Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

কন্যাদিবস ও চিরন্তন ভাবনা

Reading Time: 3 minutes

ফেসবুক জুড়ে কন্যাশিশু দিবসের পোস্ট। কন্যা শিশু, কন্যা কিশোর, কন্যা যুবক আর কন্যা বৃদ্ধ, যেকোন বয়সের কন্যার জন্য আমাদের এই পৃথিবী, বিশেষ করে আমাদের এই দেশ যে কতটা অনিরাপদ, কতটা ভীতিকর তা প্রত্যেকটি কন্যার মা বাবা মাত্রই অনুভব করতে পারেন। ছোটবেলায় গ্রামের স্কুলের পথে আমরা মেয়েরা দলবেঁধে যেতাম-আসতাম। অনেকেই বলবে, তখন ভয়ের কিছু ছিলো না। কিন্তু, ওই যে শীতকালে, ক্ষেতের পাট যখন একটু বড় হতে শুরু করেছে, আমরা কেউ আর এই ক্ষেতের আল দিয়ে স্কুলে না যেয়ে বড় রাস্তা ঘুরে যেতাম। কোন এক অদৃশ্য শক্তির ছোবলের ভয় তাড়া করতো একা ক্ষেতের মধ্য দিয়ে আসতে হলে, তখন তা না বুঝলেও ওই শিশুমনও কেঁপে উঠতো অজানা শংকায়। প্রায়ই মাঝরাতের দরবার আর বিচারের কানাঘুষা শোনা যেত। অবৈধ শিশুকে লবন খাইয়ে মেরে ফেলার কথা শোনা যেত বড়ই চুপিসারে।

 

মেয়েদের দোষ যুগে যুগে স্বীকৃত। কাউকেই তখনও দেখিনি ভুলেও ছেলেটির নাম নিয়েছে, বা দোষ বিচার করেছে। মেয়ের বাপ মায়ের কপাল চাপড়ানো দেখেছি। ছেলের বাপমায়ের লজ্জা চোখে পড়েনি কখনোই। উল্টে বিচার হিসেবে মেয়েটিকে ঘরবন্দি হতে হয়। নিউমার্কেটে বা গাউছিয়ায় গিয়ে কোন মেয়ের শরীরের বিশেষ অংশে পুরুষের উদ্দ্যেশ্যপ্রণোদিত হাত পড়েনি, এটা বোধহয় কেউই গর্ব করে বলতে পারবে না। অথচ, এর জন্য কোন ছেলেকে লজ্জা পেতে দেখিনি কোনদিন। মেয়েরা তারপরও এগিয়ে গিয়েছে, নিজের বহুমুখী বিস্তার ঘটিয়েছে। কিন্তু, যে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পাহাড় ডিঙিয়ে তাকে পথ চলার রাস্তা করতে হয়, সেই রাস্তা তো মসৃণ হয়ই নি, তদুপরি, সেখানে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে ধর্ষনের নানা কুশ্রী রূপ আর সাথে খুন। জীবন দেয় যে মেয়েটি সে তো বেঁচে যায়। যে বেঁচে থাকে এরপরও, তাকে প্রতি মুহুর্তে চারপাশের মানুষ এবং আত্মীয়দের থেকে যে আচরণ সহ্য করতে হয় তা তাকে মৃত্যুর যাতনা অনুভব করায় ক্ষণে ক্ষণে।

 

আমার পরিচিত একজন পূর্বে ধর্ষিত হওয়ার কথা তার রুমমেটদের কাছে প্রকাশ হওয়ায়, হলে তার রুমমেটরা তার সাথে থাকতে অস্বীকৃতি জানায়। তাদের নাকি ওর সাথে থাকলে নামাজ হবে না, পুজা ধুপ ধুনো শুদ্ধ হবে না। হাউজ টিউটর অফিস বাধ্য হয়ে তাকে অন্য রুমে বদলি করে। কেউ কিন্তু একবারের জন্যও মেয়েটির মনোজগত বুঝতে চায়নি বরং, প্রকাশ্যে, অপ্রকাশ্যে ওর আচরনিক নানা ত্রুটি খোঁজাই মূল লক্ষ্য ছিল।

সময় গড়িয়েছে। মানব উন্নয়ন সুচকে আমাদের দেশ অনেক এগিয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। গার্মেন্টস সেক্টরসহ অনেক পেশায় নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে অভূতপুর্ব অগ্রগতি হয়েছে। মানুষের সচেতনতা বেড়েছে, তথ্য প্রযুক্তির প্রসার ও এখানে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু, নারীকে নিয়ে মানুষের ভাবনার জগত পাল্টায়নি। সচেতনতার নামে নারীকেই ঘরে থাকার, লুকিয়ে থাকার, ঢেকে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়। অথচ, এর পেছনের কারন কেউ ব্যাখ্যা করতে চায় না। নিজের কুরুচিপূর্ণ ছেলেটির জন্য পাশের বাড়ির মেয়েটিকে ঘরবন্দী থাকতে হয়। এই হচ্ছে আমাদের সমাজ। রুচি বিকৃতি এমন গেছে যে এখন নিজের মেয়েটিকে নিজের ঘর ছাড়া আর কোথও নিরাপদবোধ হয় না।

এভাবে আর কতদিন? বিচারহীন বিচার, রাজনৈতিক ছত্রছায়া, অর্থনৈতিক প্রভাব আর পেশিশক্তির আশীর্বাদে এই ধর্ষক পুরুষ আরো শক্তিশালী হয়। শান দেয় নিজের পুরুষাঙ্গে। তুমুল বেগে এগিয়ে আসে নতুন উৎসাহ নিয়ে। সাভারের ঘটনাটি বা সিলেট, কুমিল্লা যেখানেই যাই না কেন, পুরুষটি তার পুরুষ প্রভাব প্রকাশের উত্তুঙ্গু আগ্রহ এবং উক্ত শক্তির প্রভাব বলয়ই তাকে এই জঘন্য পন্থায়, অতি জঘন্য কাজটি করতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

আজ সাভার, তো কাল সিলেট। পরশু, কুমিল্লা। তারপর দিন… অন্য কোথাও। দিন যায়, বছর যায়, যুগ যায়, শতাব্দী যায়। নারীর উপর পুরুষের এই নির্যাতন শেষ হয় না। ধর্ষন তার রূপ পাল্টেছে। একের সাথে যোগ হয়েছে গণ, বিশ্রি তার প্রকাশ, ভিডিও ধারণ, ব্ল্যাকমেল, খুন, হত্যা ইত্যাদি।

শুধু নারীর অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় না। সেই অপেক্ষা, যেদিন বুকের ভিতর ধিকি ধিকি করে জ্বলতে থাকা আগুনের স্ফুলিঙ্গ হঠাৎ রেগে জ্বালিয়ে দেবে চারিদিক, কেঁপে উঠবে গোটা পুরুষ সমাজ, মাথা নুইয়ে ক্ষমা চাইবে। আর ছোট্ট মেয়ে শিশুটিকে আর অনিশ্চিত আশংকায় দিন গুণতে হবে না। ভীষন স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে। আলোর মিছিলে সামিল হতে ইচ্ছে করে। মেয়েদের একটি মসৃণ জীবন দিতে ইচ্ছে করে। সকল কন্যাশিশুর সুন্দর নিরাপদ জীবন প্রার্থনা করি। কন্যাশিশুর ইচ্ছা আর স্বপ্নের সদর্প বিচরন প্রত্যাশা করি। সেদিন কবে আসবে জানি না।

অপেক্ষার রাত ক্রমশ দীর্ঘতর হচ্ছে…।

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>