কালো দীঘির জল
আকাশের দিকে তাকালে কাজরি শুধু জলই দেখতে পায়। আগে একথা সবাইকে বলত। ছোটোবেলা যখনই দূরপাল্লার ট্রেনে করে বেড়াতে গেছে ট্রেন থেকে ধানক্ষেতের সারি দেখিয়ে বাবা বলত, “ঐ দেখ। ধানক্ষেত। এর ওপারে গ্রাম।”
কাজরি কিন্তু ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়েও জলই দেখত। কালো দিঘীর স্বচ্ছ টলটলে জল ওর চোখের সামনে ভাসত। কত ডাক্তার দেখানো হল, তবুও চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক দীঘল জল। অনেকে বলত বয়স বাড়লে কমে যাবে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানো হল তবুও সব একই রকম রইল।
বৃষ্টি তো রাতেই থেমে গিয়েছে। উঠোনের জল এখনও নামেনি। চটি দুটো হাতে নিয়ে শাড়িটাকে প্রায় হাঁটুর ওপরে তুলে জলের ওপর দিয়ে তড়িঘড়ি যেতে গিয়ে খালি পায়ের ওপর একটা ঠাণ্ডা পিচ্ছিল অনুভূতি হল কাজরির। একটু ঝুঁকে হাত দিয়ে জিনিসটা সরাতে গিয়ে দেখল কোনও জড়পদার্থ নয়। রীতিমতো হেলেদুলে পা ছাড়িয়ে চলে গেল সাপটা। কিছুক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেল ও। পায়ের ওপর দিয়ে সাপ চলে গেলে সম্মোহন হয় কিনা জানে না ও। তবুও বোকার মতো স্থির হয়ে গেল। নড়বার ক্ষমতাটুকুও আর অবশিষ্ট নেই।
-দাঁড়িয়ো না। এগিয়ে যাও। ওই একটা নয়, আরও অনেক আছে। বৃষ্টি হলে এমনিতেই এখানে এসবের উৎপাত। আর কাল যেভাবে ডিভিসি জল ছেড়েছে। কত কি যে ভেসে গেছে? তার মধ্যে একটা দুটো ও জিনিস থাকবে না, তা হয় নাকি?
ওপর থেকে নমিতার কথাগুলো শুনে কাজরি সাহস না পেলেও দ্রুত পা চালাল। বাসস্ট্যাণ্ড অব্ধি পৌঁছাতে পারলে কিছুটা স্বস্তি। বেনাচিতি বাসস্ট্যাণ্ডে অসম্ভব ভিড়। বহুকষ্টে বাসে উঠে কোনোমতে হাতলটা ধরে দাঁড়ানোর জায়গাটুকু পেয়েছে তাই রক্ষে। হাতলে ভর দিয়েই ঘুমে ঢুলে পড়ল। কাল সারারাত ঘুমাতে পারেনি। দোতলার ওপর থাকে বলে ডিভিসির জল হুড়হুড় করে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ছে এ শুধু বারান্দায় দাঁড়িয়েই দেখছিল। তখনও বোঝেনি ওর বাড়িওয়ালী নমিতার ঘরময় জল ঢুকে বিছানা অব্ধি ভাসিয়ে দেবে আর নমিতারা সপরিবারে ওদের দোতলায় এসে আশ্রয় নেবে রাতটুকুর জন্য। দোতলার সিঁড়ির কয়েক ধাপ পর্যন্ত জল উঠেছিল কাল রাতে। সকালে সিঁড়ির জল নেমে গেছে। তবুও অস্বস্তি একটা মনের মধ্যে আটকে রয়েছে।
বাসে ঘুমের ঢুলুনির মধ্যে ও শুনতে পায় ‘এই রিয়া…”
ছুটির দিনে দুপুরে ভাতঘুমের জন্য উপুড় হলেও ঘুম আসে না ওর। আর তখনই “এই রিয়া…” ডাকটা নীচ থেকে শুনতে পায়। নীচের তলায় নমিতা ওর বর সুভাষ আর মেয়ে রিয়াকে নিয়ে ওদের সংসার। একটা কালো কুকুর রোজ এসে বসে থাকে ওদের ফেলে দেওয়া মাংসের হাড় চিবোনোর জন্য। কাজরি একবার ভাবে কুকুরটার জন্যই অল্প মাংস কিনে আনবে। কিন্তু আনা হয় না ওর। মাছ মাংস খাওয়ার পাট বহুদিন চুকিয়েছে ও। বিশেষ কোনও কারণে নয়। খেয়ালবশেই ছেড়েছে ভেবেছিল ওর বাড়ির লোক। কিন্তু আজ পাঁচবছর হতে চলেছে ও বাড়িছাড়া আর সুদীপের সঙ্গে থাকতে থাকতে একইরকম খাওয়া অভ্যেস হয়ে গেছে ওর।
কাজরির মায়ের কাছে এসব শুনে আত্মীয়রা বলে ছেলেপিলে নেই তাই এমন ধারা। নাহলে এই বয়সে মাছ মাংস খায় না? তাছাড়া, পাঁচবছর হল বিয়ে হয়েছে। এতদিন স্বামীর চাকরির কারণে দুর্গাপুরে ছিল। আজ যখন সুদীপ বদলি হয়ে দিল্লি চলে গেল মেয়ে তবুও দুর্গাপুরে ভাড়া বাড়িতে পড়ে আছে? একটা প্রাইভেট স্কুলে চাকরির জন্য কাজরির এভাবে একা একা থাকা পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় এমনকি কাজরির মা বাবাও ভাল চোখে দেখেনি। সুদীপ, কাজরির স্বামী খুবই সেন্সেটিভ। সবসময়ে পলিটিক্যালি কারেক্ট হওয়ার একটা প্রচেষ্টা। স্ত্রীর স্বাধীন সিদ্ধান্তে কোনও হস্তক্ষেপ করে নি কিন্তু মনে একটা ক্ষোভ পুষে রেখেছে। মাঝেমাঝেই বলে, “আজ তো খাওয়াই হল না সারাদিন।” অথবা, “অর্ণবের বউ আছে তাই ওর কোনও অসুবিধা নেই, যত রাতেই বাড়ি ফিরুক ভাত জুটবে। সবার কপালে তো সে সুযোগ হয় না?”
কাজরি বিয়ের প্রথম বছর কলকাতায় চাকরি ছেড়ে ব্যাঙ্গালোরে সুদীপের সঙ্গে সংসার করতে গিয়েছিল। কিন্তু এই দুর্গাপুরের মতো মফঃস্বলে কেন যে ও আটকে পড়ল তা নিজেও বোঝে না। স্কুল থেকে ফিরে পুরো দোতলার শূন্যতা ওকে গিলতে আসে। নীচে নমিতাদের সাংসারিক শব্দে ওর একাকীত্ব ঘোচে আবার মন খারাপ হয়ে যায়। বেসরকারি স্কুলের একটা চাকরি ও তো দিল্লি গেলেও পেতে পারে। তবুও কেন একা একা এই দুর্গাপুরে পড়ে আছে সে প্রশ্ন ও নিজেকে বারবার করে। প্রতি রোববার ভিডিওকলে সুদীপের সঙ্গে কথা বলার পর ও সিদ্ধান্ত নেয়, আর নয়। এবার রেজিগনেশন দিয়ে দিল্লি চলে যাবে। সেদিন নমিতাও বলছিল, তুমি কলকাতায় থাকলে এক রকম হতো। তোমার বাবা মা রয়েছেন সেখানে।
প্রত্যেকবার চলে যাবো ভেবেও শেষ পর্যন্ত থেকে যায় এখানেই। বিষ্ণুপুরের একটা বেসরকারি কলেজে বহু আগে সুদীপ থাকতেই এপ্লাই করেছিল। কাগজে ভ্যাকেন্সির বিজ্ঞাপন দেখে। ইন্টারভিউতে ডেকেছে ওকে। আগেরদিন প্রবল বৃষ্টি তার ওপর ডিভিসির জল ছেড়ে দেওয়ায় পুরো দুর্গাপুর ভাসছে তবুও ইন্টারভিউ দিতে যাবেই কাজরি। নমিতা আর ওর বর সুভাষদা বারণ করেছিল। “এর মধ্যে না গেলেই নয়?”
কখনও কোনো কিছুতে প্রশ্ন করে না সুদীপ কিন্তু এবার বলেছিল, “দুর্গাপুর ছেড়ে তুমি একা একা বিষ্ণুপুরে থাকবে? আর থাকতেই যখন পারবে না ইন্টারভিউতে যাচ্ছো কেন? এদিকে দিল্লিতেও তো দুটো কলেজে শর্টলিস্টেড হয়ে আছো, তুমি আসবে না এখানে ইন্টারভিউ দিতে?”
কাজরি কোনও উত্তর দিতে পারেনি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোনে কথা বলছিল ও। আবারও চোখের সামনে জল ভেসে এল। এই প্রথম সেই জলে ও ডুবে যাচ্ছে। একটা চিৎকার শুনতে পেল। তারপর নিজেই হাত পা ছেড়ে দিল। ডুবে যেতে চায়। ডুবে যেতে চায়।
কোনও উত্তর না পেয়ে সুদীপ ফোনের ওপার থেকে বলেছিল, “তাহলে তুমি একসাথে থাকতেই চাও না। চাকরি কোনও অজুহাত নয়। দিল্লির কলেজে ইন্টারভিউ দিতে আসবে কিনা স্থির করতে পারছ না? একা একা দুর্গাপুর ছেড়ে নতুন একটা ঠিকানায় যেতে চাইছ তুমি? সত্যিই তুমি নতুন কোনও ঠিকানা চাও তপু?”
কাজরিকে সুদীপ তপু বলেই ডাকে। কিন্তু ওর তপু তো উত্তর দেওয়ার অবস্থাতেই নেই। জলের ভেতর ওর সামনে ভাসছে একটা মৃতদেহ। জল ঢুকে যাচ্ছে ওর নাকে মুখে। রক্ত বেরাচ্ছে নাক দিয়ে। জলের চাপ ক্রমে বাড়ছে। ওই তো একটা সাপ আঁকড়ে রয়েছে ওকে। আর কিছু মনে করতে পারছে না ও। অজ্ঞান হল কিনা ঘুমিয়ে পড়ল বোঝার মতো কেউ ছিল না তখন ঘরে। প্রবল অভিমানে সুদীপ ফোন কেটে দিয়েছে ততক্ষণে।
বাসে কিছুক্ষণ পরে অবশ্য বসার জায়গা পেয়েছিল কাজরি। সারাটা রাস্তা ঘুমিয়েই কাটল ওর। দুর্গাপুর বাসস্ট্যাণ্ডের সঙ্গে কোনও তফাৎ নেই বিষ্ণুপুরের। আসলে বাংলার সবকটা বাসস্ট্যাণ্ডই একে অপরের যমজ। সেই ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ, ডেকচিতে আধসেদ্ধ ভাতের ফেন উপুড় করছে কোনও এক কিশোর বালক, ছোটো ছোটো দোকানে ব্যস্ততা। কচুরি, শিঙাড়া আর চপের গন্ধে এক অদ্ভুত মাদকতা। যে মাদকতায় ও নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। তাই আর অপেক্ষা না করে স্বাস্থ্যের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে চপ কচুরির প্লেটেই আত্মসমর্পণ করল। লাল মাটির ভাঁড়ে পুরনো জমা দুধের চায়ে চমুক দিতেই একটা ঢেঁকুর উঠল ওর। ভাঁড়ের চা টুকু শেষ হতেই একটা রিকশা নিয়ে সোজা কলেজের পথে চলে গেল।
প্রিন্সিপ্যাল বাঁকুড়ার আদি বাসিন্দা। এই আবহাওয়ায় একটা মেয়ে ইন্টারভিউ দিতে এসেছে দেখে ওনার বাড়তি মায়া হল বুঝি! খুব সংক্ষিপ্ত ইন্টারভিউতেই কাজরি বুঝতে পারল চাকরিটা এখানে হয়ে যাবে ওর। কলেজ থেকে বেড়িয়ে সুদীপের জন্য মন খারাপ লাগছিল খুবই। না, দিল্লিতে ও অবশ্যই যাবে ইন্টারভিউ দিতে। ইন্টারভিউ দিলেই দিল্লিতে চাকরি হবে তার কোনও মানে নেই। ভাবল, সুদীপকে ফোন করে জানায়, দিল্লিতে যদি চাকরি হয় তাহলে দিল্লিতেই থাকবে ও।
-দিদি, বাসস্ট্যাণ্ড তো এবার?
রিকশাটাকে দাঁড় করিয়েই রেখেছিল। একেবারে ইন্টারভিউ দিয়ে বাসস্ট্যাণ্ডে নামিয়ে দেবে এ রকমই কথা ছিল। রিকশায় উঠে মোবাইলে সুদীপকে ফোন করল। রিং হচ্ছে অথচ ধরছে না ও ফোনটা।
-ভাই, লালবাঁধ কতদূর?
-এই তো কাছেই। যাবেন?
-হ্যাঁ, চলো তো। একটু ঘুরে আসি।
লালবাঁধে এসে সেই কালো দিঘিটা দেখতে পায় ও। এই দীঘিই তো ও আকাশের দিকে তাকালেও দেখতে পায়। জল দেখতে পায় বলে বাবা মা ভয় পেতো। ভাবত, জলে বোধহয় বিপদ মেয়ের। সাঁতারে ভর্তি করেছিল। কিন্তু সব সময় তো ও দিঘিটা দেখতে পেতো না। মাঝেমাঝে দেখত। বাবা মায়ের সঙ্গে, কলেজ ইউনিভার্সিটিতে বন্ধুদের সঙ্গে, বিয়ের পর সুদীপের সঙ্গে বেশ কয়েক জায়গায় বেড়াতে গিয়ে নদী দেখেছে। কিন্তু ওর চোখের সামনে যে কালো দিঘি তাকে কোথাও খুঁজে পায়নি ও এতদিন। এই দিঘি যে ওর বড় চেনা!
কাজরি দিঘির ঘাটে নামতে থাকল। ঘাটের একেবারে শেষধাপে এসে বসে পড়ল। কে যেন পাশে এসে বসেছে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কথা শোনা যাচ্ছে। “আপনি লালবাঈয়ের গল্প জানেন?” কাজরি মাথা নাড়ে। জানেনা ও। “আপনি?”
“আমি কথক। শুনবেন? লালবাঈয়ের কথা?” কাজরি হ্যাঁ বলল কিনা সেদিকে খেয়াল নেই লোকটার। লোকটা গল্প বলে যায়।
-রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিং ছিলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ভক্ত। মুঘল দরবার থেকে সঙ্গীত সম্রাট তানসেনের বংশধরকে তিনি নিয়ে এসেছিল এই মল্লভূমিতে। সেই সময় বিষ্ণুপুর ঘরানার এক নতুন উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের খ্যাতি দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। সুদূর আগ্রা থেকে এই সঙ্গীতের টানে এসেছিল লালবাঈ। যেমন তার রূপ তেমন গুণ। কী অপূর্ব গায়কি আর সেই সঙ্গে অসাধারণ নৃত্যপটীয়সী।
রাজা লালবাঈয়ের রূপে গুণে মুগ্ধ হলেন। লালবাঈও বিষ্ণুপুরী ঘরানার প্রেমে পড়ে এখানেই থেকে গেলেন।
রাজা আর লালবাঈয়ের প্রেম প্রগাঢ় হলে তা আর চাপা রইল না। লালবাঈয়ের একটা ছেলেও হয়েছিল। রাজসন্তান ছিল সে। আর সেই বছরই রাজ্যে অনাবৃষ্টি, খরা। বৃষ্টি কমে আসছিল এই মল্লভূমিতে। ছেলে হওয়ার বছরে প্রচুর লোক মারা গেল। চারিদিকে একফোঁটা জলের জন্য হাহাকার। রাজা লালবাঈয়ের জন্য এই দিঘি কাটিয়েছিলেন। এখানেই এক বড় উদ্যানের মধ্যে লালবাঈয়ের কুঠিতেই রাজার রাত্রিযাপন। রাণী চন্দ্রপ্রভা দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছেন। ভেতরে বিষের জ্বালা। রাজাকে ফেরাতে পারছেন না কিছুতেই।
কাজরি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে এই কাহিনী। যেন লালবাঈয়ের আখ্যান শুনতেই এসেছে ও। চারিদিকে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। কথক বলে চলেছে,
রাণী চন্দ্রপ্রভা আর সহ্য করতে পারলেন না। মন্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে স্বামীকে বিষ দিয়ে হত্যা করলেন আবার মৃত স্বামীর সঙ্গে সহমরণেও গেলেন।
এই অব্ধি বলে কথক থামল। তারপর দীঘির জলে একটা পাথর ছুঁড়ে দিল। ছোট্ট একটা নুড়ি পাথর। খুব সামান্যই একটা তরঙ্গের আভাষমাত্র দিয়ে আবার সেই কাজলরঙা জল শান্ত স্থির।
-লালবাঈয়ের কী হল তারপর?
-লালবাঈ তখনও জানতে পারেন নি রাজা মৃত। কোনও এক দাসী এসে খবর দেয় রাজা লালবাঈয়ের বিচার করবেন। রাজসভা বসেছে। রাজ্যে অনাবৃষ্টির জন্য লালবাঈ দায়ী। রাজ সভায় উপস্থিত সবারই মতামত নিয়ে রাজা সুবিচার করেছেন এবার। তাঁকে মৃত্যদণ্ড দেওয়া হবে সর্ব সমক্ষে। দাসী লালবাঈকে পালিয়ে যেতে অনুরোধ করেছিল।
-লালবাঈ পালিয়ে গিয়েছিল?
-সে তখন তার তানপুরা নিয়ে বসেছিল। হাসতে হাসতে দাসীকে উত্তর দেয়, “রাজার জন্য নতুন একটা সুর তুলছি। তিনি এলেন বলে। আমি তার জন্যই অপেক্ষা করছি। তুমি আসতে পারো।”
বুড়ি দাসী আবারও সতর্ক করে দিতে চাইলে, লালবাঈ হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল “যাও রাণীমাকে বলো আমি তাঁকে সেলাম জানালাম। কিন্তু তাঁর রাজাকে তাঁর হাতে ইহজীবনে আর কখনোই তুলে দিতে পারব না।”
-তাহলে লালবাঈ রাজাকে ভালোবাসত? সেইজন্য এই নিশ্চিন্ততা, সেই কারণেই এই নির্ভীক সুস্পষ্ট ঘোষণা?
-পুরনো কাহিনী বলছি আমি। ভালোবাসার কিছুই জানিনা, বুঝিনা।
-আচ্ছা, তারপর কী হল? রাজা কি বিষ প্রয়োগে মারা গেলেন?
-হ্যাঁ। রাজার মৃত্যুর পরই তো দাসী গিয়েছিল লালবাঈয়ের কাছে। বললাম তো আপনাকে আগেই। রাজা মৃত।
একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল কাজরি। তাই ও শুনল, ‘ভালবাসা মৃত।’
-বাইজির ঔদ্ধত্য আর কেউ সহ্য করতে পারল না। হাতপা বেঁধে, মুখ ঢেকে রীতিমতো ধাক্কা দিয়ে লালবাঈকে তার শিশুপুত্র সমেত দিঘির জলে ফেলে দিল।
লালবাঈ তো সাঁতার জানত। রাজা আর লালবাঈ কতবার দিঘির জলে একসাথে নেমেছিল। কিন্তু রাজা নেই, কোলের ছেলেটাও জলে ডুবে গেল, হাত পা না বাঁধলেও লালবাঈ নিজেই ডুবে যেতো আর ভেসে উঠত না।
কাজরি নিজের দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেলো। একটা সরীসৃপের ফোঁসফোঁস শব্দও যেন কানে এল। বেশ স্পষ্ট। দিঘির কালো জলে পা ডুবে গেছে কখন ওর! খেয়ালও করে নি। জল বড় বেশী ঠাণ্ডা আর শান্ত, যেন পা জড়িয়ে কাঁদছে। এইবার পেছন থেকে চিৎকার শুনতে পেল ও, “দিদি, জল খুব গভীর। এখানে এই কদিন আগে একটা ষোলোবছরের মেয়ে ডুবে গেল। আর উঠল না। উঠে আসুন দিদি।”
পাশে তাকিয়ে দেখল কথক ঠাকুর ধারে কাছে কোথাও নেই। কাজরি একদম একা ঘাটের শেষ ধাপ থেকে দিঘির জলে এইমাত্র পা বাড়িয়েছে। দূর থেকে রিকশাওয়ালার চিৎকার, “উঠে আসুন দিদি।”
কথাসাহিত্যিক
দিল্লিনিবাসী, অর্থনীতির শিক্ষিকা। তাঁর প্রকাশিত বই তিনটি। ‘মিথ্যে ছিল না সবটা’, তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতার বই। প্রকাশক কলিকাতা লেটারপ্রেস, ২০১৮ কলিকাতা পুস্তক মেলায় প্রকাশিত। দ্বিতীয় বই গল্প সংকলন, ‘দময়ন্তীর জার্ণাল’, সৃষ্টিসুখ প্রকাশনী। ‘মালিনীর দ্রোহকাল’, পরম্পরা প্রকাশনী, ২০১৯ বইমেলা
দেশ, সানন্দা, সেতুবন্ধন(দেবেশ রায় সম্পাদিত), কৃত্তিবাস(স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত), কৃত্তিবাস(প্রতিভাস প্রকাশনী) কথাসোপান, গাঙচিল, কৌরব, বর্তমান, সংবাদ প্রতিদিন, একদিন, আনন্দবাজার(ডিজিটাল), বণিকবার্তা(বাংলাদেশ), বিডিনিউজ(বাংলাদেশ) সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী প্রকাশিত। সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি অর্থনীতি বিষয়ক উত্তর সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে সংবাদ প্রতিদিন-এর ৪-এর পাতায়। ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেস, নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ই-পত্রিকা গল্পপাঠ, বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ম্যানগ্রোভ সাহিত্য, কলকাতা থেকে প্রকাশিত চারনম্বর প্ল্যাটফর্ম, আবহমান ব্লগজিন ইত্যাদি বিভিন্ন পরিচিত ই-পত্রিকায় গল্প কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত।
দিল্লির বেঙ্গল এসোশিয়েশন ও দিগঙ্গন পত্রিকার পক্ষ থেকে ‘ব্রজমাধব সাহিত্য পুরষ্কার ২০১৯’ ও অভিজয় সাহিত্য পুরষ্কার ২০১৯, ‘দময়ন্তীর জার্নাল’ গল্পগ্রন্থের জন্য।