Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,gonit sankha geetaranga golpo sujay dutta

ইরাবতী গীতরঙ্গ গণিত সংখ্যা : অঙ্ক। সুজয় দত্ত

Reading Time: 6 minutes

যত দিন যাচ্ছেআরো যেন গাধা হয়ে যাচ্ছিস!”

যাকে বলা হল কথাটাতার মাথা নিচুচোখ মাটির দিকেঠোঁট কাঁপছে একঘর সহপাঠীর সামনে মারধোর খাওয়ার

আশঙ্কায়। এই স্যারকে যমের মতো ভয় করে ক্লাসের ফার্স্টবয় থেকে লাস্টবয় অবধি সবাই।

বলে বলে মুখ ব্যথা হয়ে গেলইক্যুয়েশনের এক দিক থেকে আরেক দিকে কোনো সংখ্যা বা রাশিকে নিয়ে গেলে তার চিহ্ন বদলে যায় — প্লাস হয়ে যায় মাইনাস আর মাইনাস হয় প্লাস। দুকানের মাঝখানটা কি এক্কেবারে ফাঁকা তোদের?” এই শেষের প্রশ্নটা অবশ্য বেঞ্চের ওপর কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছেলেটির জন্যই শুধু নয়ক্লাসের সকলের উদ্দেশে। আজ ক্লাসশুদ্ধ সবাই কাঠগড়ায়। দুচারজন ছাড়া প্রত্যেকেই ডুবিয়েছে হাফইয়ার্লির অঙ্ক পরীক্ষায়। আজ সেই নম্বর বেরোবার দিন।

আর দুম করে সমানচিহ্নের দুদিকে বর্গমূল বসিয়ে দিলেই হয়ে গেলপজিটিভ না নেগেটিভ দেখার দরকার নেই?” স্যারের রাগ যেন আজ কিছুতেই পড়ছে না। সবাই তটস্থ। সামনের রো ছেড়ে এবার পিছনের বেঞ্চের দিকে এগোন তিনি।

এই যে সুরজিৎডেস্কের ওপর উটপাখির মতো হাতে মাথা গুঁজে বসে থাকলেই ভাবছিস আমি দেখতে পাব নাতাই নাওঠউঠে দাঁড়া!” ফ্যাকাশে মুখে কোনোরকমে উঠে দাঁড়ায় সে।

এটা অঙ্ক পরীক্ষানা জেনারেল নলেজেরশুধু শ্রীধর আচার্য নামটা মুখস্থ করে লিখে দিলেই হয়ে গেলদ্বিঘাত সমীকরণটা সল্ভ করতে হবে নানাকি সেটা তোর হয়ে আমি করব?”

এভাবে মিনিট চল্লিশেক ত্রাসের রাজত্ব চলার পর সকলের কাঙ্ক্ষিত শব্দটা শোনা গেল। ছুটির ঘন্টার শব্দ। এটাই আজকের শেষ পিরিয়ড। উশখুশ করে ওঠা ক্লাসের দিকে শেষ একবার অগ্নিদৃষ্টি হেনে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে এলেন তিনিকরিডোর ধরে হাঁটা লাগলেন গেটের দিকে।

গেটের বাইরেই বেশ কিছু সাইকেলরিক্সা দাঁড়িয়ে থাকে এই সময়। রিক্সায় বাড়ি পৌঁছতে কুড়িপঁচিশ মিনিট।

ও মাস্টারবাবুমাস্টারবাবুএই যেএদিকে —“

বড়রাস্তার মোড়ে রিক্সা থেকে নেমে বাড়ির ঘুপচি গলিটার দিকে হেঁটে যেতে যেতে কার যেন ডাক শুনতে পেলেন অভয়বাবু। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন বাঁদিকের নর্দমার পাশের খুপরি দোকানঘরগুলো থেকে কয়েকজন হাত নেড়ে ডাকছে।

কী ব্যাপার?” কৌতুহলবশতঃ এগিয়ে যান তিনি। পানবিড়িসিগারেটের দোকানদার সুবল বলে ওঠে,

ইস্কুল অইতে আইজ এত দেরিতে ফিরতাসেন যে?”

লাস্ট পিরিয়ডে ক্লাস ছিলতাই। কী হয়েছে কী?”

নাতেমন কিসু নয়আপনারে কইতেও কেমন লাগেকিন্তু আইজ আর না বইল্যা পারতাসি না –“

আরে দূর বাবাযা বলার সোজাসুজি বলো।” তাড়া লাগান তিনি।

অরণি আইজ এক মাসের উপর সিগ্রেটের দাম দেয় না। চাইলে কয় বাবারে কইববাবা দিয়া যাবে–“

সেকিআমার ছেলেসিগারেটকইআমি তো খেতে দেখিনা কখনও!”

আইজ্ঞারোজই দোস্তগো লগে খাইতে খাইতে এহান দিয়া যায় বেলার দিক্যাআপনে তহন ইস্কুলে –“

তাএতদিন বলোনি কেন?”

আপনে আমাগো এ পাড়ার একজন নমস্য ব্যক্তিআপনারে এইসব ছোটখাটো ব্যাপারে নালিশ করনের –“

আচ্ছাঠিক আছেঠিক আছেকত বাকি পড়েছে শুনি।

পকেটে পুরো বকেয়া মেটানোর মতো যথেষ্ট টাকা ছিল না। যতটা পারেন মিটিয়ে বাকিটা কাল দিয়ে যাবেন — এই আশ্বাস দিয়ে বাড়িমুখো হন তিনি। আশ্চর্যকোনোদিন গন্ধটন্ধ তো তেমন পান নি ছেলের মুখেও হ্যাঁমাসকয়েক হল খুব পানমশলা আর মৌরি খাওয়া ধরেছে। সেটা তাহলে গন্ধ চাপা দেওয়ার জন্যআর তিনি স্কুলে থাকাকালীন যদি দোস্তগো লগে” সিগারেট টানতে টানতে পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়তাহলে কলেজ যায় কখনকীভাবে এইসব প্রশ্নের ফয়সালা করবেন ছেলের সঙ্গে আজসেটা ভাবতে ভাবতে বাড়ি ঢুকে ওর মায়ের কাছে শুনলেন ছেলে বলে গেছে ফিরতে রাত হবে। কলেজে সোশ্যাল‘ আছে। বাঃচমৎকারসকালে পড়াশোনার সময় কলেজ ফাঁকি দিয়ে রাতের বেলায় সোশ্যাল। নাঃআজ যত রাতই হোক জেগে থাকবেন ওর ফেরার জন্য। স্কুলের দায়দায়িত্ব নিয়ে বড্ড বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ায় ছেলেটার দিকে আজকাল আর তেমন নজর দেওয়া হয়না। এটা বদলাতে হবে। রাতের খাওয়া রোজই তাড়াতাড়ি সারেন উনিশুয়েও পড়েন তাড়াতাড়ি। কাঁটায় কাঁটায় ভোর পাঁচটায় ওঠার অভ্যেস। আজও রাত এগারোটা নাগাদ ইজিচেয়ারে শুয়ে বই পড়তে পড়তে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লেন।

ওঃআর কতবার বলব একটা সামান্তরিকের ক্ষেত্রফল দুই বাহুর দৈর্ঘ্যের গুণফল নয়এই সামান্য জিনিসটা মাথায় ঢোকে না কেনছবি আঁকা রয়েছে তো বোর্ডে। এই যেদ্যাখআবার ভাল করে দ্যাখকেন সামান্তরিকের ক্ষেত্রফল হচ্ছে ভূমি আর উচ্চতার গুণফল। ঠিক আছে?’

অনেকগুলো কালো কালো মাথা একসাথে নড়ে উঠে হ্যাঁ” বলল। আবার শেষ পিরিয়ডআবার সেই ভয়াবহ অঙ্ক ক্লাস। আবার ছুটির ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা।

আচ্ছাঅ্যাই ইন্দ্রজিৎবলতো দেখিএকটা রম্বসের ক্ষেত্রফল তাহলে কীভাবে পাওয়া যাবে?”

শান্তশিষ্ট চেহারার চশমাধারী ইন্দ্রজিৎ ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করছে দেখে তীব্র ভর্ৎসনা ধেয়ে আসে, “ছি ছিতুই না ক্লাসে ফার্স্টসেকেন্ড হোসঅঙ্কে এরকম মাথা নিয়ে প্রতিবছর স্ট্যান্ড করিস কী করেহ্যাঁ?”

ঠিক এই সময় স্কুলের পিওন নিখিলেশ একটা নোটিসের খাতা হাতে ক্লাসে ঢোকায় ক্ষেত্রফল পর্বে ছেদ পড়ল। ক্লাসের শেষ পাঁচ মিনিট তার সঙ্গে কথোপকথনে আর নোটিসের খাতায় সই করতে করতেই কেটে গেল। নাহলে বোধহয় কপালে আরও দুঃখ ছিল ইন্দ্রজিতের।

সেদিন বাড়ি ফিরে দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখেন ঘিয়ে রঙের খামে একটা চিঠি পড়ে আছে মাটিতে। দুকামরার একচিলতে ফ্ল্যাটএকটা দোতলা বাড়ির একতলায়। বাড়িওয়ালারা থাকেন ওপরের তলাটায়। অভয়ের নিচের ফ্ল্যাটের দরজায় আড়াআড়ি সরু একটা ফুটো করা। সেখান দিয়েই ডাকপিওন বাড়ি শুদ্ধ সবার চিঠি ফেলে দিয়ে যায়। হাতমুখ ধুয়ে জলখাবার খেয়ে চিঠিটা খুলতেই একটা ধাক্কা। কৃষ্ণনগর থেকে ভাই লিখেছে বেথুয়াডহরির পারিবারিক জমিটার ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে যে জ্ঞাতিতেজ্ঞাতিতে মামলা চলছিলতাতে নাকি আদালত অনির্দিষ্টকালের জন্য ইনজাংশন দিয়েছে ওই জমি বিক্রি করা বা ওতে বাড়ি করা নিয়ে। অনেক বছর ধরে ঝুলে থাকা মামলাটার একটা নিষ্পত্তির জন্য কম চেষ্টা করেননি অভয়। শরিকদের ঝগড়া আর পারস্পরিক দোষারোপে বারবার সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। নিজের শিক্ষকতার চাকরি থেকে সংসার খরচফ্ল্যাটভাড়া আর চিররুগ্না স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ দিয়ে যেটুকু সঞ্চয় হয়তাতে মেয়েটার বিয়েথা দেওয়া আর ছেলেটাকে নিজের পায়ে দাঁড় করানো সম্ভব নয়। ওই জমি বিক্রির টাকার ওপর ভীষণভাবে নির্ভর করে আছেন তিনি। সেটা এভাবে ঝুলে রইলে তো । এমনিতেই বেশ কয়েক বিঘার সেই আয়তাকার জমি থেকে জ্যাঠতুতোখুড়তুতো দাদা আর ভাইদের ভাগ দিতে দিতে অভয় আর ওঁর ছোটোভাইয়ের জন্য পড়ে আছে একটা ছোটখাটো ট্রাপিজিয়াম। এর মধ্যে আবার পশ্চিমদিকের রাস্তার ধারে ত্রিভুজাকার অংশটায় ভাই একটা কারখানা চালাত বেশ কয়েক বছর ধরে। কৃষ্ণনগরে সরকারী চাকরি পাওয়ার আগে। ওটা ওরই হয়ে গেছে বলা যায়। বাকি রইল একটা কয়েক কাঠার বর্গক্ষেত্র — না নারম্বস। সেটাও এমন জট পাকিয়ে গেলসেরাতে মাথার মধ্যে চিন্তাভাবনাগুলো কেমন জট পাকিয়ে যেতে লাগল অভয়ের। ঘুম এল না সারারাত।

সেবছর ক্লাস নাইনের প্রিটেস্ট পরীক্ষায় ঐচ্ছিক গণিতের প্রশ্নপত্রটা খুব শক্ত হয়েছিল। এমন প্রশ্নপত্র অভয়বাবু ছাড়া আর কারো হাত দিয়ে বেরোবে না। কিছু কিছু ছাত্রের অভিভাবক সেই নিয়ে কিঞ্চিৎ অসন্তুষ্টি বা উষ্মা প্রকাশ করায় টেস্ট পরীক্ষায় ঐচ্ছিক গণিতের প্রশ্ন করার দায়িত্ব দেওয়া হল স্কুলের নতুন অঙ্ক শিক্ষক প্রভাসবাবুর ওপর। কিন্তু ওই বিষয়ের পাঠ্যক্রমে যা যা আছেসেগুলো পড়ানোর অভিজ্ঞতা অভয়ের মতো তাঁর নেই। তাই ক্লাস নাইনের দুটি বিভাগেই পড়াবার দায়িত্ব অভয়েরই। কিন্তু দেখা গেল তাঁর মতো শিক্ষকও ত্রিমাত্রিক জ্যামিতি বা কনিক সেকশন্সের মতো বিষয়গুলো ছাত্রদের মাথায় ঢোকাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ছেলেগুলো শখ করে অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে অঙ্ক নিয়ে এখন টেস্ট পরীক্ষার আগে দিশাহারা। বৃত্তপরাবৃত্তঅধিবৃত্তউপবৃত্ত — এসব একেবারে ঘেঁটে ঘ হয়ে রয়েছে ওদের মাথায়। অভয় অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে আর হতাশা চেপে রাখতে পারছেন না। স্বভাবসিদ্ধ বিরক্তি ঝরে পড়ছে তাঁর গলায় — “তোরা বাংলা ক্লাসে করিস কী বল তোশুধুই গল্পগাছা আর সিনেমা নিয়ে আলোচনাব্যাকরণের উপসর্গগুলো কি জীবনে পড়িসনিতাহলে পরাউপ আর অধিতে এতো গুলায় কী করে?” একদিন তো রেগে গিয়ে সৌতিককে বেশ কয়েক ঘা ডাস্টারের বাড়ি মেরে বললেন, “বল বাড়িতে কী খাস। ডিম্ খাসডিম্কাপে করে দুধহরলিক্স খাসএই শেষবার বলছিআর যেন ভুল না হয় — ডিম্ হল উপবৃত্ত আর কাপ হল পরাবৃত্ত।

যেদিন এই ঘটনা ঘটেছিলসেই বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে একটু কেনাকাটা করলেন অভয় বড়রাস্তার মুখের বাজারটা থেকে। কারণ আজ পম্পির জন্মদিন। সবে এম এর ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে মেয়েটা। স্নাতক পর্যায়ে বেশ ভাল রেজাল্ট ছিল ওর। নিজের সীমিত সামর্থ্যের দরুণ মেয়ের শখআহ্লাদ তো খুব একটা মেটাতে পারেন না। ও নিজেই কয়েকটা ট্যুইশন করে নিজের হাতখরচ চালায়। সংসারে টুকটাক সাহায্যও করে। খুব বুঝদার আর বাস্তবসচেতন মেয়েওর ভাইয়ের মতো একেবারেই নয়। সপ্তাহে তিন দিন বাসে করে অনেকটা দূরে পড়াতে যায় ও। আজও গেছে। ফিরতে ফিরতে সন্ধে। তার আগেই যাতে ওর মা রান্নাবান্না সেরে সবকিছু একদম রেডি করে রাখতে পারেনতাই লম্বা লম্বা পা ফেলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ঢুকে বাজারের থলি না্মালেন রান্নাঘরেআর মিষ্টির দোকান থেকে কেনা কালাকাঁদের বাক্সটা লুকিয়ে রাখলেন। কালাকাঁদ পম্পির অতি প্রিয়। ও ফিরলে যথাসময়ে বাক্সটা ওর সামনে মেলে ধরে ওকে চমকে দিতে চান। হাতমুখ ধুয়ে চাজলখাবার খেয়ে ইজিচেয়ারে খবরের কাগজটা নিয়ে বসলেন অভয়। সকালবেলা স্কুলের তাড়া থাকে বলে কাগজটা খুঁটিয়ে পড়া হয় না।

পড়তে পড়তে তন্ময় হয়ে গেছিলেনহঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে দেখেন প্রায় পৌনে নটা। একীএত দেরি তো হয়না মেয়েটারতাহলে কি আজ পড়ানো শেষ করে অন্য কোথাও যাবার কথাওর মাকে জিজ্ঞেস করে কোনো সদুত্তর পাওয়া গেল না। বলে যায়নি কিছু। এমনিতে উদ্বিগ্নমনা নন অভয়। ভাবলেন আজ সারা দুপুর আর বিকেল বৃষ্টি হয়েছে দক্ষিণ কলকাতায়মেয়েটা ওদিকেই গেছেহয়তো ফেরার পথে যানজটে বাসটাস আটকে গেছে। রাস্তাঘাটের আজকাল যা অবস্থা। পম্পির টেবিলে গিয়ে দেখে আসেন ও ওর মোবাইল ফোনটা নিয়ে বেরিয়েছে কিনা। বাড়িতে দুটো মোবাইল ফোন — একটা আধুনিক আর একটু দামিঅন্যটা আদ্যিকালের আর চটাওঠা। প্রথমটা সারাক্ষণ থাকে পম্পির ভাইয়ের পকেটে। আর মেয়েটার এমনই ভুলো মনমাঝেমাঝেই নিজের রংচটা ফোনটা বাড়িতে ফেলে রেখে বেরিয়ে পড়ে। যাকআজ সঙ্গে নিয়ে গেছে। কিন্তু গেলেই বা কীতার ভাই এখন কোথায় কোন পাড়ায় দোস্তগো লগে” রাজকার্য করে বেড়াচ্ছে কে জানেসে বাড়ি না ফিরলে তো ফোনাফুনি সম্ভব নয় মেয়ের সঙ্গে। আবার কাগজে মন দেবার চেষ্টা করেন অভয়কিন্তু ঠিক পারেন না। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে নটা ছাড়াবার পর স্ত্রী এমন অস্থির হয়ে উঠলেনপাঞ্জাবিটা গায়ে গলিয়ে রাস্তায় বেরোতেই হল ছেলের খোঁজে। তবে জানিয়ে তো কোথাও যায় না সেঅতএব কোথায়ই বা খুঁজবেনবড় রাস্তার দিকে কিছুদূর হাঁটতেই অবশ্য দেখলেন সাইকেলে টিংটিং শব্দ তুলে সে উল্টোদিক থেকে আসছে। রাস্তাতেই তাকে থামিয়ে এক ধমক দিয়ে মোবাইল কেড়ে নেন অভয়টিপতে থাকেন মেয়ের নম্বর। একবারদুবারতিনবার। কোনো সাড়া নেই। অজানা আশঙ্কায় একবার বুক কেঁপে ওঠে তাঁরকিন্তু শক্ত মানুষ তিনি। বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে আর বললেন না যে ফোন করে পাননি। তাহলে আর ঘরে রাখা যেত না ওর মাকে। বললেন আর খানিকক্ষণ বাদে রিং করবেন। এদিকে সওয়া দশটা বেজে গেছেছেলে তার মাকে নানাভাবে বোঝাবার চেষ্টা করছে যে বৃষ্টিতে ইস্টার্ন বাইপাস আর সুরেন ব্যানার্জী রোডের আজকাল মাঝেমাঝেই খুব যাচ্ছেতাই জ্যাম হয়কিন্তু মায়ের মন কি আর ছেঁদো কথায় ভোলেতিনি স্বামীর কাছে কেঁদে পড়লেন। অভয় মুখে নির্বিকার হলেও ভেতরে ভেতরে অস্থির — স্ত্রীর কাছ থেকে নম্বর নিয়ে মেয়ের কলেজের বন্ধুদের কয়েকজনকে ফোন করতে লাগলেন। তাতে ওর খোঁজ পাওয়া গেলনা ঠিকইকিন্তু গাঙ্গুলিবাগানে যে ছাত্রীর বাড়িতে পড়াতে গিয়েছিল তাদের নম্বরটা অন্ততঃ পাওয়া গেল। কিন্তু তাতে চিন্তা বাড়ল বই কমলো নাকারণ সেই ছাত্রীর কথা অনুযায়ী তার পম্পিদির প্রায় ঘন্টাতিনেক আগেই বাড়ি পৌঁছে যাওয়ার কথা। সন্ধ্যে সাতটায় বেরিয়েছে সে সেখান থেকে। আর এখন এগারোটা দশ। এবার শুধু একটা রাস্তাই খোলা — পুলিশ।

নাপুলিশে আর ফোন করতে হয়নি শেষ অবধি। পুলিশই করেছিল ফোন। ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছোঁয়ার আগেই। পম্পির ভাইয়ের মোবাইলে। বলেছিল এক্ষুণি বাইপাসের ধারে পিয়ারলেস হাসপাতালে আসতে। কারণ অরুণিমা সরকার এই মুহূর্তে সেখানকার ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। লড়ছে মৃত্যুর সঙ্গে – যুঝছে প্রাণপণে। তার ব্যাগেই ছিল এই ফোন নম্বর। গড়িয়া চৌমাথার মোড়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে জলজমা রাস্তায় গর্তে পা পড়ে গিয়েছিল মেয়েটিরউপুড় হয়ে পড়ে যায় সে। কেউ কিছু করার আগেই এক ঘাতক মিনিবাসের চাকা তার নির্মম বৃত্তে মেয়েটির তন্বী শরীরের সব উপবৃত্তপরাবৃত্ত আর অধিবৃত্তকে পিষে দিয়ে চলে গেছে।

মূর্ছিত মাকে কোনোরকমে ইজিচেয়ারে বসিয়ে তীরবেগে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল ছেলে। পাড়ার একজন বন্ধুকে নিয়ে পিয়ারলেসের উদ্দেশে। আর অভয়ের চারপাশটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে এসেছিলঘুরে উঠেছিল মাথাটা। পড়ে যেতে যেতে নিজের কাজের টেবিলটাকে কোনোরকমে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন। হাতের ধাক্কায় মাটিতে লুটিয়েছিল বইপত্র। স্কুলের নানা ক্লাসের অঙ্ক বই সব — কে সি নাগভঞ্জগাঙ্গুলিকে পি বসুদাসমুখার্জী। তাঁর জীবনের নামেলা অঙ্কগুলোর নিষ্ঠূর গরমিলের কোনো সমাধানসূত্র তাতে ছিলনা 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>