৫
হঠাৎই আবহাওয়াটা কেমন বদলে গেল। ভোরবেলা শীত শীত করে। মা ফ্যান বন্ধ করে দেয়। চাদর চাপা দিয়ে দেয়। পুজো আসছে। এবারে আমার নতুন পোশাক পরতে নেই। বাবা মারা গেছে।
তবুও প্রতিবাদের সুরে বলি – স্কুলে যে নতুন ড্রেস পরে গেলাম?
মা বলে–ওঠা নিয়ম। স্কুলে তো ইউনিফর্ম পরে যেতে হবেই।
আমার বন্ধুরা রোজ বিকেলে সুন্দর রঙিন পোশাক পরে আসে। সঞ্জনা, ডলি, রাইমা, অমিতারা এখন ফ্রক ছেড়ে চুড়িদার পরে। ওদের খুব সুন্দর দেখতে লাগে। আমি বুঝি এবার আমরা শৈশব ছাড়িয়ে কৈশোরে পড়ছি।
সত্যিই আমাদের চেহারার পরিবর্তন ঘটছে প্রতিনিয়ত। বাসব জয়ন্তরা চুলের স্টাইল পালটেছে। আমি পারিনি। প্রতিমাসে রাম নাপিত বাক্স নিয়ে আসে, আমার চুল কেটে দেয়। ঠাম্মা দাঁড়িয়ে কাটায়। ঠাম্মা বলে, – রাম, কানের পাশটা ছোট করো।
রাম বলে, – এখন তো ঐ ডিজাইনই চলছে।
– তা হোক।
মেয়েরা আসে চুলে কত রকমের ক্লিপ লাগিয়ে। কেউ কেউ সুন্দর ডিজাইনের চুল গুটিয়ে লম্বা ক্লিপ লাগায়। ডলি শুধু বয়েজ কাট করে ডান দিকে সিঁথি কাটে।
বিশ্বকর্মা পুজো সামনের সোমবারে। আমি ঘুড়ি ওড়াই না। আমার ভাল লাগে না। খেলতে যাওয়ার পথে দেখি বুদ্ধদা, সুজন, পাপাই, সৌম্য বিরাট বিরাট লাটাই নিয়ে ঝিলের ধারে দাঁড়িয়ে ঘুড়ি ওড়ায়। কী সুন্দর সুতোর রং! কাঁচা হলুদ কিংবা কচি কলাপাতা অথবা হালকা গোলাপী রং। অনেক উঁচুতে ঘুড়ি বাড়ে ওরা। শরতের পেঁজা মেঘ নীল আকাশের তলা দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ঘুড়িগুলো বোধহয় মেঘকেও ছুঁয়ে ফেলছে।
বুদ্ধদা চিৎকার করে ওঠে – ভোকাট্টা! ভোকাট্টা!
শিহরিত আমি আপনমনেই চিৎকার করে উঠি হাততালি দিয়ে-ভোকাট্টা!
অনেক অ-নে-ক ঘুড়ি ওড়ে। চারপাশ থেকে চিৎকার ওঠে-ভোকাট্টা!
সুজনদার ঘুড়ি কেটে গেল। সুতো জলে পড়ার আগে লাটাই গোটায় দ্রুত। বলে – ভিজে গেছে সুতো। অন্য লাটাই নিয়ে আবার ঘুড়ি বাড়ে।
আমি ধরাই দিই ওদের। তারপর পাপাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে লাটাই ধরি। বাসব আমার কাঁধে হাত রাখে। – খেলতে যাবি না?
এই অন্যরকম সুন্দর বিকেল উত্তেজনায় ভরা ঘুড়ি কাটাকাটির খেলা ছেড়ে সমর কাকুর বাড়িতে ঢুকে পড়ি।
দুলে দুলে ডলি আর রাইমা গান গাইছে, – ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে……
ওরা গান শেখে মিতা সেনগুপ্তর কাছে। উনি রেডিওতে গান করেন। আমরাও মজা করে গাইতে শুরু করি, – বহে কিবা মৃদু বায়……..
ওরা রেগে যায়। বলে, – আমরা আর গাইব না।
আমরা বলি, – ঠিক আছে গা। কিছু বলব না।
ঠিক সেই সময় চরণ মালি বাঁশের বেড়ার গেট ঠেলে ঝাঁঝরি নিয়ে গোলাপ বাগানে জল দিতে ঢোকে। আমরাও পেছন পেছন ঢুকে পড়ে ঝরে যাওয়া গোলাপের পাপড়ি তুলি। লাল হলুদে গোলাপি কালো। হরেক রকম রঙের গোলাপ। ছবির মতো বাগান।
চরণদাকে বলি, – সবুজ ফুল দেখেছ?
চরণদা অবাক হয়ে বলে, – সবুজ গোলাপ পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যায় না।
– কেন জানো?
গম্ভীর হয়ে চরণদা বলে, – জানি না। যাও তো।
চরণদার মুখের কাছে গিয়ে বলি, – ক্লোরোফিল থাকায় পাতা সবুজ হয়। ফুলের হয় না।
চরণদা অবাক চোখে দেখে আমাকে।
মেয়েরা রুমালে কুড়োয় ঝরা ফুলের পাপড়ি। আমরা মুঠোয় পুরে পকেটে ভরি।
কাটা ঘুড়ি উড়ে যাচ্ছে সমরকাকুর বাগানের ওপর দিয়ে। সাদা বক উড়ে যাচ্ছে। আজও যাচ্ছে জেট প্লেনটা। সরু থেকে চওড়া হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে তার ধোঁয়া। ভরা শরৎ। কত ফুল ফুটবে। বাবার বাগান এবার শূন্যই থাকবে। কে বসাবে গাছ!
এখন থেকেই আগমণীর সুর। বিজ্ঞাপনের গাড়িতে আজকাল মহালয়ার গান বাজে। ঢাকের শব্দ বাজে।
আমার নতুন পোষাকপরা হবে না। আমার শার্টগুলো ছোট হয়ে গেছে। সেই পরেই খেলতে আসি। বগল ছিঁড়ে যাওয়া বা বোতাম খুলে যাওয়া বা শার্টের তলার ফোল্ড খুলে ঠাম্মা ঝুল বাড়িয়ে দেয়। সেই আনন্দেই পোশাক পরি।
একদিন ভোরবেলায় দুধ বিস্কুট খেতে খেতে জানলা দিয়ে দেখলামকত শিউলি ফুল পড়ে আছে গাছের তলায়। দৌড়ে গিয়ে কুড়োতে লাগলাম। ঠাম্মার হাতে যখন দিলাম ফুলগুলো ঠাম্মা সব বাবার ফোটোর সামনে সাজিয়ে রাখল।
সারা ঘর ভরে উঠল শিউলি ফুলের গন্ধে।
সেই গন্ধে ডুবে যেতে যেতে আমি পড়তে শুরু করি – যে বিশেষ্য পদ দ্বারা কোনো বস্তু বা পদার্থের নাম বোঝায়, তাকে বস্তুবাচক বিশেষ্যপদ বলে। যেমন – দুধ, চা, কাঠ ইত্যাদি যে বিশেষ্যপদ দ্বারা কোনো জাতি বা শ্রেণিকে বোঝায় তাকে বলে জাতিবাচক বিশেষ্য। যেমন – হিন্দু, মুসলমান, কুকুর, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ইত্যাদি।
আমি জানলা দিয়ে দেখি আলতো হাওয়ায় দুলছে শিউলি পাতা। ঝরে পড়ছে সাদা ধবধবে শিউলিফুল। কমলা ফোঁটা। অঙ্ক খাতার শূন্য জায়গায় আঁকি শিউলি ফুল। মাকে দেখাই। মা বলে–খুব ভাল হয়েছে। ব্যাকরণ শেষ কর। পড়া ধরব।
আমি পড়ছি-যে ক্রিয়ার দ্বারা কোনো কাজ শেষ হয়েছে এরূপ কোনো অর্থ বোঝায়, তাকে সমাপিকা ক্রিয়া বলে…..
বেশ বিস্ময়করভাবেই ক্লাশ সিক্স-এ উঠে গেলাম। র্যাঙ্ক পেলাম – সেভেন্থ। আমার পাশ করার কথাই নয়। পরীক্ষার এক মাস আগে আমার টাইফয়েড হয়েছিল। পরীক্ষা দিতে পারব কিনা সন্দেহ ছিল। ঠাম্মা আনন্দে আমাকে বুকে জড়িয়ে কেঁদেছিল।
আত্মীয়দের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল আমার রেজাল্টের খবর। অনেকেই গল্পের বই, পেন, ডিকশনারি উপহার দিয়েছিল। বন্ধুরাও খুব খুশি। মা একদিন সবাইকে ডেকে মিষ্টি খাইয়েছিল। ওরা রোজই কেউ না কেউ আমার শরীর খারাপের সময় দেখতে আসত বিকেলে। একটু সুস্থ হলে বাড়ির সামনের রাস্তায় আমরা আমরা দল বেঁধে হাঁটতাম।
সে এক অদ্ভুত জীবন। কত তাড়াতাড়ি বিকেল নেমে আসত। পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যাতারা উঠত। পাখিরা বাসায় ফিরতে ফিরতে বলে যায়-ঘরে ফিরে যাও। ঠান্ডা লেগে যাবে। বাগানে মা গাছ লাগিয়েছে মালি দিয়ে। কত রকম ফুল ফুটেছে–সিজন ফ্লাওয়ার চন্দ্রমল্লিকা গাঁদা। বাগানটা ভরে গেছে ফুলে ফুলে। ডালিয়ার কুঁড়ি এসেছে। চাঁদ এখন পদ পরিবর্তন করেছে। জানালা দিয়ে আলো ঢোকে না। বারান্দায় এসে বসে থাকে। কী স্নিগ্ধ আলো।
সারা দুপুর প্রজাপতিরা ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়ায়। ক্রিস মাসের ছুটিতে জানালার ধারে বসে বসে দেখি। আর ভাবি আমার যদি ডানা থাকত আমিও উড়ে বেড়াতে পারতাম। উড়তে উড়তে গিয়ে ইঠাৎ করেই বসে পড়তাম বাসব কিংবা জয়ন্তর কাঁধে। অথবা রাইমা ডলি অমিতার বিনুনির ওপর। তারপর–ধর-ধর-ধর-ধর। আমি জানলা গলে চলে যেতাম সঞ্জনা কিংবা সুমিতার বিনুনির ওপর।
বাসবের কাছে কিছুতেই যেতাম না। ও ঝিলের পাড়ে ফড়িং ধরে ডানা ছিঁড়ে দিত। বড্ড নিষ্ঠুর। কথায় কথায় ক্লাসে সকলের সঙ্গে মারামারি লাগিয়ে দেয়।
উড়ে যেতাম বাবার কাছেও। বলতাম, – বাবা, পাশ করেছি। মা, ঠাম্মা ভাল আছে। দেখে আসতাম বাবার থেঁতলে যাওয়া মাথা কতটা ভাল হয়েছে। সেজমামাকে গিয়ে বলতাম-জানো, মা-মাসিমণিরা সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। তুমি চলো, আমি নিতে এসেছি।
রোদ্দুরে চেয়ারে বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়তাম। মা তুলে নিয়ে গিয়ে খাটে শুইয়ে দিত। তারপর বিকেল হলেই ছুট সমরকাকুর বাগানে।
তখন গান হচ্ছে-আকাশ জুড়ে শুনিনু ওই বাজে……
অমিতা আর সুমিতা নাচছে।
আমরা হাততালি দিই। আমাদের খেলা জমে ওঠে। বিকেল বলে, – খেলো। ফুল বলে, – নাচো। ঘাস বলে, – আমি তো শরীর বিছিয়েই রেখেছি।
আমার কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে। মনে মনে শব্দ সাজাই-গোধূলির ম্লান আলোয় জল ফড়িং উড়ে বেড়ায়/কুচুরিপানার পাতায় পাতায়/ফুলে ফুলে/পাখির দল উড়ে যায় ঝিল পেরিয়ে/শিমুল গাছের শাখায় শাখায়/সন্ধ্যা নামছে/শঙ্খধ্বনি বেজে উঠছে গৃহস্থের বাড়িতে/বাড়ি ফিরতে হবে যে/কাল আবার আসব শেষ বিকেলে/গোধূলির আলো মেখে……
বাড়ি ফিরে একটা পুরনো অঙ্কের খাতায় লিখে ফেলি কবিতাটা। সেই আমার প্রথম কবিতা।
পরের দিন বিকেলে ওদের শোনাতেই ওরা আমাকে জড়িয়ে ধরল। সেই প্রথম রাইমার বুকের গন্ধ পেলাম। আমার চেতনায় যেন কী ঘটে গেল। রাইমা বলল-তুই কবি হবি?
আমি হেসে জড়ানো কন্ঠে বলি-জানি না। জানি না। আমার কোনো অ্যাম্বিশন তৈরি হয়নি। মা বলে অ্যাম্বিশাস হতে হবে।
সেই বিকেলে আমরা সবাই ক্লাসের করিতাই আবৃত্তি করলাম। দূরের কোনো বাড়িতে শাঁখ বেজে উঠল। আমরা সবাই উঠে দাঁড়ালাম।
কে যেন বলল–কালও কি আমরা আবৃত্তি করব?
সঞ্জনা বলে উঠল–না না। রুমাল চোর খেলব।
বাড়ি ফিরতে ফিরতেই বুঝতে পারলাম পাড়াটা ঝিম হয়ে রয়েছে। গেটের সামনে মা দাঁড়িয়েছিল। তাড়াতাড়ি বাড়িতে ঢুকিয়ে নিল। এক দল লোক লাঠি বাঁশ নিয়ে দৌড়ে গেল রাস্তা দিয়ে।
বললাম, – মা কী হয়েছে?
– সন্তোষ কাকু খুন হয়েছে। পোশাক পালটে হাত পা ধুয়ে নাও।
অনেক রাত্রে ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকার ঘরে জানলা খুলে আমরা দেখলাম প্রচুর মানুষ যাচ্ছে। শত শত। স্লোগান দিচ্ছে, – তোমায় আমরা ভুলিনি। ভুলব না। তুমিই আমাদের পথের দিশা।
ঠাম্মা বলল, – হসপিটাল থেকে লাশ নিয়ে এল বাড়িতে।
আমার হাত পা কাঁপছে। সন্তোষকাকু খুন হয়েছে। খুন শব্দটা আমার মনের শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ল।
জানলা বন্ধ করে মা আমায় ঘরে নিয়ে এল।
৬
সারা পাড়া থমথম করছে। সন্তোষকাকুর বাড়ির সামনে পুলিশ পাহারা রয়েছে। পাশের বাড়ির কবিতা কাকিমা মাকে বলেছে। রাস্তায় পুলিশ টহল দিচ্ছে। ঠাম্মা দেখেছে মোড়ের মাথায় দুটো পুলিশের জিপ দাঁড়িয়ে।
ঠাম্মা স্কুলে যেতে বারণ করেছিল। মা বলল-যাক না। কিছু হবে না।
পথে বাসবের সঙ্গে দেখা। বলল, – জানিস, সন্তোষকাকুকে দলের লোকেরাই মেরেছে। বাবা বলছিল।
দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার। সাদা কাগজে কালো কালিতে লেখা-শহীদ সন্তোষ দাশ অমর রহে!
স্কুলে জয়ন্ত বলল, – আজ আর খেলতে যাব না।
– কেন?
– পুলিশ আমাদের ধরতে পারে। সন্তোষকাকু কোথায় কোথায় যেত জানতে চাইবে।
বাসব ফিক করে হেসে ফেলল।
আমি বললাম, – সে কথা আমরা জানব কী করে?
জয়ন্ত বলল, – বাবা বলেছে এ কদিন খেলতে যাওয়া চলবে না। এখন দুদলে লড়াই লেগেছে। সাবধান।
ওর কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলাম না।
বিকেলে ঠাম্মা বলল, – আজ আর খেলতে যেও না।
সারা বিকেল মায়ের সঙ্গে গাছে গাছে জল দিলাম। শুকনো পাতা কুড়োলাম।
তারপর শুকতারা উঠল। পাখির কলকাকলি থেমে গেল। তারায় তারায় ভরে উঠল আকাশ। রাস্তায় পুলিশি টহল চলতেই থাকল।
পড়তে বসে অঙ্কের খাতাটা টেনে নিয়ে লিখতে শুরু করলাম –
পাখির পালকে পালকে মিলিয়ে যায় গোধূলি অজস্র সজনে ফুলের আলোয় আলোয় ভরে ওঠে আকাশ আকাশে উজ্জ্বল হল সন্ধ্যাতারা মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে জিপ, হেঁটে বেড়ায় পুলিশ তারা কি জানে আকাশের কোন তারাটা সন্তোষকাকু!
গভীর রাত্রে শুরু হল যুদ্ধ। বোমার শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছে বাড়ি। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে। ঠাম্মা উঠে এল এ ঘরে।
– বৌমা, ঘরের আলো জ্বালার দরকার নেই। কাছাকাছি কোথাও বোম পড়ছে।
স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে ভারি বুটের শব্দ। গুলির আওয়াজ। আমরা কাঁপছি। ঠাম্মা ঢুকে এল মশারির মধ্যে।
কতক্ষণ এসব চলেছিল জানি না। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
পরের দিন সারা পাড়া জুড়ে কারফিউ জারি হল। আমার স্কুল যাওয়া বন্ধ। লোক চলাচল বন্ধ। আজ পুলিশের সংখ্যা আরও বেশি।
সকালে উঠে পড়তে বসলাম। কিছুই পড়া হচ্ছিল না। বারবার সন্তোষকাকু মুখ দেখতে পাচ্ছি বইয়ের পাতায়। চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়স হয়ত। চওড়া চেহারা। লম্বা মতো মুখ। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি সবসময়। কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ ঝুলত। সবার সামনেই আমাকে কোলে তুলে নিত। আমার খুব লজ্জা করত। নেমে পড়ার জন্য ছটফট করতাম। কিন্তু তার গায়ের জোরের সঙ্গে পারতাম না কিছুতেই।
বাগবাজার মোড়ে মিটিং করতে যেত। চোয়াল শক্ত করে চিৎকার করে বলত, – সশস্ত্র আন্দোলন নয়। জাতীয় সংহতির স্বার্থে শিক্ষানীতি ও রাজনৈতিক মতাদর্শের বিনিময় দরকার। আমার দু চোখ বেয়ে জল নেমে এল।
ঠাম্মা এসে বলল, – পড়ছিস না? এমা কাঁদছিস?
আমি ঠাম্মার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
– কী হয়েছে বল?
আমি কিছু বলতে পারি না। ঠাম্মা আঁচলে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলে, – পড়তে হবে না। শুয়ে থাকো কিছুক্ষণ।
সকালে ঝর্ণাপিসি কাজ করতে এসে বলছিল, – বাদলের বাড়িতে বোম পড়েছে। আমাদের রাস্তার উলটো দিকের গলিতে বাদলের বাড়ি। একই দলের লোক। হিস্যা নিয়ে গোলমাল হওয়ায় বাদলের লোক সন্তোষকাকুকে খুন করেছে। বাদলকে পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওর দুনম্বরী ব্যবসা ছিল। মোজাইকের বিরাট দোতলা বাড়ি করেছে। ছেলে মেয়েদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াচ্ছে। বোমায় বাড়িটার অনেক ক্ষতি হয়েছে।
শুয়ে শুয়ে সব শুনছিলাম। খুব রাগ হচ্ছে সন্তোষকাকুর নামে এসব বলায়। হিস্যা কী আমি বুঝি।
প্রতিবাদটা মা-ই করল, – সন্তোষ আমাদের অন্যরকম ছেলে। ওর নামে এসব কথা মানায় না।
ঝর্ণাপিসি আর কিছু না বলে রান্নাঘর থেকে বাসনপত্র নিয়ে শব্দ করে কলতলায় নামাচ্ছে। বিকট সেই শব্দ।
সপ্তাহখানেকের মধ্যে সব কিছু থিতিয়ে গেল। খুনিরা ধরা পড়েছে কিনা জানি না। দুদিনের বৃষ্টিতে সন্তোষকাকুর নামের সব পোস্টার ধুয়ে মুছে গেছে। আমরা স্কুলে যাই। খেলতে যাই। পড়তে বসি। সময় হাওয়ায় ভেসে যায়। ঋতু পরিবর্তন হয়। সারা দিনের ক্লান্তি নিয়ে সূর্যাস্ত হয় কৃষ্ণচূড়ার মাথায়। প্রজাপতি তার পাখনা মেলা থামিয়ে বিশ্রাম নেয় পাতার আড়ালে। পড়ার টেবিলের ওপাশের শালের পাতার টুপটাপ ঝরে পড়ার মৃদু শব্দ সারাক্ষণ চলতে থাকে। সকালে গাছটার তলায় অজস্র সাদা ছোট ছোট ফুল ছড়িয়ে থাকে। বসন্তের আশ্চর্য বাতাস বয়ে যায় সকাল থেকেই।
এক দিন স্কুলে যেতে যেতে বাসব বলল, – একটা কলাগাছের ভেলা তৈরি করব।
– কোথায়
– সমরকাকুর মজা পুকুরে।
– অত গাছ কোথায় পাবি?
– কাল দেখলিনা পুকুরটার পাশে কত কলা গাছ পড়ে আছে। কলাবাগান আর থাকবে না। ওখানে বিল্ডিং হবে। সুমিতা বলেছে।
– কারা থাকবে?
খুব গম্ভীর হয়ে বাসব বলল, – ফ্ল্যাট হবে। বিক্রি হবে।
আমার খুব মন খারাপ হয়ে গেল। ওই কলাবাগানে আমরা ‘ধাপ্পা ধাপ্পা’ খেলতাম। খেলাটা আর হবে না।
বাসব খুশি হয়ে তাকায় আমার দিকে। আমি চোখ সরিয়ে নিই।
আমাকে কিছু বলতে না দেখে বাসব বলে, – কাল রবিবার সকালে সবাই গিয়ে ভেলাটা তৈরি করব।
বুঝলাম, এবার ভেলায় ভাসার খেলা।
আমাদের বেশি কিছু করতে হয়নি। চরণ মালিই তৈরি করে দিল ভেলাটা। দুটো লগিও যোগাড় হল।
বিকেলে আমরা সবাই পালা করে ভেলায় চাপলাম। সঞ্জনা উঠতে চাইছিল না। জয়ন্ত জোর করে তুলল।
সে এক মজার খেলা। একবার এপাশ হেলে যায় তো আর এক বার ওপাশ। আমরা জড়াজড়ি করে এর ওর হাত ধরে থাকি। লগি ঠেলাতেই মজা বেশি। কাজটা বেশির ভাগ সময় আমিই করি। ভাসতে ভাসতে মাঝি হয়ে যাই। এপার ওপার করি। এক পাশ হেলে গেলে অন্য পাশে জয়ন্ত লগি ঠেলে ব্যালান্স করে। ভাসতে ভাসতে আমরা চাঁদে যাই। মঙ্গল গ্রহে যাই। আমাদের ভাসার শেষ নেই। রাইমা বলে আজই ভেনাসে যাব। খেলাটা বেশি দিন চলেনি। একদিন অমিতা ডাঙার কাছে জলে পড়ে গেল। পাঁকে ভিজে একসা। কী কান্নাকাটি! তারপর
ভেলায় ভাসা খেলা বন্ধ হয়ে গেল। চাঁদের দেশ মঙ্গল ইউরেনাসের দেশে ভেসে বেড়ানো বন্ধ। স্বপ্নে দেখি ভাসতে ভাসতে আমরা ইংল্যান্ড চলে গেছি। আমার স্বপ্নের কথায় সবাই হেসে ওঠে।
[চলবে]
আগের পর্ব ও লেখকের অন্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন।

কথাসাহিত্যিক
স্কুলজীবনথেকে সাহিত্যচর্চা শুরু করে শূণ্য দশকের গোড়ায় পাকাপাকিভাবে সাহিত্যে চলে আসা। ইংরাজি সাহিত্যের ছাত্র। একটি দৈনিকে বেশ কিছু বছর সম্পাদকীয় বিভাগে থাকার পর এখন প্রকাশনা সংস্থায়। আনন্দবাজার, এইসময়, বর্তমান, প্রতিদিন, তথ্যকেন্দ্র, একদিন, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, দৈনিক স্টেটসম্যান, গৃহশোভা, অদ্বিতীয়া প্রভৃতি বাণিজ্যিক পত্রিকার পাশাপাশি অসংখ্য প্রথম সারির লিটিল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে লেখা। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ তিনটি – ‘তুলির শেষ টান’, ‘বর্ষাপুরুষ’, ‘সামাজিক’। লিখেছেন চারটি উপন্যাসও। গল্প থেকে তৈরি হয়েছে চারটি সিনেমা। তুলি-রং এবং বই পড়ায় অবসর যাপন। বিশ্বাস করেন, যতদিন মানুষ, ততদিন গল্প। যতদিন গল্প, ততদিন স্বপ্ন। এবং সব স্বপ্ন আগামীর নির্মাণ ও উত্তরণে।