| 29 মার্চ 2024
Categories
এই দিনে কবিতা সাহিত্য

মুজিব মেহদীর কবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

আজ ০৩ জানুয়ারি কবি মুজিব মেহদীর শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


মন খুলবার শব্দ
 
মন খুলবার শব্দ পেলাম নরম এই কুয়াশা শরতে, ভেজা ঘাসমাঠ হাহা হিহি করে জানিয়ে গেল রোদের কাছে এই কাণ্ডকীর্তি, বিপ্লবী ঘটনা যেন পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বে
 
কথার শক্তি বিষয়ে আমার ধারণা জন্মেছিল বেশ বালক বয়সে, কথাদের কলা হয়ে উঠতে যে অস্ত্রশস্ত্র লাগে, লাগে যে শানবিদ্যা, বাতাসের চেয়েও ওটা কম আয়ত্তে ছিল, এমনকি জানতাম না যে আয়রনি কাকে বলে, ঘৃণাকে ঘৃণার অধিক কিছু কখনো ভাবি নি
 
বহু তিতিক্ষা তরণি বেয়ে মতিফুল ফুটল এবার, রূপকাহিনির ভিড়ে ঢাকের বাদ্যের নিচে প্রকাশ্য শব্দ পেলাম মন খুলবার, সাক্ষী হয়ে মাথা নাড়ল শস্যসুরভি
 
প্রকৃতিপাঠ
 
স্কুল খুললেও বই কাঁধে আমি যাই নি এ বেলা ক্লাসে
বারান্দায় মোড়া পেতে বসে বসে আকাশ দেখছি
আকাশকে শূন্যতাসুদ্ধ আমার ভালো শিক্ষক বলে মনে হয়
 
যুগ যুগ একই শিক্ষা নির্গত হয় ক্লাসের ভেতরে
রাতেদিনে গুরুর বাঁশি বাজায় একই সুর
 
আমি নাদান না-ক্লাস ছাত্র আকাশের আয়নায়
নতুন করে শিখছি প্রকৃতির মনোভাব
 
মানুষে মানুষে ব্যবধান আসলে বিস্তর
পুরোটা ঘোচানো যার নিরেট কল্পনা 
 
একাগাছ
 
শালজঙ্গলের কোনো জেরক্স হয় না
পোড়োবাড়ির কোনো সারাই হয় না
 
আমাকে আধলে রেখে উড়ে গেলে তুমি
পোড়োবাড়ির ধারণা পড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
বাতাসে বাতাসে ভাঙনের সুর বেজে ওঠে
 
মাঠের ভিতরে থাকা একাগাছ যত দেখি
শূন্যতার তত বেশি পড়ে যাই প্রেমে
গোড়ার জল কী দারুণ আগলে রাখে
থমথমে কালো ছায়া
 
একদিন সবকিছু ছেড়েছুড়ে
ধুধুপথে হাঁটা দেবো শূন্য অভিলাষে
তুমি জেনে রেখো
 
সমুদ্রে
 
এই মাটি, ঢেউয়ে ঢেউয়ে সমুদ্র দিয়েছে—টোলঘর, ঝাউবীথি ও কোকের পাহাড়ে বিলি কেটে আজ তার সমূহে নেমেছি, ভেজা ও চলনক্ষম বালিতে বালিতে, দূর সব দিগন্ত-আমোদী রচনায়, নিখিল সংগীতে
 
সমুদ্রজলের গর্জন আসলে এক নীরবতা, মনে এসে মিশে গূঢ় মন, দূরের জাহাজ, দেহে খসে আরদেহ রতি, উড়ন্ত চিলের পালক
 
ফেনাময় সমুদ্রপাড়ায় কোনো বিয়ারের ক্যান খোলা হলে, প্রথম সাপোর্ট আসে সমুদ্র থেকেই, জলের বর্তিত গতি মনে হয় বয়ে চলে লোকহিতব্রতে
 
২.
বিদেশ-বিভুঁ’য়ে এই লাভ হলো—গর্জনশীলা এক সমুদ্র পেয়েছি বুকে, তার ওপরে হাওয়া, অফুরান শীৎকার
 
আদি পৃথিবীর স্যুভেনির বয়ে আনে এই বিশালতা, কুড়িয়ে-বাড়িয়ে সেসব জমা করে রেখে দিই বিশাল তোমার নামে, বিশালের নামে নিবেদিত এইসব ভালো, এই মন্দ, সূর্য সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঢেউয়ে ঢেউয়ে বহুকাল নৃত্য করে যাবে
 
৩.
বিশালতা কাকে বলে বুঝেছি সমুদ্রে নেমে, পৃথিবীর তিনভাগ জল মানে কত বারি বুঝেছি সেটাও, তবুও সাহস করি অনুভবে অতল ছোঁবার
 
দূরত্ব আসলে খুব কম তোমার সাথে আমার, মাঝখানে বয়ে গেছে ছোট নাফ নদী, অভিমান মোটে এই একটিই
 
বিশালতা বুঝি বলে বড়োর ছোটত্ব বুঝি, ফাঁকি বুঝি, ভেতরে যে মন থাকে, সেও-তো তিনভাগের চেয়ে বেশি জায়গা জুড়ে আমার, কখনো তুমি তা জেনেছিলে
 
আমি তো পাখির বড়োত্ব মেপেছি চিরকাল, আকাশের বাটখারা দিয়ে 
 
বিড়ালটি
 
তোমরা চলে যাচ্ছ, ট্রাকে মালামাল উঠে গেছে সব, এক জীবনে মানুষের কতবার যে বাড়িবদল জরুরি হতে পারে মানুষও বুঝি তা জানে না
 
একদিন এভাবেই ট্রাকে মাল বোঝাই করে রেলিংঘেরা এই বাড়ির নিচতলায় তোমরা নোঙর ফেলেছিলে, অতিথি পাখি ও গৃহস্থ বিড়াল একদিন ভোরবেলা চার সদস্যের একটি নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার দেখে আহ্লাদে উল্লাস করেছিল
 
তোমরা ত্যাগ করে যাচ্ছ একটি অভ্যস্ত পরিমণ্ডল, তার বিয়োগব্যথায় তুমি কাঁদলে, তোমার মা কাঁদল, ট্রাকের সিটে গিয়ে বসলে সবাই, তুমি, তোমার মা, ছোট ভাই, কুমারী আত্মীয়া
 
বাবাকে তো আগেই রেখে এসেছ অনিবার্য মাটির বিছানে
 
গাড়ি স্টার্ট নিতেই তাড়াতাড়ি হাত নাড়লে তোমরা সবাই, শেষবার তাকালে, বাড়িওয়ালা অনুভূতিহীন, তখনি টাঙিয়ে দিচ্ছেন ভাড়াটে ধরার ‘টু লেট’ বাহানা, ঘরে জল ঢেলে ধুয়েমুছে দেয়া হচ্ছে তোমাদের সুদীর্ঘ ছোঁয়া
 
সব মায়া কাটিয়ে বাধ্য হয়ে তোমরা শহরান্তরে যাচ্ছ, পেছনে কাজলা বিড়ালটি দৌড়াচ্ছে… দৌড়াচ্ছে… দৌ…ড়া…চ্ছে
 
হাওয়া
 
শুকনো পাতায় পাতায় প্রণয় লিখে ছেড়ে দিই হাওয়ার উজান থেকে তোমার দিকে, হাওয়া যদি প্রণয় বোঝে থাকে আর যদি সৎ হয় আর যদি পরস্ত্রীলোভী না-হয়, ঠিক তোমাদের উঠোনে নিয়ে ফেলবে পাতাগুলো
 
আর তুমিও যেমন, পাতাগুলো কুড়িয়ে পাবেই, এমনকি সন্দেহ করি, লালপায়ে নীলখাম বেঁধে আরদিন কবুতর উড়ায়ে দেবে ফেরত ডাকে
 
দূরাধিক স্বপ্নকুয়াশাজাল
 
প্রায়াথর্ব শুয়ে আছি হাজার বছর তমোঘন রাতে, ধ্বনিত সৃজনোল্লাস জীবের শ্রোণিতে, সময় নিকটে এসে ভেঙে পড়ে জলীয় কণার মতো একা, তবু চোখের উপর দিয়ে ধীরে ধীরে একখানি বেড়ে ওঠা ক্রমবর্ধমান, চেরাপুঞ্জির জঙ্গলে বাড়ে যেন জলোল্লাসী গাছ, পাখার ব্যঞ্জনাঘন এই সেই দূরাধিক চাওয়া, সৈকতে বালির প্রায় স্বচ্ছ অভিপ্রায়
 
সংসার বিষণ্নগাথা শ্রেয়োজল মাখা, কুসুমিত ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ যৌথ-অধিষ্ঠান, একটা একটা করে ভেতর-ইষ্টক খসে খসে অলংকৃত ফাটলে ফাটলে যেন পোড়োবাড়ি, ভেঙেচুরে দিনে দিনে ইতিহাস লিখে চলে বয়সের বলিরেখাজুড়ে, তার সিক্ত ক্ষতদেহে উদ্‌গত অঙ্কুর এক মহীরুহ প্রায়, আড়েদিঘে বেড়ে ওঠে নিতিদিন
 
নিচে তার প্রায়ান্ধ সাদা ঘাস, আলো সন্ধানে প্রস্থাপ্রস্থি কেবলি লম্বা হতে থাকি
 
বক্ষগ্রহপুঞ্জে
 
এইসব পাথরপ্রবর আমি রাখব কোথায়, পরিসর ছোট হয়ে যদি আসে দিন দিন নিখিল বুকের, এইসব ক্ষতের বেদনা আমি ঘুচাব কেমনে, পাঁজরবাঁশিতে যদি বেজে চলে নিত্য হাহারব
 
নবীনা ইচ্ছেরা যেন ডুবিগাঁও, ভাসা—তার মেঠোপথ, উতলা বনের শিস, চতুষ্পাঠী বেলা
 
বক্ষগ্রহপুঞ্জে ক্রমে জাগিতেছে যতিবন, অবদমনের ঢের জলা
 
কয়লাতামস
 
এত যদি সুখসন্ধিৎসা
মোহের বিস্তার
ধরো
তমসার তীর ধরে যেতে যেতে একদিন
এ শরীর প্রাপ্ত হলো কয়লাখনির রূপ
শরীর যেহেতু তাকে প্রাণময় ভাবো
অপ্রাণেও যেরকম প্রাণ থাকে জড়ধর্মের
 
হাজারো শ্রাবণ গেল তারপর একে একে
শরীর-পরিধিজুড়ে জমা হলো চাপ চাপ স্বর্ণরেণু
সম্ভবতার অধিক গাঢ় কুঞ্জলিপ্ত রোদ
ঘুমন্ত ও লুকানো সে বিলাসধাতুর মোহে
তখনো কি ভাসবে না কয়লাতামসে
তবু 
 
আত্মপাঠ
 
সে তাকাতে কহিয়াছে আমি তাকায়েছি যাহা দৃষ্টিপাপ বটে
কেননা ইহা অতি উত্তম
সে বলিতে কহিয়াছে আমি বলিয়াছি যাহা সদাসত্য বটে
কেননা ইহা অতি উত্তম
 
সব মোহ তুমি ত্যাগ করিয়াছ জলে ছুড়িয়া দিয়াছ চাবি
বাসি প্রচলের—সে কহিল
সব লোকলাজ তুমি ভুলিয়াছ মুখে তুলিয়া দিয়াছ তালা
যত নিন্দুকের—সে কহিল
কেননা ইহা অতি উত্তম
কেননা ইহা অতি উত্তম
 
তাহারে তো দেখি নাই নিরাকার নৈঃশব্দ্যমণ্ডিত কহে কথা
কেননা ইহা সত্য স্বরূপা
তাহারে তো দেখি নাই আজনম বুকের গহিনে গূঢ় ব্যথা
কেননা ইহা সত্য স্বরূপা
 
আমার ভেতরে থাকে আমি কেননা ইহা উত্তম অভিরুচি
মরিতে বলিলে সে মরে যাই বাঁচিতে বলিলে সে তবে বাঁচি
 
রূপকথা
 
স্বপ্ন তাকে শুভেচ্ছা দিয়েছিল তিমিরাকুল গিরিগুহা আর কাকতন্দ্রা থেকে জেগে গাঙুড়ের জলে মুখ ধুয়ে সে ঘোষণা করেছিল অজন্তা-ইলোরা… আক্রমণের জবাবে তাকে বারবার পালটাতে হচ্ছিল ছেঁড়া তার, মুখে ফেরা সুরসংকটের চাপা ক্ষোভ, শিল্পহীনতার অভিযোগ
 
হেরপর কল্লো না তো কল্লো কী
 
জল এল বরফকুচি পাতিলেবু… সরাবিক প্রতিদিন ঘোরের অতল তলে জগৎ সৃজিল, দেয়ালে দেয়ালে যত গুহাচিত্রের নাম গেল সেঁটে, আর ছেঁড়া তার বাঁধতে বাঁধতে মনে দেখল সে, মাল্যহস্তে দুয়ারে দাঁড়ায়ে আছে শিল্পের দেবী
 
হেরপর
 
চোখের পাতায় জেগে থাকল অনিদ্রাপরি, ঘুমমত্ত ছায়াসাথী নিশিরঞ্জনা, শ্বেতী জোছনায় লাগাতার হইহুল্লোড় আর হাঁটুর ভাঁজে ভাঁজে মৃত্যুকে সহবাসী করে আয়াসে জীবনপাতী লিখনপ্রক্রিয়া
 
হেরওপর
 
ঝাঁক ঝাঁক সারসীর ধলা পাখা দুলে উঠল আকাশের নীলায়, পৃথিবী তাকাল তার দিকে, আর ঘাসস্থান খুঁজে নিয়ে ধীরেসুস্থে শুলে সে, তার শোকে পঞ্চনিশি রোদন করল বৃক্ষ এবং পাখি
 
ভার্চুয়াল
 
❑ 
 
ভাসে শুধু
ডোবে না মোটেই
আঙুল ভেজে না
 
শুধু রিহের্সাল
মহড়া মহড়া খেলা
ফাইনাল কখনো জমে না
 
ছোঁয়া নেই ধরা নেই
গভীর সঙ্গম
 
যে কোনো অজস্রতা
 
যে কোনো অজস্রতা
বিষয়ের গুরুত্ব কমায়
 
প্রতিটা পাতাঝরা তাৎপর্যপূর্ণ
অথচ আলাদাভাবে সবাইকে ভাবা
এপিটাফ লেখা
কেঁদে ওঠা
 
মানুষ পারে না
 
কারো মৃত্যুতে কেউ না কাঁদলেও
সে মৃত্যুও মৃত্যু
 
পথমাত্র পথিকের প্রতি নিবেদিত
তার শয়ন আনুভূমিক হোক বা উলম্ব
 
যে কোনো অজস্রতা
আমাদের বিকল্প দেখায়
 
পাখিসম্প্রীতি
 
পাখিঅভিধানে কোনো ধর্মসংস্কার নেই
 
শালিকের কামকেলীতে কখনো আহত হয় না
কাকের ধর্মীয় অনুভূতি
 
পাখিকুলে সন্ধ্যারতি নেই
হিজাব-টিজাব নিয়ে নেই মাথাব্যথা
 
পাখিসমাজে চাপাতি ব্যবসা জমে না
সহস্র প্রজন্ম গেল পাখিদের
কখনো বাঁধে নি কোনো গুরুতর দাঙ্গা
 
পাখিপাড়ায় কাজেই কারো মহাত্মা গান্ধী হবার সুযোগ নেই
 
 
 
 
 
 
 
 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত