি ব্যবহারে খেলো। তুহিনার হাসিতে জাদু ছিল বলবো না। নির্মল কথাটা ঠিকঠাক হবে। হয়না কাকচক্ষু দিঘি যার জলে বাঁধা পড়ে চারপাশের সবকিছু কোন বিকৃতি ছাড়াই? ওর হাসি ছিল অমনি এক মায়াময় আধার।)
এই হাসিই চিনিয়েছিল আমুকে। অবিকল সেই প্রথমদিনের মত। যেদিন অ্যাকাডেমিতে নাটক দেখতে গেছিলাম। বহুরূপীর রাজদর্শন, মনোজ মিত্রের নাটক। আমি একাই গেছিলাম, নাটকের শেষে বাস ধরার আগে একটা সিগারেট ধরিয়েছি। দেখলাম তপনকে। আসলে তপনকে দেখলাম বলা ভুল হবে। নাটকের শেষে অ্যাকাদেমির বেরোবার জায়গাটায় বেশ ভিড় থাকে, খুব উল্লেখযোগ্য চেহারার না হলে আলাদা করে কাউকে খুঁজে নেওয়া যায় না। তপন অতি সাধারন চেহারার। দৈর্ঘ্যে, প্রস্থে, উপস্থিতিতে। তপনকে দেখার কারন আমু। তখনো ওর নাম জানি না। ঢেউয়ের মত বেরিয়ে আসা মানুষের দলের মধ্যে হঠাত যেন কেউ আলো জ্বালিয়ে ধরেছে তার হাসি দিয়ে। যদিও সবাই হাঁটছে, তার মধ্যে একটা মেয়ে হাসছে, তার চোখ হাসিতে চমকাচ্ছে, বাঁ হাতের আঙ্গুলগুলো হাসির মুদ্রায় পাতলা ঠোঁটে হাস্যমুখর দাঁতের সারিকে আড়াল করার চেষ্টায় খুশি উড়িয়ে দিচ্ছে খোলা আকাশে, আমার চোখ সেদিকেই চলে গেছিল। আর তখনই আবিষ্কার করেছিলাম সেই আলোকজ্জ্বল মেয়েটির পাশে, শুধু পাশে কেন ওর ডান হাত আলগোছে ধরে হাঁটছে আমাদের তপন। তপন! হ্যাঁ এতক্ষণে মনে পড়েছে জুতসই শব্দটা! জয় দ্য ভিভিয়ার। আমুর উপস্থিতি এমনিভাবেই আনন্দ ছড়িয়ে দিচ্ছিল চারপাশে।
(না, সত্যিটা জানিয়ে দিই। অ্যাকাডেমিতে দেখা হয়নি। কিন্তু এই রেফারেন্সটা টানলাম নাটকের নাম দিয়ে একটা সময়ের পরিচিতি দেবার জন্য। নোঙ্গর ফেলার জন্য গল্পের একটা স্থান কাল পাত্র দরকার হয়। তাই দিলাম। তবে একটা নাটক দেখতে গিয়েই প্রথম দেখেছিলাম তুহিনাকে। চুঁচুড়ার রবীন্দ্রভবনে। সেটা নাটক শুরুর আগেই, নেহাতই লোকাল নাটক। আমি মাঝামাঝি একটা সারিতে বসেছিলাম। তুহিনা বসেছিল প্রথম কিংবা দ্বিতীয় সারিতে। পিছনের সারিতে তপন ছিল, ওর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তুহিনা হেসেছিল। ঠিক তার পরেই টপ করে আলো নিভে গিয়ে নাটক শুরু হয়ে গেল আর সেই হাসিতে বিহ্বল হয়ে আমার নাটক দেখা মাথায় উঠল। সেই জন্যে অনেক চেষ্টা করেও ওই নাটকের নাম আমি মনে করতে পারি না, দেখিই নি ভাল করে। অন্ধকার একটু চোখ সয়ে গেলে বারবার ওই সামনের সারিতে বসা মেয়েটাকে দেখার চেষ্টা করছিলাম, যদি আর একবার পিছনে ফিরে হেসে ওঠে। কিন্তু হাসেনি। তাই নাটকের শেষে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়ে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করছিলাম। যদি মেয়েটাকে না পাই, অন্তত তপনকে। হ্যাঁ, ওর সত্যিকারের নাম তপন। বদলানোর দরকার হয়নি। নামটা এত সাধারন, ঠিক যেমন হওয়া উচিত এই চরিত্রটার। তাই বদলাইনি আর।)
এমনি সময়ে হলে নির্ঘাত তপনকে এড়িয়ে যেতাম, সেই মুহূর্তে নাটকটা নিয়ে ভাবতে ভাল লাগছিল। নিজের মধ্যে বিশ্লেষণ। কারো সঙ্গে কথা বলার কোন ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু তপনের সঙ্গে কে এই মেয়েটা তখুনি না জানলে চলছিল না। আমি যে কারো নিরালা মুহূর্তে থাবা বসাচ্ছি মাথাতেও আসেনি তখন। হু কেয়ারস। লোকের বাধা পেরিয়ে একদম ওদের মুখোমুখি এসে পড়লাম। কি রে তপন, নাটক দেখতে এসেছিলি না কি?
তপন দেখে বেশ খুশিই হল যেন। আরে প্রতীপ, কতদিন বাদে দেখা। কেমন আছিস?
প্রশ্নটা মেয়েটার কাছে নিজেকে জানান দেওয়ানোর জন্য একটা উপায় মনে করে গড়গড় করে জানিয়ে দিয়েছিলাম, সময় কোথায় পাই বল। পড়াশোনার বড় চাপ। হস্টেল ছেড়ে বাড়িতেও যাওয়া হয় না কতদিন। এই তো কোনমতে সময় বের করে চলে এসেছিলাম নাটক দেখতে। কিন্তু তুই কবে থেকে কলকাতায়?
মেয়েটার চোখে এইসময় খুশি ঝিলিক মারল। আমু সেরকম মেয়েই নয় যে পরিচয় করাবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। আগ বাড়িয়ে বলল, আপনি বুঝি হস্টেলে থাকেন? কি মজা না?
এই আমুদি, আপনি বলছিস কেন। প্রতীপ তো আমাদের ব্যাচের। যাদবপুরে পড়ে। তপনের এবার মনে হল আলাপ করিয়ে দেওয়া দরকার। এ হল আমার পিসতুতো দিদি অমৃতা, ওদের বাড়িতে এসেছি কদিন। আমুদি বলল চল, একটা নাটক দেখে আসি।
তপনের পিসতুতো দিদি শুনে আনন্দ হয়েছিল এই ভেবে যে ওদের হাত ধরা কোন প্রেম ভালোবাসার নয়। কেন এতো তাড়াতাড়ি এই রকমের একটা কথা আমার মাথায় এসেছিল কে জানে! প্রথম দেখাতেই একটা অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করেছিলাম নিশ্চিত। তবে দিদি শুনে একটু দমেও গেছিলাম। যদিও দিদিসুলভ চেহারা আমুর মোটেই নয়। ছটফটে দোয়েলের মত হাবভাব। বেশ পাতলা গড়ন, কোঁকড়া চুলে বেঁধে ফেলা মুখের ছাঁদ লম্বাটে। কিন্তু মুখটা কেমন আলাদা করে বোঝার উপায় থাকে না যখন বিন্দু বিন্দু হাসি শিশিরকনার মত নাকে, ঠোঁটে, গালে ছড়িয়ে থাকে।
(দোয়েল কথাটা মাথায় আচমকা আসেনি। তুহিনা খুব ভাল গান করতো, অসম্ভব সুরেলা গলা। গান শোনার বাহানায় ওর বাড়িতে পৌঁছে গেছিলাম কদিন বাদেই। তুহিনার বাড়িও চুঁচুড়ায়। সেদিন রবীন্দ্র ভবনে ওদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আর তার পরদিন তপনের বাড়ি বয়ে তুহিনার ঠিকানাটা নিয়ে আসি।
তপন একটু কিন্তু কিন্তু করছিল। দেখিস, আমার পিসির মেয়ে। এমন কিছু করে বসিস না।
আরে না, না গান শুনবো শুধু। শুনলাম খুব ভাল গান গায়।
এর দুইদিন বাদে আমি হাজির। সেরকম কিছু আহামরি বাড়ি নয়, অবস্থা বেশ খারাপই বলবো। তুহিনা আমাকে দেখে একটু অবাক হলেও, হাসিটা অমলিন। তপনের বন্ধু মা, সেদিন দেখা হল নাটক দেখতে গিয়ে। তুহিনার মা অচেনা একটা ছেলে এসেছে বলে যে খুব চমকে গেছিলেন সে রকমটা নয়। বারিন বলে আর একটা ছেলেও বসে ছিল। জানলাম তুহিনার সঙ্গে তবলা সঙ্গত করে, সকাল থেকে ওদের রেওয়াজ চলছিল এতক্ষণ। বারিন চলে যেতে তুহিনা এসে বসল একটা মোড়ায়, ওর মা একটা মামলেট আর চা নিয়ে এলো।
শাড়িতে হাত মুছতে মুছতে ওর মা বলল, সারাদিন এত দলবল আসে তুহিনার, আমি কিছুতেই নাম মনে রাখতে পারি না। কি যেন নাম বললে তোমার?)
আমু বলল, ও মা! তাই নাকি। জানিস তো আসছে সপ্তাহে আমি তোদের কলেজে গান গাইতে আসছি।
আমু পরে বলেছিল, না রে বাবা, এটা তোর সঙ্গে দেখা করার কোন প্রস্তাব ছিল না। তোদের কলেজের সুবীর বলে একটা ছেলে আমাদের কলেজ ফেস্টে এসেছিল আর আমাকে তখন থেকে পইপই করে বলতো যাদবপুরের অ্যানুয়াল ফেস্ট যেন আমি মিস না করি। তপন যেই বলল তুই যাদবপুরের, সেটাই তো মাথায় আসবে তাই না?
আমুর চোখের সাদাটা ছিল একদম স্বচ্ছ, তার মধ্যে কালো মনিটা এমন বিশ্বাসে চকচক করতো যে ওর কোন কথায় সন্দেহ করাটা অসম্ভব ছিল আমার জন্য। আমু যখনই কথা বলতো, ওর চোখ অন্যের চোখকে যেন নিজের দৃষ্টিতে বেঁধে নিত একেবারে। ছটফটে জাপটে ধরার মত করে নয়, আঙ্গুলে আঙ্গুল জড়িয়ে হাতের পিঠ দিয়ে একে অপরকে ছুঁয়ে থাকার মত। এই অন্তরঙ্গতা সবার সঙ্গে, এমন কি পথে যেতে কোন ভিখারির থালায় খুচরো পয়সা দিতে গিয়েও। একবার বলেছিলাম ওকে, তোমার যাওয়ার পথে এমনি থালা হাতে বসে থাকবো এবার থেকে। একথা শুনে আমুর সেই হাসি জুঁইফুলের মত ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। তুই বড্ড হিংসুটে তো, আমার সব হাসি খাঁচায় ভরে দিতে চাস। তারপরেই গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠেছিল, খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে, বনের পাখি ছিল বনে –আচ্ছা, তোর দাঁড়ে বসা পাখিকে দানা খাওয়াতে ভাল লাগে নাকি উঠোনে খাবার ছড়িয়ে যে আসে তাকেই?
কি বলতে চেয়েছিল আমু সেটা তখুনি স্পষ্ট বুঝিনি। কিংবা কখনোই বুঝিনি। পরবর্তীকালে স্পষ্ট করে এই কথাটার একটা মানে করে নিয়েছিলাম সেটা সত্যি। কিন্তু সেও তো অনেক পরের ব্যাপার।
প্রথম দেখা হওয়ার দিনে এসব কোন কথাই হয়নি। আমি বরং হামলে পড়ে বলে উঠেছিলাম, তাই নাকি? দারুন ব্যাপার! তপন, তুইও কি আছিস তখন? চলে আসিস না একসঙ্গে আমাদের ওখানে, বেশ আড্ডা দেওয়া যাবে।
না, আমি থাকবো না অতদিন। এই তো পরশু বাড়ি ফেরার কথা আছে।
শুনে কি খুশি যে হলাম! মুখে যদিও বলেছিলাম, যাহ্! কতদিন বাদে একটু দেখা হত। আমুর দিকে ফিরে বললাম, তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারি যদি জানাও কবে আসছো।
হাসিটা আবার ফুলঝুরির মত মুখকে রোশনাই করল। ও মা, তোদের কলেজের ফাংশান। আমার থেকে তোর তো বেশি জানার কথা। দেখে নিস একদিন সব কলেজের মধ্যে গানের কম্পিটিশান আছে, সেইটাই। কবে কখন সেটা আমার এই মুহূর্তে মনে নেই মোটেই।
পরের দিনই দিনক্ষণ সব জেনে নিয়েছিলাম। শুধু তাই নয়, জি এসের সঙ্গে কথা বলে গানের প্রোগ্রামে রেজিস্ট্রেশান কাউন্টারে বসার কাজ জুটিয়ে নিয়েছিলাম। কাউন্টারে ছিল আরেকজন খেয়ালিদি। শুরুতেই জিজ্ঞেস করল, তুই গানটান গাস?
জানতে লাগবে নাকি? আমি গান সেরকম বুঝি না। মনে মনে ভাবলাম, শুধু আমু আসছে বলেই না বডি ফেলেছি।
আরে না, না। গান গাইতে না জানাটা তোর কোয়ালিফিকেশান। আমি একটু সিওর হয়ে নিতে চাইছিলাম। গতবারও আমি এই কাজে ছিলাম। আমার সঙ্গে একটা ছেলে ছিল, বিতান। ভিতরে উঁকি মেরে দুজনের গান শুনেই ওর বুক চিতিয়ে উঠল। হাম কিসিসে কম নাহি। আম্মো গানা গায়েগা। নিজের নাম রেজিস্টার করে ফিল্ডে নেবে গেল। তারপর আমাকে পুরো একা সামলাতে হয়েছে। হাসিতে ভেঙ্গে পড়ল পিয়ালিদি।
আমার উদ্দেশ্যটা জানলে হাসি জ্বলবে না বুজবে কিনা জানিনা, কিন্তু আমি চেপে গেলাম। আমু এলে দেখা যাবে খন।
ছেলে মেয়েরা আসতে শুরু করেছিল। কলকাতার অনেক কলেজ থেকেই আসছে।সবার যে আগে থেকে নাম লেখান আছে তাও নয়। একটু ব্যাস্তই ছিলাম। সবার নাম ঠিকানা কলেজের নাম লিখে একেকটা নাম্বার লেখা ট্যাগ হাতে ধরিয়ে দেওয়া। ঘাড় গুঁজে লিখছিলাম এইসব, হঠাত অমৃতা রায় নামটা শুনে মুখ তুলে দেখি আমু। কমলা রঙ্গের একটা শান্তিনিকেতনী ব্যাগ কাঁধে, সবুজ শাড়িতে দাঁড়িয়ে আছে খেয়ালিদির সামনে। বুকের কাছে জড়ো করা হাতে একটা ডায়েরি। আমাকে দেখেই হাসিতে ছড়িয়ে পড়ল। আরে, সেদিন বললি কবে গানের কম্পিটিশান তার দিনক্ষণ জানিস না, আর নিজেই এখানে বসে আছিস? কি মিথ্যুক ছেলে রে বাবা!
আমু হাসলেই চারদিকে পাঁচশো ওয়াটের আলো। তার চ্ছটা চারপাশের লোকের উপরেও চলকে পড়ে। আমার উপরে অবশ্যই। আমু ভিতরে ঢুকে যাওয়ার পর সেটাই বলেছিল খেয়ালিদি। এইজন্যে এসে বসেছিস? তোর মুখটা যেমন চমকাল,কোন কেস আছে মনে হয়?
বুকে তখন দ্রিদিম দ্রিদিম। মুখে বলেছিলাম, ধ্যাৎ! কি যে বলো। আগে একবার দেখা হয়েছিল, ব্যাস।
হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি মনু। তুমি খেয়ালির চোখকে ফাঁকি দেবে অত বড় ডুব সাঁতারু এখনো হওনি। মন চাইলে লড়ে যা। তোকে পাত্তা দেবে কি না জানিনা, কিন্তু লজ্জা শরমের তোয়াক্কা না রেখে বডি ফেলে দে। বেশীর ভাগ রেজিস্ট্রেশান তো হয়ে গেছে, কম্পিটিশান শুরু হল বলে। তুই ভিতরে গিয়ে একটু লাইন মারার চেষ্টা কর, আমি এদিকের লাইন সামলাচ্ছি।
একা ছেড়ে চলে যাবো, তাই একটু বাধো বাধো লাগছিল। এই কথার পরে আর অপেক্ষা করিনি। ভিতরে বেশ ভিড়। একেবারে টইটম্বুর। অবশ্য এর মধ্যে অনেকেই প্রতিযোগী। বিচারক কাউকে চিনি না। একেকজন গাইবার আগে যেভাবে তাদের দিকে তাকিয়ে প্রনাম ঠুকছে, নামজাদা কেউ থাকতে পারে। আমার চোখ খুঁজছিল আমুকে। তিন নম্বর সারির একদম কোনায় খুঁজে পেতেই বুকটা ধক করে উঠছিল। একমনে গান শুনছে। কিংবা এভাবেই হয়তো ফোকাস করছে নিজেকে। মাথা নীচু করে সামনের সারিটা ক্রস করতে পারলেই আমুর কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়। কিন্তু এমন কিছু গা ঘেঁষাঘেঁষি আলাপতো নেই। দুম করে কথা বলতে গিয়ে ওর মনঃসংযোগ নষ্ট করে লাভ নেই। গান হয়ে গেলে না হয় একবার চেষ্টা করবো, এমনটাই ভাবছিলাম।
কেউ টানা তাকিয়ে থাকলে মেয়েরা ঠিক বুঝতে পারে। আমু হঠাৎ চমকে চোখ তুলে তাকাল। চোখ একদম সোজা আমার উপরে।চোখে প্রশ্ন। ভুরুটা ধনুক এঁকেই পরক্ষনেই সমান। কি করবো? হাসবো? মনে আছে থতমত খেয়ে নিজের বুড়ো আঙ্গুল উপরে তুলে থাম্বস আপ দেখিয়েছিলাম।
আমুর মুখ এবার হাসিতে ভরে গেল। হাসলে ওর চোখ দূর থেকেও হ্যাজাকবাতির মত চকচক করে।
আমু ওর হাত দেখাল, তর্জনী ঘুরিয়ে কিছু একটা বোঝাতে চাইছে। কি বলছে? এবার ঠোঁট সরু করে কি একটা নিঃশব্দে বলল। সেটাও মাথায় ঢুকল না। কিছু একটা বলতে চাইছে। যা থাকে কপালে ভেবে পিঠ বেঁকিয়ে ঘাড় নিচু করে সামনের সারির সকলের হই হই উপেক্ষা করতে করতে এক ছুটে তিন নম্বর সারিতে লাফ দিয়ে উঠে গেছিলাম সেদিন। ভাগ্যিস আমু একদম কোনায় বসেছে। পোডিয়ামে যেতে সুবিধা হবে বলেই বোধহয়। আমু হাসছিল। আমি হ্যা হ্যা করে হাঁফাচ্ছিলাম। আমু ওর বাঁ হাতের পাতা দিয়ে আমাকে নিচু হতে বলল। হলুদ রঙ্গের নেলপলিশ লাগানো আঙ্গুলগুলো যেন শিল্পীর একগোছা তুলি। মাথা নীচু করে কানটা একদম নিয়ে গেছিলাম আমুর মুখের কাছাকাছি। মুখ থেকে এলাচের হালকা গন্ধ। কি পারফিউম মেখেছিল কে জানে? মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করে উঠল। আমু ফিসফিস করে বলল, তুই কি গরু রে। তখন থেকে বলছি গানের পরে থাকিস, কথা বলবো!
শুধু তর্জনী দিয়ে কি করে এতগুলো কথা বলা যায় আমি জানতাম না। অন্তত এরকম সাঙ্কেতিক কথা বোঝার ক্ষমতা আমার ছিল না।। কিন্তু এটা বুঝেছিলাম সুখ বোধহয় এ রকমই হয়। এক অদ্ভূত আনন্দ বুকে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। একটু বাদেই অমৃতারায়ের নাম ডাকল। আমু গ্যালারি দিয়ে এক এক ধাপ করে নেবে আসছে, আমার চোখ ওর প্রতিটা পদক্ষেপ অনুসরণ করছে। তখনই কি আমি আমুকে ভালবাসতে শুরু করে দিয়েছিলাম? ভালবাসায় এতো কষ্ট! এতো আনন্দ!
আমু মঞ্চে এসে হাঁটু গেড়ে বসল। আলগোছে নমস্কার করে হারমোনিয়ামটা টেনে নিল। দাঁড়িয়ে আছো তুমি, আমার গানের ওপারে।
আমি আপ্লুত হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। গান শেষ হয়ে গেছিল, অথচ একটুও নড়তে পারি নি।আমু কখন নেবে এসে আমার জামার হাতা ধরে টান দিয়েছে। কি রে, কেমন?
ওকে দেখেই জিভে দুষ্টু সরস্বতী ভর করল। আমি গাইতে জানলে এখন কি গাইতাম বলো তো? ও চাঁদ, সামলে রেখো জ্যোৎস্নাকে।
তুই তো মহা ফাজিল ছোঁড়া! আমি গান কেমন হয়েছে জিজ্ঞেস করেছিলাম।
আমু চোখ পাকালেও কি ভাল যে লাগে! দমে না গিয়ে বললাম, ভুল কি বললাম আমু! তোমার সুর যে জ্যোৎস্নার মত অকৃপন ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।
আমু কিরে, আমুদি বল। তপনের দিদি হই না আমি? আমু ওর গভীর কালো চোখের ছায়া আমার মুখে ফেলে দাঁড়িয়েছিল।
যদি আমোদিনী বলি? দি আছে কিন্তু এর মধ্যে।
আমু খপ করে ওর ডান হাতে আমার কব্জিটা পাকড়াও করল। এই ছেলের মুখে তো একেবারে ফুলঝুরি দেখছি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিস নাকি লেখক রে তুই?
আমি লিখতাম তখনো, সেটা সত্যি। কিন্তু কলমে যেমন ঝর ঝরিয়ে বেরোতো, মুখে আমার মোটেই এমন বইত না। কেন কে জানে আমুর সামনে এসেই আমার মুখের তালাচাবি উধাও। যেন কতদিনের পরিচয়, কথা বলায় কোন অর্গল থাকছিল না। বললাম, কেন যে মেয়ে রাঁধে, সে কি চুল বাঁধে না?
চল তাহলে তোর লেখা শোনাবি।
আজ নয়, আরেকদিন। আজকে বরং তোমাকে কফি খাওয়াই আমাদের ক্যান্টিনে।
কিন্তু আরেকদিনের দেখা হওয়ার হিসেবটা পাকা হয়ে গেছিল ওই ভাবেই।
(তুহিনার সঙ্গেও একবার আমার কলেজ ক্যাম্পাসে দেখা হয়েছিল। কিন্তু ফেস্টের সময় নয়। এমনি আচমকা। আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে নেবে অরবিন্দ বিল্ডিংয়ের দিকে চলেছি তখন, হঠাৎ দেখি তুহিনা। কাঁধে একটা শান্তিনিকেতনী ব্যাগ, পরনে শাড়ি। একা হাঁটছিল, পাটা একটু টেনে টেনে। দেখেই চমকে উঠেছিলাম। এখানে এখন?
তপনের কাছ থেকে খবর নিয়ে সেই যে ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম অযাচিত ভাবে, তারপর আর দেখাও হয়নি। আমার মনে হয়েছিল আমি যে দুদিনের মধ্যে তুহিনার বাড়িতে পৌঁছে গেছিলাম সেটাই তো যথেষ্ট আমার উৎসাহটা জানান দেওয়ার জন্য। আমি ভেবেছিলাম তুহিনা এতেই গলে যাবে। কিন্তু তুহিনা এসব কিছুই করেনি। ঠিক একই রকম উচ্ছ্বলতায় আমার এবং বারীনের সঙ্গে কথা বলছিল। একই খুশির হাসি ছড়িয়ে পড়ছিল ওর চোখে মুখে। আমার মনে হচ্ছিল এখন ওর বাড়ির বেড়া ডিঙ্গিয়ে যদি একটা ছাগল ঢুকে যায় বাড়িতে, ঠিক এমনি সাদর হাসিতে শকুন্তলা সেজে তুহিনা ওকে কোলে তুলে নেবে।
আমার খুব হিংসা হচ্ছিল। এলাকায় আমার ভাল ছেলে বলে নাম ছিল। আমি কোনদিন এরকম আগ বাড়িয়ে কোন মেয়ের কাছে দৌড়ে যাইনি তো। কেন যেন মনে হয়েছিল, আমি যে গেছি সেটাই যথেষ্ট। অথচ তুহিনা সবাইকে যেমন হাসি বিলোয়, টুপটাপ ঝরে পড়া ওর কথাগুলো সবার জন্য সমান, যেমন ভোরের প্রথম আলো মন্দিরের চুড়ো অথবা ভাঙ্গা আটচালা নির্বিশেষে উজ্জ্বল করে তোলে। তুহিনা কোনভাবেই খারাপ ব্যবহার করেনি, কিন্তু আমার মনের নিরাশ ভাবটা ফুলতে ফুলতে এমন বড় হয়ে গেছিল, আমি হঠাৎ এই যাহ! একটা কাজ আছে যে আমার বলে উঠে চলে এসেছিলাম। আবার কোনদিন দেখা হওয়ার কোন সম্ভাবনা তৈরী না করেই। এরপর এমন একটা লজ্জা আমাকে গ্রাস করল, আমি নিশ্চিত হলাম তুহিনা আমার পিছনে হাসাহসি করেছে, হয়তো বলেছে অন্য কোন বন্ধুকে, রেগেই আছে আর কিছু না হোক। এরকম কোন প্রমাণ যদিও আমি পাইনি, এই ঘটনাই যে ঠিক ঘটেছে সেই বিষয়ে আমি কেমন নিশ্চিত হয়ে গেছিলাম। তাই ইচ্ছা থাকলেও আমার আর ওর বাড়িতে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
তুহিনাকে কলেজে দেখতে পেয়ে অযাচিতভাবে সেই ভুল শোধরাবার সুযোগটাই এসে গেছিল।
তুহিনাকে নিজের কলেজের ক্যাম্পাসে দেখে ভিতরটা ছটফট করে উঠল। আমাকে দেখে তুহিনাও খুশি হল। আরে, তুই এখানে?
আমার তো এখানেই থাকার কথা। বরং তোমাকে এখানে দেখে অবাক হয়ে গেছি তো।
তুহিনা একটু লজ্জা পেলো। সেটা আমি যে এখানে পড়ি এই কথাটা ভুলে যাওয়ার জন্যে নাও হতে পারে। আবার হতেও পারে। আসলে ওর পরের কথাটা বলার ভাবনাতেও লজ্জা পেয়ে থাকতে পারে। বলল, তুই সুবীরকে চিনিস?
কে সুবীর?
তোদের কলেজেই পড়ে, সুবীর তালুকদার।
এতো ছেলে পড়ে এখানে তুহিনা, কি করে বলবো। হস্টেলের ছেলে হলে তাও চেনার চান্স ছিল। কোন ডিপার্টমেন্টে?
হস্টেলেই তো, তোদের এখানে একটা নিউ ব্লক হস্টেল আছে না? সেটায়।
ও, তাহলে একটু হাঁটতে হবে। নিউ ব্লক পুরো কলেজ ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে গেলে তার পর। কে সুবীর, তোমার কেউ চেনা?
হ্যাঁ, চিনেছিলাম এক গানের অনুষ্ঠানে গিয়ে। কিছু একটা বলতে গিয়েও থমকে গেছিল তুহিনা। তারপর আবার একমুখ হেসে বলল, এই তোর দেরী হয়ে যাচ্ছে না ক্লাসের?
আরে, বাদ দাও। এরকম অনেক ক্লাস মিস হয়। চলো আমি তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি। আচ্ছা, তোমার পায়ে কি হয়েছে? হাঁটবে কি করে অতটা?
এবার প্রাণভরে হাসল তুহিনা। জানিস তো কি হয়েছে। যেই না বাস থেকে নামলাম, ফট করে চটিটা ছিঁড়ে গেল। একটা সেফটিপিনও নেই যে আটকে নেবো।
ও, তাই নাকি? তাহলে চুপ করে বোসো এই লাল চেয়ারে। আর চটিটা আমাকে দাও, সারিয়ে আনি আগে।
ধ্যাৎ, তুই আমার চটি কেন হাতে করে নিয়ে যাবি?
তাতে কি, এই তো গেটের বাইরে একটা মুচি বসে, আমি জানি।
তাহলে চল, আমিও যাচ্ছি।
সেদিন সুবীরের দেখা পাইনি। নিউ ব্লকে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেল সুবীর বলে ছেলেটা যাদবপুরে মাস্টার্স করছিল। এখন চাকরি নিয়ে মাদ্রাজ। ওর একটা ঠিকানা জোগাড় করে দিয়েছিলাম তুহিনাকে। তারপর বাসে তুলে দিলাম।
সেদিন চটি সারাতে দিয়ে এইট বি বাস স্টপে চা খেয়েছিলাম পাশাপাশি, চায়ের পরে সিগারেট ধরাতেই খপ করে আমার হাত ধরেছিল তুহিনা। অ্যাই, সিগারেট খাস কেন রে? দে, ফেলে দে। ফেলে দিয়েছিলাম। একটু বাদে ভিড় রাস্তা পার হওয়ার সময় ওর ডান হাতের মণিবন্ধ ছিল আমার মুঠোয়।
শুধু সুবীর বলে ছেলেটাকে খুঁজতে এতদূর কেন এসেছিল জিজ্ঞাসা করিনি। বরং সুবীরকে পাওয়া যায়নি বলে, এক অজানা কারনে আমার মনটা খুশি খুশি হয়ে উঠেছিল। লোকের ভারে ধুঁকতে ধুঁকতে ১৭ বি বাসটা যখন আসছে, তুহিনা আমাকে বলেছিল অ্যাই আমাকে দিদি বলিস না কেন রে? আমি তপনের দিদি না?
উত্তরটা পরের দিনের জন্য জমা থাকুক।
পাদানিতে দাঁড়িয়ে সেদিনের শেষ হাসিটা ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিল, বাড়ি এলে আমাদের ওখান থেকে ঘুরে যাস একবার।
(আরেকবার দেখা করার ব্যবস্থাটা এইভাবে পাকা হয়েছিল।)
আমুকে শোনাব বলে একটা নতুন লেখাই ফেঁদে ফেলেছিলাম। কবিতা, আমোদিনীর সঙ্গে জ্যোৎস্না যাপন।
যথা সময়ে লেখার দুপাতা পকেটে পুরে আমুর বাড়িতে উপস্থিত। সত্যি বলতে একটা প্রবল উত্তেজনায় দুপুরের খাবারটাও ভাল করে খেতে পারিনি। আমুদের বাড়ি পদ্মপুকুরে, পুরোন বাড়ি। হয়তো অনেক শরিকের। কিন্তু আমি দমে গেলাম যখন গিয়ে দেখলাম ঘরে আরো চার পাঁচটা ছেলেমেয়ে হইচই করছে।
এই দ্যাখ, আমার এক নতুন ভাই। তপনকে দেখেছিলি তো? ওর ছোটবেলার বন্ধু। প্রতীপ। ইঞ্জিনীয়ার, আবার লেখালেখিও করে।
আরেব্বাস তাই নাকি? একটা চশমা পড়া মেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। কি লেখো ভাই?
ভাই ভাই শুনে আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল। এখন যে মেয়েটা বলল, বেশ ছোটখাটো চেহারার। দেখে মনেও হচ্ছিল না আমার থেকে বড় বলে। তপনের বন্ধু বলে ভেবেছে মফস্বলের ছেলে, মুরগী করি। ফস করে বললাম, প্রেমপত্র।
ঘরে হাসির রোল উঠল। একটা ছেলে কাত হয়ে বিছানায় শুয়েছিল। উরি শালা, তুই তো মহা ঘাঘু রে। তোর কটা প্রেমিকা?
বেশ একটা জ্যুতসই জবাব দেওয়ার খুশি গলায় নিয়ে বললাম, আমার প্রেমিকার জন্য না। আমি যা লিখি, অন্যেরা প্রেমপত্র বলে চালায়।
পারি না! শোনা, শোনা। আমি আমুকে প্রেম নিবেদন করবো বলে কবে থেকে ভাবছি, খাপচু করে একটা ভালোবাসার চিঠি লিখতে পারছি না বলে কেঁচে যাচ্ছে। ছেলেটার পরনে জিনস আর পাঞ্জাবি, উঠে দাঁড়ালে দেখলাম আমার মাথায় মাথায়। যত রকমে পারছিলাম মেপে নিয়েছিলাম নাম জানবার আগেই। ইয়ার্কি মারছে নাকি সত্যিই ও আমুর প্রেমিক? আমুর মুখের দিকে তাকালাম, কোন হেলদোল নেই।
তাহলে ভেবে দেখতে হবে। খুব গম্ভীরমুখে বললাম।
খুব হাসির রোলের মধ্যে বসার জায়গা পেলাম। সবার সঙ্গে চটপট আলাপও হয়ে গেল। অনিন্দ্য, সুশ্যামল, অতীন্দ্র, নয়নিকা, পুতুল। ভালই ছেলে মেয়েগুলো। মোটা গোঁফের সুশ্যামল একটু গম্ভীর টাইপ। বয়সেও বোধহয় একটু বড়। অনিন্দ্যটা ছ্যাবলা টাইপ, কথা বলতে বলতে নিশ্চিন্ত হলাম ওর সঙ্গে আমুর প্রেম হতেই পারে না। এদের কেউ আমুর সঙ্গে গান গায়, কেউ ওর কলেজের বন্ধু। এইসব।
গল্প করলেও আমি পকেটের লেখা বের করলাম না। আমু একবার জিজ্ঞেস করেছিল, আমি বললাম এই যাহ্! লেখাটা আনতেই ভুলে গেছি। তখনকার দিনে তো আর মোবাইল ফোন ছিল না, সব কিছু হাতে লেখা। চা মুড়ি খাওয়ার পরে বন্ধুরা একে একে চলে যাওয়ার পর আমু বলল, ধুর তোর সঙ্গে আর কথা বলবো না।
শুনেই বুকটা কেমন ধক করে উঠল, কেউ যেন সযত্নে রাখা প্রদীপের সলতেতে ফুঁ দিয়ে দিল একেবারে। কেন আমু কেন?
কথা দিয়ে কথা রাখিস না মোটে। আমুর চোখ মায়াক্লিষ্ট, একেবারে বুকের ভিতরটা অবধি পড়া যায়। ও যদি বলে আমার লেখা শুনবে বলে বসেছিল, সেটা শতকরা একশো ভাগ সত্যি। মাত্র দুদিন আলাপেই, আমি সে ব্যাপারে কেমন একটা নিশ্চিত হয়ে গেছিলাম। তাই ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি বুক পকেট থেকে ফুলস্কেপ কাগজটা টেনে বের করলাম। এই যে, বান্দা হাজির। কবিতাটার নাম কি জানো? আমোদিনীর সঙ্গে জ্যোৎস্নাযাপন।
আমুর মুখে সঙ্গে সঙ্গে একশোটা ঝাড়বাতি। তারপর ধীরে ধীরে বলল, যারা কথা রাখে না, আমি তাদের বিশ্বাস করতে পারি না আর। মনে থাকবে তো প্রতীপ?
আমু হাঁটুতে কনুই রেখে দুই হাতের আঙ্গুলে আঙ্গুল জুড়ে তার উপরে থুতনি ভাসিয়ে আমার দিকে চেয়েছিল, আমি পড়ব বলে। হাতে কাগজ ধরা থাকলেও, আমার তো মুখস্ত হয়ে গেছিল লেখাটা। আমুর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে আমি পড়ছিলাম।
জোনাকি আর চাঁদের সঙ্গম হলে
নাকি মুক্তোপাত হয় !
ডানাকাটা পরীরা
ঘুরে বেড়ায় মসৃণ জ্যোৎস্নায়-
সোনা-রঙ নৌকোর মেঘ
ভেসে আসে, আলোর নদীর স্রোতে;
রূপ-টানে মুছে যায় ক্লেদ ।
শান্ত হাওয়া,
স্তব্ধ সন্ধ্যার নীল চোখে,
তিরতির ঢেউ,
স্বপ্নে পায়, প্রেরণার ভাষা।
হাওয়া ওড়ে…
হাওয়া ওড়ে…
দুঃখ ছিঁড়ে উঠে আসে মানুষ,
মৃত্যু ফিরে যায় ।
সেই আলো,
সেই ঢেউ,
এখনও দেখিনি আমি।
তবে, যেদিন তুমি
আমার ভাঙ্গা ঘরের বারান্দায়
প্রথম রাখবে পুষ্পের পা –
সেদিন ওমনি জ্যোৎস্না হবে,
আমোদিনী।
আমুর সঙ্গে সেদিন নিয়ে মোটে তিনবারের দেখা। কিন্তু প্রথমবার দেখা হওয়ার পর থেকেই কি এক অমোঘ আকর্ষণে আমি ছুটে যাচ্ছিলাম। কতটুকুই বা চিনি? অথচ দ্বিতীয়বার দেখা হওয়ার পর আমি নিশ্চিত হয়ে গেছিলাম আমার চাওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু আমু?
কবিতাটা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও কিছুটা সময় আমু কোন কথা বলেনি। পলকহীন তাকিয়েছিল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বলেছিল, আমি তপনের থেকে দুই বছরের বড়। জানিস তো সেটা?
আমার বাবা আমার মায়ের থেকে দশ বছরের বড়। ওদের দুজনের প্রেম দেখলে তুমি চমকে যাবে।
ধ্যাৎ! বলে এবার খিলখিল করে হেসেছিল আমু। তারপর বলল, তুই ছেলেটা খুব পাজী, কথার প্যাঁচ জানিস খুব।
কথা বেচেই খাস এখনো? আমু নিজের হাতের বইটা মুড়ে পাশের চেয়ারটায় রেখে বলল।
এয়ার পোর্টে দেখা হতে খুব অবাক চোখে কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে এই কথাটাই প্রথম বলেছিল আমু।
সেটা পুরোপুরি সত্যি নয়। মানে এর আগে আরও দুই একটা শব্দ এসে থাকবে, কিন্তু এটাই প্রথম কানে আটকে থাকার মত শব্দমালা। আমু চলে যাবার পরেও কানের লতিতে আটকে ছিল।
(তুহিনার সঙ্গে পরের বার দেখা হয়েছিল চুঁচুড়ার ডাচ গোরস্তানে। ওকে নিয়ে কবিতা লিখিনি কোন, আমি আদৌ কবিতা লিখিই না। এই কবিতাটি কবি উদ্দালক ভরদ্বাজের, গল্পের প্রয়োজনে ধার নেওয়া। গোরস্তানে দেখা করার কারণটাও নেহাতই গদ্যময়। কারো চোখে পড়তে চাইনি। ওর বাড়িটাও অ্যাভয়েড করেছিলাম। আর কে কে ঘর আলো করে থাকবে জানা ছিল না তো। সন্ধ্যা নেবে আসছিল, শঙ্কু আকৃতির প্রাচীন কবর স্মারকগুলো ঘনায়মান অন্ধকারে মানুষ মানুষ ভাব নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। জানতাম জ্যান্ত মানুষ ওই সময়ে ওখানে আসবে না কেউ।
কিন্তু ওখানে দেখা করতে চাওয়ার আর একটা কারন ছিল। কোন মেয়ে কেন আসবে ওরকম একটা জায়গায় যার তার সঙ্গে, অন্তত আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে? দেখতে গেলে আমার পদক্ষেপগুলো বেশ হিসেবীই ছিল।)
আমি আমুকে দূর থেকে দেখেই ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। মোবাইলে কারো সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাসছিল, আলগোছে ডান হাতের আঙ্গুলগুলো ছড়িয়ে গেছিল ঠোঁটের সামনে। নারকেল গাছের পাতা যেমন চাঁদের জ্যোতস্না আটকাতে পারে না, ওর হাসিও তেমনি আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে চলকে বেরোচ্ছিল। ফোনটা কানের থেকে সরাতেই এক পা এগিয়ে ওর সামনে এলাম। আমু!
চোখ তুলে চেয়ে ভুরুটা উপরে তুলে আমাকে দেখতে দেখতে বলেছিল, আরে প্রতীপ! তারপর হাসতে হাসতে বলেছিল, কথা বেচেই খাস এখনো?
ভাবলাম আমার লেখা পড়েছে বুঝি আমু।হাসিটা নিজের অজান্তেই স্মিত হয়ে গেল, বাংলায় গল্প লিখে কেউ খেতে পারে নাকি?
ও তাই নাকি? তুই এখনো লিখিস? খুব একটা বিরতির পর বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ তোর গল্প কোথাও দেখেছি বটে। আমুর হাসিতে বয়সের কুয়াশা ঘিরে ধরতে পারেনি। কিন্তু চোখের কৌতুক অভিজ্ঞতায় ধারাল হয়েছে। আগে ওর কথাগুলো ঝরঝরিয়ে বেরোতো। এখন অনেক মেপে। কবিরা বয়েস বাড়লে গদ্যকার হয়ে যায়, নারে? এটা কোন উত্তরের অপেক্ষায় করা প্রশ্ন নয়। কারন তারপরেই বলল, আমি ভেবেছিলাম তুই বোধহয় কোথাও মার্কেটিং জবে আছিস, ধরাচুড়ো দেখে ও রকম মনে হচ্ছিল।
সেটাও ভুল নয়। ক্লায়েন্টের অফিসে ঢুঁ মেরে বাড়ি ফিরছি। বসি এখানে?
বসে ল্যাপটপ ব্যাগটা চেয়ারের পাশে ঝুলিয়ে বললাম, আমি লিখতাম, এখনো লিখি। তুমি গান করতে এতো ভাল। এখন?
খুব একচোট হাসল আমু। বেশ আড়ম্বর করে, এতোটাই যে সত্যি না নকল তাই নিয়ে সন্দেহ হতে পারে। এমনি লোকের হবে না, কিন্তু যে একবার ঝর্নার জল খেয়েছে, বোতলের জলের সঙ্গে পার্থক্যটা চট করে বুঝে ফেলে। হাসলে আমু এখনো ঠোঁটের সামনে আঙ্গুলগুলো ময়ূরের পেখম মেলার মত মেলে ধরে। মুখ থেকে হাসিটা মুছে নেওয়ার ভঙ্গিতে আঙ্গুল সরিয়ে বলল, মনে আছে তুই আমাকে ইম্প্রেস করার জন্য কিরকম রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভক্ত সেজেছিলি।
ভক্ত কেন সাজবো? কোন বাঙ্গালির ছেলেমেয়ে ছোটবেলা থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনেনি? হ্যাঁ, তোমার গান শুনতে শুনতে হয়তো উৎসাহটা বেড়ে গিয়েছিল।
কিন্তু এখন তো আর শুনিস না, তাই না? এমন ভাবে বলল যেন ‘ঠিক জানি’ এই শব্দজোড়া না বলেও স্পষ্ট শোনা গেল ওর উচ্চারণে।
মেনে নিতে হল। খুব কম শোনা হয়। শুধু বাইরে আছি বলে নয়, হয়তো আমুই ঠিক। আমি রবিঠাকুরের গানের সেরকম ভক্ত ছিলাম না। আমুর সঙ্গে পরিচয়ের দিনগুলোতে হয়তো একটু বেশি বেশি ঝুঁকে পড়েছিলাম। তুমি কি গুনতে জানো? এমন ভাবে বলছ না! পুরোপুরি মেনে নিলে যেন নিজেকে মেকি বলে মেনে নেওয়া হবে।
নারে আমি ওরকমভাবে মনের কথা পড়তে পারি না। কবি লেখক এদের অনেক বেশি ইনসাইট থাকে এসব ব্যাপারে। আবার হেসেছিল আমু। কিন্তু এই হাসি যেন শুধুই কোন চোরাগোপ্তা হামলার মোড়ক। কতকাল আগে বলা ওর কথাগুলো কানে ঝনঝন করে উঠেছিল, কেন তুই কি আমার মনের কথা পড়ে রেখেছিলি? আমি তো কোনদিন সেরকম কিছু বলিনি।
আমি রাগে অভিমানে বাঁশপাতার মত কাঁপছিলাম সেদিন। আমার দুই হাতে শক্ত করে ওর দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকাচ্ছিলাম। সত্যি করে বলো আমু, তুমি কি আমাকে ভালোবাসনি, পুরোটাই আমার মনের ভুল?
সারাদিন এতো ধকল গেছে, খুব টায়ার্ড লাগছে রে। ওর ডান হাত দিয়ে আমার হাত ওর কাঁধের উপর থেকে সরিয়ে দিল। গলায় সত্যিই একরাশ ক্লান্তি ছড়িয়ে পড়ছিল আমুর। কেমন একটা শারীরিক দূরত্ব তৈরী করে ফেলছিল, যদিও এমনিতেই আমার থেকে দুই ফুট দূরেই দাঁড়িয়ে, তবু আলাদা করে সেই চেষ্টাটা বোঝা যায়। আমার মনে হচ্ছিল ও যেন আমার হাত থেকে পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে। এমন জায়গায় চলে যাচ্ছে, আর কোনদিন ছুঁতে পারবো না। আমার বুকের মধ্যে একটা ডুবন্ত মানুষের অনুভূতি হচ্ছিল। আমার গলায় সেই ছটফটানিটা ছিল। আমি জানতে চাই আমু, প্লিজ।
এখনো কতটা ফিরতে হবে বলতো? মা খুব চিন্তা করবে, এসব কথা পরেও হতে পারে।
আমুর মাকে যতটুকু জানতাম সত্যিই অত চিন্তা করবে বলে মনে হয়নি আমার। একদিন চায়ে চুমুক দিতে দিতে ওনাকে বলেছিলাম, আমু সারাদিন টইটই করে ঘোরে আপনার চিন্তা হয় না?
আমুর মা বেশ অবাক হয়ে তাকিয়েছিল আমার দিকে, কিন্তু মুখে কিছুই বলেনি। উত্তর না পেলে কথা হাওয়া ছাড়া বেলুনের মত চুপসে যায়, আমি সেই বেলুনে হাওয়া ভরার আপ্রান চেষ্টা করতে করতে বলেছিলাম, মানে এত রকমের ছেলে মেয়ে আসা যাওয়া করে আমুর কাছে।
তুমিও তো আসো, বারন করবো?
হেসেছিলেন উনি, কিন্তু আমুর হাসির মত আলো জ্বালানো হাসি ছিল না সেটা।
তাই জানতাম ওরা মা মোটেই চিন্তা করছেন না। তবে অনেকটা দূরেই গেছিলাম সেদিন। আমুর গানের প্রোগ্রাম ছিল সল্ট লেকে, সেখান থেকে আমাদের কলকাতায় ফিরতে এক দেড় ঘণ্টা লাগে। আমি তখন ওর সঙ্গে এরকম অনেক গানের প্রোগ্রামে যেতাম।
আমি তখনো ছাড়তে রাজি ছিলাম না। আমি তাহলে তোমার সঙ্গে কেন সব জায়গায় যাই, কেন আসি যেখানে তোমার গানের প্রোগ্রাম হয় সেখানেই?
পুরো চোখ মেলে তাকিয়েছিল আমু। আচ্ছা, কি বোকা ছেলে রে। তুই কেন আসিস, আমি কি করে জানব? তুই আসতে চেয়েছিস, আমি না করিনি।
ও, আমার আসা না আসায় তোমার কিছু যায় আসত না?
আমি কি একবারও সেই কথা বলেছি? আমি জোর করে ধরে আনিনি সেটাই বললাম শুধু। একটু থেমে বলেছিল, এখন এখানে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো না বললেই কি নয়?
মনের মধ্যে একটা নিষ্ফল আক্রোশ তৈরী হচ্ছিল। মনে হচ্ছে আমাকে যেন ব্যবহার করা হয়েছে। আমুর কথাটাও পুরোপুরি মিথ্যে ছিল না। ও তো কোনদিন আমাকে ওর সঙ্গে আসতে বলেনি। আমিই বরং বলেছিলাম, এত দূরে দূরে একা যাও গানের অনুষ্ঠান থাকলে, ফিরতে রাত হয়। আমি থাকবো সঙ্গে।
আমু খিলখিল করে হেসেছিল বরং। আমি বুঝি একা চলতে ভয় পাই? রাত্রে আমার জন্য পাহারাদার লাগে?
তুমি ভয় পাও বলিনি তো। আমি ভয় পাই। কোথায় কখন কি হয়, চিন্তা হয়।
পুরো চোখ মেলে তাকিয়েছিল আমু। কিছুক্ষণ পলক পড়েনি। তারপর বলল, ভয় পাওয়াটা একটা অসুখ। আমার বাবা বলে। আমার সঙ্গে যাবি, আমার কিসের আপত্তি, কিন্তু বুকে ভয় নিয়ে যাস না।
সেই রাত্রে আমুর সামনে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো মনে পড়ছিল, আর আমুর প্রতিটা কথা জুড়ে জুড়ে একটা ধরি মাছ না ছুঁই পানি ভাব আবিষ্কার করছিলাম। আমি রেগে বলে উঠেছিলাম, এখন আমাকে আর পছন্দ হচ্ছে না, তাই গুটি কেটে বেরোতে চাইছ।
লার্ভার জন্য গুটি লাগে প্রতীপ, তবু সেও কেটে বেরিয়ে যায় একসময়। তখন কি করবি? সেই প্রজাপতিটাকে আবার গুটিতে আটকে রাখবি বুঝি? তারপর কিছুই হয়নি ভাব টেনে বলল, তুই থাকবি আরও, না বেরোবি?
যাও না, তোমার ওই সুব্রতবাবুর সঙ্গে চলে যাও। আমি পরে যাবো।
দেখি সুব্রতদা এখনো আছে কিনা, বারবার বলেছিল ওর গাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কথা। বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় নি আমু, কাঁধের ব্যাগটা সামনে টেনে, বেড়িয়ে গেল আমাকে ওখানে বসিয়ে রেখে।
এই সুব্রতকে নিয়েই আসলে সেদিন আমাদের ঝগড়াটা শুরু হয়েছিল। তার আগের গানের আসরেও দেখেছিলাম ওনাকে। অনেকটা বড় আমাদের থেকে। দুদিনই গানের পরে খুব হেসে হেসে কথা হচ্ছিল দুজনের। আমু বলেছিল, ওর নাকি অনেকদিনের চেনা।
ওকি তোমাকে ফলো করছে? আগের দিনও দেখলাম।
তখনো আমুর হাসিতে ক্লান্তি ছুঁতে পারেনি। দুলে দুলে হেসে উঠল, ঠিক ওই কথাটাই সুব্রতদা জিজ্ঞেস করছিল। এই প্রতীপ ছেলেটা কে? তোমার সঙ্গে রোজ দেখছি কেন? কাকে কি বলি বলতো?
আমার মাথাটা ঝন করে উঠেছিল। আমার মনের কথাগুলো সরলরেখা ধরে দৌড়াচ্ছিল। আমি আর এই সুব্রত কি এক? আমাকে যদি ও ভালোই না বাসে, তাহলে আমাকে কেন এমন নাকে দড়ি ধরে ঘোরাচ্ছে? একটা হিংস্রতা আমার শরীরের অধিকার নিচ্ছিল। আমার হাত দুটো শক্ত হয়ে চেপে বসছিল আমুর দুই কাঁধে।
(তুহিনা বলেছিল, না না আলোগুলো বুঁজিয়ে দে প্লিজ।
পট করে আলো নিভিয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরলাম। বাইরে পৃথিবী জ্যোৎস্না আলোয় ভেসে যাচ্ছিল, জানালার ফাঁকফোকর গলে আসা আলোতে দেখলাম তুহিনা চোখ দুটো বুঁজে ফেলেছে লজ্জায়, আমি ঠোঁট ওর ঠোঁটের কাছে নামাতেই ওর ডান হাতটা দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরল। ফিসফিস করে বলল, জানালার পর্দাটা ভাল করে টেনে দাও, তারপর।
জানালার ভারি পর্দা টানতেই ঘরের মধ্যে মিশমিশে অন্ধকার। ফিরতেই তুহিনা আমার বুকে মাথা রেখে বলল, আমাকে ভালোবাসো?
এক ঝটকায় ওকে কোলে তুলে নিয়েই মনে হল যেন একটা পালকের শরীর। ওর কাঁধে দুই একবার হাত রেখেছি, একবার কোমরে। কিন্তু কখনো এর বেশি কাছে আসতে দেয়নি এর আগে। সেদিন এক এক করে সব পোশাক খুলে আমার সঙ্গে মিশে যেতে চাইছিল তুহিনা। নিজে আমার মাথা ধরে টেনে নিল বুকের উপরে।
কতদিন এই সময়টার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছি। কিন্তু মনে আছে তুহিনাকে জড়িয়ে ধরে কিরকম বিপরীত একটা অনুভূতি হল। হঠাৎ। সেদিন।
কেন?
সে কি এত সহজে ও আমার হয়ে গেল বলে? আগে মনে হচ্ছিল আমি ওর পিছনে ঘুরছি, ও অলভ্য। সে রাতে হঠাৎ মনে হল যেন আমাকে পাওয়ার জন্য মেয়েটা নিজেকে বাজি রেখে ফেলেছে। এমনটাও মনে হল আমি যেন প্রথম নই, সুবীরদার সঙ্গেও এমন হয়ে থাকতে পারে।
আমি কি ভয় পেয়ে গেলাম যে এবার এই মেয়েটির সব দায়িত্ব আমার, শুধু ওর না হয়তো ওদের বাড়ির সবার? ওর মার বানানো মামলেটের কাঁচা সরষের তেলের গন্ধটা ধক করে নাকে এসে লাগল। আমার দুই হাতের মধ্যে ওর শরীরটা কেমন পলকা মনে হল, ওর পায়রার মত ছোট ছোট বুক, শীর্ণ বাহু যেদিকে এতদিন আমার চোখও যায়নি হঠাৎ কেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল। ঠিক ওই সময়ে আলাদা আলাদা করে এইসব ভেবেছিলাম না পরের কটা দিন এসব মাথায় ঘুরছিল, মনে নেই। কিন্তু সেই অন্তরঙ্গ মুহূর্তে তুহিনার ঠোঁট আমার ঠোঁটের মধ্যে নিয়েও আমার মনে একটা তুল্যমূল্য বিচার শুরু হয়ে গেছিল। আমি জানি সেরকম কিছু একটা হচ্ছিল, কারন শরীর থেকে এক লহমায় সব কামনা উধাও হয়ে যেতো না তা না হলে।)
সেদিনের পর আমার সঙ্গে আর দেখা হয়নি আমুর। বেশ কয়েকবার আমি ওর বাড়ি গেছি। কিন্তু ওর মার সঙ্গে কথা বলেই চলে আসতে হয়েছিল, আমুকে একদিনও বাড়িতে পেলাম না। ওর মা বলল, আগে থেকে ফোন করে এসো এরপর থেকে। তাহলে এরকম হেনস্থা হবে না।
(আমি তুহিনার কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। তুহিনা আমাকে চিঠি লিখেছিল, খামটা এতো ভারি ছিল যে খুলেও দেখিনি ভয়ে। একদিন হস্টেলে ঘরে শুয়ে আছি, আমার কাছে খবর এলো কেউ এসেছে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য। সিঁড়ি দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম তুহিনা বসে আছে আমাদের ওয়েটিং রুমের হাতলের রেক্সিন ছেঁড়া খয়েরী সোফাটায়। পরনে বাসন্তী রঙের শাড়ি, লম্বা হাতা ব্লাউজ। সিঁড়ির উপর থেকে আমি ওর মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না, শুধু শরীর। তাও একটা অদ্ভূত অ্যাঙ্গেল থেকে। কি শীর্ণ লাগছিল ওকে। এরকমই ছিল, নাকি আমার সঙ্গে দেখা করতে পারছে না বলে। আমি ভয়ে দৌড়ে আবার নিজের ঘরে চলে গেলাম। যে বন্ধু খবর নিয়ে এসেছিল ওকে আবার পাঠালাম খবর দিতে যে আমি হস্টেলে নেই। সুজন আমার দিকে অবাক চোখে তাকাল, কি কেস গুরু? কাটিয়ে দিচ্ছিস নাকি?
আমি কোন উত্তর দিতে পারিনি। আমার হস্টেলের মেয়াদ শেষ হয়ে আসছিল এমনিতেই। চাকরি নিয়ে অন্য শহরে চলে গিয়েছিলাম দুমাস বাদেই। কিভাবে আমার ঠিকানা পেয়েছিল জানি না, আমাকে একটা নিউ ইয়ার্স গ্রীটিংস পাঠিয়েছিল আমার নতুন ঠিকানায়। তাতে শুধুই লেখা ছিল, নতুন বছরে নতুন জীবনে ভাল থাকিস।
আর কোনদিন কোন খবর নেয় নি, আমিও। অনেকদিন ধরে মনে একটা ভয় ছিল তপন আমাকে যদি চেপে ধরে, অ্যাই আমার দিদির সঙ্গে কি করেছিলি তুই? মানুষের মন কি অদ্ভুত। বহু বছর পরে মনে হয়েছে সেরকম হলেই বুঝি ভাল হত।)
আমুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল, আবার হচ্ছিলও না। কেমন হোঁচট খেয়ে খেয়ে এগোচ্ছিল। আমি বেশ কিছু কথা বলবো বলবো করেও আটকে যাচ্ছিলাম, আর আমু কিছু কথা বলবে না বলে হাসির মোড়ক পরাচ্ছিল। অনেকটা কবাডি খেলার মত, চুঁ বলে ধাওয়া দিয়েছি কিন্তু কোর্টে একা হয়ে গেলে দুদিকেই একটা নিরাপদ দূরত্ব তৈরী করার প্রবণতা হয়। সেরকম। এই করতে করতেই সময় পেরিয়ে গেল।
আমুর ফ্লাইট আমার আগে, গেটের দিকে উঠে গেল। অনেক কথা হবে তোর সঙ্গে পরে, কি ভাল হলো বল তোর সঙ্গে দেখা হয়ে! ঝকঝকে হাসি ফুলের তোড়ার মত বাড়িয়ে দিয়েছিল আমার দিকে।
আমু চলে যাওয়ার পরে খেয়াল করলাম, আমার বিজনেস কার্ডটা চেয়ারের পাশের ছোট টুলটায় ফেলে গেছে। এমা! ভুলে গেল? আমিই ওর নাম্বারটা চেয়েছিলাম। আমু বলেছিল, এই তো বিজনেস কার্ডে তোর নাম্বার আছে। আমি মিসড কল দিলেই আমার নাম্বারটা পেয়ে যাবি। কথায় কথায় ও মিসড কল দেয়নি, আমিও ভুলে গেছিলাম। এখন কি হবে?
তখনই মনে পড়ল আমু একবারও জিজ্ঞেস করেনি আমার বাড়ি কোন শহরে। ও যাচ্ছে ডালাসে, কে জানে ওটাই ওর শহর কিনা। একবারও জানতে চায়নি আমার জীবনের কথা। অথচ যাওয়ার আগে কেমন ভাবে বলল-
আমুর ছেড়ে যাওয়া খোলস নিয়ে বসে রইলাম। আমার ফ্লাইটের ডাক আসা পর্যন্ত।
(তুহিনার সঙ্গে বিদায়টা একটু অন্যরকমের হয়েছিল। কিংবা একই। বাস্তব জীবন আর গল্পের জীবন তো হুবহু এক হয় না।
আমি ওর গানের স্কুলের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে আসতে আবার ফিরে গেছিলাম। তখন তুহিনা আর একজন লোকের সঙ্গে কথা বলছিল, বোধহয় কোন ছাত্রীর মা। উফ, কথা যেন শেষই হয় না। মুখে সেই হাসি, যেমন অকাতরে বিলানোর অভ্যেস তুহিনার। আমি টগবগে ঘোড়ার মত অধৈর্য হয়ে উঠছিলাম।
ওই ভদ্রমহিলা যেতেই তুহিনার সামনে হাজির হলাম। ওকে খুব অবাক হতে দেখলাম না। যেন আমি ফিরে আসব সেটা জানাই ছিল। দেখে আমি আরো রেগে ফেটে পড়লাম। তোমার কোন অনুযোগ নেই? দুঃখ? অন্তত রাগ করতে পারতে?
খুব অবাক হয়ে তাকিয়েছিল তুহিনা। কেন?
আমার সঙ্গে কি অভিনয় করছো তুমি? কেন তুমি জানো না?
খুব ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল তুহিনা। সবার উপরে চাইলেও কি রাগ দেখানো যায় বল?
ব্যাস! এই টুকুই।
এই টুকুই শুধু।
পেশায় ইঞ্জিনীয়ার, নেশায় লেখক। প্রধানত গল্পকার, কিছু নাটকও মঞ্চস্থ হয়েছে। গল্প প্রকাশিত হয়েছে দেশ, বর্তমান, সানন্দা, কথা সোপান, দূকুল, পরিচয়, বাতায়ন এবং আরও পত্রপত্রিকায়। নাটক ‘রণাঙ্গন’ এবং ‘ঘুঘুডাঙ্গা’ বেশ কয়েকবার মঞ্চস্থ হয়েছে। উত্তর অ্যামেরিকার কবি ও সাহিত্যিকদের সম্মেলন কথামালা পরিচালনা করেছেন ২০১৮-তে। থাকেন অ্যান আরবার, মিশিগান।