Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,goutam guha roy

যখন গাছেদের গায়ে অন্ধকার লেগেছিল

Reading Time: 4 minutes

আজ ২৪ জানুয়ারি কবি, কথাসাহিত্যিক ও সম্পাদক গৌতম গুহ রায়ের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,goutam guha roy

আলো কমছিলো। কুসুমের ঢেঁকিঘর ও রান্নাঘরের মাঝের এক চিলতে ভেজা মাটি। সেখান থেকে ডাকলে শোয়ার ঘরে সে ডাক সহজে পৌঁছায়। সেই বাড়ির পেছনের ঢেঁকি শাকের ঝোপের পাশে দাঁড়িয়ে সুচন্দ্রা আবারো হাততালি দিয়ে ডাকলো, তৃতীয়বারের মতো। তার হাততালির শব্দে উড়ে এলো ভিক্টোরিয়া পার্কের ধুলামলিন ঘাসের গন্ধ, তার উপর ত্যারছা ভাবে পড়ে থাকা ভরা পূর্ণিমার চাঁদের বিষ। এই মহল্লা কোলকাতা থেকে ট্রেনে ৪ঘন্টার পথ। সেখান থেকে ৩৫ মিনিট পায়ে হাঁটা। এই নিত্যযাত্রার ধকলে মেয়েটি কেমন যেন মিইয়ে যেতে থাকে ক্রমশঃ।বেলুনের হাওয়ার মতো, ধীরে ধীরে বাতাসে মিলিয়ে যায় চকচকে দুপুরে হঠাৎ ধাক্কায় জেগে ওঠা দুজনের হাসি মাখা স্মৃতি। বাতাসে এমন অনেক কিছুই মিশে যায়, কোনো চিহ্ন না রেখে।

   কুসুমের সাথে সুচন্দ্রা চাঁদের আলোয় কোথা থেকে ফিরে এলো তা নিয়ে গোপন ফিসফাস চাপা দিতে গিয়ে নড়ে উঠলো মহল্লা। কুসুমের তরল হাসিতে ধুয়ে গেল মাথা তুলতে চাওয়া ভয়। স্বামীর পথ দুর্ঘটনায় চলে যাওয়ার ঘটনার পর একাই ঝড় সামলে এখন কাউকে আর তোয়াক্কা করে না সে। এই সব ঢ্যামনাদের ভালো চিনেছে গত এক দশকে। ওদের দুজনের পিছনে উসখুশ মহল্লা। মন্দিরের পেছনেই ঘটেছিলো যা ঘটার, একটা দীর্ঘশ্বাসকে পূজো দিয়ে বাড়ি ফিরে ছিলো সুচন্দ্রা, সেই রাতে নামটাকে একটু ছোটো করে নেয় সে, “সু”ছেটে শুধু চন্দ্রা হয়ে যায়। যদিও মহল্লার খুঁটিতে তার সু আটকেই থাকে তখনো।

    রোদে জলে পুড়ে যাওয়া সময়টাকে সে আর কান্নার জলে ভেজাতে চায় না। মহল্লায় যারা তাকে গোপনে নষ্টা বলে,তাদের বাসার সামনে দিয়ে সে বুক চিতিয়ে যায়, লক্ষ্য করে মন্টু মিঞা পাস দিয়ে যেতে যেতে কিভাবে কামুক চোখের ইশারা বাতাসে ছুঁড়ে দেয়, সে তখন উল্টো বাতাসে, ফিরেও চায় না। তার নজর ডান দিকের পুকুর পাড়ে, যেখানে নিঃশব্দে ঘাপটি মেরে আছে অষ্টাদশী কুসুমের খোয়া যাওয়া টিপ, যেখানে ভাঙা “রেশমী চুড়ি” ছুঁড়ে ফেলে সে জল ছুঁয়ে দেখেছিলো জল কিছুই ধোয় না, দাগগুলো রয়েই যায়। ঘাটের পাড়ে এসে তার খোলা বুকের ভিতর থেকে দীর্ঘশ্বাসটা ছিন্ন ফুলের মতো টপ করে ঝরে পড়েছিলো। চন্দ্রার চোখ সেই শুকনো ফুলটা খোঁজে।

   মহল্লার গাছগুলো কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে, আফশোষ করে রতন কবিরাজ। এই আমাদের  পিতৃপুরুষের ভিটা, কিন্তু দেখ ,শুধু বন তুলসী আর ঢেঁকির ঝোপে ঢেকে যাচ্ছে। কোথায় গেল জুঁই, বেলিফুল, চাঁপা, গন্ধরাজ?  কই, সেই সব ফুলে ফুলে ম ম করা সময়? সব কেমন ধূসর, বেরসিক হয়ে উঠছে, রতন নিজেই নিজেকে শোনায়। প্রাণপণে নিশ্বাস টেনে দেখে ফুলের হারানো সেই গন্ধ পাওয়া যায় কি না। ধপ করে বসে পড়ে সে। তখনই উওরের দিকে তাকিয়ে দেখে প্রচুর অচেনা পাখি উড়ে যাচ্ছে, তাদের প্রতিটি ঠোঁট থেকে ঝরছে ফুলের বীজ।

   রতন আকাশের দিকে তাকিয়ে একা একা কার সাথে যেন কথা বলে, ক্রমশ এই কথাটা চাউর হয়ে যায়।ধীরে ধীরে মহল্লার খোরাক হয়ে ওঠে সে। ভ্রূক্ষেপহীন রতন কবিরাজ আকাশের দিকে তাকিয়ে সন্ধ্যায় পাখিদের উড়ে যাওয়া দেখে, ভিটামাটির ভুতুড়ে  ছায়ার দিকে তাকায় আর নিজের মনে বিড়বিড় করে, হারানো গাছেদের সাথে কথা বলে। ভিটার মাটিতে যেই গাছ বাড়ে তার তন্তুতে তন্তুতে বাপ-ঠাকুর্দার রক্ত লেগে থাকে। রতনের ভেতরে জেগে ওঠে জুঁই বেলীফুল, চাঁপার গন্ধ, সেই গন্ধে বহু দিনের স্মৃতি জেগে ওঠে, এই গন্ধ স্মৃতির মধ্যে থেকে জেগে ওঠা কাহিনীর গন্ধকে সনাক্ত করতে পারে। রতন কবিরাজ ফিস ফিস করে, এই গন্ধের বুকে পাপের ফসিল ভেসে বেড়ায়, তোরা দেখতে পাস না । রজ্জাক সেই বিকালে কাল্লুকে বলে, গাছ গাছ করে রতনটা পাগলা হয়ে গেলরে! তখন একটা আফসোস মহল্লায় ছড়াতে থাকে, গাছেদের হারানোর মতো, ফাঁকা ফাঁকা লাগে সবার। ঠিক এমনি এক সন্ধ্যয় ওই দুই মেয়ে, খুব বন্ধু হয়েছে এখন, ফিরছিলো, হাতে কাগজে মোড়ানো ফুলের কয়েকটা চারা গাছ। মহল্লার কুঁড়েদের তাসের আড্ডার নজরে আসে, শুরু হয় ফিস ফাস, মুক্ত পাখি হয়েছে দুটো, কোথায় কোথায় যে উড়ে বেড়ায়! কথাগুলোর মধ্যে শ্লেষের থেকে হতাশা বেশী থাকে।

   রতন চোখ গোল্লা করে তাদের হাতের গাছের চারাগুলো দেখে, কি গাছগো ওগুলো? তারা হিহি করে আর বলে, বিলাইতি জবা আর ক্যামেলিয়া, বাসায় লাগামু।

   গাছগাছালি নিয়ে আর কোনো ফিসফাস হয় না, যা হয় তা হই হই করে হয়, যেমন মহল্লার বড় বট গাছটা যখন কাটার কথা হলো। পঞ্চায়েত নিলাম ডাকলো। বড়দের কেউ কেউ বিরুদ্ধে থাকলেও পঞ্চায়েত সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটলো না। রতন শুধু বিড় বিড় করে গেলো, গাছ তো কাটবে, কিন্তু ওই পাখীদের কি হবে। হাজার হাজার মুক্ত পাখী ওই গাছে সন্ধ্যায় ফিরে আসে, তাদের কি হবে, বাসাটাই যদি না থাকে? কথাটা কাল্লু মিঞার কানে গেলেও সন্ধ্যার আড্ডায় সে আর কথাটা তুলবার সাহস পেলনা, তবুও পাখিদের কথা এসেই যায়, মোড়ল আসার আগেই । অমল বুড়া কথাটা পাড়ে, মহল্লার কেউ কেউ পাখীর মতো উড়ে বেড়ালে মহল্লার বিপদ বাড়ে। মাথা নাড়ে কেউ কেউ, কিন্তু কথা এগোয় না। সময়ের সাথে সাথে মানুষগুলোও কেমন মিইয়ে যায়, মানুষগুলো ফাঁকাফাঁকা হয়ে যায়। আগের মতো গায়ে গা লাগিয়ে ফিস ফাস কথা হয় না, এখন কথার গায়ে কথা চাপিয়ে হুলুস্থুল বাধে। কালু এই সব ভাবতে ভাবতে আকাশের দিকে তাকায়,  রতনের মতো সেও দেখে অজস্র পাখী উড়ে যাচ্ছে, প্রতিটি ঠোঁটে তাদের বীজ চক চক করছে। পাখীর গল্পে গল্পেই সেই সন্ধ্যা রাতের দিকে ঢলে পরলো আর সেই পুকুরের জলে তরল আলো ঢেলে একটা গোল আলোগোলোক ডুবে গেলো।

    পর দিন সেই দুই পাখি, কুসুম ও চন্দ্রার বাসার সামনেটা  মহল্লার আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। মোড়ের পার্টি অফিসের ঝান্ডাটার মতো লাল জবা টকটক করছে সবুজ গাছটায়, বর্ষা পার হয়ে সেই গাছগুলোতে আজ বন্যতার তেজ। সেই ফুলের দিকে তাকিয়ে মহল্লার অনেকের নিজের নিজের ভিটার কথা মনে পরে, কাল্লুর মনে পড়ে কচি বৌটা কেমন নিজে হাতে শেফালির চারা লাগিয়েছিলো, একদিন সে আর ফিরে আসেনি মহল্লায়। এতদিন কাল্লুর নজর থেকে হারিয়ে গিয়েছিলো সেই গাছটার কথা, আজ সেদিকে মনটা টানল, সেখানে ফাঁকা অন্ধকার চাপ ধরে আছে। কত যুগ পরে বুকের ক্ষতটা আবার টনটন করে উঠলো । সে আকাশের দিকে তাকায়, দেখে একঝাঁক পাখী উড়ে যাচ্ছে, আকাশটা ডুবে যাওয়া আলোয় রাঙা হয়ে ওঠে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>