| 28 মার্চ 2024
Categories
শিশুতোষ

গোপাল ভাঁড়ের গল্প

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

একি মগের মল্লুক

এক পাড় মাতাল রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে গোপালের বাড়ির রোয়াকে বসে হেড়ে গলায় গান জুড়ে দিল। গোপাল তার ছেলেদের ডেকে বললে, বেটাকে বেধে ঘা কতক দে তো। এপাধা নি ব্যাটাকে দে প্যাদানি।

মাতাল ফিক করে হেসে বলল কি বাওয়া। তোমারও কি নেশা হল নাকি? যা নয় তাই বলতে শুরু করলে। আমি কি মনের সুখে গান গাইতেও পারব ‍না বাওয়া। একি মগের মল্লুক না কি, যা বলবে তাই শুনতে হবে? আর বাঁধবে কেন ঠাকুর- আমি কি ভোগের চাল কলা ফল না কি?

গোপাল এই কথা শুনে না হেসে পারল না। গোপালের হাসি দেখে মাতাল গান ছেড়ে শুরু করল তখন তিড়িং বিড়িং নাচ। পাধা নি।

সবচেয়ে বড় ফারসী শব্দ

মৌলভী সাহেব একদিন মক্তবে ফারসী পড়াতে পড়াতে প্রশ্ন করলেন, আরবী ফারসীতে সবচেয়ে বড় শব্দ কি, যে যা জান, তোমরা ভেবে চিন্তে সব বল। বারো চোদ্দ অক্ষরের এক একটা শব্দ ছেলেরা অভিধান থেকে টেনে টেনে বার করতে লাগলো। মৌলভী সাহেব টুপি নাড়াতে নাড়াতে একবার এধার একবার ওধার ঘাড় দুলিয়ে বললেন, না না এর চাইতেও বড় শব্দ আছে তোমরা ভেবে বল। তখনকার দিনে ফারসী জানা থাকলে দরবোরের কাজে সুবিধা হত। এজন্য কাজের আশায় গোপাল সেখানে পড়ত। এবার অনেক ভেবেচিন্তে সে বললে, যত বড় শব্দই থাক, সবচেয়ে বড় শব্দ হল ইসমাইল। ঠিক বলছি কিনা দেখুন। মৌলভীর চোখ তখন কপালে। তিনি অবাক হয়ে বললেন, কিসে এটা বড় শব্দ হলো? গোপাল বললে, দেখছেন না- একটি পুরো মাইল আছে এই শব্দটার ভেতরে? জী এর চেয়ে বড় শব্দ আর কিছুই হতে পারে না মুলুকে। আপনি না বললে তো হবে না।

ধরে আনতে বেঁধে আনা

রাজা কৃষ্ণচন্দ্র একবার পেয়াদাকে ডেকে বললেন, ওরে ভজহরি ব্যাপারীকে একবার ডেকে আনবি তো। ভজহরি সরেস গুড়ের কারবার করত। পেয়াদা ব্যাপারীকে একেবারে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাজসভায় হাজির করলে। ভজহরি গোপালকে ধারে মাল দিতে চাইত না, তাই তার ওপর গোপাল চটে ছিল। পেয়াদা তাকে আজ একেবারে রাজসভায় বেঁধে এনেছে বলে গোপাল মনে মনে বেশ খুশিই হল। বলল,- বেশ হয়েছে শালাকে বেধেই এনেছে।

রাজা কিন্তু পেয়াদার ওপর চটে গিয়ে বললেন, আমি ভজহরিকে ডেকে আনতে বললুম, আর তুই কিনা একেবারে বেধে নিয়ে এলি? তোকে আমি বরখাস্ত করব। তোর বেশ বাড় হয়েছে, কেন তুই বেধে এনেছিস- আগে কৈফিয়ত দে, নয়তো এখনি তোকে বরখাসত করলাম। তোর কিছু বলার থাকে বল।

পেয়াদা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আর করব ‍না হুজুর। এবোরের মত বেয়াদপি মাপ করুন। নাহলে খেতে না পেয়ে মরে যাবো।

গোপাল পেয়াদা পক্ষ নিয়ে ওকালতি করে মোলায়েম স্বরে বললে, হুজুর একে বরখাস্ত করবেন না- এ হচ্ছে জাত পেয়াদা। পেয়াদারা ধরে ‍আনতে বললে বেধেই আনে – আর এ ডেকে আনতেই বলায় বেধে আনায় প্রকৃত পেয়াদার মতোই কাজ করেছে। যদি জাত পেয়াদা না হত সে কখনই বেঁধে আনত না। কথাটা ঠিক কিনা এবার মহারাজ আপনি বিবেচনা করে দেখুন।

গোপালের কথায় রাজা হেসে ফেললেন এবং অতি করিৎকর্মা পেয়াদাকে ক্ষমা করে দিলেন সেবারের মত। বললেন, এবারের মত অবশ্য মাপ করলাম, আর যেন কখনও এমন না হয় মনে রাখবি।

জাত কুল সব গেল

গোপালের স্ত্রী নিজেই দেখাশোনা করে বড় মেয়েকে এক বামুনের বাড়িতে বিয়ে দিয়েছিল। সেই মেয়ের মেয়ে বড় হোল একদিন। তারই বিয়ের নিমন্তন্নে গোপালেরা উপস্থিত। স্ত্রী একান্তে ডেকে বললে, হ্যাঁ গা, আমাদের বড় মেয়ের জামাই নাকি জাতে নাপিত বামুন নয়। কিন্তু সে সম্বন্ধ তুমি কিছু জান কি?

স্ত্রীর কথা শুনে গোপাল বললে, আর চেপে যাও- আমিও আসলে বামুন নই, আমি জাতিতে নাপিত। তোমার বাপের কাছে জাত ভাঁড়িয়ে তোমাকে বিয়ে করেছি। তুমি জাতকুল হারালেও আমি মোটেই জাতকুল হারাইনি। জাতকুল আবার কি? ধন মানেই সব। যার ধন আছে সেই সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি। অতএব, এর জন্য তোমার ভাবনা চিন্তা করার কিছুই নেই। তুমিও হয়ত এই রকম কোন তাঁতির মেয়ে হবে।

পাওনাদার

গোপাল একবর বাইরে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানে গিয়েই অসুখে পড়ে গিয়ে বিভ্রাট। সেখানকার লোকজনেরা তখন তাকে একটি হাসপাতালে দিয়ে আসে। বিদেশ বিভুই তাই সেখানে জানা শোনা লোক ছিল না তার। রোজগার পত্র না থাকায় অনেক ধারটার হয়েও গেল সেখানে। সেই হাসপাতালে এক বৃদ্ধা তাঁর ছেলেকে রোজ দেখতে যান। তিনি লক্ষ করেন, সব রোগিকেই কেউ না কেউ দেখতে আসে- খাবার নিয়ে আসে, কিন্তু সামনের একজন রোগীকে কেউ দেখতে আসে না বা কিছু মিষ্টিও তার জন্য আনে না। অনেকদিন বাদে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, বাছা তোমাকে কি কেউ দেখতে আসে না? বাড়ি থেকে কেউ কিছু নিয়েও আসে না দেখছি।

গোপাল বললে, একটু ‍ আগে একজন এসেছিলে। সে পাওনাদার, টাকা পাবে, তার তাগাদা দিতে। আর আমি টেসে গিয়ে তার পাওনা ফেঁসে গেল কিনা চোখে চোখে রেখে খবর নিতে।

 

হিসেবী লোক

গোপাল একবার দূর দেশে বেড়াতে যাবে বহুদিন ভাড়াটে বাড়িতে রয়েছে, একে একে অনেক আসবাবপত্র জমা হয়েছে। সে সব আসবাব সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব, অথচ বেচে যেতেই ইচ্ছে নেই। হেকে পয়সা পাবে। বেচে গেলে টাকা পয়সা যা পাওয়া যাবে এখন, তাতে ফিরে এলে সে টাকায় তো আর খরিদ করা যাবে না, ভালো ভালো আসবাবপত্র প্রায় সব গোপাল সকলের কাছ থেকে দান হিসাবে পেয়েছে তা তো বেচা উচিত নয়। তাহলে লোক কি বলবে? তাই কি করা যায় এ কথাই বার বার ভাবছে। আবার আসবাবপত্র রেখে যাওয়ার জন্যে ওই ভাড়া বাড়িটা বজায় রাখার কোনো মানে হয় না। কারণ অনেক টাকা ভাড়া গুনতে হবে। ভেবে ভেবে অবশেষে একটা ফন্দী বের করলে। গোপাল একটা বড় বন্ধকী দোকানে আসবাবগুলো নিয়ে গিয়ে বন্ধক দিলে। অনেক টাকা দামের আসবাবগুলো নিয়ে গিয়ে বন্ধক দিলে মাত্র চারশো টাকায়। দোকানদার ওইসব আসবাব রেখে পাঁচ হাজার টাকাও দিতে রাজি ছিল। কিন্তু গোপাল ভাবল টাকার চেয়ে জিনিস রাখারই গরজ তার। যত কম টাকা নেওয়া যায়, সুদ টানতে হবে তত কম। সেজন্য হিসেব করে দেখলে- চারশো টাকার দরুন মাসে তার যে সুদ দিতে হবে, একটা ঘর ভাড়া করে জিনিসগুলো রেখে যেতে তাকে মাসে মাসে অনেক বেশি ভাড়া গুনতে হবে। গোপাল বেশ কিছুদিন পর ফিরে এসে টাকা দিয়ে আবার আসবাবগুলি ছাড়িয়ে নতুন ঘরে উঠল।

 

একই কপি

একদিন একটি বিশাল ধর্মসভায় বক্তৃতা হচ্ছিল সেখানে গোপালও ছিল বক্তৃতা শুনছে। একজন সকালবেলায় যে বক্তৃতা দিলেন, বিকালবেলার অন্য একজনও সেই একই বক্তৃতা দিলেন- একই ভাষা, একই কথা। লোকজন সবাই অবাক। শেষে সকলে শুনে বললে, এরূপ কি কোনদিন হয়? গোপাল বলল নিশ্চয়ই বক্তৃতা কিনে এনেছেন। দৈবক্রমে একই বক্তৃতার কপি দুজনে কিনে এনে তাই উগরাতে গিয়ে বামাল শুদ্ধ ধরা পড়েছেন, আর কি। এই শুনে সকলে গোপালের উপস্থিত বুদ্ধির তারিফ করে হাসির রোল তুলে সবাই সভা মাতিয়ে দিল।

 

তোমার আমার ব্যাপার

গোপাল একদিন তার প্রিয় বন্ধু নেপালকে বললে, দেখো ভাই সবই তোমার আমার ব্যাপার।

নেপাল জিজ্ঞাস করলে, সে আবার কি রকম?

গোপাল বললে, এই ধরো নেপাল- তোমার বাড়ি আমার বাড়ি, আমার বাড়ি তোমার বাড়ি, তোমার টাকা আমার টাকা, আমার টাকা তোমার টাকা, তোমার জামা আমার জামা, আমার জামা তোমার জামা এই সব আর কি। বন্ধুবর অবাক হয়ে গোপালের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল এ হেন অন্তরঙ্গতার ছোঁয়া পেয়ে। গোপাল ততক্ষণে ভেল্কি দেখানোর মত নেপালের পকেটে হাত ঢুকিয়ে খাবলা মেরে কিছু পয়সা তুলে নিয়ে বলে, এই যেমন তোমার পকেট আমার পকেট সেই পকেট তোমারই থাকল- তোমার হাত, মানে আমার হাত গেল আর এল।

নেপালের নয়ন গোল হয় আর বদন ক্রমাগত বিস্ফরিত হতে থাকে।

ঘোড়া নয়, গাধা দরকার

গোপালের গ্রামে এক ধোপা বাস করত। সে খুবই বোকা। তার একটা ঘোড়া ছিল। কিন্তু ঘোড়ার দ্বারা কাপড় কেচে বাড়ি বাড়ি দেওয় যায়না। তার একটা গাধার দরকার। ঘোড়া বিক্রি করে সেই টাকায় গাধা ভাল রকম কিনে আনতে পারে- সে এ কথাটা ভাবতে পারে না। এমনই তরল তার মগজের ঘিলু। গোপাল অনেক কাজ সমাধা করে দিতে পারে লোকের মুখে শুনে সে গোপালকে গিয়ে ধরল, গোপাল দাদা, গোপাল দাদা, আমার এই ঘোড়ার দরকারনেই, একে গাধা বানিয়ে দাও। তুমি নাকি লোকে বলে সব পার।

গোপাল হেসে বললে, ব্যাটা তোমার মত গাধাকে পিটিয়ে বরং ঘোড়া বানানো যায়, ঘোড়া পিটিয়ে গাধা তৈরী করা যায় না আদপেই।

গোপালের কথা শুনে সে গজরাতে গজরাতে এই বলে বাড়ি ফিরল যে তুমি সব করতে পার কিন্তু ঘোড়া থেকে গাধা তৈরি করতে পার না- তবে তুমি কিসের সব ঘোড়ার ডিমের কাম কর। তবে তোমাকে এত লোক খাতির করে কেন?

গোপাল এই কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। ধোপাও বিফল মনোরথ হয়ে ঘোড়া নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল।

 

আজ যে ভীম একাদশী

গোপাল একাদশী করত। তার একাদশী করা অভ্যাস। গোপাল একাদশীর দিন সন্ধ্যেবেলায় প্রসাদ পেত লুচি, মিষ্টি- নানাবিধ ফল সহকারে। সেদিন যেন মহোৎসব লেগে যেত। গোপালকে ওভাবে একাদশীর দিন ভোজন করতে দেখে তার এক চাকর বললে, সামনের তারিখ থেকে আমিও একাদশী পালন করব বাবু। আমার একাদশী করার খুব ইচ্ছে। আপনি যদি আদেশ দেন আমি একাদশী করি। আমার খুব ইচ্ছা।

গোপাল মুচকি হেসে বলল, খুবই ভাল কথা, এই তো চাই। একাদশী করা সকলের উচিৎ। দেহের উপকার, তার সাথেই মনেরও সাত্ত্বিকভাব সাধনের জন্য একাদশী সকলের করা উচিত। পরবর্তী একাদশীর তারিখে সকাল থেকে গোপালের সঙ্গে অভূক্ত রইল।

কিন্তু সাঁঝ গড়িয়ে রাত্রি গভীর হয় হয়, তখনও গোপাল ভোজন করছে না দেখে চাকরটি ধৈর্যহারা হয়ে জিজ্ঞাস করলে, বাবু প্রতি একাদশীতেই তো আপনি সূর্যাস্তের ঠিক পরেই প্রচুর ভাল মন্দ ভোজন করে থাকেন, কিন্তু আজ এখনও কিছু খাচ্ছেন না কেন?

গোপাল মুচকি হেসে বলল, ওরে ব্যাটা আজ যে যেমন তেমন একাদশী নয়, সাক্ষাৎ ভীম একাদশী- আজ একদম নিরম্বু উপবাস। আজকে জলও খেতে নাই । সেজন্য আজ আর কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করিনি।

গোপালের চাকর হায় হায় করতে লাগল। এমন হবে জানলে কি সে একাদশীর নাম মুখে আনতো। পেট যে চোঁ চোঁ করছে। সেই থেকে চাকর আর কোন দিন একাদশীর কথা মুখে আনল না ভুলেও। গোপালও মুচকি হেসে মনে মনে বলল বেটা আজ বেশ ভালরকম জব্দ হয়েছে, আর কোনওদিন একাদশীর কথা মুখেও আনবে না। সহজে মতলব হাসিল হল দেখে মনে মনে আর একচোট হেসেও নিল গোপাল। যেমন কর্ম তেমন ফল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত