| 25 এপ্রিল 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

জোনাকির ফোয়ারা ও একটি বিভ্রান্ত রাত

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com আলোচনাটা শুরু হয়েছিল ঘটনার চারপাঁচদিন আগে। গ্রামের হাটবার তবুও পথে পথে সওদা কিনতে যাওয়া মানুষের ভিড়। পরিচিত কয়েকটি ছেলে নদীর জলের তোড়ে ভেসে আসা নরম মাটির উপর কুস্তি খেলছে। ওদের ক্রীড়া-কৌতুক ভীষণ হাস্যকর মনে হল আমার কাছে। গ্রামের চৌকিদার খয়েরি টুপিটা মাথায় চেপে হন হন করে ছুটছে। সে আমার পাশ কাটিয়ে এমনভাবে চলে গেল যেন মহাপ্রলয়ের আগাম খবরটি জানাতে লোকটা মরিয়া। থামো! থামো! এমন একটা হাঁক দিতে দিতে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকল লোকটা। আর সেই সঙ্গে প্রাত্যহিক কাজে নিয়োজিত সাধারণ লোকজন এবং সওদা কিনতে যাওয়া মানুষগুলো থেমে গেল। হঠাৎথেমে গেল কুস্তি খেলা ছেলেগুলোর ক্রীড়া-কৌতুক। কয়েক মুহূর্ত পর শকুনের মত তীব্রবেগে একঝাঁক লোক এসে যোগ দিল চৌকিদারের সঙ্গে। ওরা অপেশাদার ভাবে এমন একটা ভয়ের খবর জানালো তাতে সকলেরই মুখের হাসিভাব অদৃশ্য হয়ে গেল। স্টেশনের চা দোকানের ভীড় থেকে কথাটা প্রথম ছড়াতে শুরু করে। তারপর সেটা গ্রামের এ মাথা হয়ে ও মাথায় চলে যায়। চৌকিদার লোকটা সর্ব প্রথম গ্রামের কার কাছে খবরটা জানিয়েছে তা বের করা অসম্ভব। স্থানীয় প্রচারকরা তাদের নিজ নিজ হাওলার ছয়ঘরি মহল্লায় খবরটা ছড়িয়ে দিল। সবাই বলাবলি করতে লাগল, আজ রাতে এই অঞ্চলে শুকনো বন্যা হবে।

আমাদের বাড়ি সমুদ্রতীরবর্তী হওয়ায় বহুবার ঝড়-বন্যার মুখোমুখি হয়েছি কিন্তু ১৯৭০ সালের মত প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের সাক্ষী আমি নই। শুনেছি, সে বছর ১৩ই নভেম্বর ঝড়ে কয়েক লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল উপকূলাঞ্চলে। ২২৪ কিলোমিটার বেগে প্রবাহিত বাতাসের একটানা গতিবেগে তেত্রিশ ফুট জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছিল নিম্নাঞ্চল। জল নেমে যাওয়ার পর গাছের ডালের সাথে লম্বা চুল পেঁচিয়ে ঝুলে থাকা নারীর লাশ রোদে শুকিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে মাটিতে পড়েছে। কেউ কঙ্কালটিকে নামাতে পর্যন্ত যায়নি। আবার ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলা থেকে এক মৌলভী শুকনো কাঠের ফালা ধরে ভাসতে ভাসতে এসেছিল বরগুনা জেলায়। এই ঘটনা সত্য নাকি মিথ্যা ইতিহাস যাচাই করতে যাইনি। তবে লোকমুখে শুনতে শুনতে মাথার ভেতর গল্পগুলো সত্য বলেই গেঁথে রয়েছে।

বিকেলের বর্ণিত আলাপে এমনটা শোনা যাচ্ছিল, মহাপ্রলয়ের পূর্বে খুব সুন্দর হয়ে উঠবে পৃথিবী। আকাশ তার সমস্ত সৌন্দর্য উন্মুক্ত করে দেবে। সজাগ হয়ে উঠবে ঘুমিয়ে থাকা পশু-পাখি। ওরাও স্তব্ধ হয়ে অপেক্ষা করবে মহাপ্রলয়ের। বুনো ফুলগুলো মুকুল থেকে বের হয়ে আসবে আর বাতাবি লেবু ফুলের গন্ধে ভরে যাবে চারপাশ। তারপর তারাগুলো ঘর বদলের জন্য খইয়ের মত ফুটতে শুরু করবে আকাশের শরীরে। গ্রামকেন্দ্রের মানুষগুলো দুর্বল আর জরাজীর্ণ বাড়ি থেকে অপেক্ষাকৃত নতুন আর শক্তপোক্ত বাড়িতে রওয়ানা হবে। একটা নরম হাওয়া গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যাবে মানুষের কাঁধ ছুয়ে। আর তাতে মানুষগুলোর পেশী সংকুচিত হয়ে পড়বে এবং অতি নিঃসার দেহ নিয়ে ঢলে পড়বে মাটিতে। আর এভাবেই প্রতিটি বাড়ির মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে পাশের বাড়ির মানুষ। মানুষগুলো আকাশের পূব দিকে তাকালে সাদা পালকের মত দুখণ্ড মেঘ ভেসে যেতে দেখবে।সময়ের ধারাবাহিকতায় মেঘের খণ্ডদুটো ক্রমশইপলিশহীন সোনার রঙের মতনঝিলিক ছড়াবে আর তাতে রাত্রিটারঙিন হয়ে উঠবে। তখন আবছা আঁধারের বিমর্ষ ভাবটুকু মুছে গিয়ে গোধূলির শেষ আলোর আভার থেকেও আলোকিত হয়ে উঠবে পৃথিবী।মানুষ ঘাড় ভেঙে মাথার উপরে তাকালে দেখবে ঊর্ধ থেকে ঊর্ধতর দূরত্বে উড়ছে বড় একঝাঁক কালো পাখি। ওদের গায়ের রঙ কয়লার টুকরোর মতন মিসমিসে কালো আর পালকদুটো ফুল ঝরা বেগুনের মত রঙিন। তখন যে কেউ চাইলেই নদীর পাড়ে ছুটে চলে যেতে পারবে। আর তারা সেখানে গিয়ে দেখবে, একেবারে তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে নদীর জল। রেতী রেখার বরাবর সামান্য কিছু জলের ভেতর মাছগুলো খলবল করতে থাকবে। শুঁশুক, কুমির আর বড় জলজ প্রাণিগুলো কাদায় লুটোপুটি করবে। মানুষ চাইলেই নদীর এপার থেকে ওপার পর্যন্ত হাঁটুজলে হেঁটে যেতে পারবে। তারা হাঁটুজলে নেমে রেতী রেখা বরাবর দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকবে নদীটার দূর বাঁকের দিকে।আকাশের আলো এতটা উজ্জ্বল হবে, জলে সাঁতারকাটা মাছগুলোর পিঠের রঙও তারা স্পষ্ট দেখতে পাবে। অথচ নদীটা সাধারণ সময়ে সাঁতরে পার হওয়া বিশেষ সাহস আর ফুসফুসের শক্তির ওপর নির্ভর করে।যেখানে একজন সুস্থ্য ফুসঁফুসওয়ালা পুরুষ কোমড়ে শক্ত করে গামছা বেঁধে ওপারের মোল্লাবাড়ির ঘাটের সাঁকো লক্ষ্য করে সাঁতার দিলে যেতে যেতে সে আধমরা হয়ে যায়। সেখানে বিকেলের আওয়াজ ওঠা চৌকিদারের বর্ণিত ঘটনার সাথে খুব অবিশ্বাস্য। কিন্তু এই মহল্লার প্রত্যেক বাড়ির মানুষ অদৃষ্টের এই পরিণতির জন্য তৈরি হতে শুরু করেছে।

সূর্যাস্তের সময় উঁচু গাছগুলির ডালের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিতে লাগল টুকরো টুকরো রক্তিম মেঘ। মসজিদের জানালার কাঁচের ওপর প্রতিফলিত হচ্ছে পশ্চিমাকাশের রং আর তা ঠিক দেখতে মনে হয় রূপকথার অগ্নিশিখার মত। একটু পরেই আকাশে চাঁদ উঠল। দু’টাকার কয়েনের মত গোল আর মস্তবড় আয়তন চাঁদটার। দপদপ করে জ্বলছে তারাদের হাট-বাজার। মাথার অনেক উঁচু দিয়ে একবার জ্বলে একবার নেভে এমন একটি উড়োজাহাজ কোন দূর দেশে যেন চলে যাচ্ছে। এত সুন্দর আলোকিত রাত সচারাচার দেখা যায় না।

সরেজমিন থেকে আমাদের বাড়িটা বেশ উঁচু। চারটি ঘর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে বৃত্তাকার হয়ে। উঠানটা অনেক বড়, পরিচ্ছন্ন আর যে কোনো জঞ্জালমুক্ত। আমরা উঠানে মাদুর পেতে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে ওর চেহারা পরীক্ষা করলাম। সন্ধ্যার পর থেকে একটা তারাও হারিয়ে যায়নি। কোথাও এক টুকরো মেঘ এসে চাঁদটাকে আড়াল করেনি আর এতটুকুর জন্যও আকাশটাকে বেজার মনে হয়নি। দেশের বিদ্যুৎব্যবস্থার চরম উন্নতির পরও আমাদের বাড়িতে কারেন্ট নেই। আব্বার রেখে যাওয়া পুরনো রেডিও অন করে প্রতিঘন্টার বুলেটিনে কান খাড়া করে রাখি। কিন্তু প্রলয় কিংবা মহাপ্রলয়ের কোনো আভাস পাওয়া যায় না। আমার চাচাত ভাই খুব আত্মবিশ্বাসের সাথেই বলল, অন্যান্য ঘূর্ণিঝড় কিংবা সাইক্লোনের মত জানান দিয়ে আসবে না এই শুকনো বন্যা। যেমনটি বিগতকালের কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে আগাম বার্তা দিয়েছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর। সিডর, আইলা আর মহাসেনের মত প্রলয়ংকারি ঘূর্ণিঝড়ের সময় প্রায় পনের দিন আগ থেকেই আবহাওয়া বুলেটিন বলেছিল টেলিভিশন চ্যানেলগুলো।

রাত সাড়ে এগারটা নাগাদ আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হলাম, এটা নিতান্ত গুজবই হবে। এটা নিয়ে অবান্তর চিন্তা করে কোনো কাজ নেই। আমার এটাও মনে হয়েছে-২০০০ সালের ৫ মে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার আগাম বার্তা দেশের প্রধান প্রধান পত্রিকাওলারাই প্রচার করেছিল। অর্থাৎ তারা এমনটা বলেনি যে পুরো পৃথিবী অমুক তারিখই ধ্বংস হয়ে যাবে। তারা শুধুমাত্র নাসার আশঙ্কাটুকু পৃথিবীবাসীকে জানিয়েছিল। দিনটি ছিল ১০ ই মহাররম, শুক্রবার। মানুষ অনেকটা বিশ্বাস করে ফেলেছিল ঘটনাটা। পুরনো মিথ আর ধর্মীয় কেতাবে বর্ণিত হয়েছে ১০ ই মহররমের বহুবিদ ঘটনা। তখন মেট্টিক পরীক্ষা চলছিল আমার। বাড়ি থেকে চব্বিশ কিলোমিটার দূরে আমতলী বন্দরের নতুন বাঁধঘাট সোনা মিয়ার বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলাম পরীক্ষার কয়দিন থাকার জন্য। সেখানে মেসের মত করে থাকি আর হলে পরীক্ষা দিতে যাই। কয়েকদিন আগে থেকেই গুঞ্জনটা শোনা যাচ্ছিল-শুক্রবার ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবী। চারপাশের মানুষের ভেতর অস্থিরতা নেমে আসছিল। কেউ কেউ বলল, পত্র-পত্রিকার কথা অবিশ্বাস করি কিভাবে! শুক্রবার দিনটা সবার বুক ধুকপুক ধুকপুক করতে করতে কেটে গেল। সন্ধ্যাটা এসেছিল কিছুটা অমসৃণ হয়ে আর পশ্চিমের লালচে রেখাটা দেখে মনে হল কারবালা প্রান্তরের রক্ত এই বুঝি আকাশ থেকে গড়িয়ে পড়ছে। রাস্তা-ঘাট ফাঁকা হয়ে গেল। মানুষ যাতক নিল যে যার ঘরের ভেতর। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর পরিবেশ আরো কিছুটা গুমোট হয়ে উঠল। কিছুটা জোড়ালো ভঙ্গিতে বইতে শুরু করল দখিনা হাওয়া। আমাদের ভাড়া বাসাটিতে সে রাতে আর আলো নিভল না। সবাই ঘরের দরজার খিল টেনে দূরের গর্জন আর অপরিচিত ঈস্রাফিলের আওয়াজ শুনতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। পাশের হাইওয়েতে গাড়ির হেড লাইটের আলো আর দেখা গেল না। একটা গাড়িরও হুইসেল এসে কানকে আর স্তব্ধ করল না। সোনা মিয়ার পাশের ঘরে কতগুলো মেয়ে পরীক্ষার্থী ছিল। ওরা ভীত মুরগীর ছানার মত গুটিয়ে রইল বিছানার এক কোণে। আর এই সুযোগটা নিয়ে নিল আমাদের সঙ্গে থাকা সুদর্শন ছেলে মাহবুব। ভীত মেয়েগুলোকে সাহস দিতে গিয়ে যে কোনো একজনকে নিয়ে আলাদা রুমে সে সময় কাটিয়েছে। মেয়েটির সঙ্গে একান্তে রাত্রি যাপনে কতদূর এগিয়েছিল তা সঠিক বলা মুশকিল। তবে মাহবুবের বর্ণনামতে ওদের সম্পর্কটা বিছানা পর্যন্ত গড়িয়েছিল আর ওই সময়টুকুতে ভুলে গিয়েছিল মহা প্রলয়ের কথা। পরের দিন বরাবরের মত সূর্য উঠেছিল পূব আকাশে। কোনো স্টেরোয়েডে সংঘর্ষ হওয়ার মত ঘটনাই ঘটেনি। অথচ, মানুষগুলো সারারাত ঈশ্বরের নাম জপেছে।

আমার মন বলছে, ২০০০ সালের মত আজ রাতের শুকনো বন্যাটাও হয়ত ধারণামাত্র। নিশ্চয়ই পৃথিবী প্রলয়ের মত বহু কারণ এখনো মানুষের সামনে আসেনি। মানুষ এখনো ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, তারা সন্ধ্যায় প্রার্থনাঘরে আলো জ্বালায়। আর তারা চুরি, লুণ্ঠন, মানুষহত্যা আর ব্যভিচারকে ঘৃণা করে। সুতরাং এই পৃথিবী আরো বহু বছর স্বাভাবিকভাবে চলমান থাকবে। অযথা উদ্বিগ্ন হচ্ছি আমরা।বিখ্যাত ভবিষ্যতদ্রষ্টা নস্ট্রাডামুস ২০০০ সালকে ইংগিত করেই ভবিষ্যতবানী করেছিলেন পৃথিবীর ইতিহাস ধ্বংসের।এছাড়াও বহু আলেম, বুজুর্গ আর তত্ত্বসাধক তো প্রায়ই মহাপ্রলয়ের দিনতারিখ বলে দেয়।অথচ, সেই সময় আসে আবার চলে যায়। পৃথিবী আগের মতই চলছে।পৃথিবীবাসিকে নতুন নতুন চমক দেয়া আর ভীত করে তোলাই একদল ভবিষ্যতদ্রষ্টার কাজ।মহা প্রলয়ের দিনক্ষণ ঈশ্বরের ইশারা মাত্র।

রাত দশটার পর ঝুলে পড়া চাঁদের আলোতে উঠানটা ঝকমক করছে। ঘরের পেছনে নারকেল পাতায় বাতাসের নাচন দেখে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হতে থাকল। ঘরে ঢুকে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র বের করতে চাইলাম কিন্তু কোনটা রেখে কোনটা বের করে আনব ভেবে পেলাম না। ব্যবহারের অযোগ্য খাট যা থেকে ঘুঁণ পোঁকার গুড়ি পড়ছে, কয়েকটি চাল রাখার পিপে, চৌকাঠের সাথে রং জ্বলা বাঁধানো ফটোফ্রেম, এক কোণে রাখা পুরনো বাক্স আর কয়েকটা কবিতার বইধুলোর আস্তরণে ভরা।এসবের কিছুতেই আমরা হাত দিলাম না।তবে দলিল-দস্তাবেজ আর প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র বাক্স থেকে বের করে ঘরের মাটি খুড়ে পলেথিনে মুড়িয়ে রেখে দিলাম। কাঠের ঘরগুলোর খুঁটির সাথে শক্ত গুনার তার বেঁধে লটকে দিলাম মোটা গাছের সাথে। হাস মুরগি নিয়ে কোনো আমাদের কোনো হেলদোল নেই। ওগুলো জলের ঝাপটায় দুটো পাল্টি খেলে আর টিকে থাকতে পারবেনা। কিন্তু গভাদি পুশুগুলোকে নিয়ে কি করব ভাবনায় আসেনা। শেষে বোবা জীবগুলোর গলার দড়ি কেটে দিয়ে আমরা আবার উঠোনে গোল হয়ে পরামর্শ সভার মত বসে রইলাম।চারিদিকে দারুণ নৈঃশব্দ।প্রতিটি অস্পষ্ট শব্দ কানে এলেই সাবধানে সবাই আলোকিত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমরা অপেক্ষা করি জলের শোঁ শোঁ শব্দ শোনার জন্য।

হঠাৎ আমাদের নাকে বাতাবি লেবু ফুলের গন্ধ আসে। গন্ধটা ভুরভুর করতে থাকে আমাদের চারপাশে। আমরা বাড়ির সবগুলো বাতাবিলেবু গাছের তলায় গিয়ে নাসারন্ধ্র ফুলিয়ে ঘ্রাণটাকে পরখ করার চেষ্টা করলাম। আসলে গন্ধটা বহুদূর থেকে আসতে আসতে জলের রেণুর মত মিশে গেছে বাতাসের সাথে। আবার একাগ্রমনে কান পাতলে এমনটা মনে হয় যেন বহুদূরে কোনো কিশোরী তার চিকন গলায় সুর তুলে বিরহের গান গাইছে। প্রতিবেশি বাড়ির মানুষগুলোর কণ্ঠস্বর ক্রমেই সরে গিয়ে দীর্ঘস্বাস হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে বহু দূরে। অলৌকিক কিছু একটা ঘটার পূর্বাভাস মনে হল আমাদের কাছে।

উঠানের শেষমাথায় বসা আমাদের বাড়ির জোনাকি ভয়ে কেঁদে ওঠল। জোনাকি আমাদের পাশের ঘরে থাকে। আমার বয়স যখন কুড়ি, ও তখন সোঙ্গরপুর গ্রাম থেকে আমাদের বাড়িতে প্রথম আসে। মেয়েটির মা মারা যাওয়ার পর ওর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে নববধূকে নিয়ে ঢাকায় গেছে। সেজন্য বোনের মেয়েটিতে দেখেশুনে রাখতে পাশের ঘরের চাচী ওকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে।মেয়েটি চৌদ্দ পনের বছরের কিশোরী। ফ্যাতার মত ফর্সা আর ওর চুল, ভ্রু মিচমিচে কালো। মেয়টির শরীরে একফোটা মেদ নেই, হাঁটলে মনে হয় যে কোনো মুহূর্তে মাটিতে ভেঙ্গে পড়বে।ওর ঠোঁটদুটো এতটা রক্তিম, দুপুরের চিকচিকে রোদের আলোয় ওর দিকে তাকালে মনে হয় মুখটা রক্তাভায় টকটক করছে। মনে মনে জোনাকিকে আমি পছন্দ করতাম।সন্ধ্যা থেকে নিজের প্রাণ আর পরিবারের অন্যান্যদের নিয়ে চিন্তায় মগ্ন ছিলাম কিন্তু জোনাকি নিঃসঙ্গতা এবং মৃত্যুর অদ্ভুত চিন্তা দিয়ে গড়া একটা কুয়াসার ভেতর ভেসে চলছে। ওর কান্নামাখা চেহারা আর ওর হরিণ শাবকের মত ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যাওয়া মুখ দেখে অন্যরকম ভাবান্তর হল। আমি উঠান থেকে বেরিয়ে সরু পথ ধরে নদীর পাড়ে যেতে লাগলাম। রাস্তার দু’ধারে দেখলাম গাছগুলো আকাশের দিকে মাথা খাড়া করে দৈত্যের মত দাঁড়িয়ে আছে। গাছের ছায়াগুলো পথের ওপর পড়ে কেমন ভুতুরে রেখা তৈরি করেছে। আর বাতাসে ডালপালার নাড়াচাড়ায় ছায়াগুলো কেমন জীবন্ত হয়ে উঠল। হঠাৎ গাছের সরু ডালপালার ভেতর থেকে ডানা ঝাপটানো কয়েকটা পাখির তীক্ষ্ম চিৎকার শোনা গেল।আমার মনে হল, শুকনো বন্যায় সুউচ্চ ঢেউগুলো যে প্রেতাত্মারা ঠেলে নিয়ে আসবে ওগুলো এই ছায়ার সাথে নড়াচড়া করছে। আমি শরীরটাকে ঝাঁকিয়ে বললাম,- দূর হ, দূর হ, সমুদ্রের প্রেতাত্মা কোথাকার!

হঠাৎ আমার মাথার উপর স্বপ্নের মত স্থির জল দেখতে পেলাম। আমার মনে হল, ঢেউয়ের তালে তালে কোন সুদূরে যেন এগিয়ে যাচ্ছি। একটা কলা গাছের ভেলা আমার অবলম্বন। ভেলাটা সজীব প্রাণির মত অধৈর্য হয়ে ঢেউয়ের উপর দুলতে শুরু করল। আমাদের বাড়ির লোকগুলো একজন একজন করে আমার চোখের সামনে ঢোক গিলে জল খাচ্ছে আর জলের ধাক্কাগুলোর সাথে লড়াই করতে করতে নিচে ডুবে যাচ্ছে।জলভাঙা ঢেউগুলোর ওপর চাঁদের ছায়াটা ঝিলমিল করছে আর পৃথিবীটা দারুণ শান্ত। আমি অন্য কাউকে নিয়ে আর চিন্তা করছি না। এমনকি আমার পরিবারের লোকজনও চোখের সামনে একজন একজন করে তলিয়ে যাচ্ছে। ওরা বাঁচার জন্য শেষ চেষ্টাটুকু করে জলের সাথে যুদ্ধ করে চলছে। কিন্তু আপনজনদের নিশ্চিত মৃত্যু দেখে আমার ভেতর কোনো রকম প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল না। বরং আমি জোনাকিকে জলের ওপর দাপাতে দেখে ওকে আমার ভেলার ওপর তুলে নিলাম। মৃত্যুযাত্রাপথে এক কিশোরীর ভেজা শরীরের অপার সৌন্দর্যের সবটুকু আমি শিকারি পাখির দৃষ্টি দিয়ে চাঁদের আলোয় দেখতে লাগলাম।ওরএমন সৌন্দর্য আগে কখনো দেখিনি। আমি দেখিনি ওর আশ্রয় খোঁজা ভীত সন্ত্রস্ত মুখ। আমি তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে দূরের অসমতল জলের দিকে তাকিয়ে রইলাম আর শুনতে লাগলাম মৃদু ঢেউয়ের শব্দগুলো। আমার মনে হতে লাগল- মরে যাক, সবাই মরে যাক। বাড়ির সবাই জীবিত থাকলে কোনোভাবেই এই অনাথ পরাশ্রয়ী মেয়েটিকে ভালোবাসা সম্ভব নয়। আর গ্রামের মানুষের কটাক্ষগুলো এতটাই কদার্য যে ওরা মনে করবে একই বাড়িতে থাকার কারণে আমি মেয়েটির সাথে দিনের পর দিন ব্যভিচার করেছি। ওদের অট্টহাসি আমার কানে বাজতে লাগল আর আমি এজন্যই পাড়াপ্রতিবেশি সকলেরই মৃত্যু কামনা করতে লাগলাম। সবাই মরে গেলে জোনাকি আর আমিকোথাও কোনো আশ্রয় খুঁজে পাব। যদিও আমাদের এখানকার দিকে কোনো পাহাড় নেই, তবুও মনে হয় ভাসতে ভাসতে আমরা হয়ত বড় বড় ফসলের মাঠ, হাট-বাজার, ঈদগাহ, খেলার মাঠ এমনকি এখানকার সবচেয়ে বড় নদীটা পার হয়ে কোনো এক রূপসী নগরে পৌঁছাতে যাচ্ছি।মনে হল ডান দিকে কোনো গভীর জঙ্গলের আভাস দেখা যাচ্ছে। হেলে পড়া গাছগুলোর পাতাগুলো কালো কালো, একটা ছোট নৌকা ডালের সাথে আটকে খাবি খাচ্ছে।আমি ঠিক করলাম যে করেই হোক ওই নৌকাটায় চড়ে আমাদের অজানা গন্তব্যের দিকে যেতে হবে।হয়ত আমাদের নৌকাটা কোনো বড় দালানের ছাদে আটকে যাবে। আমরা সেখানে দু’এক রাত অপেক্ষা করব। যে জোনাকি আমাকে দেখলে ওড়নাটা টেনেটুনে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করত কিন্তু আটকে যাওয়া ছাদে ও আমার বুকের কাছে মুখ লুকোনোর চেষ্টা করবে। তারপর জল নেমে গেলে আমরা আবার গ্রামে ফিরে আসব।তারপর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া ভিটেয় নতুন ঘর তৈরী করে জোনাকিকে নিয়ে বসবাস করব।

তখন বড় এক টুকরো কালো মেঘ চাঁদটাকে গিলে ফেলল। একটা একটা করে তারাগুলোকে ঢেকে ফেলল মেঘের পাহাড়। অদ্ভুত মৃদু শব্দে ভরে ওঠল চারিদিক। রাস্তায় গাছের ছায়াগুলো মিলিয়ে যেতে লাগল। আর পৃথিবীটা ঝিম মেরে কেমন অন্ধকার হয়ে গেল। মনে হল, প্রাগৈতিহাসিক কালের সমস্ত আঁধার একত্র হয়ে আকাশ থেকে মাটির দিকে নেমে আসছে। দূর থেকে অদ্ভুত একটা শব্দ ফেটে পড়ে গুড়িম গুড়িম করে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। যেভাবে কোনো হিংস্র জানোয়ার দীর্ঘদিনের বন্দি খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে ঝোপের ভেতর দিয়ে ঊর্দ্ধশ্বাসে দৌড়ে পালায়।আমি মোবাইলের আলোটা জ্বেলে সময় দেখে নিলাম। শহরের বন্ধু-বান্ধবকে ফোন করার চেষ্টা করে দেখলাম ইউজার বিজি আসছে। নেটওয়ার্কের একটা দাগও দেখা যায় না। একসময় নদীর পাড়ের উঁচু রাস্তায় উঠে নদীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, জল অনেকটা তলানিতে নেমে গেছে। তবে রেতী রেখাটা পর্যন্ত জল নামেনি। আর চাঁদের আলো না থাকায় জল ঠিক কতটা নেমে গেছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আমার মনে হল, এই বুঝি সমুদ্রের জলগুলো নাচতে নাচতে নিরীহ নদীটার ভেতর ছুটে আসছে। প্রচণ্ড বেগে জলের ধাক্কায় নদীগুলো দুকূল ছাপিয়ে দুপাড়ে আছড়ে পড়ছে। আর আমাদের এই ছোট্ট নদীটাও মুহূর্তে ভরে যাবে জলের ধাক্কায়। এই তো, একটু পরেই হয়ত নদীটা রাক্ষুসে রূপ প্রদর্শন করবে। আমি ভয় পেয়ে আবার বাড়ির দিকে ফিরে আসতে লাগলাম।

উঠানে দাঁড়াতেই তিনটা কুকুর আমাকে ঘিরে দাঁড়াল। কালো মেঘের খণ্ডটা কেটে গিয়ে স্বচ্ছ আকাশটা বেরিয়ে এল। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া গাছের পাতাগুলো ঝিরঝির করে নাড়িয়ে দিল। পুরো পৃথিবীজুড়ে মাখামাখি জোছনা। আমাদের কানে ভেসে এল দূরের বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। বাড়ির মেয়ে এবং মহিলারা বিলাপ করে কান্না জুড়ে দিল। ওদের প্রতিটা কণ্ঠ আলাদা আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। কণ্ঠগুলি একত্র হয়ে ভয়েররাত নামে। ওরাও কান পাতল দূরের শব্দটার দিকে। রাতটাও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। পূবের বিলটা জোছনার শেষ আলোতে এমনভাবে ভেসে যাচ্ছে, মনে হল নদীটা দুকূল ছাপিয়ে জলে ভরে গেছে চারপাশ। সবাই যখন মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত আমি জোনাকির হাতটা শক্ত করে ধরলাম। পুকুরে মাছেদের খাবার দেয়ার ভেলাটা কুলেই ভেড়ানো ছিল। আমি জোনাকিকে টানতে টানতে নিয়ে ভেলার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম। তখন আরেকটা মেঘের টুকরো মাথার উপর ছায়া ফেলল। রাতের অদৃশ্য আত্মাগুলোর দুর্বিসহ জীবনের রহস্যময় শব্দগুলি সচকিত হয়ে উঠল। পুকুরের মাছগুলো জলের ওপর দাপাতে লাগল। মাথার উপর নারকেল গাছের পাতাগুলো গড়িয়ে পড়তে লাগল একটার ওপর আরেকটা। আমি জোনাকির মুখোমুখি দাঁড়ালাম। অন্ধকারে ওর মুখটা স্পষ্ট দেখা যায় না। একঝলক বাতাস ওর অগঠিত বুকের কাপড়টা অনাবৃত করে দিল। আমি ওর অপুষ্ট বুকের দিকে নির্বাক তাকিয়ে রইলাম। জোনাকি ওর ঠোঁটজোড়া টিপে রাখল আর ওর চোখ থেকে সরে গেল কিশোরীর নমনীয়তা। তারকাখচিত নিষ্করুণ আকাশের পট থেকে ভয়ানক কালো ছায়া নেমে এল পৃথিবীতে। আমাদের চারপাশে ভর করছে আঁধার আর নৈঃশব্দ। কী এক অদৃশ্য শক্তি আমাদের ঠেলে নিয়ে গেল অদ্ভুত জগতে। আমরা দুজন দুজনকে অনেক কথা বলছি। তবে কেউ কারো কথা শুনতে পাচ্ছি না। অথচ, আমাদের মনের ভেতর ক্রমাগত তৈরি হতে থাকে কল্পনার মহাকাব্য।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত