| 25 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ গণিত সংখ্যা: পাখির খাঁচা । সুদীপ নাথ

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

অনুষা শেষ পর্যন্ত যখন কলটা নিল, ও ট্রেডমিলে দৌড়চ্ছে। নাম্বারটা দেখাচ্ছে না। দু-দু’বার কলটা নেয়নি। তৃতীয় বার নিয়েই নিল। তবে নিয়ে হতাশ হল। প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসেবে এখন যা রোজগার অনায়াসে ও একটা সেক্রেটারি রাখতে পারে। কিন্তু রাখবে না। যে কোনও কেসের অর্ধেক সূত্র লুকিয়ে থাকে প্রথম ফোন কলে। যে কোনও কেসের ফার্স্ট কনট্যাক্ট-টা খুব সেক্সি। রীতিমতো শিহরণ জাগে শরীরে। মক্কেলের কাঁপা কাঁপা গলা, ভয়, উত্তেজনা, অস্বস্তি – এই সব কিছুর মধ্যে লুকিয়ে থাকে মামলার চাবিকাঠি। কোনও এক পলাশ সেন কল করেছে। না হয়েছে কেউ খুন, না হয়েছে অপহরণ। তাহলে ব্যাপারটা কী? সামান্য একটা ধাঁধার সমাধান করে একটা সিন্দুক খুলতে হবে। পত্রপাঠ প্রত্যাখান করল অনুষা, “আমি দুঃখিত মিস্টার সেন। কয়েকটা কেস নিয়ে খুব ব্যস্ত আছি।”

ওপার থেকে ঠাণ্ডা গলা ভেসে এল, “কথা দিচ্ছি, হতাশ হবেন না। আপনার সময়ের যথার্থ মূল্য দিতে পারব বলেই আশা রাখি।”

টাকা পয়সাটা সব নয়। অনুষার এখন ভালোই রোজগার। বয়স কম, সবে তিরিশ পেরোল। তাতেই এই অবস্থা। কতদিন বেড়াতে যায়নি। হয়ত ছুটি নেওয়ার সময় হয়েছে। হালকা একটা কেস নিয়ে ঘুরে এলে কেমন হয়? হুগলি নদীর মোহনার কাছে একটা বিলাসবহুল বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে। কাছে ভালো হোটেলও নাকি আছে। রাজি হয়ে গেল অনুষা, “ঠিক আছে মিস্টার সেন। ফ্রাইডে মর্নিং। রিসর্টে দেখা হচ্ছে তাহলে।”

সঙ্গে সঙ্গে আবেগকে কল করল অনুষা। ওর বয়ফ্রেন্ড। সেই কলেজ থেকেই একসঙ্গে আছে ওরা। “এই শোন, রায়চক যাবি?” কোনও সাড়াশব্দ এল না ওপার থেকে। এবার একটু রাগত স্বরেই বলল অনুষা, “ঠিক আছে। ঘরকুনো কোথাকার। তোকে যেতে হবে না। আমি একাই যাব।”

ব্যস, ওতেই কাজ হয়ে যায়। হলও। আবেগ নরম গলায় বলল, “উফ তুই না! সব কিছুতে উল্টো করে দেখিস। মাথায় একটু প্রায়োরিটিগুলো জাগল করছিলাম। বেশ কয়েকটা প্রজেক্ট আছে। ম্যানেজ হয়ে যাবে। কবে? কখন?”

এবার একটু হেসে অনুষা বলল, “তোর ফার্স্ট প্রায়োরিটি আমি। অলওয়েজ। ফ্রাইডে। সকাল সাতটায় স্টার্ট করব।”

“মক্কেলটা কে?”

“পলাশ সেন। বয়স ষাট-পঁয়ষট্টি। ব্যবসায়ী। হেভি স্মোকার। বিপদে পড়েছে, অনেক টাকার দরকার।”

“কবে দেখা করলি?”

“ফোন করেছিল। পরে কথা হবে। কাজ আছে।”

আড়াই ঘন্টায় পৌঁছে গেল রায়চকের গঙ্গা কুটির। মোহনার কাছে মনোরম একটি বৃদ্ধাশ্রম। গাড়ি থেকে নামতেই ঠাণ্ডা হাওয়া যেন নদী থেকে উঠে এসে দস্যুর মতো শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। যে দিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। পাখিদের কিচিরমিচির লেগেই আছে। পলাশ সেন অপেক্ষা করছিলেন। আবেগ সিগারেটের প্যাকেট বার করতেই অনুষা ভাবছিল অন্য দিনের মতো ছিনিয়ে নেবে। কিন্তু আবেগ সিগারেট ধরাল না। বরং পলাশ সেনকে অফার করল। কী আশ্চর্য! পলাশ সেন ফিরিয়ে দিলেন।

“থ্যাংকস বাট নো থ্যাংকস।”

আবেগ একটু চোখ কুঁচকে অনুষার দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞাসা করল, “সরি, কেন জানি মনে হল আপনি সিগারেট খান।”

পলাশ সেন হেসে বললেন, “আমি একটু ওল্ড ফ্যাশনড। পাইপ ধরাই।”

আবেগের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখটা অনুষা দেখলই না। পলাশ সেন ওদের নিয়ে একটা বৃদ্ধাশ্রমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে চললেন, “এটা একটা নতুন রিসর্ট। সাবিত্রী সেন মানে আমার মা এই জায়গাটা খুব ভালবাসত। শহর থেকে একটু দূরেই থাকতে চেয়েছিল। তাই আমি এখানে থাকার ব্যবস্থা করি। সবচেয়ে বড়ো ঘরটা ছিল মায়ের। রিসর্টের কর্মচারীরা ভালোই দেখাশুনো করত। আমি উইকেন্ডে আসতাম। আমার মা পড়তে ভালোবাসত। সারা জীবন সাউথ পয়েন্ট স্কুলে অঙ্কের শিক্ষকতা করেছে। অবসরেও অঙ্ক নিয়ে চর্চা করত। তাছাড়া গল্পও লিখত। বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা গল্প লিখেছিল কিন্তু প্রকাশ করেনি। মা ছিল আগাথা ক্রিস্টির ফ্যান। মিস মারপল আর এরকুল পোয়ারোর সব গল্প বারবার পড়ে যেত। মাঝে মাঝে লিখতে বসত। লেখার খাতাটা থাকত মাথার কাছে একটা সিন্দুকে। মা গত মাসে চলে গেল। সেরিব্রাল অ্যাটাক। সেদিন ছিল শনিবার। আমি সারাটা দিন মায়ের সঙ্গে কাটিয়ে সন্ধ্যাবেলা কলকাতা ফিরি। আর সেই রাতেই অ্যাটাকটা হয়েছিল। আমি রোববার সকালে পৌঁছে যাই। তখন সব শেষ। মায়ের ঘরের সব কিছু এখনও একইভাবে রয়েছে। কেউ হাত দেয়নি। আমি এই ঘরটা ছাড়ব না। মায়ের স্মৃতি আগলে রাখবে। তবে সিন্দুকটা একবার খোলা দরকার। মা বলত, “আমি না থাকলে সিন্দুক খুলে খাতা থেকে গল্পগুলো পড়িস। ওর লেখাগুলো ছাড়া মূল্যবান তেমন কিছু নেই। একটা কম্বিনেশন লক আছে। সিক্স ডিজিট নাম্বার দিয়ে খুলতে হয়। অনেক চেয়েছি কিন্তু নাম্বারটা দেয়নি মা। বলত, একটা ধাঁধার উত্তরের ভেতর সংখ্যাটা লুকিয়ে আছে। যে সমাধান করবে সেই প্রথম আমার লেখা পড়বে।”

একটানা বকে যাওয়ার পর পলাশ সেন একটু থেমে পাইপে অগ্নিসংযোগ করলেন। ততক্ষণে ওরাও সাবিত্রী সেনের ঘরে এসে পৌঁছেছে। অনুষা কেটে কেটে উচ্চারণ করল, “ধাঁধাটা কী?”

পলাশ সেনের উত্তরে অবাক হয়ে গেল ওরা। “ধাঁধা বলতে তেমন কিছু নেই। মা কয়েকটা পাখি পুষেছিল। অদ্ভুত সব নামও রেখেছিল। একটা পাখিকে আবার কথা বলা শিখিয়েছিল। বলত পাখিগুলোই নাকি ধাঁধা। পাখিদের থেকেই নাকি কম্বিনেশনের নাম্বারটা উদ্ধার করতে হবে।”

“পাখিগুলো এখন কোথায়?”

“এখানকার কর্মচারীরা দেখাশোনা করছে।”

“ওঁর কোনও লেখাই কি সিন্দুকের বাইরে নেই?”

“শেষ লেখাটা রোজ বার করত আবার রাতে সিন্দুকে পুরে রাখত। অ্যাটাকের সময় বাইরেই ছিল। আমার ব্রিফকেসে আছে।”

“আপনার মা সিন্দুক খোলার সময় কোনোদিন ওঁর আঙুলের দিকে তাকাননি?”

পলাশ সেন থতমত খেয়ে আমতা আমতা করে বললেন, “দেখেছি, মানে চেষ্টা করেছি কিন্তু মায়ের আঙ্গুল খুব দ্রুত লকটাকে ঘোরাত।”

“আপনার মায়ের কোনও রোগ ছিল?”

“না না, মা সুস্থ ছিল। তবে গত কয়েক বছর ধরে খুব ভুলে যেত। লিখতে বসে রোজ প্রথম থেকে পড়ত। একটা বই কিনে দিতে বলছিল কিন্তু নামটা কিছুতেই মায়ের মনে পড়ল না।”

“আপনার মায়ের বয়স?”

“জাস্ট এইটিফাইভ পেরিয়েছিল।”

অনুষা এখন ঘুরে ঘুরে সাবিত্রীদেবীর ঘরটা দেখছে। আবেগ কয়েকটা ছবি তুলে নিল। সিন্দুকটা দেখা শেষ হলে অনুষা পাখিগুলো দেখতে চাইল। পলাশ সেন পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। সাতটা খাঁচায় আটটা টিয়া পাখি। প্রথম খাঁচায় দুটো পাখি, বাকি সব খাঁচায় একটা করে। প্রথম খাঁচার পাখিদের নাম Ego আর Knowledge। দ্বিতীয় খাঁচার পাখির নাম Square। তৃতীয় খাঁচার পাখির নাম Prime। চতুর্থ খাঁচার পাখির নাম Spider । পঞ্চম খাঁচায় রয়েছে Boron। ষষ্ঠ খাঁচায় রয়েছে Ocean। আর সাত নম্বর খাঁচার রয়েছে Mary. প্রতিটা খাঁচার গায়ে ছোট্ট একটা ট্যাগ আছে। সেখানেই নামগুলো লেখা। পিন পতনের স্তব্ধতা ভঙ্গ করে ছয় নম্বর খাঁচার পাখিটা বলে উঠল, “স্টপ, মাল্টিপ্লাই, উই আর সেইম। স্টপ, মাল্টিপ্লাই, উই আর সেইম। স্টপ, মাল্টিপ্লাই, উই আর সেইম…” কর্কশ গলায় বলেই চলল।

অনুষা বিড়বিড় বলে উঠল, “অদ্ভুত”, দু’মিনিট আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ পলাশ সেনকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনার মা কি এইভাবেই খাঁচাগুলো সাজিয়ে রাখতেন?”

পলাশ সেন উত্তেজিত ভাবে বলে উঠলেন, “এক্সাক্টলি ইন দিস অর্ডার।”

‘গঙ্গা কুটির’র একজন কর্মচারী বলে উঠল, “আমরাও ঠিক সেই ভাবেই সাজিয়ে রেখেছি। প্রথম প্রথম পাখিটা কথা বলত না। পরে উনি শিখিয়েছেন।”

এর পর অনুষা যে কথাটা বলল তা যেন তীরের মতো এসে পলাশ সেনের বুকে বিঁধল, “যে প্রথম আপনার মায়ের মৃতদেহ দেখে আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।”

পলাশ সেন ঠাণ্ডা মাথায় বললেন, “অবশ্যই, আমি আয়াকে ডেকে পাঠাচ্ছি।”

অনুষা এবার বরফ শীতল গলায় বলল, “আমাকে একা কথা বলতে দিতে হবে।”

পলাশ সেন মাথা চুলকে বেরিয়ে যেতেই একজন মধ্যবয়সী আয়া ঘরে ঢুকল।

“আমি খাবার নিয়ে গিয়ে দেকি যে উনি ঘুমোচ্ছেন। তুলতে পারলুমনি। হাত-পা ঠাণ্ডা মেরে গেছে। আমরা পলাশ বাবুকে কল করিছিলেম। উনি ফোন ধরেননি। সকালে এলেন।”

“সেদিন পলাশ বাবু কখন ফিরে যান?”

“জানি না ম্যাডাম।”

“তুমি কোনও গন্ধ পেয়েছিলে?”

“হ্যাঁ ম্যাডাম, তামাকের গন্ধ”

“জানলা খোলা ছিল?”

“জানলা খোলাই থাকত। উনি গঙ্গার হাওয়া খেতে ভালবাসতেন।”

“থ্যাঙ্ক ইউ”, বলে বেরিয়ে এল অনুষা আর আবেগ। অনুষার হাতে সাবিত্রী সেনের শেষ পাণ্ডুলিপি। পলাশ সেন বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। উৎসাহভরে এগিয়ে এলেন। অনুষা হাত জোড় করে বলল, “আমরা আসি আজকে মিস্টার সেন।”

“আর কোনও ইনফরমেশন চাই?”

“নাহ এখন আর কিছু নয়। আপনার মায়ের শেষ লেখাটা আমার কাছে থাক ক’দিন।”

“নো প্রব্লেম। আপনাদের লাঞ্চের ব্যবস্থা করেছি।”

ফেরার সময় আবেগ চাইছিল যে অনুষা ড্রাইভ করুক। যেতে যেতে কয়েকটা ছবি তোলা যাবে তাহলে। অনুষা শুনল না। সে এখন সাবিত্রী দেবীর শেষ পাণ্ডুলিপিতে মুখ গুঁজে রয়েছে। বারুইপুরে একবার থেমে চা-সিঙ্গাড়া খেয়ে সোজা গিয়ে অনুষার রাজারহাটের আবাসনের সামনে পার্ক করল। তখনও অনুষা মাথা গুঁজে পড়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে নিজের মনে আউড়ে যাচ্ছে, “আইনস্টাইন…ফোর ওর নাইন?” আবেগ ঠিক করল রাতটা অনুষার ফ্ল্যাটেই কাটাবে। কিন্তু কার সঙ্গে? ডিনার করে সেই যে পড়ার ঘরে ঢুকল আর বেরোল না। শেষ পর্যন্ত আবেগ গিয়ে বলল, “ইউ নিড টু টক বেবি।”

“তোকে একটা কাজ দিচ্ছি আবেগ। পলাশ সেনের কোম্পানির নাম সাবলাইম অ্যাডভার্টাইজিং। খবর নে – কী অবস্থা।”

“ঠিক আছে। পাখিদের নাম থেকে কিছু উদ্ধার করতে পারলি?”

“ডেফিনিটলি। Ego আর Knowledge মিলে কী হয় বল?”

আবেগ মাথা চুলকে যাচ্ছে। অনুষা আবার জিজ্ঞাসা করল, “একটা স্কোয়ার নাম্বার বল।”

“ফোর নাইন সিক্সটিন…”

“সিঙ্গল ডিজিট – ফোর ওর নাইন। স্পাইডার শব্দটা শুনলে কোন সংখ্যা মাথায় আসে?”

“এইট”

“ঠিক। বোরন মানে?”

“দ্যাটস এলিমেন্টারি অনুষা, বোরনের এটোমিক অ্যাটমিক নাম্বার ফাইভ। সাইকোলজি না পড়ে শার্লক হোমসের মতো তোর একটু কেমিস্ট্রি পড়া উচিত ছিল।”

অনুষা পাত্তা না দিয়ে বলল, “তাহলে নাম্বারটা হল X (৪ অথবা ৯) Y ৮ ৫ Z, ocean মানে?”

“সেভেন”

“রাইট। তাহলে পাচ্ছি X (৪ অথবা ৯)Y ৮ ৫ ৭। একটা প্রাইম নাম্বার বল।”

“টু থ্রি ফাইভ সেভেন…”

“তাহলে পাচ্ছি X (৪ অথবা ৯) (২ অথবা ৩ অথবা ৫ অথবা ৭) ৮ ৫ ৭”

আবেগ উত্তেজিত হয়ে বলল, “Ego আর Knowledge তাহলে কী?”

“দ্যাটস দ্য পাজল মিস্টার আইনস্টাইন। সিক্স ডিজিট কম্বিনেশন লক। হোয়াই ডু আই নিড দ্য সেভেন্থ ক্লু?”

“আমার মাথা ঘুরছে”, বলে ধপ করে সোফায় বসে পড়ল আবেগ, “শুতে গেলাম, গুড নাইট অ্যান্ড গুড লাক টু ইওর ইগো অ্যান্ড নলেজ অ্যান্ড মেরি।”

“গুড নাইট আবেগ। আমি একটু কফি বানাই। পাণ্ডুলিপিটা শেষ করতে হবে।”

আবেগ প্রাতরাশের পর চলে গেল। ও একটা আইটি কোম্পানিতে চাকরি করে। একটা প্রোডাকশন প্রব্লেম আছে। রবিবারেও কাজ করতে হবে। অনুষা অবশ্য ঘর থেকেই ওর গোয়েন্দাগিরি চালায়। বেরোনোর সময় অনুষা চেঁচিয়ে উঠল, “সাবলাইম অ্যাডভার্টাইজিংয়ের কথা ভুলিস না…”

অনুষা হোয়াইটবোর্ডে সংখ্যাগুলো লিখে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। ভদ্রমহিলা হঠাৎ কিছু সংখ্যা কেন মাথা থেকে বের করলেন। তারপর পাখিদের নামের ভেতর তাদের লুকিয়ে ফেললেন। কেন? হোয়াটস দ্য মোটিভেশন? নিশ্চয়ই র‍্যান্ডম নয়। বিশেষ কোনও সংখ্যা। X৪২৮৫৭ নাকি X৪৩৮৫৭ নাকি X৯২৮৫৭ নাকি X৯৩৮৫৭? হোয়াট ইজ X? নাহ অনুষার মাথা কাজ করছে না। সামান্য একটা ধাঁধা নিয়ে নাজেহাল। কিছুটা অন্যমনস্ক হয়েই ফেসবুক খুলে ফেলল। স্ক্রল করে এলোমেলো কিছু ফিড দেখল। নোটিফিকেশন চেক করল। বেশ কিছু ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট জমে আছে। একজন অচেনা লোক বন্ধুত্বের অনুরোধ করেছে। লোকটার ফেসবুক ওয়ালে একটা ছবি রয়েছে। আইনস্টাইনের মুখ আর পাশে ইংরাজিতে একটা ভগ্নাংশ লেখা, Ego = 1/Knowledge. ভোয়ালা! তার মানে Ego আর Knowledge মিলিয়ে হয় ওয়ান। তাহলে নাম্বারটা হল ১৪২৮৫৭, ১৯২৮৫৭ অথবা ১৪৩৮৫৭ অথবা ১৯৩৮৫৭…। একটা গুগল সার্চ করতেই ১৪২৮৫৭ সংখ্যাটা লাফিয়ে স্ক্রিনে এসে গেল। বিশেষ একটা সংখ্যা। একে বলে সাইক্লিক নাম্বার। ২, ৩, ৪, ৫… দিয়ে গুণ করলে সংখ্যাগুলো বৃত্তাকারে ফিরে ফিরে আসে। দুই দিয়ে গুণ করলে হয় ২৮৫৭-১৪। ৩ দিয়ে গুণ করলে হয় ৪২৮৫৭-১…। একটা ফিতেতে গুণফলগুলো লিখে ফিতের ল্যাজ আর মুখ জুড়ে দিলেই আসল সংখ্যাটা পাওয়া যাবে। সেই জন্যই কি ছয় নম্বর খাঁচার পাখিটা বলছিল, “স্টপ মাল্টিপ্লাই?”

আবেগ সন্ধ্যাবেলা কল করল, “সো মিস আইনস্টাইন, কী খবর?”

অনুষা নির্লিপ্ত স্বরে বলল, “কিছুটা এগিয়েছে কিন্তু পুরোটা ধরতে পারছি না।”

“তার মানে?”

“নাম্বারটা ১৪২৮৫৭ ছিল কিন্তু বুড়ি পাল্টেছে।”

“আগে তুই বুঝিয়ে বল।”

“পরে বোঝাব তোকে। আশি বছরের একটা বুড়ি রোজ ছটা সংখ্যা ঘুরিয়ে সিন্দুক খুলবে না। হয়ত আগে খুলত কিন্তু পরে পাল্টে দিয়েছিল।”

“কেন বলছিস?”

“পাখিটা কী বলছিল মনে কর।”

“স্টপ, মাল্টিপ্লাই।”

“তারপর?”

“উই অল আর সেইম।”

“ঠিক কিন্তু কেন?”

“সে তুই ভাব। শোন সাবলাইম কোম্পানির হাল খুব খারাপ। কিছুদিনের মধ্যেই তালা ঝুলবে।”

“আমিও তাই ভেবেছিলাম।”

অনুষার হঠাৎ নিজের মনে হেসে উঠল। আবেগ জানে, এর মানে হল আর একটা গিঁট খুলেছে। তবে ও কিছু বলল না। অনুষা নিজেই বলল, “মোটামুটি একটা আইডিয়া হয়েছে। বল তো Mary কে?”

“আমি বুঝতে পারছি না। একটা সিম্পল নাম্বার বলছিস?”

অনুষা হাসতে হাসতে বলল, “স্টপ, মাল্টিপ্লাই, উই আর সেইম। খুব সোজা আবেগ। এলিমেন্টারি।”

ওপারে, আবেগ ক্যাবলার মতো ফোনটা কানে নিয়ে চুপ করে রইল। তারপর কোনও ক্রমে বলল, “বাই নাউ। সি ইউ সুন।”

অনুষা রাতে ঘুমোতে পারল না। কাপের পর কাপ কফি পান করে মুখ বিস্বাদ হয়ে গেল। মাথায় শুধু ঘুরে যাচ্ছে। Mary কে? সাবিত্রী দেবী তো আগাথা ক্রিস্টির ফ্যান ছিলেন। Mary নামের কোনও চরিত্র তো তাঁর গল্পে নেই। তবে কি বাস্তবের কোনও চরিত্র? সারা রাত ভেবে ভেবে সকালের দিকে চোখ লেগে এল। ঘুম ভাঙতেই পলাশ সেনকে কল করে বলল, “একবার গঙ্গাকুটিরে আসুন। আমরা বারোটায় পৌঁছে যাব।”

রাস্তায় আবেগের সঙ্গে কোনও কথা হল না। শুধু একবার ওকে জিজ্ঞাসা করল, “পাণ্ডুলিপি কেন সিন্দুকে থাকবে? অথচ আনকোরা নতুনটা বাইরে পড়ে আছে। তাহলে সিন্দুকটা বন্ধ কেন?”

আবেগ সহজ ভাবে বলল, “তাহলে আরও মূল্যবান কিছু আছে।”

সিট্ থেকে লাফিয়ে উঠে অনুষা বলল, “ইয়েস!” ব্যস তারপর আর কথা হয়নি।

কোনও রকম ভণিতা না করেই অনুষা পলাশ সেনকে নিয়ে সাবিত্রীদেবীর ঘরে পৌঁছে গেল। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে একের পর এক নব ঘুরিয়ে চোখের নিমেষে সিন্দুকটা খুলতেই আবেগ আর পলাশ সেনের চোখ যেন রায়চকের ছানাবড়া। সিন্দুকে তেমন কিছু নেই। কয়েকটা লেখার খাতা আর একটা খাম। লেখাগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে খামটা খুলে ফেলল অনুষা। ভেতরে হাতে লেখা একটা চিঠি। গভীর মনোযোগ সহকারে চোখ বুলিয়েই মুখে ফুটিয়ে তুলল আবেগের খুব চিরপরিচিত একটি বিজয়ের হাসি। তারপরই মিলিয়ে গেল। পলাশ সেন কিছু বলার আগেই দ্রুত চিঠিটা খামে ভরে আবার সিন্দুকে রেখে দিতে যেতেই পলাশ সেন প্রথমে হতভম্ব হলেও বজ্র কঠিন স্বরে বললেন, “চিঠিটা আমাকে দিন।”

ভাবলেশহীন অনুষা নব্বই ডিগ্রি ঘুরে চিঠিটা দিল। পলাশ সেনের সঙ্গে আবেগও দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিল। হাতে লেখা একটা চিঠি। সাবিত্রী সেনকে লেখা। নিচে একটা জড়ানো সই – Mary Westmacott, ঝাপসা হয়ে যাওয়া ঠিঠিটার বয়ান দেখে মনে হয় যেন কোনও লেখক তার অনুরাগীকে দু’লাইন লিখে পাঠিয়েছেন। পলাশ সেন এবার প্রায় বাক্যিহারা। তিরিশ সেকেণ্ড কেটে গেল। হোঁচট খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলেন, “Mary West…macott কে?”

এবার অনুষা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ঠিক এই জন্যই চিঠিটা আপনার জন্য নয়। আপনি সিন্দুকের ভেতরে সম্পত্তি আশা করেছিলেন, তাই না? সাবলাইমকে বাঁচাতে হবে। সেদিন আপনি সাবিত্রীদেবীর থেকে ওঁর পাণ্ডুলিপি কেড়ে নিয়েছিলেন। তারপর সিন্দুকটাও খুলতে গিয়েছিলেন কিন্তু পারেননি। নাম্বারের নবগুলোর ওপর কিছু আঁকিবুকি রয়েছে। এই ঘটনায় আপনার মা মানসিক আঘাত পান। তা থেকেই হয়ত সেরিব্রাল অ্যাটাক। আপনি ফিরে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যাটাকটা হয়। তামাকের কটু গন্ধ পেয়েছে আয়া। কিন্তু আপনি প্রথমে ফোন ধরেননি। হয়ত যেতে যেতে ফোনের সিগন্যাল পাননি। পরে আপনি ফোন করে জেনেছিলেন যে উনি মারা গেছেন। সকালে ফিরে এলেন। কিন্তু মায়ের ধাঁধাটা আপনি কিছুই বোঝেননি। তাই সিন্দুকটাও আর খোলার চেষ্টা করেননি। আপনি সন্দেহ করেছিলেন যে সিন্দুকে মূল্যবান কিছু আছে। কিন্তু পেয়েও বুঝতে পারছেন না সেটা ঠিক কী। আগাথা ক্রিস্টি সম্পর্কে পড়লে হয়ত ধরতে পারতেন। আপনার মা আগাথা ক্রিস্টির ভক্ত ছিলেন। আমি যে পাণ্ডুলিপিটি পড়লাম তা পুরোপুরি আগাথা ক্রিস্টির স্টাইলে লেখা। হয়ত বাকি লেখাগুলোও তাই। সেইজন্যই উনি প্রকাশ করেননি। যে চিঠিটি দেখছেন, সেটি আর কারও নয় স্বয়ং আগাথা ক্রিস্টির লেখা। ভুল করে তিনি নিজের ছদ্মনামে সই করেছেন। হার পেননেইম ওয়াজ Mary Westmacott। খুব সম্ভবত আপনার মা আগাথা ক্রিস্টিকে চিঠি লিখে এই উত্তরটি পেয়েছিলেন। নিলাম হলে এর দাম উঠবে মিলিয়ন ডলারে। চিঠিটার ব্যাপারে আমি মিউজিয়ামের সঙ্গে কথা বলব। আপনি যদি বেগড়বাই না করেন আমি পুলিশকে জানাচ্ছি না। নিজেকে সংশোধন করে নিন। আঘাত না পেলে আপনার মা হয়ত আরও কিছুদিন বাঁচতেন। আমার দিকে এগিয়ে আসার চেষ্টা করবেন না। আমাদের দুজনেরই ক্যারাটে ট্রেইনিং আছে। তাছাড়া আমার কোমরে একটা পয়েন্ট থ্রিএইট থাকে।”

পলাশ সেন মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মার্সিডিজের আওয়াজটা দ্রুত মিলিয়ে যেতেই আবেগ আর অনুষা সাবিত্রীদেবীর ঘর থেকে বেরিয়ে এল। অনুষা একমনে হাতের চিঠিটা দেখে যাচ্ছে। কলকাতা ফেরার সময় আবেগ শুধু জিজ্ঞাসা করল, “কম্বিনেশন লকের নাম্বারটা কী? এত তাড়াতাড়ি খুললি কী করে?”

এতক্ষণে অনুষা স্বাভাবিক গলায় বলল, “স্টপ, মাল্টিপ্লাই, উই আর অল সেইম।”

“আবার সেই ধাঁধা?”

“তুই একটা গবেট? প্রোগ্রামিং করিস কী করে? ১৪২৮৫৭ কে ৭ দিয়ে গুণ করলে কী পাস?”

“৯৯৯৯৯৯”

“ঠিক। প্রথমে ১৪২৮৫৭ই হয়ত কম্বিনেশন ছিল। পরে সহজ করে নিয়ে পাখিটাকে বুলি শিখিয়েছিলেন। নইলে নিজেই হয়ত খুলতে পারতেন না।”

“তুই একটা জিনিয়াস।”

“আই অ্যাম দ্য বেস্ট” বলে ঘুমিয়ে পড়ল অনুষা।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত