| 20 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে গল্প সাহিত্য

সোনাই সাধু

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

আজ ০৮ নভেম্বর কথাসাহিত্যিক শিপা সুলতানার শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


তরে লইয়্যা এমন জাগাত যাইমু সাধু, এমন জাগাত… এমন জাগাত যে যে যে…
এই জায়গায় এসে সাধুর এমন ভাব আসে, এমন ভাব আসে যে, যথাযত জ্ঞান না থাকার দস্তুর আমি এর কোনও বর্ণনা দিতে অক্ষম। এই নিয়ে আমাকে কোনও চাপাচাপিও করা যাবে না।
মায়া করে সোনাভানকে যে সোনাই নিজ নাম মাখিয়ে মাখিয়ে সাধু বলে ডাকে, শুনলে মনে হবে গহীন বনে হারিয়ে যাওয়া সঙ্গীনিকে ডেকে ডেকে আকুল কোনও কাঠুরে। তবে তার থোড়াই কেয়ার করে সোনাভান। যদি হাতে একান্তই কোনও কাজকাম না থাকে, ঝাড়ুর গোড়া থেকে কাঠি ভেঙে দাঁত খিলাল করতে বসে। সোনাই সাধুকে লাই দিয়ে মাথায় তুলার দরকার নাই, পুরুষ আর বান্দর পায়ের কাছেই রাখার দস্তুর। চতুর্থ স্বামীর মুখ জুতিয়ে বাপের বাড়ি ফিরেছে সোনাভান। নতুন কোনও কথা নয়। স্বামী পছন্দ না হলে সেই স্বামীর ভাত খাবে না সে। আর দেশ বিদেশ মেরে সোনাই সাধু উড়ে এসে পৌঁছেছে তার হাওলায়।
ইবার এমন এক ঘটনা দেখলাম যে, যে কিতা কইমু রে সাধু…
পাত্তা না দিলেও কান সজাগ করে সোনাভান। সাধুর গপসপ বড় সুন্দর। দেশ বিদেশ ঘুরে। কত রঙের কত ঢঙ্গের গপ তার মগজে। সাময়িক সংসার বিরতিকালীন সময় যেন পলকে উড়ে যায় সোনাভানের! কখনও সাধুর কোনও দেশে দীঘি ভরা হলুদ পদ্মতে, কখনও কেউ খালি বেড়ালই পুষে। কারও আবার গানের ব্যারাম, তারা সকল আখড়া করে বসত করে!
একদিন দেখি এক মা’রে চাইরটা শুয়োরে ছিড়িয়া খার, আমি সাধু মানুষ, হাতো নাই কিচ্ছু, বনোর ভিতরে বইয়া কান্দি আর খালি ভগবানরে ডাকি, মা’র লগে আছিল এক হুরু কইন্যা, মা’য় কইলো ‘দৌড়াও গো মাই, যত দূরই চৌক যায়… দৌড়াও… দৌড়াও…
কইন্যা এমন দৌড় দিলো…এমন দৌড় দিলো যে মাঠঘাট জমিন পর্বত পাড়ি দিয়া আসমান গিয়া দেখে দুনিয়াই তাইর পায়ের তলে। মানুষজন হুরু হুরু, হুরু মানুষরে তাই মাফ করি দিলাইলো…
সোনাভান উঠে পড়ে। উঠার সময় নাক দিয়ে হুহ বলে একটি শব্দ করে যার বিভিন্ন অর্থই হতে পারে। হতে পারে সাধুর এই গাঁজাখুরি গল্প সে বিশ্বাস করে নাই অথবা করেছে। অথবা মেয়েটি আকাশ ছুঁতেই পারে, এ আর এমন কী! অথবা সাধুর বালপোড়া গপসপে তার কোনও আগ্রহই নাই।
তার চতুর্থ স্বামীও মাস দেড়েক হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হলো। আসমান সমান বাড়ি না হলে বছরখানেক আসতো নিশ্চিত।
পাহাড়ি গ্রামে পুকুরের পানি গরুর চোখের মতো সজল, কালো। তার ওপর গুচ্ছ গুচ্ছ হিঙ্গাইর ঝুপ। ভরদুপুরে পুকুরের এপার-ওপার করছে সোনাভান যেন সে গরমের তাপে পাহাড় থেকে নেমে আসা নিকষ কালো গুখরো সাপ। নিঝুম দুপুরে কেবল দাঁড়াশ গুখরোই সাঁতার কাটতে নেমে আসে পুকুরে। চিকন কৃষ্ণবরণ জলজ সোনাভানকে দেখে মনের আশ মিটে না সোনাই সাধুর…তোমারে লইয়া এমন দেশও এমন দেশও যাইতাম মনে লয় সাধু… সোনাভান শুনে কিনা বুঝে না সাধু। জলের অনেক তল পযর্ন্ত শব্দ পৌঁছায়। তার কথা ফুরাবার আগেই সাপিনীর মতো চকিত জলের তলায় ডুব দেয় সোনাভান। একেবেঁকে সাঁতার কেটে পশ্চিমের পাড়ে গিয়ে ফুঁস করে মাথা তুলে সে। এই ঘাটে সাধু বসা। কাপড় বদলানোর জন্য বাঁধাই করা তিন দেয়ালের একখানা বেঁড়াও আছে কোনায়। তবু সাধুকে উপেক্ষা করে ঐপারে গিয়ে উঠেছে সোনাভান। সাধুও উঠে পড়ে…
আদতে সোনাভানের কোনও বাড়ি নাই। না বাপের বাড়ি, না নানাবাড়ি। এই বাড়িতে তার জন্ম হয়েছিল বলে নিজের বাড়ি বলেই মানে সে। মায়ের পালক বাবা-মাকে সে আপন নানা, নানী বলেই জানে। ঘরের নাতিপুতিদের চেয়ে তার দাপটই বেশি এই বাড়িতে। বলতে গেলে আপন নাতিপুতিদের এখনও বিয়ে দিতে পারেন নাই আনফর আলী কিন্তু চতুর্থবারের মতো যখন গৃহস্থ্যের মুখে চুনকালি মেখে বাড়ি ফিরে এলো ‘পুন্দের তলে দি হাওর দেখা’ সোনাভানের দিকে লাঠি নিয়ে তেড়ে যেতে যেতে কোমরের বেদনায় আটকে গেলেন তিনি। সোনাভানও পানদান থেকে পান মুখে পোড়ে পাড়া বেড়াতে বেরিয়ে গেল…
সদাই আর হেটি, লগে লগে আটি… তুই বেটা না মুলার ডেটা রে সদাই?
সদাই আনফর আলীর কথা আমলে না নিয়ে ধুতির খুঁটকে সরু বানিয়ে কান চুলকাতে থাকে আর সোনাভানকে দেখে। সোনাভানের স্বল্পকালীন বিবাহ বিরতিতে সাধু আছে তার ছায়া হয়ে। গ্রামের হেন ব্যক্তি নাই এই নিয়ে হাসি মস্করা করে না। কিন্তু সাধু কী করবে, সে কি গ্রামে ফিরতে চায়! কই থেকে কই না ঘুরে! কিন্তু হঠাৎ কোনও মধ্যরাতে আকুল হয়ে উঠে তার বুক। বাড়ি না ফিরে আর বাচন নাই তার। এসে দেখে দু-চারদিন আগেই ভাতারের মুখে ঝাঁটা মেরে বাড়ি ফিরে আসছে সোনাভান। সোনাভানের সদাই না হয়ে করবেই বা কি সে।
কু… উঃ.. উঃ…. তারপর ঘাপটি মেরে বসে থাকে সোনাই। গাঁয়ে ফিরলে খানি খুরাকির অভাব হয় না। সোনাভানদের ঘরেই তো এক-দুবেলা খাওয়া হয়ে যায় তার। তবু ইচ্ছা করে ঘরের দাওয়ায় বসে বেগুন ভাজি আর পাবদা মাছের সুরু দিয়ে এক গামলা ভাত খায়। ভাইদের জন্য পারে না। গরিবের ঘরে চুলা থাকে ভিন্ন ভিন্ন। তাদের চার বউয়েরা এক হাঁড়িতেই রাঁধছে তিনবেলা। ভাইদের কড়া দিব্যি আছে বৌদের ওপর। সোনাইকে অন্ন দিলেই তালাক তালাক তিন তালাক। গাঁয়ে ফিরেছে সপ্তাহ হলো, সুযোগ পেয়েই বাড়ির বাল্লায় কাঁঠাল গাছের গোড়ায় এসে বসে উপরে ডাক পাঠিয়েছে। বৌরা কেউই কালা বোবা নয়, কিন্তু যে শোনার সে ঠিকই শুনবে। খানিক বিরতি দিয়ে ফের ডাকটি পাঠায় সোনাই। করুণ কাঁঠাল পাখির ডাক। আম কাঁঠালের দিন। ভাই গেছে আদরের বোনকে নাইয়র আনতে। ভাইকে দেখে সাত কলসি রক্ত জমে বোনের শরীরে। জামাই শশুর শাশুড়িকে বুঝিয়ে ভাই-বোন রওয়ানা দেয় বাপের বাড়ির পথে। কত মাঠ ঘাট পেরিয়ে তেপান্তরে এসে পড়ে তারা। পথের সম্বল চিড়া আর গুড়। পেট ভরে চিড়া গুড় খেয়ে বোন বলে ‘পানি খাবো ভাই’… কলিজার অধিক বোনের জন্য পানির খুঁজে বেরিয়ে পড়ে ভাই। খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও যায় পানি। আঁজলা ভরে যেই পানি তুলতে যাবে, অমনি ঝাঁপিয়ে পড়ে বিশাল সে বাঘ। সেই দৃশ্য দেখে ফেলে বোন। তার কলিজা ফেটে যায়। তখন ছিল সত্যযুগ। মুখ থেকে জবান বের হবার আগেই কবুল হয়ে যেত। সে আল্লার কাছে ফরিয়াদ করলো ‘ হে আল্লাহ, ভাই শখ করে কাঁঠাল খাওয়াতে নিতে আসছিলো, তারে খাইছে নিঠুর বাঘে, তুমি আমাকে কাঁঠাল পাখি বানিয়ে দাও…সেই থেকে জীবনভর ‘ভাইরে খাইছে বনের বাঘে, আমার যত্ত দুঃখ…’ বলে বলে কেঁদে যাচ্ছে বোন পাখিটি।
সরলা বালা অঞ্চলের তলায় মাটির পাতিলে করে ভাতে, মাছে, শাকে এক করে সোনাইর হাতে দিয়েই টান দিয়ে মাথাটা বুকে টেনে নিল। তারপর মাথায় চুমু খেয়ে দ্রুত বাল্লা বেয়ে রান্নাঘরের পেছন দিয়ে আড়াল হয়ে গেল। মাতৃসম বৌদির ছায়ার পানে তাকিয়ে চোখ জ্বলে পানি এসে পড়ে সোনাইর…কতদিন নিজের পিঠ পেতে দাদার হাতে মার খেয়েছে এই নারী। তবু সোনাইর আর মন বসলো না ঘরে…কেবল সোনাভানের ছায়া ধরতেই জীবন গেল তার।
আগদুপুরে খেয়ে দেয়ে পান সুপারি মুখে পুরে কোনাকুনি মেরে মনুদের বাড়ি যাচ্ছে সোনাভান। পিছে পিছে সাধু। সদর পথে ঘুরে গেলে বিকেলের আধেক কাটা যাবে। অনেকদিন অবধি মনুর সাথে দেখা নাই। বিয়ের আঠারো বছর পর মন্মথের বৌ এক ছেলে জন্মিয়েছে। দুনিয়ার লোক এখন মনুদের বাড়ির পথে, যেন মোকাম ঠিলায় গরুর শিন্নি দিয়েছে কেউ। সন্তানের আশায় আশায় চল্লিশেই মাজা বেঁকিয়ে ফেলছে মনু। তার ওপর এই দশ মাস ঘরে বাইরে জোয়াল টানা। গাঁয়ের লোকেই তারে দেখেছে কী না! 
গাছ ঝেড়ে এক হালি পাঁকা কমলা আঁচলে বেঁধে ছেলের মুখ দেখতে যাচ্ছে সে। সাধু আগেই গন্ধ পেয়েছিলো সোনাভান মন্মথদের বাড়ি যাবে আজ। সারাদিন সে সোনাভানের আশেপাশেই আছে। তবে ভিড়ের ভেতর আর পাহাড়ের বাঁকেবাঁকে লুকটি বনের ডাল ফুল রেনু মাখিয়ে মাখিয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়া সোনাকে কাছ থেকে দেখাও নসিব।
ও সাধু… দাদাও মনো ওয় রাজি ওইবা, না অইলে নাই, তর আমার জাত কিতা, চল এমন জাগাত যাই…. এমন জাগাত যে… সোনাই জানে ধর্মান্বরিত হলে দাদাজী নিজ হাতে সোনাভানকে তার হাতে তুলে দেবেন। এমনকি এই মুহূর্তে সে সোনাভানকে নিয়ে পালিয়ে গেলে দাদাজী হয়তো হাঁকডাক করে গ্রাম মাথায় তুলবেন, কিন্তু মনে মনে আশীর্বাদও করবেন। ঘরের মহিষ বেচা, ধান বেচা একান্ত কয়টি টাকাও পাঠিয়ে দেবেন বিশ্বাসী কারও হাতে করে। 
হুঁকা জ্বালিয়ে কাঁঠাল গাছে বাঁধা মাচানে এসে বসে মন্মথ। সোনাভানের দিকে হুঁকা বাড়িয়ে ধরে। সোনাভান চার টান দেবে, মন্মথ চার, তারপর সোনাই। সোনক আর মন্মথ সমান ক্লাসে পাঠশালাতে পড়েছে। দুজনে পিসতুতো মাসতুতো ভাই ভাই। তবে সোনক যে সোনাভানের ছায়া, তা সেই বয়েসেই টের পেয়েছিলো মন্মথ। হুঁকোতে চার টান দিয়ে পেটিকোটের ভাঁজ থেকে বিঁড়ি বের করে আনে সোনাভান। তারপর টিকির মাথা থেকে বিড়িতে আগুন জ্বালিয়ে ঠোঁটে গুঁজে। বিড়িও ঠোঁটে ঠোঁটে ঘুরবে অভ্যাস অনুযায়ী।
পঞ্চমবারের মতো বিবাহের পিঁড়িতে বসলো সোনাভান। গত চারবার যা করেনি এবার মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদলো। দাদাজী একবেলা দুধকলা কম খেলেন ভাতে। মনু হাঁটুতে হাত ফেলে মাটিতে বসে থাকলো আর ফের নিখোঁজ হয়ে গেলো সোনাই…
চিরদিনের নিঃসন্তান সোনাভান দশ বছরের এই ছেলেকে আঠারো বছরের যুবক বানিয়েছে মাতৃসম আদরে। তার বাকি ভাইবোনগুলোকেও। সে আসছে আজ তার মৃত্যু সংবাদ নিয়ে। ঘুম থেকে উঠে পুকুরে যাচ্ছে, উঠানে পড়েই আর উঠে দাঁড়ায়নি তাদের আম্মা! সংবাদের সাথে একটি আর্জিও আছে। এ পর্যন্ত চারবার মায়ের কবর খোঁড়ার চেষ্টা হয়েছে, মাটিতে কোদাল বসে না। পাথরে বাড়ি খেয়ে কোদাল ফিরে আসে অথচ এমন কখনওই হয় নাই তাদের পলিমাটির গ্রামে। আব্বাজী বলে দিছেন সোনাভানের যদি গোপন কোনও পাপ থেকে থাকে, তিনি ছদগা দিয়ে সেই পাপের মাফ চাইবেন, তবু বাদ মাগরিব জানাজা পড়তে চান। দাদাজী কেঁদে কেটে উঠে বসেছেন তখন। গোছল করে ধোয়া লুঙ্গি পাঞ্জাবি পরবেন। ঘর ভর্তি অসংখ্য বিষণ্ণ, সজল মুখ। তিনি সকলের মুখ ঘুরে ঘোষণা দিলেন যে, যে যেভাবে পারে সোনাইকে খুঁজে আনুক, সোনাই ছাড়া সোনাভানকে মাটির তল করা যাবে না। 
দিকে দিকে লোক বেরিয়েছে সোনাইকে খুঁজে আনতে, সোনাভানের জন্য আজ ঘর বানাবে সোনাই…

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত