| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প সম্পাদকের পছন্দ সাহিত্য

সম্পাদকের পছন্দ: ঘুম আর অশ্রুর গন্ধ । রবিশংকর বল

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

জানলাটা অনেক পুরোনো। এই ‘অনেক’ শব্দটা আসলে কিছুই বোঝায় না। কত পুরোনো হলে একটা জিনিসকে ‘অনেক’ পুরোনো বলা যায়? এইসব বিশেষণ যা সত্যিই কিছু বোঝায় না, আমাদের ব্যবহার করতে হয়, আর তখনি বোঝা যায়, আমাদের ভাষা; মানুষের ভাষা! কত পঙ্গু। এই ভাষা মানবিক পরিস্থিতিকে কিছুদূর পর্যন্ত বোঝাতে পারে, পুরোটা পারে না, আর মানবিক পরিস্থিতির বাইরে  চারপাশের বস্তু ও মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে ভাষাটা কোনও কাজেই লাগে না। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীদের সঙ্গে প্রকৃতির ভাষা বিনিময় অনেক সহজ।  বৃষ্টি কখন আসবে, কেউ বুঝতে পারে, ভূমিকম্প কখন হবে, তাও বুঝতে পারে কেউ কেউ; মানুষ এসব কিছুই বুঝতে পারে না। তার পাশের মানুষের ভাষাটাই বুঝে উঠতে পারে না! মহাবিশ্বের  প্রকৃতির ভাষা তো অনেক দূরের বিষয়।

যতদূর জানি, একটা দেশ দু’ভাগ হওয়ার অনেক আগেই জানলাটা তৈরি হয়েছিল। জানলা তো এমনি এমনি তৈরি হয় না। একটা বাড়ি হলে তবেই জানালার কথা ওঠে। মানে, এই বাসাবাড়িটা  পরপর মুখোমুখি কয়েকটা টিনের ঘর।  তৈরি হয়েছিল ওই রকম একটা সময়ে!  উনিশশো বেয়াল্লিশ কি তেতাল্লিশ সালে। লোকমুখে এই রকম বাসাবাড়ির নাম ‘বস্তি’, যা একমাত্র শহর ছাড়া অন্য কোথাও গজিয়ে ওঠে না। শহরে যেহেতু বাইরে থেকে অনেক মানুষ আসে কাজের খোঁজে, তাদের আস্তানা হিসেবে গড়ে ওঠে ‘বস্তি’। জানলার গল্পটা এই রকম বস্তিরই একটা ঘরের।

জানলার ইতিহাস হয় কি? কেউ লিখেছে কিনা, জানা নেই। তবে এই জানলাটার ইতিহাস আছেই; বস্তির যদি ইতিহাস থাকে, তবে জানলার আছে। তারও স্মৃতি-বিস্মৃতি আছে। দেশভাগ ও স্বাধীনতার অনেক আগেই একটা নদীর ও পার থেকে কিছু মানুষ এই বস্তির ঘরগুলির ভাড়াটে হয়েছিল। শহরে তারা এসেছিল কাজের খোঁজে। বস্তিতেই কারো কারুর জন্ম হয়েছিল, বিয়ে হয়েছিল, কেউ কেউ সন্তান প্রসব করেছিল, কেউ বা বাঁশের খাটিয়ায় চেপে শ্মশানে চলে গিয়েছিল।

এদের অনেকের কথা দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বাংলার পুরনারী’-র গল্পের মতো মনে হয়। জানলাটা দেখলে ওই কাহিনিগুলির কথাই মনে পড়ে। এসব অনেক, অনেক বছর আগের কথা। কত বছর? কত পুরোনো?
বিশেষণেরা তা জানে না। ওই জানলা যেন বহু দূরের…  কত দূর… এক নক্ষত্র! যার দূরত্ব আমরা ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না।সেই নক্ষত্রের জন্মসময় জানি না। কবে তার মৃত্যু হয়েছিল, তাও অজানা, তবু এত দিন পর… কত, কত দিন পর-  নক্ষত্রটির আলো আমরা দেখতে পাচ্ছি? মৃত নক্ষত্রের আলো, মনে হয়, স্মৃতির ভিতরে জেগে থাকা জানলাটিকে।


আরো পড়ুন: দরজা । দেবেশ রায়


বস্তির ঘরগুলো ধ্বংসন্মুখ। টিনের ঘরগুলো হেলে পড়েছে, মাটিতে মিশে গেলেই তারা স্মৃতি-বিস্মৃতি থেকে মুক্তি পাবে। প্রতিটি ঘরে তালা লাগানো, তালায় জং, চাবি ঢুকিয়ে ঘোরাতে গেলে কড় কড় শব্দ হয়। তালারা যেন বলে, খুলো না।  আর কেন?  আবার কেন!  এবার শান্তি দাও।

লোকটা হেমন্তের এক বিকেলে সেখানে এসে পৌঁছল। আশপাশের গাছগাছালির ঝরা পাতা এসে ঢেকে দিয়েছিল রাস্তা, তারা উড়ছিলও, না-জানা গন্তব্যের দিকে। লোকটার জুতোর তলায় শুকনো পাতার মচ্‌মচ্‌ শব্দ। মাঝে মাঝে তার মনে হচ্ছিল, সে আসলে একটা স্বপ্ন দেখছে; ঝরা লাল লাল পাতারা তাকে ছুঁয়ে কোথায় যে উড়ে যাচ্ছে।

সে দেখল, ঘরের দরজায় এখনও লেটার বক্সটা ঝুলছে। খালি লেটারবক্স। ধুলো আর ঝুলে ঢাকা হলেও লেটার বক্সের গায়ে লেখা নামটা পড়া যায়; শ্রী মোহনলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।

তালা খুলে সে ঘরে ঢুকল। তার মনে পড়ল, কবে কেউ যেন কাকে বলেছিল, তোমার শরীরে ঘুম আর অশ্রুর গন্ধ। এই ঘরেও সেই গন্ধ,  ঘুম ও অশ্রুর গন্ধ। কার ঘুম? কার অশ্রু? কত দিন সে ঘুমিয়ে আছে? কত দিন ধরে এই অশ্রুপাত? তার মনে পড়ল, অনেক দিন আগে দেখা একটা মুখ। কুয়াশায় অস্পষ্ট সেই মুখ। কার? সে কি এখনও বিলাসপুরেই থাকে?

ঘরের মেঝে ধুলোয় ঢাকা। পায়ে ধুলো মাখার জন্যই সে জুতা খুলল। ধূলিমলিন বিছানায় ছড়িয়ে আছে বইগুলো। সে একটা বই হাতে তুলে নিল। তার মলাট ছিঁড়েখুঁড়ে গিয়েছে, সামনের বেশ কয়েকটি পাতা উধাও; বইয়ের নাম, লেখক কে, তা জানার উপায় নেই আর, রুপোলি পোকা আর উঁইদের আক্রমণের ছাপ পাতায় পাতায়; এলোমেলো পাতা ওলটাতে ওলটাতে এক জায়গায় আন্ডারলাইন করা অংশ সে পড়তে লাগল; এক সময় মনে হল কারা যেন ফিসফিস করে কথাগুলি বলছে: মাঝে মাঝে মনে হয়, চৌত্রিশ হয়েছে বটে—  সত্তর হয়নি, কিন্তু তবুও সবই যেন সমাপ্ত হয়ে গেছে; কেমন একটা গভীর অবসাদ পেয়ে বসে। সন্ধ্যার অন্ধকারে মেসের বিছানার থেকে উঠতে ইচ্ছা করে না, মনে হয়, সব দেখেছি, জেনেছি, বুঝেছি, সব লিখেছি, তখন ঘুমিয়ে পড়া যাক, অন্ধকার বেড়ে চলুক, কোনওদিনও যেন এই অন্ধকার শেষ হয় না।ঘুম কোন দিনও ফুরোয় না যেন আর।

আর কী রকম চিন্তা করো?
চুপ করে ছিলাম।

এই সৃষ্টিটাকে একটা পাখির খাঁচার মতো যদি তৈরি করে নিতে পারা যায়, তখন মানুষের অবস্থা বড় ভয়াবহ হয়ে ওঠে। আমার অনেক সময় মনে হয়, জীবনটা কলে ধরা ইঁদুরের মতো। যেন চারদিকে শিক আর শিকল শুধু-  না আছে রূপ না আছে ফুর্তি-

সে দেখল একটা কালচে রুপোলি পোকা বইয়ের শরীর থেকে তার হাতে উঠে এসেছে। আশ্চর্য এই পোকাগুলি, তার মনে পড়ল। আঙুল ছোঁয়ালেই ধুলো হয়ে মরে যায়। কোনো প্রতিরোধ, লড়াই চালায় না মৃত্যুর বিরুদ্ধে। যেন সে প্রস্তুত ছিল একটি আঙুলের স্পর্শের জন্য। সে আসবে, একটি আঙুলের নির্মমতা, আর তাকে হারিয়ে যেতে হবে।

জানলাটা খুলতেই একটা দমকা হাওয়া এসে ঢুকে পড়ল আর সেই সঙ্গে যেন একঝাঁক সবুজ প্রজাপতি। ঘরে ঢোকার আগে সে খেয়াল করেনি। এ বার দেখল, জানলার জং ধরা শিক, ভাঙা-ভাঙা তারের জাল বেয়ে উঠেছে অপরাজিতার লতা; সবুজ পাতাগুলি হাওয়ায় কাঁপছে, এখনও ফুল ফোটেনি। কে এখানে অপরাজিতা রোপণ করল? এই জানলার পাশে, যে জানলা বহুদিন খোলা হয় না?

এখন জানলার পাশে তার মুখ; গালে অপরাজিতার পাতা ছুঁয়ে আছে। সে কেঁপে উঠল, কচি পাতার স্পর্শে কি শরীরে তরঙ্গ খেলে? সেই তরঙ্গ কি অনেক দিন ধরে চাপা পড়া বাসনাকে জাগিয়ে তোলে? নইলে মনে হল কেন, এখন, এখনই এই ঘরে কেউ আসতে পারে? সে কি এখনও বিলাসপুরেই থাকে?

জানলার ওপারে, কয়েক পা দূরেই একটা ঘর, দরজা, সেই দরজায় তালা লাগানো। ও ঘরে যারা থাকত, তারা কবে মরে-হেজে গেছে। এদের কোনও বংশধর অন্য কোথাও থাকে। হয়তো মাঝে মাঝে আসে। তার সঙ্গে দেখা হয়নি কখনও।

যাওয়ার জন্য জানলাটা বন্ধ করতে গিয়ে সে থমকে দাঁড়াল। জানলাটি বন্ধ করলে কি অপরাজিতার লতাটি ঠিকঠাক বেড়ে উঠতে পারবে? ও হয়তো চায় কেউ ওকে দেখুক। হাওয়া-আকাশ-রোদ্দুর-পাখি-বৃষ্টি, এরা তো ওকে দেখেই, তা বাদে কেউ দেখুক। কিন্তু কে দেখবে তাকে? এই শূন্য, ভাঙাচোরা ঘরে, যেখানে কেউ থাকে না?

হয়তো একটা টিকটিকি, সে ভাবল। শিকার ধরার জন্য লাফ দেয়ার আগে হয়তো সেই টিকটিকি মুহূর্তের জন্য অপরাজিতার সবুজের দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে।

সে তাই জানলাটা খোলা রেখেই ঘরে তালা লাগাল; পিছন ফিরে কেন অপরাজিতার লতার দিকে তাকায়নি তা সে-ই জানে। বা হয়তো সে জানত, এ জন্মের চোখদুটি সে ওই ঘরের ভিতরে রেখে এসেছে, যারা দিনের পর দিন অপরাজিতা লতার বেড়ে ওঠা দেখবে, আর সে-ই অন্ধ হয়ে এই শহরের রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে যাবে। অসুবিধে তো নেই, সব রাস্তাই তার চেনা; শুধু সে জানে না, কবে, কখন জানলার পাশে জন্ম নিয়েছিল অপরাজিতার লতা।

সেদিন রাতেই অপরাজিতার লতা ভাবছিল, লোকটা কে? এভাবে জানলাটা হাট করে খুলে দিয়ে গেল!  নাকি ভুলে গিয়েছে? কষ্ট হয়, ঘরটার ভিতরে তাকাতে বড় কষ্ট হয়, সারাক্ষণ শুধু ঘুম আর অশ্রু গন্ধ ভেসে আসে।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত