শিল্পের বড়াই
১.
-তুই যহন প্যাটে তহন এমন উচা হইয়া উঠলি যে লুকজন আমারে ডাইক্যা জিগাইতো, যমজ নি লো বেডি? ফকিরে মায়রে কইলো যমক হইলে নাম দিবা হাসনা আর হেনা। তারপরে হইলো একটাই মাইয়া, মুডাশুডা, কী সুন্দর, সেই থিকা হাস্নাহেনা নাম। তা এই নামে আমাগো বাড়িতে কেডা ডাকবো মাইয়ারে। তর নানী নাম রাখনের কাম, তাই নাম রাখলো পায়রা।”
মা বিহ্বল চোখে টেবিলে অয়েলক্লথের ওপর একটা আবছা দাগ মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে বলে, হাস্নাহেনা অথবা পায়রা অনেক কাল পরে তার নামকরণের ইতিহাস আবার শোনে, এসব ছোটবেলা থেকেই শোনা তার। তবু কোথাও যেন তার এই সামান্য মানবজনম নেবার সামান্য উৎসব জেগে আছে, এই বাড়িতেই। সে কান খাড়া করে রাতের ধুলপথে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শোনে। যেন চটকা ভেঙে জেগে উঠে জিজ্ঞেস করে
-তাইলে অহন আমাগো নানীর বাড়িতে কে থাহে?
-শাহীনে থাহে।
-কুন শাহীন? পাগলডা?
-হ, পাগলা শাহীন থাহে। পাগল কইস না রে বেডি, সে তো পাগল না। তাগোডা ভাড়া দিয়া কেমন আমাগোটায় থাহে। সুন্দর কইরা থাহে। ছাদে কত্তগুলি হিমসাগর আমের গাস লাগাইছে, আমরা গেলে পর ছাদের ক্যালাকুচ পাতার ঝোল দিয়া মাছ-ভাত খাওয়াইলো, পরে আম কাইট্টা দিল। এমন মিঠা ছোকলাশুদ্ধা মিঠা।”
পায়রা আরো কিছুক্ষণ আলাপ করে, বায়তুল আমান আর সিটাডেল-এর মাঝখানে যেই গলি, সেই গলির নাম তাদের কাছে ছিল ছাগলওয়ালা বাড়ির গলি… গলির মুখে একটা বড় জমিতে ঠোঙ্গা-(ব্রাউনপেপার)রঙা ছাগল চরতো, অনেকটা পেছনে টিনের চালের ঘর, টিনের রঙ মহিষের রক্তের মতন ঘোর লাল, টিনের ঘরের ভিতরখানা মহিষের গায়ের মতন অন্ধকার, আঙিনায় মহিষের মাড়ির মতো লালচে বিবর্ণ একটা সায়া ঝুলতো সবসময়। দেয়ালের বদলে সীমানা জুড়ে অনেকগুলো বরইগাছ। মা শুধরে দেয়, “হ রে ঐডা ছিল মোতাহারের বাপগো বাড়ি। অরা তো সবাই মিল্যা ঘরবাড়ি বেইচ্যা দিয়া বিদেশ গেছে গা।”
-বিস্কুটের ফ্যাক্টরির সামনে রঞ্জিতাগো গানের ইস্কুল আছিল না? ঐ যে ড্যানিশ বিস্কুট কিনতে পাওয়া যাইতো?”
-খালি ড্যানিশ বুলে! ড্রাই কেক, বেলা বিস্কুট, টিপা বিস্কুট, দুইরকমের টোস্ট বিস্কুট, ঝাল বিস্কুট, আনারকলি বিস্কুট…” মা বলতে বলতে দেয়ালের টিকটিকির দিকে চেয়ে উদাস হয়ে যায়। রঞ্জিতা আর গান শেখায় না। রঞ্জিতার ছোট বোন নন্দিতা হাতের কাজ করতো খুব ভাল, তাদের বাড়ির সামনে ছোট্ট একটা দরজি-দোকান হয়েছে, ‘মুনতাহা বুটিকস’, হ্যালহেলে কয়েকটা কামিজ ঝোলানো, সেই কামিজগুলোর হলুদ, গোলাপি, নীল এত গাঢ় যে দোকানের লাইট বন্ধ করে দেবার পরেও সেগুলো জ্বলজ্বল করতে থাকবে। এই দোকান ধরে সামনের গলির নাম হয়ে গেছে ‘বেডির দুহান লেন’। পায়রার মায়ের প্রিয় রঙ ছিল কমলা, পায়রার ছিল হলুদ। এখন তারা কেউই আর হলুদ বা কমলা পরে না। মার গায়ের রঙ কোনোকালে উজ্জ্বল ছিল, তামায় রাঙ মেশালে যে কাঁসা হয় তেমন, তা সংসারের হরেক কাজের ঘানি টেনে টেনে সেই রঙ কালি ধরা কাঁসার মতো হয়ে গেছে, খদ্দরের কাপড়ের মতো অসংখ্য কোঁচকানির দাগ সেই চামড়ায়। হাস্নাহেনার রঙ ছিল তার নামের মতোই, জোছনার সবুজ আভা ধরানো ফিকে শুভ্র। মোলায়েম। উঠে গিয়ে ভেজা ত্যানা বুলিয়ে অয়েলক্লথ সাফ করে মা, বলে, “খেজুরের গুড় ইচ্ছামতন হেইচ্যা দিয়া ফিন্নি রাইন্ধা দিসে পুববাড়ির দিদিমায়, অহন তুই খাবি নি?” জিজ্ঞেস করে যেন নিজেই জবাব করে, “হেরা কয় মিষ্টান্ন… মণ মণ দুধ জ্বাল দিয়া আগে যেমন রানতো, তেমন হইব না খাইতে।”
-ভাত বেশি খাইয়া ফালাইছি ও মা। একমুঠ কম দিলেও পারতা।”
সামনের দেয়ালে শাদাকালো ছবিতে ফিলিপস ট্র্যানজিস্টর পাশে রেখে বসে আছে ন্যাংটা একটি ছেলে, কপালে কালো বড়ির মতো বড় কালির ঢ্যাবা, গলায় একঝাঁক মাদুলি। মুখের ভঙ্গি ভাল নয়, যেন এখনি কেঁদে দেবে। ভাইটি তো ছিল তাদের, একটিমাত্র ভাই, বাপের কান্ধে উইঠ্যা কইতো, “তাউল্লা-ছুলা (টাকমাথা) ঘোড়া, চল চল।” আর তাদের অনটনের সংসার চালাতে চালাতে মাথার চুল উঠে যাওয়া বাপ হাসতো, সামনে সুন্দর দিন, পুন্নাম নরক থেকে ত্রাণ করবে পুত্র, দিদিমা বুঝিয়েছিল। ছেলে হয় না বলে চুপচুপ করে দিদিমার সাথে গিয়ে একদিন সোনার ধান মানত করে এসেছিল মা, পায়রা ভাবতো অত পয়সা কোথায় পাবে তারা? পরে দ্যাখে ওটা সোনার জল করা ধান। দেখন-সোনা। আরো পরে দ্যাখে, ওসব করতে গিয়ে মা তার পায়ের রুপার মল বেচে দিয়েছে কবে।
রাতটা আচমনের পানির মতন স্থির, শীতল। জানালার খোলা পাটটা এঁটে দিতে দিতে পায়রা দেখে পুরনো দেয়ালটা, শ্যাওলা ধরা ইটের দেয়ালে লেখা অজস্র বি- আর -এস, ‘বিভুরঞ্জন সাহা’র ইট। সাহাবাবুর ইটভাটি থেকে এসেছিল এই ইট। শীত কেটে যাবার মতন হালকা বাতাস। সেই বাতাসের ঘ্রাণ নিতে নিতে পায়রার মনে হয়, ক্ষেতপাথালি দৌড় দিয়ে প্রায় উড়ে আসছে তার ছোটবেলার বন্ধু দিলারা, সর্ষেফুল রঙা ওড়নার ডগা দিলারার কাঁধের পেছন দিয়ে ডানার মতো উড়ছে। শ্যালো মেশিনে গোসল করতো তারা, পায়রা আর দিলারা, উজ্জ্বল শাদা স্ত্রী-পাখিরা, দুইধারে শস্যের মাঠ সবুজ আর আকাশ নিঃসীম নীল, সেই আকাশে উড়িয়ে দেয়া ছেঁড়া কাগজের টুকরার মতন উড়ন্ত পায়রার ঝাঁক, দিলারা কইতো, “এক পায়রা ডাঙ্গায় আর বাকিগুলি আসমানে!” বৈদ্যের বাজারের ঐপারে ফরায়েজি কান্দি চর। নিশিন্দা চর। চরে চলে যেত তারা অমল শৈশবে। সেখানে ভটভটিয়ে মিশুক চলে না, গাড়িঘোড়া নাই, চাষারা সারি দিয়ে বসে আলু তোলে, কাঁটাবেগুন ছেঁড়ে, বৌরা জালি দিয়ে মাছ ধরে, বাজারে কিলবিল করে শোল টাকি আর ভোলা টাকি, মাছরাঙা ঝুপ করে ডুব দেয় পানিতে, ঐখানে ঝুপঝুপ করে ডুব দিত তারা দু’জন, অথৈ নৈঃশব্দে।
কিন্তু নিথর নীরবতার সেই স্থির পানি দুলিয়ে দিয়ে ঝুপঝুপ করে ঢিল পড়ে তাদের বাড়ির টিনের চালে। মা চেঁচায়, “ক্যাডা ক্যাডা!” আর জবাবে ভেসে আসে পাগলের চিৎকার। “দিবানি, ম্যায়ার বিয়া আমার কাছে দিবানি? আ গো, দিবানি?”
মা মোটা লাঠিটা ধরতে যায়, পায়রা তাকে থামায়, অবিশ্রাম বিবাহপ্রস্তাব দিয়ে একসময় ক্লান্ত হয়ে যাবে পাগল। কুকুরের মতো ঘ্রাণশক্তি এই পাগলের, এত বছর পরেও। পায়রা যেন আপনমনে একটু শিউরে ওঠে।
শোরগোল অবশ্য সত্যিই একসময় কমে আসে। পাগল গুঙিয়ে গুঙিয়ে বলে, “ফসফসায়া কাগশ ছিড়্যা দিবা, আমি টেকা বানায় দিমু। টেকা উড়ায় দিবা, আমি টকটকা লাল গোলাপ বানায় দিমু। সাত বচ্ছরের সাধনা গো মা, ম্যায়ার বিয়া দিবানি?” যেন তার কথার জবাব দিতেই পথের কুকুরগুলো জোর গলায় ঘেউ ঘেউ করতে থাকে। মা সরু চোখে পায়রার দিকে তাকিয়ে থাকে। পায়রা মাথা নুইয়ে কোলের ওপর শাড়ির জরিপাড় ভাঁজ ভাঁজ করেই যাচ্ছে। মা ঘেরা বারান্দার দরজার দিকে সরে গিয়ে গলা তুলে বলে, “বাবা না ভাল, তুমি অহন যাও গিয়া, মাইয়া বিয়াইলে আমি তোমার কাছেই দিতাম, মাইয়া তো জন্মে নাই।” পাগল জবাবে কী বলে কে জানে, নাকের কানের সোনা দেবে এমনটা বলে। কাঁদে। আবার শুরু করে, “দিবানি গো ম্যায়ার বিয়া আমার কাছে দিবানি?”
-ক্যান আইলি রে মা।” মা সখেদে বলে, বেশ নীচুগলায়।
-তোমারে দ্যাখতে আইলাম। পাগলের কাছে যে অহনো বিয়া বইতে হইবো ক্যাডা জানতো।” বিরক্ত গলায় বলে পায়রা। তার গলায় বিরক্তির পাশে যেন একটু শক্তিও আছে।
রাস্তায় কারা যেন যায় টর্চ হাতে, মাথা-কান-গলা বরফিকাটা মাফলারে মুড়ি দিয়ে হাফ-সোয়েটার গায়ে হনহন করে পাড়াগাঁয়ের রাস্তায় যেমন যায়। এরা কেউ পাগল এবং কুকুরের দল উভয়কে তাড়া দেয়, কেউ নিচু গলায় বলে, “দিদিমায় বিয়া বইবো, হেই বাড়িত যা রে আব্দুল হালিম।”
-হ হ চপলারাণী দিদিমায় বিয়া বইবো, যা গিয়া দ্যাখ।”
পাগল চলে যায়। বকবক করতে করতেই যায়। আগামীকাল দুপুর অব্দি সে নীলকুঠির সামনের সিমেন্ট বাঁধানো দাওয়ায় ঘুমিয়ে থাকবে, কিংবা সামনের আমগাছটার ছায়ায়। গায়ে চট। চুলে জটা। এমন বেজাত লোক, জেগে থাকলে সবসময় মুখটারে হ্রস্ব-উকারের মতন উল্টায়া রাখে। এখানে দুপুরও শুনসান নয়। ‘ইন্দুর লাইন দিয়া খায়, সিরিয়াল ধইরা মরে’ সাইকেল রিকশায় চেপে হেঁকে যাবে ইন্দুর মারার বিষবিক্রেতা। কেউ খুব জেদ করে সিরিয়াল ধইরা সবক’টা পোলাপান পেটাচ্ছে বলে কান্নাকাটির শব্দ আসবে গেরস্থবাড়ি থেকে। কিন্তু তাতেও পাগলের ঘুম ভাঙবে না। মামুদাবাদ মাদ্রাসার রোদ-ঝলসানো শাদা দেয়াল দেখা যাবে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা থেকে, ধানক্ষেতের ওপর লিকলিকে পিলারে দাঁড়িয়ে আছে মাদ্রাসার পাকা বাড়িটা। কত দূর থেকে আরবি সবক নেবার গুনগুন শব্দ উঠবে।
কাল আরেকটা দিন।
কাল এই গরাদ দেয়া জানালা দিয়ে উঁচু খাটের দিকে তাকাতে তাকাতে কেউ না কেউ জিজ্ঞেস করবে, “ওলো কাহি, তোমার মাইয়া নি আইছিল? উনি কই কাস্করেন?”
মা শীতদুপুরের সামান্য ঘাম গলার আঁচলে মুছতে মুছতে গাঢ় গর্বে বলবে– “পৌরসভায়।”
কিন্তু রাত্রি সাঁতার দেয়া কী কঠিন! মা তাকিয়ে দেখে পায়রার কপালে ক্লান্তির বিনিদ্র চাঁদ। মা উঠে গিয়ে ওষুধবড়ি হামানদিস্তায় মৃদু আঘাত করে চার টুকরো করে, অসম টুকরো। তখন মাকে কবেকার কোনো ভুলে যাওয়া- বিলীন হয়ে যাওয়া গোষ্ঠীর বৈদ্যের মতন লাগে, ডাইনির মতন লাগে। ফ্লানেলের ফুলহাতা ব্লাউজ, কমলাপাড় শাড়ি, গলার খাঁজে কোথাও কালচে হয়ে আছে পুরান স্বর্ণের চেইন, মা ওষুধের একটুকরো মেয়ের হাতে দিয়ে বলে, “খায়া ফ্যালা, ঘুম আইবো, তারপর একঘুম দিয়া ওঠ রে মা!”
২.
এইখানে বাজারের সোনার দোকানে লজ্জায় গা মোচড়াতে মোচড়াতে সে-ও কোল্ডড্রিংক খেত। মা সযত্নে তুলোয় মোড়া গয়না বের করে ভাঙাতো, নতুন কিছু গড়তে দিত, তা এইসব সোনার জিনিস ভাঙা-গড়া হলেই স্বর্ণকার কাকু মিরিন্ডা আনাতো, পায়রার মনে হতো ভাঙা-গড়ার স্বাদ কোল্ডড্রিংকের মতো, ঝাঁঝালো অথচ মিষ্টি।
দুলারী কাকী আর চন্দনা কাকী সুরেশ্বর হোমিও হলের জন্য কাগজের ঠোঙা বানাতো একটা ঘরে, সেই ঘরে নিচু একখানা টুলে টিভি ছেড়ে রাখা, তাতে কেউ না কেউ সারাক্ষণ ষড়যন্ত্র করছে নয় কান্নাকাটি করছে। বাজারের ফার্মেসী থেকে ফিরবার সময় রেবতীমোহন কাকু কারে যেন নিয়ে ফিরবে বলেছে, তাই কাকীদের কেউ তেজপাতা আর পাঁচফোড়ন সম্ভার দিয়ে ফুলকপি গাজর সিম পেপে মিঠাকুমড়ার লাবড়া বানিয়ে ফেলতো ঝটপট, গরম সেঁকে আনতো হাতরুটি। মোড়ায় বসে তাদের সাথে পায়রাও খেত। সুন্দর শিশু বলে খুব আদর ছিল তার, পাড়ায় ঘরে ঘরে ছিল তার পরিব্রাজকের অধিকার। ভাঙা ঘাটে বসে কতবার কাকীরা আতাগাছের পাতা বেটে পায়রার মাথায় দিয়ে দিত উকুন সারবে বলে। কাকু ঢেঁকুর তুল্লেই দুলারী কাকী প্রায় ছুটে আসতো- কড়া আমপাতা চাবায়া খাইলে গ্যাস্টিকের পেইন যাইব গিয়া। সুন্দর মেয়েশিশুটির সামনে তাকে সাক্ষী রেখে আরো কত রঙ্গ হতো। এই যেমন রেবতীকাকু বলতো, “জানস নি উকুইন্যাবুড়ি, হ্যায় (দুলারীকাকী) আমারে বেশি ভালবাসে।”
শুনে দুলারী কাকীমা চোখটা দু’তিন দেয়ালে ঘুরিয়ে এনে খানিকটা লজ্জার সাথেই বলতো, “আন্তাজে!”
-শিবঠাউর যেমন সতীরে না দ্যাখলে থাকতে পারতো না হেইরম বাসে। মানে, আমি রেবতীমোহন সতী আর তগো দুলারী কাকীমা শিবঠাউর। গায়ে বাঘছাল খালি”… বলে হাসতে হাসতে পড়ে যেত যেন রেবতীমোহন দাস। দুলারী কাকীমার কানে চেইন দেয়া কানপাশা, সেটার রঙের চেয়ে অনেক উজ্জ্বল হয়ে আসতো কাকীর মুখ, কাকীও হাসতে হাসতে বলতো, “মানুষডা এমুন দুইনম্বরি!”
সাথে সাথে রেবতীকাকু বলতো, “পাবিনি জগত জুইড়্যা!”
-তয় না কইছিলা কাইল, আমরা দুইজন সমাইন্যা?”
-কবে জানি আমার দিকে চাইতে চাইতে গিয়া আমগাশটার লগে ঠুয়া খাইছে হ্যায়। জিগায়া দ্যাখ তর কাকীরে।”
কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে এখনকার পায়রা সেকালের পায়রাকে দেখে চেয়ে চেয়ে, যেন সিনেমার মতন করে কবেবকার ঘটনা ঘটে যাচ্ছে একটা পাতলা পর্দার ওপর। কোলের শিশুটিকে কোলে জুতে, বুকের শিশুটিকে দুধ দিতে দিতে দুলারীকাকী রাতের বেলায় হাত নেড়ে নেড়ে কইতো, পরশুরামে বহু পারাপারি কইরা তার কুঠার সমুদ্রে ছুইড়্যা দিছিল গো, মায়েরে খুন করছে তার অস্তর কেহ লয় না, সমুদ্রের পানিও পিছায়া গেল… তগোরে কইছিলাম না, কুঠার তো পরশুরামের হাতে জোড়া লাইগ্যা গেছিল মায়েরে মারার পাপে, আর তো সেই কুঠার ছুটে না!” ফাল্গুনের রাতে অন্ধকার আকাশের ভিতর আস্তে আস্তে সকালের আলোর মুকুল জাগতে থাকে। সেই আলো যেন অন্ধকারের একই মশারির তলে শুয়ে থাকা সুন্দরী সহোদরা। উপুড় হয়ে শোয় পায়রা। যেন উপুড় করে নেয় তার জীবন। যেন দেখতে পায় উঁচু-খুরঅলা খাটের তলায় পুতুলের সংসার যেভাবে সাজাতো সে, সেভাবেই সাজানো রয়েছে তার সোনার শৈশব, কাপড়ের পুতুল, শখের হাঁড়ি, ঝিনুইক্যা বোতাম। মেলায় চামচে করে এলুমিনিয়মের হাঁড়ি থেকে হলদে ডালডা তুলে দীপে ঢালতে ঢালতে মানিককাকু বলছে, “খাইল্যা মুচির উফরে ডালডা ঘি দিয়া প্রদীপ জ্বালাইতাসি গো মা, নাইলে পাশ-টেহায় দিমু কেমনে?… না কিনলে ঐদিক যা রে মা, ভগবানের নাড়িভুঁড়ির মতন চকচইক্যা গুড়ের জিলাপি ভাজতাছে। দেক গিয়া।” শখের-হাঁড়ির মতো ছোট ছোট ভারী সুন্দর পাত্র হয়ে যেন সাজানো আছে দুলারী আর চন্দনাকাকী, রেবতীকাকু, স্বর্ণকারকাকু, সপ্রশংস চোখে চেয়ে বলছে, “ভগবানে রুপার কালাই কইরা পাঠাইছে গো মা তরে, কেমুন চকচক করতাসোস!” যৌবন জুড়িয়ে গেছে, কিন্তু খাইল্যা দেয়ালের দিকে মুখ করে হাসতে হাসতে নুয়ে পড়ে দুটো লোক হিসেব করছে তারা কে কারে বেশি চায়, দুলারী আর রেবতী। আর সেই দৃশ্যের সাক্ষী একটি সুন্দর শিশুর মনে হচ্ছে, জগতে কত না চিত্রিত হাঁড়িতে জমা হয়ে আছে ভালবাসার দুধভাত। কবেকার কথা? কে জানতো কত ভাঙা-গড়ার স্বাদে ঝাঁজ নাই মিরিন্ডার মতন, নিঃশব্দে পাতাবাটার মতন তিতা অন্ধকারে ভরে যায় মুখ? আন্ধারে পায়রা ঠাহর করে দেখতে চায়, কোনো হন্তার হাতে কুঠার আটকায়া গেল কি না!
রেবতীকাকুর উকুইন্যাবুড়ি না মায়ের জাত?
৩.
কে যায় রাস্তা দিয়া, দুলারীর মাইগ্যা সোয়ামী যায়? মজিবর যায়নি মাথায় সিলাইন্যা টুপি দিয়া? কাগো বাড়ি দখল লইয়া থাকা লোকে ক্যালাকুচপাতার ঝোল রান্ধে, সে-য় নি? চপলারাণী বুড়ি নি? সেই যে বুড়ি কবেকার রাজরাণীগো কিচ্ছা কয়, কারে কয় সে, তিন রাণী বইন-সতীন, জগত জুইড়্যা অত জ্বলনের সম্বন্ধ আর আছে নি? আপন যে আপন, তারও চাইতে আপন বইন…পর যে পর, তার চাইতে পর সতীন। রাণীগো নাম আকুতি- কাকুতি- মিনতি। আহা, যার যেমন কান্দুনি মন, তেমন তার নাম। কানবো না আবার!
মাতোয়ারা হাওয়া দেয় খালপাড়ের এক হিজল গাছ থিকা পূববাড়ির বগলে আরেক রসুইন্যা গাছে- আওয়াজ হয় শোঁ শোঁ, য্যান কার বুক ভাঙনের শ্বাস, গাছের চৈতার বৌ পাখির কালনিদ্রা ভাঙে না। ‘আগো চৈতার বৌ লো, তর জাগন নাই লো? ডিমগুলা সাপে খাইলো!’ মামুদাবাদ মাদ্রাসার চুনকাম করা দেয়াল জুশনায় ঝলমলায়, য্যান আসমানের ফেরেশতা আন্ধারেও সই কইরা নামতে পারে। অত বাতাসে কে আন্ধারে ফর্সা মাঠখানে নাইম্যা জুশনার ভিতর বল খেলায়? কারা সেই খেলা দ্যাখে, বিবাদ লাগলে কারা জোকার দিয়া উঠে, অই অই অই কইরা?
কে যায় অন্ধকারে সিঁথির মতন শাদা হইয়া থাকা সুঁতি-আল দিয়া? ছপ ছপ কইরা পানিতে নামে কে? কে দেয় লগি দিয়া ঠেলা? কে নামলে পর খালের কালা পানি তারে ঘের দিয়া ছমছম করতে থাকে…এই পানিতে কে কারে জাগ দিছিল, কার পেটের নাড়ি ছেঁড়া ধন, কাগো বাড়ির পাট, কাগো কুঠির নীল? পুরান কয়লার মতন আন্ধারে চোখ সরু করে চায়া থাকতে থাকতে গুলচেয়ারা বেগমের চোখ সয়ে আসে…তবু উত্তর কি আর মেলে? গুনগুন কইরা গান গায় সে, ‘কত পানি-পান্তা পইড়া রইছে, খাইবার চাইয়া খাইলা না, খসম তুমি বাড়িত আইলা না!’ ইলেট্টিক গেলে নীলকুঠির কবেকার নীল ভিজানির তলভাঙা চাড়িগুলিতে আর কারো পেটের ধনের মতন কুন্ডলি পাকায়া শুইয়া থাকে পাগল। যে পাগল হইতে পায়, সে তারে পায়। যে পাগল হইতে পায় না, সে এই অন্ধকারে খালের ছমছম শুনতে বইয়া থাকে খালি। অন্ধকারে গিট্টু পাকাইন্যা সুতার মতন হাতের ডগায় আইস্যা লাগে এই মানবজনম, তার আকুতি- কাকুতি- মিনতি। কত সরল-সিধা হইতে পারতো তার বুনানি… কে তারে লইয়া খেলে এমন খ্যাপা বিলাইয়ের মতন?
৪.
গুলচেয়ারা বেগমের নাম আসলে গোল-চেহারা বেগম, কিন্তু কতজনকে আর সে ডেকে ডেকে বোঝাবে যে সে এইরকম ফাটা-চটা দেখতে ছিল না, একদিন পটে আঁকা বিবির মতন গোল মুখখান ছিল তার। এই যে আমোদী মসজিদের নাম লোকের মুখে এখন ‘হামদী’ মসজিদ হয়ে গেল, গ্রামের নাম ‘বাগ-এ-মুসা’ অথচ বদল হয়ে গেল ‘বাঘমুছা’তে— যেন ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে বাঘ সত্যি মোছা যায়, এই তো চোখের সামনে সব সজল পল্লী সিমেন্ট আর পেলাস্টিকের বডিস পরে বসে রইলো… তাদের মুখে আর কলমীফুলের কোমলাঙ্গী ছায়া ফোটে না, এতসব বদলের ভিতর নাম বদলায় কি না?
নীলকুঠির পাশ দিয়ে সে চপ্পলপায়ে প্রায় উড়ে যাচ্ছিল, পাগলে কেন এতদিন পরে কইলো, “বাদুড়ে পেচ্ছাপ করবো তর পুরির ঠোঙ্গায়!” সে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল নীলকুঠির স্যাঁতসেঁতে আন্ধারে, দেয়ালে দেয়ালে বাদশাহী কোটর, তাতে পাখির বাসা, ছাদখানা উলটো নাওয়ের মতন নোয়ানো জমিনের দিকে, কুঠির পেছনবাগে গরুছাগল পালে মন্টুর বাপ, ছাগলের নাদির গন্ধে ভুরভুরে আতাগাছটার ছায়ায় চুপ করে বসে আছে পাগল। পাগলের পাশে বসে গুলচেয়ারা বেগম, ঠোঙা বাড়িয়ে ধরে, “খাইবি তো খা!”
পাগলে কি আর খায়! সে বলে, “জিলাপির আসল নাম বিলাপী!”
-তয় জিলাপি খাবিনি?”
পাগল হাসিচাপা দুষ্টু চোখে চেয়ে থাকে, পাতলা পর্দাটানা আয়নার মতন চাউনি। গুলচেয়ারা বেগম শ্বাস ফেলে। এদিকে তার পেট মোচড়াচ্ছে ঠোঙার ভেতরের ডালপুরির গন্ধে। অত ক্ষুধার ভেতরেও তার মাথায় পাক দিয়ে ওঠে গান ‘খাইবার চাইয়া খাইলা না, খসম তুমি বাড়িত আইলা না!’
রাস্তা দিয়ে গান বাজাতে বাজাতে একখান রিকশা গেল- ‘আমার লাইন হইয়া যায় আঁকাবাঁকা, ভাল না হাতের লিখা’… লাইনঘাট ভুলে শহর এঁকেবেঁকে ঢুকে পড়ে গ্রামে, পলিথিন ঢুকে পড়ে জলকচুভরা পানাপুকুরে, সে তেমন করে ঢুকে পড়েছিল পুতুলনাচের দলে। হাতে মাইক্রোফোন ধরে শুরুতেই তারস্বরে গাইতো সে— ‘তুমি যে আমার কবিতা আমার বাঁশির রাগিনী’, সবরকম গান করবার পারতো আর নির্লজ্জ হেসে বলতো, “মাগার লেখাপড়া জানি না, চারুমাস্টারের ছাত্রী আমি!” কত কথাই না বলতো আব্দুল হালিম, “মাগার লেখাপড়া জানি না” শুনলেই ক্ষেপে উঠতো, বলতো, “কইতে পারস না মাগী, যে আমি শিল্পী! রাজাগো উপরে রাজা?”, আজ যে সে চুপ করে আছে। কামরূপ কামাখ্যার কলতানিপাড়াতে জাদু শিখেছিল আব্দুল হালিম– সাতটা বচ্ছর। তামাবিল বডার দিয়া যাইতে হয়, সেই রাজ্যের কথা আর কী কমু, ম্যায়ার রাজ্য, নেংটা ম্যায়া, কোমরে একখান পাতা পরে খালি। গায়ের রঙ কাঁচা হলুদ, তুলাপেটির মতন নরম, চুল লম্বা এমুন যে ঐ পাতাপুতা ঢাইক্যা যায়, মাগীগো স্বাস্থ্যর কথা আর কী কমু, কাপড় খারাপ হইবার মতন। পুরুষমানুষের জন্য পাগল তারা, পাগল বানায়াও ফ্যালায়। সাত বচ্ছর আমারে আসতে দেয় না, বুঝবার পারেন তাগো হাউশ? তারা আটজন কইরা থাকে একখান পাতার কুটিরে, মইষের খামার আছে তাগো, সেই মইষের দুদ আর মাংস খায়, গমের আডা দিয়া রুটি। খাওনের কষ্ট করি নাই। একধারে নীলকন্ঠ পাহাড়…আসলেই নীল কালারের পাহাড়, মইষ চরাইতাম, চরানি আর কী ছাইড়া দিয়া ছায়ায় বইসা থাকন, তা তারা তখনো ছাড়তো না আমারে, আরে আরে গাছতলায়ই শুরু কইরা দিত, দিনরাত কে বা এমনে খুশি করতে পারে ম্যায়ামানুষেরে। না পারতে করা, মন না ভরলে যদি গরুছাগল বানায় খুঁটায় বাইন্ধা রাখে? যাদুভেদ কইরা আর ফির্যা আসন লাগতো না আমার! এট্টু অবসর দিলে মইষের শিঙের কাঁকই দিয়া তাগো দীঘল চুলের জটা ছাড়ায়া দিতাম, সাত বচ্ছর আছিলাম সেইখানে। জাদুবিদ্যার অধিকারী হওন কি যে সে কথা।
জাদু শিখছিলাম যার ঠাঁই, তার নাম ভগবতী, কেশে এমনে হাড় বান্ধা, সাত বচ্ছরে ৯১৯টা যাদু শিখাইল আমার ওস্তাদে। মানুষরে বাধ্য করার তন্ত্র, বান মাইরা অসুস্থ করা, এমনি জাদু-কাগশরে ট্যাহা বানানি, তাসরে ফুল বানানি। আমার বাপেও ছিল যাদুকর, বাসায় বান্দর আছিল, সাপ-বেজি সবই আছিল, যারে যেই আজ্ঞা করতো সেই সেইটা শুনতো। বাড়িতে তদ্দিনে বন্যায় ঘর ডুইবা গেছে, মেরামত চলতাছে, আমার নামে কবেই গায়েবানা জানাজা পড়ায়া ফালাইছে আব্বায়। একদিন যহন বাড়িত ফির্যা আইলাম, তহন এমুন স্বাস্থ্য আর এমুন লম্বা চুল যে বাপে লাফ দিয়া উঠ্যা ভাবছে—আমি মনে হয় ডাকাইতের পো! যতই কই আমি যাদুশিল্পী আব্দুল হালিম, কেডায় শুনে আমার কথা! জন্মদাত্রী মায়ে আমার সামনে ঘোমডা টাইন্যা আইস্যা কয়, “উনারে ছাইড়া দেন গো, ভালমানুষের পুত আপনে!” শেষে মায়ে আমারে ত্যালমালিশ করতো এক গান গাইয়া- ‘এক মায়ের এক পুত আছিল, আব্দুল হালিম নাম রাখিল’ সেই গান গাইয়া শুনাইয়া বিশ্বাস করাইতে পাল্লাম আমি তাগো পোলা, সিনামার মতন না?
ডালপুরি চিবিয়ে ক্লান্ত হয়ে উঠছে গুলচেয়ারা বেগম, বাজারের মজফফর মিয়ার পোলা বাপের মতন হাত পায়নি, আগের কালে হলে আব্দুল হালিম খেঁকিয়ে উঠতো, “তুশোক কিন্যা আনছস রে মাগী! চাবায়া আর শেষ হয় না!” এখন সে কিছুই বলে না, হাত বাড়িয়ে খায় না সহজে, আজ তো তাও হাতে নিল, বুক দুলে উঠেছিল তার দুরাশায়, তারপর ডালপুরিটা দিয়ে রুমালের মতন বুলিয়ে মুখখান মুছলো পাগল, নগদ টাকার অপচয়ে খেপে উঠছিল সে, কিন্তু পাগলের সাথে খেপে কী লাভ, জিততে তো আর পারবে না। শুধু মাঝে মাঝে পাগলের মুখে ফুটে উঠবে নিবিড় স্বচ্ছতা, পৌষমাসের ভোরে পুকুর যেমন হয়ে থাকে, প্রথম হাতের ঢুলানি লাগবার আগে। অন্যান্য সময় একটা কালো রঙ গুলে রাখা আরশীর মতো হয়ে থাকে পাগলের চোখ, গুলচেয়ারা বেগম কত উঁকি দেয় সেই আরশীতে, কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না। দেশে দেশে ঘুরতো তারা, শিল্পীর জীবন, গেরস্তিতে বাঁধা পড়বে না ভেবেছিল তারা, শুধু ফাটার দিন আসলে স্নো এনে দিত আব্দুল হালিম, আর শিলপাটার মতো বুকে ফেলে মরিচপেষা করতো তাকে, কবেকার কথা? আরশীর দানো আব্দুল হালিমকে বেন্ধে ফেলার আগে যে জীবন, তা কেমন ছিল সেটা আর মনে পড়ে না তার…তবু ক্ষুব্ধ হাত পাগলের বাহুতে রেখে সে আকর্ষণ করে তার দিকে, “ল যাই, আমরা এই দ্যাশ ছাইড়া আমাগো দ্যাশে যাইগা!” পাগল শূন্য চোখে চেয়ে থাকে। সে মুক্তি পাবে না– জানে গুলচেয়ারা বেগম, তাদের জীবন বাঁধা পড়েছিল কোনো এক অঝোর ভাদ্রমাসে, তাদের মুক্তিও বাঁধা পড়ে আছে। গুলচেয়ারা বেগম মনে মনে একটা লাইনে সুর দিতে থাকে, লাইনটা সে নিজেই ভাবে প্রায়দিনই, তার নিজেরই লাইন- আমার সিলাইন্যা খেতায় তুমি কারে লইয়া ঘুম যাও।
আমবাগানের ঐধারে কারা যেন বেবিট্যাক্সিতে করে বেড়াতে এসেছে, “ঐ, কুলে আয়, তরে না ফাশশো টেহা দিছি হেইবার ঈদে!” অনিচ্ছুক শিশুকে কে যেন এইসব বলে জোর করে কোলে নিচ্ছে, আর সেই অত্যাচারে ঠা ঠা করে কেঁদে ফেটে পড়ছে শিশু। সেই আওয়াজে পাগল আনমনে হাসলো, গুলচেয়ারা বেগম আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো- “তর মনে আছে আব্দুল হালিম, পরী নামছিল আমাগো তাম্বুতে?”
৫.
সত্যি পরী নেমেছিল তাদের নিউ হাসিখুশি পুতুল থিয়েটারের তাঁবুতে, হাস্নাহেনার মতো রঙ গায়ে, রুপালি জোছনার মতো ডানা। পরীকে আকাশ থেকে পেড়ে এনেছিল টোটা আর মোতাহার, আজমত আর ধনমিয়া। এক মায়ের এক পোলারে খুন করে খালে ফেলে দিয়ে মেলায় এসেছিল টোটাবাহিনী, আর তার বোনকে তুলে এনেছিল। টোটার চেহারা দেখে কেউ আর টুঁ শব্দ করেনি, ঢুকেই হুকুম করেছে- “শো চালা! বাজনা চালা!” বেঁটেখাটো গুলচেয়ারা বেগম গলা খুলে গেয়েছে, ‘তুমি যে আমার কবিতাআআ’, তারপর শুরু হয়ে গেছে পুতুলদের ড্যান্স ধামাকা- দিল তো পাগল হ্যায়। আজা না ছুঁলে মেরি চুনরি সনম। তুলিতে আঁকা সিনারির সামনে বার্নিশচটা লাঠিপুতুলগুলোকে ঠুয়া মেরে মেরে চুমকির জামায় লহর তুলে তুলে নাচিয়ে গেছে আব্দুল হালিম, টিকেটের দায়িত্ব যার, সেই পুতুলমাস্টার, সেই যাদুশিল্পী, লাঠিপুতুলের খেলা দেখায়, হাতের তাসরে ফোয়ারার মতন উড়ায়, টুপির ভেতর থেকে বের করে আনে টকটকে লাল পেলাস্টিকের ফুলের গোছা। পেছনে ড্রাম বাজায় একজন, দ্রুম দ্রুম করে, সে ড্রাম বাজিয়েছে। এত জোরে যে অনেকদিন কানে তালা লেগে ছিল গুলচেয়ারা বেগমের। মেলার শেষদিন, বায়োস্কোপ আর কেউ দেখতে আসেনি, আশুতোষ মালাকার কাকুর শোলার ফুলমালিকা কেউ কেনে নাই। একখানা টিকেটও বিক্রি হয়নি পুতুল থিয়েটারের, পরী নিয়ে ঢুকেছে টোটাবাহিনী, তাই আর কেউ তাঁবুতে ঢুকতে পায়নি। বাইরে গ্রাম্য মেলায় নাগরদোলার টানা ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজের মতন শীৎকারে না ব্যথার চিৎকারে না আকাশ থেকে পরী পড়ে গিয়ে ভেঙে যাওয়ার চৌচির আওয়াজে কেউ আর কিছু আলাদা করে কানে শুনতে পায়নি। যেন আবহসঙ্গীত বাজিয়ে গেছে তারা তিনজন, সিনামার মতন না?
সেই ভাঙা পুতুল ভাঙা পরীকে রেখে পরে টোটাবাহিনী পালিয়ে গেছিল। কিন্তু গনধর্ষণের নেপথ্যে ‘দেড়ব্যাটারি’ পুতুলের মুখে চুটকি শুনিয়েছে শিল্পী আব্দুল হালিম, চাষাপুতুল হয়ে ঘরণীপুতুলের মান ভাঙিয়েছে, সে কোথায় পালাবে! তার মুক্তি কোথায়? অচেতন পরী কাঁধে করে ইউএনএফপিও পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল সে, ব্যাটাছেলে না ম্যায়ামানুষ কেডা তার পরীরে পরীক্ষা করলো তাই জানবার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। পুলিশ টোটাবাহিনীর কী করবে! অতএব পুলিশের প্রথম হাড়ভাঙানি মারও খেয়েছিল সে। তারপর একদিন এসে বসেছে আতাগাছটার তলায়, হেস্টিংসের জমানার নীলকুঠির বারান্দায়। কথা বলেনি, যাদু দেখায়নি আর, কিন্তু চলেও যায়নি। পাগল জানে না, পরীর জন্য রেখে দেয়া দুধমাখা ভাত কাকে এসে খেয়ে গেল…ক্ষীর শুকিয়ে কাঁই হয়ে গেল আদরের পাতে, যত ঘরে পরীর ঠাঁই ছিল সবক’টা ঘর থেকে সে কেমন করে বিতাড়িত হলো। কিছুই জানে না।
তবু পাগল আর কোথাও যায় না- সে না শিল্পী? বার্নিশচটা পুতুলে ফের রঙ দেয়? লেস সেলাই করে দেয় প্রিন্টের কাপড়ের ঘাগরায়, স্পঞ্জে মুড়িয়ে দেয় ছেঁড়া বুক আর ভাঙা ডানা জোড়া দেয়? গুলচেয়ারা বেগম কত হাত ধরে টানে, বলে ‘ল যাই’- সে যায় না, আলো চলে যাওয়া অন্ধকার পথে রিকশা চলে যায় ঝরঝর করে, অন্ধকারে আন্দাজে হাত বাড়িয়ে নতুন বৌয়ের হাত খুঁজে নিতে নিতে রাস্তার ওপারে চলে যায় মোতাহারের বাড়ির ভাড়াটে… ছোটকালে পাগল শিখেছিল সব কিচ্ছার শেষ বিয়েতে, সব দানো শায়েস্তা হয়, সেটা শুধু তার মনে আছে। হাস্নাহেনারঙ সেই পরীকে বিয়ে করবে সে, তারপর তারা সুখেশান্তিতে বসবাস করতে থাকবে। এখনো তাই বিবাহপ্রস্তাব ভোলে না পাগল, পাড়াগাঁয়ের ধূসর কুয়াশা কাঁপিয়ে পরীর মাকে ডাকে, দিবানি, ম্যায়ার বিয়া দিবানি!” ডানা-ভাঙা পরী উড়ে গেছে আরেক জেলায়, ম্যাট্রিকপরীক্ষা দিয়েছে, কলেজ পাশ দিয়েছে, আর কী কী করেছে কে জানে, কে তার খবর রাখে! ঐ যে মা কয়, মাইয়া জন্মেই নাই…সেটাই একসময় সত্য হয়ে যায়, খানা তল্লাশি করে আর কে দেখবে সে ছিল কি ছিল না! তার সই দিলারা চলে গেছে শ্বশুরবাড়ি, শ্যালো মেশিনের পানির শাদা ফোয়ারায় আর তারা কোনো দিন আকাশের নীচে গোসল করবে না। যারা চলে যায় তারা লুকিয়ে মাঝে মাঝে আসে, সেই আসাটা ‘প্রত্যাবর্তন’এর মতো চওড়া শব্দ নয়।
জন্ম ৮ই ডিসেম্বর, ১৯৭৬, ঢাকার বাসাবোতে। শৈশব কেটেছে বাসাবো কদমতলার অলিগলিতে খেলে বেড়িয়ে।
প্রথম পাঠ মায়ের কাছে, এরপর স্কুল। মূলতঃ নানার উৎসাহে লেখালেখির এবং আঁকাআঁকির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, দেয়ালপত্রিকা- সাহিত্য সাময়িকী এইসব করে ঝালাই করা কেবল।
স্কুল ও কলেজ যথাক্রমে হলিক্রস গার্লস স্কুল ও কলেজ। স্নাতক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদ থেকে। স্নাতকোত্তর যুক্তরাজ্যে।
প্রথম প্রকাশিত ছোটগল্প- ‘কবিতাযাপন’, প্রকাশিত গ্রন্থ- ‘কনফেশন বক্সের ভিতর। অটাম-দিনের গান’ (২০১০), ‘ভরযুবতী, বেড়াল ও বাকিরা’ (২০১১), ‘অলস দিন-খয়েরিপাতা-বাওকুড়ানি’ (২০১২), লুনা রুশদীর সাথে সম্মিলিতভাবে ‘আনবাড়ি’ (২০১৪)।