ইরাবতী গীতরঙ্গ গণিত সংখ্যা : অঙ্ক। সুজয় দত্ত
“যত দিন যাচ্ছে, আরো যেন গাধা হয়ে যাচ্ছিস!”
যাকে বলা হল কথাটা, তার মাথা নিচু, চোখ মাটির দিকে, ঠোঁট কাঁপছে একঘর সহপাঠীর সামনে মারধোর খাওয়ার
আশঙ্কায়। এই স্যারকে যমের মতো ভয় করে ক্লাসের ফার্স্টবয় থেকে লাস্টবয় অবধি সবাই।
“বলে বলে মুখ ব্যথা হয়ে গেল, ইক্যুয়েশনের এক দিক থেকে আরেক দিকে কোনো সংখ্যা বা রাশিকে নিয়ে গেলে তার চিহ্ন বদলে যায় — প্লাস হয়ে যায় মাইনাস আর মাইনাস হয় প্লাস। দু–কানের মাঝখানটা কি এক্কেবারে ফাঁকা তোদের?” এই শেষের প্রশ্নটা অবশ্য বেঞ্চের ওপর কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছেলেটির জন্যই শুধু নয়, ক্লাসের সকলের উদ্দেশে। আজ ক্লাসশুদ্ধ সবাই কাঠগড়ায়। দু–চারজন ছাড়া প্রত্যেকেই ডুবিয়েছে হাফ–ইয়ার্লির অঙ্ক পরীক্ষায়। আজ সেই নম্বর বেরোবার দিন।
“আর দুম করে সমানচিহ্নের দুদিকে বর্গমূল বসিয়ে দিলেই হয়ে গেল? পজিটিভ না নেগেটিভ দেখার দরকার নেই?” স্যারের রাগ যেন আজ কিছুতেই পড়ছে না। সবাই তটস্থ। সামনের রো ছেড়ে এবার পিছনের বেঞ্চের দিকে এগোন তিনি।
“এই যে সুরজিৎ, ডেস্কের ওপর উটপাখির মতো হাতে মাথা গুঁজে বসে থাকলেই ভাবছিস আমি দেখতে পাব না, তাই না? ওঠ, উঠে দাঁড়া!” ফ্যাকাশে মুখে কোনোরকমে উঠে দাঁড়ায় সে।
“এটা অঙ্ক পরীক্ষা, না জেনারেল নলেজের? শুধু শ্রীধর আচার্য নামটা মুখস্থ করে লিখে দিলেই হয়ে গেল? দ্বিঘাত সমীকরণটা সল্ভ করতে হবে না? নাকি সেটা তোর হয়ে আমি করব?”
এভাবে মিনিট চল্লিশেক ত্রাসের রাজত্ব চলার পর সকলের কাঙ্ক্ষিত শব্দটা শোনা গেল। ছুটির ঘন্টার শব্দ। এটাই আজকের শেষ পিরিয়ড। উশখুশ করে ওঠা ক্লাসের দিকে শেষ একবার অগ্নিদৃষ্টি হেনে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে এলেন তিনি, করিডোর ধরে হাঁটা লাগলেন গেটের দিকে।
গেটের বাইরেই বেশ কিছু সাইকেল–রিক্সা দাঁড়িয়ে থাকে এই সময়। রিক্সায় বাড়ি পৌঁছতে কুড়ি–পঁচিশ মিনিট।
“ও মাস্টারবাবু! মাস্টারবাবু! এই যে, এদিকে —“
বড়রাস্তার মোড়ে রিক্সা থেকে নেমে বাড়ির ঘুপচি গলিটার দিকে হেঁটে যেতে যেতে কার যেন ডাক শুনতে পেলেন অভয়বাবু। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন বাঁদিকের নর্দমার পাশের খুপরি দোকানঘরগুলো থেকে কয়েকজন হাত নেড়ে ডাকছে।
“কী ব্যাপার?” কৌতুহলবশতঃ এগিয়ে যান তিনি। পান–বিড়ি–সিগারেটের দোকানদার সুবল বলে ওঠে,
“ইস্কুল অইতে আইজ এত দেরিতে ফিরতাসেন যে?”
“লাস্ট পিরিয়ডে ক্লাস ছিল, তাই। কী হয়েছে কী?”
“না, তেমন কিসু নয়, আপনারে কইতেও কেমন লাগে, কিন্তু আইজ আর না বইল্যা পারতাসি না –“
“আরে দূর বাবা, যা বলার সোজাসুজি বলো।” তাড়া লাগান তিনি।
“অরণি আইজ এক মাসের উপর সিগ্রেটের দাম দেয় না। চাইলে কয় বাবারে কইব, বাবা দিয়া যাবে–“
“সেকি! আমার ছেলে? সিগারেট? কই, আমি তো খেতে দেখিনা কখনও!”
“আইজ্ঞা, রোজই দোস্তগো লগে খাইতে খাইতে এহান দিয়া যায় বেলার দিক্যা, আপনে তহন ইস্কুলে –“
“তা, এতদিন বলোনি কেন?”
“আপনে আমাগো এ পাড়ার একজন নমস্য ব্যক্তি, আপনারে এইসব ছোটখাটো ব্যাপারে নালিশ করনের –“
“আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে, কত বাকি পড়েছে শুনি।“
পকেটে পুরো বকেয়া মেটানোর মতো যথেষ্ট টাকা ছিল না। যতটা পারেন মিটিয়ে বাকিটা কাল দিয়ে যাবেন — এই আশ্বাস দিয়ে বাড়িমুখো হন তিনি। আশ্চর্য, কোনোদিন গন্ধটন্ধ তো তেমন পান নি ছেলের মুখে! ও হ্যাঁ, মাসকয়েক হল খুব পানমশলা আর মৌরি খাওয়া ধরেছে। সেটা তাহলে গন্ধ চাপা দেওয়ার জন্য? আর তিনি স্কুলে থাকাকালীন যদি “দোস্তগো লগে” সিগারেট টানতে টানতে পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়, তাহলে কলেজ যায় কখন? কীভাবে এইসব প্রশ্নের ফয়সালা করবেন ছেলের সঙ্গে আজ, সেটা ভাবতে ভাবতে বাড়ি ঢুকে ওর মায়ের কাছে শুনলেন ছেলে বলে গেছে ফিরতে রাত হবে। কলেজে ‘সোশ্যাল‘ আছে। বাঃ, চমৎকার! সকালে পড়াশোনার সময় কলেজ ফাঁকি দিয়ে রাতের বেলায় ‘সোশ্যাল‘। নাঃ, আজ যত রাতই হোক জেগে থাকবেন ওর ফেরার জন্য। স্কুলের দায়দায়িত্ব নিয়ে বড্ড বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ায় ছেলেটার দিকে আজকাল আর তেমন নজর দেওয়া হয়না। এটা বদলাতে হবে। রাতের খাওয়া রোজই তাড়াতাড়ি সারেন উনি, শুয়েও পড়েন তাড়াতাড়ি। কাঁটায় কাঁটায় ভোর পাঁচটায় ওঠার অভ্যেস। আজও রাত এগারোটা নাগাদ ইজিচেয়ারে শুয়ে বই পড়তে পড়তে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লেন।
“ওঃ, আর কতবার বলব একটা সামান্তরিকের ক্ষেত্রফল দুই বাহুর দৈর্ঘ্যের গুণফল নয়? এই সামান্য জিনিসটা মাথায় ঢোকে না কেন? ছবি আঁকা রয়েছে তো বোর্ডে। এই যে, দ্যাখ, আবার ভাল করে দ্যাখ, কেন সামান্তরিকের ক্ষেত্রফল হচ্ছে ভূমি আর উচ্চতার গুণফল। ঠিক আছে?’
অনেকগুলো কালো কালো মাথা একসাথে নড়ে উঠে “হ্যাঁ” বলল। আবার শেষ পিরিয়ড, আবার সেই ভয়াবহ অঙ্ক ক্লাস। আবার ছুটির ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা।
“আচ্ছা, অ্যাই ইন্দ্রজিৎ, বলতো দেখি, একটা রম্বসের ক্ষেত্রফল তাহলে কীভাবে পাওয়া যাবে?”
শান্তশিষ্ট চেহারার চশমাধারী ইন্দ্রজিৎ ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করছে দেখে তীব্র ভর্ৎসনা ধেয়ে আসে, “ছি ছি! তুই না ক্লাসে ফার্স্ট–সেকেন্ড হোস? অঙ্কে এরকম মাথা নিয়ে প্রতিবছর স্ট্যান্ড করিস কী করে, হ্যাঁ?”
ঠিক এই সময় স্কুলের পিওন নিখিলেশ একটা নোটিসের খাতা হাতে ক্লাসে ঢোকায় ক্ষেত্রফল পর্বে ছেদ পড়ল। ক্লাসের শেষ পাঁচ মিনিট তার সঙ্গে কথোপকথনে আর নোটিসের খাতায় সই করতে করতেই কেটে গেল। নাহলে বোধহয় কপালে আরও দুঃখ ছিল ইন্দ্রজিতের।
সেদিন বাড়ি ফিরে দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখেন ঘিয়ে রঙের খামে একটা চিঠি পড়ে আছে মাটিতে। দু–কামরার একচিলতে ফ্ল্যাট, একটা দোতলা বাড়ির একতলায়। বাড়িওয়ালারা থাকেন ওপরের তলাটায়। অভয়ের নিচের ফ্ল্যাটের দরজায় আড়াআড়ি সরু একটা ফুটো করা। সেখান দিয়েই ডাকপিওন বাড়ি শুদ্ধ সবার চিঠি ফেলে দিয়ে যায়। হাতমুখ ধুয়ে জলখাবার খেয়ে চিঠিটা খুলতেই একটা ধাক্কা। কৃষ্ণনগর থেকে ভাই লিখেছে বেথুয়াডহরির পারিবারিক জমিটার ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে যে জ্ঞাতিতে–জ্ঞাতিতে মামলা চলছিল, তাতে নাকি আদালত অনির্দিষ্টকালের জন্য ইনজাংশন দিয়েছে ওই জমি বিক্রি করা বা ওতে বাড়ি করা নিয়ে। অনেক বছর ধরে ঝুলে থাকা মামলাটার একটা নিষ্পত্তির জন্য কম চেষ্টা করেননি অভয়। শরিকদের ঝগড়া আর পারস্পরিক দোষারোপে বারবার সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। নিজের শিক্ষকতার চাকরি থেকে সংসার খরচ, ফ্ল্যাটভাড়া আর চিররুগ্না স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ দিয়ে যেটুকু সঞ্চয় হয়, তাতে মেয়েটার বিয়ে–থা দেওয়া আর ছেলেটাকে নিজের পায়ে দাঁড় করানো সম্ভব নয়। ওই জমি বিক্রির টাকার ওপর ভীষণভাবে নির্ভর করে আছেন তিনি। সেটা এভাবে ঝুলে রইলে তো —। এমনিতেই বেশ কয়েক বিঘার সেই আয়তাকার জমি থেকে জ্যাঠতুতো–খুড়তুতো দাদা আর ভাইদের ভাগ দিতে দিতে অভয় আর ওঁর ছোটোভাইয়ের জন্য পড়ে আছে একটা ছোটখাটো ট্রাপিজিয়াম। এর মধ্যে আবার পশ্চিমদিকের রাস্তার ধারে ত্রিভুজাকার অংশটায় ভাই একটা কারখানা চালাত বেশ কয়েক বছর ধরে। কৃষ্ণনগরে সরকারী চাকরি পাওয়ার আগে। ওটা ওরই হয়ে গেছে বলা যায়। বাকি রইল একটা কয়েক কাঠার বর্গক্ষেত্র — না না, রম্বস। সেটাও এমন জট পাকিয়ে গেল? সে–রাতে মাথার মধ্যে চিন্তাভাবনাগুলো কেমন জট পাকিয়ে যেতে লাগল অভয়ের। ঘুম এল না সারারাত।
সেবছর ক্লাস নাইনের প্রিটেস্ট পরীক্ষায় ঐচ্ছিক গণিতের প্রশ্নপত্রটা খুব শক্ত হয়েছিল। এমন প্রশ্নপত্র অভয়বাবু ছাড়া আর কারো হাত দিয়ে বেরোবে না। কিছু কিছু ছাত্রের অভিভাবক সেই নিয়ে কিঞ্চিৎ অসন্তুষ্টি বা উষ্মা প্রকাশ করায় টেস্ট পরীক্ষায় ঐচ্ছিক গণিতের প্রশ্ন করার দায়িত্ব দেওয়া হল স্কুলের নতুন অঙ্ক শিক্ষক প্রভাসবাবুর ওপর। কিন্তু ওই বিষয়ের পাঠ্যক্রমে যা যা আছে, সেগুলো পড়ানোর অভিজ্ঞতা অভয়ের মতো তাঁর নেই। তাই ক্লাস নাইনের দুটি বিভাগেই পড়াবার দায়িত্ব অভয়েরই। কিন্তু দেখা গেল তাঁর মতো শিক্ষকও ত্রিমাত্রিক জ্যামিতি বা কনিক সেকশন্সের মতো বিষয়গুলো ছাত্রদের মাথায় ঢোকাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ছেলেগুলো শখ করে অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে অঙ্ক নিয়ে এখন টেস্ট পরীক্ষার আগে দিশাহারা। বৃত্ত, পরাবৃত্ত, অধিবৃত্ত, উপবৃত্ত — এসব একেবারে ঘেঁটে ঘ হয়ে রয়েছে ওদের মাথায়। অভয় অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে আর হতাশা চেপে রাখতে পারছেন না। স্বভাবসিদ্ধ বিরক্তি ঝরে পড়ছে তাঁর গলায় — “তোরা বাংলা ক্লাসে করিস কী বল তো? শুধুই গল্পগাছা আর সিনেমা নিয়ে আলোচনা? ব্যাকরণের উপসর্গগুলো কি জীবনে পড়িসনি? তাহলে পরা, উপ আর অধিতে এতো গুলায় কী করে?” একদিন তো রেগে গিয়ে সৌতিককে বেশ কয়েক ঘা ডাস্টারের বাড়ি মেরে বললেন, “বল বাড়িতে কী খাস। ডিম্ খাস, ডিম্? কাপে করে দুধ–হরলিক্স খাস? এই শেষবার বলছি, আর যেন ভুল না হয় — ডিম্ হল উপবৃত্ত আর কাপ হল পরাবৃত্ত।“
যেদিন এই ঘটনা ঘটেছিল, সেই বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে একটু কেনাকাটা করলেন অভয় বড়রাস্তার মুখের বাজারটা থেকে। কারণ আজ পম্পির জন্মদিন। সবে এম এ–র ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে মেয়েটা। স্নাতক পর্যায়ে বেশ ভাল রেজাল্ট ছিল ওর। নিজের সীমিত সামর্থ্যের দরুণ মেয়ের শখ–আহ্লাদ তো খুব একটা মেটাতে পারেন না। ও নিজেই কয়েকটা ট্যুইশন করে নিজের হাতখরচ চালায়। সংসারে টুকটাক সাহায্যও করে। খুব বুঝদার আর বাস্তবসচেতন মেয়ে, ওর ভাইয়ের মতো একেবারেই নয়। সপ্তাহে তিন দিন বাসে করে অনেকটা দূরে পড়াতে যায় ও। আজও গেছে। ফিরতে ফিরতে সন্ধে। তার আগেই যাতে ওর মা রান্নাবান্না সেরে সবকিছু একদম রেডি করে রাখতে পারেন, তাই লম্বা লম্বা পা ফেলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ঢুকে বাজারের থলি না্মালেন রান্নাঘরে, আর মিষ্টির দোকান থেকে কেনা কালাকাঁদের বাক্সটা লুকিয়ে রাখলেন। কালাকাঁদ পম্পির অতি প্রিয়। ও ফিরলে যথাসময়ে বাক্সটা ওর সামনে মেলে ধরে ওকে চমকে দিতে চান। হাতমুখ ধুয়ে চা–জলখাবার খেয়ে ইজিচেয়ারে খবরের কাগজটা নিয়ে বসলেন অভয়। সকালবেলা স্কুলের তাড়া থাকে বলে কাগজটা খুঁটিয়ে পড়া হয় না।
পড়তে পড়তে তন্ময় হয়ে গেছিলেন, হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে দেখেন প্রায় পৌনে নটা। একী, এত দেরি তো হয়না মেয়েটার? তাহলে কি আজ পড়ানো শেষ করে অন্য কোথাও যাবার কথা? ওর মাকে জিজ্ঞেস করে কোনো সদুত্তর পাওয়া গেল না। বলে যায়নি কিছু। এমনিতে উদ্বিগ্নমনা নন অভয়। ভাবলেন আজ সারা দুপুর আর বিকেল বৃষ্টি হয়েছে দক্ষিণ কলকাতায়, মেয়েটা ওদিকেই গেছে, হয়তো ফেরার পথে যানজটে বাস–টাস আটকে গেছে। রাস্তাঘাটের আজকাল যা অবস্থা। পম্পির টেবিলে গিয়ে দেখে আসেন ও ওর মোবাইল ফোনটা নিয়ে বেরিয়েছে কিনা। বাড়িতে দুটো মোবাইল ফোন — একটা আধুনিক আর একটু দামি, অন্যটা আদ্যিকালের আর চটা–ওঠা। প্রথমটা সারাক্ষণ থাকে পম্পির ভাইয়ের পকেটে। আর মেয়েটার এমনই ভুলো মন, মাঝেমাঝেই নিজের রংচটা ফোনটা বাড়িতে ফেলে রেখে বেরিয়ে পড়ে। যাক, আজ সঙ্গে নিয়ে গেছে। কিন্তু গেলেই বা কী, তার ভাই এখন কোথায় কোন পাড়ায় “দোস্তগো লগে” রাজকার্য করে বেড়াচ্ছে কে জানে? সে বাড়ি না ফিরলে তো ফোনাফুনি সম্ভব নয় মেয়ের সঙ্গে। আবার কাগজে মন দেবার চেষ্টা করেন অভয়, কিন্তু ঠিক পারেন না। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে নটা ছাড়াবার পর স্ত্রী এমন অস্থির হয়ে উঠলেন, পাঞ্জাবিটা গায়ে গলিয়ে রাস্তায় বেরোতেই হল ছেলের খোঁজে। তবে জানিয়ে তো কোথাও যায় না সে, অতএব কোথায়ই বা খুঁজবেন? বড় রাস্তার দিকে কিছুদূর হাঁটতেই অবশ্য দেখলেন সাইকেলে টিংটিং শব্দ তুলে সে উল্টোদিক থেকে আসছে। রাস্তাতেই তাকে থামিয়ে এক ধমক দিয়ে মোবাইল কেড়ে নেন অভয়, টিপতে থাকেন মেয়ের নম্বর। একবার, দুবার, তিনবার। কোনো সাড়া নেই। অজানা আশঙ্কায় একবার বুক কেঁপে ওঠে তাঁর, কিন্তু শক্ত মানুষ তিনি। বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে আর বললেন না যে ফোন করে পাননি। তাহলে আর ঘরে রাখা যেত না ওর মাকে। বললেন আর খানিকক্ষণ বাদে রিং করবেন। এদিকে সওয়া দশটা বেজে গেছে, ছেলে তার মাকে নানাভাবে বোঝাবার চেষ্টা করছে যে বৃষ্টিতে ইস্টার্ন বাইপাস আর সুরেন ব্যানার্জী রোডের আজকাল মাঝেমাঝেই খুব যাচ্ছেতাই জ্যাম হয়, কিন্তু মায়ের মন কি আর ছেঁদো কথায় ভোলে? তিনি স্বামীর কাছে কেঁদে পড়লেন। অভয় মুখে নির্বিকার হলেও ভেতরে ভেতরে অস্থির — স্ত্রীর কাছ থেকে নম্বর নিয়ে মেয়ের কলেজের বন্ধুদের কয়েকজনকে ফোন করতে লাগলেন। তাতে ওর খোঁজ পাওয়া গেলনা ঠিকই, কিন্তু গাঙ্গুলিবাগানে যে ছাত্রীর বাড়িতে পড়াতে গিয়েছিল তাদের নম্বরটা অন্ততঃ পাওয়া গেল। কিন্তু তাতে চিন্তা বাড়ল বই কমলো না, কারণ সেই ছাত্রীর কথা অনুযায়ী তার পম্পিদির প্রায় ঘন্টাতিনেক আগেই বাড়ি পৌঁছে যাওয়ার কথা। সন্ধ্যে সাতটায় বেরিয়েছে সে সেখান থেকে। আর এখন এগারোটা দশ। এবার শুধু একটা রাস্তাই খোলা — পুলিশ।
না, পুলিশে আর ফোন করতে হয়নি শেষ অবধি। পুলিশই করেছিল ফোন। ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছোঁয়ার আগেই। পম্পির ভাইয়ের মোবাইলে। বলেছিল এক্ষুণি বাইপাসের ধারে পিয়ারলেস হাসপাতালে আসতে। কারণ অরুণিমা সরকার এই মুহূর্তে সেখানকার ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। লড়ছে মৃত্যুর সঙ্গে – যুঝছে প্রাণপণে। তার ব্যাগেই ছিল এই ফোন নম্বর। গড়িয়া চৌমাথার মোড়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে জলজমা রাস্তায় গর্তে পা পড়ে গিয়েছিল মেয়েটির, উপুড় হয়ে পড়ে যায় সে। কেউ কিছু করার আগেই এক ঘাতক মিনিবাসের চাকা তার নির্মম বৃত্তে মেয়েটির তন্বী শরীরের সব উপবৃত্ত, পরাবৃত্ত আর অধিবৃত্তকে পিষে দিয়ে চলে গেছে।
মূর্ছিত মাকে কোনোরকমে ইজিচেয়ারে বসিয়ে তীরবেগে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল ছেলে। পাড়ার একজন বন্ধুকে নিয়ে পিয়ারলেসের উদ্দেশে। আর অভয়ের চারপাশটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে এসেছিল, ঘুরে উঠেছিল মাথাটা। পড়ে যেতে যেতে নিজের কাজের টেবিলটাকে কোনোরকমে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন। হাতের ধাক্কায় মাটিতে লুটিয়েছিল বইপত্র। স্কুলের নানা ক্লাসের অঙ্ক বই সব — কে সি নাগ, ভঞ্জ–গাঙ্গুলি, কে পি বসু, দাস–মুখার্জী। তাঁর জীবনের না–মেলা অঙ্কগুলোর নিষ্ঠূর গরমিলের কোনো সমাধানসূত্র তাতে ছিলনা —।
ওহায়োর ইউনিভার্সিটি অফ অ্যাক্রন-এ পরিসংখ্যানতত্ত্বের (statistics) অধ্যাপক। জৈবপরিসংখ্যান বিশ্লেষণতত্ত্ব (biostatistics) তাঁর গবেষণার বিষয়। তিনি কলকাতার বরানগরের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন ছাত্র। কিন্তু তরুণ বয়স থেকেই সাহিত্য তাঁর সৃজনশীলতার মূল প্রকাশমাধ্যম, সাহিত্য তাঁর মনের আরাম। ছোটগল্প, বড় গল্প, প্রবন্ধ ও রম্যরচনার পাশাপাশি নিয়মিত কবিতাও লেখেন। এছাড়া করেছেন বহু অনুবাদ — হিন্দি থেকে বাংলায় এবং বাংলা থেকে ইংরেজিতে। গত পনেরো বছরে আমেরিকার আধ ডজন রাজ্যের বিভিন্ন সাহিত্য-পত্রিকায় ও পুজাসংখ্যায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন হিউস্টনের “প্রবাস বন্ধু” ও সিনসিনাটির “দুকুল” পত্রিকার সম্পাদনা ও সহসম্পাদনার কাজও করেছেন। এছাড়া শিকাগোর “বাতায়ন” পত্রিকাটির জন্মলগ্ন থেকে সেটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছেন। এই তিনটি পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলি ছাড়াও “অপার বাংলা” নামক ওয়েব-ম্যাগাজিনটিতে, “গল্পপাঠ” নামক ওয়েব-ম্যাগাজিনটিতে, “আনন্দলিপি” নামক পত্রিকাটিতে আর ভারতের মুম্বাই থেকে প্রকাশিত “কবিতা পরবাসে” নামক বার্ষিক কাব্যগ্রন্থটিতে রয়েছে তাঁর লেখা। সম্প্রতি নিউ জার্সির “আনন্দ মন্দির” তাঁকে “গায়ত্রী গামার্স স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কারে” সম্মানিত করেছে। সাহিত্যরচনা ছাড়া অন্যান্য নেশা বই পড়া, দেশবিদেশের যন্ত্রসঙ্গীত শোনা ও কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র বাজানো।