হলুদ চাঁদের কথা
বাদল গেট খুলে ঢুকছিল বাড়িতে। বাড়ির সামনের বাগানটা অন্ধকারে ঝুপসি হয়ে আছে। হয়ত জল না পেয়েই শুকনো সব গাছের পাতা। ঠিক ওর মতই।আজ আর স্নান হয়নি বাদলের। সেই সকালে বেরিয়ে এখন ফিরল। তা প্রায় সাতটা বাজে। গতকালের ঘটনার পর কোনমতেই রনিতাকে বাড়িতে আশা করা যায় না। তবু ও দরজার চাবি খুলতে খুলতে একবার সোজা তাকাল রান্নাঘরের দিকে। না। আলো জ্বলছে না।
সাধারনত এসময় রনিতা চা বানায় বা বাবলিদের দুধ গরম করতে ওখানে ঢোকে। এখন নেই। বেশ বোঝা যাচ্ছে এই মুহূর্ত্তে রনিতা বাড়িতে অনুপস্থিত।
আগের দিন কি কি হয়েছে মনে করতে চাইল বাদল। আজ সকাল থেকেই তো বাড়িতে ছিল না। একবারও বাড়ির ছায়া মাড়ায়নি। যদিও জানত বাবলির স্কুল আছে। টিফিন বানানোর জন্য পাঁউরুটি লাগবে। রিনির রিক্সাকাকু কিছুদিন হল আসছে না। ওকে স্কুলে পৌঁছে দিতে হবে। গেটটা খোলার আগেই বুঝে গিয়েছিল বাড়িতে কেউ নেই। থাকার কথাও নয়। গতকাল রাতে যথেষ্ট কেলেঙ্কারি হয়েছে, তারপরও রনিতা বাড়িতে থাকবে এটা কোনভাবেই আশা করা যায়না।
ঝগড়াটা হতো না যদি বাদল নিজের অপরাধ মেনে নিত। নেশার ঘোরে ও ঠিক কি কি করেছে সবটা মনে করার চেষ্টা করছিল কিন্তু মাথায় কিছুই আসছিল না। শুধু মনে পড়ছিল রাস্তার মেঝেতে থেবড়ে বসেছে একটা আলুথালু বয়স্ক মেয়ে। আর তার দুপাশে তাকে তোলার জন্য হাত ধরে টানাটানি করছে দুটো ছোট ছোট বাচ্চা। যাদের একজনের বয়স আট, আর একজনের এগারো।
বাড়ির সবগুলো ঘরে ঘুরছিল ও। রান্নাঘরে গ্যাসের ওপরে কড়া হাঁড়ি যেমনকে তেমন পড়ে আছে। সিঙ্কে অনেক না মাজা বাসনকোসন জড়ো করে রাখা। শেষে আলমারির মাথার দিকে তাকাল একবার। তাকাতেই সেখানকার শূন্যতা বলে দিল বড় সুটকেসে জামা কাপড় গুছিয়ে নিয়েই এবারে গিয়েছে রনিতা। চট করে ফিরবে না। পাশের ঘরটায় এলো। টেবিলের ওপর বাবলি রিনির বই, স্কুলের ব্যাগ, সাজানো থাকে। সে সবও নেই। ছেলেমেয়ে মালপত্র নিয়ে কোথায় আর যাবে মেয়েটা? নির্ঘাৎ বাপের বাড়ি গিয়েছে।
রনিতাকে দোষ দেওয়া যায় না। সত্যি সত্যিই ও বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। যার কোন ক্ষমা নেই। রাত এগারোটা নাগাদ বাড়ি ফিরেছিল গজুর মদের ঠেক থেকে। সেখানে অনেক হিসেব মেলানোর কথা ছিল। আর তা না মিলতেই, নেশা করে, মেজাজ টঙে চড়িয়ে, বাড়ি ফিরেছিল ও। আসলে ওখানেই রানা আসবে বলেছিল। রানার কাছে হাজার কুড়ির মত পাওনা আছে। জোর করে কিছু বলাও যাচ্ছে না। রানার যাদের সঙ্গে ওঠাবসা তারা মোটেই সুবিধের লোক নয়। পঞ্চাশ হাজারের মধ্যে ত্রিশ হাজার দিলেও বাকিটা দিচ্ছি দেব করে আটকে রেখেছে। হয়ত টাকাটা একেবারেই পাওয়া যাবে না।ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ। বাজারে অনেক ধার জমে আছে। নতুন কোন অর্ডারও পাওয়া যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে একটা হতাশা ভেতরে ভেতরে ধিকিধিকি জ্বলা আগুনের মত পোড়াচ্ছিল ওকে। বাড়িতে ফিরে সেটাই উগড়ে দিয়েছে।
এছাড়া অনেকদিন ধরেই রনিতার সঙ্গে একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। ওকে মন খুলে কোন কথাই বলা যায় না। আসলে রনিতার বাড়ি, রনিতার রুচি কোনকালেই ওর সঙ্গে খাপ খায়নি। ভালোবাসার বিয়ে। বাড়ির অমতে পালিয়ে ওকে বিয়ে করেছিল রনিতা। কলেজে আলাপ। গ্র্যাজুয়েট হয়ে ও নামল ব্যবসায়। তখন ইলেকট্রিকের যাবতীয় কাজে ওর অদম্য উৎসাহ। রনিতার বাড়ি মানবে কেন? ওর নিজের তেমন পিছুটান না থাকলে ও মা বেঁচে। দাদারা যে যার আলাদা হয়ে যাবার পর মাকে নিয়ে পুরোনো বাড়িতে কোন রকমে দিন গুজরান। বাবা মা অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করতে, ওর কাছেই চলে এসেছিল মেয়েটা। মা কোন ঝামেলা করেনি। প্রচন্ড অভাব, নানা রকমের অসুবিধে, তবু মায়ের সঙ্গে ওর এক অদ্ভুত বোঝাপড়া ছিল। তারপরে একে একে রনিতার প্রাইমারি স্কুলের চাকরি, বাদলের নিজের ব্যবসায়ের স্বপ্ন পূরণ। সেই সুখের দিনেই এলো বাবলি। চলে গেল মা। সেই কি শুরু দূরত্বের? মাঝে মাঝে ওর মনে হয় উপচে ওঠা সুখ সয়নি ওর। তা ধুয়ে দিয়েছে সমস্ত ঘর বারান্দা।
গতকাল রাতে কাঁদতে কাঁদতে রনিতা বলছিল অমানুষের সঙ্গে ঘর করা যায় না। চলে যাব আমি। সেই কথাটাই সত্যি হল তবে! ও কি একেবারেই চলে গেল?
ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল একই ভাবে, যেমন প্রতিবার হয়। ও বাড়ি ঢুকতেই নাকে কাপড় চাপা দিয়ে রনিতা ওকে বলেছিল এই ভাবে আসতে তোমার লজ্জা করেনা? বাড়িতে দুটো ছোট বাচ্চা আছে। ওদের কথা কি তুমি ভুলে যাও?
বাবলি আর রিনি ঘরের বিছানায় ঘুমোচ্ছিল তখন। তাই ও চুপচাপ বাইরের কাপড় ছেড়ে খাবার টেবিলে বসেছিল, আর বলেছিল, খিদে পেয়েছে। খেতে দাও।
রনিতা কোন জবাব না দিয়ে ঠকাস করে থালা নামিয়ে রুটির বাটি আর তরকারি জায়গাটায় রেখে চলে যাচ্ছিল ঘরে। তখনই মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিল ওর।
চিৎকার করে বলেছিল কুকুর বেড়ালের মত খেতে দেওয়া! লজ্জা করে না তোমার?
রনিতা ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসেছিল। হ্যাঁ, লজ্জা হয় মাঝে মাঝে। তবে সেটা তোমাকে দেখে।
টুলে বসে ঝিমোচ্ছিল ও। মনে হল পেছন থেকে গলাটা জড়িয়ে ধরে বাবলি বলছে, আমাকে ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে যাবে বাবা? একা আমি যাব। বোন যাবে না। ও গেলে ফুচকা কাকু ফুচকায় ঝাল দেয় না।
একটু দূরে বসে মেঝেতে কুটনো কুটছে মা। লাল শাক দেখে ও উবু হয়ে বসল মায়ের পাশে। মা হাসল ওর দিকে তাকিয়ে। জানি রে জানি, রসুন দিয়ে কুঁচি কুঁচি করেই ভাজব। তোর বাবাও ওরকম করে খেতেই ভালোবাসত।
ঘরের মধ্যে থেকে পাউডারের গন্ধ ভেসে আসছে। স্নানের পর কাপড় পাল্টে রনিতা সিঁদুর পরছে হয়ত। পাউডারের পাফ দিয়ে পাউডার বোলাচ্ছে সারা শরীরে।
রিনি বসে আছে সাইকেলে। আস্তে আস্তে প্যাডেল ঘোরাচ্ছে। চেঁচিয়ে বলল বাবা, মাকে বলে দাও না, আমি কাল স্কুলে যাব না।
বাদল বলল আচ্ছা। তখনই চটকাটা ভেঙে গেল। কেউ কোথাও নেই। টেবিলের ওপরে রাখা একটা মাটির ভাঁড় থেকে পিঁপড়ে নামছে সারি দিয়ে। ওই ভাঁড়ে করেই বাবলি রিনির জন্য রসগোল্লা এনেছিল ও। ঢাকাটা সরিয়ে বাদল দেখল এবার। দুটো মিষ্টিই আগের মত পড়ে আছে। তার মানে ওদের দেয়নি রনিতা। কাল রাতে একটু বেশীই গোলমাল হয়েছিল তো।
রনিতার বাঁকা কথার পর একহাতে ধরে ও ছুঁড়ে দিয়েছিল খাবারের থালাটা। ওটা গিয়ে পড়েছিল বারান্দা টপকে উঠোনে। সমস্ত রুটি তরকারি ছত্রখান হয়ে ছড়িয়েছিল। থালা ছোঁড়ার ঝনঝন্ আওয়াজে ঘুম ভেঙে ছুটে এসেছিল বাবলি, রিনি। ভয়ে নীল হয়ে যাওয়া মুখে ওরা জড়িয়ে ধরেছিল ওদের মাকে।
রনিতার সঙ্গে মেয়েদের অদ্ভুত এক সম্পর্ক আছে। লক্ষ্য করেছে ও। যেন ওরা আলাদা নয়। একই গাছের ছাল। মা বাবার ঝগড়া হলে ওরা সবসময় নিঃশব্দে মায়ের পক্ষ নেয়। কাল রাতেও তাই হয়েছিল। তাতে ওদের দোষ দেখে না বাদল। ওদের মা তো দিনরাত ওদের আগলায়। বাবার ভালোবাসা ওরা কবে আর তেমন করে টের পেয়েছে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে একবার বাইরে গেল ও। কিসের একটা আওয়াজ হচ্ছে। অন্ধকারে সাদা গোল গোল বলের মত কি যেন ঘোরাফেরা করছে। মনে পড়ল ওর, বেড়ালের ছানা দুটো। কয়েকদিন আগে এপাড়ার বেড়াল সুন্দরী কয়েকটা বাচ্চা বিইয়েছেন। তাদের মধ্যে দুটোকে উনি এবাড়ির উঠোনের রকের নীচে রেখে দিয়েছেন। সাদা গায়ে কালো কালো ফুটকি ওলা বেড়ালের ছানাদুটোকে বেশ দেখতে! রনিতা বেড়াল পছন্দ করে না। একবার বলেওছিল ওদের সরিয়ে দেবার কথা। বাবলি রিনি বায়না করে রেখে দিয়েছে। ওরা বাচ্চা দুটোকে খেতে দেয়। সকাল থেকে খেতে না পেয়ে খিদের জ্বালায় ছটফট করছে হয়ত।
ঘরে গিয়ে দুটো রুটি নিয়ে এল ও। টুকরো করে ছিঁড়ে একটা বাটিতে রেখে একটু দুধে ভিজিয়ে ওদের সামনে ধরে দিতেই ছুটে এলো বাচ্চাদুটো। চুক্চুক আওয়াজে বাদল বুঝছিলো ওরা খাচ্ছে। ঠিক এরকম আওয়াজ করে রনিতা আচার খায়। বাবলি আর রিনি আইস্ক্রিম খেতেও শব্দ করে ঝোল টানে। আচ্ছা ওরা গেল কোথায়? রনিতা নিশ্চয়ই ওদের নিয়ে বাপের বাড়িতেই গিয়েছে। কিন্তু সেখানে মেয়েগুলো আদর পাবে কি? রনিতার বাবা তো আর বেঁচে নেই। ওর মাকেই দাদা ভাইরা ঠিকমত দেখে না। সেখানে…।
মন ছটফট করতেই হাসি পেল বাদলের। গতকাল রাতে ও যা ব্যবহার করেছে, তারপর এসব চিন্তা ওকে আর মানায় না।
গতরাতে ওরা ফেরেনি। আজ রাতেও কি ফিরবে না? কিন্তু রনিতা তো জানে রাতে ও একা থাকতে পারে না। গত রাতে টলতে টলতে বেরিয়ে ও গজুর ঠেকে পৌঁছয়। গজু বারবার ফিরতে বললেও ফেরেনি। সারা রাত বাড়ির বাইরে এর আগেও থেকেছে। পুজোর প্যান্ডেল সাজাতে হয়েছে আলো দিয়ে। কিংবা বিয়েবাড়ির কাজে, দিনের পর দিন কেটেছে। বাড়ি ফেরা সম্ভব হয়নি। তবে রাগ করে বাড়ি না ফেরা এই প্রথম।
পা ছড়িয়ে বারান্দার পাতা চেয়ারে বসল বাদল। টিপটিপ বৃষ্টিটা আবার বাড়ছে। বেড়ালের বাচ্চাদুটো অন্ধকারের মধ্যে একটা অদ্ভুত আওয়াজ করছে। ঠিকঠাক না বুঝেই টলমল পায়ে এগোল ও। বেড়াল মায়ের কাছে তো ওদের পৌঁছে দেওয়া যাবে না। রকের তলায় ঢুকিয়ে দিতে হবে। রাত বাড়ছে, রনিতা তো এখনো এলো না।
হঠাৎ ক্যাঁচক্যোঁচ আওয়াজ করে বাগানের গেটটা খুলে গেল।কোথা থেকে একটা গোলাপী মেঘ অন্ধকারকে আলো করে নেমে এলো মাটিতে। প্রথমে বাবলি তারপর রিনি ঢুকল বাড়িতে। রিনি ওর গোলাপী বাহারি জামাটা পরেছে। আর মাথায় দিয়েছে সাদা ব্যান্ড। বাবলির সাদা লেসের পোশাক। ওটা নিউমার্কেটের সামনের দোকান থেকে কেনা। একটু বেশী দাম নিলেও জামাটা বেশ সুন্দর, ওকে ভালোই মানায় ।
রনিতাকেও হলুদ রং এর শাড়িতে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। তবে মুখটা খুব গম্ভীর করে রেখেছে। বাদল ওদের দিকে তাকিয়ে হাসে। ফিরে এলে তাহলে?
না ফিরিনি। কিছু জিনিসপত্র নিয়েই একেবারে চলে যাব। তোমার সঙ্গে কোন ভদ্রলোক থাকতে পারে না।
জানি।বাদল ম্লান হাসে। তোমরা থাক। কোথায় আর যাবে। আমি চলে যাচ্ছি।
টেবিলের ওপর সাজানো বোতল গ্লাস রেখে বাদল উঠে দাঁড়ায়। দুপা এগিয়ে রনিতার হাত ধরতে চায় ও। পারে না। টাল সামলাতে না পেরে দাওয়া থেকে সটান উঠোনে আছড়ে পড়ে।
এখন মধ্যরাত। আকাশে, চাঁদের আলোর ধার, ক্রমশঃ কমছে। উঠোনে উপুর হয়ে পড়ে আছে একজন মানুষ। তার শরীরের চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে দুটো ছোট ছোট বেড়াল ছানা। তাদের সাদা গায়ের কালো ফুটকি গুলো অন্ধকারের মধ্যেও বেশ বোঝা যাচ্ছে। মানুষটার চোখ দুটো বোজা। কিন্তু মুখে একটা হাসি লেগে আছে।
রাতের আকাশ থেকে ধীরে ধীরে নেমে এসে, হলুদ চাঁদ, লোকটার কপালে একটা আলতো চুমু দিয়ে আবার আকাশেই ফিরে যায় ।
ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।