গণিত সংখ্যা: অঙ্কের দিদিমণিকে চিঠি । হৈমন্তী ভট্টাচার্য্য
পূজনীয় গীতাদি,
স্কুলের লেটার বক্সে আপনার নামে এই বেনামি চিঠিটা দেখে আপনি অবাক হবেন। নাম লেখবার সাহস হল না। কেন হল না, পরে বলছি।
আপনি বোর্ডে কাঠের মস্ত কম্পাস দিয়ে বৃত্ত আঁকার সময়ে যেমন শুরুর বিন্দুর সাথে শেষের বিন্দু মিলিয়ে দিতেন, আমার চিঠিটা সেরকমই লাগবে হয়ত আপনার। তবে না, সিনেমার মত অঙ্কে ফেল করে পরে বিরাট নামকরা কোনো বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমি হইনি, ওরকম কোনও ফিল্মি উত্তরণ ঘটেনি!আমার জীবনের সিঁড়ি দশ পাঁচ করে গুণিতকে নামতে নামতে শূন্যের একটু ওপরে স্থির হয়ে আছে আপাতত।
অঙ্ক ভয়ের একটা নাম আছে গাল ভরা, ম্যাথেমাফোবিয়া। এটা আমি ঐ মস্ত বড় ফিস ফ্রাই এর মত স্মার্ট ফোনে গুগল ঘেঁটে দেখেছি। তবে এই ভয়ের জন্ম মোটামুটি ফাইভ থেকে। তার আগে, হুঁ হুঁ, আমি অঙ্কে আশি নব্বই পেতাম। তবে আপনার মত কোনো অঙ্ক জানা, বা বলা ভালো অঙ্কের দেবী আমায় ধরলে আমার অঙ্কের হাল দেখে ঘূর্ণি ঝড়ের মত দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া কিছুই করত না। বইয়ের সব অঙ্ক আমার পুরো আকন্ঠ মুখস্থ ছিল। ওই দেখুন, চোখ কপালে তুলছেন, অবশ্য আপনিও জানেন আমাদের মত ফার্স্ট জেনারেশন লার্নারদের বুনিয়াদি স্কুলে এরকমটা আমি একা নই। দুলে দুলে সন্ধেবেলা “আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে” যে ছন্দে মুখস্থ করতাম, সেই একই ছন্দে, নামতা আর প্রশ্নের অঙ্ক – সবই গিলে নিয়ে জমাতাম মাথার পকেটে।পরীক্ষার সময়ে শুধু জাবর কাটা।
একজন শ্রমিক একদিনে দশটা কলসি বানায়, পনেরো জন শ্রমিক, সাত দিনে কটা পারে?তারপর কয়েকজন শ্রমিক চলে গেল। সব মিলিয়ে কাজটা কত দিনে উঠল-এসব জটিল হিসাব নিজে নিজে মাথা খাটিয়ে করা যায়, কে জানত? তাই মুখস্থই ভরসা!
আমার বাবা অটো চালাত। নিজের অটো নয়। কিন্তু আমি তো বাবার সঙ্গেই বেরোতাম, দেখতাম ঝড়ের বেগে টাকা নিয়ে হিসাব করে বাবা খুচরো ফেরত দেয়, কয়েক সেকেন্ড অবধি লাগে না। কী করে পারে এমন অঙ্ক? জীবন শিখিয়ে নেয়। এখন আমিও পারি। তবে ঐকিক নিয়ম, ত্রৈরাশিক এসব ভুলে গেছি। হয়ত বইগুলো দেখলে মনে পড়বে।
অঙ্ক আমি অন্যভাবে বুঝতাম। মা কাজের বাড়ি থেকে ধার নিয়ে ঘরের পাকা মেঝে করল, মাসে মাসে কাটান করত, লিখে দিতাম আমি খাতায়। বিয়োগ করতাম। বাবা হাতে হাতে হিসাব করে বলে দিত ঠিক হল কিনা।
আমি পড়তে যেতাম কোচিনে। এই কোচিন ভারতের দক্ষিণের সমুদ্রতীরের কোচিন নয়, বিরুদার কোচিং ক্লাস। সব সাবজেক্ট সব ক্লাসের ছাত্র ছাত্রীর মহামিলনের সাগরতীর। স্যার বাইরে গিয়ে ফোন কানে দিয়ে বিড়ি খেত। আমরা এ ওর চুল টানতাম। তারপর অঙ্ক করতাম। হাই উঠত। পাশের বাড়ির টিভিতে বাংলা সিনেমার গান হত। আমি হাতের মুঠোয় খপ করে মশা ধরে ডানা কেটে ছেড়ে দিতাম অঙ্ক খাতার ওপর। মশার সরু সরু ঠ্যাং বানরের তৈলাক্ত বাঁশের পাটি গণিত, পনেরোর নামতার ফাঁকা ঘর, দশমিকের টিপ পরা সংখ্যা পার হয়ে যেত।
তখন আসল ভয় ছিল মার খাওয়া। ভুলভাল নামতা বললেই হাতের তালুতে স্কেলের বাড়ি পড়ত। তবে সেটা কতবেলের আচারের মত রোজকার রুটিন ছিল বলে ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যেতাম না। তবে একেক দিন ডোজ বেশি পড়ত। সেদিন রাতে সংখ্যাগুলো লিকলিকে সরু হয়ে নাচ করত স্বপ্নে। স্বপ্ন দেখতাম মুখস্থ অঙ্কের একটাও আসেনি।
ঝাড়া মুখস্থকরে ফাইভ অবধি হল। সিক্স থেকে সেকেন্ডারি স্কুল। ওখানে আসল খেল শুরু। এতদিনের চেয়ে একটু কঠিন হল সিলেবাস। বইয়ের অঙ্কের বাইরে প্রশ্ন আসতে শুরু করল পরীক্ষায়। সে যে কী বিভীষিকা! ফাইভে বরুণ স্যার অঙ্ক নিতেন। বোর্ডে ঝটঝট করে করতেন একের পর এক অঙ্ক। টুকে শেষ করার আগেই একরাশ ধুলো উড়িয়ে বোর্ড মোছা হয়ে যেত। সামনের বেঞ্চের ছেলে মেয়েগুলো টপটপ করে করে ফেলত। আমরা ঘসটাতাম। কিছুই ঢুকত না মাথায়। শেষে স্যার ফার্স্ট বয় সেকেন্ড বয়ের খাতা আমাদের দিয়ে বলতেন, “দেখে বুঝে নাও।”
কী আর বুঝব, টুকে নিতাম। সেটাই তো আর পরীক্ষায় আসবে না। ফলে পেনের পেছন দিয়ে মাথার খুশকি চুলকোনো ছাড়া কোনই উপায় থাকত না। ছু মন্তর ম্যাজিক মনে হত অঙ্ককে। পরে জেনেছি অঙ্ক শব্দের আরেকটা মানে কোল। অঙ্ক যেন চাইত ই না আমরা তার অঙ্কে বসি। পরীক্ষার সময়ে বুঝতেই পারতাম না কোন অঙ্ক কোন পদ্ধতিতে শুরু করব। কাটাকাটি করে খাতা পেনের কালির আলপনায় ভরে উঠত। একদিকে ‘রাফ ‘ লিখে হিজিবিজি করে রাখতাম। খাতাটা দেখতে বিয়েবাড়ির এঁটো শালপাতা ফেলার স্তূপের মত লাগত। তার পাশে স্যারের চাকু চালানো লাল কালির কাটাকুটি। যেন গলগল করে রক্ত ঝরছে। পাশে অবশ্য একটা করে রসগোল্লা। শূন্যগুলোকে আমার রসগোল্লার চেয়েও বুদবুদের মত লাগত বেশি। হাত দিলেই টুকরো টুকরো হয়ে ভ্যানিশ হয়ে যাবে।
ক্লাস সিক্সে অঙ্কে ফেল। প্রথম লাল কালি রেজাল্টে। দুমদাম পড়ল ঘাড়ে পিঠে। পিঠেই পড়ত। পজিশন চেঞ্জ করতে গিয়ে এলোমেলো পড়ে গেল।
সেভেন থেকে আবার নতুন আপদ, বীজ গণিত। বীজ কলা খেতে আমার কোনো দিন ভালো লাগে না। বীজগণিতও তেমনই একটা কিছু হবে। এতদিন a b c x এসব ইংরেজির সম্পত্তি বলে জানতাম। অঙ্কেও জবর দখল আছে এদের এবার বুঝলাম। আর কীসব ফর্মুলা। মুখস্থ করলাম, কিন্তু কোথায় কীভাবে কাজে লাগাতে হবে হরিই জানে। হরি, আমাদের ফার্স্ট বয়।
সেভেনের মাঝামাঝি থেকে আপনাকে পেলাম। অন্য কোন একটা স্কুল থেকে এলেন। রোগা ছিপছিপে। গম্ভীর মুখ দেখে চোখের সামনে ভয়ে শুধু জিরো ঘুরতে থাকে, শূন্যের বুদবুদ।
ব্ল্যাক বোর্ডে চক দিয়ে একটা অঙ্ক দিয়েছিলেন প্রথম দিন।
সমাধান করো: (a-k)(b-k)…..(z-k) =?
বাপরে, এ যে বিরাট গুণ। দূর, সকালে শুরু করলে বিকেল গড়িয়ে রাতের রুটির আটা মাখার টাইম হয়ে যাবে।
আপনি হাসছেন? আরে তেমনিই মনে হচ্ছিল।
অঙ্ক না করে জানলার বাইরে গাছের ডালে আটকে থাকা সাদা মেঘ গুনছি, হঠাৎ সামনে আপনি। চশমার ভারী কাঁচের আড়ালে এত্তো বড় বড় চোখ।
-“শুরু করো।”
ঢোক গিলে গুণ করতে লাগলাম। k এর স্কোয়ার মাইনাস ab , দূর ছাই তারপর প্লাস হবে না মাইনাস। দুপা এগোনোর পরই বাম্পার। কপালে, চুলের ফাঁকে বিনবিনে ঘাম।
আপনার কাঁচের আড়ালের চোখে হাসি।
খাতাটা তুলে নিয়ে লাল কালির কলমে সলভ করতে লাগলেন,
(a-k)(b-k)…..(k-k)….(z-k)
=(a-k)(b-k)….0…(z-k)
=0
যাহ তেরি অঙ্ক শেষ! আমি মস্ত হাঁ করে চেয়ে রইলাম।
–কোনো কিছুর সঙ্গে শূন্য গুণ করলে সবটাই শূন্য হয়।
–ও।
–খুব কঠিন?
–না।
সত্যিই খুব কঠিন লাগল না। মেলায় কেনা পেরেকের মতন। একটা প্যাঁচ বুঝতে পারলেই পরপর একটার পর একটা লেগে গিয়ে শিকল হয়ে যায়।
–এরকম সহজ ভাবলেই সহজ।
আমি সেদিন বাড়ি ফিরে অঙ্ক বই আর অঙ্কের মানে বই নিয়ে বসলাম। টোকার জন্য নয়। প্রথমবার, বোঝার জন্য। পড়ে। বুঝতে লাগলাম স্টেপগুলো কেন হল। দিমাগকি বাত্তি জ্বলে ওঠা বলব না, তবে অল্প অল্প করে দরজার ফাঁক দিয়ে আলো আসতে লাগল।
না, এর পরেও আমি অঙ্কে বিশারদ হলাম না। মুখস্থই করতাম। কিন্তু বুঝে। আর সত্যি কথা, একটু ঘুরিয়ে অন্য রকম প্রশ্ন আসলে পেন চুষতাম না আর।
ওই এক দিন ছাড়া এমনিতে খুব যে মনোযোগ আপনি দিতেন, তা নয়। ক্রমশ আপনার ধৈর্য কমছিল হয়ত। প্রথম দিকে ধরে ধরে বোঝাতেন। তারপর যখন দেখলেন খুব বেশি হেরফের হচ্ছে না, সকলের চোখে খুব উৎসাহ ফুটছে না,আস্তে আস্তে আপনিও বাকিদের মত হয়ে গেলেন। কিন্তু আমি জানি, ওই একটা দিনের ওই এক টুকরো ফুলকি আমার মধ্যে এক বিন্দু হলেও চকমকি জ্বেলেছিল। হয়ত অঙ্ক জীবনের ধ্যান জ্ঞান হয়নি। কিন্তু শূন্যের বুদবুদগুলো একে একে ফেটে গিয়েছিল ফট ফট করে।
অঙ্কের সঙ্গে শেষ মোলাকাত মাধ্যমিক পরীক্ষায়। তারপর কলেজে আমি আর্টস নিয়ে পড়লাম। বাংলা অনার্স। এরপর চাকরির জন্য এটা ওটা পরীক্ষা। কিন্তু সবেতেই অঙ্ক! পারিও না! কিন্তু পেছন ছাড়বেই না এই অঙ্ক!
শুরুতে বললাম না, একটা বৃত্ত হবে আমার গল্পে। আঁকতে আঁকতে শেষে এসে গেছি। এবার মিলবে, দেখুন। চাকরি বাকরি না পেয়ে আমি এখন ট্যুইশনি করি। সব বিষয় একসঙ্গে। হ্যাঁ, নীচু ক্লাসে অঙ্কও। এখানেই দুম করে সেই খাদ এসে দাঁড়ায়, যার ভেতরে ঝুল পড়া অন্ধকার, আর সেখানে শুকনো কঙ্কালের মত কাঠি কাঠি হাত পা নিয়ে সংখ্যাগুলো ঝোলে। আমিও তো মানে বই থেকে মুখস্থই করাই। একটা ছেলে খুব ভালো জানেন। ও প্রশ্ন করে। আমি তো ওর জানার খিদে মেটাতে পারিনা। অথচ ওর পয়সা নেই ভালো গাইড নেবার। আর স্কুলের যে গল্প ও বলে… কী বলি বলুন তো, সকলেই যে তাতে সমর্থন জানায়, আপনি, হ্যাঁ, আপনি নাকি ক্লাসে এসে এখন একটা অঙ্ক কোনোরকমে করে ঘণ্টা পড়লেই চলে যান। পরে বুঝতে গেলে ভাগিয়ে দেন।
আপনি তো পারেন দিদি, আমি জানি। তবে কি ক্লান্তি? একই বোধহীন সিলেবাস, একই পরিকল্পনাহীন শিক্ষানীতিতে কি আপনারা ক্লান্ত হয়ে যান? আর সংখ্যাগুলো তাদের হাজার কোটি রহস্যময় সম্ভাবনা নিয়ে ঝুলতে থাকে নাগালের বাইরে!
ক্ষমা করবেন দিদি। হয়ত ধৃষ্টতা হল। তবু একটি বার আমাদের সামনে মোমবাতিটা জ্বালান না দয়া করে। আমি আপনার কাছ থেকে অঙ্কের চেয়েও বেশি শিখেছি চেষ্টা। রবার্ট ব্রুসের মাকড়সার মত পড়ে গিয়েও ওপরে ওঠার যে মন্ত্র আপনি গেঁথে দিয়েছিলেন, সেটা আজও আমার পাথেয়। হয়ত অঙ্ক শিখিনি ভালো, কিন্তু একটার পর একটা চাকরির পরীক্ষা দিয়ে হেরে হেরে যদি একটিবার জিতি, জীবনে যদি সত্যিকারের দাঁড়ানোর মাটি পাই,ওই যে ছেলেটা যার চোখে হাজার কৌতূহল তার জন্য আলো খুঁজে এনে দেব। হ্যারিকেনটা তুলে ধরব যাতে সে জানার পথের সন্ধান পায়।মুখস্থ করে অঙ্ক করে পাশ নম্বর তুলে বাবার কষ্টের পয়সার উসুল না হয় তাদের।
আমি যদি সেদিন আপনার সামনে নিজের পরিচয় দিয়ে সাহায্য চাই, এই লাস্ট বেঞ্চের অযোগ্য ছাত্রকে ফেরাবেন না তো দিদি?
প্রণাম নেবেন।
ইতি,
কোনো এক বছর পাশ করা কোনো এক ছাত্র।
পেশায় শিক্ষিকা। নিবাস দমদম। মূলত নিবিড় পাঠক। রঙের বাহারে প্রকৃতির ছবি আঁকা এবং কলমে ভাবনাকে রূপ দেওয়া তার প্যাশন। বাংলা লাইভ, শারদীয়া সহজিয়া পত্রিকা, বিষাণ শারদীয়া সংখ্যা, ঋত্বিক ওয়েবজিন, অভিব্যক্তি শারদ পত্রিকা, কাশফুলের বার্তা, পাঁচ মাথার মোড় ওয়েবজিন, শনিবারের আসর শারদীয়া পত্রিকা, দক্ষিণের জানালা ই-ম্যাগ ইত্যাদি বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত।