| 28 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

হাবীবুল্লাহ সিরাজী বাংলা কাব্যের স্বতন্ত্র স্বর

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

বাংলা ভাষার বিশাল কাব্যভাণ্ডারে দৃষ্টি দিলে সহস্র কবিক্রমের ভিড়ে যাঁর নাম স্বতন্ত্র ঔজ্জ্বল্যে দ্যুতি ছড়ায়, তিনি ষাটের দশকের অন্যতম কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতায় মনোযোগী হলে পাঠক আবিষ্কার করবেন, নিজেকে তিনি বারবার কী কৌশলে পরিবর্তন করেছেন; তাঁর কবিতার বুনন, ভাষাশৈলী, উপস্থাপনকলা এমনকি বিষয় নির্বাচনে তাঁর পরিবর্তন প্রবণতা চমকিত করে পাঠককে। কবিতার নিরবচ্ছিন্ন সচেতন নির্মিতি প্রত্যক্ষ করতে অনুসন্ধিৎসু পাঠককে হাবীবুল্লাহ সিরাজীর শরণাপন্ন হতে হবে। পাঠককে চমকে দেয়ার মতো কাব্যমেধা যেমন তাঁর আছে, পাশাপাশি কবিতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিজের কবিতাকে অনন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দেয়ার সামর্থ্যও তাঁর মধ্যে অপরিসীম। ব্যক্তিগতভাবে বর্তমান নিবন্ধকারের অনেক সময়ই মনে হয়েছে, হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার উচ্চতা তাঁর সময়ের অন্য অনেক কবির চেয়েই স্বতন্ত্র, ধারণা করি তাঁর এ স্বাতন্ত্র্যের কারণে অনেক সমালোচক তাঁকে এড়িয়ে যান; কবিতার গভীর সৌন্দর্য আবিষ্কারের জন্য যে প্রস্তুতি একজন সমালোচকের থাকা প্রয়োজন তেমন সামর্থ্যে পৌঁছার আগেই অনেকে গদ্য রচনার কসরত শুরু করেন; বোধগম্য কারণেই অনেক ক্ষেত্রে হাবীবুল্লাহ সিরাজী অনালোচিত থেকে যান। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কাব্যালোচনার জন্য বর্তমান নিবন্ধকার নিজেকেও বিশেষ যোগ্য মনে করেন না, যে কারণে এখানে সিরাজীকাব্যের পাঠানুভূতি প্রকাশের বাইরে বিশেষ কিছু লেখার ধৃষ্টতা থেকে নিজেকে নিবৃত করার চেষ্টা থাকবে, নিজের সীমাবদ্ধতার কথা যতটা ঢেকে রাখা যায় সে চেষ্টা নিশ্চয়ই থাকবে। আগ্রহী পাঠক যদি অযোগ্য মুগ্ধ-পাঠকের নিষ্ঠ-পাঠানুভূতি পড়ে স্বতন্ত্রধারার এই মগ্ন কবিকে আবিষ্কারে উদ্যোগী হন, সেই প্রত্যাশায়।
হাবীবুল্লাহ সিরাজীর জন্ম ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর, ফরিদপুর জেলায়। শিক্ষা ও পেশায় তিনি প্রকৌশলী; হাতেগোনা কয়েকজন প্রকৌশলী কবির অন্যতম হাবীবুল্লাহ সিরাজী। যদিও প্রকৌশল শাস্ত্রের সাথে কাব্যচর্চার কোনো বিরোধ নেই, তবুও প্রকৌশলীদের কবি হওয়ার প্রবণতা বোধগম্য কারণে অনেকটাই কম। সেখানেও হাবীবুল্লাহ সিরাজী যতটাই প্রকৌশলী ততটাই অথবা তারচেয়ে কিছুটা বেশিই কবি। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার স্বাতন্ত্র্যের সন্ধান পেতে প্রথমত তাঁর প্রকাশিত কাব্যের তালিকার দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। ধারণা করি গ্রন্থ তালিকা দেখেই পাঠক মোটা দাগে তাঁর কাব্যচারিত্র্যের সন্ধান পেয়ে যাবেন, আর যাঁরা তাঁর কাব্যসৌন্দর্যের গলিঘুপচি আবিষ্কারে আগ্রহী তাঁদের প্রবেশ করতে হবে তাঁর কাব্যভুবনের অন্দরে। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যেÑ দাও বৃক্ষ দাও দিন (১৯৭৫), মোম শিল্পের ক্ষয়ক্ষতি (১৯৭৭), মধ্যরাতে দুলে ওঠে গ্লাস (১৯৮১), হাওয়া কলে জোড়া গাড়ি (১৯৮২), নোনা জলে বুনো সংসার (১৯৮৩), স্বপ্নহীনতার পক্ষে (১৯৮৪), আমার একজনই বন্ধু (১৯৮৭), পোষাক বদলের পালা (১৯৮৮), কৃষ্ণ কৃপাণ ও অন্যান্য কবিতা (১৯৯০), সিংহ দরজা (১৯৯০), ম্লান ম্রিয়মাণ নয় (১৯৯২), বিপ্লব বসত করে ঘরে (১৯৯৯), ছিন্নভিন্ন অপরাহ্ণ (১৯৯৯), সারিবদ্ধ জ্যোৎস্না (২০০০), সুগন্ধ ময়ূর লো (২০০০), মুখোমুখি (২০০১), হ্রী (২০০৫), কতো কাছে জলছত্র, কতো দূর চেরাপুঞ্জি (২০০৬), কাদামাখা পা (২০০৬), ভুলের কোনো শুদ্ধ বানান নেই (২০০৮), ইতিহাস বদমাশ হ’লে মানুষ বড়ো কষ্ট পায় (২০০৯), শূন্য, পূর্বে না উত্তরে (২০০৯), একা ও করুণা (২০১০), আমার জ্যামিতি (২০১২), পশ্চিমের গুপ্তচর (২০১২), কবিরাজ বিল্ডিংয়ের ছাদ (২০১৫), মিথ্যে তুমি দশ পিঁপড়ে, মৌলানার মন, আমিই জেনারেল ইত্যাদির সবই যেমন উল্লেখযোগ্য, নানান কারণে প্রতিটি গ্রন্থই গুরুত্বপূর্ণ। এবার সিরাজীর কবিতাভুবনের অন্দরে প্রবেশ করতে চাই।
হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য, তাঁর পরিমিতিবোধ, বুননরীতি, শব্দচয়নে স্বাতন্ত্র্য, নির্মাণশৈলীর কুশলী গ্রন্থনা, ছন্দবিন্যাসে নিষ্ঠা এবং সর্বোপরি দৃশ্যের অধিক বাক্সময় করার মুন্সিয়ানা ইত্যাদি অনুষঙ্গের কথা আরো একবার স্মরণ করে নিতে চাই। অচেনা ভুবনে ভ্রমণের আগে সেখানকার আবহাওয়া-জলবায়ু-পরিবেশ-পরিপার্শ্ব যেমন জেনে নেয়া আবশ্যক; এ-ও অনেকটা তেমনি। হাবীবুল্লাহ সিরাজী সহজ-সরল ভাষায় কাব্যচর্চা করেন না। সুতরাং যেখানে আড়াল থাকবে, সেখানে উন্মোচনের প্রচেষ্টা থাকতে হবে; যখন বিমূর্ততার ঘোমটা থাকবে তখন অন্তরালোকে মূর্ত করে নেয়ার প্রস্তুতি থাকতে হবে; যখন গতির ক্ষিপ্রতা থাকবে, সে ক্ষিপ্রতাকে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার গৌরব অর্জনের প্রয়োজন হবে। জটিল গ্রন্থি উন্মোচনের আনন্দ সহজপ্রাপ্য হবে তেমনটি আশা করাও অন্যায়। সিরাজীকাব্য পাঠে মস্তিষ্কের গ্রন্থিগুলোকে সজাগ রাখার পাশাপাশি হৃদয়ের কপাটগুলোকে শিথিল করে নেয়া ভালো। হৃদয়সংবেদী পাঠে উন্মোচিত হবে দুর্ভেদ্য সব অন্ধকার।
প্রথম কাব্য ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন’-এ যেন হাবীবুল্লাহ সিরাজী পাঠককে সতর্ক করে দিয়েছেন তাঁর পরিমিতির দৃঢ় প্রপঞ্চের নান্দনিক পরিবেশনায়।
একটি কবিতাতেই তাঁর পরিমিতি, শব্দচয়নের স্বাতন্ত্র্য এবং ছন্দের নিষ্ঠা পড়ে নিতে পড়ব।
‘চন্দননগর যাবো’ ব’লে গেলো উজান পাহাড়
থেকে উড়ে আসা পাখি; মাথায় উড়াল ঝুঁটি, কালো
চোখে ঘর-জল ভাসে থৈ থৈ… আহা সবুজ নায়রী
নরম পালক তুলে লেখে নাম : চন্দননগর!

‘চন্দননগর যাবো’ ডাকে পাখি, ভাটার নয়র।
দেখে নিচে কালো জল, আরো নিচে শাদা জলপরী
বাড়িয়ে দু’বাহু তার বুকের আড়ালে টানে, বলে :
‘ভালো আছি, ভালোবাসা নেবে তুমি আর কতোবার?’
(জলপরী ॥ দাও বৃক্ষ দাও দিন)
যেকোনো তুচ্ছ বিষয়কে কবিতা করে তুলতে হাবীবুল্লাহ সিরাজী সিদ্ধহস্ত। বাংলা ভাষার আরেক প্রকৌশলী কবি বিনয় মজুমদারের কবিতায় সাধারণকে অসাধারণ করে তোলার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। কেবল বিনয় মজুমদার নন, অনেক বড় কবির কবিতায়ই এ গুণটি দেখা যায়, হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতায় প্রবণতাটি যেন সতোৎসারিত। একই কাব্যের ‘অঙুরবালা : নজরুল’ শিরোনামের কবিতাটি আমরা পড়ে দেখতে পারি। পড়ে দেখতে পারি ‘বিপ্লব বসত করে ঘরে’ কাব্যের ‘বোতাম’; ‘সুগন্ধ ময়ূর লো’ কাব্যের ‘দুই কন্যা’; ‘হ্রী’ কাব্যের ‘বাঁচাও, ঘরে মাতাল ঢুকেছে’সহ অসংখ্য কবিতায় এ প্রবণতা লক্ষ করা যাবে। নিচের কবিতাটিও আমরা পড়ে নিতে পারি।
একটা কোনো পোকা ঘুরছে,
তেলাপোকা হ’তে পারে আবার ছারপোকাও
শুঁয়োপোকা কিংবা গুবরে পোকা হ’লে
মাটিচাপা প’ড়লে গাছ হবে
সেই গাছে আম ফ’ললে বেগম-পছন্দ
আঁটি চুষবে বুড়ো-হাবড়া,
আমড়া হ’লে ঢেঁকি হবে
হেঁশেল জুড়ে মশা ভন্ভন্
একটা কোনো পোকা ঘুরছে…
(পোকা ॥ বিপ্লব বসত করে ঘরে)
উপমা-উৎপ্রেক্ষা, প্রতীক-ইঙ্গিতের মাধ্যমে হাবীবুল্লাহ সিরাজী তাঁর কবিতাকে কখনো কখনো এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যার গ্রন্থি সাধারণ পাঠে উন্মোচিত হওয়ার নয়। যে কারণে তাঁর কবিতা বারবার পাঠের প্রয়োজন পড়ে; কবিতা যে অমনোযোগী পাঠের অনুষঙ্গ নয়, কবিতায় অন্তরপ্রবাহ বিদ্যমান; কবিতায় যে গোপন-অদৃশ্য সৌন্দর্য বিদ্যমান; এসব সত্য হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা পাঠে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে। তেমন ব্যঞ্জনার কবিতা তাঁর কবিতা থেকে সহজেই উদ্ধার করা যাবে; কিন্তু আমি এখানে তাঁর অন্য এক অনুষঙ্গের উল্লেখ করতে চাই। প্রতীক ও ইঙ্গিতের মোড়কে সমকাল ও পরিপার্শ্বের অনুষঙ্গ উপস্থাপনের প্রবণতার প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই; কেবল দেশ-কাল, সমকালীন রাজনৈতিক অবক্ষয় নয়, এমনকি প্রেমের কবিতায়ও তিনি প্রতীক-ইঙ্গিত এবং আড়ালের আশ্রয় নিয়েছেন। নিচের কবিতাটিতে দৃষ্টি দিতে অনুরোধ করব-
কুমিরেরা ভালোবাসে জল। জলের হিমার্ত স্বাদ
তারা আজীবন পেতে চায়।
মানুষেরা ভালোবাসে ছল। ছলনা মিশিয়ে পথে
কাঁটাতারে তৈরি করে ঘর।
…….. ………… ……………
কিন্তু আজ কুমিরে-মানুষে
বড় বেশি গলাগলি ভাব, চরিত্রে-বৈশিষ্ট্যে মিল
উভয়ে বসত করে আধুনিক চিড়িয়াখানায়।
(কুমির ও মানুষ ॥ মধ্যরাতে দুলে ওঠে গ্লাস)
উত্তরাধুনিকতা বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে খুব বেশি পরিষ্কার নয় বর্তমান নিবন্ধকারের কাছে; বুঝতে গিয়ে বারবারই দ্বিধান্বিত হয়েছি; উত্তরাধুনিকতার প্রবক্তাদের বয়ান ও বর্ণনা থেকে যেটুকু ধারণা পাই, তাতে জীবনানন্দ দাশের কবিতায়ও উত্তরাধুনিকতার স্বাদ পেয়ে যাই, যেমন ‘অদ্ভুত আঁধার’; হাবীবুল্লাহ সিরাজীর ‘ফলের দোকানে দেখা’ শিরোনামের কবিতাটি উত্তরাধুনিক কবিতার উদাহরণ হতে পারে কি না ভেবে দেখতে চাই। উত্তরাধুনিক কবিতা প্রশ্নে নিচের কবিতাটির প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই-
এ ঘরের তিনটি দরোজা।

প্রথমটি ভেতরের দিকে, হেলাফেলায়
দিনরাত খোলা-
……… ……….. …………
দ্বিতীয়টি অতি সামান্য, ব্যক্তিগত :
স্নানে ও প্রক্ষালনে আধা খোলা আধা বন্ধ-
মেঝের জল থেকে কলের নল নিয়ে হায়-হাঙ্গামা,
কার শ্রী কখন কে কোথায় লুকায়?

আর তৃতীয়টি?
সে দরোজা মধ্যরাতে খোলে-
স্বপ্ন আর শিহরণে আকাশের উজ্জ্বল খবর
এক বুক মুক্ত বাতাস!
(তিন দরোজা ॥ সুগন্ধ ময়ূর লো)
‘তিন দরোজা’ কবিতাটিকে কেন উত্তরাধুনিক মনে হলো সে ব্যাখ্যা দেয়ার সামর্থ্য দেয়ার ঘাটতির কথা আগেই উল্লেখ করেছি; তার পরও বলব কবিতাটির বহুমাত্রিকতাই একে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ‘হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা নিয়ে আলোচনায় প্রশস্তিসূচক শব্দভাণ্ডার শূন্য হয়ে যায়, কিন্তু তাঁর কবিতার গুণপনার অনুষঙ্গ শেষ হয়ে যায় না’- এই যখন বাস্তবতা তখন বিদগ্ধ পাঠকের হাতে অনুদঘাটিত অংশ উদঘাটনের দায়িত্ব দিয়ে রণে ভঙ্গ দেয়াই যৌক্তিক মনে করি। 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত