Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com, hades-and-persephone-how-seasons-came

ইরাবতী লোকসংস্কৃতি: পৃথিবীতে যেভাবে ঋতু এল

Reading Time: 5 minutes

তখন টাইটানদের যুগ চলছে। গ্রিক পুরাণের স্বর্ণযুগ। তখন মানুষ অন্যায় করতে জানত না। ক্রোনাস তখনকার রাজা। ক্রোনাস তার বাবা ইউরেনাসকে উচ্ছেদ করে পুরো জগতে চালাচ্ছে একক আধিপত্য। ইউরেনাস ক্রোনাসকে বলে গেছেন, “ইতিহাস নিজে থেকেই ফিরে আসে ক্রোনাস। তুমি আমার সাথে যা করেছ, সেই একই কাজ তোমার সাথে তোমার সন্তান করবে।”

সাবধানী ক্রোনাসের স্ত্রী রিয়া। দুজনের যত সন্তান হয়, বিদ্রোহ এড়াতে সবাইকে খেয়ে ফেলেন ক্রোনাস। রিয়া দেখল তার একটা সন্তানও বাঁচছে না। শেষের সন্তানকে বাঁচাতে তাকে সিন্দুকে ভরে পাহাড়ের গুহায় রেখে এল। ক্রোনাসের হাতে কাপড়ে জড়ানো পাথরের টুকরো তুলে দিল। সেই সন্তান জিউস। জিউস বড় হয়ে ক্রোনাসের সাথে যুদ্ধ করে তার পেট ফালি ফালি করে দেয়। ক্রোনাসের পেট চিরে বের হয়ে আসে জিউসের সব ভাইবোন। টাইট্যানদের হারিয়ে জগতের দখল নেয় জিউস আর তার বাহিনী।

এই সময়ের যোদ্ধারা পরবর্তী প্রজন্মের দেবতা। জিউস স্বর্গের রাজা, দেবাধিদেব। পসেইডন রাজত্ব করেন সাগরে। হেডিসের আধিপত্য পাতালে। গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী মৃত্যুর পর আত্মা চলে যায় পাতালে। হেডিসের কাজকর্ম মৃতদের আত্মাদের নিয়ে। তিনমাথাওয়ালা কুকুর সারবেরাসকে নিয়ে বেশিরভাগ সময় তাকে দেখা যায় ভাস্কর্যে। জাগতিক চমকের থেকে পাতালপুরীর অন্ধকারই তাকে বেশি টানে। তাই খুব একটা মর্ত্যে আসেন না হেডিস।

এদিকে পার্সিফোনি হলেন বসন্তের দেবী। জিউস আর দিমিতারের কন্যা। বাবা দেবতাদের রাজা, মাও কম যান না। তিনি আর সব গুরুত্বপূর্ণ দেবতাদের সাথে অলিম্পাসে থাকেন। পৃথিবীতে ফসল ফলানোর দায়িত্ব তার। তার জীবনের একমাত্র ভালোবাসা তার মেয়ে, পার্সিফোনি।

গ্রিক পুরাণে পৃথিবীর সব ঘটনার পৌরাণিক ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। পৃথিবীতে ঋতু আসার যে গল্প, তার সাথে জড়িয়ে আছেন হেডিস ও পার্সিফোনি।

একদিন জিউস ঠিক করলেন হেডিসের সাথে পার্সিফোনির বিয়ে দিলে মন্দ হয় না। তবে তা ভুলেও বললেন না দিমিতারকে। পার্সিফোনি তাকে ছেড়ে পাতালে গিয়ে বসবাস করবে, একথা দুঃস্বপ্নেও হয়তো ভাবতে চাইবেন না দিমিতার। কিছু গল্প অনুযায়ী জিউস হেডিসকে বলেছিল তার মেয়েকে বিয়ে করার কথা। আবার কিছু গল্পে জিউস কিউপিডকে পাঠায় হেডিসের কাছে।

মর্ত্যের সকাল এত সুন্দর এই নারীর কারণে; image source: MrPsMythopedia

সাধারণ নিয়মের বাইরে কোনো একদিন সকালে হেডিস মর্ত্যে উঠে এসেছিলেন। চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে বনে গিয়ে দেখলেন এক নারীকে। তিনি ভাবলেন মর্ত্যের সকাল এত সুন্দর এই নারীর কারণে। মাথা নিচু করে সে ডালাতে ফুল তুলছে। সাথে আছে বনের পরীরা। হেডিস ভেবে পেলেন না এই মেয়ে কেন ফুল তুলছে। সে কি জানে না, যে এই ফুলের স্নিগ্ধতা তার স্নিগ্ধতার অংশমাত্র? নাকি মাথায় ফুল গুঁজে সে এই ফুলের জীবন ধন্য করতে চায়?

হেডিস দেখল পড়ে থাকা কিছু ফুল, সে নিজেকে ওইসব ফুলের সাথে তুলনা করল, যারা এই নারীর হাতের ছোঁয়া পায়নি। কী হবে তার এই দেবত্ব দিয়ে, তার পাতাললোকের রাজত্ব দিয়ে যদি এই নারীকে না পায়? সম্মোহিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল হেডিস। পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেল নারী। হেডিস খোঁজ নিয়ে জানলেন এই নারীই জিউসের মেয়ে পার্সিফোনি। কিন্তু তার মা দিমিতার কোনোদিন এই বিয়ে মানবে না। পাতাললোকে ফিরে গেলেন হেডিস। দিনরাত চুপ করে থাকত। কিছুই ভালো লাগছিল না তার। শেষে স্থির করল, এই নারীকে তার জয় করতেই হবে, সে যত বাধাই আসুক না কেন।

কিছুই ভালো লাগছিল না হেডিসের; image source: MTM

সেদিনও ফুল তুলছিল পার্সিফোনি। পাতালের রাজা হেডিস কালো রঙের ঘোড়ায় টানা রথে ঝড়ের বেগে মর্ত্যে এলেন। মাটি ফুঁড়ে যখন তার রথ বের হচ্ছিল পার্সিফোনি বিস্ময় নিয়ে চেয়ে ছিল। তার বিস্ময় ভয়ে পরিবর্তন হতে সময় নিল না। এক হাতে রথের ঘোড়াদের লাগাম টেনে অন্য হাতে পার্সিফোনিকে কাঁধে উঠিয়ে নিলেন। ভয়ে চিৎকার করে উঠল সে। তার চিৎকার দেবরাজ জিউস, জাদুবিদ্যার দেবী হেকেটি, সূর্যের দেবতা হেলিওস আর মা দিমিতার শুনতে পেয়েছিল। দিমিতার এত দূরে ছিল যে তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব ছিল না। জিউস তো মনে মনে খুশিই হলেন। এটাই তিনি চাইছিলেন। হেকেটি শুনতে পেলেও দেখতে পায়নি কিছু। হেলিওস যেহেতু আকাশে ছিলেন তিনি দেখলেন সব।

পার্সিফোনিকে নিয়ে পাতালের পথে চলছেন হেডিস; image source: Pinterest

দিমিতারের মন দুঃখে ছেয়ে গেল। হাতে মশাল নিয়ে পৃথিবীর প্রতিটি কোনা খুঁজে দেখলেন তিনি। জিউস সব না জানার ভান করে পড়ে আছেন। কোথাও মেয়ের খোঁজ পাচ্ছিলেন না। বার বার মনে পড়ছিল সেই চিৎকার। না জানি কী হয়েছে পার্সিফোনির। আর তার পরেই পৃথিবী থেকে তার সব অস্তিত্ব একেবারে মিটে গেছে। যেন কখনো কেউ ছিলই না পার্সিফোনি নামে। তার এই কষ্ট দেখে এগিয়ে এল হেকেটি। বলল, সেও শুনেছিল পার্সিফোনির চিৎকার। কিন্তু দেখতে পায়নি কী হয়েছে। সে দিমিতারকে বুদ্ধি দিল হেলিওসের কাছে যেতে।

দিমিতার হেলিওসকে অনুরোধ করতেই সে সব খুলে বলল। কীভাবে জিউস চেয়েছিল তার মেয়ের বিয়ে হোক, আর হেডিস হঠাৎ এসে যেমন অপহরণ করে নিয়ে গেছে পার্সিফোনিকে। কিন্তু হেলিওস দিমিতারকে বলল, পার্সিফোনিকে হেডিস সত্যিই ভালোবাসে। পার্সিফোনিকে সে সুখেই রাখবে। তার উপর হেডিস অন্যতম ক্ষমতাধর দেবতা। এমন স্বামী পার্সিফোনি পাবে না। কিন্তু হেডিসের স্তুতিবাক্যে মন গলল না দিমিতারের ।

ডিমেটারের মন দুঃখে ছেয়ে গেল; image source: Greek Mythology Pantheon

তার অগোচরে যে ষড়যন্ত্র হয়েছে এর জন্য তিনি ক্ষমা করতে পারবেন না কাউকে। প্রাণের প্রিয় পার্সিফোনিকে না জানি কত যন্ত্রণায় রেখেছে পাতালের বর্বরটা। পাতালের কালি ময়লায় না জানি কত কষ্টে কাটছে তার মেয়ের জীবন। এর চেয়ে পার্সিফোনির মারা যাওয়ার সংবাদও ভাল ছিল। আগের চেয়েও বেশি ভেঙে পড়লেন তিনি। প্রতিজ্ঞা করলেন যতদিন পর্যন্ত পার্সিফোনি ফিরে না আসছে তিনি অলিম্পাস পর্বতে পা রাখবেন না, পৃথিবীতে জন্মাতে দেবেন না এক দানা শস্যও। শুরু হল দুর্ভিক্ষ। প্রাণীরা না খেয়ে মরতে লাগল। জিউস দেখলেন এবার প্রাণপ্রকৃতি উচ্ছন্নে যাবে। দিমিতারকে তিনি অনেক বোঝাতে চেষ্টা করলেন, লাভ হল না। না পেরে বার্তার দেবতা হার্মিসকে তিনি পাঠালেন হেডিসের কাছে।

পাতালে তখন বসন্তের দেবীর বসন্ত চলছে; image source: Pinterest

অন্যদিকে পাতালে কিন্তু তখন বসন্তের দেবীর বসন্ত চলছে। পাতালে আসার পর কিছুতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না পার্সিফোনি। পুরো সময়টা তাকে সাহায্য করেছিলেন হেডিস। হেডিস আসলেই পার্সিফোনিকে ভালোবেসেছিলেন। পাতালে নিয়ে এসে তাকে যত্নে রেখেছিলেন। কখনো অসম্মান করেননি। অতঃপর পার্সিফোনি হার মানলেন হেডিসের তুমুল ভালোবাসার কাছে। তিনিও তখন আর হেডিসকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারেন না। হোমার তাকে পাতালের রাজকন্যা বলে আখ্যায়িত করেছেন। পাতালের সুখ দুঃখ, অভিশাপ সব বয়ে আনতেন পার্সিফোনি।

দুজনের সংসার ভালোই চলছিল। এমন একদিন হার্মিস বার্তা নিয়ে হাজির হলেন। সব খুলে বললেন। জানালেন দেবরাজের আদেশের কথা। পার্সিফোনিকে ফেরত পাঠাতে হবে দিমিতারের কাছে। ভেঙে পড়লেন হেডিস। কিন্তু দেবরাজের আদেশ অমান্য করার মতো সাহস তার নেই। স্বামীর মতো কষ্ট পার্সিফোনিও পাচ্ছিল। স্বামীর হাতে নিজের চিহ্ন বেদানা তুলে দিল। বেদানা বা আনার তুলে দিয়ে গ্রিক পুরাণে প্রতিজ্ঞা করা হয়। কথা দিল, সে ফিরে আসবে।

“কথা দিলাম ফিরে আসব”; image source: Puistopulu-DeviantaARt

জিউস পড়েছিলেন উভয় সংকটে। একদিকে দিমিতারের ক্রোধ, অন্যদিকে বিরহকাতর হেডিস-পার্সিফোনি। দিমিতার তো কিছুতেই পার্সিফোনিকে কাছছাড়া করবেন না। পার্সিফোনির ভালোবাসাকে তিনি হেডিসের কালোজাদু ভাবলেন। জিউস তার মা রিয়াকে পাঠালেন দিমিতারের কাছে, যদি কিছু হয়। রিয়া দিমিতারকে বুঝিয়ে শুনিয়ে চুক্তিতে আনল। বছরের একটা অংশ পার্সিফোনি পাতালে থাকবে, আর একটা অংশ থাকবে তার কাছে। দিমিতার শর্তে রাজি হলেও বলে গেলেন, যতদিন পার্সিফোনি পাতালে থাকবে পৃথিবীতে ফসল জন্মাতে দেবেন না তিনি।

তারপর থেকে বছরে ছয়মাস পার্সিফোনি মায়ের কাছে থাকে। তখন পৃথিবীতে চলে উষ্ণতা। ফুল হয়, ফসল হয়। যখন সে পাতালে স্বামীর কাছে যায়, ডিমেটারের দুঃখে পৃথিবী শীতল থেকে শীতলতর হয়ে ওঠে। গ্রিক পুরাণে পৃথিবীর ঋতুর রহস্যকে এভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়।

ফিচার ইমেজ- Pinterest

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত