অতীশ দীপঙ্কর কেন তিব্বতে চলে গেলেন
সন্ন্যাসী হওয়ার আগে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বিয়ে করেছিলেন। এক বার নয়, পাঁচবার। খুব অল্প বয়সে। তখন অবশ্য তাঁর নাম ছিল আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ। ৯ ছেলের বাবা হয়েছিলেন তিনি। এদের মধ্যে একজনেরই মাত্র নাম জানা যায়। সেই ছেলের নাম পুণ্যশ্রী। রাজ পরিবারের সন্তান ছিলেন চন্দ্রগর্ভ। ঢাকার কাছাকাছি বিক্রমপুর অঞ্চলের বজ্রযোগিনী গ্রামে তাঁর জন্ম হয়েছিল। পড়াশোনা শুরু করেছিলেন প্রথমে মায়ের কাছে এবং তারপর স্থানীয় বজ্রাসন বিহারে। ছোট্টবেলা থেকেই তাঁর মেধার বিচ্ছুরণ অবাক করেছিল আশেপাশের সবাইকে। ৩ বছর বয়সে সংস্কৃত ভাষায় পড়া শিখে যান। ১০ বছরের কাছাকাছি বয়সে বৌদ্ধ আর অবৌদ্ধ শাস্ত্রের পার্থক্য বুঝতে পারতেন। এই আশ্চর্য মেধা দেখে বৌদ্ধ পণ্ডিত জেত্রি তাঁকে নালন্দা যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
নালন্দার আচার্য বোধিভদ্র যখন চন্দ্রগর্ভকে শ্রমণ হিসেবে দীক্ষা দিলেন, তখন চন্দ্রগর্ভের বয়স ১২। কারো কারো মতে ওই সময়েই তাঁর নাম হল ‘দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান’। এরপর বিক্রমশীলা বিহারের দ্বারপণ্ডিত নাঙপাদের আছে তন্ত্র শিখলেন। মগধের ওদন্তপুরী বিহারের মহাসাংঘিক শীলরক্ষিতের থেকে উপসম্পদা দীক্ষা গ্রহণ করলেন। অনেক গবেষক বলেন, উপসম্পদা নেওয়ার সময়েই ‘দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান’ নাম হয়েছিল তাঁর। পশ্চিম ভারতের কৃষ্ণগিরি বিহারে গিয়ে তারপর পণ্ডিত রাহুল গুপ্তের কাছে বৌদ্ধধর্মের গুহ্যবিদ্যায় শিক্ষালাভ করে ভূষিত হলেন ‘গুহ্যজ্ঞানবজ্র’ উপাধিতে। আরও পড়তে মালয়দেশের সুবর্ণদ্বীপ অর্থাৎ এখনকার ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রাদ্বীপে পাড়ি দিয়েছিলেন দীপঙ্কর। সেখানে আচার্য ধর্মপালের কাছে ১২ বছর বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন। দেশে ফিরলে পাল সম্রাট প্রথম মহীপাল তাঁকে বিক্রমশীলা বিহারের আচার্য নিযুক্ত করলেন। বিক্রমশীলা, সোমপুর, ওদন্তপুরীর মতো বিহারে অধ্যাপক ও আচার্যের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। কলচুরী শাসক লক্ষ্মীকর্ণের সঙ্গে মহীপালের ছেলে নয়পালের যুদ্ধ বাঁধলে অতীশ দীপঙ্করই শেষ পর্যন্ত মধ্যস্থতা করে সব বিবাদের অবসান ঘটান।
পশ্চিম তিব্বতের এক প্রাচীন রাজ্য ছিল গুজ। সেখানকার রাজা ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস-ওদ দূত পাঠিয়েছিলেন বিক্রমশীলা মহাবিহারে। সঙ্গে ছিল সোনার উপহার। দীপঙ্করকে তিব্বতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি। দূত জানিয়েছিলেন, তিব্বতে গেলে সেখানকার সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হবে শ্রীজ্ঞানকে। কিন্তু শ্রীজ্ঞানের কোনো সম্মানের মোহ ছিল না। সেই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলেন তিনি। এদিকে গুজের রাজা একদিন সীমান্ত অঞ্চলে গেলে কারখানি খানাতের শাসক তাঁকে বন্দি করলেন আর মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করলেন প্রচুর সোনা। গুজের রাজা নিজের ছেলেকে বলেন, তাঁর জন্য মুক্তিপণ না দিয়ে সেই সোনা যেন অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতে নিয়ে আসতে কাজে লাগানো হয়। সেই ছেলে সিংহাসনে বসলেন। বাবার শেষ ইচ্ছে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে জানাতে দূত পাঠালেন বিক্রমশীলায়। আবারও সঙ্গে প্রচুর সোনার উপঢৌকন পাঠানো হল। ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস-ওদ কীভাবে বন্দি অবস্থায় মারা গেছেন, সেই কথা শুনে অভিভূত হলেন দীপঙ্কর। যাত্রা করলেন তিব্বতের দিকে।
পথে নেপালের রাজা অনন্তকীর্তি বিশেষভাবে সংবর্ধনা দিলেন অতীশ দীপঙ্করকে। দীপঙ্কর সেখানে খান বিহার নামের এক মঠ স্থাপন করলেন। নেপালের রাজপুত্র পদ্মপ্রভকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা দিলেন। দীপঙ্কর তিব্বতে পৌঁছলে গুজের রাজা এক বিশাল সংবর্ধনাসভার আয়োজন করেছিলেন। তার দৃশ্য এখনও সেখানকার এক মঠে আঁকা রয়েছে। এই সংবর্ধনার জন্য বানানো হয়েছিল নতুন এক বাদ্যযন্ত্র, যার নাম রাগদুন। অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতের সর্বোচ্চ ধর্মগুরুর পদে বসানো হল। তিব্বতের সামাজিক ঐতিহ্যে লামারা তাঁরই ধর্মীয় উত্তরসূরী। তিব্বতেই জীবনের শেষ পর্যন্ত কাটিয়ে গেছেন অতীশ দীপঙ্কর। ধর্মপ্রচারের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছিলেন কৃতি শিক্ষকও। সারা জীবনে কয়েকশো বই লিখে গেছেন তিনি।
তথ্যসূত্র-
১. “চন্দ্রগর্ভ থেকে শ্রীজ্ঞান”, ত্রৈমাসিক ঢাকা, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা।
২. “অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের খোঁজে”, অদিতি ফাল্গুনী, দৈনিক প্রথম আলো (২৬/৯/২০১১)।
৩. “দীপঙ্কর অতীশ শ্রীজ্ঞান”, বাংলা বিশ্বকোষ, দ্বিতীয় খণ্ড, নওরোজ কিতাবিস্তান।
৪. “তিব্বতে সওয়া বছর”, রাহুল সাংকৃত্যায়ন, চিরায়ত প্রকাশন প্রাইভেট লিমিটেড।
কৃতজ্ঞতা: বঙ্গদর্শন
