| 29 মার্চ 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ গণিত সংখ্যা: অঙ্ক দৌড় । অমিত মজুমদার 

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

    কিছু কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না৷ কাকতালীয় হয় কিন্তু একটা ব্যাখ্যা খুঁজতে ইচ্ছে হয়। বছর তেরো পিছিয়ে যাচ্ছি। একদিন বিকেলে একটা দোকানে কিছু জেরক্স করতে গেছি। দোকানদার বলল, একটু দেরি হবে। একজনের বেশ কিছু জেরক্স হচ্ছে। সেগুলো হয়ে গেলেই আমারটা করে দেবে। আমার কোনো তাড়া ছিল না। ভাল করে লক্ষ্য করে বুঝলাম অঙ্ক বইয়ের উপপাদ্য মাইক্রো জেরক্স হচ্ছে। পরের দিন মাধ্যমিকের অঙ্ক পরীক্ষা। জেরক্স করতে এসেছে বছর বাইশ তেইশের একটা ছেলে। সে পরীক্ষার্থী হতেই পারে না। আলাপ করলাম, “এগুলো কি কালকের পরীক্ষার?” 

“হ্যাঁ কাল অঙ্ক পরীক্ষা। তার উপপাদ্য গুলো।”

“কার জন্য করছেন? আপনার নিজের জন্য নিশ্চয়ই নয়?”

“না না। আমার স্ত্রী পরীক্ষা দিচ্ছে?”

    আমি অনেকটা অবাক হলাম। বেশ দায়িত্বশীল স্বামী। স্ত্রীকে পরীক্ষায় টোকার জন্য নিজে হাতে মাইক্রো জেরক্স সাপ্লাই দেবেন। বললাম, “শেষ পর্যন্ত মাইক্রো করতে হচ্ছে?” 

     “আর বলবেন না। সব পরীক্ষা মোটামুটি ভাল দিয়েছে। কাল অঙ্ক হলেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু অঙ্ক তো সে পারেই না। সম্পাদ্যটা পারবে। ত্রিকোণমিতির হাইট এন্ড ডিসট্যান্ট হয়ে যাবে। আর উপপাদ্য টুকতে পারলেই পঁচিশ ছাব্বিশ পেয়ে যাবে। ওরাল ধরে চৌত্রিশ উঠে গেলেই পাশ হয়ে যাবে৷” 

    আমি হাঁ করে ছেলেটার দিকে তাকালাম। বললাম, “কোন স্কুলে সিট পড়েছে?” 

    সে স্কুলের নাম বলার পর আমার পিলে চমকে গেল। এ তো আমার স্কুল। কালকে আমার গার্ড আছে। জিজ্ঞাসা করলাম, “কত নম্বর ঘর?” 

    সে নিঃসন্দেহে আমাকে চেনে না। তাই নির্বিঘ্নে ঘর নম্বরও বলে দিল। তার জেরক্সের বিল উঠেছে তিরিশ টাকা। তখন এক কপি জেরক্সের দাম পঞ্চাশ পয়সা। পরীক্ষার মাইক্রো একটু বেশিও হতে পারে৷ এতগুল পাতা দেখে মনে হল গোটা বই জেরক্স হয়ে গেছে৷ 

   পরের দিন পরীক্ষার গার্ড আমার ওই ঘরে পড়েনি। কিন্তু মেয়েটাকে দেখার খুব কৌতূহল হচ্ছিল। মাঝখানে একবার অনুমতি নিয়ে সেই ঘরে গেলাম। এই ঘরের ইনভিজিলেটর খুব একটা কড়া নন। প্রথম বেঞ্চে সেই মেয়ে। চিনতে অসুবিধা হল না কারণ ঘরে সেই একমাত্র বিবাহিতা মেয়ে। একেবারে আপাদমস্তক নিরীহ একটা মেয়ে। চুপচাপ বসে আছে। পাশ নম্বর তুলতে পেরেছে বলে মনে হয় না। তার সামনে এসে দাঁড়ালাম। দেখেই মনে হল এই বয়সে তাকে সংসারের প্রচণ্ড ধকল নিতে হয়৷ চেহারায় অভাবের ও অপুষ্টির লক্ষণ পুরোদমে। দেখে খুব খারাপ লাগল। মেয়েটার কাছে তিরিশ টাকার নকল আছে কিন্তু সে বের করে ইনভিজিলেটরকে ফাঁকি দিয়ে টুকতে পারবে বলে মনে হয় না। পরীক্ষায় ফেল করলে হয়তো তার পড়াটাই বন্ধ হয়ে যাবে। জিজ্ঞাসা করলাম, “প্রশ্ন কেমন এসেছে?” সে কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে হাসল। যেন বলতে চাইল, অঙ্ক তো পারিই না। প্রশ্ন ভাল না খারাপ কীভাবে বুঝবো। সেই সামান্য হাসি আমাকে একটা পৃথিবীর সন্ধান দিল। স্কুলে জয়েন করার পর এটাই আমার প্রথম মাধ্যমিক পরীক্ষার গার্ড। সেদিন বিকেলে জেরক্সের দোকানে যাওয়াটা আমার কাকতালীয়ই ছিল। না গেলে হয়তো এই বিষয়টা আমার অজানাই থেকে যেত। আমি যে স্কুলে পড়াশোনা করেছি সেখানকার পরিবেশ আর এখানকার পরিবেশ বিস্তর ফারাক। মনে হল ছেলেমেয়েদের অঙ্কে ভীতি আমরাই তৈরী করে দিয়েছি৷ সংখ্যা চেনার পর থেকে যেমন ভাবে শেখাঅঙ্কের ভয় দূর হবে সেটা আমরা একদমই শেখাতে ব্যর্থ।

এই ব্যর্থতা কিন্তু আজকের নয়।

আরও অনেকটা সময় পিছিয়ে যাচ্ছি। গত শতাব্দীর নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়। ক্লাস টেনে টেস্ট পরীক্ষা চলছে। সেদিন অঙ্ক পরীক্ষা। পরীক্ষা শুরু হয়েছে। গার্ড খুব একটা কড়া হচ্ছেন না। এমন একটা সময় একটা ছেলে আমার পাশে এসে একটা পাতা খুলে আমাকে দেখাল। একটা উপপাদ্য। সে বলল, “দ্যাখ তো এটাই পরীক্ষায় এসেছে কিনা?” আমি সেদিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম। প্রথমে মনে হল ছেলেটা বাইরে গিয়ে বই থেকে পাতাটা ছিঁড়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু পাতাটা বইয়ের মাপের থেকে অনেকটাই ছোটো। আমি উপপাদ্য না দেখে শুধু পাতাটা দেখতে থাকলাম। আর বারবার ভাবতে থাকলাম বইয়ের পাতা এত ছোটো হয়ে গেল কী ভাবে?জেরক্স কথাটা শুনে থাকলেও মাইক্রো জেরক্স ব্যাপারটা আমার তখনও জানা ছিল না। অঙ্ক পরীক্ষার জন্যই শিখেছিলাম মাইক্রো জেরক্স কথাটা। 

    অঙ্কের কথা মাথায় এলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক বজ্রকঠিন মাষ্টারমশাইয়ের ছবি। কবি অপূর্ব দত্তের ভাষায় বলতে হয় “দুই চোখে ঠিকরায় দু’রকম রাগ / ডান চোখে কে পি বসু বামে কে সি নাগ।”।কে পি বসু আর কে সি নাগের আতঙ্ক আমাদের ছেলেবেলায় তাড়া করে বেড়াতো। কে সি নাগ তো নয় সাক্ষাৎ কে সি এন। যাকে বলে পটাশিয়াম সায়ানাইড। স্কুলের ছেলেমেয়েরা সব থেকে বেশি ভয় পায় অঙ্ককে। বিশেষ করে গ্রামগঞ্জে। এমনকি ক্লাসের প্রথম সারির ছেলেমেয়েরাও অঙ্কে দুর্বল। অঙ্ক এদের কাছে আতঙ্ক। এরঅঙ্ককে সাবজেক্ট হিসেবে দেখে না।  দেখে ঘাড়ের ওপর চেপে বসা কোনো দৈত্য হিসেবে। কোনরকমে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ নম্বর তুলতে পারলেই ঘাড় থেকে দৈত্য ঝেড়ে ফেলা যায়৷ এই পাশ নম্বর তোলাটাও খুব সহজ না। আগের মতো এখনকার পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের মাধ্যমিক পরীক্ষায় চৌত্রিশ পেতে হয় না। এখন পাশ নম্বর পঁচিশ। স্কুলের হাতে থাকে দশ। সাধারণত স্কুল থেকে গোটা নম্বর ছেলেমেয়েদের দিয়ে দেয়া হয়। তাহলে তাকে লেখা পরীক্ষায় তুলতে হবে নব্বইয়ের মধ্যে পনেরো। সঠিক পনেরো নম্বরের জন্য পরীক্ষার সময় তিন ঘন্টা। বিষয়টা হাস্যকর শুনতে লাগলেও মোটেও তা নয়। এই পনেরো নম্বর তুলতেও গলদঘর্ম হতে হয় ছেলেমেয়েদের। তিন ঘন্টা পরীক্ষার সময় পেয়েও অনেকেই আট দশের বেশি নম্বর তুলতে পারে না৷ মাধ্যমিক পরীক্ষার খাতা যে সমস্ত শিক্ষকরা দেখেন তাঁদের প্রত্যেকের এই অভিজ্ঞতা আছে। মনে হতে পারে এরা একদমই পড়াশোনা করে না। পাশ করার যোগ্যতা এদের নেই। এদের ফেল করাই উচিৎ। কিন্তু পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোলে দেখা যায় অদ্ভুত ভাবে এরা পাশ করে গেছে৷ কিন্তু পাশ করা আর পাশ করানো এক বিষয় না। এখানেই সমস্যার শুরু। এই সমস্যার সূত্রপাত ছাত্রজীবনের একদম গোড়াতেই। যাকে বলে গোড়ায় গলদ।

অঙ্ক বিষয়টা এমনই যে নিজে থেকে শেখা যায় না। একজন গাইড সবসময় প্রয়োজন। একেবারে ধারাপাতের এক -এ চন্দ্র থেকেই এই প্রয়োজন আছে। কোনো ছাত্রছাত্রী প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হবার সময় ধরেই নেয়া হয় সে অন্তত সংখ্যাগুলো চিনে এসেছে। না চিনলে স্কুলে তাদের চিনিয়ে দেবার কথা। কিন্তু সমস্যা সেখানেই। চার বছর প্রাইমারিতে পড়াশোনা করার পর পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হবার পর অঙ্কের শিক্ষক ধরে নিতেই পারেন যে চতুর্থ শ্রেণির পাঠ সে বুঝে এসেছে৷ কিন্তু বাস্তব চিত্রটা একদম অন্য। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হবার সময় তার অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয় না পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হবার পরও। একই অবস্থা থাকে নবম শ্রেণিতে গিয়েও। পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া ছেলেমেয়েরা অনেকেই একশো পর্যন্ত বলতে পারে না। পাঁচের ঘর পর্যন্ত নামতা জানে না। সামান্য যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ তো অনেক দূরের ব্যাপার। পঞ্চম শ্রেণিতে বিগত চার বছরের ঘাটতি পুরোপুরি মিটিয়ে ফেলা সম্ভব হয় না। সেই অর্থে পঞ্চম শ্রেণির পর থেকে প্রতি ক্লাসেই এই ঘাটতি বড় হয়। মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার আগে এটা হয়ে ওঠে চূড়ান্ত। এর জন্য দায়ী কে?ছাত্রছাত্রীরা নিজেই?তাদের অভিভাবক?তাদের শিক্ষক?পাশফেল প্রথা বিলুপ্তি?পড়াশোনার সিস্টেম?দায়ী যেই হোক ভোগান্তিটা ছাত্রছাত্রীদেরই হচ্ছে। 

    বিষয়টা খুব তলিয়ে দেখলে ব্যর্থতার কারণ হিসেবে ঠিক কারো দিকেই এককভাবে আঙুল তোলা যাবে না৷ এখানে অনেকগুল বিষয় কাজ করে। সবগুলো সমস্যার সম্মিলিত ফলাফল অঙ্কে ভীতি। গ্রামের ছেলেমেয়েদের অভিভাবকরা একদম সচেতন না। তাঁরা অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের অন্তর্গত। বেশিরভাগ জন কৃষিজীবী। বাকিরা দিনমজুর নয়তো খুব ছোটোখাটো দোকানদার। তাঁরা নিজেরাই ঠিকঠাক পড়াশোনা জানেন না। ছোটোবেলায় যেটুকু শেখেন জীবনযুদ্ধে জড়িয়ে যাবার পর তা পুরোপুরি ভুলে যান। তাই এইসব পরিবারে ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার তৈরী হওয়া কখনও শেষ হয় না। এই অভিভাবকদের নিজের হাতে ছেলেমেয়েদের পড়ানো সম্ভব নয়৷ স্কুল থেকে অভিভাবককে কোনো কারণে ডেকে পাঠালেও তাঁরা আসতে পারেন না। একদিন পাঁচ মিনিটের জন্য স্কুলে আসতে হলে তাঁর একদিনের আয় বন্ধ। ব্যক্তিগতভাবে অভিভাবককে স্কুলে আসার জন্য ফোন করে অনেকের কাছেই ফোনে উত্তর পেয়েছি তিনি কাজের সুবাদে কেরালায় আছেন। এই মুহূর্তে আসতে পারবেন না। কেরালাটা কারো ক্ষেত্রে মুম্বাই কারো রাজস্থান কারো গুজরাট। অর্থাৎ কাজের সূত্রে বাড়ি ছেড়ে ভিন রাজ্যে অবস্থান। সুতরাং পড়াশোনার বিষয়ে বাবার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় দূরত্ব শুরু থেকেই থাকছে। মায়েদের অবস্থাও একই তাঁরা বাড়িতে থাকলেও বাড়ির কাজ সামলে ছেলেমেয়েদের জন্য সময় বের করতে পারেন ন। ছেলেমেয়েরা বড় হয় নিজেদের মতো। 

    স্কুলছুট একটা বড় সমস্যা। স্কুলে বেশিরভাগ ছাত্র নিয়মিত আসে না। না আসার জন্য অভিভাবকদের ডাকা হলে তাঁরাও আসেন না। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত যারা আসে তাদের একটা অংশ দুপুরে মিড ডে মিল খেতে আসে। স্কুলে না এলেও এরা সকাল বিকেল সন্ধ্যা প্রাইভেট পড়তে যায়। গ্রামে সাধারণত কারা প্রাইভেট পড়ান?যাঁরা নিজেরা মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় কোনোরকমে অঙ্কের ভূত ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে বেঁচে গেছিলেন তাঁদের অনেকেই গ্রামে অঙ্কের শিক্ষক। সুতরাং সেই ছাত্রছাত্রীরাও ঘাড় থেকে অঙ্কের ভূত ঝেড়ে ফেলার জন্যই প্রয়োজনীয় পদ্ধতি শিখবে এটা খুব স্বাভাবিক। এই পদ্ধতি শেখার কিছু সমস্যা আছে। স্কুলে শিক্ষক অঙ্কটা সেই ক্লাসের উপযোগী করে বোর্ডে দেখিয়ে দেয়া নিয়ম অনুযায়ী শেখানোর চেষ্টা করেন। সেই ছেলেমেয়েরা প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে শেখে অন্যভাবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নোটবই বা মেড ইজি ব্যবহার করা হয়। যে ছেলেমেয়েরা এক নিয়মের অঙ্কই মাথায় ঢোকাতে পারে না তাদের নিতে হয় দুই ধরণের নিয়মের চাপ। অনেকে তো পঞ্চম ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের এক্স ধরে পাটিগণিত করা শিখিয়ে দেন যদিও  তখন এক্স কিংবা সমাধান সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই তৈরি হয় না। 

    বহু স্কুলেই কোনো ক্লাসের এক সেকশনে আশি থেকে নব্বই জন ছাত্রছাত্রী। কোথাও সংখ্যাটা একশোর ওপরে। উপস্থিত থাকে গড়ে চল্লিশ জন। এদের মধ্যে দশ জন হয়তো নিয়মিতবাকি তিরিশ জনের মুখ প্রতিদিন পরিবর্তন হয়। আজ যে তিরিশ জন এসেছে পরের দিন সেই তিরিশ জনের বদলে অন্য তিরিশ জন হাজির। এইরকম পর্যায়ক্রমে আসা ছাত্রছাত্রীদের অঙ্ক ঠিকঠাক শেখানো মুশকিল যেখানে তাদের ঘাটতি প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে। এখানে বেশিরভাগ শিক্ষক বোর্ডে অঙ্কটা করে দেন। দুবার বুঝিয়েও দেন। কয়েকজন অঙ্কটা বোঝে। বাকিরা বোর্ড দেখে টুকে নেয়। অবশ্য বোর্ড দেখে অঙ্ক টোকাও খুব সহজ ব্যাপার না। একটা বড় অংশ দেখে দেখেও ঠিকঠাক টুকতে পারে না অঙ্ক। 

    স্কুলের ক্লাসগুলোকে আমি একটা ফুটবল মাঠের মতো দেখি। এখানে ছাত্রছাত্রীরা বল। বিভিন্ন পজিশনে খেলতে থাকেন বিভিন্ন শিক্ষক। ডিভেন্স, মিডফিল্ড আর স্ট্রাইকার। প্রাইমারি স্কুল এখানে ডিফেন্স। পঞ্চম (যদিও এখন এই শ্রেণির বহু প্রাইমারি স্কুলে চালু হয়ে গেছে) থেকে অষ্টম মিডফিল্ড। আর নবম দশম শ্রেণি হচ্ছে স্ট্রাইক জোন। গোলে ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবক। তিনি বল ঠেলে দিচ্ছেন ডিফেন্সে খেলা শিক্ষকের কাছে। প্রাইমারি শিক্ষকের কাজ ছাত্রছাত্রীদের পর্যাপ্ত শিক্ষা দিয়ে মিডফিল্ড পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া। ঠিক একই ভাবে মিডফিল্ড সেই ছাত্রছাত্রীদের পৌঁছে দেয় স্ট্রাইক জোনে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে শিক্ষকরা স্টাইকারে খেলছেন তাঁরা পর্যাপ্ত বল পাচ্ছেন না। যে বল পাচ্ছেন তা দিয়ে গোল করা যায় না। অর্থাৎ একজন ছাত্র প্রাইমারি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত আসতে আসতে তার ভেতরের সমস্ত প্রতিভা নষ্ট যাচ্ছে। নবম শ্রেণিতে অঙ্ক ক্লাস নিতে আসা শিক্ষক আবিষ্কার করছেন ছাত্রছাত্রীরা নামতা জানে না। গুণ ভাগ জানে না। যোগ বিয়োগ করতে হাত কাঁপে। তাকে কিভাবে সূচক, জটিল রাশি, লাভ ক্ষতি, বীজগণিতের সমীকরণ, লেখচিত্র, পরিমিতি সহ গোটা নবম শ্রেণির পাঠ দেয়া সম্ভব হবে? 

    ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যারা প্রথম দিকে তারাও অঙ্ক খুব একটা পছন্দ করে না। অনেকে তো অঙ্ক মুখস্থ পর্যন্ত করে ফেলে। পরীক্ষায় বই থেকে অঙ্ক এলে তারা হুবহু সেটা নামিয়ে দেয়। এটাও একধরণের প্রতিভা। অথচ দুঃখের বিষয় এমন প্রতিভা নিয়েও ওদের চিরকাল অঙ্ককে ভয় পেতেই হয়। এই ভয় কাটিয়ে উঠতে পারে না কিছুতেই। ভয়টা ভেতরে ভেতরে বড় হতে থাকে। মাধ্যমিক পরীক্ষার গণ্ডী কোনোরকমে টপকে গেলেই মনে হয় অঙ্কের হাত থেকে বেঁচে গেলাম। কিন্তু এই আনন্দ সাময়িক। কয়েক বছর পরে চাকরির পরীক্ষা দিতে গেলে আবার এই অঙ্কের প্রয়োজন হয়। একটা বড় অংশের ছেলেমেয়েদের অঙ্ক ভীতির দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হয়। আর এই ভীতিটা মারাত্মক। কারণ এখানে নিজের কেরিয়ার, ভবিষ্যতের প্রশ্ন। ছাত্রজীবনে ফাঁকি দিয়ে একটা আনন্দ পাওয়া যায় কিন্তু প্রতিযোগিতার জীবনে এসে আবিষ্কার হয় ছোটোবেলার ফাঁকি এখন বিরাট আকার ধারণ করে ফেলেছে। যাঁরা পারেন তাঁরা আবার নতুন করে অঙ্ক শেখেন। কিন্তু অনেকেই সেটা পেরে ওঠেন না। 

    অঙ্ককে সহজ করে ছোটোদের সামনে উপস্থাপন করতে আমরা অনেকেই পারি না। অথচ অঙ্ক আসলেই একটা মজার খেলা। ধাঁধার উত্তর খুঁজতে সব ছোটোদের ভাল লাগে। একই কথা প্রযোজ্য অঙ্কের ধাঁধার ক্ষেত্রেও। কিন্তু অঙ্কটা যখনই নব গণিত মুকুল হয়ে সিলেবাসে ঢুকে যাবে তখনই সেটা ধাঁধা থেকে গণিতে পরিণত হবে। ছাত্রছাত্রীদের ভীতির কারণ হবে। আমরা কিছুতেই সিলেবাসের অঙ্ককে ক্লাসঘরে ধাঁধায় রূপান্তরিত করতে পারি না। অথচ এর অনেক প্রথা আছে। আমাদের ছোটোবেলায় কারো কারো হাতে এসেছিল মির প্রকাশন মস্কো থেকে প্রকাশিত ইয়া পেরেলম্যানের ‘অঙ্কের মজা’ বইটা। যার ভূমিকাতে লেখা ছিল, “এই বইটা পড়ে উপভোগ করার জন্য গণিত সম্বন্ধে একটা মোটামুটি জ্ঞান — অর্থাৎ, পাটিগণিতের নিয়মকানুন আর জ্যামিতি সম্বন্ধে প্রাথমিক জ্ঞান থাকলেই যথেষ্ট। খুব কম অঙ্কের বেলাতেই সমীকরণ তৈরী করা আর সমাধান করার মতো দক্ষতার দরকার হবে এবং এ ধরণের কিছু অঙ্ক থাকলেও সেগুলিও নিতান্তই সহজ।” বইটার মধ্যে প্রচুর গাণিতিক সমস্যা ও সমাধান ছিল৷ সমস্যা অনেক ক্ষেত্রে বেশ জটিল। কিন্তু ধাঁধার আদলে সমস্যাগুলর এমন সহজ উপস্থাপন যে অঙ্ক যার কাছে ভীষণ অপ্রিয় তাকেও মাথা খাটাতে বাধ্য করবে৷ একটা উদাহরণ দিচ্ছিঃ “আপনার তিনজন বন্ধুর প্রত্যেককে তিনটি জিনিসের যেকোনো একটিকে তাঁর পকেটে লুকিয়ে রাখতে বলুন এবং অবশ্যই আপনার অনুপস্থিতিতে। আপনি ঘরের বাইরে চলে যাবার পর একজন পেন্সিল একজন চাবি এবং তৃতীয় জন ছুরিটাকে নিজের পকেটে রাখলেন। এবং আপনি ঘরে ফিরে এসেই ঠিক-ঠিক বলে দিলেন কার পকেটে কোন জিনিসটি রয়েছে।” এইটুকু শুনে এটা একটা ম্যাজিক বলে মনে হতে পারে কিন্তু মোটেও ম্যাজিক না৷ কার কাছে কোন জিনিসটা আছে সেটা বের করতে গেলে একটা সহজ অথচ ভীষণ জটিল অঙ্ক কষতে হবে। সমাধান হবে একটা চমৎকার অঙ্কেই। 

    এই বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা আরও কিছু বই পেয়েছিলাম। যেমন অঙ্ক মানেই বুদ্ধির খেলা, বুদ্ধির খেলা আর হরেক মজা ইত্যাদি। এই বইগুলো হাতে পেলেই যে একজন ছাত্র দারুণ অঙ্ক করতে শুরু করে দেবে তা নয়। তবে একদম ছোটোবেলায় এই ধরণের বই অঙ্কে উৎসাহ যোগাতে খুব কাজ করে। ছোটো থেকেই সিলেবাসের বইয়ের পাশাপাশি তাদের হাতে এই বইগুল ধরিয়ে দিতে পারলে অনেক ক্ষেত্রে সুফল পাওয়া যায়। ছাত্রছাত্রীরা সাধারণত অঙ্ককে ভয় পায় না। তারা ভয় পায় সিলেবাসের মধ্যে ঢুকে থাকা অনুশীলনীগুলোর সমাধানকে। সিলেবাস জিনিসটাই বাধ্যতামূলক। সেই জন্যই অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় একটা ক্লাসের কোনো ছাত্র অন্য ক্লাসে বই পড়লে আনন্দ পাচ্ছে। তাদের ভয়টা সিলেবাস নিয়ে। যেটা তাকে বাধ্যতামূলক পড়তে হবে। সিলেবাস একটা সিস্টেমে তৈরি হয়। মাঝখানে কোনো একটা স্টেপে ঘাটতি হয়ে গেলে পরবর্তী স্টেপগুলোতে সেই ঘাটতি বাড়তেই থাকে৷ কমে না। আর এটাই সব থেকে বড় সমস্যা। ফ্রিজ কারিন্থির লেখা রিফান্ড নাটকটার কথা মনে পড়ছে। যেখানে স্কুল থেকে পাশ করে বেরিয়ে যাওয়া একটা ছাত্র ওয়াশারকপ আঠেরো বছর পর আবার স্কুলে ফিরে এসেছে। প্রিন্সিপালের কাছে সে দাবি করছে স্কুল থেকে তাকে কিছু শেখানো হয়নি কিন্তু পাশ করিয়ে দেয়া হয়েছে। এই সার্টিফিকেট আর যোগ্যতা নিয়ে সে কোনো চাকরি পাচ্ছে না। তাই ফিরে এসেছে স্কুলে পড়াকালীন সে টিউশন ফি বাবদ যত টাকা খরচ করেছে তা ফেরৎ দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয় তাকে আবার পরীক্ষা নেওয়া হবে এবং কোনো একটা বিষয়ে ফেল করলেই প্রমাণ হবে সে স্কুল থেকে কিছু অন্তত শেখেনি। সেই ক্ষেত্রে তাকে টাকা দেয়া হবে। কিন্তু সব সাবজেক্টে পাশ করে গেলে প্রমাণ হবে সে কিছু শিখেছে। সেক্ষেত্রে তাকে টাকা দেবার প্রশ্নই নেই। সে ফেল করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করেছে। তেমনি শিক্ষকরাও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে তাকে পাশ করাতেই হবে। এবং তেমনভাবেই তাঁরা কৌশল অবলম্বন করেন। ওয়াশারকফ যা উত্তরই দেবে সেটাই যুক্তি দিয়ে সঠিক বলে প্রমাণ করা হবে। এইভাবে সব কটা সাবজেক্টে তাকে জোর করে পাশ করিয়ে দেবার পর অঙ্ক পরীক্ষায় শিক্ষকের প্যাঁচে পড়ে নিজের বিপদ ডেকে আনে। পরীক্ষার কৌশল অসাধারণ। একটু দেখে নিই বিষয়টা  — 

ইতিহাস শিক্ষক — তিরিশ বর্ষব্যাপী যুদ্ধটা কত বছর ধরে চলেছিল?  

ওয়াশারকফ — এটার উত্তর আমার জানা নেই। 

ইতিহাস শিক্ষক — না না তুমি জানো। আমাকে উত্তরটা দাও। 

ওয়াশারকফ — তিরিশ বর্ষব্যাপী যুদ্ধটা কত বছর ধরে চলেছিল?এটাই প্রশ্ন তো? 

ইতিহাস শিক্ষক — হ্যাঁ হ্যাঁ। 

ওয়াশারকফ — এটা আমি জানি। এটার উত্তর সাত মিটার। সাত মিটারই ছিল। হ্যাঁ হ্যাঁ সাত মিটার লম্বা। আমি জানি আমার উত্তর ভুল। আর সেই সঙ্গে আমি ফেল করেছি। আমার টাকা ফেরত দিন। 

ইতিহাস শিক্ষক — সাত মিটার?একদম সঠিক উত্তর। তোমার উত্তর অসাধারণ। 

ওয়াশারকফ — কী? কী বলতে চাইছেন? 

ইতিহাস শিক্ষক — আসলে যুদ্ধ তো প্রতিদিনের অর্ধেক সময় হয়েছে। সেই হিসেবে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বারো ঘন্টা যুদ্ধ। তাহলে তিরিশ বছর হয়ে যায় পনেরো বছরে। আবার বারো ঘন্টাও পুরো সঠিক নয়। সৈনিকদের খাওয়াদাওয়া আছে তাতে তিন ঘন্টা বাদ গেলে সময়টা দাঁড়ায় বারো বছর। আমরা প্রকৃত যুদ্ধের সময়টাই ধরেছি৷ 

গণিত শিক্ষক — যুদ্ধের প্রকৃত সময়টা পরীক্ষার্থী আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ দিয়ে কনভার্ট করে উত্তর দিয়েছে সাত মিটার। সেই হিসেবে উত্তর সঠিক। এই পরীক্ষার্থীকে ইতিহাসে ভেরি গুড গ্রেড দেয়া উচিৎ। 

সকল স্টাফ — অসাধারণ। পরীক্ষার্থী ইতিহাসে পাশ করেছে। 

    অঙ্কের স্যার ইতিহাসের স্যারকে সাহায্য করে তাকে পাশ করিয়ে দিলেন। পরের ঘটনা আরও চিত্তাকর্ষক। অঙ্ক স্যারের পালা আসলে তিনি ওয়াশারকফকে বললেন, অঙ্ক পরীক্ষায় দুটো প্রশ্ন করবেন। দুটো প্রশ্নের যে কোনো একটা প্রশ্নের উত্তর সঠিক দিতে পারলেই তাকে পাশ বলে গন্য করা হবে। তিনি আক্ষরিক অর্থেই একটা জটিল অঙ্ক করতে দিলেন যে অঙ্কের সমাধান ওয়াশারকফের কাছে ছিল না৷ এবার অঙ্ক স্যার বললেন, তুমি উত্তর ঠিক দিতে পারোনি। স্কুলকে তোমার টাকা ফেরৎ দিতে হবে। এবার বল স্কুল থেকে যে পরিমাণ টাকা পাও তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব কী?ওয়াশারকফ এবার দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে নিখুঁত হিসেব করে উত্তর দিয়েছিল টাকার অঙ্ক। শিক্ষক তখন বলেন এটাই তাঁর পরীক্ষার দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল। আগেই বলা ছিল যেকোনো একটা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারলেই পাশ করে যাবে। দ্বিতীয় প্রশ্নের একদম সঠিক উত্তর দিয়েছো। সুতরাং তুমি পাশ করেছো। অঙ্ক স্যারের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ওয়াশারকফ পাশ করে যায় আর স্কুল রক্ষা পায়। এখানে দেখা গেল সব থেকে কঠিন বিষয়ে সে নিজে থেকে পাশ করল। এই টাকা পয়সার হিসেব সব ছাত্রছাত্রী করে দিতে পারে। কিন্তু সেটা যখনই অনুশীলনীতে থাকবে তখনই সে আটকে যাবে। মূল সমস্যাটা এখানেই। অঙ্ককে কিছুটা বুঝতে শেখার মতো মেধা ছাত্রছাত্রীদের থাকে কিন্তু সেই মেধার যথাযথ প্রয়োগ করা হয়ে ওঠে না। যাদের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয় তারা ঠিকই অঙ্ককে ভালবাসতে পারে। 

    বিখ্যাত বাংলা ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দুর কথা ও সুরে ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’ চলচ্চিত্রে একটা গান আছে, “অঙ্ক স্যার বাগানে বসছেন / হাতে হাতে দিচ্ছেন কোশচেন / আঁক করে ফেল খুব জোরসে / এক্সাম চালু ফুল ফোর্সে” এই পর্যন্ত সাধারণ কথা কিন্তু তার পরের লাইন “বুরুন তুমি অঙ্কে তেরো।” এই বুরুনের সংখ্যাই ক্লাসে সবচেয়ে বেশি। যাদের বারবার অঙ্কভীতি তেরোর গেরোতে আটকে যায়। এই তেরো শুধু একটা নম্বর নয়। একট আতঙ্কও। এখানেই লুকিয়ে আছে ভয়। এই আতঙ্কটা একেবারে গোড়াতে নির্মূল করতে পারলে অঙ্কও খুব আকর্ষণীয় বিষয় হয়ে ছাত্রছাত্রীদের কাছে ধরা দেবেই। ছোটোদের একটা খেলা আছে অঙ্ক দৌড়। সেখানে প্রতিযোগীরা একসঙ্গে দৌড় শুরু করে মাঝপথে তাদের নির্দিষ্ট অঙ্ক খাতায় কষে নিয়ে আবার দৌড়াতে হয়। অঙ্কের সঠিক সমাধান করে যে আগে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে সেই প্রথম হয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে প্রথম পৌঁছেছে তার অঙ্ক ভুল হয়েছে। সাধারণত এটার কারণ অত্যন্ত তাড়াহুড়ো। তাড়াহুড়ো করে অঙ্কের সমাধান হয় না। ধৈর্য ধরে সময় দিলেই সঠিক সমাধান করে গন্তব্যে পৌঁছানো যায়৷ অঙ্ক খুব কঠিন কিছু না। সামান্য ধৈর্য আর বিষয়ের প্রতি ভালবাসা থাকলে যে কোনো অঙ্কদৌড় সাফল্যের সঙ্গে পার করা সম্ভব।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত