অনুবাদ গল্প: পুরুষ । গুলজার »অনুবাদক ফজল হাসান
»ফজল হাসান
সে খুবই চিন্তিত। তার শরীরে গর্ভধারণের চিহ্ন অল্প করে দেখা যেতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে হস্টেল থেকে কাপ্পুর বাড়ি আসার সময় ঘনিয়ে এসেছে। সে ভয়ে ভয়ে আছে, কাপ্পু যদি তাকে জিজ্ঞাসা করে, তখন কী হবে? যদিও কাপ্পু তার একমাত্র ছেলে, স্বামী তো নয় যে জবাবদিহিতার জন্য জোর খাটাবে।
মহিলারা যা-ই করুক না কেন, সবসময় তাদেরকে কোন না-কোন পুরুষের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। কখনও বাবার কাছে, অন্য সময় স্বামী কিংবা ছেলের কাছে। কান্তার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সময় থেকে বক্সিকে কোন জবাবদিহি করতে হয়নি। সত্যি বলতে কি, যদি কখনও বক্সিকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তাহলে সে থালাবাটি ভাঙবে। অনেক সময় সে মারধরও করেছে। ঘটনাটি ঘটেছিল সেই সব দিনগুলোতে, যখন ঘরের ভেতর উত্তেজনা ছিল তুঙ্গে। তারা উভয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, কাপ্পুকে নৈনিতালের এক আবাসিক স্কুলে পাঠিয়ে দিবে, যেন সে ভাঙা থালাবাসন না দেখে, যা তাদের সংসার ভেঙে টুকরো হয়ে যাবার চিহ্ন বহন করে। বক্সির সঙ্গে কান্তার পরিচয়ের পর থেকে রমার প্রতি বক্সির দৃষ্টিভঙ্গি খুব দ্রুত পাল্টে যায়। রমা বুঝতে পারে, তার সঙ্গে বক্সি বেশি দিন থাকবে না এবং ঘটনা ঠিক তা-ই ঘটেছে। টেলিফোন বাজে এবং তৎক্ষণাৎ থেমে যায়। বক্সি সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে। হয়তো অফিসে প্রায়ই অসময়ে কোন বিশেষ কাজ পড়ে যায়। সে প্রতিটি সঙ্কেত ধরতে পারে- বুঝতে পারে…
বক্সি ঘরসংসার থেকে দূরে থাকা শুরু করে। অফিসের কাজে বাইরে যাওয়া তার জন্য একধরনের অজুহাত মাত্র। সবসময় রমা জানে, বক্সি কোথায়, কখন এবং কোন হোটেলে থাকে।
এক বছরের মধ্যে রমা তার ব্যাঙ্কের পুরনো চাকুরিতে পুনরায় যোগদান করে। কিন্তু তার পরেও তাকে জবাবদিহি করতে হয়। তার বাবার কাছে এবং বক্সির কাছে। সত্যি বলতে কী, তার বাবাকে বুঝিয়ে শান্ত করার জন্য বক্সি সহযোগিতা করেছে। সে জানে, শুধু তার একার বেতনের টাকা দিয়ে দুটি সংসার চালানো সম্ভব নয়।
মেয়েকে অগোচরে নিয়ে গিয়ে রমার বাবা জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমাদের দুজনের মধ্যে কী কোন সমস্যা দেখা দিয়েছে?’
রমা আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছে, ‘না, বাবা। সব সংসারেই তো কম-বেশি খুনসুটি হয়। কিন্তু কপিলের আবাসিক স্কুলে যাবার পর থেকে উপলব্ধি করছি যে কিছু একটা হারাতে শুরু করেছি।’
বাবা মেয়েকে আর কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি। তিনি শুধু বলেছেন, ‘নানা-নানীকে দেখার জন্য কপিলকে পাঠিয়ে দিও।’
জবাবে তারা দুজনেই বলেছে, ‘ঠিক আছে, পাঠিয়ে দিব।’
আরো পড়ুন: গুলজারের গল্প ধোঁয়া
রমা এবং বক্সি কানপুর থেকে ফিরে এসেছে। উভয়ই জবাবদিহি চাওয়া এবং দেয়ার বিষয়টি পরিত্যাগ করেছে। ঘটনা যখন ঘরের বাইরে চলে যায়, তখন জবাবদিহির প্রয়োজন আছে কী? তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, পারস্পারিক সমঝোতার মাধ্যমে আলাদা হয়ে যাবে। যাহোক, কাপ্পু একটা সমস্যা। কীভাবে তাকে বলবে এবং তাদের দুজনের মধ্যে সমস্যার কথা সে বুঝতে পারবে। তখনও সে বাচ্চা ছেলে- মাত্র নয় বছর বয়স।
রমার ব্যাঙ্ক ম্যানেজার রমন কুমার দুজনের মাঝে হস্তক্ষেপ করেছে এবং যুক্তি দিয়ে বোঝাতেও চেষ্টা করেছে। সে বলেছে যে, তারা যেন সবকিছু ভুলে যায়। কিন্তু রমা জানে বক্সির আবেগী মন। একসময় সে প্রচণ্ড রকম আবেগে তাকে গভীরভাবে ভালোবাসতো।
রমন কুমার একদিন রমাকে বলেছে, ‘আমি বুঝতে পারি, তুমি কেন কাঁদছো। কিন্তু আমি তারচেয়েও বেশি আশ্চার্য হয়েছি যখন বক্সির সঙ্গে কথা বলার সময় তার চোখে অশ্রু দেখি। তোমার বিরুদ্ধে সে একটি কথাও উচ্চারণ করেনি। বরং সে নিজের ভুল স্বীকার করেছে। হয়তো সে খুব আবেগী মানুষ।’
রমা জানে, বক্সি মাঝে মাঝে ভুল করে। কিন্তু তার চোখের অশ্রু কোন ধরনের ভণ্ডামি নয়। আসলে সে ভণ্ড নয়।
অবশেষে তারা বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আদালতে আবেদন করেছে। এরই মাঝে এক বছর কেটে গেছে।
এই সময়ে কাপ্পুকে দেখতে তারা একাকী অথবা একসঙ্গে হস্টেলে গিয়েছে। কাপ্পুর ছুটির সময় তারা কখনো কাপ্পুকে দিল্লীর বাইরে কোথাও বেড়াতে নিয়ে গেছে, অথবা কাপ্পু রমার সঙ্গে থেকেছে, যখন বক্সি অফিসের কাছে দিল্লীর বাইরে গিয়েছে।
কপিল অবশ্য বুঝতে পেরেছে যে, একটা কিছু ঘটেছে। কিন্তু সে আগ বাড়িয়ে বলতে পারে না, ‘পাপা আগের মতো তোমাকে কিংবা আমাকে ভালোবাসে না।’
‘বাজে বকো না ! তিনি অফিসের কাজ নিয়ে খুবই ব্যস্ত। ঘটনা তাই। ‘আসলে রমা ছেলের নিষ্পাপ চিন্তাকে নষ্ট করে দিতে চায় না। ‘এছাড়া আমিও তো কাজ করা শুরু করেছি।’
তাদের বিবাহ বিচ্ছেদের পরে রমা নিজের তত্ত্বাবধানে রাখার জন্য ছেলেকে চেয়েছে। বক্সি মোটেও আপত্তি জানায়নি- বরং সে বিনাবাক্যে রাজি হয়েছে। সে জানতো, ছেলের সামনে কান্তার উপস্থিতি কিছুতেই ব্যাখ্যা করে বলতে পারবে না। এমন পরিস্থিতি তাকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। যদিও সে কাপ্পুর হস্টেলে যায় এবং নিয়মিত দেখা করে, কিন্তু রমা বিবাহ বিচ্ছেদের কথা ছেলেকে বলেনি।
কান্তার সঙ্গে বক্সির সম্পর্ক বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কিন্তু তারপর রমা বক্সিকে ফিরে পেতে চায়নি, এমনকি বক্সিও রমার কাছে ফিরে আসতে চায়নি। ইতিমধ্যে তাদের সম্পর্ক ভেঙে গেছে। ভাঙা সম্পর্ককে মেরামত করাও সম্ভব নয়। সেই বছর যখন ছুটির সময় কপিলের ফিরে আসার সময় হয়, তখন বক্সি দিল্লী থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে মাদ্রাজে বদলী হয়। হয়তো বক্সি ভুলে গেছে, এবং ছেলের কাছ থেকে সত্যটা লুকিয়ে ভণিতা করা রমার কাছে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। রমা তাই কাপ্পুকে সব কথা খুলে বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু ছেলেকে সে ধীরে ধীরে তেরি করবে, সারাদিন বাবার সম্পর্কে আলাপ করবে এবং অবশেষে রাতে ঘটনা যখন বলবে, কাপ্পু তখন ফুপিয়ে কাঁদবে। ছেলেকে সে সান্ত্বনা দিবে এবং একসময় বিছানায় শুইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিবে।
‘আমি তোমার সঙ্গে আছি, বাছা। তোমার মা…’
যেই মুহূর্তে কাপ্পু বাড়ি ফিরে আসে, সে জিজ্ঞাসা করে, ‘মা, পাপা কী আমাদের ছেড়ে চলে গেছে? এটা কী সত্যি, মা?’
রমা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। কাপ্পু এগিয়ে আসে এবং মাকে জড়িয়ে ধরে। ‘আমি এখানে মা, তোমার সঙ্গে আছি। তোমার ছেলে…’
রমা আশ্চর্য হয়। কিছু ঠাহর করার অনেক আগেই কেমন করে এসব ছেলেমেয়েরা বেমালুম বেড়ে উঠে।
এক বছর আগে ছুটির সময় সে স্কুলের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দার্জিলিংয়ে গিয়েছিল। রমাও কয়েক দিনের জন্য রমনের সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছিল। অনেক বছর পরে রমা ছুটি নিয়েছিল। শেষ বার সে হোলি উৎসবের সময় কাপ্পুকে দেখতে গিয়েছিল। সেই সময় সে রমন সম্পর্কে ছেলেকে বলতে চেয়েছিল। কিন্তু ভয়ে বলতে পারেনি। রমন সম্পর্কে ছেলের মনে কোন ধরনের ভুল বুঝাবুঝি হোক, তা সে চায়নি। কেননা কাপ্পু তখনো বাচ্চা ছেলে।
এমনকী সেদিনও সে বলার জন্য কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েছে। এ কথা সত্যি যে, কাপ্পু তখনও পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ হয়ে ওঠেনি। সে একটা কচি ছেলে। যদি সে মায়ের স্ফীত পেট দেখে, তাহলে বুঝবে হয়তো ওজন বেড়েছে। কেন করে সে অনুমান করবে? কিন্তু এবার রমা সত্যি রমন সম্পর্কে বলবে। সম্ভব হলে এ-ও বুঝিয়ে বলবে যে, গোপনে সে রমনের সঙ্গে বিয়ের নিবন্ধন করেছে।
কাপ্পু যখন বাড়ি আসে, তখন রমা সারাদিন ছেলের দৃষ্টি থেকে স্ফীত পেট আড়াল করে রেখেছে। সে ঢিলেঢালা জামা পড়ে এবং শরীর থেকে একবারও ওড়না খসে পড়ার সুযোগ দেয়নি। ছেলের জন্য সে খাবার তৈরি করে এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে, রাতে কাপ্পু যখন ঘুমানোর জন্য বিছানায় যাবে, তখন সবকিছু খুলে বলবে।
হঠাৎ রমা পাশের ঘরে গ্লাস ভাঙার শব্দ শুনতে পায়। চটজলদি সে দৌঁড়ে গিয়ে দেখে কাপ্পু নিজের হাত কেটেছে। সারা মেঝে জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফুলদানীর ভাঙা টুকরা।
‘কাপ্পু…?’
যেই মুহূর্তে রমা এক পা এগিয়ে যায়, তখনই কাপ্পু তাকে ধাক্কা দিয়ে পাশে সরিয়ে দেয়। ‘আমার কাছে আসবে না…’
রমা থেমে যায়। কাপ্পুর কণ্ঠস্বরে কান্নার গমক মেশানো।
‘তুমি কী গর্ভবতী?’
রমার হাত এবং পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। বুকের ধুকপুকানি যেন কপালে ফুটে উঠেছে।
‘কার সন্তান? রমন আঙ্কেলের? বদমাশ!’
কিন্তু রমা যা শুনেছে, তা কাপ্পুর কণ্ঠস্বর নয়- সেটা ছিল বক্সির। সে অনুভব করে, কথা বলা পুরুষটি তার ছেলে নয়, বরং তার স্বামী।
গল্পসূত্র : ‘পুরুষ’ গল্পটি গুলজারের ইংরেজিতে অনূদিত ‘মর্দ’ [এ ম্যান] গল্পের অনুবাদ। হিন্দি থেকে গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন অলোক ভাল্লা। গল্পটি লেখকের ‘রাভি পার অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ ছোটগল্প সংকলনে প্রকাশিত এবং সেখান থেকে নেয়া।
(পাঞ্জাবি: ਗੁਲਜ਼ਾਰ; জন্ম: ১৮ আগস্ট, ১৯৩৪) প্রখ্যাত ভারতীয় কবি, সুরকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক।[৩] তিনি মূলত হিন্দী ভাষায় রচনা করেন। তবে উর্দু গজল রচনাতেও তার বিশেষ কৃতিত্ব রয়েছে। তার আসল নাম সাম্পুরাণ সিং কারলা। তৎকালীন অখ- ভারতের পাঞ্জাব (বর্তমানে পাকিস্তান) প্রদেশের ঝিলাম জেলার দিনা শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মূলত হিন্দি, উর্দু এবং পাঞ্জাবি ভাষায় সাহিত্য রচনা করলেও ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় লেখালেখি করেন। ‘টু’ তার একমাত্র উপন্যাস, যা ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পরে শরণার্থীদের করুণ কাহিনি নিয়ে রচিত। তিনি তিনটি কাব্যগ্রন্থ এবং দুটি ছোটগল্প সংকলন রচনা করেন। ‘রাভি পার অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ (১৯৯৭) এবং ‘হাফ এ রুপি স্টোরিজ’ (২০১৩) ইংরেজিতে প্রকাশিত ছোটগল্প সংকলন। তবে ‘রাভি পার অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ থেকে চারটি গল্প নিয়ে ২০০২ সালে প্রকাশিত হয়েছে ‘সীমা অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’। কাব্যিক ভাষায় চরিত্র চিত্রণের, বিশেষ করে শব্দ প্রয়োগের জন্য তাকে ‘মাস্টার ওয়ার্ডস্মিথ’ বা ‘শব্দ কারিগর’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
গুলজারের কর্মজীবন শুরু হয়েছে সংগীত পরিচালক হিসেবে। পরবর্তী সময়ে তিনি গীতিকার, চিত্রনাট্যকার এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেছেন। গীতিকার হিসেবে তিনি ২০০৪ সালে ‘পদ্মভূষণ’ এবং ২০০২ সালে ‘সাহিত্য আকাদেমি’ পুরস্কার অর্জন করেছেন। এ ছাড়া তিনি ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কারসহ একাধিক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন। হলিউডের বিখ্যাত ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’ চলচ্চিত্রের গান ‘জয় হো’ সংগীত রচনার জন্য তিনি একাডেমি অ্যাওয়ার্ড এবং গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডও অর্জন করেছেন। তিনি ১৯৭৩ সালে বলিউডের বিখ্যাত নায়িকা রাখীর সঙ্গে ‘সাত পাকে বাঁধা’ পড়েন।