টুপি থেকে অনেক পায়রা বের করে
গভীর রাত। অন্ধকারের বুক চুইয়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ফুটপাথ থেকে ফুটপাথে পড়ছে। মুষলধারে ঝরার মতো লায়েক হয়ে ওঠেনি তখনও। বহুক্ষণ ধরে ইলশেগুঁড়িতেই আটকে আছে। শুধু ঠাণ্ডা বাতাস কমলাপুর বাস ডিপোর ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে মানুষের বাড়ি।
সেখানে ঘুমিয়ে আছে ছোট মেয়ে। নারীটিও ঘুমিয়ে। লোকটি নারীর স্তনে আঙুল দিয়ে হিজিবিজি কাটে। নারী ঘুমের ঘোরে লোকটির হাত সরিয়ে দেয়। দুইবেলা খাওয়াতে পারে না ঠিক মতো। কিসের আদর? এ কথা বলেই পাশ ফিরে শোয়। ঘুমের ঘোর ঠেলে উঠে যায় লোকটি। ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা কবি জসীমউদ্দীন রোডের এই ঘরটিতে ঢুকে যায়, যেন তাকে জাগিয়ে দেবে বলেই। ডিসেম্বারের শুরু। গরমের সাথে বোঝা-পড়ায় শীত কিছুটা এগিয়ে। এই বৃষ্টির পর হয়তো শীত উড়ে এসে জাঁকিয়ে বসবে জানলার কাচে।
নিঃশব্দে এনার্জি সেভিং বাল্ব জ্বলে উঠলে শুঁড় নাড়িয়ে টেবিল ক্লথ বেয়ে নেমে যায় দুটো প্রকাণ্ড তেলাপোকা। তারপর খুশখুশে কাশির শব্দ মিশে যায় ঘরের ঠাণ্ডা বাতাসে। ফুলের নকশা আঁকা কাচের গ্লাসে ঢালতে থাকা পানি একটু একটু করে ওপরে উঠে। ছুঁয়ে ফেলে ফুলের নকশা। তারও কিছু পরে দেয়াশলাই জ্বালানোর শব্দ শোনা যায়। লিচুর বিচি রঙা শরীর নিয়ে চেয়ারের অন্ধকারে বসে ঝিমায় তেলেপোকারা। এসব দেখে তার কোনো ভাবান্তর হয় না কিংবা হলেও বোঝা যায় না।
ঘুপচি বারান্দায় দাঁড়িয়ে শীতের মাত্রা ঠাহর করে যে, তার নাম আরেফিন। বৃষ্টিতে ভর দিয়ে শীত নেমে এসে শরীরের খোলা জায়গাগুলো হামলে পড়ে ডাকাতের মতো। ভেতর থেকে কান টুপিটা নিয়ে এলে সামান্য উষ্ণতা বাড়বে ঠিকই। কিন্তু তার ঘরে ঢুকতে ইচ্ছে হয় না। কনকনে ঠাণ্ডা যতবার চাবুক কষায়, বেঁচে থাকার অনুভূতিটা সে তীব্রভাবে টের পায়। হিমবিষে রক্ত লাল থেকে নীল হতে হতে মস্তিষ্কে বার্তা পাঠায় বেঁচে থাকার। এই উপলব্ধিটা এ মুহূর্তে ওর খুব প্রয়োজন।
টুপিটা উলের মতোই ঠিক উলের না। কৃত্রিম তন্তুজাত। উলের টুপির চেয়ে সস্তা। নরমে গরমে উলের কাছাকাছি। নিউমার্কেট থেকে টুপিটা কিনেছে আরেফিন। আলমারিতে তুলে রেখেছে রিনি। এখন স্টীলের আলমারি খুলতে গেলেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে রিমির ঘুম ভাঙবে। মিম্মিও জেগে উঠতে পারে।
লোকটার খুব কান্না পায়। কাঁদতে কাঁদতে সে সিগারেট ফুঁকে। একজন সম্পাদকও উপন্যাসটা নিল না। জীবনানন্দ দাশ মূল চরিত্র। দু বছর ধরে অনেক খেটেখুটে বিস্তর পরিশ্রমের পর সে লিখেছে- ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
ভর দুপুরে ভাত খেয়ে খুব ঘুম পাচ্ছিল প্রকাশকের। হাই তুলতে তুলতে বলল- আরেফিন সাহেব, নাম শুনেই তো মনে হচ্ছে উপন্যাস ল্যাটকা খিচুড়ির মতো হয়েছে। পাণ্ডুলিপি রেখে যান। পড়ে দেখি। ‘একজন কমলালেবু’ কী সুন্দর নাম দেখেছেন? এমন একটা স্মার্ট নাম দিতে পারেন না?
প্রকাশকের অভদ্র কথা শুনে ভেতরটা শুকিয়ে আসারই কথা। ওই প্রকাশক জানে না নতুন এক জীবনানন্দকে আরেফিন একটু একটু করে নির্মাণ করেছে। যে জাম-হিজল-পতঙ্গের কথা জীবনানন্দ কবিতায় লেখেন সেটা আমাদের চেনা গাছ-পাতা, আকাশ-বাতাস নয়। সেসব অন্য আকাশ। অন্য পতঙ্গ। আরেফিন লিখেছিল জীবনানন্দের সেই অন্য আকাশ আর পতঙ্গের কথা। লিখেছিল ভিড় এড়িয়ে চলা জীবনানন্দের স্বভাবজাত। একা সময় কাটাতে চাইতেন, চিন্তা ভাবনা করতে চাইতেন। তাই বলে তিনি আত্মগোপনকারী নন। আরেফিন উপন্যাসটা নিয়ে কী করবে বুঝে উঠতে পারে না।
এই বারান্দাতেই কয়েকদিন আগে পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে বন ফায়ার করেছে বাবা-মেয়ে। বহ্ন্যোৎসবের সময় রিনি বাসায় ছিল না। তেমন কোনো ধোঁয়া হয়নি। আশেপাশের লোকজন খবর নিতে আসেনি। শুধু আপেলে কামড় দেয়া ভুলে প্রবল বিস্ময়ে দেখছিলো মিম্মি। ছয় বছরের জীবনে সে এমন অদ্ভুত ব্যাপার দ্যাখেনি। আরেফিনও সম্মোহিতের মতো দেখছিল। এফোর সাইজের পৃষ্ঠাগুলোর এক দিক সজীব তরতাজা। আরেক দিক নরম গাঢ় ধূসর। ছুঁলেই ছাইয়ের পাউডার। উজ্জ্বল কমলা আগুনে কি অবিশ্বাস্য দ্রুততায় শেষ হয়ে গেল সবটুকু। ষাট সেকেন্ডেরও কম সময়ে একটা আস্ত উপন্যাস গিলে নিল আগুনের জিভ।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে আরেফিন। কথা বলে জীবনানন্দের সাথে।
-তো এখন আপনাকে কী করে বলি উপন্যাসটা হলে কী কী হতে পারত?
-এখনও হতে পারে।
-হবে না। উপন্যাসই নেই। হলে হয়তো সংসারের চাকাটা আরেকটু ঘুরত। মিম্মির চুলে রোজ শ্যাম্পু। রোজ আপেল। খেতে কী যে পছন্দ করে মেয়েটা! রোদ এসে পড়ত রিনির পাটভাঙা সবুজ বুটির নীল তাঁতের শাড়িতে।
-জীবনটাকে এত নিষ্ফল ভাবছেন কেন?
-যেভাবে সব অন্তঃসারশূন্যতা আচমকা ঘাই মেরে যায়, নিষ্ফলতার কথা না ভেবে পারা যায় না।
সদ্য ছাই হয়ে যাওয়া উপন্যাসটি ঝাড়ু দিয়ে বিনে ফেলে দিয়েছিল আরেফিন। এটুকু সে অনায়াসেই করেছে।
রিনি আর আরেফিন নিউ মার্কেটে গিয়েছিল মেয়ের স্কুলের ব্যাগ কিনতে। রিনির কেনাকাটার লিস্টিতে ছিল সংসারের টুকিটাকি জিনিসের নাম। এইসব বস্তু নিউমার্কেট ছাড়া পাওয়া যায় না। এই অদ্ভুত জিনিসগুলোর একটা হলো পিঠার ছাঁচ, আরেকটা খাঁজকাটা চাকা। খোলা আকাশের নিচে দোকানীরা সারিবদ্ধ হয়ে পসরা নিয়ে বসেছে। সিলভারের হাঁড়িপাতিল, দা-বটি নিয়ে। হামানদিস্তা দেখে চোখ কপালে উঠল আরেফিনের। এই বস্তু ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে দেখেছে সে। মিনিয়েচার ফর্মে ঢাকা শহরের রান্না ঘরে এসে ঢুকে গেল কবে! চারদিক ভিড়ে ভিড়াক্কার। দাঁড়ানোই মুশকিল। হাঁটতে হচ্ছে না। মানুষ ঠেলে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রিনি লেবুর রস চেপে বের করার কাঠের মেশিন দেখছে।
আরেফিন বেশ একটু দূরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিল। লেদারের ব্যাগ ঝাড়পোঁছ করছে এক কিশোর। সেখানে ভিড় কম। কনফেকশনারীর দোকানে বরং ভিড় বেশি। সেখানে ফুচকা চটপটির আয়োজন। পাশেই ফটো স্টুডিও। সুন্দরী নায়িকাদের বিশাল সব পোস্টারের ছবি সাঁটা কাচের দরজায়। স্টুডিওর দেয়াল ঘেঁষে ওপাশটায় টেবিল পেতে শীতের কাপড়ের দোকান। দূর থেকে মিষ্টি একরঙা হলুদ টুপি দেখে এত ভালো লাগল ওর! যেন অদ্ভুত এক বিষণ্ণ হলুদ গোলাপ। কী মায়াময় আলো ছড়িয়ে দিয়েছে চারপাশে! অনেকটা দূর থেকে তাকিয়ে দেখছিল আরেফিন। ভালো করে দেখা হলো না যদিও। মানিব্যাগে শুধু বাসায় ফিরে যাবার মতো টাকা আছে। তাই ওদিকে আর গেল না। রিনি এসব জানে না। বাকিটা তো আরও জানে না। আরেফিন দুদিন পর ফের নিউমার্কেটে গিয়েছিল।
টুপিটা বিক্রি হয়ে যাবার কথা। তবু ক্ষীণ আশা নিয়েই দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল আরেফিন। শীতের কাপড়ের স্তুপে কোথাও সে কানটুপি দেখতে পাচ্ছে না।
-একটা টুপি ছিল না? হলুদ মতো। সাদা বর্ডার দেয়া?
দোকানী কিছু বলে না। হাত বাড়িয়ে একটা প্যাকেট নেয়। সেখান থেকে একটা টুপি বের করে দেয়।
-হ্যাঁ। এইটাই। কত করে দিবেন?
-দাম দিতে হইব না।
-কেনো?
-যে টুপিটা যে নিছিলো, সে মনে করেন দাম দিয়া গেছে।
-কী অদ্ভুত! কে সে?
-আছে। নিয়া যান। এমুন জিনিস আর পাইবেন না।
উষ্ণতা পাবার আশায় আলমারিতে তুলে রাখা সেই কানটুপিটা এখন পরতে ইচ্ছে করে আরেফিনের। রিনির শরীরে উঠে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে কিছুই করে না। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে না। এমন কি দশটা আঙুলে চুলও খামচে ধরে না। স্থিরতা পাবার জন্য সে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে আরেকবার গলির দিকে। এক সময় কান্না শুকিয়ে আসে। আধপোড়া সিগারেটের মাথা ঠুসে দেয় রেলিং এ। কান্নাটা ভেতর থেকে উঠে এসেছিল। টুপির জন্য না উপন্যাসের জন্য জন্য সে বুঝতে পারে না। এসব ভাবনা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতেও পারে না।
বারান্দার পুরো দৃশ্যটা দূর নক্ষত্র থেকে ম্লান চোখে তাকিয়ে দ্যাখে কেউ। আরেফিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। আরেফিনকে তার ১৯৩২ সালের সুবোধ মনে হয়। মিল এই যে সুবোধের পাণ্ডুলিপিও সম্পাদক ফিরিয়ে দিয়েছিল আর পার্থক্য হলো সুবোধ হাঁটছিল আরেফিন দাঁড়িয়ে।
তক্ষুনি কমলাপুর বিআরটিসি বাস ডিপো থেকে ফ্লাড লাইট জ্বালিয়ে একটা নাইট কোচ বেরিয়ে যায়। আরেফিন কম্বল টেনে ঘুমন্ত রিনির পাশে শুয়ে পড়ে।
অপু কিংবা শান্তা খুব ভালোবাসেই টুপিটা হাতে তুলে নিয়েছিল। পাড়ার সবাই তাকে অপু ডাকে। দেখতে অবিকল নায়িকা অপুর মতো কিনা। ফরহাদ ওকে শান্তা ডাকে।
শান্তা নিউমার্কেট ঘুরে ঘুরে সোয়েটার দেখে, মাফলার দেখে। কিছুই পছন্দ হয় না। হলেও দামে বনে না। শেষ দোকানটার টেবিলের ওপর গুছিয়ে রাখা রাজ্যের শীতের পোশাক। এরপরই কনফেকশনারী দোকান, ফটো স্টুডিও। টেবিলের ওপর থেকে নিজের জন্য একটা কার্ডিগান বেছে নেয় শান্তা। সামান্য দামাদামি করে কিনেই ফেলে।
দোকানীর অভিজ্ঞ চোখ শান্তার মনটা নিবিড়ভাবে পড়ে নেয়।
-নিয়া যান একটা দুলাভাইয়ের লাইগা।
মক্কেল বুঝে হাসি হাসি মুখে ফরহাদের জন্য একটা সোয়েটার গছিয়ে দেয় দোকানী। ভাংতি টাকা গুনে ব্যাগের চেইন আটকায় শান্তা। প্যাকেটে দুটো সোয়েটার নিয়ে নিউমার্কেটের দুই নাম্বার গেটের দিকে পা বাড়ায়। তক্ষুনি মনে হলো একটা হলুদ আলো গরম কাপড়ের ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সোয়েটার আর মাফলার সেখানে মিশে গেছে লোকদের ঘাঁটাঘাঁটিতে। ব্যাপারটা শান্তা ঠিক বুঝতে পারছে না। সে তাকিয়ে দেখল কিছুক্ষণ। দোকানদার অন্য ক্রেতার সাথে কথা বলছে। তর সইল না শান্তার। টেনে বের করে আনল যা- সেটা এক হলুদ রঙের টুপি। চারদিকে সাদা বর্ডার।
-এইটা উলের টুপি?
-হ। এক নাম্বার উল।
-কেমন সিনথেটিক মনে হয়। কত হইলে দিবেন?
-এই টুপি তো বেচবার লাগি না।
-তাইলে রাখছেন ক্যান? টুপিটা টেবিলে রেখে হেসে ফেলে শান্তা। অবাকও হয়।
-এই যুদি কারো মনে লয়।
-মনে লইলে?
-এমতেই দিয়া দিমু। আপনে কি অপু’র বইন?
– না। কেন?
– চেহারার কাটিং সেম। অনেক মিল। এই বলে ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস করে বাম গাল চুলকায় দোকানদার। বলে- নিয়া যান। এমুন জিনিস আর পাইবেন না।
শুধু হলুদ রঙটায় আক্রান্ত বা আচ্ছন্ন হয়েই শান্তা কান টুপিটা নিয়ে এলো। কার জন্য বা কেন এসব সে ভাবেইনি। ফলে যা হলো টুপিটা ফরহাদের মাথায় এঁটে বসে না। পুরো কান পর্যন্ত নামে না। শান্তা হেসে ফেলে।
– মাথা মোটা লোক!
-কি এক টুপি কিন্না আনলা। নাও, তুমিই পরো।
শান্তার মাথায়ও ঠিকঠাক মতো লাগে না। ঢল ঢল করে টুপি। দুজনের কেউ না পরলেও অসুবিধা নেই। দাম দিয়ে তো আর কিনতে হয়নি। ফ্রিতে পাওয়া। শান্তার ধারণা ওর অপুমার্কা চেহারার জন্যই দোকানদার টাকা নেয়নি। কিন্তু ফরহাদের কথা ভিন্ন। সে মনে করে দুইটা সোয়েটারে দোকানদার যথেষ্ট পুষিয়ে নিয়েছে। ব্যাপারটা হলো দুইটা কিনলে একটা ফ্রি’র মতো। ফরহাদ হো হো করে হেসেছে। হাসির শব্দের জন্যই কি না টিকটিকির লেজ খসে পড়ল মেঝেতে। আর দেয়ালে বুক ঘষে ঘষে দরজার ওপাশে চলে গেল লেজহীন টিকটিকি।
-লেজটা ফালাও তো। গা ঘিন ঘিন করছে। টিস্যু দিয়ে ফেলবা। খালি হাতে না।
-তোমার মাথায় বুদ্ধি এতো কম?
টেবিলে দোকান পেতে ব্যবসা করা লোক ফ্রি দিয়ে দিয়েছে এটা ভাবতেই ফরহাদের আবার হাসি পায়। শান্তার ভ্রু কুঁচকে গেল। কী কুৎসিতভাবে হাসছে ফরহাদ।
নিঃশ্বাস ফেলে সে বলে- আসলেই দোকানদারটা খারাপ! কেমন ভালো মানুষের মতো মুখ করে বলল নিয়া যান। ফ্রি।
পরদিন সকালে মটরশুঁটির খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে শান্তার মনে হয়, দোকানদার লোকটা ভালো। না দিলেই পারত। দুইটা সোয়েটার নিয়ে সে চলেই যাচ্ছিল অযথা টুপিটা দিয়ে দিল। গরিব মানুষ! নিজেও তো পরতে পারত। এসব পরস্পর বিরোধী সম্ভাবনার ভাবনায় শান্তার মাথাটা গরম হয়ে ওঠে। তাকিয়ে দেখে মটরদানার বাটিতে কখন অজান্তে খোসা ফেলে রেখেছে। খোসার ট্রেতে মটর।
লাল প্লাস্টিকের বালতিতে ধরে রাখা পানির প্রায় সবটা গায়ে ঢালার পর হুঁশ হয় শান্তার। গরমের একেকটা চাঙারি যেন মাথার ওপর থেকে পা পর্যন্ত গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে আর শান্তা একটু একটু করে সুশীতল নির্ভার হয়ে উঠছে। টুপিটা আসলে ব্যবহার করা যাবে না। অন্তত তাদের দুজনের কাছে টুপিটা গুরুত্ব হারিয়েছে।
একটি সমাধানে আসার পর ঘুম পায় শান্তার। মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে ইচ্ছে করে ভেজা মেঝেতে শুয়ে পড়তে। সম্ভব হলে শুয়েই পড়ত। এত ছোট গোসলখানায় ওর পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির শরীর আঁটবে না।
না শুলেও বাথরুমে বসে থাকে শান্তা। টুপিটা সত্যি সে নিতে চেয়েছিল। দাম দিয়ে হলেও। ফরহাদের গা জ্বালানো হাসিটা মনে পড়তেই সিদ্ধান্ত নেয়াটা সহজ হলো। কালই নিউমার্কেটে গিয়ে টুপিটা ফেরত দিয়ে আসবে। ফেরত হয়ত বলা যায় না। দাম দিয়ে তো আর কিনেনি। টুপিটা ঘরে থাকলে ফরহাদের হাসিটা আরও চওড়া হবে। সেটা ভাবতেই অসহ্য লাগছে শান্তার।
হাসপাতাল এবং হাসপাতালে রোগী দেখতে যাওয়া, কোনটাই কখনো ভালো লাগে না শান্তার। ফরহাদ এটা জানে বলেই কাঁচুমাচু মুখে বলেছিল- ছেলে হইছে। আমি একা যাই কেমনে? অন্য অসুখ হইলে একটা কথা ছিল। ভাবীরে দেখতে যাব, তুমি না গেলে খারাপ দেখায়।
-ফিনাইলের গন্ধে আমার বমি আসে।
-এই হাসপাতালটা ভালো। প্যান প্যাসিফিক হাসপাতাল।
-রাখো তোমার প্যাসিফিক। সব এক। বাচ্চার জন্য কী নিয়ে যাবা?
-নেয়ানেয়ির ঝামেলায় নাই আমি, টাকা দিয়ে দিব।
আলমারি থেকে থ্রিপিস বের করে শান্তা। চারটা বাজে। ছয়টায় ভিজিটিং আওয়ার শেষ। হাত মুখ ধুয়ে চুলে চিরুনি বোলায়। জট ছাড়াতে সময় লাগে। কোমর পর্যন্ত ছড়ানো চুল। ফরহাদ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। একবারের বেশি দুবার বলতে হলো না। শান্তার বিবেচনা বোধ খুব তীক্ষ্ণ। সদ্যজাত দেখার ব্যাপার না হলে কিছুতেই তাকে হাসপাতালে নেয়া যেত না।
হাসপাতালের গেটের একটু দূরে ডাবের ভ্যান। চায়ের দোকানে কলা আর কেক বিস্কুটের মিনি প্যাক ঝুলছে। হাসপাতালে ঢোকার মুখেই রাস্তা জুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। পানির পাইপ বসানো হবে। বড় গেটের সামনে বিরাট গর্ত থেকে কাদামাটি তুলে হাসপাতালের সামনেই রাখা হচ্ছে। একদিকে গর্তের ওপর স্টীলের পাত ফেলা। সেটার ওপর দিয়েই হাসপাতালে ঢুকতে হবে।
লোহার পাতে পা ফেলেই অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো শান্তার। নিউমার্কেটে সেদিন সোয়েটার কেনার সময় হলুদ টুপিটার সামনে দাঁড়িয়ে এমনই একটা বোধ তাকে আচ্ছন্ন করেছিল। শান্তার শুধু ভালো লাগছিল। কেউ যেন আছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে সে কিছু বুঝতে পারে না। স্বাভাবিক সাধারণ লোকজন সব। একবার মনে হয় ঠিক এই জায়গা দিয়েই কেউ যেন হেঁটে চলে গেছে আরেকবার মনে হয় কেউ যেন রয়ে গেছে।
বহুদূর থেকে এই দৃশ্যটি দ্যাখে কেউ। তাঁর মনে হয় কী আশ্চর্য! এই তো সতী! পার্থক্য শুধু সতী দাঁড়িয়ে ছিল সিনেমা হলের বাইরে আর শান্তা দাঁড়িয়ে প্যান প্যাসিফিক হাসপাতালের সামনে। শূন্যতার মাঝে এই যে অপেক্ষা, সেটা শুধু নবজাতককে দেখার জন্য নাও হতে পারে। হয়তো সেটা আর্টই যাকে আমরা অপেক্ষা বলে জানি। নইলে বিকেলটাই বা এতো নরম হয়ে উঠবে কেনো?
রিনির সাথে খিটিমিটি লেগে যাচ্ছে অল্পতেই। উপন্যাস পোড়ানোটা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি রিনি। দু বছর আগে উপন্যাস লিখবে বলে কি অবলীলায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল আরেফিন। এখন সেই উপন্যাস কিনা ছাই! সঞ্চয় যা ছিল ফুরিয়ে এসেছে। আরেফিনের ছন্নছাড়া জীবনের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে দিন দিন ক্লান্ত হয়ে পড়ছে সে।
সকালে চায়ে চুমুক দিয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠল আরেফিন। চিনি কম হয়েছে। চেঁচামেচি করা আরেফিনের স্বভাববিরুদ্ধ। অবাক হলো রিমি। উঁচু করে এক চামচ চিনি দিয়ে মিম্মির হাতে চা পাঠিয়ে দিল। কাপ থেকে চা ছলকে পড়ল মেঝেতে। মিম্মির হাত থেকে কাপটা নিয়ে মেয়ের গালে একটা চড় দিল আরেফিন। কাপের ভেতর তাকিয়ে দেখল পিঁপড়া ভাসছে। মিম্মি ফোঁপাচ্ছে। আরেফিন এর আগে কখনও মিম্মির গায়ে হাত তোলেনি। সোজা বেসিনের সামনে গিয়ে সবটুকু চা ঢেলে দিল সে। মিম্মি আর রিনির হতভম্ব চোখের সামনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল।
নিজের ওপর আশ্চর্য আক্রোশে হাঁটতে থাকে সে। ইতিহাস, দর্শন, আধুনিক, উত্তরাধুনিক, জীবনানন্দ, দেরিদা, ফুকো সব যেন পারলে কচলে মারে। কেমন যেন এক আঠালো বিতৃষ্ণা ওর সমস্তটুকুতে মেখে যাচ্ছে। আঠা ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশটায়। যেই সিগারেট ধরালো, আঠা লেগে গেল সিগারেটের গায়ে, দেয়াশলাইয়ের বাক্সে। সিগারেটে আগুন জ্বালাতেই আঠা এসে ঢেকে দিল সিগারেটের পেছনটা। দুটান দিয়েই ধুর শালা বলে সিগারেটটা ফেলে দিল আরেফিন।
কোনো রকম শীতের পোশাক ছাড়াই বেরিয়ে পড়েছে সে। পাতলা টি শার্টের ভেতরে সামান্য ঘেমে উঠেছে শরীর। বাঁয়ে বাস ডিপো ছাড়িয়ে, রেল স্টেশানের দিকে হন হন করে হেঁটে রাস্তার পর রাস্তা, গলির পর গলি পেরিয়ে যায় আরেফিন। ফুটপাথের দেয়াল ঘেঁষে হলদে পেশাব ছাড়ছে লোকজন। ফুটপাথ গড়িয়ে রাস্তা মূত্রময়। শিশ্ন ঝাঁকিয়ে প্যান্টে গুঁজে অবাক হয়ে তারা দ্যাখে উদভ্রান্তের মতো হাঁটছে এক লোক। রেলস্টেশান পেরিয়ে সে হাঁটতে থাকে মুগদা পাড়ার দিকে। একটা পাগল ভবঘুরে কুড়িয়ে নেয় আরেফিনের ফেলে দেয়া সিগারেটের শেষাংশ। না, কোনো আঠা নেই এতে।
হাঁটতে হাঁটতে মায়াকাননের দিকে চলে যায় আরেফিন। মেয়েকে চড় মারাটা খুব অন্যায় হয়েছে। একটা ক্যাডবেরিজ কিনে নিয়ে যাবে মিম্মির জন্য। ফাঁকা পকেটের কথা ওর মনে থাকে না।
একটা লেগুনা আসছে। থামলেই হয়। ডান হাত বাড়িয়ে সিগন্যাল দেয় আরেফিন। ব্রেক করতে দেরি হয়ে যায় লেগুনার ড্রাইভারের।
ছলছলে চোখের দিকে তাকিয়ে আরেফিন টের পেল রিনির মুখ ওর ওপর ঝুঁকে আছে। হাত দিয়ে রিনিকে ধরতে গেল। পারল না। হাত অসাড়। রিমি ওর ডান হাত ধরে আছে।
-এখন কেমন লাগছে?
নিরুত্তর আরেফিন। চারদিকে তাকিয়ে হাসপাতালই মনে হলো। ফিনাইলের কড়া গন্ধ। জানলার পাশে বেড। নরম রোদ এসে পড়েছে গায়ে। ডিসেম্বরের ঠাণ্ডায় মিষ্টি ওম। চোখ বন্ধ করে উপন্যাসটার কথা ভাবে সে কিংবা নিজের অস্তিত্বের কথা। ভাবতে ভাবতেই আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
ডান হাতে কনুইয়ের কাছে ফ্র্যাকচার হয়েছে। লেগুনার বাড়ি খেয়ে রাস্তায় ছিটকে পড়েছিল আরেফিন। আঘাত গুরুতর নয়। এক দিন পরই আরেফিন রিলিজ হয়ে গেল হাসপাতাল থেকে। হাসপাতালের মেইন গেটের সামনে রাস্তা খোঁড়ার কাজ চলছে। রোগী নিয়ে হাসপাতালে ঢুকতে ভোগান্তি হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সগুলোর। স্টীলের সরু পাত ফেলে রাখা হয়েছে মানুষের চলাফেরার জন্য।
বিকেলে রিমির হাত ধরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে আরেফিন। খোঁড়াখুঁড়ির ওপর দিয়েই সাবধানে। ডান হাতে প্লাস্টার করা। কানটুপিটা পরিয়ে দিয়েছে রিমি।
হঠাৎ চমকে উঠল আরেফিন। যেন নীরব নিথর প্রাচীন কুয়ার বুকে ঘটি পড়ে পানি ছলকে উঠল। দীর্ঘ একটা শ্বাস বেরিয়ে এলো। মনে একটা ব্যথা এলো। কেউ যেন খুব কাছে। মনে হলো জীবনের গভীর বেদনার সময় সে বলবে- আমি আছি। সমস্ত রুক্ষ্মতার পর শেষ বিকেলের মতো নরম হয়ে এসে কেউ জীবনের ব্যর্থতাকে মুছে দিয়ে যাবে।
সিএনজির জন্য এগিয়ে গেছে রিমি। হাতছানিতে ডাকছে আরেফিনকে। আনমনে টুপিটা খুলে হাতে নেয় সে। তক্ষুনি দৃশ্যত এক ঝাঁক পায়রা উড়ে যায়। আরেফিনের মনে হয় এই টুপি থেকেই যেন! তারপর পায়রাগুলো হারিয়ে যায় যেখানে, সেটা প্রতীক্ষা নাও হতে পারে, হয়তো ঘুমের ভেতর উড়ে গেছে। নিশ্চুপ কোনো এক কুয়াশার দেশে। আশ্চর্য শূন্যে।
