মাল্যবান বলছে,স্বপ্নের কী জানেন ফ্রয়েড? হ্বিয়েনা শহরে বসে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে স্নায়ুরোগীদের স্বপ্ন নিয়ে কোনও স্বপ্নতত্ত্ব বানানো যায় না।চড়কের মাঠে কোনওদিন তো আর যাবেন না ফ্রয়েড সাহেব,স্বপ্নের আর কী বুঝবেন।কী ভয়ঙ্কর রকমের আধুনিক একজন চিন্তক জীবনানন্দ দাশ ভেবে অবাক হই।
ঠিক এখানেই ফ্রয়েডেরই শিষ্য কার্ল গুস্তাভ ইয়ুঙও ফ্রয়েডের থেকে আলাদা হয়ে যান।ইয়ুঙও মনে করেন,শুধু ব্যক্তি নির্জ্ঞান নয়, স্বপ্নের ক্ষেত্রে যৌথ নির্জ্ঞানেরও একটি ইতিবাচক ভূমিকা আছে।আর সেজন্যই কি জীবনানন্দ চড়কের ইঙ্গিত করেন?ফলিত বিজ্ঞানের ফ্রয়েড থেকে তত্ত্ব বিজ্ঞানের ইয়ুঙ বেশি কাছের হবে জীবনানন্দর?
আমাদের কাছে জীবনানন্দ দাশের উপন্যাসগুলো দুর্বোধ্য মনে হয়, একঘেয়ে লাগে, রিপিটেডিভ মনে হয়।একটু লক্ষ করে দেখবেন, জীবনানন্দ দাশের অনেক গল্প-উপন্যসের পটভূমি ঠিক যেন বাস্তব নয়, স্বপ্ন-স্বপ্ন। ডায়েরিতে আমরা দেখি, অনেকসময়ই কী স্বপ্ন দেখছেন তার এন্ট্রি করে রাখছেন।মোদ্দা কথা,জীবনানন্দ খুব সচেতন ভাবে স্বপ্ন নিয়ে ভাবছেন।এতে আমার কোনও সংশয় নেই।
ফ্রয়েড পড়েছেন কোনও সন্দেহ নেই,জীবনানন্দ কী তবে ইয়ুঙও পড়েছেন।ধুরন্ধর লোকটা যে আর কী কী করেছেন তার ঠিকুজি তৈরি করা এখনও শুরুই হয়নি!ইয়ুঙ তো তাঁর ‘সাইকোলজি অ্যান্ড লিটারেচার’ সন্দর্ভে বলেছেন:
মহৎ লেখার গঠন-কাঠামো অনেকটা স্বপ্নের মতো।
আসলে আমরা তো নিজেদের স্বপ্নকেও বিশ্লেষণ করিনা।করতে শিখিনি।নিজেদের স্বপ্নও তো আমাদের কাছে একপ্রকার দুর্বোধ্য। আমরা কীভাবে জীবনানন্দ দাশের চরিত্রের মনোপ্রকৃতি বা লিখন-বিশ্বকে বিশ্লেষণ করব!কিংবা ডায়েরির এন্ট্রিগুলি ধরে ধরে জীবনানন্দর মানসিক গঠনকে বুঝে নেব!
‘মাল্যবান’-এর কথাই যদি ধরি,আমাদের কী মনে হয় না,মাল্যবান তো বটেই,উৎপলাও জীবনানন্দ দাশেরই একটি সত্তা।ইয়ুঙ দেখিয়েছেন দৈহিক গ্রন্থিগত কারণে, পুরুষের নারী সত্তা ও নারীর পুরুষ সত্তা আছে।পুরুষের নারী সত্তাকে বলে এ্যানিমা ও নারীর পুরুষ সত্তাকে বলে এ্যানিমাস।এই এ্যানিমা ও এ্যানিমাসের নির্জ্ঞান প্রভাবে মনের গঠন তৈরি হয়।এছাড়া আছে ব্যক্তির নির্জ্ঞানের ছায়াছন্ন দিক ও নির্জ্ঞান মানসের আত্মন।
তো ‘মাল্যবান’-এ যে রূঢ়,কোঠোর, নির্দয় ও মুখরা উৎপলাকে দেখি তা কি জীবনানন্দ দাশেরই আরেকটি সত্তা নয়!
নিজের অজান্তে,তিলতিল করে,প্রথমে মুনিয়া,তারপর Y ও শেষে লাবণ্যর দ্বারা নিষ্পেষিত ,ব্যবহৃত ও প্রত্যাখ্যাত হতে হতে উৎপলা চরিত্রটি গড়ে তুলেছেন!
বিস্মিত হয়ে একটি গল্পে আমরা দেখি,একজন মহিলাকে কীভাবে সামান্য লুচি-মাংসের আস্বাদ, ধীরে ধীরে তৈরি হওয়া আসন্ন যৌনতার আস্বাদকে ভুলিয়ে দেয়।জীবনানন্দর মহিলারা প্যাসিভ না অ্যাকটিভ এটা নিয়েও অনেক ভেবেছি।যেমন ‘গ্রাম শহরের গল্প’-এ শচীর আগ্রাসী ভূমিকার বিপরীতে নায়কের মনে হয়,যা একদিন উন্মুক্ত প্রান্তরে হয়েছিল তা এই ‘সোফা’-তে সম্ভব নয়!
আসলে ব্যক্তি জীবনের মহিলারা যেমন মা কুসুমকুমারী,বোন সুচরিতা,মাসী হেমন্তবালা দেবী, মেয়ে মঞ্জুশ্রী, মনিয়া, খুড়তুতো বোন শোভনা,স্ত্রী লাবণ্য, মাসতুতো বোন খুন্টি,শালী ছুটু কিংবা ব্রাহ্মসমাজের কিছু মহিলা শুধু নয়, নির্জ্ঞান মানসও জীবনানন্দের অরুণিমা সান্যাল,বনলতা সেন, শেফালিকা বোস, সুরঞ্জনা, উৎপলা, বিভা, কল্যাণীদের গড়ে তুলেছে।
এত গূঢ় ও তির্যক উচ্চারণ বাংলা কবিতা আর কখনও দেখেছে, যেখানে এখন শুধু শেল্ফের চার্বাক ও ফ্রয়েড জানে,কবির প্রক্ষিপ্ত সত্তা সুজাতাকে ভালোবেসেছিল কিনা।নির্জ্ঞান এমনই গোঁয়ার,কোনও বিধিনিষেধ মানে না,তল্লাট তার দখলে নেওয়া চাই।
সত্যিই তো! জীবনানন্দ দাশের মনে হবে,স্বপ্নের কী জানেন ফ্রয়েড!পিকাসোর আগে একজন পিকাসো ছিলেন,আইনস্টাইনের আগে একজন আইনস্টাইন, জীবনানন্দ দাশের আগে একজন জীবনানন্দই শুধু ছিলেন।
ইতিহাস যেখান থেকে শুরু হয়।
কুন্দেরার মতে সেই ইতিহাসের ‘এইচ’ বড়ো অক্ষরের।
কবি,সমালোচক,গবেষক