৩
রাত নেমেছে বেশ খানিক আগে। বাড়ির সবাই নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। খালতো বোনগুলো সবাই যার যার ঘরে পড়তে বসেছে। তবু কোথাও যেন এক নিস্তব্ধতা খেলছে আজ বাড়িটাতে। মেয়ে চাকরগুলোর সাথে প্রতিদিনের মতো ছোট খালার বকা ঝকার শব্দ নেই। বাড়িতে সব বোনদের খলখল হাসির আওয়াজ নেই। খুব শান্ত । খালাত বোনেরাও যেন এ ওর সাথে কথা বলছে শুধু চোখের ইশারায়। কিন্তু কপালের ভাঁজগুলো প্রকট। সবাই সেটা বুঝতে পারছে। খুব দ্রুত রাতের খাবারও শেষ হয়। খালার গম্ভীর মুখটা কেমন একটা ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করছে। রাত বাড়ে। পুরো বাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে এক সময়। রহিম সাধারণত খালার ঘরে মাটিতে বিছানা করে শোয় প্রতিদিন। আজ একটু অন্যরকম সব
-রহিম। তুই ওদিকের শেষ ঘরটায় বিছানার উপর শুয়ে পড় আজকে।
বাড়ির একদম বাইরে দারোয়ান মুন্সীর ঘর প্রায় লাগোয়া।
-মুন্সি তুমি খেয়াল রেখ। রাতে একবার ওর ঘরে উঁকি দিও। আর রাবেয়া তুই ঘরটা ভালো করে গুছিয়ে দিয়ে আয়। দুটো বিছানাই গুছিয়ে দিয়ে আয়।
-রাশেদ। তুই একটু ও ঘরটাতে শুয়ে পড়। রাতে একটু দেখিস রহিমকে।
রাশেদ সম্মাতি দিয়ে মাথা নাড়ে। কিন্তু কিছু একটা অন্যরকম আভাস পায়। কি সেটা। বুঝতে একটু সময় লাগবে। সেটা অনুমান করতে পারে।
-আম্মা। বিছানা গুছান শ্যাষ। পানি অষুধ গামছা। বিছানায় নতুন চাদর। সব দিছি। মশারী..
রাবেয়ার কথা শেষ হতে পারেনা। রাশেদ বলে উঠে
-মশারীর দরকার নেই খালা
-অনেক মশা আছে
-থাক। কয়েল জ্বালিয়ে নেব।
-ঠিক আছে। শুয়ে পড় তাহলে।
মুন্সী আর রহিমের পেছনে হাঁটতে লাগে রাশেদ। দেখতে পায় ধীরে ধীরে ওরা যে ঘরটাতে যাচ্ছে ওটা কী মায়ের নিষেধ করা সেই ঘরটা! অনেকদিন দরজা খোলা হয়নি ঘরটার বোঝাই যায়। অদ্ভূত একটা পুরানো গন্ধ..নাকে ঝাপটা লাগে
-রাবেয়া আফা যে কি ফাঁকিবাজ। আম্মায় কইছে হগল দিন ঘরটা খুলতে। ঝারফোছ করতে। কিন্তু হ্যায় কাম চুরার উস্তাদ
-হুম। পুরানো গন্ধ।
রাশেদ ঘুরে ঘুরে দেখে। পুরোনো আমলের উঁচু পায়ার খাট। চারপাশে মশারী টাঙানোর চারটে খুঁটি লাগানো। যেগুলো আবার খুলেও রাখা যায়। বিশাল আকারের আলমারি একটা
-ওটাতে কী রে রহিম
-জানিনা। আম্মার কাছে সব তালাচাবি থাকে। আমি জিন্দেগীতে ওই আলমারী খুলতে দেখছিনা আম্মারে।
-আলমারির উপরে এগুলো কোরআন শরীফ না?
-হ, কুরআন শরীফ।
-কে পড়ে ওগুলো?
-হেইডাও কইতে পারতমনাগো ভাইজান।
-আচ্ছা। তুই শুয়ে পড়। অষুধগুলো খেয়ে নে।
প্রেসক্রিপশন দেখে অষুধ খুলে দেয় রাশেদ। পাশের বিছানাটায় রাশেদ নিজেও শুয়ে পড়ে। বাতি নিভেছে। ঘর অন্ধকার। একটা হালকা নীল আলোর ডিমলাইট জ্বলে ওঠে। নিস্তব্ধতা শুনশান। অদ্ভূত এক মাদকতায় ভরা ফুলের ঘ্রাণ আসছে রাশেদের নাকে
-কী ফুল! কী ফুল রাশেদ
নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে রাশেদ। সেই বন পাহাড়ের দেশে বসবাস তার। কত যে নাম না জানা পাহাড়ি ফুল আর প্রাণীর ডাক শোনা যায় সন্ধ্যা রাতেই সেখানে। কিন্তু কোনোদিন তো এমন কোনো ফুলের ঘ্রাণ নাকে আসেনি। কী জানি তার নিজেরই ভুল মনে হয়। আজ বিকেল থেকে সবই কেমন অদ্ভূত। এত যে আশা যাওয়া ছোটবেলা থেকে এ বাড়িতে। আজকের বিকেলের সাথে কোনো দিনেরই মিল নেই। ভাবতে ভাবতে চোখ লেগে যায় রাশেদের। বরাবরই খুব হালকা ঘুম রাশেদের। মা বলেন পাখির ঘুম। এই ঘুমালো আবার টু শব্দেই জেগে উঠলো। আজ এই ঘরটাতে শুয়ে রাশেদের বেশ খানিকটা অস্বস্তি হচ্ছে। তারচেয়েও বেশি কৌতূহল। ঘরটাতে কেউ থাকেনা। অথচ কোরআন শরীফ দু’টো যেন পরিষ্কার আর গুছানো। ঘরটাতে সহজে কাউকে খালা ঢুকতে দেননা। তারই বা কি কারণ। আর আজই বা খালা রহিমকে তার ঘর থেকে বের করে দিলেন কেন? কিছুক্ষণ বাদেই রাশেদের ঘুম ভাঙে। ভাঙে বলা ঠিক নয়। ঘুমটা ছুটে যায়। কি এক অদ্ভূত মিষ্টি গন্ধে পুরোটা বাড়ি ভরে আছে। তবুও কেমন যেন অসহ্য লাগে গন্ধটা। খুব সাবধানে জানালায় চোখ রাখে রাশেদ। চোখ আটকে যায় তার। কি অসাধারণ সুন্দর সৌম্যকান্তি এক মানুষ। অন্ধকারে বাইরের ফুল বাগানে যেন জ্বলজ্বল করে জ্বলছেন। ঠিক তালগাছের মাথার উপর থেকে নেমে এলেন-এমন মনে হল রাশেদের। হ্যা ঠিকই তাই
-কীভাবে নামলেন? উড়ে? হেঁটে? তালগাছ বেয়ে?
কিছুই ঠাহর করতে পারলো না কেন রাশেদ! সৌম্যকান্তি ধবধবে সাদা দাড়ি সমেত। লম্বা সাদা আলখাল্লায় তার পায়ের পাতা কিংবা আঙুল কিছুই দেখা যায়না।কি ব্যাপার। এই ভেতর বাড়ির দিকেই আসছেন তিনি মনে হচ্ছে! এই মধ্যরাতে! ঠিক দেখছে তো রাশেদ! চোখ রগড়ে তাকায় আবার। হ্যা । ঠিক। ঠিক তিনি যাচ্ছেন। ঐ তো মুন্সী ভাইর ঘরের দিকে
-মুন্মী ? মুন্সী? ও মুন্সী?
পড়িমড়ি করে মুন্সী ভাই ছুটে আসে কোনোদিক থেকে কে জানে? মাথা নিচু করে মুন্সীভাই সালাম দেবার আগেই লম্বা সুরে
-আসসালামু আলাইকুম মুন্সী।
মুন্সী মাথা নিচু করে সালামের জবাব দেয়। দারোয়ানের কথা বলবার ধরণ এমন যেন সে বহুকাল চেনে ওই লোকটিকে। তিনি আবার বলেন
-ভেতর বাড়ি যাও বাবা। আম্মাকে খবর দাও। দরকার আছে। তিনি আমায় তলব করেছেন।
-জি আচ্ছা।
মুন্সী ভাই ভেতর বাড়ির দিকে পা বাড়ান। রাশেদ আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারেনা। ভেতরবাড়ির দরজা খোলে। বাড়ির পেছন দিক দিয়ে খালার ঘরের দিকে পা বাড়ায়। বাইরে নিস্তব্ধ রাত। টানা বারান্দা ধরে খালার ঘরটার দিকে রওনা হয় রাশেদ। বারান্দায় ঝুঁকে পড়া নারকেল পেয়ারার ডালগুলো প্রায়ই এদিক সেদিক গায়ে হাত দিয়ে যেন রুখতে চাইছে রাশেদকে। কিন্তু কেউ পারলোনা আজ। পৌঁছে যায় রাশেদ প্রায় খালার ঘরটার দিকে অমনি অন্য একটা ঘরের দরজা খুলে যায়। তারপর হ্যাচকা টানে কেউ ওকে ধরে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। ভয়ে আঁতকে ওঠে রাশেদ। বুকে থু থু দেয় তাড়াতাড়ি। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে
বিনু আপা? তুমি?জেগে আছ?
ভয়ে উত্তেজনায় রাশেদের যেন প্রাণ বেরিয়ে আসছিল। ফিসফিস করে বিনু বলে
-হ্যা। তুই কোথায় যাচ্ছিলি ওদিকে?
-খালার ঘরের দিকে
-কী কাজ ওদিকে তোর?
-বিনু আপা তোমায় সত্যি বলছি.. শোনো..
গলার স্বর আরও একটু নিচে নামিয়ে ফিসফিস করে
– লম্বা আলখাল্লা পড়া ফরসা একটা লোক। এত্ত লম্বা দাড়িওয়ালা একটা লোক।এত রাতে বাড়িতে ঢুকলো।
-তো কী হয়েছে?
-তুমি চেন ওকে?
একটানে কথাগুলো বলে চলেছে রাশেদ। খুব অস্থিরভাবে। যেন সেই প্রথম এই দৃশ্য দেখেছে আজ। যেন একমাত্র সেই আজ প্রথম জানলো সব। আর কেউ জানেনা।
-বিনু আপা জানো? লোকটা মুন্সী ভাইকেও চেনে।
-হ্যা চেনে তো।
-মুন্সীভাই ই তাকে নিয়ে যাচ্ছেন খালার ঘরের দিকে।
একটানা কথাগুলো বলে যায় রাশেদ। বিনু-ছোটখালার বড় মেয়ে। রাশেদকে সেই ছোটবেলা থেকে খুব আদর করে। কথাগুলো শুনছিল রাশেদের। হঠাৎ সে রাশেদের মুখটা তার দু’হাতের অঞ্জলিতে তুলে ধরে আদর করে বলে
-ভাই। যা দেখেছিস দেখেছিস। আর বাড়িসনে। আমি বলছি। তুই তোর ঘরে গিয়ে ঘুমো। আজ মায়ের ঘরের দিকে পা বাড়াসনে। ভাই না আমার লক্ষ্মী সোনা!
বিনু আপার গলায় কেমন একটা মিহি আর্তির সুর। ফেলতে পারেনা রাশেদ। আবার কৌতূহলও নিবৃত্ত করতে পারেনা। ওমনি বাইরে হঠাৎ কি যেন জ্বলে ওঠে। সামনের দিকের তালগাছটার গোড়ায়।পর্দার ফাঁকেও হালকা আলোর ঝলক দুজনেই দেখতে পায়। রাশেদ বিনু দুজনেই ঝটিতি ওদিকে তাকায়। রাশেদ ফিসফিস করে ওঠে
-ওই যে দেখ। দেখ। ওই ছেলেদুটো না বিনু আপা? পায়রাগুলোকে গুলি করেছি.. …
কথা শেষ করতে পারেনা। বিনু ওর ঠোঁটে আঙুল চাপা দেয়।
-হুসসসসসসসসসসসসস।
-চুপ। চুপ কর।
রাশেদের মুখে হাত চাপা দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয় বিনু আপা। তারপর পর্দা সরিয়ে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে দু’জন। ওদিকে। বাহির বাড়ির দিকে।তালগাছের নিচে। যেখানে পায়রা দুটোকে কবর দেয়া হয়েছিল। সেখানে ছেলেদুটো। বার দুয়েক তালগাছটার উপরে কী যেন দেখবার চেষ্টা করে। তারপর নিচু হয়ে কী যেন করতে লাগে
-বিনু আপা? এই বিনু আপা
-হুস্। চুপ চুপ। আস্তে..
-বিনু আপা। পায়রার কবর খুঁড়ছে মনে হয়?
বিনু আপার ভেতর উত্তেজানা রাগ সবই বুঝতে পারছে রাশেদ আস্তে আস্তে। কাঁপছে বিনু আপা। ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ খেয়াল করে রাশেদ বিনু আপার চোখ দিয়ে ঠিকরে পড়ছে যেন আগুন
-সর্বনাশ হয়েছে রাশেদ।
– কি? কী হয়েছে বিনু আপা? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা?
-এরা পায়রাগুলোকে নিতে এসেছে।
-এরা কারা?
-চুপ্। আস্তে কথা বল। এরা মৃত আত্মা
-কী বলছ? এরাই না গত বিকেলে পায়রা দুটোকে গুলি করলো
-হ্যা। এরাই? মৃতদের আত্মা?
-হ্যা। এ বাড়িতে এরা সব সময় আসে?
-না। প্রায় প্রায়ই আসে। ওই যে পায়রা দেখলি না? ওই পায়রাগুলো শান্তির দূত। ওরা এই বাড়িটাকে রক্ষা করছে ওদের হাত থেকে
-পায়রাগুলো রক্ষা করছে বাড়িটাকে? কি? বলছ কি তুমি? মানে কী?
-অতসব কথা বলবার সময় নেই এখন। কবরগুলো প্রায় খুঁড়েই ফেলেছে মনে হচ্ছে ওদিকে।
-এখন কী করবে ? বলনা কী করবে?
কোনো কথা না বলেই হঠাৎ এই মধ্যরাতেই বিনু আপা দরজা খুলে এক দৌড়ে বের হয়ে আসেন একেবারেই বাহির বাড়িতে। রাশেদও বিনুর পেছন পেছন সামনের বাড়ির ফুলবাগানের কাছে
-মুন্সী ভাইইইইইইই… ওরা আবার এসেছে… নিয়ে গেল ..নিয়ে গেল ..আটকাও ওদের
বলেই অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল বিনু আপা। রাশেদ দেখলো সেই দৃষ্টি। আজই বিকেলে ওদের চোখে দেখেছ রাশেদ। সেই রাগ। অস্বস্তি। সেই তীক্ষ্ণ। ক্ষুরধার। অভিশপ্ত চোখ। এক ঝলক তাকিয়েই ছেলেদুটো উধাও
-বিনু আপা? বিনু আপা?
কথা বলছেনা তো। মুন্সীভাইইইইই। বিনু আপা অজ্ঞান হয়ে গেছেন .. …
তখন ভোরের আলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে। খালা এসে দাঁড়ান। অস্থির। পাশে কাজের মেয়ে রাবেয়া। বিনু আপার পড়ে থাকা শরীরটার দিকে তাকান একবার ছোটখালা। রাশেদ বিনু আপার মাথাটা কোলে নিয়ে বসে আছে। রাশেদ স্পষ্ট দেখতে পায় খালা সালাম দিয়ে বিদায় করেন মধ্যরাতে নেমে আসা হুজুর ধরনের লোকটাকে। কিন্তু এখন তিনি খুব সহজভাবে হেঁটে বাড়ির বাইরে চলে গেলেন নামায পড়বেন বলে। রাশেদ আর কৌতূহল চাপতে পারেনা
-খালা এই লোকটি কে?
-পরে বলছি।
-রাবেয়ার হাতে ধরা গ্লাস থেকে বিনু আপার মুখে পানির ছিটা দেন খালা
-বিনু? বিনু? ওঠ মা
-মা। মা। ওরা পায়রাগুলো নিয়ে গেছে মা? পায়রাদুটোকে নিতে পারেনি তো?
তিনজন ধরে বিনু আপাকে তার নিজের ঘরে শুইয়ে দেয়। ততক্ষণে মুন্সীভাই এসে দাঁড়ায় ছোটখালার কাছে
-কি মুন্সী?
-আম্মা। পায়রাদু’টো কবরে নেই। ওগুলোকে নিয়ে গেছে।
খালার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ রাশেদের চোখ এড়াতে পারেনা।
পরের শুক্রবারে…