| 28 মার্চ 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

অর্কিড

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comহোটেলের সামনে এসে দাঁড়াতেই মন ভাল হয়ে গেলো সৌমিকের। ছোট ছোট কতগুলো পাহাড় ঠিক তার মাঝখানে উজ্জ্বল ব্রাউন রঙের হোটেল। জানালার কাঁচগুলো টারকুইশ ব্লু রঙের। একটুও সময় নষ্ট না করে স্প্রিংহিল ইনের লবিতে ঢুকে পড়লো সৌমিক। লবি থেকেই সে আঁচ করে নিলো হোটেলের ইন্টেরিয়র। পিচ রঙের দেয়াল আর ডার্ক মেরুন রঙের আসবাবগুলো সৌমিকের ভেতরের উচ্ছলতা আরোও বাড়িয়ে দিল। সে প্রায় দৌড়ে পৌছে গেলো রিসেপশনের কাছে। চেকইন করে ফেললো খুব দ্রুত।

অফিশিয়ালি উইন্টার বিদায় না নিলেও তাপমাত্রা দেখে এই সময়টাকে স্প্রিং বলে চালিয়ে দেওয়া যায় নির্দ্বিধায়। আর এ কারণেই বোধহয় হোটেলে ট্যুরিস্টের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। সৌমিক লবিতে একে ওকে সৌজন্য দেখিয়ে হাই হ্যালো করার ফাঁকেই ন্যান্সি চলে এসেছে হোটেলের ঘরে।জানালার দুই শেডের পর্দা দু’পাশে সরাতেই প্রায় ন্যাড়া পাহাড়গুলোয় চোখ আটকে যায় ন্যান্সির।
‘আমরা বীচের পাশে হোটেল কেন বুক করলাম না?’ হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া প্রশ্নটি ঘরে ঢুকেই লুফে নিলো সৌমিক। উত্তর দিলো, ‘খোরগোশের মতো আদুরে ওই পাহাড়গুলো দেখবো বলে।’ ন্যান্সি ঘুরে একবার সৌমিককে দেখে নিয়েই নিভৃতে একটা দীর্ঘশ্বাস লুকালো। ন্যান্সি অরল্যান্স আর সৌমিক ডি কস্তা।

ইকুয়েডরের ন্যান্সি আমেরিকায় ইমিগ্রেন্ট হয়েছে ডাক্তার ভাইয়ের সুত্রে। বছর ছয়েক আগে। স্প্যানিশ ন্যান্সি শুরুতেই বুঝে নিয়েছিলো এদেশের জন্য তাকে নতুন করে তৈরী হতে হবে। নিজ দেশের হাইস্কুলের শিক্ষক ন্যান্সি সার্টিফিকেট ইভ্যালুয়েট করে যতই মার্কিনীদের সমকক্ষ হয়ে উঠুক কিন্তু ইংরেজি ভাষার অদক্ষতা তাকে পেছনের সারিতে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছিলো বারবার।

তাই ন্যান্সি শুরু করলো একটি কলেজে সান্ধ্যকালীন ইংরেজি শেখার কোর্স।সেখানেই পরিচয় সৌমিকের সাথে। স্প্যানিশ আর ইংরেজি ভাষার প্রচন্ড দক্ষ সৌমিক আদতে একজন বাংলাদেশী ইমিগ্রেন্ট, তা বুঝতে বেশ কিছুদিন লেগে গিয়েছিলো ন্যান্সির।
‘হাউ ডিড ইউ কেইম ইন আমেরিকা?’ প্রশ্নটির উত্তরে সৌমিকের বলা ইংরেজী কথাগুলোর বাংলা এরকম দাঁড়ায়, ‘আমার বাবা এদেশে আসে ১৯৯০ সালে। সে সময় আমি খুব ছোট ছিলাম। এর প্রায় বছর দশেক পর তিনি আমাকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। হ্যাঁ, আমাকে একাই তিনি নিয়ে আসেন। কারণ এখানে তখন তাঁর নতুন পরিবার হয়েছে, নতুন স্ত্রী আর এক ছেলে সন্তানের।’
‘তোমার মায়ের কী হলো এরপর?’ ‘শুরুতে সে কিছুই জানতো না। তবে কিছুদিন যাবার পর আমি তাকে সব জানিয়েছিলাম।’
এরপর…?
‘তিনি একজন অসাধারণ মহিলা। খুব শান্ত, খুব ব্যক্তিত্বময়ী। পুরো ব্যাপারটাই তিনি খুব সহজভাবে নেন। আর এরপর তো তিনি জীবনটাকে এগিয়েও নিয়েছেন। তারও এখন একটি নতুন পরিবার হয়েছে।’ এই কথাগুলো বলতে বলতে সৌমিকের চেহারার রঙ একবারও পালটায় না। না, পালটায় অভিব্যক্তি। এরপর ছেলেটিকে ঠিক কী বলা উচিত তা কারোরই বোধগম্য হয় না। তবে ন্যান্সি প্রথম পরিচয়ে এই প্রশ্নগুলোর সাথে আরোও একটি প্রশ্ন করেছিলো,
-‘হাউ ইজ ইউর স্প্যানিশ ল্যাঙ্গুয়েজ সো গুড? ‘এ কথার উত্তরে সৌমিক হাসতে হাসতে বলেছিলো,
-‘আমার নতুন মা একজন ম্যাক্সিকান স্প্যানিশ।’
শুধু ভাষাতেই নয় সৌমিকের খাবার বা অভ্যাসেও ছিল নতুন মায়ের প্রভাব। আর এজন্যই বোধহয় ন্যান্সি খুব তাড়াতাড়ি সৌমিকের বন্ধু হয়ে উঠেছিলো।চিকেন তামালেস, ভ্যালেন্টানো আর রিফাজো-তে দু’জনার সমান আগ্রহ ওদেরকে একসাথে সময় কাটানোর সুযোগ করে দিলো। আর একদিন এই আগ্রহ খাবার ছাপিয়ে দুজনায় গিয়ে সীমাবদ্ধ হলো বিনা নোটিশে।

যুগ্ম জীবনের পরিকল্পনায় মেতে উঠলো দু’জন। বিয়ের আড়ম্বরতা নিয়ে সৌমিকের তেমন কোনো আগ্রহ না থাকলেও ন্যান্সির ছিল। আর সেই আড়ম্বরের নাম সাদা ভেইল, ব্রাইডাল মেইড, একগুচ্ছ সাদা গোলাপ আর চার্চ। শেষের এই শব্দটিতেই দু’জনের অমিল প্রথম সামনে এলো। ‘জানি না কেন আমরা সবাই চার্চ নিয়ে এত অবশেসড?’

প্রশ্নটির উত্তরে ন্যান্সি একটু থমকেছিল। এরপর গ্রীবা উঁচু করে তীক্ষ্ম কয়েকটি শব্দ ছুড়ে দিয়েছিলো সৌমিকের দিকে। ‘কারণ আমরা সবাই ঈশ্বরের সন্তান। আর চার্চ এমন জায়গা যেখানে আমি ঈশ্বরকে খুব কাছে অনুভব করতে পারি।’ ন্যান্সির তীক্ষ্ম নাকের ডগায় আলগোছে আঙুল বুলিয়ে সৌমিক রণে ভঙ্গ দিয়েছিলো। বলে, ‘ওকে ডিয়ার, চার্চ থেকে বিয়ের তারিখ নাও।’

ওদেরকে অবাক করে দিয়ে উইন্টারের মধ্যভাগেই চার্চ নির্ধারণ করে দিলো বিয়ের তারিখ। ম্যানহাটনের ফিফথ এভিনিউ থেকে কেনা সাদা গাউন, লম্বা ভেইল, সাদা একগুচ্ছ গোলাপ আর কয়েকজন ব্রাইডাল মেইড। হয়ে গেলো ন্যান্সি আর সৌমিকের আড়ম্বরপূর্ণ বিয়ে। তবে সে বিয়েতে সৌমিকের পরিবারের ঠান্ডা উপস্থিতি আরেকবার প্রমাণ করে দেয়, অনেকগুলো পরিবার থাকা সত্ত্বেও এই ছেলেটি আদতে পরিবারহীন। তবে সেই বিয়েতে একটি জিনিষ আড়ম্বড়তা একটু হলেও বাড়িয়ে দেয়। সেটি হলো, যাজকের দেওয়া একটি উপহার।একটি রথসচাইল্ড’স স্লিপার অর্কিড প্ল্যান্ট। যাজক মৃদু ঝুঁকে অর্কিডটি ন্যান্সিকে দিতে গিয়ে বলছিলেন,

এই অর্কিডের বাহুর মতো বিস্তারিত পাপড়িগুলো ন্যান্সি আর সৌমিকের জীবনে সকল শুভক্ষণ বয়ে আনবে। শুভ বার্তার বহক হবে এই রথসচাইল্ড’স অর্কিড। গাছটি ন্যান্সির হাতে দিয়ে যাজক বলেছিলেন, যত্ন নিও এটার জীবনের মতো। আর ডান হাত বাড়িয়ে সে উপহার নিতে গিয়ে ন্যান্সি পেয়েছিলো একটা শীতল হাতের অদ্ভুত ছোঁয়া। ব্যাস! আড়ম্বরপূর্ণ বিয়ের এতটুকুই ছিল ন্যান্সির পরিকল্পনা মাফিক। এরপর সবটুকুর দায়িত্ব ছিল সৌমিকের। রিসেপশন নয়, ওরা যাবে পাহাড় দেখতে। খোরগোশের মতো ছোট ছোট পাহাড়।

এই পরিকল্পনা পুরোটাই সৌমিকের। আর ঠিক সে কারণেই আজ ওরা এই হোটেলে। ‘কোথায় খোরগোশের মতো পাহাড়?’ অর্কিড গাছটি হোটেল রুমের জানালার পাশে রাখতে রাখতে প্রশ্ন করলো ন্যান্সি। সৌমিক প্রায় দৌড়ে চলে এলো ন্যান্সির কাছে। এরপর ওর ঘাড়ের উপর দিয়ে একটা হাত ছড়িয়ে জানালার বাইরে নির্দেশ করে বললো,
-‘ওই যে, ধুসর রঙের পাহাড়টা। দেখতে পাচ্ছো? ভাল করে দেখো, ওটা একটা আদুরে খোরগোশ।’ সৌমিক কে দমাতে চাইলো না ন্যান্সি। শুধু কন্ঠে আহ্লাদ ঢেলে বললো,
-‘ইউ আর সাচ এ্যা চাইল্ড।’
সৌমিক যেন অপেক্ষাতেই ছিল।
‘হু, হু, ঈশ্বরের বেয়াড়া সন্তান!’ ন্যান্সি আর কথা বাড়াতে চাইলো না।

এমনিতেই বিয়ের পর ঘুরতে আসার এই জায়গাটা ওকে বলতে গেলে হতাশই করেছে। এরপর সৌমিকের এই হেঁয়ালী কথা পাত্তা দিয়ে হানিমুন মাটি করতে চাইলো না।
হানিমুনের জায়গাটা নিয়ে মনে একটা ছবি এঁকে রেখেছিলো ন্যান্সি।
ছবিটা এরকম…!
একটি ডিল্যাক্স সুট। যার জানালার সামনেই নীল-সবুজ সমুদ্র। নোনা বাতাসে অনবরত উড়তে থাকবে মিল্ক হোয়াইট সিল্কের কার্টেন। কিন্তু এখানে কোথায় সমুদ্র? ওকে দেখতে হবে কিছু ন্যাড়া পাহাড়। মন এমনিতেই ধুসর হয়ে আছে ওর। কিন্তু সেই ধুসরতা খুব বেশী সময় ঘিরে রাখতে পারলো না ন্যান্সিকে।
-‘লেটস স্ট্যা টুগেদার…’ গুনগুন করতে করতে সৌমিক ঠিক ন্যান্সির পেছনে এসে দাঁড়ালো আচমকা। এরপর মুখটা ওর কানের কাছে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘আজকের দিনটি তোমার জন্য আমার উপহার। তৈরী হয়ে নাও। বাইরে যাবো।’

ন্যান্সি ঘুরে মুখোমুখি হলো সৌমিকের। সেই চিরপরিচিত অন্তর্ভেদী দৃষ্টি সৌমিকের।
পরিচয়ের অল্প কিছুদিন পরেই ন্যান্সি এই দৃষ্টির অর্থ বুঝে ফেলেছিলো। নিজের সকল মানুষগুলোর অযত্নে একলা হয়ে যাওয়া এই ছেলেটি একান্ত আপনজন খুঁজে পেয়েছে। আর এই বুঝতে পারাটুকু ন্যান্সিকে অদ্ভুত অহংকারী করে তোলে সব সময়। নিজেকে মূল্যবান মনে হয়।

ন্যান্সি আপাতত সেই দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যায় ব্যবহার্য জিনিসপত্রে ভরা সুটকেসের থেকে। সেখান থেকে শুধু বের হয়েছে অর্কিডটি।
‘আমরা কতটা লম্বা জার্নি করে এসেছি নিউইয়র্ক থেকে। এখনই বের হবো? ইনফ্যাক্ট আমি ভাবছি ঘরে বসে বসে ওই খরগোশগুলো দেখলে কেমন হয়?’ ন্যান্সির কন্ঠে রসিকতাটুকু হজম করে সৌমিক বলে ওঠে,
-‘আমি ভাবছিলাম আর একটু সময় আজ পেলে ভাল হতো। ছোট পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে যে নীল সমুদ্রটা দেখা যায়, তা বোধহয় আজ মিস হয়ে যাবে!’
সমুদ্রের কথা শুনে ন্যান্সি প্রায় লাফিয়ে ওঠে। তুমুল উৎসাহে শেষ হয়ে আসা বেলার সবটুকু ব্যবহার করতে ঝটপট তৈরী হয়ে নেয়। সৌমিক আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সন্ধ্যা ন্যান্সিকে উপহার দিতে চায়।

মধ্য শীতেই এবার আবহাওয়া চমৎকার হয়ে উঠেছে। স্নো বা হিমশীতল হাওয়া দুটোই এবার কম। আর আজ তো এই সময়ের রেকর্ড টেম্পারেচার। দিন তারিখের হিসেব না রাখলে আজকের দিনকে বসন্ত বলা যায় অবলীলায়। হোটেলের রুমের জানালা দিয়ে পাহাড়গুলোকে যতটা কাছে মনে হয়েছে আদতে তা নয়। ড্রাইভ করে সেখানে পৌঁছাতে প্রায় মিনিট পনেরো লেগে গেলো।সূর্যের আলো ক্রমশ হলদে রঙ ছেড়ে দৌপ্রদীর মতো অনন্ত লাল আঁচল বিছিয়ে যাচ্ছে। সৌমিক দেরী করতে চাইলো না মোটেও।
-‘চলো, এবার খরগোশগুলোকে আলিঙ্গন করি।’ একথা বলেই ন্যান্সির হাত ধরে খুব আলগোছে উঠতে লাগলো পাহাড় বেয়ে। পাহাড়গুলোকে দূর থেকে যতটা ন্যাড়া মনে হয় আসলে তা নয়। খাঁজে খাঁজে অল্প অল্প শ্যাওলা সবুজ। সেই সবুজ আগলে আগলে সৌমিক পৌঁছে যায় ন্যান্সিকে নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায়। সেখানে ছোট্ট একটা রেস্টুরেন্ট।

কাঁচের তৈরী রেস্টুরেন্টের সি ভিউ টেবিলে লেখা ওদের দু’জনের নাম। আর বড় একটি ফুলদানিতে রাখা ন্যান্সির প্রিয় সাদা গোলাপ। সেখানে বসতে গিয়েই ন্যান্সি লক্ষ্য করলো জানালায় মিল্ক হোয়াইট সিল্কের কার্টন।সূর্যের প্রায় শেষ হয়ে আসা লাল আলোটুকু পর্দাগুলোকে রহস্যময় করে তুলেছে। ন্যান্সির চেহারায় মুগ্ধতা পুরোপুরি পড়তে পারছে সৌমিক।
-‘বলেছিলাম তো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সন্ধ্যাটা আজ তোমাকে উপহার দেবো।’ কথাটুকু শেষ করেই সৌমিক নিজের একটি আঙুল সামনে এগিয়ে নির্দেশ করলো একটি জায়গা।
-‘ওদিকটায় দেখো।’
ন্যান্সি ঘাড় ঘুড়িয়ে সেদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
-‘থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ সৌমিক। তে আমো,’
অতিরিক্ত আবেগী হয়ে উঠলেই সৌমিককে স্প্যানিশ ভাষায় ‘ভালোবাসি’ বলে ন্যান্সি।ওপাশটায় তখন নীল সমুদ্রের ছোট ছোট ঢেউ নির্জনতায় আছড়ে পড়ছে। সেদিকে দেখতে দেখতেই ন্যান্সির অজান্তে পাহাড়ের উপরে ছড়িয়ে পড়লো পিচ রঙের আভা। সেই রঙ কাঁচের দেয়াল টপকে জায়গা করে নিলে ন্যান্সির চোখেমুখে। ন্যান্সিকে এখন রাজকুমারীর মতো লাগছে সৌমিকের। ঠিক তখনই মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা করে ফেললো সৌমিক। আজ পৃথিবীর সকল অসুন্দর তার নিজের জন্য জমা রেখে শুধু সুন্দরটুকু উপহার দেবে ন্যান্সিকে।

‘আজ আমরা সারাসন্ধ্যা এভাবেই সমুদ্র দেখবো।’সৌমিকের এই কথায় দুষ্টুমি খেলে যায় ন্যান্সির মাথায়। ‘আমি তো নিশ্চিত ছিলাম সারারাত আমরা সমুদ্র দেখবো।’ ন্যান্সি যেন আলগোছে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলো সৌমিককে। সৌমিকও তা লুফে নিয়ে বললো,
-‘তাই হবে।’
পৃথিবীর সকল সুন্দরের জন্য সে অঙ্গিকারবদ্ধ ন্যান্সির কাছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে নীলজলে চাঁদের আলো পড়তেই সৌমিক লবস্টারের খোসা থেকে মাংস ছাড়ানো শুরু করলো। খুব আলগোছে বললো,
-‘তোমার জন্য আরেকটি জিনিস আছে।’
কাঁটাচামচে এক টুকরো লবস্টারের মাংস জড়িয়ে ন্যান্সি প্রশ্নবোধক চোখে তাকালো সৌমিকের দিকে।
-‘আরোও?’
উত্তরে একটি সাদা খাম তুলে ধরলো ন্যান্সির সামনে সৌমিক। অফার লেটার, কলোম্বিয়া ইউনিভার্সিটি একাডেমিক এডমিনিস্ট্রেটর-এর জন্য। পেছনে সমুদ্রকে ফেলে ন্যান্সি প্রায় ছিটকে চলে এলো সৌমিকের খুব কাছে।
-‘অভিনন্দন! আমি জানতাম অর্কিড গাছটি খুব তাড়াতাড়িই আমাদের আনন্দের একটি খবর দেবে। চার্চের যাজক এমনই বলেছিলেন।’ আপাতত ন্যান্সির এই সরল বিশ্বাসটুকু হেসে দূরে ঠেলে দিয়ে সৌমিক শুধু বললো,
-‘তুমি আমার জন্য শুভ।’
তবে সৌমিক তখনো জানতো না, এই আপাত নিরীহ বিশ্বাস ওদের জীবনে ঠিক কী ভূমিকা রাখতে চলেছে।

সেদিন হোটেল রুমে ফিরেই ন্যান্সি বসে গেলো অর্কিড গাছের যত্নে। ভেজা টিস্যু দিয়ে গাছের পাতা মোছে। অদেখা ধুলোর আশংকায় বারবার টবে হাত বুলায়। সৌমিক এসব ন্যান্সির সরলতা ভেবে মুচকি হাসে।এরপরের কয়েকটি দিন ওদের স্বপ্নের মতো কেটে গেলো। ছোট্ট সে শহর থেকে ফিরে এসেই সৌমিক জয়েন করলো নতুন চাকরিতে। এতদিন বিভিন্ন কলেজে পার্টটাইম জব করতো সৌমিক। তাই এই চাকরীটা খুব প্রত্যাশিত ছিল ওর। ন্যান্সি ফিরলো ওর পুরাতন চাকরিতেই। একটি পোশাক কোম্পানির প্রোডাক্ট এক্সিকিউটিভ হিসেবে। সপ্তাহের পাঁচদিন চাকরী, একদিন গ্রোসারী, একদিন চার্চের জন্য বরাদ্দ। তবে চার্চের সময়টুকু ন্যান্সির একার। কারণ সৌমিক সে সময়টা পাশের স্টারবাক্স কফিশপে ব্লন্ড স্মোকড বাটারস্কচে গলা ভেজানোই বেশী উপভোগ করে। এ নিয়ে ন্যান্সির অবশ্য কোনো আপত্তি নেই। না আছে আক্ষেপ। তবে আক্ষেপ আছে একটা ব্যাপার নিয়ে। অর্কিড গাছটির প্রতি সৌমিকের অবহেলা, এটা ওকে মাঝেমাঝে খুব অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। উপহারটি ওদের দু’জনের। অর্কিড গাছটি তো সাধারণ নয়!শুভ বার্তাও বয়ে এনেছে ওদের জন্য। প্রায়ই ন্যান্সি আশংকিত হয়, সৌমিকের এই অবহেলা না কোনো অশুভ বার্তা নিয়ে আসে!
এই আশংকায় সে গাছটির প্রতি যত্ন দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। একটা সন্ধ্যাও এমন হয় না যে সৌমিক অফিস থেকে ফিরে ন্যান্সিকে গাছটির যত্ন থেকে বিরত থাকতে দেখে।

তবে হঠাৎই এক সন্ধ্যায় এর ব্যত্যয় ঘটলো।সেদিন অফিস থেকে ফিরে সৌমিক অবাক হয়ে গেলো লিভিং রুমে একগুচ্ছ অন্ধকার দেখে। লিভিং রুমের জানালা দিয়ে স্ট্রিট লাইটের যতটুকু আলো ভেতরে আসছে তা সেই গভীর আঁধারে হাবুডুবু খেয়ে তলিয়ে যাচ্ছে। আর জানালার পাশে রাখা অর্কিড গাছটি অন্ধকার গায়ে মেখে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে। ঘাবড়ে যায় সৌমিক।
-‘ক্যুরেডা ( ডার্লিং)’
খুব নীচুস্বরে ডাকে সৌমিক।
ডাকটি অন্ধকারে ভেসে বেড়ায় কিছুক্ষণ।এরপর বিপর্যস্ত নির্জনতায় ধাক্কা খেয়ে হারিয়ে যায় খুব দ্রুত। বিপন্ন হয়ে ওঠে সৌমিক। অন্ধকার লিভিং রুম পেছনে ফেলে লবি ধরে এগিয়ে যেতে থাকে বেডরুমের দিকে। তখনি স্টাডিরুম থেকে ভেসে আসা মৃদূ একটি শব্দ সৌমিককে পথ দেখায়। নিয়ে যায় সে ঘরে। দুই বেডরুমের এই এপার্টম্যান্টটি একটি ছোট্ট উত্তরমুখী স্টাডি রুম দিয়েই বাজিমাত করেছে। নিউইয়র্ক শহরে সচরাচর এমন পাওয়া যায় না। তাই তুষার ঝরা দিনে ব্রোকার যখন এই এপার্টম্যান্ট দেখালো তখন স্টাডিরুমের উত্তরের জানালাটা ওদেরকে নির্দ্বিধায় রাজি করিয়ে নিলো। স্টাডিরুমের দরজা হালকা ভেজানো ছিলো। সৌমিকের হাতের হালকা স্পর্শেই পুরোটা খুলে গেলো। রুমের ভেতরের ছবিটুকু সৌমিকের দমবন্ধ করে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল। বুকশেলফ আর ডিভানের মাঝখানের ছোট্ট জায়গাটায় হাটু ভাঁজ করে পড়ে আছে ন্যান্সি। সৌমিক হাতড়ে হাতড়ে হারিয়ে ফেলা সাহসটুকু কুড়িয়ে জড়ো করে। এরপর পা বাড়ায় ন্যান্সির দিকে। না, নিথর নয়। ঘন ঘন শ্বাসের সাথে শরীরটা কুঁকড়ে যাচ্ছে একটু পরপর। আর সাথে খুব মৃদূস্বরে গোঙানি।

সৌমিক বুঝে নিলো যা বোঝার। স্টাডিরুমের ক্লোজেটেই ছিল ন্যান্সির ইনহেলার কয়েক পাফ স্প্রে করলো প্রায় অচেতন হয়ে আসা ন্যান্সির মুখে। ন্যান্সির এ্যাজমা আছে এটা জানতো সৌমিক কিন্তু সিভিয়ার এ্যাটাক আজই প্রথম দেখলো সে। সব সুন্দরের জন্য অঙ্গিকারবদ্ধ সৌমিক তখনো জানে না অসুন্দর এক শীতল সময় ওদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে খুব নিঃশব্দে।

সেদিন সন্ধ্যার পর কিছু সময়ের জন্য ধাতস্থ হলো ন্যান্সি। কিন্তু অসুস্থতা আরোও বেশী করে আঁকড়ে ধরলো ন্যান্সিকে মধ্যরাতের পর। প্রচন্ড জ্বরের সাথে শুরু হলো কাঁপুনি। সেই অদ্ভুত জ্বরের সঙ্গী হয়ে এলো প্রবল দূর্বলতা আর ঘন ঘন এ্যাজমা এ্যাটাক। ক’দিনের অসুস্থতায় ন্যান্সি মোটামুটি শয্যাশায়ী হয়ে পড়লো।

বাড়িটিও নিস্তেজ হয়ে পড়লো ন্যান্সির সাথে। তবে শুধু এ বাড়িই নয়, শহরজুড়েই এই জ্বর এনে দিল এক অদ্ভুত নীরবতা।পৃথিবীর সবচেয়ে উজ্জ্বল আলোর এই শহরজুড়ে নেমে এলো মহামারীর অন্ধকার। সময়কে নিজের জিম্মায় রেখে ছুটে চলা মানুষগুলো অথর্ব হয়ে গেলো অসুস্থ সময়ের চোখ রাঙ্গানিতে।
-‘কী হলো আমার?’
ক্ষীণস্বরে ন্যান্সির এই প্রশ্ন সৌমিককে ভেতর থেকে ভেঙে দেয়। তবুও কিছু উচ্ছলতা মিশিয়ে বলে,
-‘কিছু না। এটা হচ্ছে বিরতি, কর্মবিরতি। সবাইকেই লম্বা সময়ের কাজের পর বিরতিতে যেতে হয়।’ খুসখুস করে কাশতে কাশতে ন্যান্সি পালটা প্রশ্ন ছোড়ে,
-‘এই বিরতি সাময়িক নাকি স্থায়ী’ এই প্রশ্নে সৌমিক থমকে যায়। বিবশ হয়ে যায়। তবুও মনযোগ অন্যদিকে নিতে গল্প ফাঁদে বসন্তের। ‘এবার কিন্তু বসন্ত খুব তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। স্প্রিং ব্লুমিং শুরু হয়ে গেছে।’ এই কথাতে ন্যান্সি কি খুঁজে পায় বোঝা যায়না। তবে হঠাতই ওর চেহারায় একটা আলো ঝলমল করে ওঠে।
-‘আমাকে লিভিং রুমে নিয়ে চলো। আমি অর্কিডের ফুল দেখবো। রথসচাইল্ড অর্কিডের ফুল সৌভাগ্য বয়ে নিয়ে আসে।’
-‘অর্কিডের ফুল?’
-‘হ্যাঁ, এতদিনে নিশ্চয় ফুটে গেছে। আমি যেদিন অসুস্থ হলাম সেদিন একটা কলি দেখেছিলাম।’অর্কিডের ফুল দেখবে এই আনন্দ ন্যান্সিকে কোথা থেকে যেন অদ্ভুত শক্তি এনে দিলো। সৌমিকের হাত ধরে বেশ দ্রুতই পৌছে গেল লিভিং রুমে। গিয়ে দাঁড়ালো জানালার পাশে। যেখানে অর্কিড গাছটি থাকে। সেখানে দাঁড়াতেই ন্যান্সির চেহারা থেকে মুছে গেলো আলো। চরম অবিশ্বাস নিয়ে তাকালো সৌমিকের দিকে।সৌমিক বিব্রত হয়। ন্যান্সির চোখে আসা প্রশ্ন থেকে নিজেকে আড়াল করতে চায়।
-‘তুমি জানতে এই অর্কিড সাধারণ নয়। যাজক বলেছিলেন, এটা সৌভাগ্য বয়ে আনবে।’
-‘আমি সরি। আর শোনো এগুলো কুসংস্কার। এবার এই অর্কিডের কথা ভেবে শরীর খারাপ করো না প্লিজ।’ সৌমিকের কথায় আচমকাই উত্তেজিত হয়ে ওঠে ন্যান্সি। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
-‘আমার অসুস্থতার জন্য দায়ী এই আধমরা অর্কিড। এটা ঈশ্বরের উপহার। তুমি এটার অযত্ন করেছো। তাই আমার অসুস্থতার দায় তোমারো কিছু কম নয়।’ সৌমিক এটার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তবুও ন্যান্সির এই মিথ্যে অপবাদটুকু হজম করে নীরবে। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলে,
-‘তুমি সুস্থ হয়ে যাবে। ডাক্তার বলেছে। তুমি চিকিৎসায় ভাল রেসপন্স করছো।’
-‘চিকিৎসা নয়, অর্কিড গাছটার যত্ন নাও। সতেজ করে তোলো। আমি সুস্থ হয়ে যাব।’ এই ন্যান্সি সৌমিকের অচেনা। এই অসুন্দর সময় সৌমিকের অচেনা। তবুও অসুন্দর সময় ন্যান্সির জীবন থেকে সরিয়ে দেবার প্রচেষ্টায় সৌমিকের কমতি নেই। সে ন্যান্সির কাছে পণ করে, রথচাইল্ডস অর্কিডে ফুল ফুটবে। সেদিনের পর সত্যি সত্যিই সৌমিক যত্ন নিতে শুরু করে অর্কিড গাছটির। গাছের গোড়ায় নতুন মাটি দেয়, ঘরের টেম্পারেচার ঠিক রাখে গাছের কথা ভেবে, দক্ষিণ জানালার পাশে রাখে আলোর জন্য, অল্প অল্প জল দেয়, সার দেয়, মরে যাওয়া কলি ছেঁটে দেয়। কিন্তু লাভ হয় না। গাছটি দিনে দিনে আরোও নুয়ে পড়ে। ওদিকে নুয়ে পড়তে থাকে ন্যান্সি। দূর্বলতা বাড়তে থাকে অর্কিড গাছের সাথে পাল্লা দিয়ে। এরমধ্যে নতুন আরেক উপসর্গ দেখা দেয়।
ওষুধে অরুচি। ন্যান্সির একই কথা, ‘ওসব ওষুধ অকাজের। অর্কিড গাছটি সতেজ হলেই আমি সুস্থ হবো।’

সৌমিক অসহায় বোধ করে। দু’হাতে ঠেলে এই অসুন্দর সময় দূরে সরিয়ে দিতে চায় ন্যান্সির চারপাশ থেকে। নিজের করা পণ বারবার নিজের মনে আওড়ায়। অবশেষে মির‍্যাকল ঘটলো। এক রবিবারে ন্যান্সির সামনে সৌমিক এসে দাঁড়ালো সজীব অর্কিড গাছটি নিয়ে। তা যেন যাদুর মতো কাজ করলো। আচমকাই ন্যান্সির ওষুধে রুচি ফিরলো। আস্তে আস্তে সুস্থ হতে লাগলো সে।
অসুন্দর সময় সরে দাঁড়ালো ন্যান্সির চারপাশ থেকে। দক্ষিণ জানালায় অর্কিড গাছটি বাড়িতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনলো। সৌমিকের উচ্ছ্বলতা আর প্রায় সুস্থ হয়ে আসা ন্যান্সির রসিকতায় এই বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে সুখ ছবি আঁকতে শুরু করলো।

আজ অনেকদিন পর সৌমিক রেস্তোরায় গেলো চিকেন তামালেস আনতে। বাসায় ফিরে দু’জনের প্রিয় পানীয় বানাবে। গাড়িতে মিডিয়াম ভলিউমে বাজছে,
‘লেটস স্ট্যা টুগেদার…’
হঠাৎই এক টুকরো অন্ধকার এসে পড়লো সৌমিকের গাড়ির সামনে। তা এড়াতে গাড়িটা বা’দিকে টার্ণ নিতেই খেই হারিয়ে উল্টে গিয়ে পড়লো রাস্তার পাশের ফুটপাতে।
দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া গাড়িটির ভেতর থেকে ভেসে আসা মৃদূ শব্দ ‘তে আমো, ক্যুরেডা (ভালোবাসি প্রিয়তমা)’ চাপা পড়ে গেলো আচমকা গাড়ির ব্রেক থেমে যাওয়ার বিশ্রী কর্কশ শব্দের নীচে। অদ্ভুদভাবে সেদিনই ন্যান্সি গার্বেজ ক্যানে খুঁজে পেল একটি মৃত অর্কিড গাছ। দক্ষিণের জানালায় সতেজ রথসচাইল্ড অর্কিডে ন্যান্সির অজান্তে ফুটে উঠলো একটি ফুল।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত