| 20 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

হুমায়ূন আহমেদ : ছোটগল্পের বাঁশিওয়ালা

আনুমানিক পঠনকাল: 15 মিনিট

জীবন কী?
এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে, গল্প। জীবন একটি গল্প। সভ্যতার প্রথম সকালে প্রথম মানুষটি প্রথম চোখ মেলে দেখেছিল, জীবনের চারপাশে ছড়িয়ে আছে রাশি রাশি গল্প। বিচিত্র গল্প। সীমাহীন গল্প। বেদনার গল্প। হাসির গল্প। মাতাল গল্প। রুটির গল্প। পাখির গল্প। প্রাকৃতিক গল্প। হরর গল্প। সুন্দর গল্প। অসুন্দর গল্প। রাত ভাঙা জ্যোৎস্নার গল্প। কৃষকের গল্প। একটি গল্পে অজস্র আখ্যান। অনেক প্রতিশ্রুতি। লক্ষ চরিত্র। সেইসব আখ্যান চার চরিত্ররা হাত ধরাধরি করে মানুষের সংবেদি আত্মার ভেতর দিয়ে হাজার কোটি দিনরাত্রি পার হয়ে গল্প আজ মানুষের প্রতিদিনের প্রতিধ্বনি। আশার উদ্বোধনী সংগীত। প্রেরণার করুণাসিন্ধু। ডুব সাঁতারের অথৈ জলে ঘূর্ণিপাকের তাণ্ডব। সৃষ্টি ও সৃজনের বিস্ময়কর কারুকাজ, গল্প।

আমরা যেদিকে তাকাই গল্প দেখতে পাই। গল্প কালের স্রোত, জীবনের রুদ্ধ আবেগ, সৌন্দর্যের অশ্রুপাত, প্রেমের মহালগ্ন, বিরহের সাতকাহন, মিলনের তীব্র আকাঙক্ষা, বিপ্লব ও বিদ্রোহের মুষ্টিবদ্ধ হাত… সব কিছুর ভেতর গল্প নিজের জায়গা করে নিয়েছে অবাক দক্ষতায়। জীবনের গতি যেখানে থেমে যায়, গল্প তার বাস্তব শরীর নিয়ে চেতন ও অবচেতনের দুয়ার খুলে সেখানে অনায়াসে হাজির হয়। জানান দেয়, আমি আছি। আমি থাকব। আমাকে ছাড়া মানব জীবন অচল। গল্পের এই স্বার্বভৌম রূপ ও রূপান্তর একজন গল্পকারের শ্রেষ্ঠ শক্তি।

সেই শক্তির সম্পূর্ণ আধার নিয়ে বাংলা গল্পের পৃথিবীতে এসেছেন হুমায়ূন আহমেদ। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাগল্প চলে আসছিল একটা ম্যাড়মেড়ে কাদা থকথকে ভাব নিয়ে ক্লান্ত আর আশ্রয়হীন পথিকের মতো, গল্পকার হুমায়ূন আহমেদ এলেন মেড়ে কেটে তেড়ে, নিজস্ব ঘরানার মীড়ে গল্পকে দিলেন নতুন বিন্যাস, আনলেন গল্পের শরীরে তুমুল পরিবর্তন। দিলেন নতুন বাঁক, গড়লেন বাংলা গল্পের নতুন প্রতিমা। বাংলা গল্পের প্রথম মুক্তিদাতা স্বার্বভৌম রবীন্দ্রনাথ, তাঁর দেখানো পথ ধরে বাংলা গল্প প্রায় এক’শ বছর বিচিত্র ধারায় এগিয়ে গেছে অনেক অনেক পথ। রবীন্দ্র পরবর্তী নিবিষ্ট গল্পকারেরা জগদীশ গুপ্ত, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, আনিস চৌধুরী, আবু রুশদ, সরদার জয়েনউদ্দীন, জহির রায়হান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেলিনা হোসেনসহ আরও অনেক গল্পকারের হাতে গল্প এগিয়ে চলছিল। কিন্তু গল্পকার হুমায়ূন আহমেদ দীর্ঘদিন ধরে চলা গল্পের পথটাকে আচমকা আমূল পাল্টে দিলেন। চমক দেখালেন। গল্পের জন্য আঁকলেন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের এক জগৎ। গল্পকারেরা তো বটেই পাঠকও তার সঙ্গে দ্বিধাহীন স্রোতে যেতে শুরু করলেন। এবং সেই যাত্রা এখনো অব্যাহত। সব স্রোত, সব মোহ, সব ক্ষোভ, সব মিছিল, সব আরতি মিলিত হয়েছে তাঁর সঙ্গে, তাঁর গল্পে। তাঁর গল্পের সৃষ্ট অনবদ্য সব চরিত্রের ভেতরে আমরা একটা কুহকের জগৎ পাই। নতুন দিনের নতুন পাঠকদের জন্য ভিন্ন বৈশিষ্ট্য, আলাদা ও স্বাতন্ত্র্য ঘরানায় একজন বরপুত্র হুমায়ূন আহমেদ এলেন, তাঁর আগমনের জন্য বাংলা সাহিত্য দীর্ঘ প্রতীক্ষায় ছিল, তিনি সেই প্রতীক্ষার অবসান ঘটালেন। বাংলা গল্পে আনলেন নতুন দিন। পাষাণে দিলেন প্রাণ। বাঙালি পাঠকের চিত্ত নেচে উঠল অনির্বাচনীয় আনন্দে ও সুখে। এই আনন্দ ও সুখ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যতদিন পৃথিবীতে থাকবে, চলমান থাকবে। একজন গল্পকারের এই স্বয়ম্ভু প্রবল ক্ষমতার কাছে আনত না হয়ে পারা যায় না। বরং কথাটা আমরা এভাবে বলতে পারি, এই আনত হওয়ার মধ্যে গৌরব আছে। বাঙালির গৌরবের শতকিয়া খুব কম। সেখানে একজন গল্পকার হুমায়ূন আহমেদ আমাদের জন্য গৌরবের স্মারক। আনন্দের উৎস। পালার প্রধান পালাকার। রূপান্তরের শ্রেষ্ঠ কারিকর।

কী আছে হুমায়ুন আহমেদের গল্পে? তাঁর গল্পের প্রধান আকর্ষণ বৈঠকি ঢং বা আয়োজন। আমাদের অধিকাংশ গল্পকারদের মধ্যে প্রবল ইচ্ছে থাকে, পাঠকদের জানান দেওয়া, যে তিনি মেধাবী একজন গল্পকার। চিন্তায় তিনি গভীর চেতনা সম্পন্ন। তার গল্প পাঠ করতে হলে ডিকশনারি নিয়ে বসতে হবে। কেননা তিনি গল্পই লেখেন না, করেন নিরীক্ষাও। আর নিরীক্ষা করতে হয়ে অবোধিত শব্দ ব্যবহার জরুরি। গল্প, গল্পের কাঠামো বা আখ্যানকে কঠিন থেকে কঠিনতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া আরও জরুরি। না হলে পাণ্ডিত্য প্রকাশ পায় না। নিজেকে জাহির করা যায় না। এইসব করতে করতে গল্পকেই গিলোটিনের তলায় সপে দিয়েছেন। পাঠক প্রায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তারপরও আমারা বুদ হয়ে আছি- কোষ্ঠকাঠিন্যের মহীসোপান। সেখানে গল্পকার হুমায়ূন আহমেদ একেবারে উল্টো। তিনি তাঁর গল্প, গল্পের চরিত্র আর গল্পের আখ্যান বা কাঠামোকে সরল অভিব্যক্তিতে, নিপুণ দক্ষতায় পাঠকের অস্তিত্বের আস্তিনে সাঁটিয়ে দেন চেতনার রঙকে পান্নার ঢংয়ে সাজিয়ে। সেখানে থাকে না কোনো পাণ্ডিত্য, থাকে না কাঠিন্য, থাকে না নিজেকে উপস্থাপন করার প্রবল ঝোঁক। গল্প, গল্পের আখ্যান, চরিত্র আর শব্দাবলি নিয়ে অবাক রাজত্ব তৈরি করেন তিনি। যে রাজত্বে একজন পাঠক অনায়াসে ডুব দিতে পারেন। এমন কী নিজেকে হারিয়েও ফেলতে পারেন। ডুব দেওয়া ও হারিয়ে ফেলতে পারার মধ্যেই পাঠক পেয়ে যান তার স্বপ্নলোকের চাবি। যে চাবির জন্য পাঠক দিন রাত হাতড়ে বেড়ান। হুমায়ূন তাঁর পাঠকের কাছে খুব যতেœর সঙ্গে খুঁজতে থাকা চাবির গোছা তুলে দেন। এইভাবেই তিনি তাঁর গল্পের জগৎ তৈরি করেন। অতিলোকিক গল্পও তাঁর নতুন উপস্থাপন কৌশলে পাঠক পেয়ে যায় ভিন্ন এক স্বাদ। হয়তো ভয়ে গা ছমছম করছে,তারপরও নিষিদ্ধ গন্ধমের মতো হুমায়ূন আহমেদ-এর গল্প তাকে পাঠ করতে হচ্ছে। অনেকটা এরকম যে, পাঠকের পাঠ না করে নিস্তার নেই। রবীন্দ্রনাথ থেকে আজকের সকালের প্রথম গল্পকার- বাংলা গল্প ও গল্পকারদের দীর্ঘ মহাস্মরণীতে এখানেই গল্পকার হুমায়ূন আহমেদ অনন্য। অসাধারণ। মহিমান্বিত।

আগেই লিখেছি, হুমায়ূন আহমেদের গল্প বাংলা গল্পে এনেছে নতুন বাঁক। কী সেই বাঁক? প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। প্রায় একশ’ বছর ধরে বাংলা গল্প চলেছে বহুমাত্রিক রেখায়। কল্পনায়। আঙ্গিকে। প্রকরণে। শব্দে। বাক্যে। এবং গল্প মানবিক বোধে ছিল সমৃদ্ধ। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অমানবিক ক্ষত, বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক দুই কাঠামোয় বিভক্ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিয়েতনাম আক্রমণ, ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্র তৈরি, নিরপরাদ ফিলিস্তিনিদের নিজ মাটি থেকে উচ্ছেদ করে চিরকালের উদ্বাস্তু জাতি তৈরি করেছে, সেখানেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী হাত। ব্যবহার করেছে জাতিসংঘ নামক নাখদন্তহীন সংস্থাটি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের যুদ্ধ। যুদ্ধে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় রাজনৈতিক দোসর জামাত রাজাকার আলবদর কর্তৃক বাংলাদেশে চালিয়েছে নরমেধযজ্ঞ। ওরা মিলেমিশে এই দেশের নারী শিশু কিশোর বৃদ্ধ যুবক যুবতী বুদ্ধিজীবী ছাত্র কৃষক শিক্ষক-অজস্র মানুষ খুন করেছে পবিত্র ধর্মের নামে। কিন্তু নিয়তির পরিহাস, এত খুন, এত রক্তপাত, তারপরও ওদের পরাজয় হয়েছে। এতসব মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে পাল্টে গেছে দুনিয়া। টেলিগ্রাফ, টেলিগ্রাম অলরেডি দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। চিঠি, মানুষের সঙ্গে মানুষের নিবিড় গোপন আর চিত্তাকর্ষক সম্পর্ক তৈরির কারখানা আর কয়েক বছর পর দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে। থাকবে জাদুঘরে। কারণ হাতের মুঠোয় আছে সেলফোন, সঙ্গে এস এম এস। দ্রুত যান্ত্রিক কোলাহল আর যন্ত্রের যন্ত্রণায় মানুষের গভীর অন্তবোধের আবেগ বিদায় নেবার পথে। এসবের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে অবাক যন্ত্র কম্পিউটার। কয়েক বছরের মধ্যে কম্পিউটারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেট। ইন্টারনেট নিয়ে এসেছে ফেসবুক। দুনিয়া সত্যিই এক সেকেন্ডে হাতের মুঠোয় বা তালুতে। গল্প এইসব পার হয়ে আসতে আসতে নিজেকে কিছুটা যান্ত্রিক সত্তায় বিকিয়ে দিয়েছে। বিকিয়ে না দিয়ে গল্পের উপায় নেই। কারণ, পাঠকের কাছে এখন আছে হরেক রকম বিকল্প। না, কেবল রেডিও টেলিভিশনই নয়, আছে সিনেমা দেখারও সুযোগ। ঘরে বসে সিডি বা ডিভিডি কিনে মনের আউশ মিটিয়ে সে সময় পার করতে পারেন। অর্থাৎ গল্পকে তার জয়যাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে সময়ের নিরিখে নিজেকে কিছুটা হলেও পাল্টে ফেলার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমাদের সৌভাগ্য, গল্পের নির্মাতা বা গল্পকারেরা সেটা বুঝে গেছেন আগেই। এখানেই জগতের সকল শিল্পকারিকরদের থেকে গল্পকারেরা এগিয়ে থাকলেন। বিশ্বগল্পের পুরোহিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঁচে থাকলেও নিজেকে, নিজের গল্পকে আমুল পাল্টে ফেলতেন। যেমন তিনি ‘শেষের কবিতা’ লিখে প্রমাণ রেখেছেন, তিনি সময়ের সঙ্গে নিজেকে, নিজের ছাঁচকে সহজে পাল্টে ফেলতে পারেন! সময়ের সঙ্গে বা সময়কে কিছুটা অতিক্রম করে নতুন নির্মাণের প্রয়োগই অগ্রসরমানতা। বাংলা গল্পের শত প্রবহমানতার ধারায় নিজেকে পাল্টে ফেলে সময়ের সঙ্গে অগ্রসর গল্পকার হুমায়ূন আহমেদ অন্যতম কুশীলব।
হুমায়ূন আহমেদের বড় কৃতিত্ব, তিনি খুব সাধারণ বা তুচ্ছ একটা বিষয়কে অসামান্য দক্ষতায় একটি মানবিক গল্পে রূপান্তরিত করতে পারেন। তুচ্ছ বা অতি সাধারণ বিষয়কে সার্থক একটি গল্পে রূপান্তর বা পরিণত করার নির্মোহ ক্ষমতার ভেতরেই গল্পকারের প্রাণ-প্রাচুর্য, ক্ষমতার তরবারির ধার প্রমাণ রাখতে পারেন। হুমায়ূন আহমেদ সেই প্রমাণ রেখেছেন অজস্রবার। তিনি ছোট প্রাণে বড় প্রাণের চাষ করেন, অবশ্যই শিল্পমানকে যথাযথ রেখে। ছোট্ট টলটলায়মান পুকুরকে বিশাল জলদিঘিতে রূপান্তর করার অসম্ভব দক্ষ তিনি। গল্পে গল্পে সেই শিল্পকলাকে বিন্যাস করতে পেরেছেন, কারণ, তাঁর চেতন সত্তায় গল্প শিল্পকলার সমস্ত ছালবাকল নিয়ে বিরাজমান।

বাবা সংসারের কর্তা। তিনি তো মাছ তরিতরকারি কিনে আনবেনই। হ্যাঁ বাবা বেচারা সময় সুযোগ পেলে, হঠাৎ হাতে টাকা এলে একদিন একটা বড় মাছও কিনে আনতে পারেন। তাই বলে এই তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে একটা হৃদয় মোচড়ানো গল্প লেখা সম্ভব ? হ্যাঁ সম্ভব। কারণ, গল্পকার যে হুমায়ূন আহমেদ!
জরী, দীপু, পরী, তিন ভাইবোন। তাদের মা হাসিনা আর বাবা। বাবা ছোট্ট একটা চাকরি করেন। হাত টানাটানি থাকেই। ছেলেমেয়েদের ছোটখাটো আবদার পূরণ করতে পারেন না বাবা। তার বড় কষ্ট। সেই বাবা এক রাতে বাসায় এসেছে অনেক রাত করে। ছেলেমেয়েরা ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। বাবা বড় একটা মাছ এনেছে। ছেলেমেয়েরা ঘুম থেকে উঠে এসেছে। হাসিনা মাছ বড় বড় করে কেটে ভাজছে। আজ সবাই আবার ভাত খাবে। ছোট্ট বাড়িটায় উৎসব।
গল্পটা এখানেই শেষ। কিন্তু শেষ হলো না, কারণ গল্পকার যে হুমায়ূন আহমেদ, আপনার আত্মার দুয়ার ধরে টান দেবেন যে!
গল্পের শেষ তিনটি লাইন-

বাসন কোসন কলতলায় রাখতে গিয়ে হাসিনা অবাক হয়ে দেখে মেঘ কেটে অপরূপ জ্যোৎস্না উঠেছে। বৃষ্টিভেজা গাছপালায় ফুটফুটে জ্যোৎস্না। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকে সেদিকে। অকারণেই তার চোখে জল এসে যায়।”

আমি নিশ্চিত পাঠক, আপনার চোখে জল না এলেও আপনার সংবেদনশীল মন আপনাকে আমূল নাড়া দিয়ে গেছে। এই জন্যই হুমায়ূন আহমেদ অনন্য গল্পকার।
অবদমন, আত্মদমন মানুষের মনোজগতকে কতখানি বিষাক্ত, আগ্রাসী করতে পারে, আত্মহননের কারুকাজে মানুষ কতটা নিজের কবর খুঁড়তে পারে, গল্পের মায়াভুবনে তারই বিস্তার করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। গল্পের নাম ‘জ্বীন কফিল’। তাঁর লেখার ব্যাকরণ অনুসারে তিনি গল্পটি শুরু করেছেন। পড়তে পড়তে পাঠক এগিয়ে যাচ্ছেন। ক্রমে ক্রমে পাঠক গল্পটির ভেতর ঢুকতে ঢুকতে এক অজানা জগতে প্রবেশ করে। গল্পকার উত্তম পুরুষে গল্পটি বলছেন। সাধু কালু খাঁ নামক এক অবাক মানুষের সঙ্গে দেখা করার জন্য গল্পকার অনেক দূরের এক গ্রামে গেলেন। সেখানে যাবার পর রাত কাটানোর জন্য একটি মসজিদে উঠলেন। গ্রামীণ মসজিদ। মসজিদের ইমাম তাদের সাদরে গ্রহণ করলেন। তারপরই গল্পের প্লট থেকে হারিয়ে গেল সাধু কালু খাঁ এবং গল্পকারের বন্ধু। গল্পে অবতীর্ণ হলেন মসজিদের ইমাম এবং তার স্ত্রী লতিফা। রাতে ঘুমুতে যাবার সময়ে ইমাম তার ও তার স্ত্রী লতিফার ঘটনা বলল গল্পকারকে।
ইমাম একজন সর্বহারা সাধারণ মানুষ। নেত্রকোনার মমতাজউদ্দিনের বাড়িতে থাকার জায়গা হলো। সে বাড়িতে কাজ করে, খায়, থাকে। মমতাজউদ্দিনের তিন মেয়ের মধ্যে লতিফা তার প্রেমে পড়ে। লতিফা খুব সুন্দরী। স্বাভাবিকভাবে ইমামও পড়ে। কিন্তু নিজেকে গুটিয়ে রাখে। সে মনিবের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে নিমকহারামি করতে পারবে না। এদিকে লতিফার বিয়ে ঠিক হয়েছে। লতিফা তার মা বাবাকে জানায় সে গর্ভবতী। আর সেই গর্ভের অংশীদার ইমাম। পরিস্থিতি হঠাৎ পাল্টে গেল। মমতাজউদ্দিন অনেক গালিগালাজ করে ইমামের সঙ্গে রাতেই লতিফার বিয়ে দিলেন। শুরু হলো নতুন সমস্যা, বাড়ির কেউ লতিফা আর ইমামকে দেখতে পারে না। সম্মান করে নাজ এক ধরনের নিষিদ্ধ জীবনযাপন চলতে থাকে দুজনের। একদিন লতিফার বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি যায়, দায় পড়ে ইমামের। যত নিচু শ্রেণীর হোক, মানুষ তো। তারও সহ্য ক্ষমতার একটা সীমা থাকে। সেই সীমা অতিক্রম করলে ইমাম ও লতিফা বাড়ি থেকে বের হয়। এবং নেত্রকোনার সিদ্দিকুর রহমান নামক এক লোকের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয়। দুজনে থাকছে, সুখের সংসার। এর মধ্যে লতিফার ঘাড়ে ভর করল এক জ্বীন। নাম তার কফিল। কফিল লতিফার দুটো সন্তানকে মেরে ফেলেছে। এখন লতিফা গর্ভবতী। সেই সন্তানকেও মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। এবং টোটাল বিষয় নিয়ে ইমাম খুব পেরেশানিতে আছে।
গল্পটা বেশ বড়। হুমায়ূন আহমেদের গল্প খুব বড় হয় না। কিন্তু ঘটনা আর গল্পের টানাপোড়েনের ঘনঘটায় এই গল্পটি বড়। তো গল্পকার সেই সকালে ঢাকা চলে এলেন। গল্পকারের জীবনের নানা ধরনের ঘটনা তিনি মিসির আলিকে বলেন। মিসির আলি মনোবিদ। তিনি যুক্তির মাপকাঠিতে সব ঘটনা বিচার বিশ্লেষণ করেন, সমাধান দেন। এই গল্পেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। ‘জ্বীন কফিল’ গল্প আলোচনার শুরুতে লিখেছিলাম, অবদমন মানুষকে কোন কুয়ায় নিয়ে নিয়ে, তার প্রতিফলন পাব এই গল্পে। ইমাম আর লতিফার ঘটনা দুইবার শুনলেন মিসির আলি। তারপর তিনি ‘জ্বীন কফিল’ গল্পের প্রধান কুশীলব লতিফার চরিত্রের ব্যাখ্যা দিলেন।

“মেয়েটা অসুস্থ। মনোবিকার ঘটেছে। ইমাম সাহেব লোকটি তাদের আশ্রিত। তাদের পরিবারের চাকর বাকররা যে কাজ করে সে তাই করত। মেয়েটি ভাগ্যের পরিহাসে এমন একজন মানুষের প্রেমে পড়ে যায়। প্রচণ্ড মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়। পরিবারের সবার কাছে ছোট হয়। অপমানিত হয়। এত প্রচণ্ড চাপ সহ্য করার ক্ষমতা তার ছিল না। তার মনোবিকার ঘটে। পোয়াতি অবস্থায় মেয়েদের হরমোনাল ব্যালান্স এদিক-ওদিক হয়। সেইসময়ে মনোবিকার তীব্র হয়। মেয়েটির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। মেয়েটি দরিদ্র ইমামকে বিয়ে করে কঠিন মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়েছে। একইসঙ্গে সে লোকটিকে প্রচণ্ড ভালোবাসে আবার প্রচণ্ড ঘৃণাও করে। কী ভয়াবহ অবস্থা!
মেয়েটি ইমামকে ঘৃণা করে এটা কেন বলছেন ?
ইমামতি পেশা মেয়েটির পছন্দ নয়। পছন্দ নয় বলেই মেয়েটি কফিলের গলায় বলেছে-ইমাম আসছে। অজুর পানি দে, জায়নামাজ দে, কেবলা কোনদিকে বলে দে। এক ধরনের রসিকতা করার চেষ্টা করছে।
মনোবিকার এমন ভয়াবহ রূপ নিল কেন ? সে নিজের বাচ্চাকে হত্যা করছে কেন ?
বড় ধরনের বিকারে এ রকম হয়। সে নিজেকে ধ্বংস করতে চাইছে। নিজের সন্তান হত্যার মাধ্যমে সেই ইচ্ছার অংশ বিশেষ পূর্ণ হচ্ছে। আরও কিছু থাকতে পারে। না দেখে বলতে পারব না।”

গল্পটি শেষ হয়েও শেষ হলো না। কারণ, গল্পকার এবং মিসির আলি সেই গ্রামে গিয়েছিলেন। লতিফার সঙ্গে কথা বলেছেন মিসির আলি। লতিফা তার ভুল বুঝতে পেরেছে।
আমারা আগের লেখায় ফিরে যাই। লিখেছিলাম অবদমনের প্রক্রিয়া। একটি গল্পের একজন লতিফার ভেতর দিয়ে গল্পকার হুমায়ূন আহমেদ আমাদের বিধ্বস্ত সমাজ কাঠামোর অজস্র লতিফা-ইমামের ঘটনা উপস্থাপন করেছেন। আমাদের সমাজে, রাষ্ট্রে, পুলিশের কাছে পাবলিক, পলিটিশিয়ানদের কাছে পাবলিক, সচিবালয়ের টেবিলে টেবিলে লাল ফিতার ফাইলে আটকা পাবলিকের প্রাণ, পবিত্র ঈদে দোকানদারদের গলাকাটা দাম প্রতিটি ক্ষেত্রে বাঙালি এখন চরম অবদমনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে দেশে চলছে হরিলুটের বাতাস বিতাড়ন। এই গল্পে লতিফা লক্ষ কোটি লতিফার প্রাণভোমরা হয়ে উঠেছে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে এক একজন গল্পকারকে সমাজের বিবেক বলি। কেন বলি? যখন সমাজ রাষ্ট্রে পচন ধরে, সমাজের মাথাওয়ালা মানুষগুলো নিজেদের বাঁচানোর জন্য পবিত্র ঈমান বিক্রি করে দেয় পানির দরে, তখন গল্পকারেরা তাদের গল্পে চরিত্রে আখ্যানে সেই পচনের বিষক্রিয়া কাউকে পরোয়া না করেই প্রকাশ করে। অবশ্য যেসব হাঙরদের জন্য গল্প, তারা কোনোদিন, কখনো সেই গল্প পড়ে না, পাঠ তো অনেক পরের কথা। পড়ে না বলেই সমাজ ও দেশটা ক্রমাগত তলিয়ে যাচ্ছে। হুমায়ূন আহমেদের গল্প সম্পর্কে লিখতে বসে কেন এসব কথা লিখছি ? কারণ, তাঁর গল্প। গল্পটির নাম ‘তুচ্ছ।’
গল্পের প্রধান চরিত্র বদরুল আলম। তিনি সম্প্রতি সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। সমাজ দেশ রাষ্ট্র নিয়ে খুব ভাবেন। তিনি দেশের ক্ষুধার্থ শিশুদের জন্য রুটি বানানোর একটি প্রকল্প চালু করেছেন। রুটি বিতরণ সমিতি। সংক্ষেপে রুবিস। গল্পের গল্পকারও এই প্রকল্পের একজন নিযুক্ত হয়েছেন। উপায় নেই। এক এলাকায় থাকতে গেলে অনেক কিছু মুখ বুঝে মানতে হয়। গল্পকারও মানলেন। রুটি বিতরণ আপাতত বন্ধ। কারণ, বর্ষার জন্য অপেক্ষা। তখন শিশুদের অবস্থা খারাপ থাকে বেশি। হঠাৎ একদিন পথে বদরুল আলমের সঙ্গে দেখা। তিনি গল্পকারকে দেখে দ্রুত ডাকলেন। বদরুল আলমের সামনে তিনটি বাচ্চা। তারা কাঁদছে। বদরুল বললেন, হাতে সময় নেই। এই বাচ্চাদের সমস্যা একটু শুনন। বদরুল আলম কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে দ্রুত কেটে পড়লেন। শেষে জানা গেল বাচ্চা তিনটি তাদের বাবার খোঁজে ঢাকা শহরে এসেছে মামার সঙ্গে। বাচ্চাদের বাবা গাতক। মামা হাতে দশ টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলেছে অপেক্ষা করতে। বাচ্চারা মামার ফিরে আসার অপেক্ষা করছে আর কাঁদছে। গল্পকার কী করবেন? তিনি পড়েছেন অকাল সমুদ্রে। জীবন থেকেও তো মানুষ কিছু শিক্ষা নেয়। যেমন নিয়েছেন কিছুক্ষণ আগে বদরুল আলমের কাছ থেকে। সুতরাং তিনি সেই চালটা চাললেন। তিন বাচ্চার বড়টি মেয়ে। তার হাতে দশ টাকা ধরিয়ে দিয়ে আর একজন পথচারীকে ওদের ঘটনা শুনতে বলে দ্রুত কেটে পড়লেন।
এবার গল্পকারের সঙ্গে গল্পের শেষটায় প্রবেশ করব।
“বদরুল আলম সাহেবের সঙ্গে পরদিন দেখা। বাজার করে ফিরছেন। আমাকে দেখে হাসিমুখে বললেন, কী ভালো ?
আমিও হাসিমুখে বললাম, জি, ভালো।
ইলিশ মাছ আজ খুব সস্তা যাচ্ছে। পঞ্চাশ টাকায় আজ যে ইলিশ এনেছি অন্যদিন তার দাম পড়ত একশ’। এই দেখেন সাইজ। তিনি ইলিশ মাছ বের করে দেখালেন। বিশাল সাইজ। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললেন, ‘রুবিসে’র কাজকর্ম’ তো শুরু করা উচিত। বর্ষা তো এসে গেল তাই না?
হ্যাঁ তাই। এবার বর্ষা আগেভাগে নামবে ?
এ বছরেও ফ্লাড হলে তো সর্বনাশ। ফ্লাডের ব্যাপারটাও কনসিডারে রাখতে হবে।
আর কোনো কথা হলো না। তিনি ওই বাচ্চাগুলির কথা কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। আমিও কিছু বললাম না। যেন ওই জাতীয় কোনো ঘটনা আমাদের জীবনে ঘটে নি। আর ঘটলেও সেটা খুবই তুচ্ছ ব্যাপার। তুচ্ছ কিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথায় আমাদের ?”
এই গল্পটি ১৯৭১ সালের সাড়ে সাত কোটি বাঙালি থেকে আজকের বিশ কোটি বাঙালির চরিত্রের অসাধারণ প্রকাশ নয়? সুযোগের অভাবে ঘুষখোর না হয়ে সাধুর মতো আমাদের ক্যারেক্টার। হাজার জনসভায় দেওয়া আমাদের বিকৃত নেতাদের কথামালা ও চরিত্রের আশ্চর্য মিল খুঁজে পাচ্ছেন না আপনি এই গল্পে? শংকর বাঙালির বামন মানসিকতার কী বাস্তব প্রকাশ! এই গল্পের উপপাদ্য তো আমাদের প্রতিদিনের জীবনের চাকা। যে চাকার নিচে আমরা প্রতিদিন পিষ্ট হচ্ছি, থেঁতলে যাচ্ছি, অস্থিচর্মসার হচ্ছি- কিন্তু তারপরও দাঁত কেলিয়ে কিছু দলবাজি বুদ্ধিজীবী দালাল সম্প্রদায় বলে যাচ্ছে, আমরা ভালো আছি, ভালো আছি আপনাদের দয়ায়। এই দুঃসময়ে ‘তুচ্ছ’ গল্পটি চাবুকের মতো নেমে আসে আমাদের মানবিক চাতালে। আর তাই, হুমায়ূন আহমেদ, গল্পকার হুমায়ূন আহমেদ প্রতিবাদের বিবেক, সাহসের বিবেক, গল্পের দ্রোনাচার্য।
একাত্তর আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ উজ্বল রঙিন দিন। একাত্তর এসেছিল, তাই শেখ মুজিব এসেছিলেন, তাজউদ্দিন আহমদ এসেছিলেন। শত শত মহীয়সী বীরাঙ্গনা, লাখো লাখো মুক্তিযোদ্ধা, একটি রক্তসবুজ পতাকা আর হাজার বছরের স্বপ্ন বাঙালির একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি, একাত্তরের সোপানতলে। আমরা বড় অভাগা একটি জাতি, যারা খুব দ্রুত একাত্তরের মতো বিশাল মহাকাব্যিক প্রান্তরকে ভুলে গেছি। যারা আমাদের স্বদেশের স্বাধীনসত্তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, তাদের কুর্কীতি ভুলে গেছি। শুধুমাত্র ক্ষমতার ভোগের কারণ তাদের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছি। পৃথিবীতে এখন ১৯৭টি দেশ। সেই দেশগুলোর কোনোটিতে এমন আত্মঘাতী প্রবণতা দেখতে পাই না। এমন কী তারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। তারা মন্ত্রী হয় তাদের বাড়ির সামনে আমাদের বুকের রক্তখচিত পতাকা ওড়ে। তারা লাখো শহীদের প্রাণের তৃষ্ণায় আবৃত পতাকা শোভিত গাড়িতে চড়ে। তাও আমাদের দেখতে হচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধের মাত্র চলি­শ বছরের ব্যবধানে।
এই অদ্ভুত পাশবিক দৃশ্য আমাদের দেখতে হবে মাত্র এক প্রজন্মের মধ্যে, হুমায়ূন আহমেদ নিশ্চয়ই আশা করেন নি। কারণ, যুদ্ধে পিতা ফয়জুর রহমানকে হারিয়েছেন তিনি। তাঁর পরিবার। ফয়জুর রহমান ছিলেন তৎকালীন মহকুমা পিরোজপুরের পুলিশ অফিসার। আর আমার বাড়ি সেই পিরোজপুরেই। আমি তাঁর চেতনার অংশীদার। আমি শহীদ ফয়জুর রহমানের আত্মার প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। আমি প্রত্যেক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কাছে আমাদের ভীরু কাপুরুষ মেরুদণ্ডহীন রাজনীতিবিদদের হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। শহীদ ফয়জুর রহমানের পুত্র হুমায়ূন আমাদের গল্পে স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযুদ্ধের রক্ত কুসুম প্রস্ফুটিত হবেই। মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশি স্রোতধারা তাঁর চেতনার শীর্ষবিন্দুতে শামসুর রাহমানের কবিতার মতো জ্বলজ্বল করে উড়ছে। তাঁর গল্পে, গল্পের চরিত্রে আর রক্তাপ্লুত গল্পের কলকবজায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় সমর্থক দোসরদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র লড়াই, তাদের গতি, বিরামহীন পথচলা বর্ণাঢ্য হয়ে উঠেছে। মূর্ত হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে এখনো বাংলার পথেমাঠে অন্তবীক্ষে আমাদের যুদ্ধ চলছে- মুক্তিযুদ্ধ তাঁর গল্পে এতটাই সজীব, সচল আর অগ্নিময়। সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হুমায়ূন আহমদ গল্প আমাদের সকল আকাঙক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
জলিল সাহেবের পিটিশন, জনক, পাপ, উনিশ শ’ একাত্তর গল্পগুলো আমাদের মানসে একাত্তরের মানচিত্র হয়ে ওঠে। সেইসঙ্গে চেতনার উত্তরাধিকারের রাফখাতা লেখে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের গল্প। যুদ্ধ যে মানুষের ভেতরের স্বাভাবিক বুদ্ধি বিবেচনাবোধের কবর রচনা করে, তারই আখ্যান ‘পাপ’ গল্প। যুদ্ধ আসলে মানুষকে মানুষের বাসভ‚মি থেকে হিংস্র পশুর চারণক্ষেত্রে নিয়ে যায়। আমরা একাত্তরে যেমন দেখেছি মানুষের এই নিকৃষ্ট পশু হয়ে ওঠার সবাক চালচিত্র, তারপর দেখছি মার্কিন আগ্রসানে ইরাকের যুদ্ধ, আফগানিস্তানে যুদ্ধ, তামিলদের বিরুদ্ধে শ্রীলংকার যুদ্ধ। আর ভাগ্য বিড়ম্বিত ফিলিস্তিনের যুদ্ধ তো দেখছি গত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে। দেখছি গণন্ত্রের পূজারি, বিশ্বমানবতার তথাকথিত মোড়ল মার্কিনের নগ্ন সমর্থনে ইসরাইলি সৈন্যদের শাতিলা আর শাবরা আশ্রয় শিবিরে হাজার হাজার নিরুপায় অসহায় নারী শিশুদের ওপর ইতিহাসের বর্বরতম আক্রমণ। দুটি শিবিরের প্রায় দশ হাজার নারী শিশু পুরুষদের মাটির সঙ্গে প্রায় জ্যান্ত পিষে ফেলার দৃশ্য। এই নৃশংস নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে নিরুপায় জাতিসংঘ ইসরাইলের বিরুদ্ধে একটি নিন্দা প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিল। এ টুকু না করলে জাতিসংঘ বলে একটা প্রতিষ্ঠান আছে, তার তো লজ্জা আছে! সেই নিন্দা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে এই গণতন্ত্রের দাদন ব্যবসায়ী মার্কিন রাষ্ট্রটি ভেটো দিয়েছিল। এখন পর্যন্ত মার্কিনিরা দানব ইসরাইলকে রক্ষা করার জন্য ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ৪৩ বার ভেটো দিয়েছে। কী চমৎকার যুদ্ধ! কী অসাধারণ মানবতা! যুদ্ধের সেই ভয়াবহ হিংস্র রূপান্তরকে হুমায়ূন দেখিয়েছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আলোয় ছোট্ট একটি পরিসরে, ‘পাপ’ গল্পে।
মুক্তিযুদ্ধের অনুভ‚তি একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে আসমান স্পর্শ করার মতো সাহস আর শৌর্যের গান। সেইসঙ্গে চেতনার কাছে নিজস্ব অঙ্গীকার মায়ের স্তন পানের মতো অমৃত অভিজ্ঞতা। সেই অমৃত অভিজ্ঞতাকে নিজের চেতনায় ধারণ করে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন ‘জনক’ গল্প। মুক্তিযোদ্ধা মতি যুদ্ধের পর, বিজয়ী হয়ে ফিরে এসেছে নিজের ডেরায়। রাত। শুয়ে আছে বিছানায়। পাশে স্ত্রী জয়গুন আর দুই মাস এগারো দিনের পুত্র মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন। মতি তার ছেলে মনোয়োর হোসেনের সঙ্গে বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে কথা বলে। ছেলের মাঝে নিজের স্বদেশের মানচিত্র দেখে। রাতে মনোয়ার হোসেন কাঁদে। জয়গুনকে জাগিয়ে দেয়। জয়গুন দুধ দেয়। কিন্তু জয়গুনের শারীরিক অবস্থা এখনো ভালো হয় নি। তাই বেঘোরে ঘুমায়। মনোয়ার হোসেন কেঁদে উঠলে মতি পুত্রকে কোলে নেয়। আর পুত্র শান্ত হয়। এবং ছেলের সঙ্গে গল্প শুরু করল মতি। ছেলেকে মুক্তিযোদ্ধা মতি তার যুদ্ধের ঘটনা বলছে। যুদ্ধক্ষেত্রে সম্মুখ যুদ্ধের ঘটনা “… রাইফেল হাতে কাঁপতেছি আর দোয়া ইউনুস পড়তেছি তখন ডাইন পায়ে গুলি খাইলাম। আমার দুনিয়া আন্ধাইর হইয়া গেল। বুঝলি ব্যাটা, তখন মনু ভাই কি করল শুন এই আমারে পিঠের মইধ্যে নিয়া মনু ভাই পাক্কা তিন মাইল দৌড়াইল। আমার জীবন রক্ষা হইল। মনু ভাই আমারে ফালাইয়া চইল্যা আসতে পারত। তখন সবের ঘোর বিপদ। ফালাইয়া আসে নাই। মনু ভাইয়ের ঋণ শোধ করতে পারি নাই। এর এক মাস পরে মুরাদখালী ফাইটে মনু ভাই মারা গেলেন। মনে হইলেই কইলজায় কামড়ায়। বুঝলিরে ব্যাটা, মনু ভাইয়ের নামে তোর নাম রাখছি। মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন। নামের ইজ্জত রাখন চাইরে ব্যাটা। নামের ইজ্জত রাখন চাই। বড় ইজ্জতদার নাম।
গল্প বলতে বলতে মতি মিয়ার চোখ জলে ভর্তি হয়ে আসে। চোখ ভর্তি অশ্র“র কারণেই বোধহয় শিশু পুত্রটিকে তার অন্যরকম মনে হয়। তার বড় মায়া লাগে। মতি মিয়ার শিশুপুত্র চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় বাবার গল্পটা সে বুঝতে পেরেছে।”
আপনার চোখ কি ভিজে উঠেছে ? আমারও চোখে পানি জমেছে। মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তর আমাদের প্রতিজন বাঙালির চেতনার তৈন্ত্রীতে তৈরি করেছিল একটু মহাসেতু। মতি, মুক্তিযোদ্ধা মতি তাঁর সহযোদ্ধার প্রতি যে শ্রদ্ধা, যে ভালোবাসা, যে অকুণ্ঠ সমর্থন প্রকাশ করেছে, তাঁর ইস্পাত সমৃদ্ধ চেতনারই প্রকাশ পাই ‘জনক’ গল্পে। একাত্তরে, দখলদার পাকিস্তানি হার্মাদ সৈন্য, রাজাকার আলবদর আল শামসদের বিরুদ্ধে সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে মতি আর মনোয়ার হোসেনেদের মতো অজস্র ঘটনা ঘটেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের পবিত্র রক্তে বাংলার প্রতি ইঞ্চি মাটি ভিজে গিয়েছিল। লাশের ভারে বাংলাদেশ নুয়ে পড়েছিল। সেইসব যুদ্ধের ছোট্ট একটি চিত্র বায়ান্নোর অক্ষরে লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ ‘জনক’ গল্পে। একাত্তরের রণাঙ্গনের প্রতিজন মুক্তিযোদ্ধার অভিজ্ঞতা যদি লিখে রাখা যেত, জীবনের আশ্চর্য আলিঙ্গনে এই প্রকারের লাখো গল্প লেখা যেত। কিন্তু কে নেবে এই উদ্যোগ ? যে সরকার ক্ষমতায় আসে, সেই-ই মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন তালিকা করে। সত্তরের নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠ একটি রাজনৈতিক দল মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পিত ঘোষণার মধ্য দিয়ে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের নয় মাসের মরণপণ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশে এখন দুটি জাতীয়তাবাদ। রাজনৈতিক ও মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ একটি দেশে হুমায়ূন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের গল্প লিখে চেনতার পলাশ ফোটাচ্ছেন, এইটাই অনেক বড় ইতিহাস। সেই ইতিহাসের শরীরে ‘জনক’ গল্পটি শঙ্খ চিলের মতো ডানা মেলে উদার আকাশে ছায়ার মতো ঘিরে থাকবে। যাতে মুক্তিযোদ্ধারা চিরকাল এই বাঙালি জাতির মননে শরণে থাকে।
“তিনি হাসিমুখে বললেন, আমি দুজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বাবা। সেভেনটিওয়ানে আমার দুটি ছেলে মারা গেছে”- ‘জলিল সাহেবের পিটিশন’ গল্পটি এইভাবে শুরু করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। আমার ধারণায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ধারণ করে যত লেখা হয়েছে, ‘জলিল সাহেবের পিটিশন’ গল্পটি চেতনাগত প্রবাহের কারণে শ্রেষ্ঠতম একটি গল্প। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর নিজস্ব গল্পঢংয়ে গল্পটি শুরু করেছেন। গল্পটি পাঠ করতে করতে যত গভীরে প্রবেশ করেন পাঠক, তার নিজের চেতনাপ্রবাহে গল্প আর গল্পের চরিত্র জলিল সাহেবের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যান। প্রতিজন পাঠকের মনে হবে, তিনিই জলিল। একাত্তরের সন্তান হত্যার নিঃসীম বেদনা ধারণ করে দাঁতে দাঁতে কামড়ে বিচারের আশায় বসে আছেন, যার একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার দুটি সন্তান নিহত হয়েছেন। জলিল সাহেব এই বাংলার মাটি ও জলের ত্রিশ লক্ষ পিতার স্মারকস্তম্ভ।
জলিল সাহেব গল্পকারের বাসায় এসেছেন। সঙ্গে চৌদ্দ হাজার তিনশত সিগনেচার ফাইল। জলিল সাহেব তার পিটিশন ফাইলটি এগিয়ে দিলেন গল্পকারের কাছে। গল্পকার পাঠ করতে শুরু করলেন। পিটিশন জলিল সাহেব লিখেছেন

“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দশ লাখ ইহুদি মারা গিয়েছিল। সেই অপরাধে অপরাধীদের প্রত্যেকের বিচার করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। কিন্তু এদেশে ত্রিশ লক্ষ মানুষ মেরে অপরাধীরা কি পার পেয়ে গেল কেন এ নিয়ে আজ কেউ কোনো কথা বলছে না? জলিল সাহেব তাঁর দীর্ঘ পিটিশনে সরকারের কাছে আবেদন করেছে যেন এদের বিচার করা হয়।… জলিল সাহেব পানের কৌটা বের করে পান সাজাতে বসলেন। শান্ত স্বরে বলেন, আপনি কি মনে করেছেন আমি ছেড়ে দেবো? ছাড়ব না। আমার দুই ছেলে ফাইট দিয়েছে। আমিও দেব। মৃত্যু পর্যন্ত ফাইট দেব। দরকার হলে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের সিগনেচার জোগাড় করব। ত্রিশ লক্ষ লোক মারা গেল আর কেউ কোনো শব্দ করল না? আমরা মানুষ না অন্য কিছু বলেন দেখি ?”

এই পোড়া অভাগা দেশে হুমায়ূন আহমেদ আছেন বলে জলিল সাহেবদের জন্ম হচ্ছে। ফলে জলিল সাহেব চেতনার সলতেটাকে নিবু নিবু করে হলেও জ্বালিয়ে রেখেছেন, গল্পের চরিত্রের অহংকারে। গল্পে আমরা দেখতে পাই, গল্পকারের সঙ্গে জলিল সাহেবের একটা হার্দিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। মাঝে মাঝে জলিল সাহেবের বাসায়ও যান গল্পকার। জলিল সাহেবের নাতি বলে” দাদার খাতা লেখা শেষ হলে যারা আমার বাবাকে মেরেছে তাদের বিচার হবে।”
গল্পকার বেশিদিন এলাকায় থাকেন নি। পরে তিনি বিদেশে চলে গেছেন। বিদেশ থেকে ছ বছর পর দেশে ফিরলেন। গেলেন জলিল সাহেবের বাসায়। জলিল সাহেব মারা গেছেন। জলিল সাহেবের নাতির সঙ্গে দেখা হলো। আমরা ‘জলিল সাহেবের পিটিশন’ গল্পের শেষটুকু পাঠ করলে এই গল্পের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আমাদের সামনে উন্মোচন হবে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের খাণ্ডবদাহন মানচিত্র দেখতে পাব।
‘উঠে আসার সময়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার দাদু যেসব মানুষের সিগনেচার জোগাড় করতেন সেইসব আছে ?
জি আছে। কেন ?
তোমার দাদু যে কাজটা শুরু করেছিলেন সেটা শেষ করা উচিত। তাই না ?
মেয়েটি খুবই অবাক হলো। আমি হাসি মুখে বললাম, আমি আবার আসব, কেমন ?
জি আচ্ছা।
মেয়েটি গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে নরম গলায় বলল, দাদু বলেছিলেন একদিন কেউ না কেউ এই ফাইল নিতে আসবে।
আর যাওয়া হলো না। উৎসাহ মরে গেল। দেশের এখন নানা রকম সমস্যা। যেখানে সেখানে বোমা ফাটে। মুখ বন্ধ করে থাকতে হবে। এর মধ্যে পুরনো একটি সমস্যা টেনে আনতে ইচ্ছা করে না। আমি জলিল সাহেব নই। আমাকে ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হয়। মিরপুরে একটা পরিত্যক্ত বাড়ি কেনার জন্য নানা ধরনের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে হয়। জলিল সাহেবের বত্রিশ হাজার দরখাস্তের ফাইল নিয়ে রাস্তায় বেরুনোর আমার সময় কোথায়? জলিল সাহেবের নাতনিটি হয়তো অপেক্ষা করে আমার জন্যে। দাদুর পিটিশনের ফাইলটি ধুলো ঝেড়ে ঠিকঠাক করে রাখে। এই বয়েসী মেয়েরা মানুষের কথা খুব বিশ্বাস করে।”

গল্পটি পাঠ শেষে বজ্রাহত হয়ে বসে থাকতে হয়। অনেক দিন আগে প্রজন্ম একাত্তর একটি পোস্টার বের করেছিল। সেই পোস্টারটি সামনে এসে দাঁড়ায়। বধ্যভ‚মিতে হাত মুখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে অসংখ্য মানুষ। নিচে লেখা ‘এই বাংলাদেশ কি তোমরা চেয়েছিলে?” জানি, তারা রাজাকার আলবদর জল্লাদ পরিবেষ্টিত বাংলাদেশ তারা, সেইসব পবিত্র শহীদের আত্মারা চায় নি। কিন্তু আমরা মুক্তিযুদ্ধের মানুষেরা সামান্য স্বার্থের যূপকাষ্ঠে একাত্তরের সব অর্জন বিসর্জন দিয়ে বসে আছি, সর্বনাশের আশায়। সে কারণেই গল্পকার নির্বিকারভাবে বলতে পারেন, আমার সময় কোথায়!
তবে, আশার প্রতীক জলিল সাহেবের নাতনি। সে বত্রিশ হাজার ফাইল ঝেড়েমুছে অপেক্ষায় আছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস, কেউ না কেউ একদিন তার দাদার পিটিশনের ফাইলের সন্ধান নিতে আসবে। এই আশাটুকু নিয়ে একাত্তরের লক্ষ লাশের রক্তে রাঙা নদীর পাড়ে আমরা বসে আছি। জীবনের সব আশা নিয়ে বুভুক্ষুর মতো বসে আছি, জলিল সাহেবের পিটিশন নিয়ে একদিন এই বাংলার মানুষ আবার একাত্তরের মতো, জয় বাংলার মতো, পদ্মা মেঘনা যমুনার মতো, একুশে ফেব্রুয়ারির মতো, মুজিবনগর সরকারের মতো, একাত্তরের অসমসাহসী গেরিলার মতো বাঙালি আবার দাঁড়াবে। বিশ কোটি মানুষের একটি মিলিত কণ্ঠস্বর হবে আমরা ওদের বিচার চাই।
হুমায়ূন আহমেদের গল্প আমাদের এই ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। আমাদের বাংলা গল্পের সেই বাঁশিওয়ালা তিনি, যিনি সাগরের অথৈ জ্বলে আগুন জ্বালাতে পারেন।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত