| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প ধারাবাহিক সাহিত্য

বড়গল্প: কাঠ কয়লা ছাই (পর্ব-১)

আনুমানিক পঠনকাল: 18 মিনিট

রাত-দুপুরে নয়, সন্ধের পর পর তুলে নেওয়া হয় তাকে। বিকেল থেকে আকস্মিক মেঘলা আকাশ। শেষ ফাল্গুনের এই বেলায় কখনো ঝড়-বৃষ্টি হয়। গাছের পাতা ঝরে যাওয়া শাখাপ্রশাখায় নেমে আসে জীবনের নবায়ন। আকলিমার বুক জুড়ে শূন্য হাহাকার। অনেক জোরপায়ে ছুটে আসা। তার মুখছবিতে অজানা কোনো আশঙ্কায় মৃত অন্ধকার হাত-পা ছড়িয়ে নেমে আসে। শেষ সন্ধের বিমর্ষ আঁধারও নিজেকে বিছিয়ে নেয় চারপাশ। তখন রাস্তার পশ্চিমে গলির মাথায় ধূসর-নীল পুলিশ-ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে দু-তিনজন হেঁটে হেঁটে ঘরের দোরগোড়ায়। মানুষের হালকা জটলা। দেড় মিটার প্রশস্ত গলি। পশ্চিমে চলে গেছে চল্লিশ মিটার। তখন ছায়া-আবছায়ায় সবকিছু সংকীর্ণ লাগে। উত্তর-দক্ষিণে বাড়িঘর-বারান্দা-সীমানা প্রাচীর। কোনো ঘরের জানালা ঝটপট বন্ধ হয়ে যায়। কারও উৎসুক জিগীষু দৃষ্টি জানালা থেকে লাফিয়ে গলিতে নেমে আসে। কৌতূহল বড় সাংঘাতিক জিনিস। কী ব্যাপার? ঘটনা কী? মামুনকে ভ্যানের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আকলিমা পেছনে পেছনে হেঁটে-দৌড়ে আর পারে না। কী করার আছে তার? কখন দপ করে নিচে বসে পড়ে মনে নেই। গলির সবটুকু বিস্তৃতি বালু…বালু আর বালু। উত্তরে বিশাল জায়গা গভীর করে খনন হয়েছে মাস দুয়েক আগে। পুরোনো ভবন ভেঙে দশ-বারোতলা ফ্ল্যাট উঠছে। সারাদিন বালুর ট্রলি আর শ্রমিকের চেঁচামেচি হট্টগোল। মানুষ কাজ করে। আকলিমাও দিনভর অনেক কাজে ব্যস্ত। রাত আট-নয়ে ফেরার অবসর পায়। হোটেলের কাজ, শুরু আছে; শেষ নেই। সে মাছ-মাংস-সবজি কাটে। শিলনোড়ায় মশলা বাটে। উনুনে কতরকম রান্না। আগুনের হলকা পোড়া বুকের কাঠ-কয়লা-ছাই। সেই সকল কাহিনি মনে করতে চায় না। কখনো তবু হামলে পড়ে। একে একে মনে আসে। এইসব নিয়ে বেঁচে থাকা। শত কষ্টের মধ্যেও একটু আশা প্রদীপের মতো জ্বলজ্বল জেগে থাকে। ছেলেমেয়ে। চোখের আলো। সেই আলো শত কষ্টে বুকে আগলে রাখা। কতটুকু পারে অথবা পারল সেই ভাবনা মনকে দোলায়। কখনো বিশুষ্ক দৃষ্টিতে ভাবতে হয়। অবসর নেই। আজকাল দু-হাতের সন্ধি আর কবজিতে টান ধরে। কোমর আর হাঁটুতে আচমকা চিনচিন ব্যথা। কখনো অসাড়। কাজ থেমে থাকে না। তখনো কাজ বাকি। তবু সবকিছু এড়িয়ে ছুটে আসতে হয়। ঘরের দরজার কাছাকাছি থেমে অসি’র দমবন্ধ হাঁসফাঁস ক্লান্তি। মামুন মোবাইল কিনে দিয়েছে। সেটাই গমগম করে বেজে উঠেছিল। মুনার অস্থির কণ্ঠ।
‘মা তাড়াতাড়ি আসো…পুলিশ আসছে।’
‘পুলিশ!’
মামুনও হতভম্ভ। পুলিশ? সে তখন ঘরের বাইরে দেয়াল ঘেঁষে রাখা সাইকেল নিতে যায়, শেষ টিউশন; কিছু বুঝতে পারে না। এমন কোন্‌ অপরাধ করেছে সে? তার হাতে হাতকড়া পড়ে কিছু বুঝতে না বুঝতেই। কেন? কী অপরাধ? আকলিমা ছুটে-দৌড়ে এসে হাঁপাতে থাকে। তারও জিজ্ঞাসা।
‘মামুন করছেডা কী?’
সেই প্রশ্নের উত্তর কিংবা কৈফিয়ত শোনে না কেউ। অথবা কারও মনোযোগ নেই। অথচ গলির প্রান্ত ঘেঁষে গুরুতর অভিযোগ দমকা বাতাসের ঢেউয়ে উদোম নেচে নেচে ছড়িয়ে যায়। যা জানার কথা নয়, ভাবনা কিংবা কল্পনার শক্তি নেই; সেই কথা সুর-লয়-তাল ধরে মানুষের ঠোঁটে ঠোঁটে কানে কানে ধাক্কা মারে। মামুন ড্রাগ কারবারি। অথচ সকলেই জানে ছেলেটি যেমন ভদ্র-বিনয়ী-সৎ, তেমন পরিশ্রমী। পুলিশ ঘরের মধ্য থেকে চার বোতল ফেনসিডিল বের করে। প্যান্টের পকেটে আট পিস ইয়াবা। মুনা নিশ্চুপ বিস্ময়-বিমুঢ়। কী করবে ভেবে পায় না। সে কখনো পুলিশ আর প্রতিবেশী মানুষজন আবার কখনো বাইরের অন্ধকারে কিছু খোঁজে। বড় অসহায়।
পুলিশ হেঁটে চলে। তাদের মধ্যখানে মামুন। তারা অনেক দূর চলে গেছে। অবশেষে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে-দৌড়ে গলির মাথায় এসে দাঁড়ায় মুনা। রাস্তার বাঁ-পাশে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে পিকআপ ভ্যান। উত্তরে কোতয়ালি থানা। সেদিকে মুখ। ইঞ্জিন ধীরস্থির প্রায় নিশ্চুপ শব্দ তুলে যায়। ভ্যানের পেছন উন্মুক্ত, পুব-পশ্চিমে দুটো বেঞ্চ; কয়েকজন বসে আছে অভিব্যক্তিশূন্য কাঁচপাথর। তাদের হাতে রাইফেল আকাশমুখী। বেঞ্চ দুটোর মধ্যখানে নিচে এক মানুষ, এলোমেলো বিস্রস্ত দুশ্চিন্তার ছবি আঁকা অবয়ব। ড্রাইভারের পাশে কেউ একজন, তার সামনে উইন্ডশিল্‌ডের কাছে রাখা ওয়ারলেসে বিচিত্র শব্দের গুঞ্জন বাজে। সেই কথামালা ভারি অদ্ভুত লাগে। মামুন এতক্ষণে পশ্চিম বেঞ্চের মধ্যখানে সেই মানুষের কাছে বসে পড়ে। মাথার টুপি খুলে সামনে ছুড়ে দেয়। চোখে-মুখে ভয়ার্ত জলছাপ। অদেখা দুশ্চিন্তা রেখা। আকলিমা ছুড়ে দেওয়া সেই বস্ত্রখণ্ড ধরতে পারে না। ছেলে তার কয়েক মাস হয় নামাজ ধরেছে। নিয়মমতো মসজিদে যায়। উপরঅলার দরবারে হাত তোলে। কষ্ট যে আর সহ্য করা যায় না। মাগরিব শেষে ঘরে ফিরে ঘটনার মুখোমুখি। দোকানের পার্টটাইম চাকরি অকারণ একদিন চলে গেল। কাজ পাওয়া সহজ নয় যত অবলীলায় চলে যায়। কয়েক সপ্তাহ এখানে-ওখানে ঘোরাঘুরি করে। অবশেষে কয়েকটি টিউশন। শেষ-দুপুর থেকে একটির পর আরেকটি। এমন একজন ছেলে কি না ড্রাগ ব্যবসায়ী! মানুষের ফিসফিস গুঞ্জনধ্বনি। উচ্চকণ্ঠ মন্তব্য। মুনা অসহায় নির্বাক দৃষ্টি তুলে দেখে থাকে। কী করবে কিছু বুঝে উঠতে পারে না। পিকআপ ভ্যানে বসে থাকা পুলিশেরা যেন পাথরের মানুষ। কোনো দয়মায়া নেই। কোনো ভাবান্তর নেই। তারপর মিহি ধোঁয়া উড়িয়ে চলে যেতে থাকে ভ্যান। মুনা মায়ের গা-ঘেঁষে দঁড়িয়ে বিষাদ সন্ধের সবটুকু বেদনা বুকে গেঁথে নেয়। মামুনের দৃষ্টি থেকে ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়তে থাকে। আকলিমার দু-চোখে অসহায় তেপান্তর কাহিনি। মুনা ঘুরে দাঁড়ায়। অত সহজে ঘাবড়ে যায় না সে। মায়ের হাত টেনে পশ্চিমে ফিরে চলে। এখনো সামলে উঠতে পারে নাই আকলিমা। বুকের গহিনে চাপাকান্নার নিশ্চুপ গুঞ্জন থেকে থেকে ধাক্কা দেয়। কী করবে এখন? কীভাবে সামলাবে বিপদ? তখন আকাশের দিগন্ত থেকে দু-এক ফোঁটায় নেমে আসে মেঘজল। সেখানে কি জেগে ওঠে অতীতদিনের ক্ষোভ-বিক্ষোভ? আগুন ঝলসানো দৃষ্টিবান? কে জানে।
‘দেখলি? হেরা ছাইয়ের দড়ি পাকাইতে পারে। ওদের লগে কাইজ্যা করতে নাই রে মা। এ্যাহন কী যে হইব কে জানে।’
‘ভাই তো কিছু করে নাই। একখান থাপ্পর দিয়া সাবধান কইরা দিছে মাত্র।’
‘কী দরকার আছিল? হাজার হাজার মাইয়া রাস্তাঘাটে কত্‌তো কথা শোনে, কত্‌তো মন্দ জিনিস হয়, মানুষজন ফাতরা, তাগো লগে কিয়ের কাইজ্যা? কোনো বেডি তো কিছু কয় না। মাথা নিচু কইরা ঘরে ফিইরা আহে। এ্যাইডা পুরুষ মানুষের সমাজ। মাইয়া গো সব বুইজা চলন লাগে। কী দরকার ঝামেলার?’
‘আমি তো কিছু কই নাই। মাথা নামাইয়া স্কুল যাই। সেদিন কী হইছে ভাই রে তো কই নাই। কেডায় কইছে? কোথাও শুনছে মনে হয়। সহ্য করবার পারে নাই। কথা কাটাকাটি হইছে। সজল রে একখান হালকা চাটি দিছে। ঠিক করছে। বান্দরের বাচ্চা বান্দর।’
‘মা রে…মাছ না চিলকাইলে বক ঠোকর মারে? আমি বুঝি না?’
‘তুমি আমারে খারাপ কইলা মা? আমি এমুন মাইয়া?’
‘নে থো! আর কথা বাড়াস না। চল থানাত্‌ যাই। হাত-পা ধইরা যদি কাম হয়।’
‘তুমি যাও…আমি যামু না।’
‘তা যাবি ক্যান্‌ হারামজাদি।’
মুনার অভিমান জেগে ওঠে। মন বড় দিশাহীন অস্থির। মামুনকে বেশি ভালবাসে মা। তার চেয়েও। সে যে মেয়ে। তার মূল্য কম। মা সারাদিন কথায় কথায় কাজে-অকাজে ছেলে আর ছেলে। মুনা কি ভাইকে ভালবাসে না? তার বুকে কোত্থেকে এত কষ্ট আসে? সন্ধে অন্ধকার হয়ে নেমে যায়। সেই ছায়া ছায়া-আবছায়া বুকের বিষাদ লুকোতে পারে না বুঝি। সে মায়ের হাত ছেড়ে দেয়। ঘরে সাঁঝবাতি দেওয়া হয়নি। দ্রুত ঘরে ঢুকে সুইচ খুঁজে নিতে থাকে। তারপর হলদে-ফ্যাকাশে আলোয় দু-জন মানুষ পরস্পরের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে একমুহূর্ত। এখন কী করার আছে?

আকলিমা থানা থেকে ফিরে এসেছে। তখন বেশ রাত। শহরের জেগে থাকা ব্যস্ততায় কিছু নয়। হোটেল মহাজনের সঙ্গে দেখা করে যাওয়ার পথে। তিন-চার হাজার টাকার আবদার। থানা টাকা খায়। দিলশাদ খান মানুষ ভালো। আকলিমা সংক্ষেপে কারণ তুলে ধরে। অবশেষে তিনখানা সবুজ নোট। সেই শক্তি আর সাহসে লালঘরে উঁকি দেয়। পুবমুখী গেটের পেছনে ঝাঁকড়া বকুল গাছ। এখনো ফলের ফাঁকে ফাঁকে কিছু ফুল রয়ে গেছে। তারই শেষ কিছু সুবাস বাতাসে ভেসে ভেসে থানা চত্বরের আশপাশে মাতাল ঢেউ তোলে। আকলিমার মন পোড়ে। আশা-নিরাশার দোলাচল। সে টেবিল থেকে টেবিলে ঘোরে। তার অনুনয়-বিনয় কারও এড়িয়ে যাওয়া উৎসুক চোখে হোঁচট খায়। কোনো হুশ থাকে না। ছোট ছোট লুকোচাপা দীর্ঘশ্বাস বুকের গহিনে ছটফট করে হেরে যায়। হায় আজ যদি মানুষটা বেঁচে থাকত! একা একা একলা লড়াইয়ের শেষধাপে মন উন্মন। মুনা আসতে চেয়েছিল। আকলিমা সঙ্গে নেয়নি। কোনো মিনতি শোনেনি। এখন মনে হয় সঙ্গে থাকলে বুকে বল পেত। অবশেষে কারও দৃষ্টি পড়ে। পাথরের চোখ হোক সে, তবু সেখানে কিছু নির্বিকার মনোযোগ, কিছু কৌতূহল, জিজ্ঞাসা খেলা করে; আকলিমার বুকে সাহস আসে। অনেক আশা নিয়ে এসেছে। নৌকোডুবি মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে তীরে উঠতে চায়, যদি এই অন্ধকার গোলকধাঁধা গহ্বর থেকে একটু আলো খুঁজে পাওয়া যায়; তার মনজুড়ে স্বস্তি নামতে থাকে। কোতয়ালির উত্তরে যে টং দোকান, সেখান থেকে দুই প্যাকেট নাবিস্কো গ্লুকোজ বিস্কুট কিনেছে, মামুনকে দেবে; ছেলে যে ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না। সেই প্যাকেট হাতের মধ্যে ঘেমে ওঠে। টেবিলের মানুষ কী ভেবে নেয়, কিছু লিখতে লিখতে থেমে গিয়ে চোখে চোখ প্রশ্ন করে।
‘কী দরকার?’
‘বাবা আমার পোলা। আপনেরা সন্ধ্যায় তুইল্যা আনছেন।’
‘পোলার নাম কী? কোন্‌ জায়গা?’
তারপর ব্যস্তত্রস্ত ফাইল ঠেলে উঠে দাঁড়ায় মানুষ। এদিক-ওদিক অস্থির দৃষ্টি ছুড়ে গরম স্বর তোলে। ওয়ারলেসে বেজে ওঠে পেট্রোলিং কথোপকথন। মানুষ সামনের কাউকে জিজ্ঞেস করে।
‘শফিক কই গেছে? মালদহপট্টি ফিরছে?’
‘না স্যার, আইসা পড়ব এখনি।’
‘দেখ তো এই মহিলা কী কয়?…এ্যাই এদিকে শোনো, কী নাম কইলা তোমার পোলার?’
‘মামুনুর রশিদ, মামুন বাবা, মামুন।’
আকলিমার কথা কে শোনে? আলোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ সবটুকু আলো শুষে নিতে নিতে অন্ধকার করে তোলে দু-চোখ। সেই নিষ্প্রভ ছায়া ছায়া আলো-আঁধারিতে টেবিলে বসে থাকা অন্যজন মন্তব্য করে বসে।
‘মাদক কেস স্যার। ফেনসিডিল আর ইয়াবা।’
‘না বাবা, আমার পোলা এসব করে না। কলেজে পড়ে। আপনেরা ভুল সন্দেহে লইয়াইছেন বাবা।’
‘তুমি চুপ করো। এত কথা কও কেন হাঁ? কথার মইদ্যে কথা।’
‘স্যার পোলাডা না খাওয়া…ওরে এই বিস্কুটডা দিই?’
আকলিমা অবশেষে এক প্যাকেট বিস্কুট আর ঘি রং একটি চাদর দিতে পারে। ফাল্গুনের রাতে হিম হিম কুয়াশা। শীত ভেজা রাত। ঠান্ডা সহ্য হয় না। বিস্কুটের অন্য প্যাকেট খুলে লাল চায়ের আসর বসে। আকলিমার বুকে নিভে যাওয়া আগুন ফুরফুর করে জেগে উঠতে চায়, চোখ উঁচু দেখতে দেখতে ভেবে নেয়; উপায় কী? এসব তো হয়ই। তার অসহায়-কাতর দৃষ্টি। সে কোনো আইন জানে না। বোঝে না কিছু। পুলিশ দেখলে অচেনা কাঁপন জাগে। সেই ভয়…সেই আতঙ্ক বোবা করে রাখে চোখ-মুখ। বুকের ধুকপুক। ছেলেকে ফেরত নিয়ে যেতে পারবে তো? এই প্রশ্ন মনের অলিগলিতে দমবন্ধ নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে আশপাশ ঘুরে আসে। গেটের ওখানে লাইটপোস্ট। শিখরে বিশাল এক বাল্‌ব জ্বলছে। সেখানে জমায়েত হয়েছে হাজার পোকা। সেগুলো উড়তে থাকে, আছড়ে পড়ে, মরে যায়। তারই ছায়ায় ঘোড়ানিম গাছে হালকা বেগুনি ফুল আশার আলো জাগিয়ে রাখে। আকলিমা এখন পোকা। সে আছড়ে পড়ে মেঝেয়। এখন শুধু পা ধরা বাকি।
মামুনের শুকনো চোখ-মুখ। এই আধ-এক ঘণ্টায় জমে উঠেছে হাজার দুশ্চিন্তা-অসহায় দৃষ্টি। একটু কি অলীক বিশ্বাস আর ক্ষোভ? সে বিস্কুট হাতে নিতে নিতে বলে, –
‘মা তুমরা চিন্তা করবা না। আমি কিছু করছি না কি?’
‘চুপ যা বাপ। আল্লা আল্লা কর। আল্লা রে ডাক। আল্লা সব মাফ কইরা দিব।’
‘মা মুনা আহে নাই?’
‘না বাপ। তর হেদিন সজল রে মাইর দেওন ঠিক হয় নাই। সরকারি দল করে। ওগো ম্যালা ক্ষ্যামতা।’
‘আমার হুশ আছিল না মা। আমারে মাফ কইরা দাও।’
‘আহা রে আমার জাদু!’
শেষমেশ কিছু হলো না। আকলিমা যখন কোতয়ালি থেকে রাস্তায় নেমে আসে, বেশি দূরের পথ নয়, অথচ মনে হয় যোজন যোজন দূর বিস্তৃত তেপান্তর, পুলসিরাতের সূক্ষ্ম সেতু পেরিয়ে যাচ্ছে। চোদ্দো শিকের অন্ধকার খাঁচায় কলিজার টুকরো থেকে গেল। তার প্রাণবায়ু নিশ্বাস। তখন আরও একবার, কতদিন পর সেই অস্থির মুখছবি ভেসে ওঠে। রাতের আকাশে তারাদের মেলায় কোন্‌ কোনায় সেই মানুষ? কোন্‌ অচিন অন্ধকারে লুকিয়ে বেসুরো জীবনের পরতে পরতে সপ্তসুর তুলতে মরিয়া? বেচারা! হতভাগা মানুষ। তাদেরও অন্ধকারে রেখে চলে গেল। আকলিমা কি গভীর আনমনা অস্ফুটে সেই নাম উচ্চারণ করে বসে? ‘মামুনের বাপ, আমাগো ফেলাইয়া কই গেলা তুমি?’ কোনো উত্তর নেই। বাতাসে ভেসে আসে শুধু উদাস হিম ঢেউ।

সেও এক সন্ধের কাহিনি। সেদিন আকস্মিক বিবর্ণ পাঁশুটে চেহারা নিয়ে ঘরে এসে দম ছাড়ে মামুনের বাপ আবদুর রশিদ। পঁচিশ বছরের টোনাটুনি জীবন। মুনার বয়স পাঁচ-সাড়ে পাঁচ। অনেকদিনের পর বাবাকে পেয়ে নাচতে নাচতে কোলে গিয়ে বসতে চায়। পিঠের পেছনে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। সবকিছু তেমনই, যেমন দেখে এসেছে, কিন’ সেদিন সে-সবের মধ্য দিয়ে বেসুরো খাপছাড়া কোনো ছন্দপতন প্রতিভাত হতে থাকে। পথ হারানো দিশাকুল ভুলে যাওয়া বলে উঠে কেউ, –
‘তুমার কী হইছে? মাথাব্যথা-জ্বর? শরীল খারাপ?’
‘কিছু হয় নাই মামুনের মা কিছু না।’
‘তুমারে এমন দেখি নাই। আসতে কুনো অসুবিধা হইছে?’
‘তেমনকিছু না গো…শোনো, এই ট্যাকা কয়ডা তুইল্যা রাখো।’
মানুষ বড় কাহিল। অনেক দূরের রাস্তা। যেতে আসতে নয়-দশ ঘণ্টা। তারপর আজকাল যানজট। নাইটকোচ রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আকলিমা কপালে হাত দিয়ে কোনোকিছু পরখের চেষ্টা করে। বুঝতে পারে না। সে অনেককিছুই বুঝতে পারে না। তারপর একসঙ্গে এতগুলো টাকা দেখে চমকে ওঠে। সে টাকার বান্ডিল টিনের বাক্সে কাপড়ের ভাঁজে রেখে দিতে দিতে কৌতূহল চোখে তাকায়। আবদুর রশিদের শরীরজুড়ে ক্লান্তি। চেহারায় আবছায়া হাসি। আকলিমার মন ভরে যায়। কত পুণ্যে এমন মানুষ তার সঙ্গী।
‘বোঝলা মামুনের মা, এই কয়ডা টাকাই শেষ সম্বল। সাহেব আমারে বিদায় দিছে। বাইশ বছর নয় মাস চাকরির পুরস্কার।’
‘মানে?’
‘আমার চাকরি নাই আকলিমা।’
এই ছোট একটি কথায় ঘরের ছায়া ছায়া আলো-বাতাস কোনো কপিশ অন্ধকার আঙিনায় ডুবে যায়। অন্ধকার কালো হয়ে আসে চারপাশ। মুনা তখন বাবার পিঠে চড়ে আনন্দের কত কথা বলে। আবদুর রশিদের কোনো বিরক্তি নেই। কত আনন্দে মেয়েকে একবার কোলে নেয় একবার জড়িয়ে ধরে। ভালবেসে গালে চুমো দিতে থাকে। আকলিমার মনে হয়, আজও মানুষটিকে বুঝতে পারল না। এত ভালবাসা বুকে তার।
‘তুমার চাকরি নাই? কেমনে চলব আমাদের?’
‘আল্লা আছে আকলিমা।’
‘তুমার চাকরি কেমতে গেল? ঠিক কইরা বলো তো কী করছ তুমি? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।’
‘মালিক এ্যাহন কোম্পানির অফিস নতুন কইরা সাজাইব। বিবিএ-এমবিএ অফিসার থাকব অফিসে। স্যুটেড-বুটেড জেন্টলম্যান। এইডা ডেকোরেশন। তুমি বুঝবা না। সাধারণ অ্যাকাউন্টিং-ম্যানেজমেন্ট পড়া লোকজন রে বিদায় কইরা দিতাছে। এডাই এখনকার ফ্যাশান। গুডবাই উইথ থ্যাংকস্‌।’
আকলিমা সত্যি এসব বোঝে না। স্কুলে পড়তে পড়তে ঘটকালির বিয়ে। তখন সবে ক্লাস সিক্সে উঠেছে। বিয়ের কল্পনা ছিল না। বোঝেও না তেমন। সেই সন্ধেয় মানুষজনের ভিড়ে ছাপানো একটি কাগজে স্বাক্ষর করতে হয়। কেউ মাথায় টোকা মেরে বলিয়ে নেয় ‘কবুল’। আকলিমার সব মনে আছে। মায়ের দু-একটি গয়না হাতে-কানে-গলায়। নিজেকে বেশ দামি মনে হতে থাকে তার। শরীর-মন জুড়ে অচেনা শিরশির লাজুক ভাবনা। পড়ার সাধ ছিল, তেমন বলেছিল কেউ; বিয়ের পর পড়তে পারবে। সেই কথা আর থাকেনি। তিন-সাড়ে তিন বছরের মাথায় কোলে এলো মামুন। পেছন ফিরে আর তাকানো হলো না। পৃথিবীর সকল সুখ-আনন্দ-ভালবাসা-ত্যাগ তার সন্তান। আবদুর রশিদ ঢাকায় চাকরি করে। সিগারেট কোম্পানির বড় অফিসার। বছরের কয়েকটি দিন আসতে পারে। সেই দু-চারটি দিন আনন্দ-হাসি-গল্পগুজবে দ্রুত শেষ হয়ে যায়। কোনোদিন সন্ধেয় আবার বেদনা-বিষাদ প্রহর নেমে আসে। আবদুর রশিদের ছুটি শেষ। ঢাকায় যেতে হবে। আকলিমা ব্যাগ গুছিয়ে দেয়। টিফিন বাক্সে দুটো পরোটা-তরকারি। একলা বিরহী প্রহর গোনার প্রস্তুতি নিতে নিতে বারবার বলে, ‘মনে কইরা খাইবা কিন’।’ তারপর মনের শুকনো দৃষ্টির প্রান্তসীমায় শেষ কষ্টের বিদায়বেলা। আকলিমার অনেক সাধ, আরও দুটো দিন বেঁধে রাখে, এটা-ওটা রাধে, কোনোকিছু করা যায় না; পারে না। এই অদ্ভুত বেঁচে থাকা সভ্যতার দিনকাল। সব মেনে নিতে হয়। মেনে নিয়েছিল হাতে গোনা কয়েকটি দিন। সুখ বলো স্বস্তি যা সব তো ছিল। সেই মানুষ একেবারে চলে এসেছে। চাকরি নাই।
‘কিন’ চাকরি না থাকলে আমাগো চলব কেমনে? এই বয়সে আর কোথায় চাকরি খুঁজবা? কেউ দিব?’
‘তুমি চিন্তা কইরো না মামুনের মা। খোদার দুনিয়ায় কেউ বইসা থাকে না। উপায় একটা অবশ্যই হইব।…তারপর কী রাধছ? আমার ক্ষিদা লাগছে।’
‘হায় রে আমি যে কী! যাও মুখ-হাত ধুইয়া আসো, তুমারে ভাত দিই।’
‘আকলিমা, আইজ একখান সিগারেট খাইছি। সিগারেট কোম্পানিতে চাকরি করলাম, কুনোদিন খাই নাই। শেষবেলা আসার পথে এক প্যাকেট লইছি। বেশ ভালোই। বুজছো দুইন্যায় মন্দ জিনিসের স্বাদ বেশি। তুমার অসুবিধা হইব না তো?’
‘যাও…আমি যে কী ভাবতাছি, আর তুমি? কেমনে চলব…কুনো চিন্তা নাই।’
‘চিন্তা কিয়ের? হা হা হা!’
আকলিমার মনে কি বিরহকাতর দিনযাপনের প্রহর শেষ হয়ে যায়? কে জানে। তার মনে হাজার ভাবনা-দুর্ভাবনা এসে ভিড় করে। যার বুকে জীবনের সকল নির্ভরতা-আস্থা, তার নির্ভার চোখ-মুখ, চিন্তার ছায়ারেখা নেই; আকলিমার তো কেমন ভয় ভয় করে। অচেনা আশঙ্কার বিষকাঁটা খাবলে ধরে স্বস্তি। কোনো বুদ্ধি পায় না: আবদুর রশিদ এখন হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকা বেকার মানুষ। কীভাবে দিন যাবে? কী ভাবে চলবে? ছেলেমেয়ের ভরা সংসার। সেই সন্ধেয় এইসব হাজার চিন্তা-দুশ্চিন্তার জটিল গুল্মলতা সারারাত ঘুমোতে দেয় না। তার সকল ভাবনার আগামিকাল বিদঘুটে ছায়াচিত্র হয়ে দেয়ালে ভেসে ওঠে। পথ হারানো অন্ধকার গোলকধাঁধা।
আবদুর রশিদ লক্ষ্য করে। সেও নির্ঘুম গুনে যায় রাতের সময়। এপাশ-ওপাশ কাত হয়ে স্বস্তি খোঁজে। তারপর নিজের কাঁধে যেমন সবকিছু তুলে নিয়েছে, তেমনভাবে আকলিমার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলে, –
‘তুমি অত ভাইবো না আকলিমা। ঘুমাও। আল্লার দুনিয়ায় যত মুশকিল…তত আশান। আমার একার চাকরি তো যায় নাই, চার-পাঁচজনের গেছে। মালিক যার যেমন বেতন, তেমন হিসাব কইরা ট্যাকা দিছে। ট্যাকা হইল শক্তি। আমি যা ট্যাকা পাইছি, দেখি কোনো দোকান-টোকান দেওন যায় কি না।’

এত সোহাগ নির্ভরতার সেই মানুষ অকালে চলে গেল একদিন। পঞ্চাশ হাজার টাকার একবুক আশা-প্রত্যাশা-মনোবল আর পরিশ্রম নিয়ে কাচারিতে খুলে বসে ভেন্ডার ব্যবসা। প্রাসাদের মতো ভবন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, তারই মধ্যে টেবিল-চেয়ারের আপাত শৌখিন জীবন তখন টং দোকানে হাঁটু গেড়ে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে। এদিক-ওদিক সাজিয়ে রাখে কোর্ট ফি, ডিডবন্ড, রেভিনিউ স্ট্যাম্প, ওকালতনামা আরও কত কী! মনে কোনো খেদ নেই। পুরুষের জীবনে দুই দশা, কখনো হাতি কখনো মশা। আক্ষেপ থাকলেই কি? আবদুর রশিদ চাপা মানুষ। তার চোখে-মুখে কোনোদিন দেখা যায় না। এই পৃথিবী এমনই। কেউ সোনার চামচ আর রুপোর বাটি নিয়ে জীবন উপভোগ করে। কেউ শানকিতে খুঁজে ফেরে পান্তার আমানির নিচে থেকে যাওয়া ভাতের দু-একটি দানা। সব সহনীয় হয়ে এসেছিল। অথবা কে জানে তার বুকের গোপন দীর্ঘশ্বাস। আকলিমার কষ্ট হয়। মানুষটার বুকের মধ্যে নিজেকে সঁপে সব বুঝতে পারে…বুঝতে পারে না। কোনো উপায় নেই। এই তো জীবন। মামুন এসএসসি দেবে। মুনা স্কুলে ক্লাস ফাইভের ফার্স্ট গার্ল। তাদের নিয়েই যত স্বপ্ন আর সম্ভাবনা। অথচ সেই জীবনও কোথায় হারিয়ে যায়।
আকলিমা গ্রীষ্মে এক দুপুর শেষে বুঝে নিল আবদুর রশিদকে। আগুনে পোড়া কালচে-লাল মানুষ। কাঠ-কয়লা-ছাইয়ের গাদায় লুকিয়ে থাকা দেহ। রক্ত-মাংসের শরীর। কত চেনা হাত-পা-মুখ-চোখ সব অচেনা বীভৎস লাগে। আকলিমা দৃষ্টি লুকোয়। আবদুর রশিদের হাতে তখনো টিক টিক বেজে চলে শৌখিন ঘড়ি। এই একটি জিনিসের প্রতি বড় দুর্বল ছিল যে সে। তখন আকাশ বিদীর্ণ জলভেজা ধোঁয়ার মধ্যে বেজে চলে সময়ের কোনো কথা। সময়ের কাজ সময়ে না করলে পস্তাতে হয়। আকলিমা সেই স্বর শুনতে শুনতে ঝাপসা চোখে আবদুর রশিদকে খোঁজে। কেন তাকে একলা ফেলে চলে গেল?
কয়েকদিন ধরে কানাঘুষো গুজব বাতাসে ভাসে। জজকোর্ট চত্বরে কোনো দোকান থাকবে না। বানর খেলা মাদারি, কবরেজি দাওয়া আর তাবিজ বিক্রি, টিয়ের ভাগ্যগণনা কোনোকিছুর স্থান নেই। নতুন কোর্ট ভবনের প্ল্যান চূড়ান্ত হয়ে গেছে। টাকা এলেই শুরু হবে কাজ। একদিন সত্যি সত্যি কোর্ট ভবনের দক্ষিণে হাতুড়ি-শাবলের আঘাত পড়ে। লাল সুরকি-চুন পলেস্তরা খসে পড়তে থাকে, যেমনভাবে মানুষের জীবন-জীবিকার অবলম্বন ছায়া। সাইরেন মেশিন দো-তলা থেকে নেমে আসে মানুষের হাতে হাতে। এখন সার্কিট হাউসের ছাদে অথবা কে জানে কোথায় বসানো হবে। কেউ কেউ নিজেদের দোকান ভেঙে মালামাল যা কিছু নিরাপদ স’ানে সরাতে ব্যস্ত হয়। আবদুর রশিদ সময় পেল না। তার টং ঘর আরও কয়েকটির সঙ্গে সময়ের অপক্ষো করে। সময়ের কাজ সময়ে করা হলো না তার। সে খেসারত দিল। কয়েক শত টাকার কাগজ বাঁচাতে আগুনের সঙ্গে প্রাণান্ত যুদ্ধ। যুদ্ধে তো জয়-পরাজয় আছে। কেউ জেতে কেউ হারে।
তারপর আকলিমার নতুন বাস্তবতা নতুন জীবন। ভেন্ডার দোকান মালিক সমিতি থেকে কিছু টাকা হাতে পায়। সেই টাকায় কী করা যেতে পারে ভাবতে ভাবতে কোন্‌ সময় শেষ বোঝা গেল না। পৃথিবীতে কেউ টাকা জমায় কেউ খরচ করে। টাকা হলো পুণ্য, সেখানে শক্তি-সাহস আর আস্থা। কেউ খরচ করে ভালো-মন্দ খায় আর পেটভরতি হাগে। আকলিমার এসব ভাবনার সময় কোথায়? সে শুধু বোঝে শক্তি কমে আসছে, নিঃশেষ হতে চলেছে; অথচ কিছু করা হলো না। এমন কেউ নেই যে দুর্দিনে কাছে এসে সাহস জোগায়। তিন-চার বছর এর দরজা ওর আঙিনায় কাজ করে কাটিয়ে দিল। বুকজুড়ে অস্থির হতাশা। অশান্তি-কষ্ট আরও। এতকিছুর মধ্যে কখনো শূন্য হাহাকার তেপান্তর জাগিয়ে তোলে। মানুষটা কাছে ছিল আজ নেই। একা একা কী করে সে? তখন মামুন-মুনার মুখ চেয়ে প্রাণে শক্তি খোঁজে। মানুষ করতে হবে তাদের। আকাশ দিগন্তে দৃষ্টি রেখে আশা-প্রত্যাশার স্বপ্নদোলা। কারও প্রতি কোনো অভিযোগ কোনো আকাঙ্ক্ষা কোনো হিসাব-নিকাশ নয়। নিজের মড়া নিজেকেই সামলাতে হয়। তাই একলা চলার দিনকাল কত সহজেই জীবন-অস্তিত্বের সঙ্গে মিলেমিশে যায়। কিন্তু এখন? কীভাবে সামলায় অচেনা-অজানা এই দিনকাল? সে কোনো দিশা পায় না। সামনে বিস্তীর্ণ জমাট অন্ধকার। আকলিমার আনত দৃষ্টি মলিন মুখ অতীতের চোখে চোখে আকাশের তারায় পথের দিশা হাতড়াতে থাকে। কাউকে অসি’র খুঁজে ফিরে যায়। আশ্চর্য ঘুরেফিরে পুনরায় বারবার ভেসে ওঠে সেই সকাল। মামুন কেন যে এমন করে বসল। এই তার দোষ। বাপের স্বভাব।

মুনা স্কুলে যায়। ক্লাস এইট শেষ করে নাইনে উঠেছে। গত অগ্রহায়ণে পেরিয়ে এলো তেরো বছর। স্কুল থেকে উপবৃত্তি পায়। মেধাবী বলে মনোযোগি আদর-যত্ন। আকলিমার এসব অহংকার। নিজের পড়ালেখার সাধ ছিল। হয়নি। মেয়ে তার অনেক অনেক পড়বে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নাম-সুনাম অর্জন করবে একদিন। আকলিমার গোপন স্বপ্ন। সেগুলো কখনো গুনগুন সুর তোলে। অলীক ভাবনায় ভেসে যায়। মুনা স্কুল যেতে সাজে। উজ্জ্বল ফরসা পানপাতা মুখ। পূর্ণিমা চাঁদ। মেঘ কালো ঝাঁকড়া চুল। আকলিমার আনমনা সঘন দৃষ্টি। মনের গহিনে বহমান নদী। তার জলছায়ায় বুঝি খেলা করে নিজের কৈশোরবেলা। মেয়ের দিকে চোখ পড়লে দৃষ্টি ফেরাতে পারে না। মায়ের নজর। কোনোদিন টুক করে কপালের ডানপাশে কাজল টিপ পরিয়ে দেয়। মুনা হাসে।
‘এইডা কী হইল? আমি কি ছুডো বাচ্চা?’
‘নজর লাগব না রে মা।’
‘দূরো! আমারে আবার কেডায় নজর দিব? গরিব মানষের ছাওয়াল। মা হোডলের রাঁধুনি।’
আকলিমাও হাসে। বোকার সেই হাসি বিষাদে ভরে যায়। আজ যদি মানুষটা বেঁচে থাকত! মেয়েকে দেখে কত না সুখ। সেই সুখে যে তারও অংশ আছে। হায় সুখ সবার কপালে জোটে না! মুনা কপালের টিপ মুছে রাস্তায় বের হয়। গ্রীবা বাঁকিয়ে হেসে হেসে কি মধুর বলে বসে!
‘যাই গো মা।’
‘দেইখ্যা যাস মা। রাস্তাঘাটে খেয়াল রাখিস।’
‘হুঁম। গুডবাই।’
মুনার দুষ্টুমি হাসি। তার যাওয়ার পথে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে আকলিমা। মেয়েকে কি বয়সের চেয়ে বেশি বড় দেখায়? কেমন ডাগর হয়ে উঠেছে নয়নের মণি। চেহারা-ছবি-রং আর…অকারণে আরক্ত হতে থাকে আকলিমা। কেমন করে বেঁধে রাখে সোনার টুকরো আকাশের চাঁদ?

মুনা শেষমেশ আসতে চেয়েছিল। ভাইকে খুব ভালবাসে। অভিমান-রাগ যা হোক ধরে রাখতে পারে না। এমনিতেই চোখ-মুখ ভার ভার। তার উপর সেয়ানা মেয়ে। সে বরং ঘরে থাক। আকলিমা তাই সঙ্গে নেয়নি। মনের আবেগ দিয়ে তো সব কাজ হয় না। কোতয়ালি থানা অচেনা ভয়ের জগৎ। সেখানে কোন‌ নিশ্চুপ অন্ধকার কোনায় পড়ে আছে মামুন কে জানে। সেখানে কোথায় কার কাছে যেতে হবে কিছু জানা নেই। ফিরিয়ে আনতে পারবে কি না সন্দেহ দোলাচল। মুনা দরজার কাছে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দুশ্চিন্তা-কাতর দৃষ্টি অন্ধকারে ছড়িয়ে রাখে। সব দোষ তার। কোন কারণে কীভাবে যে ঘটে গেল, কিছু তার অনুমান, বাকিটুকু বুঝি সত্য। নিজেকে ক্ষমা করে কোন বিশ্বাসে? সে আর সহ্য করতে পারছিল না। কোনো উপায় বা বুদ্ধিও নেই। প্রায় প্রতিদিন সীমাহীন দুর্লঙ্ঘ্য অত্যাচার। স্কুলের পথে নিমতলা মোড় বড় ভয়ংকর লাগে। বুক ঢিপ ঢিপ করে। বুধারু চা স্টলের আশপাশে আড্ডা দেয় সজল। তিন-চারজন সঙ্গে থাকে। তারা সিগারেটের ধোঁয়া ওড়ায়, উচ্চস্বরে কথা বলে, আজেবাজে নোংরা শব্দ, হাসি-অট্টহাসি-চিৎকার, দৃষ্টিতে কুৎসিত কুশীলব। এইটুকু পথ পেরোতে কত সাহস আর শক্তির পরীক্ষা। মুনা মাথানিচু নিশ্চুপ পেরিয়ে যায়। সহজাত অনুভূতিতে বুঝতে পারে, কখনো শুনে যায়, পেছন পেছন আসতে থাকা হাজার দৃষ্টি আর জঘন্য শব্দশর। সে কী করে বা করতে পারে? এই তো নিরাপদ সময় আর সভ্যতা। মানুষ কত লক্ষ বছর পেরিয়ে এলো? সেদিন সজল ওড়নায় টান দেয়। শফিক, মাসুদ আর জিলাপির চিৎকার অট্টহাসি। বীভৎস ভয়ংকর সকাল। স্কুল যাওয়ার তাড়া। মুনা রাস্তা থেকে কোনোমতো ওড়না উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে নেয়। একপলক পেছনে তাকায় কি? সেই দৃষ্টিতে আগুন ঝরে। রাস্তার ওপারে স্টুডিওর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে তপন। তার ড্যাবড্যাব দৃষ্টি। মুনা বোঝে কি বোঝে না অথবা কী বোঝাতে চায়? কী বলতে চায়? তপন এগিয়ে আসে। মুনার হাতে বইখাতা তুলে দিতে দিতে কী বলে সেও অজানা। মুনা কিছু বোঝে না অথবা সব অচেনা নতুন। সে প্রায় ছুটে মোড় পেরিয়ে যেতে থাকে। অ্যাসেমব্লি বুঝি শুরু হয়ে যায়। তারপর যেভাবে ভুলে যায় অথবা প্রতিদিনের এইসব ঝামেলা মনে থাকে না, রাখতে নেই; স্মরণে ছিল না। মামুন একদিন সন্ধের টিউশন থেকে ফিরে জাগিয়ে তোলে সব। মুখ-চোখ গম্ভীর লাল। যেভাবে ঘরের কোনায় সাইকেল রেখে বিকেল থেকে রাত আট-নয় অবধি তিন-চারটি টিউশন শেষে ক্লান্তির অবশেষ টেনে নেয়, ঘরোয়া পোশাক পরে কলতলায় যায়, হাত-মুখ ধোয়, তেমন করে না।
‘তোরে কেউ ডিস্টার্ব করে বলিসনি তো?’
‘কী বলব? এসব গায়ে মাখলে চলে?’
মামুন রেগে আছে। মুনা চকিতে চোখ থেকে চোখ সরিয়ে এদিক-ওদিক দিগ্‌ভ্রান্ত মায়ের কাছে এসে থামে। আকলিমা তখন বাইরে থেকে ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। সারাদিনের কাজ শেষ। রাস্তার গলিতে দু-খানা ঘর। এই দরজা যাওয়া-আসার পথ। ঘরের মধ্যে যতটুকু উচ্চকণ্ঠ সব তার বাইরে হামলে পড়ে। তার কানেও গেছে মামুনের জিজ্ঞাসা। কণ্ঠস্বরের ঝাঁজ। সে তো এমন করে কথা বলে না।
‘কী হইছে?’
‘তুমি জানো মা, মুনারে সজল-মাসুদ-জিলাপি রাস্তায় ডিস্টার্ব করে, তুমি জানো?’
‘ক্যান কী হইছে? এইসব নিয়া পিরেশান হওনের কী আছে? আপ ভালা তো জগৎ ভালা।’
‘কিন্তু,…।’
মামুনের স্বস্তি-অস্বস্তি অথবা রাগ। মায়ের মুখে কিছু শোনার অপেক্ষা। তাকে বড় অধৈর্য মনে হয়। শান্ত মানুষ অশান্ত হলে অনেক সমস্যা। আকলিমা কী বলে? কোনো ভাষা নেই। সে আলগোছে নিজেকে কলতলায় নিয়ে যায়। সারাদিনের কাজ। শরীর-মনে ক্লান্তি অবসাদ। সময় নিয়ে শুনতে হবে কী বিষয়। মামুনের ধৈর্য নেই।
‘ক্যান আইজ কী হইল মুনা?’
‘তেমনকিছু হয় নাই। ভাই শুধু শুধু গোস্যা করতাছে।’
‘কিছু না মানে? সজল ওরে ধাক্কা দিছিল। ওড়নায় টান মারছিল। কিছু নয়? সে বলে না ক্যান?’
‘তুই শুনলি কার থন?’
‘যেহান থাইক্যা শুনি…বিষয়ডা তো সহ্য করা যায় না। আমারে কইল না ক্যান?’
‘ওগুলা নিয়া ভাবিস না বাপ। খারাপ পোলাপান। ওদের লাইগ্যা কাইজ্যা করবি? মারামারি করবি? নিজের মানসম্মান নিজের কাছে। ওগুলা নিয়া মাথা গরম করিস না।’
‘তুমি তো চিরকাল মাথা নিচু কইরাই রইলা। দেশে কি আইনকানুন নাই? ইয়ার্কি!’
‘বাদ দে বাপ বাদ দে। রাগ করিস না।’
আকলিমা যত সহজে সবকিছু এড়িয়ে যেতে চায়, যতটুকু চেষ্টা, সময় বুঝি ক্ষমা করে না। মুনার অসহায় দৃষ্টির কাছে সব উদোম হতে থাকে। কেউ বুঝি বলেছে। অনেক রাগ মামুনের। কীভাবে জানল সে? তার কানে কে তুলেছে? মুনা নিশ্চয়ই নয়। কে তবে কানে উঠিয়েছে?

আকলিমা কোতয়ালি থেকে ব্যর্থ ফিরে এসে পুনরায় হাজার মুখ-ব্যাদান ভাবনায় ডুবে যায়। মুনা সামনে বসে আছে। চোখের তারায় আকুল জিজ্ঞাসা। আকলিমা কী জবাব দেয়? সে যে কারও মন গলাতে পারে নাই। কত অনুনয়বিনয় করল। কোনো অনুকম্পা পায়নি। অচেনা মানুষের পায়ে গড়াগড়ি। তারা আইনের মানুষ। আইনের চোখে সবাই সমান। সে গরিব। গরিব মানুষের শক্তি থাকে না। আবদুর রশিদ চলে যাওয়ার পর সবটুকু নিঃশেষ হয়ে গেছে। এখন ঘরে এসে ছোট ছোট নিশ্বাসে বুঝে নেয় বেঁচে আছে কি না? আকলিমার মেঘভেজা চোখ বাইরের অন্ধকারে কোনো সান্ত্বনা খুঁজে নিতে চায়। সেখানে নিকষ কালো অন্ধকার। কখনো জানালা গলিয়ে দূর আকাশের বিদ্যুৎ ঝলকানি হামলে পড়ে। মেঘ জমেছে। বাতাস থেকে থেকে শীত স্পর্শ ছড়িয়ে দেয়। মাথার উপর পঁচিশ ওয়াটের বালব মিটমিট ফ্যাকাশে আলো। আকলিমার চারপাশ ঘনিভূত অন্ধকার। তাকে আরও জমিয়ে দিতে আচমকা নেমে আসে লোডশেডিং। ক্রমশ অজানা আতঙ্কে হাত-পা ভারী হতে থাকে। তখন দু-জন মানুষ দমবন্ধ বিষণ্ন নিশ্বাস নিতে নিতে অন্ধকার মেপে নেয়। একজন আরেকজনের কথা শোনার আশায় মুখিয়ে থাকে। অথচ কেউ কোনো কথা বলে না। এই তো ঘণ্টা কয়েক আগে ওপাশের পেয়ারা গাছে দুটো চড়-ই নেচে নেচে এই ডাল থেকে ওই ডালে উড়ছিল। এখন কেমন নিশ্চুপ। অন্ধকারে শাখাপ্রশাখায় কোনো দোলা আছে কিনা বোঝা যায় না। এই নীরব অবসরে দু-জন চুপচাপ বসে থাকে।
মুনার ঘুরেফিরে সেই সন্ধের কথা মনে পড়ে। মামুনের শত অভিযোগ। কেন তাকে জানানো হয়নি? মুনার বুকচাপা হাজার ভয়। তার নিশ্চুপ দৃষ্টি মায়ের চোখে ভরসা খোঁজে। এ ছাড়া কী করতে পারে? কোন্‌ কথা কাকে জানায়? ওইদিন সকালে যে ঘটনা, সজল ওড়না কেড়ে ফেলে দেয়। মুনার হাত-পা কাঁপে। শক্তিহীন বিবশ শরীর। মাথায় ভোঁ ভোঁ গুঞ্জন। সে একলা মেয়ে কী করে? কোনোমতো পালিয়ে বাঁচতে ব্যাকুল। তখন কোত্থেকে ছুটে আসে তপন। সেই সব জানিয়েছে। মুনা নিশ্চিত। আজ অন্ধকারে মায়ের পাশে বসে হাজার দুর্ভাবনার মধ্যরেখায় সেই কথা পুনরায় মনে আসে। তপন কেন জানাল? কী এমন ক্ষতি হতো না জানালে? আড়ালে-প্রকাশ্যে কত ঘটনাই তো ঘটে যায়। মুনা সেদিন থেকে ভয় পেয়েছে। তাই যতবার ওই রাস্তায় পা রাখে ভীত-সন্ত্রস্ত পেরিয়ে যায়। মোড়ে বুধারু চা স্টল সরগরম থাকে। কোনোদিন আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ভেসে যায়। কখনো বেশ নির্জন। মুনার স্বস্তি। অবশ্য তেমন ঘটনা আর হয় না। মুনা একরকম ভুলতে পেরেছিল। মানুষকে অনেককিছু ভুলে যেতে হয়। মামুন যেদিন প্রশ্ন তোলে আর রেগে যায়, সে কেন কবর খনন করে মৃতদেহ জাগিয়ে তোলে? তখন থেকে দু-জন মানুষের বুকে অচেনা ভয় জেগে থাকে। সাপ যেমন গর্তের মুখে এসে বাইরে তাকায়, তেমন করে কখনো ভয় ইশারা দেয়। কখন না জানি কী হয়?
মুনার হাজার উদ্‌বেগ হাজার ভয়। মামুনের উচিত হয়নি। সজলকে থাপ্পড় মেরে বড় ভুল করেছে। সজলের বড়ভাই সরকারি দলের মানুষ। সজলও ছাত্র সংগঠনের নেতা। অনেক ক্ষমতা তাদের। মুনা কিছু বোঝে না। মামুন কেন এমন করল? অভিযোগ করতে গেল কেন? কেউ তো কিছু বলে না তাদের। সবকিছু নিয়ে কথা বলতে নেই। এখন কী হবে কে জানে। মঙ্গল-বুধ-বৃহস্পতি, শুক্রবার পেরিয়ে আজ শনিবার দরজায় ‘ঠক-ঠক-ঠক’ অস্থির টোকা। মামুন তখন শেষ টিউশনের জন্য রওয়ানা দেবে। ঘরের বাইরে সাইকেল। সে প্রথম বের হয়। তারপর কী কথা, কাদের সঙ্গে, মুনা দেখে কেউ একজন ঘরে এসে কিছু রেখে গেল। এত আকস্মিক এত দ্রুত সব যেন কিছু নয়, চোখের ভুল; সেই ভুল মিথ্যে মরীচিকা সত্য আজ। মামুন এখন কোতয়ালির অন্ধকার ঘরের কোনায় বসে কী ভাবে? সে কি অনুতাপ? কোথা থেকে ভেসে এলো ডুকরে ওঠা কান্না? মুনার কাঁধে কারও হাত এসে পড়ে। সে ওই হাতকে নিজের দিকে টেনে নেয়। সেই সময় ঠিক, বৃষ্টির দিগ্‌বিদিক বড় বড় ফোঁটা নামতে শুরু করে। ঝম ঝম শব্দে জেগে ওঠে টিনের চাল। সেই তাল-লয়-ছন্দের সঙ্গে কেউ ফুঁপিয়ে কেঁদে যায়। মুনা নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। মাকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে সেও।

বেশি দূরের পথ নয়, অথচ সীমাহীন তেপান্তর; সময় নড়ে না। সকাল থেকে অদ্ভুত ন্যুব্জ মন্থর হেঁটে যায়। এলোমেলো ভাবনায় আশা-দুরাশা কুহকী সকালের মতো খাপছাড়া। সারারাত বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ। মামুন না জানি কত কষ্টে আছে। আকলিমার শত ক্লান্তি, বয়সের ভার; আলগোছে চোখের পাতা নেমে আসে। আসে হায় আসে…ঘুম হয় না। তন্দ্রাঘোর রাত অন্ধকার বয়ে যায়। জেলখানায় সময়ের ঘণ্টা বাজে। রাতে কতবার উঠে বসে আকলিমা? শরীরের মধ্যে কত পানি জমা থাকে? মানুষের যাওয়া-আসা আবছায়া জীবন। একবার আলো জ্বেলে কিছু খোঁজে। কয়েকটি টাকা। বাক্সের কোন কোনায় রেখেছে দুটো বালা। আবদুর রশিদের দেওয়া শেষ চিহ্ন। মুনার জন্য সাত রাজার ধন যক্ষের মতো আগলে রেখেছে। আকলিমা যতবার ওঠে, বুঝে নেয় জেগে আছে মুনা। ভাই কষ্টে থাকলে বোন ঘুমোতে পারে? চোখ ছোট ছোট দৃষ্টিতে দুর্ভাবনা-উৎকণ্ঠার ছায়াচিত্র ভেসে যায়। একটি ভুল। সে যে এত মারাত্মক হবে কে জানত? মানুষ ভুল জীবনের কত কাহিনি কত অপমান কত যন্ত্রণা বয়ে বেড়ায়, কাকপক্ষী টের পায় না, অথচ একটি চড়; মামুন কত মূল্য টেনে বেড়ায়। আজকের রাত। সকালে হয়তো থানা কোর্টে চালান করে দেবে। একজন ভালো ছেলে, মেধাবী ছাত্র, তার কপালে বসে যাবে কলঙ্ক তিলক। মাদক কারবারি। কে জানে কোন খেলা চলে আকলিমার বুকে? রাত-ভোর-সকাল সারাক্ষণ শুধু কু-ডাক। ঘর থেকে আঙিনা, পেয়ারা গাছের ছায়া, আর সামনে বিশাল খনন, সবখানে খাঁ-খাঁ শূন্যতা বয়ে আনে বাতাস। রাত দুপুরে কয়েকটি কুকুর ঘেউ ঘেউ শব্দে কাতর কাঁদে। বড় অলুক্ষণে। হায় হায়!
তখনো আকাশে তেমনভাবে আলো ফোটেনি। আকলিমা কারও দোরগোড়ায় কাউকে ডাকে। মুনা সঙ্গে এসেছে। ফাল্গুনের শেষদিকে কোনো কোনো ভোর হিম হিম লাগে। এক টোকা দুই টোকা…কত আর। অনেকক্ষণ পর বেরিয়ে আসে কেউ। তপনের বাবা। মানুষ সহজে বিস্মিত হয় না। অদ্ভুত গম্ভীর মুখে মৃদু হাসি রংধনু মনে হয়। কারও সাতে-পাঁচে নেই।
‘কী ব্যাপার এত ভোরে?’
‘ভাইজান একটু তপনকে দরকার। একটু ডেকে তোলা যাবে?’
‘সে কি আর উঠেছে? নয়টার আগে তো নবাবের বাচ্চা ওঠে না। তো ভেতরে আসো। দেখি।’
‘না ভাইজান, দুটো কথা শুনে চলে যাব। জানেন তো…।’
‘হ্যাঁ শুনলাম। কি যে জামানা এলো! আল্লাহু সাফি আল্লাহু মাফি।…একটু দাঁড়াও তবে।’
তারা দাঁড়িয়ে থাকে যেমন অনন্তকাল স্থির। আজকের মধ্যে একটি দফা রফা করতে পারলে হয়। সময় কম। এক-দুই-তিন করে মিনিট কেটে যায়। কতক্ষণ নাকি খুব বেশি সময়? তপন ঘুম জড়ানো চোখে এসে দাঁড়ায়। তারপর কী কথা আনুপূর্বিক ঘটনাপ্রবাহ শলা-পরামর্শ। সে এমনটা হবে জানলে কিছু বলত না মামুনকে। বড় ভুল হয়ে গেছে। জগৎ এমনই, কেউ ভুল করে, কেউ অন্যের ভুলের খেসারত টানে। পৃথিবীর আজব দাবাখেলা। আকলিমা আবার হেঁটে যায়। মুনা সঙ্গে সঙ্গে কখনো পাশাপাশি কখনো সামনে পেছনে হেঁটে আসে। অচেনা দূরের যাত্রা। হোক দূর কিংবা কঠিন। সজলের কাছে মাফ চেয়ে নেবে। ওর ভাই বড় নেতা। কোতয়ালিতে ফোন করে দিলে সেখানেই সব মিটে যায়। ক্ষমার চেয়ে বড় কিছু আর নেই। প্রয়োজনে পা ধরে মাফ চাইবে। উলটো দিকে কান মলে নেবে না হয়।
যেতে যেতে অনেক সময়। এখন খালপাড়ায় ভদ্র অভিজাত মানুষের বসবাস। একসময় মেথরে সয়লাব ছিল। এখানে-ওখানে মানুষ আর শূকরের দলবদ্ধ জীবনযাপন। ড্রেন-ল্যাট্রিন পরিষ্কারের ব্রাশ-বালতি আর কত কী ঝুপড়ির দেয়াল আর আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। বাতাসে চোলাই মদ, মানুষ আর শূকরের মলমুত্রের দুর্গন্ধ মৌতাত। আকলিমা সেই কথা মনে করতে চায় না। মন বড় অশান্ত অসি’র। তারপরও ঘাগড়ার কাদাজলে কয়েকটি শূকরের হুটোপুটিতে মনে পুরোনো স্মৃতি উঁকি মেরে যায়। কত কথা কত স্মৃতি। আকলিমার দৃষ্টি কি ভিজে উঠে? চোখের জল যে শুকিয়ে গেছে। একাত্তর কত পটপরিবর্তন করে দিল। কার বাড়ি কে দখল করে নেয়। কার আগুনে পোড়া ভিটেয় ওঠে নতুন ঘর। পৃথিবী আর মানব সভ্যতার ইতিকথা। আবদুর রশিদ বলে, –
‘বোঝলা আকলিমা, আমাদের জমি ছিল, দোকান ছিল, ভালো ব্যবসা। মুক্তিযুদ্ধে সব শেষ। যুদ্ধে কেউ বড়লোগ হইয়া যায়, কেউ রাস্তার ফকির। ভারত পলাইতে পারি নাই। বাবা গেল না। গ্রামে চাচাদের কাছে গেলাম। তারপর এহানে-ওহানে জান লইয়া দৌড়াদৌড়ি। জুন মাসের দিকে ফের টাউন। গ্রামে খান বিহারি আর রাজাকার মানুষ মারতাছে। কে কারে ধইরা লইতেছে। বাঁইচ্যা থাকনের কোনো গ্যারান্টি নাই। বিশ্বাস নাই।’
‘আমি কইতে পারি না।’
‘তুমি পারবা কেমনে? তখন আমিই তো ক্লাস সিক্সে পড়ি। ছুডো মানুষ। একদিন বিহারিরা আমাগো বাড়ি আইল। তাগো হাতে গরু-ছাগল জবাই করা ইয়াব্বড়া ছোরা। বাপেরে টাইন্যা নিয়া গেল। পিস কমিটিতে নাম লেখাইব। আর ফিইর‌্যা আইল না।’
‘তোমাগো দোকান আর জমি?’
‘দোকান তো লুট হইয়া গেছে। জমির ভাগ পাওয়া গেল না। বড়বাপ-চাচায় কয় জমি নাই।’
‘আহা রে! আপন মানুষ তারাও এ্যামনডা করল?’
আকলিমা জানে মানুষ চেনা বড় দায়। অভিজ্ঞতা কম হয়নি। মানুষের পোশাক চেহারাছবি যেমন দেখা যায়, তার সবটুকু সত্য নয়; মানুষ মুখোশ পরে থাকে। সব মানুষ তো তেমন নয়। একটি ভালো কাজে যেতে এইসব ভাবনা আসে কেন? কেন এত কু-ডাক আকুল করে? ঘাগড়ার কাদাজল দুর্গন্ধের ভারী বাতাস, কালভার্ট পেরিয়ে এলে মন থেকে সকল অতীত দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে দিতে পারে সে। অনেক আশা নিয়ে বেরিয়েছে। নিশ্চয়ই সফল হবে। এই সকাল-গাছপালা-বাড়িঘর দেখার সময় নেই। মন তবু অপাঙ্গে আশপাশে তাকায়। মুনা ঠিক বাবার মতোই বেশ গম্ভীর। কে বলবে তার বুকেও কোনো ঝড় বয়ে চলে।

 

 

 

 

 

 

চলবে…

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত