| 28 মার্চ 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

পুরাণী

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comমেঘে মেঘে এত বেলা হল অথচ এখনও একটা খদ্দেরও পেল না পুরাণী। এদিকে মেঘটাও বাদ সেধেছে। গতকাল বিকেল থেকে সেই যে অঝোরে ঝরতে শুরু করেছে, এখনও পর্যন্ত থামার কোন নাম-চিন্তা নেই। কী আর করার আছে? তা নইলে কি এই প্যাচপ্যাচে বাদলায় ফুটো ছাতার নীচে কাকভেজা হয়ে গুটিকয়েক আনাজপাতি নিয়ে বসে থাকতে হয় তাকে?

পাশেই ত্রিপল টাঙানো ধীরেন চাষার দোকান। বিশাল পসরা তার। বাবুরা দিব্যি ছাতা মাথায় থলি ভর্তি করে বেশি দাম দিয়ে সবজি কিনে নিয়ে যাচ্ছে তার দোকান থেকে। পুরাণী গলা ফাটিয়ে কত ডাকছে, “এ বাবু, নিয়ে যা। সস্তা আছে। কচি পুঁই, টাটকা করলা…” কেউ শুনলে তো! কেউ পাত্তাই দিতে চায় না। অথচ কিছুদিন আগেও, কিছুদিন কি, এই তো সেদিন পর্যন্ত রাতের বেলা মদের নেশায় বেশ পাত্তা দিত পুরাণীকে।

আজ পাঁচ-ছয়মাস এই ব্যবসাতে নেমে ঠিক বুঝে গেছে পুরাণী যে এই খদ্দেরগুলো তার নয়। হবেও না কখনো। তবুও ডাক দেয়, গলা ফাটায়। যদি আসে সেই আশায়। কিন্তু ওরা আসে না।

পুরাণীর অবশ্য নিজস্ব কিছু খদ্দের আছে। রিক্সাওয়ালা, মুটে, দিনমজুর, এরা সব। যারা তার আগেও খদ্দের ছিল, এখনও বেশ রয়েছে। পুরাণী তাদের খুব একটা পছন্দ‌ও করে না। কিসব যা তা বলে। প্রকাশ্যেই তাকে নিয়ে কথায় কথায় মশকরা করে মজা লুটে। দিন দিন কার আর সহ্য হয়? আগে হলে এসব পরোয়া করত না। এখন যেন গায়ে লাগে। তবুও একরকম মেনেই নিয়েছে। কেননা তারাই তো আজ তাকে এই ব্যবসাতে টিকিয়ে রেখেছে। টুকিটাকি লাভের মুখ‌ও দেখিয়েছে।

আজ এই ঘোর বাদলে তারাও আসেনি। আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায় পুরাণী। দাঁতে দাঁত চেপে গাল দেয় মেঘকে, “মুখপুড়ি, হতচ্ছাড়ি! তোর মরণ নাই? আজ দু’টা বিকতেও দিবি নাই?” মেঘ কি আর তার মতো মেয়ের কথায় পাত্তা দেয়? সে আজ উন্মাদ। ঝরছে তো ঝরছেই।

রোগা লিকলিকে কুকুরছানা যেমন কোনো খড়গাদার আস্তানা থেকে কাঁপতে কাঁপতে বুড়ি মাদী কুকুরের দুধ খেতে আসে। ঠিক তেমনি করে হঠাৎ কোথা থেকে একটা বছর তিন-চারের নোংরা, রোগা ফিনফিনে বাচ্চা ছেলে, শুধুমাত্র ছেঁড়া প্যান্টে ভিজে সপসপে হয়ে এসে, পিছন দিক থেকে পুরাণীর কাপড়ের খুঁট ধরে টানতে শুরু করে। নাকে  কফে ভ্যাড়ভ্যাড় করছে। নাক শুষে আধো আধো স্বরে বলে ছেলেটা, “ভোক লেগেছে, খেতে দে মা…”

পুরাণীর মেজাজটা ভালো নেই। তাই সে ঝনঝনিয়ে উঠে, “পালা বলে দিচ্ছি। ভোক লেগেছে? খেতে দে? দূর হ ইখান থেকে।” ছেলেটা তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে। পুরাণী আরও বিরক্ত হয়ে গলাবাজি করে, “এই পা টা দেখেছু। এমন এক লাথ দিব, হা ড্রেনটায় পড়বি। পালা, দূর হ আমার সামনে থেকে…”

বেচারা ছেলেটি পুরাণীর করাল মূর্তি সহ্য করতে সাহস করে না আর। চোখের জল মেঘের জল এক করে যে গলি থেকে এসেছিল, ভয়ে ভয়ে সেই গলিতেই মিলিয়ে গেল আবার।

পুরাণীর তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। বসে বসে দিব্যি ভিজছে সে।

বৃষ্টিটা সবে একটু হালকা হয়েছে। সেই সময় হঠাৎ দূরে কাকে যেন লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে ডাকে পুরাণী, ” ও নিতাই, তরকারি নিয়ে যা। আজ সস্তায় পাবি।”

নিতাই ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয় যে তার লাগবে না।রাগ বেড়ে যায় পুরাণীর। আবারও চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে, “অন্যদিন আসবি রে শালা। আমের আঁটি চুষাবো।”

আজ যে কার মুখ দেখে উঠেছে কে জানে? এমন অযাত্রা কোনো দিন হয়নি তার। একটা খদ্দের পর্যন্ত পাশ ঠেকল না।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর যখন দেখে বেলা বেড়েই চলেছে,  তখন পিঁড়া ছেড়ে উঠে পড়ে  পুরাণী। কাদা প্যাচপ্যাচে পায়ে সোজা ধীরেনের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ধীরেনের বাসি সবজিগুলো বেছে বেছে নিয়েই তার ব্যবসা। যতটুকু বিক্রিবাটা হয় তার  থেকে মুল দামটা ধীরেনকে দিয়ে বাকি লাভের টাকায় দিনটা চালিয়ে নেয় পুরাণী। লোকসানের কিছু নেই। বিক্রি না হলে আবার শেষ বেলায় মালটা ধীরেনকেই ফিরিয়ে দেয়। বুদ্ধিটা অবশ্য ধীরেনের‌ই। কত সবজি পঁচে যায়। কত মাল নষ্ট হয়ে ফেলা যায়। পুরাণী আগে ধীরেনের সবজি দোকানের সামনেটা ঝাঁট দিয়ে দিত। এখনও দেয়। সেই থেকেই একদিন কথা হতে হতে পুরাণী বলেছিল, “তোর মত পয়সা থাকলে আমিও সবজি ব্যবসা করতাম যে ধীরা। আমার কি আর নোংরামি করতে ভালো লাগে?”

“লে তবে আমার পাশটাতেই  বাসি সবজিগুলো নিয়ে বোস। দেখি কেমন ব্যবসায় মন তোর।” ইয়ার্কি করে বলেছিল ধীরেন।

সেদিন ভাগ্যিস ইয়ার্কিটাকে গুরুত্ব দিয়ে কাজে লাগিয়ে নিয়েছিল পুরাণী। তাই সেও আজ ইন্দুবাজার সবজি বাজারের একজন ছোটখাটো ব্যবসায়ী।

ধীরেনর‌ও খদ্দের নেই এখন। পুরিণীকে আসতে দেখে রসিকতা করে বলে, “কি লো, আজ ক’টাকার বিকলি?”

পুরাণী কোন ভনিতা না করে গম্ভীর স্বরে বলে, “কুড়ি টাকা দে না ধীরা। কাল দিয়ে দিব। আজ শালা একটা খদ্দের‌ও জোটেনি। মেঘটাই সব খেল।”

ধীরেন হাট্টাগাট্টা বলিষ্ঠ পুরুষ হলেও পুরাণী নামের এই বছর পঁয়ত্রিশের মহিলাটিকে বেশ ভালই ভয় পায়। ভয় পায় তার মুখটাকে। কখন কি বলতে কি বলে ফেলে তার ঠিক নেই। পুরাণীর লোক লজ্জার ভয় না থাকতে পারে। তার তো আছে। যত‌ই হোক ব্যবসা করে খাচ্ছে। নিজের ইমেজটাকে তো জনসমক্ষে আর নষ্ট করা চলে না। তাই বেশি কথা না বাড়িয়ে বসে থাকা চৌকির ড্রয়ার খুলে  দুটি দশটাকার নোট বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দেয় ধীরেন।

পুরাণী টাকাটা নিয়ে যেই পিছন ফিরে, অমনি পাইটার মুখোমুখি। গায়ে রেইনকোট, মাথায় ছাতা, আর এক মুখ খোঁচা খোঁচা দাড়ি। পান গাবানো সাদাকালো দাঁত বের করে বিশ্রী রকম হাসি হেসে বলে, ” দিনের না রাতের?”

পুরাণী কিছু না বলে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে। পাইটা তাতে একটু মজায় পায়। চোখ দুলিয়ে বলে, “টাকাটা যে নিলি, তা দিনে শোধ করবি, না রাতে?”

“সরে যা পাইটা। ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।” মুখ খুলে পুরাণী। দাড়িতে হাত বুলিয়ে পাইটা বলে, “সরে যাবো না তো কি তোর মতো নোংরা মেয়েছেলের সাথে কথা বলে নিজের সম্মান নষ্ট করবো? তারপর এই দিনের বেলায়।” তারপর গলির স্বরটা নামিয়ে বলে, “তবে তুই মাইরি গায়- গতরে এখনও সলিড আছিস।”

পুরাণী কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। এখন আর কার‌ও কথার বেশি জবাব দিতে যায় না। কত লোক কত কি বলে। এখন আর সেদিকে কান করে না খুব একটা। সব সয়ে নেয় এখন।

তবে পাইটার উপর ক্ষোভটা দিন দিন বাড়ছে পুরাণীর। পার্টির লোকের সাথে উঠাবসা বলে সাহসটা একটু বেশিই। এই পাইটাই কত ঠকিয়েছে তাকে। সরকারি যোজনায় বাড়ি বানিয়ে দেবার নাম করে কত কি করছে তার শরীর নিয়ে। বাড়ি তো হলোই না, বরং কোনদিন একটাও পারিশ্রমিক হিসেবে দেয়নি তাকে। পুরাণীর তাতে খুব একটা আক্ষেপ নেই। কিন্তু পাইটার এখন নজর পড়েছে টিকলির উপর।

টিকলির স্বভাব ভালো। তাই নিজের মেয়ে হলেও নিজের থেকে দূরেই সরিয়ে রেখেছে পুরাণী। বাবুদের বসায় কাজ করে টিকলি। থালা ধোয়, কাপড় কাচে, বাবুদের বাচ্চা সামলায়।

পনেরো বছর বয়সেই অনেক বড়ো হয়ে গেছে টিকলি। সে এখন পুরাণীকে ঘেন্না করে। তবুও মেয়েদের মন। মাঝে মাঝে পুরাণীর কাছে আসে। বাবুদের বাড়ির পুরানো শাড়ি, কখনো বা খাবার দিয়ে যায়।

আগে যখন ও ছোট ছিল, তখন কত আদর করত পুরাণী। এখন আর সাহস পায় না। এখন তাকে ছুঁলেই তেতে উঠে টিকলি। মাঝে মাঝে ভয় দেখায়। বলে, আর কোনদিন তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না। তবু আসে। আসে বলেই টিকলির উপর পুরাণীর এত মায়া। মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখে পুরাণী, টিকলির বিয়ে হয়েছে, জামাই এসেছে। এক মাথা সিঁদুর, গায়ে কত গয়না। নিজের মাথায় তো কখনো সিঁদুর উঠেনি। তা বলে টিকলির মাথায় উঠবে না? ভাবলেই গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে পুরাণীর। নাই বা তাকে ভালোবাসুক, নাই বা তাকে মা বলুক, তবুও তো সে তার‌ই মেয়ে!

পাইটা ছোঁড়া যখন তখন টিকলিকে নিয়ে এমন সব কথা বলে সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠে পুরাণীর। মনে হয় খুন করে দেয় তাকে। কিন্তু পারে না। বছর কয়েক আগে হলে হয়তো পারতো। তখন মনে নোংরামির নেশা ছিল, ভয় ছিল না। এখন একটু ভালো হয়ে, সৎ হয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে বলেই বোধহয় হঠকারিতায় কিছু করে বসতে ভয় পায়। নইলে কোমরে তো সবসময় ছুরি গোঁজাই থাকে।  ইচ্ছে হয় বসিয়ে দিতে। ফলাফলা হয়ে যাক পাইটার বুক। তবুও পেরে ওঠে না। টিকলির মুখটা মনে পড়লে সব রাগ ঠান্ডা হয়ে যায়।

বৃষ্টিটা একটু কমেছে। বাজারে লোকজনের সমাগম‌ও হচ্ছে। পুরাণী তাই সব ঠিকঠাক করে বসার চেষ্টা করে। যে সব সবজিগুলোতে একটু আধটু কাদা ছিটকে এসে লেগে ছিল, সেগুলোকে ভালো করে জল ছিটিয়ে পরিষ্কার করে ডাক পাড়তে থাকে, “বাবু, তরকারি নিয়ে যা…  সস্তা দরে পাবি…

কিছুক্ষণ পর কাউকে যেন উদ্দেশ্য করে ডাকে, “এই ভোকা, শুনে যা একবার।” বলতে বলতে একটা বছর দশ-বারোর ছেলে এসে দাঁড়ায়। মলিন বদন। ছিপছিপে চেহারা। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। বুকের পাঁজর গোনা যায়। সামনের চা দোকানে কাজ করে। তার পিছনে পিছনে আরও দু’জন ছোট ছেলে এসে হাজির হয়। এরা প্রত্যেকেই পুরাণীর পাপের ফসল।তাদের সকলের পিছনে এসে দাঁড়ায় সেই বাচ্চা ছেলেটি, যে প্রথমে খাবার চাইতে এসে ধমক খেয়ে গলিতে মিলিয়ে গিয়েছিল।

পুরাণী কাপড়ের খুঁট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে ভোকাকে দিয়ে বলে, “যা, এটা নিয়ে এদের মুড়ি কিনে দিবি। তুইও খাবি।”

ভোকা পুরাণীকে ভীষণ ভয় করে। পুরাণীর কত যে লাঠি, কত যে লাথি তার শরীরের উপর দিয়ে গেছে, তা শুধু সেই জানে। “তুই খাবি নাই?” ঢোক গিলে ভোকা বলে।

“আমার কথা তোদের ভাবতে হবে নাই। তোরা আপনার খেয়ে মরগে যা।” ধমক দিয়ে উঠে পুরাণী। ভোকা আর কথা না বাড়িয়ে তিন ভাইকে নিয়ে চলে যায়। পুরাণী আবার ব্যবসাতে মন দেয়, “তরকারি নিয়ে যা… পুঁই, করলা..

আজ প্রায় তিরিশ বছর এই ইন্দুবাজারে পড়ে আছে পুরাণী। নিজের চোখে ইন্দুবাজারকে নতুন করে গড়ে উঠতে দেখেছে। ইন্দুবাজার‌ও দেখেছে তার জীবনের দুঃখ দুর্দশার গতি প্রকৃতি। সাতকুলে আপন বলতে কেউ আছে কিনা তা জানে না সে। আছে বলতে ফরেস্টের জমির উপর বাঁশ, তালপাতা আর প্লাস্টিকে ছাওয়া ঝুপড়ি টুকু। এছাড়া আর কিছু নেই। মাঝে মাঝে মাকে মনে পড়ে। লোকের বাড়িতে ঝি খাটত। একদিন মা মারা গেল। সেও হয়ে গেল অন্যরকম। সেসব দিনের কথা ভাবলে খেই হারিয়ে ফেলে পুরাণী। তাই আর ভাবে না কিছু। কত লোক যে তাকে নিয়ে ফুর্তি করছে তার ঠিক নেই। কে যে টিকলির বাপ, কে যে ভোকার, তা জানে না পুরাণী। তবে এখন আর কাউকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না সে। লালসায় লিপ্ত নেশাতুর চোখ নিয়ে কেউ যদি কাছে আসতে চায়, পুরাণীর চোখমুখ তখন ভয়ঙ্করভাবে জ্বলে উঠে। তখন আর কাছে আসতে সাহস পায় না কেউ।

আজ এই পরিবর্তন সব টিকলির জন্য। টিকলির কথা ভাবলে পুরাণী সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়।

মেঘের আড়ালে বেলা গড়িয়ে দুপুর। পাতলা মেঘের তলা থেকে কখনো কখনো সূর্যটা অস্পষ্টভাবে একবার করে উঁকি দিচ্ছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। গায়ের কাপড় গায়েই শুকিয়ে গেছে। ওসবে কোন পরোয়া নেই পুরাণীর। তবে আজ একটা টাকাও বেচাকেনা করতে পারেনি। উপরন্তু ধীরেন এর কাছে কুড়ি টাকা ধার। গতিক ভালো নয় দেখে এখনকার মতো দোকান গুটিয়ে ফেলে পুরাণী। খাওয়া-দাওয়া কিছুই হয়নি সারাদিন। এখন উপোস করাটা যেন তার কাছে সাধারন ব্যাপার। এই কদিনে সে বেশ বুঝে গেছে যে খারাপ রাস্তায় মন না ভরলেও  পেট ভরে ঠিকই। তখন মনের জোর বাড়িয়ে ভাবতে থাকে, এতদিন তো পেট ভরল। এখন না হয় মনটাই ভরুক।

ঠিক করে, মাঠের ধারে পুকুরে গিয়ে কিছু শামুক কুড়িয়ে আনবে একবার। এলাকায় শামুকের চাহিদা বেশ ভালো। নষ্ট মেয়ে বলে লোকে তার কাছে সবজি কিনতে লজ্জা পেলেও, শামুক কিনতে কোন সংকোচ করে না। কেননা, সবজি যত সহজে বাজারে মেলে, শামুক তো তত সহজে মেলেনা কিনা।

যথারীতি শামুক এনে বিকেলে আবার বাজারে বসে পড়ে পুরাণী। সঙ্গে সবজিও ।সকালে লোক হয়নি বলে বিকেলে একটু ভিড় জমেছে। অনেক শামুকও পেয়েছে সে। ফলে একরকম আনন্দেই আছে। অর্ধেকের চেয়েও বেশি বিক্রি হয়ে গেছে। বাকিটাও বেচতে বেশি সময় লাগবে না।

সন্ধ্যা প্রায় হবো হবো। কিছু শামুক এখনো রয়ে গেছে। পুরাণীর আর বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে‌। সারা দিন উপোস। তারপর আবার বৃষ্টিতে ভিজেছে। কিছু ভালো লাগছেনা। তাই সবকিছু গুটিয়ে নিয়ে ধীরেন এর টাকা মিটিয়ে দেয়। বাড়তি শামুক টুকুও ধীরেনকে অমনি দিয়ে দেয়, “যা তোর বউ রেঁধে খাবে।” তারপর আর দেরি না করে নিজের বিড়ির দিকে পা বাড়ায়।

আকাশে আবার মেঘ ঘনিয়ে আসছে। বৃষ্টি নামলো বলে। দ্রুত পায়ে পুরাণী ঝুপড়ির কাছে এসে পৌঁছায়। তাকে দেখে সেই ছোট্ট ছেলেটি তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে যায়। পুরাণীও ঘরে ঢুকে ।ছেলেকে কোলে তুলে নেয়। আদর করে, চুমু খায়। ছেলেটিও মায়ের আদর পেয়ে কোলে লুটিয়ে পড়ে।

কিছুক্ষণ পর ভাত রাধার জোগাড় করে পুরাণী। সারা দিনের শেষে একবারই রাধে, সন্ধ্যেবেলায়।

ইতিমধ্যে টিকলি এসে উপস্থিত। পুরাণী তো স্থির হয়ে যায়।  টিকলি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে অবহেলার স্বরে বলে, “ভোকা বলছিল তুই কিছু খাস নাই। ভাত নিয়ে এলাম। আজ আর  রাঁধতে হবে নাই। জল পড়বে। আমি চললাম।”

টিকলি চলে যায়। আটকায় না পুরাণী। সে বরং পুটলি খুলে দেখতে যায় কি রয়েছে। দেখে অনেক ভাত।  কাল সকালেও হয়ে যাবে। তরকারিও আছে অল্প। দেখেই খুশিতে একেবারে ভরে উঠে মনটা।

দেরি না করে এই সবে মনের সুখে থালায় ভাত সাজাতে যাবে, এমন সময় শুনতে পায় টিকলির চিৎকার। “মা, আসবি গো…. এরা আমাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে…

শোনামাত্রই সারা শরীরের রক্ত যেন টগবগ করে উঠে। স্থির থাকতে পারে না পুরাণী। সঙ্গে সঙ্গে ছুরিটা নিয়ে ছুট্টে যায় রাস্তার দিকে। দেখে তিনজন মিলে ধস্তাধস্তি করছে টিকলিকে। তার মধ্যে একজন পাইটা। সহ্য করতে পারে না পুরাণী। কিছু না ভেবে সোজা গিয়ে ছুরিটা বসিয়ে দেয় পাইটার বুকে। জোর আর্তনাদে কেঁপে উঠে আকাশ বাতাস। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে পাইটা। পুরাণী তখন নাছোড়। উন্মাদের মতো কোপের উপর কোপ দিয়ে যায় এলোপাতাড়ি।বাকি দুজন পালিয়ে যায় ভয়ে। রক্তে ভেসে যায় মাটি। রক্ত পুরাণীর চোখে মুখেও। ছটফট করতে থাকে পাইটা। একসময় শান্ত হয়ে যায় সমস্ত চিৎকার, সমস্ত ছটফটানি।

টিকলি তখন ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। কেঁদে কেঁদে বলে, “এ কি তুই? এ যে মরে গেল!”

-মরুক।

-তোর কী হবে? তোকে যে পুলিশে ধরবে।

-ধরুক। তুই পালা।

থরথর করে কাঁপতে থাকে টিকলি। আলুলায়িত চুলে রক্তাক্ত ছুরি হাতে পাইটার দেহটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পুরাণী। জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বলে, “তুই পালা টিকলি। আমার জন্য ভাবিস না। যা করেছি ভালো করেছি। তুই পালা।”

কথা না বাড়িয়ে সরে পড়ে টিকলি।  বৃষ্টি তখন শুরু হয়ে গেছে অঝোর ধারায়। পাতলা অন্ধকারে অস্পষ্ট হয়ে আসে সবকিছু… পাইটার রক্তাক্ত দেহ… ঝুপড়ির দিকে পুরাণীর ধীরে ধীরে হেঁটে যাওয়া।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত