| 21 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গণিত সংখ্যা: ক্যাবলা এবং যাদবচন্দ্র । সংগ্রামী লাহিড়ী

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

ক্যাবলা থলি হাতে মাছের বাজারে এসেছে। ডিসেম্বর মাস। সবে অল্প অল্প ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। এই সিজন চেঞ্জের সময় ক্যাবলার বাবা ঠান্ডা লাগিয়ে ফেলেছেন। নাক দিয়ে অনবরত জল পড়েই যাচ্ছে। রানিং নোজ। দেখেশুনে ক্যাবলা বাবাকে বাড়িতে বিশ্রাম নিতে বলেছে। আজকের বাজারটা সেই করে দিতে পারবে। বাবা যদিও সন্দিহান, “মাছ কিনতে পারবি তুই?”

মাছের বাজারে যেতে ক্যাবলা মোটেই ভালোবাসে নাতবে সেটা লুকিয়ে রেখে বাবাকে আশ্বস্ত করে, “কী আর এমন হাতিঘোড়া ব্যাপারনা হয় তোমার চেনা মাছওলার কাছেই যাব। ওই যেযার কাছে তুমি রোজ মাছ কেনো।

বাবা শুধরে দেন, “মাছওলা নয়মেছুনি। খাসা সব মাছ আনে শান্তি ওর দেশগাঁয়ের ভেড়ি থেকে। আমার নাম করিসভালো মাছ বেছে দিয়ে দেবে।

সে বিশ্বাস ক্যাবলার আছে। বাবার সঙ্গে বাজারের তাবৎ দোকানির বন্ধুত্ব। সেরা জিনিসটিই তারা দেবে।

অতএবপিতৃবলে বলীয়ান হয়ে ক্যাবলার বাজারে আগমন।

শান্তির মাছের দোকানের দিকে পা বাড়াতে যাবেদেখল ঘোর অশান্তি বেধেছে। মাছের ব্যাগ হাতে চশমাপরা এক ভদ্রলোক তুর্কি নাচ নাচছেন।

কীইইইইযতবড় মুখ নয়ততবড় কথাজানিসআমি কে?”

জানতি বয়েই গেচে আমার।” শান্তি অগ্রাহ্যে ঠোঁট ওল্টায়। ওগো বাবুতুমি ওই ওধারে গিয়ে লাপাও দিনিএকানে ভিড় কোরোনাকো। দ্যাকো দিকিকত মানুষ ডেঁইড়ে আচে?”

তুড়ুক লাফ আরও বাড়ল, “উঁহুতুই আমায় ঠকিয়ে নিবিসেটি হবে না। মাছের দাম আমি হিসেব করে তবে তোকে পয়সা দেব।

মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে শান্তি হাত নাড়ে, “হিসেবই তো বোজো নাএতটি সময় নষ্ট করেও কি ঠিক ঠিক দাম কষতে পাল্লেআমি যা বলনুঐটেই মাচের দাম। মিটিয়ে দিয়ে বিদায় হও দিকি?”

ব্যাসআগুনে যেন ঘি পড়ল। চিড়বিড়িয়ে জ্বলে উঠলেন, “আমি হিসেব বুঝি নাআমি হলুম গে অঙ্কের প্রফেসরদুবেলা কলেজে অঙ্ক করাই। কোন সাহসে তুই আমায় বলিস আমি ভুল দাম কষেছি?”

এবার দুয়েকজন এগিয়ে আসেন, “ও দেবুদাহলটা কীএত চিৎকার কীসের?”

শান্তিও এবার বঁটি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কোমরে আঁচল গুঁজেছে। চিচকার কীসেরআমি বলি তবেশোন বাবুরা। টাটকা ভেটকিটি দেকে এই বাবুর ইচ্ছে হল কিনবে। তা দেকেশুনে ভালো মাচই কেটেকুটে দেলাম। দাম জিজ্ঞেস করতি মুকে মুকে হিসেব করে বলেও দেলাম। ও মানোকের ভালো কত্তে নেই দেকচিতকোন থেকে নেইপ্যে যাচ্চে গোআমি নাকি ভুল দাম বলিচি!”

থলি হাতে নাচতে নাচতে দেবুদা আবার চেঁচালেন, “একশোবার ভুলদুশোবার ভুল। সাড়ে ছশো টাকা কেজির মাছ এক কেজি চারশো পঁচাত্তর গ্রাম কিনলে নশো আটান্ন টাকা হয়কক্ষনো নাআমায় ঠকাবি তুইজানিসআমি অঙ্কের প্রফেসর?”

শান্তি মুচকে হাসে, “নশো আটান্ন টাকা পঁচাত্তর পয়সা হয় গো বাবুওই পঁচাত্তরটি পয়সা তোমায় আমি ছাড় দিচি। ট্যাকাটা দিয়ে যাও দেকি একান থেকিদিক কোরো না।

লোকজন বুঝিয়ে বাঝিয়ে তাঁকে বাড়ি পাঠায়, “মেছুনির হিসেবে ভুল হয় না দাদাবাড়ি যানগিয়ে নাহয় একবার অঙ্কটা কষে মিলিয়ে নেবেন।

গজগজ করতে করতে দেবুদা থলি হাতে অদৃশ্য হন।

ক্যাবলা এতক্ষন থ‘ হয়ে শুনছিল। অঙ্কে ভালো বলে তার মনে মনে একটু গর্ব আছে। কিন্তু নিমেষের মধ্যে এই কূটকচালি হিসেব তার দ্বারা হবে নাতাহলে আর কী অঙ্ক শিখল সেমাছ কেনা হল বটেকিন্তু মনের মধ্যে বিঁধে রইল কাঁটা।

বিকেলে চাটুজ্যেদের রকে এসে সে তার মনোদুঃখ জানায়। হাবুল সেন তড়বড়িয়ে বলে, “মেছুনিগো লগে পাল্লা দেওনের কথা মনেও ভাবস না। চোহের পলক পড়নের আগেই অরা হিসাব কইরা ফেলে গিয়া।

দিনের পর দিন শিঙিমাছ খেয়ে বেঁচে থাকা প্যালা জিজ্ঞেস করে, “কী মাছ কিনলি?”

ক্যাবলার মায়া হয়। বলে, “ভেটকিই কিনলাম। একটু বেশি করে। ঠাকমা ফ্রাই বানিয়ে সবাইকে খাওয়াবে বলছিল। তা তোর জন্যে নাহয় মা পাতলা করে ঝোল করে দেবে। ভাবিস নে।

টেনিদা এতক্ষন চুপচাপ ছিল। অঙ্কে সে বরাবর ফেল করে। বহু বছরের ট্র্যাক রেকর্ড তারইসকুলে আজ পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারেনি। এবার মুখ খোলে, “যাদবচন্দ্র।

না নাযাদব মাছওলাকে কেউই পছন্দ করে না। পচা মাছ চালিয়ে দেয়। আমি গেছিলাম শান্তি মেছুনির কাছে!” ক্যাবলা শুধরে দেয়।

টেনিদা এবার হাতটা তোলেমাথায় গাঁট্টা পড়ার আগেই ক্যাবলা সুড়ুৎ করে সরে যায়। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে হাবুলের মাথায় গাঁট্টা গিয়ে পড়ে। হাবুল উঃ করে ওঠে। সেই ফাঁকে টেনিদা জ্বলন্ত চোখে ক্যাবলার দিকে তাকায়, “যাদবচন্দ্র চক্কোত্তির নাম শুনিসনিকীসের ভালো ছেলে তুইঅ্যাঁবলিপাটিগণিত শিখতে গেলে যে চক্কোত্তি মশাইই ভরসাজানিস তা?”

ক্যাবলার এবার মনে পড়েছে। বাবার কাছে শুনেছে বটে যাদব চক্রবর্তীর পাটিগণিতের বইয়ের কথা। তবে সে বই চোখে দেখেনি কখনো।

সে কথা বলতেই টেনিদা বলে, “চিন্তা কীআমার কাছ থেকে নিস। ওই বই থেকেই আমি অঙ্ক শিখেছি কিনা!”

তুমিযাদব চক্রবর্তীর বই?” ক্যাবলার চোখ গোল গোল হয়ে গেছে।

টেনিদা মাসল ফোলায়, “নয়তো কীও বইয়ের সব অঙ্ক আমার জলভাত। তোকেই দিয়ে দেবোখন বইটা। তোর কাজে লাগুক। এই তো অঙ্ক শেখার বয়েস!”

সেইমত পরের দিন টেনিদা তার বাড়ি থেকে নিয়ে আসে লাল মলাটের পাটিগণিত বই। ভেতরে যাদবচন্দ্র চক্রবর্তীর সাদাকালো ছবি। বইটাকে মাথায় ঠেকিয়ে পেন্নাম করে ক্যাবলা তার মাথার কাছে রাখে। কাল থেকেই অঙ্ক কষা শুরু করবে।

মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে যায়। কে যেন তাকে ধরে নাড়াচ্ছে। চোখ খুলে দেখে যাদব চক্কোত্তি মশায়। নাকের তলায় মোটা গোঁফগোলগলা ফতুয়া পরা। ছবিটা একবার দেখেই মনে থেকে গিয়েছিল। চিনতে কোনোই অসুবিধে হয় না।

ভক্তিভরে পায়ের ধুলো নেয় সে। স্যারআপনি?”

বাঁচালি বাবা আমায়।” চক্কোত্তি স্যার মাথায় দুহাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন। টেনির বাড়িতে সেই কবে থেকে বন্দী হয়ে আছি। ব্যাটা একবর্ণ অঙ্ক বোঝে না। এমন বাড়িতে আমি কী করে থাকি বলকী কষ্টটাই না পেয়েছি এতকাল!”

তবে যে বলল স্যারআপনার সব অঙ্ক নাকি টেনিদা করে ফেলেছে?” ক্যাবলা বাজিয়ে দেখতে চায়।

তুইও যেমন,” চক্কোত্তি স্যার একটু উচ্চাঙ্গের হাসি হাসেন, “মিথ্যে কথার জাহাজ। বইটাই খোলেনি কোনোদিন। তা তুই বাবা আমার সব অঙ্কগুলো মন দিয়ে করিস। বহুদিন হয়ে গেলকেউই আর আমায় নিয়ে মাথা ঘামায় না।

ক্যাবলা তড়িঘড়ি বলে ওঠে, “আমাদের তো স্যার কে সি নাগএর বই থেকে অঙ্ক করতে হয়তাই আর আপনাকে…”

কী বললিআবার বল দেখিকে সি নাগমানে সেদিনের ওই কেশব ছোঁড়াও আবার অঙ্ক শিখল কবে?”

ক্যাবলা কী বলবে ভেবে পায় না। কে সি নাগের পুরো বই শেষ করেছে। এর জন্যে স্কুলের অঙ্ক স্যার তাকে একটু বিশেষ রকম ভালোবাসেন।

যাদব চক্কোত্তি তার মনের কথা যেন পড়ে ফেলেন।

কে সি নাগের বই তো গুলে খেয়েছিসতাও তো ওই মেছুনির হিসেবটা করতে পারলি না?”

ক্যাবলা চুপ। এ লজ্জা যে তারও।

চক্কোত্তি মশায় বলে চলেন, “পারবি কী করেকেশব তোদের কী অঙ্ক শিখিয়েছেনাতেলচপচপে বাঁশ বেয়ে বাঁদরের ওঠানামা। বলিএমন বাঁদর কোনোদিন ধরাধামে দেখেছিস যে তেলমাখানো বাঁশে চড়তে চায়?”

ক্যাবলা ঘাড় নাড়ে। নাঃবরং বাঁদর তার হাত থেকে বাদামের ঠোঙা নিয়ে মুহূর্তে হাওয়া হয়ে যায়। ওঠানামার কোনো প্রশ্নই নেই।

যাদবচন্দ্র বলেন, “তারপর দেখচৌবাচ্চার থেকে জল ঢোকা আর বেরোনোর অঙ্ক। চৌবাচ্চায় দুটো নলএকটা দিয়ে জল ঢুকছেএকটা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ রেতোর বাড়ির চৌবাচ্চা এমন খুলে রাখতে কোনোদিন দেখেছিস?”

ক্যাবলা এবার চটপট উত্তর দেয়, “চৌবাচ্চাহুঁহজলের কল খুলে রাখলেই বাবা কানমলা দেয়। জল অপচয় করা অপরাধ। পৃথিবীতে জলস্তর হু হু করে নিচে নেমে যাচ্ছেকিছুদিন পর…”

সে আমি জানি।” যাদবচন্দ্র হাত তুলে থামান, “ভয়াবহ জলসঙ্কটে পড়বে মানুষ। ঐরকম ভাবে চৌবাচ্চা থেকে জল বেরিয়ে যেতে দেয় কেউছিঃ!”

কে সি নাগ বলে বলে আউট হচ্ছেনএবার ক্যাবলার একটু মায়া হয়। বলে, “কিন্তু স্যারছেলেদেরকে বাবার বয়েস বার করতে কিন্তু কেশব নাগ মশাইই শিখিয়েছেনএটা তো মানবেন?”

বাবার বয়েস জেনে তোর কী হবে রে ছোঁড়া?” যাদবচন্দ্র গর্জে ওঠেন। তারপর সে অঙ্ক ভুল করলে ছেলের বয়েস বেরোবে বাবার চেয়ে বেশি। দেখেছি তো তোদের অঙ্কের খাতা। জানতে আর বাকি নেই!”

অ্যাঁ?” ক্যাবলা ভড়কে গেছে।

মুদি তার চালে কাঁকর মেশাচ্ছেগোয়ালা দুধে মেশাচ্ছে জলএসব কালোবাজারি নিয়ে অঙ্ক বানানোর কী আছেসুকুমারমতি বালকবালিকাদের মনের ওপর কুপ্রভাব পড়বে না?” যাদবচন্দ্র উত্তরোত্তর চটছেন।

ক্যাবলা এবার হাল ধরে। কেশব নাগের অন্ধ ভক্ত সে। তাঁকে গালি দিলেই হলচটপট বলে, “কিন্তু স্যারকে সি নাগই কিন্তু মেছুনির হিসেবটা ঠিকঠাক করতে পারতেনজানেন তো?”

সে কীশুনিনি তো?” যাদবচন্দ্র থমকেছেন।

ক্যাবলা সেই ফাঁকে শোনায়, “সেদিন হোয়াটস্যাপে এলতাই জানলাম। কেশব নাগ তখন ছোটগঙ্গার পারে গেছে বেড়াতেদেখছে ইলিশের আড়তদারের সঙ্গে দালালের দরদাম চলছে। ইলিশের মণ দেড়শো টাকা হলে একটা আড়াইসেরি ইলিশের দাম কত পড়বেদুজনে হিসেব নিয়ে মাথা চুলকোচ্ছে। কেশব ঝটপট বলে দিল,’ন’টাকা ছ’আনা‘!”

সত্যি নাকি রে?” যাদবচন্দ্র শুধোন।

সত্যি মিথ্যে জানিনে স্যার। সত্যি হওয়া খুবই সম্ভব। তবে এটুকু কিন্তু জানিকেশব নাগ ছাত্রদের সবসময় বলতেন পাটিগণিত দিয়ে অঙ্ক সমাধান করতে। বীজগণিত নয়। তাতে যুক্তিবোধ বাড়ে।

সে তো এক্কেবারে ঠিক কথাসেজন্যেই তো আমার বইখানা…”

সেকথাই তো বলছি স্যারআপনার শিক্ষাকেই তো তিনি এগিয়ে নিয়ে গেলেন। মিত্র ইনস্টিটিউশনে যাঁরা তাঁর কাছে অঙ্ক শিখেছেনতাঁরা সব্বাই পাটিগণিতে দড়আর সে অঙ্ক ভালোবেসে করেছেন।

বাঃ বাঃছোকরা তো তাহলে মন্দ কাজ করেনিভালো করলি আমায় এগুলো জানিয়ে। পরলোকে সবসময় সব খবর তো এসে পৌঁছয় না!”

তবে আমি স্যারআপনার বইখানা শেষ করবইআর শান্তির সঙ্গে মুখে মুখে মাছের দাম কষে প্র্যাক্টিস করব। এই প্রতিজ্ঞা করলাম।” ঢিপ করে আরেকখানা পেন্নাম ঠোকে।

যাদবচন্দ্র চক্রবর্তী মাথায় হাত রাখেন, “এই তো চাইলড়ে যা!” পরমুহূর্তেই অদৃশ্যঘরে কেউই নেই।

ক্যাবলার বাড়ির লোক বেশ অবাককারণ ক্যাবলা আজকাল বাবাকে আর মাছের বাজারে যেতে দেয় না। নিজেই মাছ কিনতে যায় রোজ। শান্তি মেছুনিও ভারি খুশি। সকালের দিকটায় দোকানে বড্ড ভিড় থাকে। একা হাতে সে সামলে উঠতে পারত না। এখন ক্যাবলা তার ঢের সুবিধে করে দিয়েছে। শান্তি মাছ ওজন করেক্যাবলা পাশে দাঁড়িয়ে মুখে মুখে দামের হিসেবগুলো কষে দেয় ঝটপট। খদ্দেরও খুশি। বিক্রিবাটা বেড়েছে বেশ। মাঝে মাঝেই শান্তি আদর করে ক্যাবলার ব্যাগে পছন্দসই মাছ বেশি করে ঢুকিয়ে দেয়। টেনিদাহাবুলপ্যালাও সে মাছের ভাগ থেকে বঞ্চিত হয় না।

One thought on “গণিত সংখ্যা: ক্যাবলা এবং যাদবচন্দ্র । সংগ্রামী লাহিড়ী

  1. বাহ! চমৎকার লেখা তো।
    ‘পরবাসে’ আপনার লেখাগুলির লিঙ্ক কি পাওয়া যেতে পারে?
    পড়াতাম আর কি ,এই যা ।
    ধন্যবাদ।

    হীরক সেনগুপ্ত

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত