গত পর্বের পরে…
-ফাইয়াদ .. বাপ আমার। রহিহহহহহহমমমম…
বলে চিৎকার করে ছোট খালা নেমে পড়েন পুকুরের জলে। তাকে ধরে রাখে বিনু আপা আর রাবেয়া। এলাকার অনেক লোক জড়ো হয়েছে। তারা প্রাণপণে চেষ্টা করছে এই রাতেও জলে নেমে রহিম আর ফাইয়াদকে তুলবার। কেউ কেউ জলের ভেতর বহুদূর পৌঁছে গেছে রহিম আর ফাইয়াদের কাছাকাছি। ওদেরই কেউ একজন বলে উঠলো রাশেদ শুনতে পায়
-হ্যা হ্যা। বেঁচে আছে। তাড়াতাড়ি ধরুন। হসপিটালে নিতে হবে।
কিন্তু কে বেঁচে আছে। কে মরেছে। দু’জনেই বেঁচে আছেতো? রাশেদের মনে শংকা। এরই মাঝে আবার শুনতে পায়
-এম্বুলেন্স খবর দিন। তাড়াতাড়ি করুন। তাড়াতাড়ি..
ভীড়ের মধ্যে অন্য একজন বলে ওঠে
-রহিম? এই রহিম। রহিম?
কেউ একজন মাথা নাড়ে
-নাহ। রহিম বেঁচে নেই..। নাড়ি চলছে না। একদম নেই ..
অনেক লোক ধরাধরি করে তুলে আনে রহিমের মৃত দেহ। রাশেদ ঝুকে পড়ে রহিমের মৃত মুখের উপর। কী নিশ্পাপ চেহারাটা। কী যে লক্ষী আর সহজ সরল ছেলেটা।
-রহিম। রহিম। এভাবে চলে গেলি..। রহিম..। এই রহিম..ওঠ্না। রহিম
মাটিতে শুইয়ে দেয়া রহিমের শরীরটা ধরে বার দুই ঝাকায় রাশেদ।কান্নায় বুজে আসছে ওর কণ্ঠ। ওর চোখের জল আর বাধ মানাতে পারেনা। হাতের তালুতে চোখ মোছে।
ফাইয়াদকে তুলে আনা হয় পুকুরের জল থেকে। মাটিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। এম্বুলেন্স আসে খুব তাড়াতাড়ি। বিনু আপা রুমী আপা আর পাড়ার এক মুরুব্বী গোছের কেউ চলে ফাইয়াদকে নিয়ে হসপিটালে। খালার সাথে রাশেদ আর রাবেয়া। রাবেয়া কাঁদে
-ওরে রহিম। রহিম রেরররররর। ভাই আমার…চোখ খোল রহিম। কথা ক। কথা ক ভাই। ভাইরে.. ও ভাই । কথা ক ভাই।
জ্বিন হুজুর কিন্তু ততক্ষণে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অশরীরিটা রহিমের শরীর থেকে বের হতে গিয়ে ধরা পড়েছে জ্বিন হুজুরের কাছে। ছুটে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হয় জ্বিনের চিৎকারে
-দাঁড়াওওওওওওওওওওওও। কী চাও?
-কেন এভাবে প্রাণ নিলে নিষ্পাপ ছেলেটার?
অট্টহাসি হেসে ওঠে অশরীরী। রাতের অন্ধকার ভেঙে খান খান হয়ে যায়।
-হা হা হা। হা হা হা। হা হা হা। নিষ্পাপ! হা হা হা
-থামো।
জ্বিনের ধমকে থমকে থামে..
চোখে দেখা যায়না তার কোনো আকার। সাধারণে দেখতে পাবার মতো নয়। জ্বিন একটা অদ্ভুত আলোর শিখার মতো দেখতে পান। সে আলো সাধারণ আলোর মত মনোরম কিছু নয়। দারুণ বিকট। মনে হচ্ছে কেমন এক উদ্ভট পচাগলা মাংশের গন্ধও বের হচ্ছে ওই আগুণের শিখা থেকে। কেমন বীভৎস ফ্যাসফ্যাসে একটা গলায় কথা বলে ওঠে অশরীরি
-জানো না? তুমি জানোনা কেন?
– না জানিনা।
-কেন জানোনা?
-আমার কি জানবার কথা?
-হ্যা। তোমারই তো জানবার কথা। আর জানবার কথা ওই তোমার মালেকিনের।
-কে ? আম্মার?
-কি কথা?
-কেন এসেছি? কেন প্রাণ নিচ্ছি? কেন রহিমের শরীরে ভর করেছিলাম।
-সত্যি জানিনা। আমাকে একটু বুঝিয়ে বল। এই কথাই তো জানতে জানতে এ জীবন গেল। আম্মা আমি কেউতো কোনো কুল কিনারা করতে পারিনি আজও
– কি কুল কিনারা করতে পারনি?
-ভাই, সত্যি বলছি। তুমি আমাকে সাহায্য কর।
রাত্রি দুই প্রহরের নিস্তব্ধতা খান খান করে ভেঙে দিয়ে আবার অট্টহাসি হেসে ওঠে অশরীরি। সে শব্দ অদূরে রহিম আর ফাইয়াদের শুইয়ে রাখা শরীরের কাছে জড়ো হয়ে থাকা মানুষগুলোর মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। সবাই এ ওকে সর্তক করে চুপ করে থাকে। বুঝতে পারে সবাই। এই মৃত্যু । এই মধ্যরাতে জলে মানুষে আর অপার্থিব কিছুর এ যুদ্ধ এখানেই শেষ নয়। আরও কিছু আছে। আরও কিছু রয়ে গেছে আড়ালে। ওদিকে চলছে জ্বিনে আর অশরীরির তুমুল বাকযুদ্ধ
-কি জানতে চাও? কত আর তোমরা আমাদের অত্যাচার করবে? এসো এসো এদিকে । দেখে যাও..
অন্ধকারে যেন একটা সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলছে অশরীরি। একটা আলোর রেখা তীব্র র্দূগন্ধ সহ এগিয়ে চলছে সেই ঘরটার দিকে। যেন সত্যিই একটা সাপ ফোঁস ফোঁস করতে করতে চলছে তার সব বিষ নিয়ে। আর পেছনে পেছনে জ্বিন সম্মোহিতের মতো চলছে।
-আরে এত সেই ঘরের দিকেই চলছে।
কি করে যেন অশরীরি জ্বিনের মনের কথাটা জেনে ফেলে। মনে মনে বলা কথাটার উত্তর সে দেয় চলতে চলতেই
-হ্যা। সেই ঘর। ওখানেই তো আমাদের বাস।
এবার জ্বিন আর দ্বিধা না করে মুখ খুলেই বলতে থাকে কথাগুলো
-হ্যা। আমি এতকাল ধারণা করেই আসছিলাম এখানেই ওদের বাস। তাই আমি কোরআন শরীফ দুটো দিয়ে ওখানে কারো আসা যাওয়া বন্ধ করে রাখবার চেষ্টা করে ছিলাম। আমার যেটুকু সাধ্য ছিল ততটুকু দিয়ে।
-কেন? কেন আসাযাওয়া বন্ধ করে রেখেছিলে? নিজেদের সব সুখ নিশ্চিত করেছিলে তোমরা। আর আমাদের করেছিলে সর্বনাশ। তার কী হবে?
-কী সর্বনাশ? বল? তোমাদের কী সর্বনাশ করেছি আমরা?
বলতে বলতে সেই ঘরটাতে এসে পৌঁছায় দু’জনে। অসহ্য ঠেকে জ্বিনের চোখে ওই ঘর। অস্বাভাবিক আকার ঘরটার। ওটা ভরতি গুমোট র্দূগন্ধ। মানুষের মাংশ পোড়ানো। পচা। গন্ধ। খুব দেখা.. যাচ্ছে ভীষন এক গর্তের ভেতর। অসংখ্য মানুষের দেহ। এরা মৃত না জীবিত বোঝার উপায় নেই। কেমন ধোয়াশা সব। হিন্দু মুসলিম নর নারীর দেহ। ঝলসে যাওয়া মাংশ কারো গায়ে। কারো দুই চোখ উপড়ানো। কালো গলা কাটা। কারো পেটের এ পাশ থেকে ওপাশে এফোর ওফোর হয়ে যাওয়া। ছুরি এখনো বিঁধে আছে পেটে। জ্বিনেরও মনটা কেমন এক বীভৎসতায় কেঁপে ওঠে। অশরীরির শরীর থেকে যেন এখন বের হয়ে আসছে আরও তীব্র র্দূগন্ধ। তার সমস্ত রাগ যেন গন্ধেই প্রকাশ হচ্ছে
-দেখ দেখ কী করেছিলে তোমরা আমাদের। দেখ তাকিয়ে কীভাবে । কত ভয়ানকভাবে হত্যা করা হয়েছিল আমাদের।
-হ্যা। হ্যা । দেখতে পাচ্ছি। কিন্ত বাবা আমার একটা কথা শোনো
-কোনো কথা আর শুনবার নেই তোমাদের। বহুবছর আমরা এখানে রয়েছি। এভাবেই।
-হ্যা হ্যা। বহু বছরেরই কথা। হবে প্রায় পঞ্চাশ বছর
– হা হা হা। পঞ্চাশটি বছর। খুব কম মনে হলো তোমার?
অশরীরিকে আরও বিকট দেখা যায়।
-না না। কম নয়। আম্মারা যখন বাড়িটি কেনেন তখন নিজাম সাহেব বোধ করি জানতেন কিছু। তিনি আম্মাকে বলেওছিলেন।
-বোধ করি জানতেন?
-মানে এই বাড়িটাতো নিজাম সাহেব কিনেছিলেন এক রাজার কাছ থেকে। তারই এই সব অত্যাচার হবে এরকম জানা ছিল আম্মা আর নিজাম সাহেবের।
-তারপর?
-মাঝে সাঝেই তোমাদের আলামত টের পেয়ে আম্মা আমাকে এনে রেখেছিলেন তার সন্তানদের আর এ্ই বাড়িটাকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে। আমি পায়রাদের মাঝে…যাক সে কথা। কিন্তু তা আর হলো কই
জ্বিনের কথাগুলো যেন অশরীরির মাথার উপর দিয়ে গেল। সে শুনতে পেল কি পেলনা বোঝা গেলনা। সে বলতে থাকলো
-পঞ্চাশ বছর আমরা এখানে এভাবেই বাস করি। আমাদের কবর নেই। হিন্দু যারা তাদের দাহ করা হয়নি। আমাদের অন্যায় ভাবে খুন করা হয়েছে। আমাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। গোপনে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের জন্য আমাদের আত্মীয়রা দোয়া মাগফেরাত প্র্রার্থণা করলেও আমাদের উপর তা কাজ করেনা। আমরা অসহায়। আমরা ভীষন ক্ষুব্ধ। আমরা তীব্র যাতনায় সংক্ষুব্ধ। আমরা… আমরা কখন কী করি । কী করবো কিচ্ছু জানিনা। না জানা নেই আমাদের কী কী ঘটবে।
পাগলের মতো প্রলাপ বকছে যেন। ভীষণ অস্থির আর দুঃখি লাগে জ্বিনের কাছে অশরীরির এই আর্তনাদ। অপরাধীর মতো লাগে তার কণ্ঠস্বর
-বাবা । আমি তোমাদের কথা দিচ্ছি। তোমাদের আত্মার শান্তির ব্যবস্থা আমি করবো। তোমাদের কাছে প্রাপ্য পাপের ক্ষমা চাইছি। যদিও আমরা মানে আমার মালেকিন এসব হত্যার সাথে জড়িত নন। তবু যেহেতু এই বাড়ি তাদের। অতএব আমাদের উচিত ছিল তোমাদের সৎকারের ব্যবস্থা করা।
-হাহ হাহ হাহ। ক্ষমা?
– আমাদের পঞ্চাশ বছর ফিরিয়ে দাও। ফিরিয়ে দাও আমাদের সেই সুন্দর জীবন। ফিরিয়ে দাও আমাদের পৃথিবী।না হলে তোমাদের কোনো ক্ষমা নেই। এই বাড়ির একটি লোককেও আমরা ছাড়বোনানানানানাননাননানানাননা।
-আসছি। আবার আসছি আমরা। আবার দেখা হবে তোমাদের সাথে যেকোনো এক রাতে.. আবার.. আবার ..যে কোনো রাতেই..হা হা হা হা হা হা
তীব্র চিৎকারের সাথে সাথে কোথায় যেন মিলিয়ে যায় অশরীরির ছায়া। কোথায় হারিয়ে যায় অত অত আধমড়া মানুষের দেহের আকার। ভীষন ব্যাথার চিৎকার। কোথায় যেন হারিয়ে যায় ওই ঘর। জ্বিন ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়। সুবেহ সাদিকের সময় হয়েছে। হালকা আলো উৎসমুখটুকু কেবল উঁকি দিতে শুরু করবে কিছু সময় পর। ফজরের আজান ভেসে আসে মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের কন্ঠে
-আসসালাতু খাইরুম মিনান্নায়ুম। ঘুম হতে নামাজ উত্তম…
বাকী অংশ আগামী সংখ্যায়…