| 18 এপ্রিল 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

লকডাউনে পর্যটক

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট
Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comমনটা একদম ফুরফুর করছে কারণ সন্ধ্যা থেকে আজকে অনেকগুলো জায়গা ঘুরে ফেলেছি। অফিস শেষ করেই সোজা, কালকে রাতে অর্ধেক ঘুরে বেড়ানো কাপাডোকিয়া’র বাকি জায়গাগুলো ঘোরা শেষ করলাম। কয়েক শতাব্দীর পুরনো গুহাগুলোকে হোটেল বানানো হয়েছে। ছোট বড় গুহাগুলোতে রাশি রাশি ফ্রেস্কো… যীশু, মা মেরী ও আরো কত সন্তদের ছবি দেয়ালে দেয়ালে। হাজার বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা এ এক আশ্চর্য ল্যান্ডস্কেপ… পৃথিবীর বুকে অতি প্রাকৃত অন্য কোন গ্রহ একটা! দেখতে দেখতে আমিও পাহাড়ের গায়ে প্রাচীন এক গুহার মধ্যে চুপ করে বসে থাকতে থাকতে সেই আদিম প্রকৃতির মধ্যে মিশে যাচ্ছি।
গতকালকে সন্ধ্যা থেকেই আমি যেন এক মুসাফির হয়ে, বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। হারিয়ে যাচ্ছি ইস্তানবুল এর হাজিয়া সোফিয়া’র হাজার বছরের গোলক ধাঁধাঁয়, যার প্রতিটি বাঁকে বাঁকে মধ্যযুগের ইতিহাসের গন্ধ, পুরনো দিনের গা ছমছমে রহস্য আর ধ্বংসের বিষন্নতা! নিজেকে যেন আমি দেখতে পাচ্ছি সুলতান আহমেদ স্কোয়ার এ ‘ব্লু মস্ক’ ধরে হেঁটে বেড়াচ্ছি আর টপকাপি প্যালেস থেকে গোল্ডেন হর্ণ আর ইস্তানবুল এর টিউলিপ এর অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নির্ণিমেষ তাকিয়ে আছি। বসফরাসের দুদিকে চোখজুড়ানো সব ছবি… জমকালো ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে একদিকে এশিয়া অন্যদিকে ইউরোপ এই দুই মহাদেশের ছায়ায় বড় হওয়া মোহনীয় কনস্টান্টিনোপল, আজকের তুরস্ক- জালালুদ্দিন রুমি, নাজিম হিকমত আর ওরহান পামুকের দেশ।
বসফরাসের নীল পানিতে ভেসে বেড়ানো বড়ো বড়ো ডানা মেলা সি-গালদের গা ঘেষে, ক্রুজ শিপে বসে বেলি ড্যান্স দেখতে দেখতে ঘুমের অতলে তলিয়ে যাই রাতে আর স্বপ্নে আমার হানা দেয়, টাটকা ফলের রস আর হরেক রকম চিজ, ঘন মধু, ডিম, টম্যাটো, জলপাই তেল মিলিয়ে তৈরী পৃথিবী বিখ্যাত তুর্কি প্রাতরাশ, সাথে দুধ ছাড়া চা, আর আছে বাকলাভা! আহ! টার্কিশ ডিলাইট যেন মুখের মধ্যে গলে গলে যাচ্ছে!
সকাল হতে না হতেই তো আবার শুরু ওয়ার্ক ফ্রম হোম। বিকেলের মধ্যে অফিস শেষ করেই ঝলমলে, উদ্দাম, রূপসী আন্তালিয়ার নীল বেলাভূমিতে হারিয়ে যাওয়ার জন্যে মন ছুটতে থাকে। আন্তালিয়া, ইতিহাসের সেই এশিয়া মাইনর, এক আশ্চর্য জাদুমায়া ভরা রহস্য প্রান্তর, যেন এক নেশা ধরানো নাম। রোমান, সেলজুক,অটোম্যান, টার্কদের ফেলে যাওয়া অতীত চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এ গলি ও গলি ঘুরে দুদিকে পুরনো ধাঁচের দোতলা অটোম্যান বাড়িগুলো দেখতে দেখতে যাচ্ছি যার বেশীরভাগই এখন হোটেল, ক্যাফে আর রকমারী দোকান। আমি যেন অতীতের এক অটোম্যান এফেন্দী, এ্যাপ্রিকট গাছের নীচে বসে বসে যে এশিয়া মাইনরের আন্তালিয়ায় যুদ্ধরত আমাজন নারী যোদ্ধাদের তীর ধনুক চালানোর সাক্ষী! আন্তালিয়া থেকে মেডিটেরানিয়ান, সেখান থেকে একে একে এজিয়ান, মার্মারা, ব্ল্যাক সী দেখতে দেখতে ইতিহাসের পথ ধরে কত শতাব্দীর কত মানুষের ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছি। আঙুর মজানো মদের গন্ধের সাথে কৃষ্ণসাগরের তাজা মাছ ঝলসানো খুঁশবু যেন পাগল করে দিচ্ছে!
কোনিয়াতে যেয়ে চারপাশে অসাধারণ ক্যালিগ্রাফ করা জালালুদ্দিন রুমির সমাধি প্রাঙ্গনে বুঁদ হয়ে সুফি রুমি’র দরবেশী ঘূ্র্ণি নাচ ‘সামা’ দেখি আর তার শর্তহীন ভালোবাসা’র পৃথিবীতে আমি একা ‘হূ হূ জিকির’ করতে থাকি।
তুরস্কের পথে পথে পুরনো গ্রীকদের গন্ধ মাখা আছে এখনও। এজিয়ান সমুদ্রের ধারে এফেসাস… প্রাচীন গ্রীক রোমান বন্দর শহরের ধবংসাবশেষ। কামাল আতাতুর্ক শেষ গ্রীক মানুষদেরকেও কাপাডোকিয়ার গুহা থেকে চলে যেতে বাধ্য করলে সেখানে তুর্কিদের বসতি শুরু হয়। সেই গ্রীকদের ছেলেমেয়ে, নাতিপুতিরা নাকি এখনও দলবেধে পূর্ব-পুরুষদের এইসব গুহা দেখতে চলে আসে। শতশত বছর ধরে বংশপরম্পরায় বাস করা গুহাচ্যুত সেই অজানা গ্রীকদের জন্য আমার মনে কেমন যেন একটা বিষাদমাখা হাহাকার তৈরী হলো। ইদানিং শুনছি তুরস্ক থেকে অনেকেই গ্রীসের অপূর্ব সুন্দর দ্বীপ সান্তরিনি ঘুরতে চলে যাচ্ছে। তুরস্কের পর আজকে রাতে তাই ওটাই হবে আমার পরবর্তী ভার্চুয়াল ট্যুর।
টিভিটা বন্ধ করে ঘড়ির দিকে তাকালাম, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজে। আন্তালিয়ার নীল সমুদ্র এমন ঘোর লাগিয়ে দিয়েছে যে মনেই ছিলনা, আজ বৃহস্পতিবার, একটু বের হতে হবে আজকে, মায়ের বাসায় যেতে হবে। সপ্তাহে এই একদিন আমি মা’র সাথে দেখা করে দরকারী ওষুধ পত্রগুলো কিনে দিয়ে আসি, না যাওয়া পর্যন্ত মা অপেক্ষা করে থাকে। যদিও বাসা কাছে, হেঁটে গেলে আধাঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাবো।
রাত আটটার দিকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর এগিয়ে এসে চারদিকের সুনসান, ভূতুড়ে নীরবতা দেখে কেমন জানি গা ছমছম করে উঠলো, বুকের মধ্যেও কেমন যেন একটু চিনচিন করে উঠলো নিজের শহরের এই অচেনা চেহারা দেখে। মনে হচ্ছে সবার এখানে অসুখ, কারণ হাসপাতাল আর ফার্মেসীগুলো ছাড়া আর কোন কিছু খোলা নেই, অন্যকোন কিছুর চিহ্নও চোখে পড়ছেনা। ফার্মেসির দোকানগুলোর বিষন্ন হলুদ,সাদা নিয়ন বাতির আলোগুলো কেমন যেন জ্বলজ্বল করে আমার দিকে চেয়ে আছে।
কি অদ্ভুত যে লাগছে শহরটাকে দেখতে! প্রতিদিন হাজার রকমের লক্ষ যানবাহনের চব্বিশ ঘন্টা দানবের মত দাপিয়ে চলা ভীড়, কানের, নাকের পাশ দিয়ে হুসস করে বের হয়ে যাওয়া মোটরসাইকেল গুলো সব কোথায় ভোজবাজির মত মিলিয়ে গেল।! সারারাত ধরে নানা কাজে, অকাজের ব্যস্ততায় মুখর থাকা এই শহর যে রাত আটটা, ন‘টার মধ্যে এরকম শ্মশানঘাটের মত হয়ে পড়তে পারে কদিন আগেও কেউ কল্পনাও করেছে নাকি! এই সেদিনও চারদিকের সার্বক্ষণিক অসহ্য শব্দকে সকাল বিকেল শাপশাপান্ত করেছি। মহামারি যেন আলাদিনের চেরাগ হয়ে সারা পৃথিবীর মানুষের জীবন নিমেষে পাল্টে দিয়েছে। কয়েক মাসের মধ্যে পুরো পৃথিবী’র সব হিসাব নিকাশই উল্টে পাল্টে গেল। প্রকৃতিকে প্রতি মুহূর্তে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করার প্রতিশোধই যেন সে নিচ্ছে। তার উপরে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা এত অনাচার আর সহ্য করতে না পেরে অবাধ্য সন্তানকে বশে আনার জন্যেই যেন এই অস্ত্র ছুঁড়ে দিয়ে বলছে, ‘অনেক হয়েছে এবার থামো তো বাছা, একটু জিরোও, অকারণে বড় বেশী লাফাচ্ছো।’
অন্যসময় হলে এমন নীরবতাকে একটা মিষ্টি রোমান্টিক, এমনকি হঠাৎ সোনার হরিণ পাওয়ার মতোও ব্যাপার বলেই মনে হতে পারতো কারণ এই শহর কবে যে এমন নীরব ছিল এখনতো আর সেটা মনেই পড়েনা। না, তবে কিছুটা নিরবতা পনেরো, বিশ বছর আগেও ছিল। তখনও এতটা অসহ্য রকমের অগুণতি শব্দের জালে বন্দী হয়নি শহরটা। সারাক্ষণ কনস্ট্রাকশনের ঢংঢং, হিসস হিসস, ভুউউসসস জাতীয় বিচিত্র সব শব্দ আমাদের কর্ণকুহরে তালা লাগানো শুরু করেনি। এই শহরে বাস করার একটা আরাম তখনও পর্যন্ত ছিল।
আবাহনী মাঠের পাশ দিয়ে যেতে যেতে অবধারিতভাবে রুমকি’কে মনে পড়ে গেল। নানা নতুন নতুন রকমারী খাবারের দোকানের ভিড়ে ‘লাবাম্বা’র সেই জমজমাট জিভে জল আনা কাবাব রোল এর দোকানটাও নেই বহুদিন হলো। কত ঘন্টা,দিন,মাস কেটেছে ঐ দোকানে বসে, রুমকি’কে নিয়ে আড্ডায়, ঝগড়ায়, ভালোবাসায়। কোমল মায়াবী চেহারার সেই ধানমন্ডি ইদানিং সারাক্ষণ কাকের মত কর্কশ শব্দের কারখানা খুলেছে যেন। বারোয়ারি বহুতল ভবনের আড়ালে হারিয়ে গেছে গাছগাছালিতে ভরা মায়াবী সেই চেহারাটা। ‌ধানমন্ডির এই রাস্তাগুলো দিয়ে রুমকি’কে নিয়ে রিক্সায় করে কত যে ঘুরেছি! রিক্সাওয়ালার সাথে ঘন্টাভিত্তিক চুক্তি করে ঘোরা শুরু হতো আর এ গলি সে গলি চষে বেড়াতে বেড়াতে সেই চুক্তি বাড়তেই থাকতো কিন্তু কয়েকবার রিক্সা পাল্টিয়েও ঘোরা যেন আমাদের শেষই হতো না; রুমকি পায়রা’র মত বাক-বাকুম করতে করতে দেখা না হওয়া দিনগুলোর সব গল্প একটা একটা করে বলতেই থাকতো। একসময় কথা ফুরিয়ে গেলে দুজন দুজনের হাত ধরে নিঃশব্দে বসে থাকতাম, কখনও ওর মাথাটা আমার কাঁধে, আমার মুখটা ওর রেশমী চুলের ফাঁকে। সুমন এর গানটা মনে পড়লো, আমাদের দুজনেরই খুব প্রিয় ছিল যে গানটা-
‘এই শহর জানে আমার প্রথম সবকিছু
পালাতে চাই যত সে আসে আমার পিছুপিছু-‘
আমাদের প্রজন্ম তখন উঠতে বসতে সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গানে বুঁদ হয়ে থাকে। বয়স বাড়ছে বটে কিন্তু সেই বিশ, বাইশ বছরের ভালোলাগাগুলো এখনও মনে কিছুটা হলেও উত্তাপ ছড়ায় বৈকি!
রুমকি এখন কোথায় আছে জানা নেই। ওর বিয়ের পরে আর খবর নিইনি কখনও। হয়তো বরের হাত ধরে হারিয়ে গেছে পৃথিবীর কোন মেগাসিটির চোখ ধাঁধাঁনো আলোকসজ্জার মধ্যে! কেমন আছে ও? সেই চুড়ি ভাঙার মত খিলখিল হাসিটা যেন ‌অনেকদিন পর কানে ভেসে এল! আমার কথা কি কখনও মনে পড়ে? মনে পড়লে কি করে? খুব ঘৃণা করে নাকি আমাকে? বুকের ভেতর কোথায় যেন একটু মোচড় লাগে এখনও এটা ভাবলে। রুমকিকে ভালোবাসতাম কিন্তু আমার তখন মনে হয়েছিল এত তাড়াতাড়ি সংসারের চৌহদ্দিতে আমি ঢুকতে চাইনা, কোন দায়িত্বের মধ্যে ঢোকার জন্যে আমি প্রস্তুত নই, আরো একটু সময় চাই। কিন্তু সেটা হয়নি, হয় না মনে হয়! দুই রকম চাওয়া তো আর বাস্তবে পূরণ হওয়ার নয়। রুমকির বাসা থেকেও কোনো কথা শোনেনি। সব জেনেও চুপচাপ ছিলাম। রুমকিকে ভালোবাসি। ও চিরজীবনের মত আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে জেনেও আমি একটা নির্জীব সাপের মত পড়ে ছিলাম। নতুন একটা চাকরিতে মাত্রই ঢুকেছি তখন, সামনে আমার আরো কতকিছু করার পরিকল্পনা! চাকরীর পাশাপাশি কত কত জায়গা ঘুরে ঘুরে বেড়াবো!
বিয়ের আগের দিন শেষ ফোন দিয়েছিল রুমকি। কোন অভিযোগ আর করেনি, মনে হয় অধিক শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলো। দুজনে আসলে ইচ্ছে করলেই জীবনটা একসাথে শুরু করতে পারতাম, কেন করলাম না জানি না। সব প্রশ্নের উত্তর নেই, হয়না।
হাঁটতে হাঁটতে প্রায় কাছেই চলে এসেছি। সারাদিন শুয়ে বসে অফিস করে করে গায়ে চর্বি জমে যাচ্ছে, হাঁটাহাটিটা জরুরী। লকডাউন চলছে মাসখানেক হয়ে যাচ্ছে। একটা ফার্মেসীতে ঢুকে যথেষ্ট পরিমাণ মাস্ক, গ্লাভস আর মা’র প্রয়োজনীয় ওষুধগুলো একটু বেশী পরিমাণেই কিনে নিলাম, কখন আবার বাজার থেকে সব উধাও হয়ে যায় বলা তো যায়না। লকডাউনের প্রথমদিকে তো তাই হলো, দোকান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস অনেককিছুই উধাও, এখন অবশ্য আবার একটু স্বাভাবিক হয়েছে। ঘড়ি দেখলাম সাড়ে আটটা বাজে তারমানে পাক্কা আধাঘন্টা হেটে ফেলেছি রুমকির কথা ভাবতে ভাবতে।
মায়ের সাথে দেখা করে বাড়ি ফিরে সান্তরিনি ঘোরা শুরু করবো। লকডাউন শুরু হওয়ার পর প্রায়ই ইউটিউবে ট্রাভেল শো গুলো দেখতে দেখতে দুনিয়া ঘোরাটা আমার একটা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সন্ধ্যার মধ্যে অফিসের কাজ শেষ করেই শুরু করি ঘোরা। যেসব জায়গায় যাওয়া হয়নি এখনও কিন্তু আমার ঘোরার লিস্টের একদম প্রথম দিকে আছে সেগুলো নিয়েই মগ্ন হয়ে আছি, পৃথিবীর অসুখ সারলেই এক একটা করে ঘুরে ফেলতে হবে।যদিও অফিসের কাজে আমার নিয়মিতই বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় পাশাপাশি ঘোরাটাও হয় তবুও তার বাইরে এমন বহূ জায়গা আছে যা এখনও দেখা হয়ে ওঠেনি। আমার কলিগ রেজা ভাই তার ফ্যামিলি রেখে একদম ঘুরতে পছন্দ করেননা, তার কাজগুলোও আমি সেধে সেধে নিজের কাঁধে তুলে নিই যদি সেটা দেশে বিদেশে নতুন কোন জায়গা দেখার ব্যাপার হয়। দুমাসে তিনমাসে একবার নতুন কোন জায়গায় যেতে না পারলেই আমার অস্থির লাগে। ঘোরার এই নেশায় জীবনে কতকিছু যে জলান্জলি দিয়েছি!
লকডাউনের আগের তিন মাস কোন ট্যুর ছিলনা বরং এক ডাচ গ্রুপ এসে একমাস ধরে রোহিংগাদের উপরে একটা ডকুমেন্টারী করলো, পুরোটা সময় কক্সবাজারে ওদের সাথে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে ভেবেছিলাম ওরা গেলেই দশ দিনের ছুটি নিয়ে গোটা তুরস্ক চষে বেড়াবো অথবা পেরু’র ‘মাচুপিচু’ ঘুরে আসবো একদম একা, বহুদিনের স্বপ্ন এটা। প্লান ছিল এপ্রিলেই যাবো, মার্চ থেকে লকডাউন শুরু হয়ে সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল।
ঝিগাতলায় ভাইয়ার বাসায় পৌছে বেল দিলাম। দরজার সামনে মোটামুটি একটা যুদ্ধাবস্থা, কোভিড-১৯ ভাইরাসে’র সাথে যুদ্ধ করার জন্য এরা একদম প্রস্তুত। পায়ের মধ্যে যা যা লাগানোর সব লাগালাম, হাতে হেক্সিসল দিলাম আচ্ছা মতন আর গরুর ঠুসি লাগানোর মতো করে মাস্ক তো মুখে আছেই, তা স্বত্ত্বেও ভাইপো তুর্য দরজাটা খুলে দিয়ে তাড়াতাড়ি সরে গেল যেন আমি ‘করোনাভাইরাস’ সাথে করে নিয়েই ঢুকছি এমন একটা ভাব। ভাবী রান্নাঘর থেকে জোরে চেঁচিয়ে বললো, ‘অমিত, আগে হাত ধুয়ে নাও।’ বললাম,
‘হেক্সোসল দিলাম তো ভাবী।’
-‘আরে না না, তুমি আবার হাত ধোওতো তাড়াতাড়ি, তার আগে আম্মার কাছে যেওনা, বয়স্ক মানুষ।’
মা দেখি বসে নিউজ দেখছে, মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা প্রতিদিনকার মত স্বাস্হ্য অধিদপ্তরের ব্রিফিং দিয়ে যাচ্ছেন আর নিউজে বারবার সেটা রিপিট হচ্ছে। টিভি খুললেই প্রতিদিনকার এই মৃত্যেুর হিসাব আর ভালো লাগেনা, মানুষ সারাক্ষণ এরকম মৃত্যু আর অসুস্থতার খবর নিয়ে বাঁচতে পারে নাকি!
‘অমিত, শুনলিতো, শেলী’র ভাই এর বৌটা মরে গেল গতকাল, সিএমএইচে নেয়ার পরেও বাঁচলোনা। রাতে নাকি ওরা একদম ভালো দেখে এসেছে, ভোর না হতেই বাসায় ফোন, রাতের মধ্যে কি হয়ে গেল বলতো? সিএমএইচেও কি তাহলে এখন ভালোমতো দেখছেনা, না কি রে?’ – মায়ের গলায় গভীর উদ্বেগ। সান্তনা দিয়ে বললাম, ‘তোমার এত চিন্তা করার দরকার নেই মা, যা হওয়ার তাতো হবেই।’ ‘তুই যে কিভাবে কি চালাচ্ছিস! মুখটা তো শুকায়ে গেছে, রান্নাবান্না তো হচ্ছেনা ভালোমতো সেটা বুঝতে পারতেছি। বুয়াটাকে না হয় ঢুকতে দে, দূরে দূরে থাকবি। রান্না, কাজ কর্ম করে দিয়ে চলে যাবে। তোকে নিয়ে হয়েছে যত চিন্তা।বিয়ে শাদীতো করছিসনা, এখন বোঝ কত কষ্ট!’
মায়ের এই ব্যাচেলর ছেলেকে নিয়ে তার যত চিন্তা।মনে হয় সবাই বিয়েই করে, বউ রান্না বান্না করে খাওয়াবে সেই কারণে। এই করোনাকালীন সময়ে আমি যে ‘ওয়ার্ক এ্যাট হোম’ও কত ভালোভাবে রপ্ত করে ফেলেছি মা‘র সে সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই।
ভাইয়া এসে বসতেই মুখ দেখে মনে হলো একটু চিন্তিত। বললাম ‘কি, বাইরেতো বের হচ্ছো না, তাও এতো চিন্তা কিসের?’
‘আরে কি যে হচ্ছে কিছু বুঝছি না। জলজ্যান্ত মানুষগুলো নাই হয়ে যাচ্ছে, এ কিসের মধ্যে পড়া গেল বলতো! মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। গতকাল খুব কাছের দুজনের মারা যাওয়ার খবরে মনটা একদম খারাপ হয়ে আছে। প্রীতির বন্ধু সুমি’র আব্বা আইসোলেশানে আছে কদিন আগেই শুনলাম, গতকাল প্রীতি’র আরেক বন্ধুর আব্বা ফোন করে জানালো সে আর নেই। এমন তরতাজা মানুষটা! এখনও বিশ্বাস করতে পারছিনা! তুই কিন্তু একটু সাবধানে থাক, উল্টা পাল্টা ঘুরে টুরে বেড়াস।’
আমারও মনে পড়লো, কালকেই আমার এক সহকর্মী শাহীন ভাই ফোন দিয়ে বললেন, তার মা মারা গেছেন, লোকজন দিয়ে গ্রামের বাড়ীতে লাশ দাফন করেছেন, মাকে শেষবার দেখতে পর্যন্ত যেতে পারেননি ভাইরাস ছড়ানোর ভয়ে। কি ভয়ানক এক বাস্তবতা পার করছি আমরা!
ভাইয়াকে বললাম, ‘সাবধানেই আছি। সারাদিন অফিসের পরে সিগারেট কিনতে একটু নীচে নামি দুই এক দিন পরপর, বাকী সবতো অনলাইনেই কিনে ফেলছি খাবার টাবার সহ। মানুষজন তো ধুমায়ে অনলাইনে কেনাকাটা করতেছে শুনছি।’
ভাবী টেবিলে খাবার দিতে দিতে বললো, ‘আমাদের তো সব্জি টব্জী সব ভ্যানে করে নীচে দিয়ে যাচ্ছে। তোমার ভাইয়া তিনদিন ধরে বাইরে ফেলে রেখে, বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে, ভাইরাসকে চীনে আবার ফেরত পাঠায়ে তারপর সেগুলো ভেতরে ঢুকাচ্ছে।’ আমি শুনে হাসি। ‘প্রীতি, তু্র্যদেরতো সব অনলাইনে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে’ ভাবী বলতে থাকে, ‘বাড়ির মধ্যে থেকে থেকে সব জমে গেল একদম। তবে ওদের দেখে মনে হচ্ছে সারাক্ষণ বাইরে দৌড়াদৌড়ির হাত থেকে রক্ষা পেয়ে ওরা ভালোই আছে, এরপরতো মনে হয় বাইরে আর যেতেই চাইবেনা।’
‘ওদের আর দোষ কি, ভাইয়া বলে ওঠে-‘ ‘আমারও তো বাসায় বসে অফিস করতে খুব আরাম লাগে। সারাক্ষণ পাগলের মত দৌড়াদৌড়ি নেই। সেই যে চাকরীতে ঢুকেছি, তারপর থেকে তো গাড়ী ননস্টপ চলছেই, এরকম একটানা বাড়ীতে থাকার অভিজ্ঞতাতো ভুলেই গেছিলাম। মাঝেমাঝে এটা সেটা রান্নাবান্নাও তো করছি, বুঝলি? সবাইতো বলছে ভালোই মজা হচ্ছে খেতে।’
ভাবলাম, এই অচেনা ভাইরাস সাময়িক ভাবে হলেও আমাদের দীর্ঘদিনের যাপিত জীবনে এক বড় পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে। সকাল হতে না হতেই ভাইয়ারা চারজন চারদিকে চলে যায়, ছুটির দিন ছাড়া হয়তো একসাথে সবাই বসে কথা বলারও সময় পায়না, সেই সার্বক্ষণিক ছোটাছুটি থেকে এই চাপিয়ে দেওয়া বিরতি মানুষকে যেন একটু আরাম করে বসে জীবনটা কাটানোর ফুরসত করে দিয়েছে বলতেই হবে।
‘গত কালকে শমিক’দের সাথে কথা হইছে বুঝলি, মা বললো, ‘ওরাতো খুব ভালোই আছে। ওদের দুজনেরই কাজ বন্ধ কিন্তু তাতে ওদের কোন অসুবিধা হয় নাই। দুজনে প্রতিমাসে যা আয় করে, তার তিনগুণ টাকা পাচ্ছে সরকার থেকে। আবার তন্বী’ও নাকি ওর ইউনিভার্সিটি থেকে টাকা পাচ্ছে! কি সুন্দর ওদের ব্যবস্থা!’ টরন্টোতে থাকা ছোট ছেলের জন্য এতদিন ধরে চিন্তিত মা এখন খুবই খুশী!
‘আমাদেরও একটা ট্রুডোর মত প্রেসিডেন্ট থাকলে কি ভালো হতো তাই না কাকু?’ বাসায় বসেই আমরা টাকা পেয়ে যেতাম?’- বড়দের কথাগুলো শুনতে শুনতে এতক্ষণে যেন বলার মত একটা কথা খুঁজে পেল তুর্য।
‘হুমম…সব দেশই কমবেশী এরকম সাপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমরাই শুধু ফুটো কলস।’ – ভাবীর গলায় ঝাঁজ। ‘সরকার গরীব মানুষগুলোকে যাও কিছু দেয়ার চেষ্টা করছে চোরগুলো সেটাওতো ওদের কাছে পৌছতে দেয়না, এসব দেখতে দেখতে ঘেন্না ধরে গেল। তোমার ভাইয়াকে কতবার বলতেছি, দেশপ্রেম যথেষ্ট হয়েছে, এবার একটু ভাবো অন্যদিকে যাওয়ার কথা, ছেলেমেয়েদের একটা ভবিষ্যত আছে, আমার কথা শুনলে তো! তুমিও যে কি হাতিঘোড়া মারছো এখানে বসে, তাও বুঝিনা বাপু-‘
রূপচাঁদা ফ্রাইটা গলার ভেতর চালান করে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সবার আরো নানারকম হতাশাজনক আলাপ শুনতে শুনতে খাওয়া শেষ করে ওখান থেকে বের হয়ে আবার হাঁটা ধরলাম, গত ছয়দিনের না হাঁটা আজকে পুষিয়ে গেল একেবারে। ভেবেছিলাম ‘সান্তোরিনি’ আর ‘মাচুপিচু’ টা আজকে একসাথে ঘুরবো। কালকে অবশ্য শুক্রবার, অফিস নেই, অনেক রাত জেগে দেখা যাবে, অসুবিধা কি! সারা সকাল ঘুমিয়ে নিলেই হবে। আমারতো আর ডাকাডাকির কেউ নেই। চোখে চালশে পড়া বয়স শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু থিতু তো হতে পারলামনা এখনও। মনিকা’র সাথে একটা গাঁটছড়া বাঁধতে বাঁধতেও বাঁধছে না। অফিসের এত ব্যস্ততা, আজ এখানে তো কাল ওখানে, পুরোই যাযাবর জীবন আমার। যেই একটু ফুরসত মেলে তো আজ আমি ‘হালং বে’তে তো কালকে মিশরে’র মমি’র পাশে। ওকে তো সময়ই দেয়া হয় না। বোঝাবুঝিতেই যদি এত সময় চলে যায় তো সে মেয়ে আমার সাথে জীবনের ছক কাটবে কিভাবে! তবে রুমকি’র পর আর কারো প্রতি তেমন জোরালো টানও তৈরী হচ্ছেনা, সেটাও একটা মুশকিল বটে। ওহ! আবার রুমকি ঢুকে যাচ্ছে মাথার ভিতর! আজ আমার হলোটা কি! তবে মাঝে মাঝে মনে হয় আমি যে খুব খারাপ আছি তা না, ভালোই লাগে এই বল্গাহীন স্বাধীন জীবন। কিন্তু ইদানিং বন্ধু বান্ধব যখন আশেপাশে কাচ্চা বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তখন কি আমার বুকের খুব ভেতরে কোথাও একটু তিরতির করে কেঁপে ওঠে নাকি? একটু যেন হচ্ছে তেমন কিছু। ভাবছি একটা বাচ্চা এ্যাডপ্ট করে নেবো। নিজেরই হতে হবে তার কি মানে! এত এত বাচ্চা এই দেশে, যেকোনো একজনকে নিজের মনে করে বাসায় নিয়ে আসলেই তো হয়। ছোট ছোট হাত পা নেড়ে খলবল করবে, দেখতে ভালোই লাগবে… একটু বড় হলে দিব্যি আমরা বাপ-বেটা ওয়ার্ল্ড ট্যুরে বের হয়ে যাবো। ভাবনাটা কিন্তু মন্দ না।সিরিয়াসলি মনে হয় ভাবতে হবে বিষয়টা।
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। আজ দুদিন ধরেইতো আবহাওয়ার এক ভাবগম্ভীর অবস্থা। এই মহামারি’র মধ্যে নাকি ‘আম্ফান’ নামে এক ঘূর্ণিঝড়ও তেড়ে আসছে আবার! একটু তাড়াতাড়ি পা চালালাম, ঘরে জানালা দরজা সব বন্ধ করেছিলাম কিনা মনে পড়ছে না। সাড়ে এগারোটার দিকে কৌশিকে’র আবার ফোন করার কথা কালিফোর্নিয়া থেকে। ছোটবেলার বন্ধু, যে যেখানেই থাকি যোগাযোগটা থাকে সবসময়ই। প্রায় প্রতিদিনই একবার রিলে করে শোনাচ্ছে ওদের ওখানে কি অবস্থা। গতকালকে ও যখন মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস পরে ওর কাজের জায়গায় যাওয়ার পথে বাসের জন্যে ওয়েট করতে করতে ভিডিও কল দিল, চারপাশে দেখছিলাম খুব অল্প কিছু মানুষ মুখে মাস্ক পরা, কারো কারো তাও নেই। ও নিজেও নাকি কদিন আগে ওর বাড়ীর কাছের সান্তা মনিকা বীচ থেকে ঘুরে এলো আর সেখানে নাকি লোকে লোকারণ্য, কেউ আর লকডাউন মানতে চাইছেনা। তবে ওর অনলাইন স্টোরে কাজটা ভাগ্যিস আছে, ওদের ওখানে নাকি বহু মানুষেরই চাকরি নেই এখন। ‘বুঝলি, কনডমের বিক্রী এখন সবচাইতে বেশি! ‘বলছিল হাসতে হাসতে গতকাল। মনে পড়তেই আমি আর এক দফা হেসে উঠি। এবার অফিসের কোন কাজ ওদিকে পড়লে ভাবছি কয়েক বন্ধু একসাথে শিডিউল মিলিয়ে ওর ওখানে যাওয়ার একটা প্ল্যান করতে হবে।
কৌশিকে’র মত আরো অনেক বন্ধু, আত্মীয়, যারা পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে তাদের সাথে মোটামুটি নিয়মিত একটা যোগাযোগ রেখে চলি আমি, ওদের এক এক জায়গার জীবনযাত্রার খুঁটিনাটি গল্প শুনতে আমার ভালোই লাগে। কোন জায়গায় বাস না করলে সেখানকার আসল চিত্রটা গভীরভাবে বোঝা যায়না। আমরা সাত দিন, দশ দিন সময় নিয়ে যে ভাবে ঘুরি তাতে নতুন একটা জায়গা দেখার আনন্দ পাওয়া যায় বটে কিন্তু সেটা অনেকটাই উপর থেকে দেখা।
বাসায় পৌঁছেই ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই ফোন। আমার এই ফ্ল্যাটের বাড়িওয়ালী সুমিত্রা দি নিউইয়র্ক থেকে ফোন দিয়েছেন। ইসস্! সব ফোন কি আজকেই আসতে হবে! এমনিতে খুব স্নেহ করেন আমাকে। বললেন, ‘’অমিত, অনেকদিন তো কথাই হয়না তোমার সাথে তাই ভাবলাম একটু ফোন করি। চৌদ্দ বছর ধরে আছি এখানে, এরকম অবস্থা দেখবো এই মেগাসিটির কল্পনাও করিনি বুঝলে, তাও আবার এই বয়সে।’ ওদের দুজনেরই আসলে একটু বয়স হয়েছে, ছেলেমেয়েরা থাকে অন্য স্টেটে, সবকাজ তো নিজেদেরই করতে হয়। লকডাউনের প্রথমদিকে যদিও অনেক ওষুধ কিনে রেখেছিল কিন্তু পরে শেষ হয়ে গেছে, দোকানে নাকি প্রায়ই প্রয়োজনীয় ওষুধ পাচ্ছেনা। একটা উন্নত দেশে এই কদিনের মধ্যেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই হাল একটু অবাকই করে। একটা সামান্য ভাইরাস অসামান্যভাবে সারা পৃথিবী’র সামনে এক একটা দেশের ভেতরের অবস্থা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল!
বৃষ্টিটা দমকে দমকে বাড়ছেই। কৌশিক বলছিল আজকে জুম আড্ডাও হতে পারে যদি মেলবোর্নে শাফিন আর লন্ডনে অনিন্দ্যর সাথে সময় ম্যাচ করতে পারে। আবহাওয়া এরকম খারাপ হতে থাকলে তো মনে হচ্ছে সেটা আর হবেনা, নেটওয়ার্ক তো এখনই ঝামেলা করা শুরু করতেছে মনে হয়! ভাবলাম ওরা যখন জুম আড্ডা শুরু করে করুক আমি ততক্ষণে একটু ইউটিউব থেকে ঘুরে আসি। একটু স্যালাদ রেডী করে নিয়ে বসলে ড্রিংক্সের সাথে ভালোই লাগতো কিন্তু এখন আবার সব কাটাকাটি করতে হবে মনে করে বিরক্ত লাগলো।
কয়েকদিন ধরে আমার বুয়াটাকে মিস করা শুরু করেছি আসলে। এ্যাপার্টমেন্টে এখনও ওদেরকে ঢুকতে দিচ্ছে না। অনেকদিনের পুরনো বয়স্ক মানুষ, আমার একা জীবনের চালচিত্র সে বুঝে গেছে ভালোমত। স্বাভাবিক সময়ে তার সাথে আমার দেখাও হয়না প্রতিদিন, চাবি নিয়ে ঘরে ঢুকে সব কাজ করে দিয়ে চলে যায়। রান্নাবান্না তার এতই প্রিয় যে ওর কথা শুনলে মনে হবে এই দুনিয়ায় মানুষের একটাই কাজ শুধু, খাওয়া। সাধারণত ছুটির দিনেই তার সাথে আমার দেখা হয়, আর সেদিন শুরু হয় কাজের ফাকে তার নানান রকম অদ্ভুত আলাপ সালাপ, যেমন ‘আইচ্চা ভাইয়া খালেদা জিয়া’র ভুরুডা তো নাই তাই না? ভুরুডা করলো কি হেইয়া?’ আমিও বলি, ও, তাই নাকি? নেই? আমিতো খেয়ালই করিনি।’ তো এই সময়ে তার সাথে আমার অভ্যস্ত জীবনেরও একটা বিরতি ঘটে গেছে, বুঝতে পারি বেচারিরও নিশ্চয়ই সময়টা ভালো যাচ্ছে না।
যাহোক এত চিন্তা করে লাভ নেই। এক প্লেট চানাচুর নিয়ে টম্যাটো, ধনে পাতা, পেঁয়াজ আর মরিচকুচি দিয়ে একটা স্যালাদ বানিয়ে গ্লাসে খানিকটা রেড ওয়াইন ঢেলে নিয়ে অবশেষে একটু আয়েস করে বসলাম টিভি’র সামনে। ইউটিউবে সার্চ দিতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো অপরূপ দ্বীপটা! কবে থেকে যে এখানে যাওয়ার প্ল্যানটা করছি, নানান তালে হয়েই উঠলো না। ইসস! জায়গাটা যেন অন্য কোন গ্রহে মনে হচ্ছে, নীল আর সাদা’য় মাখামাখি পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর একটা দ্বীপ! সান্তরিনির নীল সমুদ্রে হারিয়ে যেতে যেতে ভাবলাম, রুমকি’র খুব প্রিয় রং ছিল নীল! আহ! রুমকিকে সাথে নিয়ে এজিয়ান সমুদ্রের মাঝখানে চাঁদের মতো বাঁকা এই সাদা সাদা স্বর্গপুরী দ্বীপটিতে বসে পৃথিবীর সেরা সূর্যাস্ত দেখা হলো না!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত