| 18 এপ্রিল 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

ভালোবাসার পরিধি

আনুমানিক পঠনকাল: 18 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comসে অনেকদিন হয়ে গেল। তারিখটা মনে নেই। আমি ভাদ্রের পিচগলা রোদে হাতিরপুল বাজারের ফুটপাত দিয়ে খালাম্মাকে হেঁটে আসতে দেখি। হাতে টিফিন ক্যারিয়ার। পায়ে জুতা ছিল না। ট্রাফিক সিগনালে তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়নি। ফুটপাতের মুখ জুড়ে স্তূপ করা পাকা তাল, কাছাকাছি গাদা খানেক আনাজ, ওল বা কচুমুখী। পথচারী পারাপারের বাঁশি বেজে উঠতে, তিনি আনাজপাতির মাঝখান দিয়ে ধীরগতিতে রাস্তায় নেমে গেলেন।

ভাগ্য ভালো, আমার রিকশার হুডতোলা ছিল! কেন ভাবলাম কথাটা? সে কি শুধু চাঁদি-ফাটা রোদ্দুর ছিল বলে?

আমার রিকশা তখন ভূতের গলির অলিতে-গলিতে। ভূতগ্রস্তের মতো চলেছি। সাপ্তাহিক কাগজের আমার বরাদ্দের পাতাটায় এবারও একটা ভুল তথ্য গেল! কোয়েল-কোকিলের বিভ্রাট। (কোয়েলিয়া কোয়েলিয়া মাতর্ক পুকার- বেগম আখতারের সর্বনেশে গানটা কবে শুনেছিলাম!) প্রতিবেদক লিখেছে, আজকাল কোয়েলের চাষ হয় সাভারের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আশা করা যায়, তা অচিরেই দেশময় ছড়িয়ে পড়বে। কোয়েল পাখির ডিম আকারে ছোট হলেও হাঁস-মুরগির ডিমের মতোই উপাদেয়, সুস্বাদু। পোচ-কারি-অমলেট! কতভাবেই না খাওয়া যায়। তাই বাজারে বিক্রি করে কারবারিরা মুনাফাও লুটছে দেদার। এর সুফল যেমন রাতারাতি, কুফলও তেমন সুদূর প্রসারী। সেই সুবাদে কোয়েল-কোকিল সমার্থক হয়ে প্রতিবেদকের উদ্বেগ মারমুখী হয়ে উঠেছে যে সব বাক্যে, এর একটি যেমন, মানুষ ডিম খেয়ে খেয়ে কোকিলের বংশ নাশ করছে। তারপর কুহুতানের আগাম বিরহে এন্তার হা-হুতাশ। আমি নবিশি কলমে তখন তখন ‘ওকে’ করে পাতাটা ছেড়ে দিলাম। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের টেবিলে নিয়ে যাওয়ারও গরজবোধ করিনি। সে কথাটাই মিটিং ডেকে তামাম স্টাফের সামনে বিস্তর হাসি-তামাশা সহযোগে বলা হলো। আমি তো মরমে মরে যাচ্ছি। তারপরও যে চাকরিটা বহাল আছে –  সে কপালজোর। তখনো পরীক্ষার রেজাল্ট হয়নি, বিনা সার্টিফিকেটে কে দেবে নকরি!

‘যা একটা দিন গেল! বিরাট একটা ঝড় বয়ে গেছে। ফাঁড়াও কাটছে মনে হয়।’ আমি বোনের বাসার ডাইনিং টেবিলে জাঁকিয়ে বসে বলি। ও আমার ছোট হলেও কম বয়সে বিয়ে করে গুছিয়ে সংসার করছে। স্বামীর রোজগার ভালো। ইচ্ছামতো দানখয়রাত করায়, চলাফেরায় বাধা নেই।

‘সমস্যাটা কী?’ প্রশ্নটা করে ও দাঁড়ায় না, খাবার গরম করতে রান্নাঘরে চলে যায়। গ্যাসের চুলা ধরায়। তখনো ঢাকার মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে শরীরের ক্ষতিকারক মাইক্রো ওয়েভ যন্ত্রটার চল হয়নি।

রোজই আমার কোনো না কোনো সমস্যা থাকে। আজকের সমস্যাটা কী। অফিসের কথা আর বলতে ইচ্ছে করে না। ‘খালাম্মা রাজপথ দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন।’ কথাটা মুখ ফসকে বেরোতে নিজের কানেই কেমন রূঢ় শোনায়।

তাঁর বড় ছেলের ফুসফুস ক্যান্সার। মহাখালি বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। বড় জোর আর দু-তিন মাস। ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিয়েছে। কথাগুলো এ রকম নির্বিকারভাবে বলে, আমার বোন নুডল-ভর্তি ফ্রাইপ্যান টেবিলম্যাটে রাখে।

খালাম্মা যেমন ঘোরের মধ্যে হাঁটছিলেন, আমি ধূমায়িত খাবার সামনে সুস্থির হয়ে ভাবি, তাঁর মহাখালি পৌঁছাতে বেলা গড়াবে। এখন হয়তো বিজি প্রেসের পর সাত রাস্তার মোড়ের কাছাকাছি। বড় জোর ইউক্যালিপটাসের আইল্যান্ড ছাড়িয়ে তেজগাঁমুখী প্রশস্ত সড়কে পড়েছেন। পায়ের নিচে খোয়া-ওঠা ফুটপাত। মাথায় ছায়া নেই। মৃদু বাতাসে থেকে থেকে বেকারির ঘ্রাণ ভেসে আসে। তাঁর ছেলে নাবিস্কো বিস্কুট খেতে বড় ভালোবাসতো। হয়তো ফোস্কা পড়া পায়ে পথ চলতে চলতে ভাবছেন খালাম্মা।

‘খালি পায়ে হাঁটা, খালাম্মার বদ-অভ্যাস। ক’দিন আগে হয়েছে।’ নুডলসে গোলমরিচের গুঁড়া ছড়িয়ে দিয়ে গল্প শুরু করার ঢঙে বলে আমার ছোট বোন। স্বরটা অসম্ভব তিক্ত। খালাম্মা এই গেল-মাসে বাড়ি বয়ে অনেক কটু কথা বলে গেছেন। তা-ও আব্বা-আম্মার নাম ধরে। কে তাঁর বাড়াভাতে ছাই দিয়েছে?

আমার বোনকে এমন চটতে দেখা যায় না কখনো। ওর দয়ার শরীর। মানুষের বিপদে-আপদে সব সময় ঝাঁপিয়ে পড়ে। আপন-পর হিসাব করে না। একবার ওর শাশুড়ির কাজের মেয়ে ফুলের টবসুদ্ধ পাঁচতলার ছাদ থেকে পড়ে যায়। মেয়েটা হয়তো মরেই যেত, ওর পর্যাপ্ত সেবা-শুশ্রুষা না পেলে। ঢাকা মেডিকেলের ফিমেল ওয়ার্ডে বাচ্চা মুরগির স্যুপ বানিয়ে নিয়ে গেছে রোজ। নিজ হাতে নোংরা বেড পরিষ্কার করে রক্তমাখা কাপড়-চোপড় কাচা-কুচির জন্য বাসায় বয়ে এনেছে। মেয়েটার তো থেঁতলানো হাড়-মাংসে পচন শুরু হয়েছিল। ‘আপনাকে গোল্ড মেডেল দেয়া উচিত, আপা,’ এক ইন্টার্ন ছোকড়া আমার বোনকে বলেছিলো ‘আপনে যমের দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনছেন মেয়েটারে।’

‘এমন আলগা দরদ সবাই দেখাইতে পারে,’ খালাম্মার দিকে এক সময় আমাকে হেলে পড়তে দেখে বোন রেগে আগুন। ‘তুমি তো তীরে বসে রোদ পোহাও। কারো উপকারে লাগছো কোনোদিন?’

আমার কি চাল-চুলা আছে? আগে চাকরিটা পোক্ত হোক, তারপর দেখা যাবে কারো উপকারে লাগি কিনা। কথাটা বলতে গিয়ে আমি জিবের নিচে লুকিয়ে ফেলি। রিকশার হুডতোলা ছিল বলে যে স্বস্তিবোধ করেছি, সেটা মনে পড়ে যায়। বোনের সঙ্গে মিটমাটও করি সঙ্গে সঙ্গে। তা সম্ভবত ওপর-ওপর। ওর অস্থির আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আমি তখন না-ভেবে পারি না যে, ভুল-ত্রুটি যাই থাক, সে কি খালাম্মার একার? বিষয়টা কেমন যেন কাঁটার মতো গলায় বিঁধতে থাকে।

খালাম্মার বিয়ে হয় এগারোতে। বর নাবালক ছিলেন না। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়তে পড়তে মিলিটারিতে নাম লেখান। বৃটিশরাজ জাপান-জার্মানির বিরুদ্ধে ফ্রন্ট খুলেছে। দেদার সৈন্য প্রয়োজন। জামশেদপুর ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার আগে গার্জিয়ানের পারমিশনের জন্য তাঁর ছুটি মঞ্জুর হয়েছিল মাত্র পাঁচ দিন। বাড়ি আসার তৃতীয় দিনে বিয়ে পড়ানো হয়। ধুতি-পিরান আর বিদ্যাসাগরী চটিতে লক্কা কবুতরের মতো শ্বশুরবাড়ির এক উঠান থেকে আরেক উঠান। শালা-শালী তো আছেই, অন্তঃপুরবাসিনী বউগুলোও একেকটা বিচ্ছু। দিনের বাকি সময়টা কাটে ধুতির কোঁচা থেকে ব্যাঙ ঝাড়তে ঝাড়তে আর নুন গোলা শরবত গিলে। রাতে কাছারি ঘরে বিছানা পড়ে। বাপের সঙ্গে এক বিছানায় দু রাত ঘুমিয়ে, যখন গরুর গাড়িতে লটবহর তোলা সারা, তখন দুজন বৃদ্ধা বউকে পুঁটলি বানিয়ে টানতে টানতে হাজির। ঘর-ভর্তি মানুষ। কোনোক্রমে কদমবুসি সেরে পোঁটলাটা নিমেষেই গায়েব। দুসরা-বার কেউ কারো মুখ দেখারও ফুরসত পেল না। তবু গাড়ির চাকার দাগ মোছার আগেই সেই বউয়ের নামে বানের জলের মতো চিঠি আসতে শুরু করে।

বিয়ের দিন সাতেক পর খালাম্মা যখন হাতের চুড়ি বাজিয়ে পাড়া বেড়াতে বের হন, তখন তাঁর স্বামী পিঠঠু প্যারেড করছেন। মিষ্টিমুখের সময় হাত আয়নায় বালিকা বধূর পলকহীন চাহনি তাঁর কলজেয় বিঁধে গিয়েছিল। তা থেকে লেফট-রাইট পা ফেলায় ভুলচুক। স্কোয়াড কমান্ডারের ‘কদম মেলাও’ হাঁকেও কাজ হয় না। দেখতে দেখতে গোটা কোম্পানিতে তা সংক্রমিত হয়। ফলত খরখরে রোদে আধমণী বোঝা পিঠে ডবল মার্চ। 

এসব সাজা প্রাপ্তির খবর বরাবর উহ্যই থাকত খালাম্মার স্বামীর চিঠিতে। তিনি জামশেদপুরের তাঁবুর মাচায় শুয়ে নববধূকে লিখতেন, খাকি পোশাকে প্যারেড করছেন কঙ্করময় পাহাড়ের পাদদেশে। বা ডাল-রুটি চেটে-পুটে খেয়ে নদীর ঘোলা জলে থালা ধুইছেন। একশো আশি পাউন্ডের তাঁবুতে আটজনের ঠাঁই। বিছানা বলতে ডারি-লোহি-চাদর-চারপাই। ঘড়ি ধরে তাঁদের ঘুমাতে হলেও গোরা সাহেবদের জন্য অন্য নিয়ম। তাঁরা আকণ্ঠ মদ গিলে কেন্টিন-কাউন্টারের বেবি-পেট্রোম্যাক্সের জ্বলজ্বলে আলোয় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান নার্সদের নিয়ে ফস্টিনস্টি করত। নেটিভ সেন্ট্রি বা কেন্টিন বয়দের নাকের ডগায়।

খালাম্মার জন্য এসব বিষয় ছিল যারপরনাই কঠিন। শব্দগুলোও দাঁতভাঙা, বুদ্ধির অগম্য। যদিও সেই বয়সে ‘আনোয়ারা’, ‘জোহরা’ তাঁর পড়া সারা। মৌলবি সাহেব উর্দু কিতাব ‘বেহেশতি জেওর’ পিঠাপিঠি তিন বোনকে বাংলা তর্জমা করে শোনাতেন যখন, নানাজান ছড়ি হাতে দুয়ারে বসে থাকতেন। সামান্য অমনোযোগী হওয়া বা পড়ার মাঝখানে উঠে যাওয়ার সুযোগই ছিল না।

দম আটকানো ঘরের সেই কেতাবি বিদ্যা যখন চিঠির পাঠোদ্ধারে ব্যর্থ হয়, স্বামীর প্রতি রাতারাতি ভক্তি বেড়ে যায় খালাম্মার। চিঠিরও কদর বাড়ে। বিয়ের পর বাপের বাড়ির বাধা-নিষেধ ঢিলেঢালা। এখন থেকে মেয়ের পাপের বোঝা যেহেতু স্বামীতে বর্তায়, শরিকি পুকুরে দিনদুপুরে সাঁতার কাটায় বা ঘাগরা, শাড়ি কোমরে গোছ দিয়ে গাছে চড়ায় নিষেধ নেই। পেছনের খিড়কিপথে পাড়া বেড়াতে বের হলে, নানি বিলাতি ধনেপাতা বা লতালুর চারায় পানি ছিটাতে ছিটাতে ঘড়ি দেখার মতো আকাশের দিকে এক ঝলক তাকাতেন। কন্যা বেলাবেলি ঘরে ফিরলেই হলো। কিন্তু এ হঠাৎ পাওয়া স্বাধীনতা খালাম্মার কাছে তখন অর্থহীন, মনে হয় সময়ের অপচয় বা বালখিল্যতা। তিনি স্বেচ্ছায় ঘরবন্দী হয়ে রইলেন কিছু দিন। তারপর চিঠির গোছা বালিশ-চাপা দিয়ে যখন দুয়ারে আড়মোড়া ভেঙে দাঁড়ালেন, ততদিনে তাঁর স্বামী জলন্ধরের পথে। পাঞ্জাব মেলে চড়ে বসেছেন। তখনো রেলস্টেশনের বাতিগুলোতে ব্ল্যাকআউটের ঢাকনা পড়েনি। তৈরি হয়নি স্টেশন মাস্টারের ঘরের দরজায় ব্যাফল-ওয়াল। ট্রেন চলার বিরতিতে প্যারেড। আম্বালায় যখন খালাম্মার স্বামী লেফট-রাইট করছেন, তখন নাজি জেনারেল রমেল উত্তর-আফ্রিকার দ্বারপ্রান্তে, অতর্কিত আক্রমণের জন্য পরে যে মরু শিয়াল নামে আখ্যাত হবে।

পাঞ্জাবের জলন্ধরে তখন হেডকোয়ার্টার। ওখান থেকে কে কোন ফ্রন্টে চালান হবে, কোম্পানির কেউ জানে না। করাচিগামী ট্রেনে উঠে বসার পর খালাম্মার স্বামী বুঝতে পারলেন, তাঁকে জাপান নয় জার্মানির বিরুদ্ধে পাঠানো হচ্ছে। ছাত্রাবস্থায় সুভাস বসুর প্রতি আকৃষ্ঠ হয়েছিলেন। পূর্বরণাঙ্গনে নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজে ভিড়ে যাওয়ার মনে মনে যে স্বপ্ন ছিল, তা ভেস্তে গেল। তিনি সেই নির্ঘুম রাতে ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণীতে দুলতে দুলতে সিন্ধু অববাহিকার কোনো এক অচেনা শহর পেরিয়ে যান। মুখে লেমনেডের টক-মিষ্টি স্বাদ। করাচির ডাকে ফেলা চিঠিতে লেখা, এক বাটি দুম্বার গোশতের সুরুয়ায় জনা চারেক ফৌজ মিলে রুটি চুবিয়ে খেয়েছেন। এ যেন অমৃত। চারটা ভাত পেলে কতই না ভালো হতো। বিকালে ব্যারাকের লাগোয়া চায়ের দোকান থেকে রাবড়ি, গরম দুধ, সন্দেশ নিজের গাঁটের পয়সায় খাওয়া চলে। তা-ও বেশি দিন কপালে সইল না। পরের চিঠিতে লিখছেন, মাটি ল্যাপা চাটির ব্যারাক ছেড়ে এবার সমুদ্র পথে বসরা। জাহাজে তাঁবু, গোলাবারুদ ও রসদের সঙ্গে অ্যানিমেল ট্রান্সপোর্ট সেকশনের খচ্চর-ঘোড়াও তোলা হয়েছে। সৈনিকের জীবন তো যাযাবরের! হয়তো একেই বলে দুর্ভাগ্য।

এ কার দুর্ভাগ্য! সৈনিক লোকটার না খালাম্মার? যে অচেনা দুনিয়ার ছবি আঁকতে আঁকতে খালাম্মার স্বামী এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁর মাটি ছেড়ে সাগরে ভাসাটা যেন এর যবনিকা। পৃথিবীরও শেষ ওইখানে। জাহাজ থেকে শাতিল আরব তীরের খেজুরবাগান চোখের সামনে ফুটে ওঠার আগপর্যন্ত খালাম্মার খুব অস্থির লাগে। এর মধ্যে গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো মাসিক শুরু হয়। এ যেন অসম্ভব শক্তি ধরে এমন এক শারীরিক ব্যাধি। মাসে মাসে এর হ্যাপা সামলাও। উঠতে-বসতে মা আর বড় বোনদের গায়ে-পড়া উপদেশ কার সহ্য হয়! যাকে এ কষ্টের কথা বলা যেত, সে তখন বসরা বন্দরে। খাস রণাঙ্গনে প্রবেশ বাবদ বেতনের ওপর মাসিক ভাতা পাঁচ টাকা, ডবল রেশন আর ডাকমাসুল ফ্রি। বিনিময়ে গলায় ঝুলেছে আইডেনটিটি ডিস্ক, যার মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রে হত বা আহত হলে তাঁকে শনাক্ত করা হবে।

ঘরের পুরু দেয়ালগুলো খালাম্মাকে ভীষণভাবে চেপে ধরে। এ যেন যুদ্ধক্ষেত্রের বাঙ্কার, যা তাঁর স্বামীর চিঠিতে রয়েছে। এর প্রায়ান্ধকার কোণ থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া জড়িয়ে উঠে আসে বাঙ্কারের মতোই ইঁদুর-পচা দুর্গন্ধ।

অথচ বাড়িটা আমাদের কাছে ছিল স্বপ্নপুরী। গরম বা শীতের ছুটিতে মামাবাড়ি যাওয়ার মতো আনন্দ কিছুতেই ছিল না। এখনো ছুটি বলতে বুঝি, ব্যাগ টানতে টানতে দেউড়ির উঁচু চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে ছায়া-ঢাকা পরিষ্কার উঠানে ঢুকছি, যার ধার ঘেঁষে বেলি, গন্ধরাজ, হাস্নাহেনার একহারা সুগন্ধি বাগান। মনে আছে, বাড়িটা উঁচু সিলিংয়ের হওয়া সত্ত্বেও পর্যাপ্ত জানালার অভাবে একে গুহা মনে হত। এর বদ্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াত আমাদের প্রিয় খাবারের ঘ্রাণ। দিনের বেলা পারত ওখানে ঢোকা হত না। উদলা নায়ে দিনমান খালে-বিলে। কোঁচর-ভর্তি ঢ্যাপ, কাঁটাযুক্ত পানিফল আর গলায় মালার মতো শাপলা পেঁচিয়ে গায়ে আঁশটে গন্ধ নিয়ে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা।

নানার জমানায়ও ঘাটে ডিঙি-নাও বাঁধা থাকত। গা-টা গাবের পানিতে ধোয়া, আরও মজবুত, চকচকে জেল্লাদার। ছিল বছর-চুক্তি সুঠাম দেহের মাঝি। কিন্তু নানাজানের জীবিতাবস্থায় বয়স সাত-আট বছর ডিঙ্গানো মেয়েদের তাতে চড়ে বেড়ানোর ইজাজত ছিল না। তখন রান্নাঘরের পেছনের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলে মামাদের পড়ার ঘর। সামনে পরীক্ষা, তাই ওখানেই তাঁরা খেতেন, ঘুমাতেন। দেয়ালে ঝোলানো আয়নায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেউরি করতেন। ছোট ছোট লোহার গরাদের জানালায় হাত গলিয়ে মৌসুমের আম-পেয়ারা খাটে বসেই তখন ছিঁড়ে খাওয়া যেত। গাছের ফাঁক দিয়ে এক চিলতে আকাশও নজরে পড়ত। আমরা যখন দেখি, দোতলাটা ততদিনে পরিত্যক্ত। সিঁড়িটা নড়বড়ে। ইটের ফাঁকে ফাঁকে আগাছা বা শেকড়-বিস্তারি অশথ-চারা গজিয়ে গেছে। লাল সুরকির গুঁড়া দিয়ে আমরা জমিয়ে রান্না-বাটি খেলতাম তখন।

যুদ্ধের সেই অস্থির দিনগুলোতে খালাম্মার দিনমান কাটে ওখানে। তিনি যেখানে যান, সেখানেই উত্তেজনা, কলরব। তখন বড় ভাইদের পরীক্ষা বানচাল করাই যেন তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য। ঘন ঘন নালিশ যাচ্ছিল নানাজানের কাছে। তিনি যখন মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর ফন্দি-ফিকির করছেন, তখন খালাম্মার শাশুড়ির মৃত্যু সংবাদ আসে। খালাম্মার স্বামী বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। শ্বশুরকে এক মুঠো চাল ফুটিয়ে দেওয়ারও কেউ নেই। এভাবে বারো বছর বয়সে ঠিকানা বদলে গেল খালাম্মার। জীবনটাই বদলে গেল, বলতে গেলে। রসুই থেকে গোয়ালঘর, গোটা সংসারের বোঝা তাঁর একার কাঁধে। ডাকে আসা চিঠিগুলোতেও তখন হলুদ-মশলার দাগ লাগতে শুরু করে।

দিনের বেলা চিঠি পড়ার সময় বা সুযোগ হতো না খালাম্মার। বাজার থেকে কেরোসিনও উধাও। রাতে রেড়ির তেলের বাতি জ্বেলে চিঠির ভাঁজ খুলতেই ছেঁচা বাঁশের পার্টিশনের ওপাশে শ্বশুরের হায় হোসেন হায় হোসেন মাতম। ‘ভূঁইয়ার ঝি আমারে পথে বসাইল রে!’ তখন বড় বড় শহরগুলোতে ব্ল্যাকআউটের ঘনঘটা। যেখানে বিজলি-বাতি, সেখানেই তা খাটে। জাপানি বোমার নিশানাও ওখানে। বোমার চেয়ে শ্বশুরের কিপটামির দৌরাত্ম কি কম? খালাম্মা পাতিলের কালিতে হারিকেনের চিমনির উর্ধাংশ ঢেকে দিয়ে ব্ল্যাকআউটের ঢাকনা বানালেন। দিনে এ নিয়ে সে কি উত্তেজনা। রাতে দেখা গেল, এ নেহায়েতই পণ্ডশ্রম। চিমনির নিচে মেলে ধরা পত্রখানার লেখক যেন অন্য কেউ, যে ততদিনে ফুটা বেলুনের মতো চুপসে গেছে।

অথচ শাতিল আরব পৌঁছে খালাম্মার স্বামীর মনটা আনন্দে নেচে উঠেছিল। দাজলা-ফোরাতের পবিত্র জল মিশেছে মোহনায়। তীর জুড়ে সুদীর্ঘ খেজুরবন। হজরত মুহম্মদ (সঃ)-এর প্রিয় ফল, তখন পক্ক না হলেও বাহারি। মরুবালুতে তাম্বু গাড়া, ট্রেঞ্চ খোঁড়ার কাজ করতে করতে কখন যেন এ সুখানুভূতি উবে গিয়ে মনটা উৎকণ্ঠায় ভরে উঠল। নেপথ্যে নাজি-ফ্যাসি যেই থাক, সামনে যে আগুয়ান শত্রু, সে ধর্ম ও জাতিগত উভয় দিক থেকেই আত্মার আত্মীয়। তাঁদের বন্দুকের গুলিতে রক্তাক্ত হবে ধর্মভাই, যারা আবার তাঁদেরই মতো ইংরেজ আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। বাগদাদে উড়ে এসে জেহাদের ডাক দিয়েছেন তো ফিলিস্তিনের গ্র্যান্ড মুফতি আমিন আল হোসাইনি।

বসরাতে তখন ফৌজ উপচে পড়ছে। মুভ করার অনুমতি নেই সদ্য ক্ষমতাসীন ইংরেজ-বিরোধী ন্যাশনাল ডিফেন্স গভর্মেন্টের কর্ণধার রশিদ আলীর। ফলে বসরাতেই তাঁদের থাকতে হয় কিছু দিন। কেউ সানট্রোক বা ছোট ছোট মাছির কামড় খেয়ে স্যান্ড ফ্রাই ফিভারে আক্রান্ত হচ্ছে। এরপর বার্জে করে ফোরাত নদীতে ভাসতে মরুভূমির দুর্মর চেহারা ফুটে ওঠে। যুদ্ধের উত্তাপে আরও গরম। ইউনিফরমের তলায় সবাই আরও বেশি ঘর্মাক্ত। পথে পড়ে নাজাফ-কারবালা। নাজাফে হজরত আলীর মাজার। কারবালায় ইমাম হোসেনের। তীরে নেমে মাজার জিয়ারতের অনুমতি নেই। ফাল্লুজায়, হাব্বানিয়াতে তুমুল লড়াই করেছে ইরাকবাহিনী। বৃটিশের এয়াররেডে মরেছেও দেদার। ফাল্লুজার পথে-প্রান্তরে বিধস্ত বাঙ্কার, রক্তমাখা পাগড়ি, ভাঙা তলোয়ার, খণ্ডিত দেহ – মনটা আরও বিষিয়ে তোলে। বিবেক ক্ষতবিক্ষত। আরব ন্যাশনালিস্ট রশিদ আলী আর বাংলার নেতাজিতে ফারাক কী। দুজনেই অক্ষশক্তির সঙ্গে জোট বেঁধে সমূলে ইংরেজ তাড়াতে চান। রোলগোল্ডের গোল চশমা দুজনের। নেতাজির গোঁফ নেই। হিটলারি বাটার-ফ্লাই গোঁফ রেখেছেন রশিদ আলী।

তখনো বাগদাদের দিকের সব কটি রাস্তাই বন্ধ। রশিদ আলীর পলায়নের খবর আসে মরুপথে বাগদাদগামী আরমার্ড-কারে চলতে চলতে। রশিদ আলী ইরানে আশ্রয় নিয়েছেন। মুফতিও সঙ্গে গেছেন। বাগদাদের ইহুদিদের ওপর ইরাকি ফৌজ-আমজনতা চড়াও হয়েছে। ফিলিস্তিনে ইহুদি পুনর্বাসনের বিরুদ্ধে মুফতির যে জেহাদ, যার জন্য হিটলারের সঙ্গে গাঁটছড়া, তা তখন পানির মতো পরিষ্কার। 

তাঁবুতে শুয়ে খালাম্মার স্বামীর নিজেকে মনে হয় কীটানু কীট বা ফৌজি পোশাকে ভাড়া-খাটা গোলাম, নিজের তন-মনের ওপর যার হক নেই। ইংরেজের ডেকে আনা দুর্ভিক্ষে তাঁর দেশের লোক মাছির মতো মারা যাচ্ছে। বিনা প্রতিরোধে জাপানি ফৌজ ইম্ফল ডিঙ্গিয়ে পাহাড়ে-অরণ্যে-লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। কোহিমার পতন যখন-তখন। যুদ্ধাক্রান্ত মানুষগুলো তো নেটিভ, ওদের জীবনের মূল্য কী। বোবা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে খালাম্মার স্বামী ভাবেন, বেকার হোস্টেলের সেই সঙ্গীরা আজ কোথায়, যারা একদিন থিয়েটার রোড দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্বপ্ন দেখেছিল, ইংরেজের অস্ত্র দিয়ে ইংরেজ খেদানোর! এখন নিজেরাই বরং তাঁবেদার ফৌজের ছাঁচে ঢালাই হয়ে যাচ্ছে ফ্রন্ট থেকে ফ্রন্টে।

এসব ঘোরতর চিন্তা চিঠিতে ব্যক্ত করার সুযোগ ছিল না। তখন এক নামহীন সখার সলজ্জ কমনীয় মুখ হঠাৎ হঠাৎ উঁকি দিতে শুরু করে। যে পরম যত্নে বুট পালিশ করে দেয়, ইউনিফরম পাট করে কম্বলের নিচে চাপা দিয়ে রাখে, বুটের ফিতা-পট্টি বেঁধে দিয়ে সযত্নে চিন-স্ট্রেপও এঁটে দেয়, লঙ্গরখানার বরাদ্দের খাবার রেশন-টিনে ভরে হেভারসেকে তুলে দেয়, যখন রাতের সেন্ট্রি ডিউটি থাকে।

তা সত্ত্বেও খালাম্মার স্বামী ফ্রন্ট থেকে মরু শিয়াল রমেলের মতো নিয়মিত পত্র লিখতেন স্ত্রীকে। খাকি পোশাকের নিচে তাঁর একটা কবি মন ছিল। শুরুতে রেলগাড়ির জানালা দিয়ে দেখা কোনো মনোরম দৃশ্য, মরুপথে উটের কাফেলা, কালান্তরের পরিত্যক্ত পাথুরে সরাই বা নদীর বুক ছুঁয়ে উড়ে যাওয়া কোনো অচেনা পাখির বর্ণিল পালকের বর্ণনা থাকত চিঠিতে। খেজুরপাকার দিনগুলোতে ধূসর বা তামাটে মরুপ্রান্তর যখন স্বর্ণাভা ছড়াত, চিঠিতে লিখতেন, মনটা কেমন আনচান করে। তেল চকচকে ভুট্টা ক্ষেত, গাছে গাছে ডালিম, থিন, নাশপাতি, লোহিত বর্ণের খেজুর। নিস্প্রদীপ বাঙ্কার বা হু-হু কান্নার মতো সাইরেন বাজিয়ে উড়ে আসা যুদ্ধ বিমানের বর্ণনা থাকত কদাচিৎ।

অ্যাংলো-ইরাক যুদ্ধ শেষে ফের ইংরেজদের পুতুল সরকার ক্ষমতায়। ডাকাতের ধন পাহারা দিতে খালাম্মার স্বামীর কোম্পানি যুদ্ধের বাকি বছরগুলোতে সিরিয়া-ইরাক করেছে। আলেপ্পো থেকে তুর্কির সীমান্ত উত্তর-পশ্চিম সিরিয়া বেষ্টন করে মসুল, বাগদাদ। মসুলে ইউনুস নবীর মাজার। হাতিয়ার-ইউনিফরম বাইরে রেখে ভেতরে ঢোকার পর আর বেরোতে ইচ্ছা করেনি। মনে হয়েছিল, মাছের পেটের মতো জায়গাটা যুদ্ধের বাইরে, নিরাপদ।

খালাম্মা তখন চিঠির ভাঁজে ভাঁজে স্বামীর দোসরের গন্ধ খুঁজে বেড়াতেন। সে যদি সঙ্গে আসে, করিৎকর্মা তায় পুরুষমানুষ যখন, গাই গরুটার ভালোই যত্ন-আত্তি হবে। ঘাস কেটে আনবে দূর থেকে। বা পুকুরে ডোবানো নৌকাটা টেনে তুলে নিজেই দাঁড় বেয়ে কচুরিপানা আনতে বিল-বাওরে চলে যাবে। দুর্ভিক্ষ তখন চরমে। তিনি মাটির চারিতে যেটুকু খুদ-ফ্যান ঢেলে আসেন, ভুখা মানুষ তা চেটে-পুটে খেয়ে যায়। গরুটা বাছুরসমেত উপোস করে।

৩.

সেই বাছুরটাই যখন বড় হয়ে দ্বিতীয় দফায় বাচ্চা দিল, তখন খালাম্মার স্বামী একাই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এলেন। নৌকা থেকে পল্টনি পোশাকে নামতেই গাঁয়ে পালানোর ধুম লেগে যায়। খানিকবাদে উঠানে তিল ধারণেরও ঠাঁই নেই। ঘরের দুয়ারে কুলুপ। তিনি ছড়ি হাতে নিজের বাক্স-পেঁটরায় বসে রইলেন। সেই অবস্থায় পিতার মৃত্যুসংবাদ পড়শির মুখ থেকে শুনতে হয়। তাঁকে খামোশ দেখে ভিড়ে গুঞ্জন ওঠে, বউটা কেমন খোদার জাহিল, শ্বশুরের মরার খবর গোপন রাখে! বাড়িতে পিয়নের আনাগোনা তারা নিজের চোখেই দেখেছে। তবে কি পাক্কা দুইটা বছর সে চুলকানির কথা লিখত স্বামীকে?

‘কী শুনি বাবা! লোকে বলে, তুমি বড় মিয়াভাইয়ের মৃত্যুসম্বাদ পাও নাই?’ গাঁয়ের চাচা-সম্পর্কীয় মুরুব্বি লাঠি ঠুকঠুকিয়ে এসে যখন কাঁধে হাত রাখেন, খালাম্মার স্বামী মাথা থেকে শোলার হ্যাট নামিয়ে উঠে দাঁড়ান। বেঙ্গল থেকে যাওয়া প্রতিটা চিঠিতেই তখন দুর্ভিক্ষে মানুষ মারা যাওয়ার খবর। কর্তৃপক্ষ তাই কলমের খোঁচায় লাইন-লাইন হাপিস করে দিচ্ছিল। সেই ধাক্কায় বাবার মৃত্যুসংবাদটা হয়তো সেন্সর হয়ে গেছে। যদিও তিনি মামুলি সর্দি-জ্বরেই মারা গেছেন। খালাম্মার স্বামী যখন থ্রি-কোয়ার্টার খাকি প্যান্টে বাবার কবর জিয়ারতের জন্য পা বাড়ান, তখন গাইয়ের দড়ি ধরে বউ হাজির। কচি বাছুরটা লাফাচ্ছে আগে আগে। তাঁকে বাড়ি থেকে বেরোতে দেখে বউ নাক পর্যন্ত ঘোমটা টেনে গোয়াল ঘরের দিকে চলে যায়।

এ কি সেই মেয়ে, যে মিষ্টিমুখের সময় তাঁর চোখে চোখ রেখে পলকহীন তাকিয়েছিল – বাবার কবরের সামনে মোনাজাত ধরে খালাম্মার স্বামী ভেবে ভেবে আকুল হন। রাতে পাশাপাশি শুয়ে মনে হলো, যুদ্ধ যেন তাঁর বউয়ের শরীরে এক তাল গোবর মাখিয়ে দিয়ে গেছে। চিঠিতে তো এ বদগন্ধ ছিল না! শেষমেষ একটা কবিতা ছিল, ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনি ’পরে। সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’ সেই কচি মুখটার কথা ভেবে তিনি চিঠি পড়তে পড়তে বেদম হেসেছিলেন। যদিও তাঁর কাছে ছত্র দুটির কোনো অর্থ ছিল না। তখন হজ করার অনুমতি না পাওয়ায় কোম্পানিতে খুব গোলমাল চলছিল। তাঁরা কাবাশরিফ দর্শন না করে আরবমুলুক ছেড়ে যাবেন, তা কিছুতেই হতে পারে না। সেই ক্ষোভের কথা জানিয়েছিলেন স্ত্রীকে। তার উত্তরে এই কবিতা। কথাটা মনে পড়তে অন্ধকারেই হাসলেন তিনি।

ভোর না হতে বিউগলের আওয়াজে ছুটে গিয়ে ফল ইন করা বহুদিনের অভ্যাস। কাক ডাকার আগেই তাই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। চোখ রগড়ে দেখেন বিছানা খালি। বউ উঠানের কোণের চারিতে খৈল-ভুসি গুলে গাইয়ের খাবার বানাচ্ছে। খালি বাড়িতে তিল তিল গড়ে ওঠা বউয়ের যে একার জীবন, তা তাঁর হাতের বাইরে চলে গেছে। ওখানে প্রবেশাধিকারও নেই তাঁর। নিজের সেই ইচ্ছাটাও কখন যেন মরে গেছে। বউয়ের বাহুবন্ধনে বাঙ্কারের সহযোদ্ধাদের মনে পড়তো। হাত দিয়ে ছুঁতে চাইতেন সখাকে। পেশীবহুল হাত, ইউনিফরমের বোতাম খোলা লোমশ বুক, মরা বোঁটার বর্তুল। একবার সডমির অভিযোগ ওঠে। কোর্ট মার্শালও হয়। বৈদ্যুতিক পিলারে কষে বেঁধে বত্রিশ বেত্রাঘাত। অন্ধকারে বউ পিঠ হাতাতে তিনি ধুসমুসিয়ে উঠে বসেন। ‘ও কিছু না, ও কিছু না’ বললেও কে শোনে কার কথা। বউ যখন কুপি হাতে বিছানায় উঠে বসে, তখন তাঁকে পিঠের কাপড় সরিয়ে উপুড় হয়ে শুতেই হয়। ইংরেজ মেজরকে শাপ-শাপান্ত করলেও কোর্ট মার্শালের কারণ বউ জানতে চায় না। কাকে বাতির নিচে বসে রাত জেগে চিঠি লেখেন, তাতেও কৌতুহল নেই। তাঁর ভাবতে অবাক লাগে, এ রকম নিবিষ্টতায় একদিন বউকেও তিনি চিঠি লিখতেন, যখন সখা আশপাশ ঘুর ঘুর করত। এ কেমন দ্বিচারিতা!

এক রাতে তিনি স্বপ্ন দেখলেন, মরুবালুতে লাল নিশান পুঁতে চাঁদমারি হচ্ছে। বাঁ চোখ বুজে টারগেটের ওপর নিশানা করতে ঝাপসাভাবে নজরে পড়ে একটা খোলা বই। ‘তুমহারা সামনে জার্মান দুশমন। ঠিকসে নিশানা লেও।’ পরমুহুর্তে লেফটেন্যান্টের হুকুম, “ফায়ার!” বইয়ের পাতাগুলো পাখির পালকের মতো উড়তে থাকলে ছুটে গিয়ে দেখেন, ‘বিষাদসিন্ধু’ যা রোজ রাতে বউ হাতে করে বিছানায় আসে। আর দু’পাতা পড়েই ঘুমে তলিয়ে যায়। আগে এরকম স্বপ্ন দেখে বউকে জড়িয়ে ধরলে, সেও জেগে উঠে সাড়া দিত। কদিন হয়, পাশ ফিরে শোয় বা বিছানার আরেক প্রান্তে সরে যায়। তাহলে কি গোপন পত্র-চালাচালি জেনে গেছে? বয়স কম হলে কী, বোকা তো নয়। এক হাতে ঘরদোর, কামলা-কামিন সামলায়।

‘যুদ্ধশেষে এই নিষ্ঠুর, খুনি মনটা নিয়ে আমরা ঘরে ফিরব,’ ফ্রন্টের এক বড়ভাই বাগদাদ থেকে মসুল যাওয়ার পথে বলেছিলেন। ‘আর আপনজনের জীবন বিষিয়ে তুলব।’ কে আপনজন? বউয়ের পাশে শুয়ে তিনি আকাশ-পাতাল এক করেন। যে বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়ে বাঁচায়, চাদরের মতো জড়িয়ে গোলার আঘাত থেকে রক্ষা করে, বরফ-শীতল বাঙ্কারে জমে পাথর হতে হতে যার দেহের উত্তাপ বেঁচে ওঠার আশা জাগায়, তার চেয়ে আপনজন কে। যুদ্ধ শেষ হয়েছে বলে সে পর হয়ে যাবে! তবু মন্দের ভালো, ছুটি মাত্র দু’মাসের। সামনে আরেকটা যুদ্ধ। তা নকরির। দক্ষিণ থেকে সখা আসবে। তাঁরা কলকাতার এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের দপ্তরের সামনে দাঁড়াবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।

সেই আনন্দে বউয়ের একা বাড়িতে থাকা না-থাকার ভাবনাটা তলিয়ে যায়। যাওয়ার আগ দিয়ে লাঠি ঠুকঠুকিয়ে আসেন সেই মুরুব্বি। হের হিটলার সামনাসামনি দেখতে কেমন নেতাজির চেলা এ দিয়ে বাতচিত শুরু করলেও এ দফায় বউয়ের একটা হিল্লে করতে উঠে পড়ে লাগেন। তাঁর কথা সে আর খুকিটি নেই। বাপের বাড়ির তো শুনি টাকা-কড়ি, জমি-জমা বিস্তর। একটা পেট চলবে না! বউ ওখানে গিয়ে থাকুক কয়দিন। তোমার ঘর-বাড়ি দেখার লোকের অভাব কেন হবে? আমরা কি মরে গেছি!

তাঁরা মরে গেছেন কি বেঁচে আছেন,  সে তাঁদের ব্যাপার। বউই বেঁকে বসে। সে তখন ডালকুত্তার মতো একরোখা। ভেঙে না বললেও বোঝা যায়, এখানে যে অপার স্বাধীনতা, বাপের বাড়ির আরাম-আয়েশের মূল্যে তা খোয়াতে চায় না। বরং দুর্ভিক্ষের বছর থেকে পাই পাই হিসাব করে নিজের ভাগ বুঝে নিয়ে যেভাবে গরুগাড়ি বা নৌকা বোঝাই করে বাপের বাড়ি থেকে ফিরেছে, আগামীতেও তা চলবে। তিনি নিজেও ভাবলেন, বাপদাদার ভিটেয় ঘুঘু চড়বে, তা তাঁর সহ্য হবে না।

সুটকেস-বেডিং নৌকায় তোলা হলে তিনি গলুইয়ে এসে দাঁড়ান। ঘাটের কিনারের খাড় পানিতে নেমে এসেছে বউ। চোখে চোখ রেখে প্রথম দিনের মতোই পলকহীন তাকিয়ে আছে। এর মধ্যে দাঙ্গা, দেশভাগ। সখা ও তাঁর দুই দেশ। ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডে দু’রকমের পতাকা। তারপর পেরিয়ে যায় আরও বিশটি বছর। পরের দশ বছর বউ ছেলে কোলে, কখনো ছেলের হাত ধরে ঠিক এ জায়গাটায় এসে দাঁড়াত। তাকিয়ে থাকত ঠিক অমন করে। তার মধ্যে আনন্দ বা বিষাদ কোনোটাই ছিল না।

৪.

ছোটবেলার একটা নৌ-ভ্রমণের কথা মনে পড়ে। আমরা খালাম্মার বাড়ি যাচ্ছি। সেটি শরৎকাল ছিল সম্ভবত। খালে-বিলে খইয়ের মতো ফুটফুটে চাঁদমালা। কোমর-ডোবা ধঞ্চেখেত। ভাসমান কচুরিপানার ধাম। তার মধ্যে নৌকা আটকে গেলে দাঁড়িরা প্রাণপণে লগি ঠেলে যখন, আমরা পানিতে ঝুঁকে লাল-নীল শাপলাফুল ছিঁড়ি। যদিও শাপলা-ডাঁটায় সাপ পেঁচিয়ে থাকার কথা পই পই করে বলা হয়েছিল আমাদের। বসে বসে কিছুতেই সময় কাটছিল না। খালের ধারে কাঁচা রাস্তা পড়লে আব্বা নৌকা ভিড়িয়ে নেমে পড়ছিলেন। আমরাও কচি বাছুরের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটছিলাম তাঁর পেছন পেছন। খানিকটা গেলেই বাঁশের ভাঙা সেতু বা কাদার পাঁক। ফের আলকাতরার গন্ধমাখা নায়ে হাত-পা পেটে সেঁদিয়ে বসে থাকো। এর মধ্যে মাঝি দুজন পালাক্রমে মাটির সানকিতে এলেঙ্গা মাছ দিয়ে ভাত খেল আমাদের সামনে। আম্মা ছইয়ের ভেতর চাদর ঝুলিয়ে কোলের ছেলেকে বুকের দুধ দিলেন। আমার আর ছোট বোনের জন্য আনারস ফ্লেবারের ক্রিম বিস্কুট আর ঘরে ভাজা নিমকি। তাই হাতে হাতে বেঁটে দিতে দিতে আম্মার চোখ রাঙানি। বাড়ি থেকে ঠাইস্যা খাওয়াই আনলাম। এত জলদি খিদা কী। তারপর নরম-গরম স্বরে বলা হলো, খালাম্মার বাড়ি কিছু মুখে দিয়েছি কি ফিরতি পথে দমাদ্দম মার। খালুর যক্ষা হয়েছে। এ মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ।

খালাম্মার বাড়ি গিয়ে বুঝলাম, মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ হলে খাটের নিচে নোংরা চিলমচি থাকে, খোলা জায়গার তোলা চুলায় বিশাল বিশাল তামার ডেকচি বসিয়ে রান্না হয়, কিশোর বালক বাপের ঢলঢলে খাকি প্যান্ট বুকের কাছে টেনে ধরে ডাংগুলি খেলতে চলে যায় আর হামা দেওয়া শিশু বালিশ-বন্দী হয়ে একা ঘরে কেঁদে মরে। পরে শুনেছি, দু বছর আগে রোগটা সঙ্গে করে খালাম্মার স্বামী বাড়ি এসে ঠাঁই গাড়েন। এক বছর চার মাসের মাথায় খালাম্মার কোল জুড়ে আসে প্রায় এক যুগ পর তাঁর দ্বিতীয় সন্তান।

আমরা তখন উঠানে, নৌকা থেকে নেমে মাতালের মতো টলমলিয়ে হাঁটছি। তার মধ্যে বোঝার ওপর শাকের আঁটি, বিদেশী ফলের ঝুড়িটা আমাকেই বইতে হচ্ছে। আব্বা পেছনে ডাবের ভারে কুঁজো হয়ে হাঁটছেন। ‘বইন বড় ভালা দিনে তোমরা আইছো,’ আম্মার কোল থেকে ভাইকে নিয়ে খালাম্মা বললেন, ‘বাচ্চাটার আকিকা।’

‘আকিকা!’ আম্মা খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে আব্বার হাত থেকে এক জোড়া ডাব নিতে নিতে ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘আমি খুশি অইতাম, এ যদি শাফা খতম বা খোদাই জিয়াফত হইত।’

পোলাও-মাংসের ঘ্রাণে এমনিতেই জিহ্বায় পানি চলে আসছিল, খালাম্মা নারকেল-নাড়ু সাধতে আমার ছোট বোন টুক করে খেয়ে ফেলে। আমি সবার বড়। খাটের আধশোয়া লোকটাকে ঘিরে বসা আব্বা-আম্মার ওপর তাই নজর রাখতে হচ্ছে। তখনো খালাম্মার হাতভরা নাড় আর আরেক হাতে মিষ্টির তসতরি। তখনই জোর কাশির শব্দ, আম্মা খাটের নিচ থেকে চিলমচি তুলতে ব্যস্ত, আব্বা রোগীর পিঠে হাত রেখে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, আমি পর পর দু-দুটি মিষ্টি ঝটপট মুখে পুরে ফেলি।   

পাশের কামরা থেকে বাচ্চার কান্নার শব্দ আসছিল। আমরা মুখভর্তি খাবার নিয়ে পা টিপে টিপে গা-ঢাকা দিতে যাই ওখানে। পেছনে গুড়গুড়িয়ে হেঁটে আসে আমাদের ছোট ভাই। তিনজনের উদ্ধারকারী বাহিনীটা দেখে বালিশের পাচিল-বন্দী বাবুটা অবাক। কান্না ভেজা চোখে চোখ গোল গোল করে তাকায়। ‘আজকে তোমার আকিকা-আকিকা। কী মজা কী মজা।’ অত্যাশ্চর্য এ কোরাস শুনে হাসে খিলখিলিয়ে। ওকে ঘিরে এতগুলো কচি মুখ, এত হাবুল-বাবুল রগড়! ও নিজেও ঠোঁট গোল করে নানা সুরে কথা কইছিল। হাসছিল। সে সময় ঘরের পর্দা ঠেলে খরদজ্জালের মতো আম্মা হাজির। কোমরে হাত রেখে ওর হাত-পা ছোঁড়া, ফোকলা দাঁতের খিলখিল হাসি দেখলেন খানিক। হাত বাড়িয়ে কোলে নিলেন না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার লাগোয়া খাটের পাশটায় বসে পড়লেন। পরে মনে হয়েছে, পাশের ঘরে বাবা মৃত্যু শয্যায়, আম্মা হয়তো ভাবছিলেন, বাচ্চাটা কত মন্দ কপাল নিয়ে জন্মেছে। রোগীর ঘরে আকিকার অতিথিরা জড়ো হলে আব্বাও এ কামরায় এসে চট করে জানালার ধারে চলে যান। শল্লা করছেন দুজন। ‘বড় বোন তো কী, আমি ওরে ঘিন্নাই করি। বোধ-শোধহীন মেয়ে মানুষ। স্বামী মরতেছে, এমন রান্না-বাড়ার বহর, যেন বিয়া লাগছে। ছেলেটাও মানুষ হয় নাই। নইলে এ অবস্থায় ডাং-গুলি খেলতে যায়!’ আব্বা শ-শ করে আম্মাকে চুপ করতে বললে, রাগে গনগন করে তাঁর ফর্সা মুখটা।

মুরগির ছানার মতো তাড়িয়ে আমাদের যখন নৌকায় তোলা হয়, তখনো খালাম্মা আকুল হয়ে ছোটবোন-ভগ্নীপতিকে খেয়ে যেতে বলছেন। এত বছর পর এখনো খালাম্মার কথাগুলো আবছাভাবে কানে বাজে। তখন বাচ্চাটাও মনে হয়, জানালার শিক ধরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিল।

‘খালাম্মার বাড়ি লুকিয়ে নারকেল-নাড়ু খাওয়ার কথা মনে আছে?’ আমি সেদিন চামচে নুডলস জড়াতে জড়াতে ছোট বোনকে বলি। ও তখন পাঁচ, আমি সাড়ে ছয়। তবু গম্ভীর মুখটায় আলো ছড়িয়ে মাথা নাড়ে। ভাবি, তাহলে তো সেসময়ের অপমানটা ওর ভুলে যাওয়ার কথা নয়। খালাম্মা না হয় বোধশোধহীন ছিলেন, আমাদের মা-বাবাও সেদিন কতটা বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন! খালাম্মার স্বামী মারা যান লাং-ক্যান্সারে। তাঁর বড় ছেলেটিও। তাতেও দোষ খালাম্মার। তিনি চাল বেচে ছেলের সিগারেটের পয়সা জোগাতেন। খুব অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন তখন। শেষের দিকে খালাম্মার স্বামী ব্যবসা করতে গিয়ে দেউলিয়া হন। বাকি সয়-সম্পত্তি যায় তাঁর চিকিৎসায়। আমরা শুনে শুনে বড় হয়েছি, খালাম্মার হাতে বরকত নেই। বাপের বাড়ির সম্পত্তি অন্য বোনেরা যেখানে হাসিমুখে ভাইদের বিলিয়ে দিয়েছে, খালাম্মা নানাজানের জীবদ্দশায় কড়ায়-গন্ডায় বুঝে নিয়েছিলেন। তাতেও বদদোয়া পড়েছে। খালাম্মার স্বামী যে জীবনভর ঘর-ছাড়া, সে দায়ও অযোগ্য স্ত্রী হিসাবে তাঁর।

গরিবের পায়ে লক্ষ্মী। আত্মীয়দের দোরে দোরে তাই হয়তো খালাম্মা ঘুরে বেড়াতেন। কাজে-অকাজে। মনে অসম্ভব তিক্ততা। বড় ছেলের অসুখ ধরা পড়ার পর পায়ের চটি, মাথার ঘোমটাও বিদায় হলো। সুখ-দুঃখ সংসারেরই নিয়ম। তা বলে বড় ঘরের মেয়ে, চৌধুরি খান্দানের বউয়ের এই কী লেবাস! তাঁর আচরণেও তখন দিকে দিকে দিকদারি বাড়ছে। আত্মীয়ের ঘর ডিঙ্গিয়ে আন-লোকের দোরে হাত পাততে শুরু করেছেন। মৃত্যুপথযাত্রী ছেলের মাকে কেউ রেয়াত করে না। চিন-অচিন মানুষ দু’ কথা বলে তো তিনি মুখের ওপর দশ কথা শুনিয়ে খালি হাতে ফিরে আসেন। ছেলের চিকিৎসা করাতে ঢাকা এসেও একই কান্ড।

‘আমরা তাঁকে সাহায্য করতেই পারি,’ আমার বোন বলে, ‘তিনি টাকা চাইতে আসেন, না ঝগড়া করতে?’ সেই তামাশা দেখতে পাশের ফ্ল্যাটের মহিলা দুয়ার ফাঁক করে আড়ি পাতে, যার সঙ্গে ছাদের তারে কাপড় মেলা নিয়ে কথা কাটাকাটি, তারপর মুখ দেখাদেখি বন্ধ আজ প্রায় এক বছর। পরদিন দারোয়ানের কাছে শোনা গেল, ওই মহিলার কাছ থেকে দুটি ছেঁড়া কাঁথা আর একটি লজঝড়ে টিফিন ক্যারিয়ার চেয়ে নিয়েছেন খালাম্মা। কথাগুলো বলতে বলতে আমার বোন অপমানে কেঁদে ফেলে।

৫.

স্বপ্নের মতো একটি দৃশ্য। বা অবাস্তবও তা বলা যায়। ছড়ানো-ছিটানো নানা বর্ণ-আকৃতির পাজলের টুকরা জুড়ে যেন একটি কল্পিত পরিবার খাড়া করা হয়েছে। এর মধ্যমণি খালাম্মা, লাল মখমলে মোড়া গিল্ডি করা চেয়ারে বসে আছেন। পেস্ট কালারের সাউথ ইন্ডিয়ান সিল্ক, সোনার চেন-কানপাশা-বাউটিতে তাঁকে মোটেও বেমানান লাগছে না। একই রকম আরেকটা চেয়ারে ক্রিম-রঙা স্যুট পরে ঘোর কালো বর্ণের একজন পৌঢ়। মেষের লোমের মতো একমাথা হলদেটে সাদা চুল। দুজনের মাঝখানে মেল-বন্ধনের মতো সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর সোনালি জরিদার উত্তরীয় গায়ে খালাম্মার ছোট ছেলে। তাজা ফুল-পাতা ছাওয়া উঁচু মঞ্চে তাঁরা বসে আছেন। তখনো ছেলের মুখে হলুদবাটা লাগানো হয়নি। সামনের নিচু টেবিলে কনের বাড়ির ফিরনি-মিষ্টির নকশাদার বারকোশগুলো সবে থরে থরে সাজানো হয়েছে। আল্পনা আঁকা সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে, করিডরে অতিথিরা জড়ো হচ্ছেন। শরবতের জগ-গ্লাশ নিয়ে ক্যাটারারের লোকদের হই-চই, দৌড়-ঝাপ। আর এ হট্টগোলে একমনে খালাম্মা ও পৌঢ় ভদ্রলোকের দোভাষীর কাজ করে চলেছে তাঁর ছোট ছেলে। 

দরজা খুলে হাঁ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। পরিচয় দেওয়ার পরও বিশ্বাস হচ্ছিল না, বালিশের পাচিল ঘেরা শিশুটি এই সুদর্শন যুবক। যে সোনার জলছাপের বিয়ের কার্ড নিয়ে হাজির হয়েছে। ঘরে ঢুকে কালো বার্নিশের গুটিকয় আটপৌঢ়ে ফার্নিচার, সিলিং পর্যন্ত উঠে যাওয়া বইয়ের তাক, তাকের এলোমেলো বই, দেয়ালে ঝোলানো রঙ-চটা ফ্রেমের আয়না, খয়রাতি পেন্টিং ঘুরে ঘুরে দেখছিল। বলছিল, বয়স্থ দম্পত্তির সংসার এমন জৌলুসহীন, মাধুর্য্যময়ই হয়। আগেও সে দেখেছে। চাপে না পড়লে বিয়েটা এখন সে করতো না।

‘চাপ কার, খালাম্মার বুঝি?’ আমি ধাতস্থ হয়ে বলি।

‘আরে না, কাকাবাবুর। আব্বার সৈনিক জীবনের বন্ধু।’ আমরা ততক্ষণে খাবার কাম পড়ার টেবিল থেকে কাগজ-পত্র হটিয়ে চেয়ার টেনে বসে গেছি। খালাম্মা তো এমন চাপা স্বভাবের ছিলেন না! তাঁর স্বামীর বন্ধু কবে থেকে ছেলের গার্জিয়ান, যে বিয়ের জন্য চাপ সৃষ্টিও করে!

‘বন্ধু বললে কমই বলা হবে।’ ছেলে হাসতে হাসতে বলে, ‘তাঁরা ছিলেন হরিহর আত্মা।’

খালাম্মার ছোট ছেলে তখন ইন্টারমেডিয়েট দিয়েছে। অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে খালাম্মা ঢাকায়। সে সময় তাদের গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় বিদেশ থেকে একটি চিঠি আসে খালাম্মার স্বামীর নামে। আঠারো বছর আগেকার এক মৃত ব্যক্তির নামে চিঠি! সে খাম ছিঁড়ে আরও ঘাবড়ে যায়। মান-অভিমানে ঠাসা গোটা গোটা ইংরেজি অক্ষরের চিঠিখানা। পত্রদাতাকে সে মেয়েই ভাবত, যদি ইরাক ফ্রন্টের উল্লেখ না থাকত। লোকটা যেন যুদ্ধকালীন স্মৃতির সম্ভার মেলে ধরে মৃতকে জিন্দা করতে চাইছে। ‘আসলে তিনি তো জানতেন না, আব্বা মারা গেছেন,’ খালাম্মার ছোট ছেলে হাত থেকে চায়ের কাপ নামিয়ে বলে। ‘তাই হয়তো চিঠির পর চিঠি লিখে শেষমেষ এই ফন্দি।’ সে তখন ফাঁকা বাড়ি পেয়ে খালাম্মার ট্রাঙ্কের তালা ভাঙে। পেয়েও যায় রেশমি রুমালে জড়ানো এক তাড়া চিঠি। সবই ইংরেজিতে লেখা। পড়তে না পারলেও খালাম্মা যত্ন করেই রেখে দিয়েছেন। ওখান থেকে ঠিকানা নিয়ে সে লোকটাকে লিখে, বাবার মৃত্যু, সংসারের দুর্দশা, নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যত ইত্যাদি। ছয় মাস পর সে যখন মাদ্রাজ আইআইটিতে পড়তে যায়, খালাম্মা জানতেন যে, ছেলে স্কলারশিপ পেয়েছে। এখন থেকে ওর খরচাপাতি নিয়ে তাঁকে ভাবতে হবে না।

আমরাও সে রকমই শুনেছি।

শঙ্করণ নামদার লোকটা যে, যুদ্ধ শেষে খাকি পোশাকের সঙ্গে সখাকেও ঝেড়ে ফেলেনি, সে বড় আশ্চর্যের। মুখে বলি, ‘সব শুনে খালাম্মা নিশ্চয় অবাক হয়েছিলেন?’

‘অবাক হলেও খুশি হয়েছিলেন,’ খালাম্মার ছোট ছেলে বলে।

তা হওয়ারই কথা। দেশেই যে বাবা-ভাইহীন এতিম, বিদেশ-বিভুঁইয়ে তার গার্জিয়ান জুটেছে, সে কি কম স্বস্তির! আমার মনে হলো, খালাম্মাকে আমি বুঝতে পারছি।

এক ছুটিতে কাকাবাবু তাকে মহাবালিপুরম সি-বিচে বেড়াতে নিয়ে যায়। শোর টেম্পলের তৈলাক্ত সিঁড়িতে বসে তারা মন খুলে অনেক কথা বলে। শঙ্করণ তাঁর সখার। সে বলে, মায়ের মুখে শোনা কিছু খুচরা গল্প, যার গুরুত্ব ততদিনে নিজের কাছেই হারিয়ে গেছে। বাবার মৃত্যুশয্যায়, বয়স যখন আট মাস, মা তার আকিকার আয়োজন করেছিলেন। খৎনার সময়ও এমন এক ভোজ দেন, যার খেসারত দিতে হয়েছিল বড়ভাইকে। পরীক্ষার ফি দিতে না পারায়, পরের বছরও ভাইটাকে একই ক্লাশে থাকতে হয়। এ রকম আরও কিছু অসঙ্গত কার্যকলাপ। সে মন্দির গাত্রের নৃত্যরত মানুষগুলো দেখতে দেখতে বলেছিল, যার জন্য আত্মীয়-বন্ধুরা মাকে পরিত্যাগ করে আর সে তার আম্মাকে আরও বেশি ভালোবাসে। মহাবালিপুরমের ধারালো বালু ঠেলে চলতে চলতে তার সেন্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে গিয়েছিল। সৈকতের লাগোয়া জুতোর দোকানে বসে সে যখন প্যান্ট গুটিয়ে সমুদ্ররঙা কেডসে পা ঢোকাচ্ছে, শঙ্করণ বলেন, তার পা-পায়ের আঙুল অবিকল তার বাবার। তবে সে যেমন ফিতা বাঁধায় পটু, বাবা সে রকম ছিলেন না। শঙ্করণকেই তাঁর বুটের ফিতা বেঁধে দিতে হত রোজ। সে বলে, বাবার স্মৃতি বলতে খাকি পোশাকে শোলার টুপি মাথায় দেয়ালে টাঙ্গানো একটি গ্রুপ ছবি। তাতে শঙ্করণ থাকলেও তাঁকে চিনিয়ে দেওয়ার কেউ ছিল না। তারপর বেলা পড়ে গেলে তারা সূর্যাস্ত দেখতে সমুদ্রের ধারে আসে। তখন জোয়ার চলছে। সাগরের অসম্ভব গর্জন আর দর্শনার্থীদের কোলাহল। ভাড়া-খাটা ঘোড়াগুলো তখনো সওয়ারি পিঠে সমুদ্রতট দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। শঙ্করণ তাকে ঘোড়ায় চড়তে বললে সে দক্ষিণ ভারতীয়দের অনুকরণে মাথা ওপর-নিচ করে না বলে। কারণ সফরের খরচ সে মনে মনে পাই-পয়সা ধরে হিসেব করছিল। ডিগ্রিটা তার আবশ্যক কিন্তু বেড়ানোটা ছিল না। শঙ্করণও তো সামান্য পেনশনদারি সরকারি চাকুরে। অকৃতদার বলেই না তার পড়ার খরচ জোগাতে পারছেন। যা হোক, সামনে আর মাত্র দুটি বছর। সেদিন সূর্য ডোবার পরও তারা আরও কিছুক্ষণ বেলাভূমির তপ্তবালুতে বসে থাকে। পশ্চিমাকাশের লালিমা ক্রমশ ফিকে হচ্ছে। একটা অভাবনীয় সুন্দর দিনের সমাপ্তি।

‘তোমার মা কি আমাকে ক্ষমা করবেন?’ সে ঝট করে ফেনিল সমুদ্র থেকে চোখ সরিয়ে কাকাবাবুর দিকে তাকায়। ক্ষমার কথা আসছে কোত্থেকে। যতদিন বেঁচে থাকবেন, মা তো তাঁর কাছে ঋণীই থাকবেন। থাকবে সেও। তাকে অবাক হতে দেখে শঙ্করণ হেসে ওঠেন। ‘না মানে’ একটু কেশে তিনি শুরু করেন, ‘মা রাগ করবেন, আমি যদি তোমার শাদির অনুষ্ঠান করি? তোমার বাবা বেঁচে থাকলে যেমন হত, তেমন একটা মাঝারি অনুষ্ঠান!’

সেটা এত তাড়াতাড়ি হবে – কারো জানা ছিল না। খালাম্মার দ্বিতীয়বার স্ট্রোক করার পর, শেষ সেমিস্টারের আগেই তাকে শাদির জন্য দেশে আসতে হলো।

হ্যান্ডমাইকে বাংলা এবং ইংরেজিতে খাবারের সময় ঘোষণা হয়েছে। আনকোরা কোলাপুরিতে ফোলা পা গলাতে খালাম্মার কষ্টই হচ্ছিল। শঙ্করণও ছড়ি ঠুকে ঠুকে স্টেজ থেকে নেমে খাবারের দিকে এগিয়ে গেলেন। পোলাও-খাসির রেজালা-মুরগির রোস্টের পাশে তিন পদের সাউথ ইন্ডিয়ান ডিশ দোসা-ইটলি-উত্তাপা। বড় এক স্টিলের পাত্রে কারিপাতা মেশানো সাম্বার। সবাই খাবার প্লেট হাতে টেবিলে ফিরে আসে। খালাম্মা আর শঙ্করণ মুখোমুখি দুটি গদিআঁটা চেয়ারে। কখন তাদের থালা বদল হলো! সাম্বারে ইটলির টুকরো ডুবিয়ে মুখে তুলতে তুলতে খালাম্মা বলেন, এমন নরম খাবারই তাঁর পছন্দ। শঙ্করণ কিছু বললেন না। ঝাল রোস্টের ধকল সামলে তিনি হাসছিলেন। তাঁর চোখে পানি। 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত