কথায় বলে— কালি কলম মন, লেখে তিন জন । কিন্তু কলম কোথায় ? আমি যেখানে কাজ করি সেটা লেখালেখির আপিস । সবাই এখানে লেখক । কিন্তু আমি ছাড়া আর কারও হাতে কলম নেই । সকলের সামনেই চৌকো আয়নার মতো একটা কাচের স্ক্রিন বা পরদা । আর তার নীচে টাইপরাইটারদের মতো একটা কি-বোর্ড । প্রতিটি বোতামে ছাপা রয়েছে একটি করে হরফ । লেখকরা অনবরত তা দিয়ে লিখে চলেছেন, মাঝে মাঝে লেখা থামিয়ে তাকাচ্ছেন সেই পরদার দিকে । যা ইতিমধ্যে লেখা হয়েছে তা-ই ফুটে উঠেছে পরদায় । আমি যা লিখি ওঁরা ভালোবেসে আমার লেখাকেও এভাবে ছাপার জন্য তৈরি করে দেন । একদিন যদি কোনও কারণে কলম নিয়ে যেতে ভুলে যাই তবেই বিপদ । —কলম ! কারও সঙ্গে কলম নেই । যদি বা কারও কাছে গলা-শুকনো ভোঁতা-মুখ একখানা জোটে, তবে তাতে লিখে আমার সুখ নেই । দায়সারা ভাবে কোনও মতে সেদিনকার মতো কাজ সারতে হয় । অথচ আমাদের আপিস, সবাই বলেন, লেখালেখির অফিস । লেখকের কারখানা । বাংলায় একটা কথা চালু ছিল, ‘কালি নেই, কলম নেই, বলে আমি মুনশি’ । কালগুণে বুঝিবা আজ আমরাও তা-ই ।
আমি গ্রামের ছেলে । পঞ্চাশ ষাট বছর আগে আমার মতো যাঁরা বাংলার অজ-পাড়া-গাঁয়ে জন্মেছেন তাঁরা হয়তো বুঝবেন কলমের সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক । আমরা কলম তৈরি করতাম রোগা বাঁশের কঞ্চি কেটে । মুশকিল হতো কলমের মুখটি চিরে দেওয়ার সময় । বড়োরা শিখিয়ে দিয়েছিলেন, কলম শুধু সুঁচলো হলে চলবে না, কালি যাতে এক সঙ্গে গড়িয়ে না-পড়ে তার জন্য মুখটা চিরে দেওয়া চাই । তবে কালি পড়বে ধীরে ধীরে চুইয়ে । কোথায় পড়বে ? না, লেখার পাতে । লেখার পাত বলতে শৈশবে আমাদের ছিল কলাপাতা । তাই কেটে কাগজের মতো সাইজ করে নিয়ে আমরা তাতে ‘হোম-টাস্ক’ করতাম । আর সেগুলি বান্ডিল করে নিয়ে যেতাম স্কুলে । মাস্টারমশাই দেখে বুঝে আড়াআড়ি ভাবে একটা টানে তা ছিঁড়ে ফেরত দিতেন পড়ুয়াদের । আমরা ফেরার পথে কোনও পুকুরে তা ফেলে দিয়ে আসতাম । বাইরে ফেললে গোরু খেয়ে নিলে অমঙ্গল । অক্ষরজ্ঞানহীনকে লোকে বলে, ওর কাছে ক’অক্ষর গোমাংস । গোরুকে অক্ষর খাওয়ানোও নাকি পাপ ।
আমরা কালিও তৈরি করতাম নিজেরাই । অবশ্য মা পিসি দিদিরাও সাহায্য করতেন । প্রাচীনেরা বলতেন— ‘তিল ত্রিফলা শিমুল ছালা /ছাগ দুগ্ধে করি মেলা /লৌহপাত্রে লোহায় ঘসি / ছিঁড়ে পত্র না ছাড়ে মসি ।’ ভালো কালি তৈরি করতে হলে এই ছিল তাঁদের ব্যবস্থাপত্র । আমরা এত কিছু আয়োজন কোথায় পাব । আমাদের ছিল সহজ কালি তৈরি পদ্ধতি । বাড়ির রান্না হতো কাঠের উনুনে । তাতে কড়াইয়ের তলায় বেশ কালি জমত । লাউপাতা দিয়ে তা ঘষে তুলে একটা পাথরের বাটিতে রাখা জলে তা গুলে নিতে হতো । আমাদের মধ্যে যারা ওস্তাদ তারা ওই কালো জলে হরতুকী ঘষত । কখনও কখনও মাকে দিয়ে আতপ চাল ভেজে পুড়িয়ে তা বেটে ওতে মিশাত । সব ভালো করে মেশাবার পর একটা খুন্তির গোড়ার দিকটা পুড়িয়ে লাল টকটক করে সেই জলে ছ্যাঁকা দেওয়া হতো । অল্প জল তো, তাই অনেক সময় টগবগ করে ফুটত । তারপর ন্যাকড়ায় ছেঁকে দোয়াতে ঢেলে কালি । দোয়াত মানে মাটির দোয়াত । বাঁশের কলম, মাটির দোয়াত, ঘরে তৈরি কালি আর কলাপাতা, বলতে গেলে তাই নিয়ে আমাদের প্রথম লেখালিখি । এত বছর পরে সেই কলম যখন হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম, তখন মনে কষ্ট হয় বইকী !
ভাবি, আচ্ছা, আমি যদি জিশু খ্রিস্টের আগে জন্মাতাম ! যদি ভারতে জন্ম না হয়ে আমার জন্ম হত প্রাচীন মিশরে ? আমি যদি বাঙালি না হয়ে হতাম প্রাচীন সুমেরিয়ান বা ফিনিসিয়ান ? তবে হয়তো নীল নদীর তীর থেকে একটা নল-খাগড়া ভেঙে নিয়ে আসতাম, সেটিকে ভোঁতা করে তুলি বানিয়ে লিখতাম । হয়তো সূঁচালো করে কলম বানাতাম । হয়তো ফিনিসীয় আমি, বনপ্রান্ত থেকে কুড়িয়ে নিতাম একটা হাড়— সেই আমার কলম । এমনকী আমি যদি রোম সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হতাম, আমি যদি হতাম স্বয়ং জুলিয়াস সিজার, তা হলেও আমার শ্রেষ্ঠ কারিগররা বড়োজোর একটা ব্রোঞ্জের শলাকা, যার পোশাকি নাম স্টাইলাস, তুলে দিত আমার হাতে, তার বেশি কিছু নয় । সিজার যে কলমটি দিয়ে কাসকাকে আঘাত করেছিলেন সেটি কিন্তু এই স্টাইলাস বা ব্রোঞ্জের ধারালো শলাকা । কলম সেদিন খুনিও হতে পারে বইকী । চিনারা অবশ্য চিরকালই লিখে আসছে তুলিতে । তাদের বাদ দিলে এই সেদিন পর্যন্ত বিশ্বের জ্ঞানাঞ্জন-শলাকা ছিল সর্বার্থেই শলাকা । তা বাঁশের হোক, নল-খাগড়ার হোক, পাখির পালক আর ব্রোঞ্জেরই হোক ।
এখন স্কুলের ছেলেমেয়ের তহবিলেও হয়তো দেখা যায় রকমারি কলম । হয়তো গ্রামাঞ্চলেও আজ বাঁশের কঞ্চির কলম আর খুঁজে পাওয়া যাবে না । খাগের কলম দেখা যায় একমাত্র সরস্বতী পুজোর সময় । কাচের দোয়াতে কালির বদলে দুধ । ফাউন্টেন পেন বা বলপেনের বদলে খাগের কলম । পালকের কলমও আর চোখে পড়ে না । তার ইংরেজি নাম ‘কুইল’ । লর্ড কার্জন বাঙালি সাংবাদিকদের গরম গরম ইংরেজি দেখে তাঁদের বলতেন— ‘বাবু কুইল ড্রাইভারস’ । এখন পালকের কলম দেখতে হলে পুরানো দিনের তৈলচিত্র কিংবা ফটোগ্রাফ ছাড়া গতি নেই ।
উইলিয়াম জোন্স কিংবা কেরি সাহেবের স-মুনশি ছবিতে দেখা যায় সামনে তাঁদের দোয়াতে গোঁজা পালকের কলম । এই পালক কেটে কলম তৈরির জন্য সাহেবরা ছোট্ট একটা যন্ত্রও বের করেছিলেন । যন্ত্রটা এক ধরনের পেনসিল সার্পনারের মতো । তাতেও রয়েছে ধারালো ব্লেড । পালক ঢুকিয়ে চাপ দিলেই ব্যস, তৈরি হয়ে গেল কলম ।
পালকের কলম তো দূরস্থান, দোয়াত কলম বা আজ কোথায় ! কোনও কোনও আপিসে দেখা যায় টেবিলের উপর সাজানো রয়েছে দোয়াত কলম । কিন্তু সে সব ফাঁকি মাত্র । ওই কলম দুটি আসলে ছদ্মবেশী বল-পেন মাত্র । তাকে আবার কেউ কেউ বলেন ডট-পেন । কিছুকাল আগে একজন বিদেশি সাংবাদিক লিখেছিলেন কলকাতার চৌরঙ্গির পথে গিজগিজ করছে ফেরিওয়ালা । তাদের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনের পেশা কলম বিক্রি । এক হাতে দশ কলমধারী ফেরিওয়ালা কিন্তু এখনও দেখা যায় । শস্তার চূড়ান্ত । ফলে প্রত্যেকের পকেটে কলম । শুধু কি পকেটে ? পণ্ডিত মশাইয়ের কলম খ্যাত ছিল কানে গুঁজে রাখার জন্য । দার্শনিক তাঁকেই বলি— যিনি কানে কলম গুঁজে দুনিয়া খোঁজেন ।
ছেলেবেলায় একজন দারোগাবাবুকে দেখেছিলাম যাঁর কলম ছিল পায়ের মোজায় গোঁজা । আজকাল কোনও কোনও অতি-আধুনিক ছেলেকে দেখি যাদের কলম বুক-পকেটে নয়, কাঁধের ছোট্ট পকেটে সাজানো । কেউ কেউ অবশ্য চুলেও কলম ধারণ করেন । সেটা অবশ্য ইচ্ছাকৃত নয়, ভিড়ের ট্রামে বাসে যাতায়াতের ফল । মহিলা যাত্রী ট্রাম থেকে নামছেন, কে একজন চেঁচিয়ে উঠল,— ও দিদি, আপনার খোঁপায় কলম ।
বিস্ফোরণ । কলম বিস্ফোরণ । এক সময় বলা হতো— ‘কলম কায়স্থ চিনি, গোঁফেতে রাজপূত ।’ এখন কলম বা গোঁফ, কোনও কিছুই আর বিশেষ কারও নয় । ‘কালির অক্ষর নাইকো পেটে, চন্ডী পড়েন কালীঘাটে ।’ এখনকার পেটে কত অক্ষর তা নিয়ে যাঁদের ভাবনা তাঁরা ভাবুন । আমরা শুধু জানি দেশে সবাই স্বাক্ষর না হলেও, কলম এখন সর্বজনীন । সত্যি বলতে কী, কলম এখন এতই শস্তা এবং এতই সর্বভোগ্য হয়ে গেছে যে, পকেটমাররাও এখন আর কলম নিয়ে হাতসাফাইয়ের খেলা দেখায় না । কলম তাদের কাছে আজ অস্পৃশ্য ।
পণ্ডিতরা বলেন কলমের দুনিয়ায় যা সত্যিকারের বিপ্লব ঘটায় তা ফাউন্টেন পেন । এক কালে বাংলায় তাকে বলা হতো ঝরনা কলম । নামটা রবীন্দ্রনাথের দেওয়াও হতে পারে ।
একদিন অফুরন্ত এই কালির ফোয়ারা যিনি খুলে দিয়েছিলেন তার নাম—লুইস অ্যাডসন ওয়াটারম্যান । সেকালের আরও অনেক ব্যবসায়ীর মতো তিনি দোয়াত কলম নিয়ে কাজে বের হতেল । একবার গিয়েছেন আর একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে চুক্তিপত্র সই করতে । দলিল কিছুটা লেখা হয়েছে এমন সময় দোয়াত হঠাৎ উপুড় হয়ে পড়ে গেল কাগজে । আবার তিনি ছুটলেন কালির সন্ধানে । ফিরে এসে শোনেন, ইতিমধ্যে আর একজন তৎপর ব্যবসায়ী সইসাবুদ সাঙ্গ করে চুক্তিপত্র পাকা করে চলে গেছেন । বিমর্ষ ওয়াটারম্যান মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন— আর নয়, এর একটা বিহিত তাঁকে করতেই হবে । জন্ম নিল ফাউন্টেন পেন ।
আমার মনে পড়ে প্রথম ফাউন্টেন কেনার কথা । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বেশ কয়েক বছর পরের ঘটনা । কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের একটা নামী দোকানে গিয়েছি একটা ফাউন্টেন পেন কিনব বলে । দোকানি জানতে চান, কী কলম । বাস, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম । তিনি আউড়ে চলেছেন,— পার্কার ? শেফার্ড ? ওয়াটারম্যান ? সোয়ান ? পাইলট ? কোনটার কী দাম সঙ্গে সঙ্গে তা-ও তিনি মুখস্ত বলতে লাগলেন । আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন আমার পকেটের অবস্থা । —তবে হ্যাঁ, শস্তার একটা পাইলট নিয়ে যাও । জাপানি কলম । কিন্তু দারুণ । বলেই মুখ থেকে খাপটা সরিয়ে ধাঁ করে কলমটা ছুড়ে দিলেন টেবিলের এক পাশে দাঁড়-করানো একটা কাঠের বেডের উপর । সার্কাসে খেলোয়াড় যেমন একজন জ্যান্ত মানুষকে বোর্ডের গায়ে দাঁড় করিয়ে ধারালো ছুরি ছুড়ে দেয় তার দিকে, ভঙ্গিটি ঠিক সে-রকম । সার্কাসের খেলায় লোকটি শেষ পর্যন্ত অক্ষত থাকে । আমাকে অবাক করে তিনি কলমটি বোর্ড থেকে খুলে নিয়ে দেখালেন,— এই দেখো । নিব ঠিক আছে । দু’এক ছত্র লিখে দেখিয়ে দিলেন । আমি সেদিন সেই জাদু-পাইলট নিয়েই ঘরে ফিরেছিলাম । পরে নামী দামি আরও নানা নামের নানা জাতের ফাউন্টেন পেন হাতে এসেছে । কিন্তু অনেক দিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছিলাম সেই জাপানি পাইলটকে । ফাউন্টেন পেনের এক বিপদ, তা লেখককে নেশাগ্রস্ত করে । অবশ্য যদি পয়সাওয়ালা লেখক হন । বিখ্যাত লেখক শৈলজানন্দ একবার আমাকে দেখিয়েছিলেন তাঁর ফাউন্টেন সংগ্রহ । —ডজন-দু’য়েক তো হবেই । পার্কারই ছিল বেশ কয়েক রকম । শৈলজানন্দ বলেছিলেন, এই নেশা পেয়েছি আমি শরৎদার কাছ থেকে । হ্যাঁ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় । তাঁরও ছিল ফাউন্টেন পেনের নেশা ।
আদিতে ফাউন্টেন পেনের নাম ছিল ‘রিজার্ভার পেন’ । ওয়াটারম্যান তাকেই অনেক উন্নত করে তৈরি করেছিলেন ফাউন্টেন পেন । আমাদের ঝরনা কলম । গাঁয়ের ছেলে আমি অবশ্য ফাউন্টেন পেন হাতে তুলে নিয়েছি অনেক পরে । আমি ছিলাম কালি কলমের ভক্ত । অর্থাৎ, দোয়াত আর নিবের কলমের । বাঁশের বা কঞ্চির কলমকে ছুটি দিই শহরে হাইস্কুলে ভর্তির পর । কালি বানানোও বন্ধ তখন । কাচের দোয়াতে আমরা কালি বানাতাম কালি ট্যাবলেট বা বড়ি-গুলি দিয়ে । লাল নীল দু’রকম বড়িই পাওয়া যেত । অবশ্য তৈরি কালিও পাওয়া যেত দোয়াতে এবং বোতলে । তাদের বাহারি সব নাম, কাজল কালি, সুলেখা ইত্যাদি । বিদেশি কালিও পাওয়া যেত । তবে তা প্রধানত ফাউন্টেন পেনের জন্য । নিব এবং হ্যান্ডেলও ছিল রকমারি । সুচালো মুখের নিবের মতো ছিল চওড়া মুখের নিব, যার যেমনটি চাই । হ্যাঁ, বিদেশে উন্নত ধরনের নিবও বের হয়ে ছিল একসময় । সে সব গোরুর শিং নয়তো কচ্ছপের খোল কেটে তৈরি । খুবই টেকসই । পালকের কলম বা তাড়াতাড়ি ভোঁতা হয়ে যায়, তাই এই ব্যবস্থা । কখনও বা শিংয়ের নিবের মুখে বসানো হতো হিরে । ফাউন্টেন পেনের প্লাটিনাম, সোনা— এসব দিয়ে মুড়ে তাকে আরও দামি, আরও পোক্ত করা হতো । এসব করে রকমারি চেহারার শস্তা দামি ফাউনটেন পেন বাজারে ছেড়ে ক্রমে হঠিয়ে দেওয়া হলো দোয়াত আর কলমকে । আমরা যখন কলেজে পড়ছি তখন বলতে গেলে সব পড়ুয়ার পকেটেই ফাউনটেন পেন । কঞ্চির কলম, খাগের কলম, পালকের কলম সব উধাও । সেই সঙ্গে শিক্ষিত ঘরে, কিংবা অফিসে আদালতে টেবিল থেকে উধাও জোড়া দোয়াত কলম— সেগুলো সাজিয়ে রাখার আসবাব । কালির আধার, ব্লটিং-পেপার সব । এক সময় লেখা শুকানো হতো বালি দিয়ে । পরে ব্লটিং পেপারে । সব মিলিয়ে লেখালিখি রীতিমতো ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান ।
দোয়াত যে কত রকমের হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত । কাচের, কাট-গ্লাসের, পোর্সেলিনের, শ্বেতপাথরের, জেডের, পিতলের, ব্রোঞ্জের, ভেড়ার শিংয়ের, এমনকী সোনারও । গ্রামে কেউ দু’একটা পাশ দিতে পারলে বুড়ো-বুড়িরা আশীর্বাদ করতেন— বেঁচে থাকো বাছা, তোমার সোনার দোয়াত কলম হোক । সোনার দোয়াত কলম যে সত্যিই হতো; তা জেনেছিলাম শুভো ঠাকুরের বিখ্যাত দোয়াত সংগ্রহ দেখতে গিয়ে । সাহিত্য এবং ইতিহাসের নানা চরিত্র পর্যন্ত যোগ করা ছিল কোনও কোনও দোয়াতে । অবাক হয়ে সেদিন মনে মনে ভাবছিলাম, এই সব দোয়াতের কালি দিয়েই না শেক্সপিয়ার, দান্তে, মিল্টন, কালিদাস, ভবভূতি, কাশীরাম দাস, কৃত্তিবাস থেকে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র সব অমর রচনা লিখে গেছেন । হায়, কোথায় গেল সে সব দিন । এখন ফাউন্টেন পেন ! ক্রমে তা-ও বুঝিবা যায় যায় । এখন বল-পেন বা ডট পেন । এক রোগা লিকলিকে রিফিলে কে কত দূর দৌড়াতে পারে তা নিয়ে তার গর্ব । ফাউন্টেন পেনও অবশ্য কম যায় না । একটা বিদেশি কাগজে ফাউন্টেনের বিজ্ঞাপনে দেখেছিলাম ওঁদের তহবিলে নাকি রয়েছে সাতশো রকম নিব । যাঁরা গান চর্চা করেন তাঁদের জন্য, যাঁরা শ্রুতিলেখক বা স্টেনোগ্রাফার তাঁদের জন্য, যাঁরা বাঁ হাতে লেখেন তাঁদের জন্য, এক কথায় সব ধরনের লেখকের জন্য আলাদা আলাদা নিব । যন্ত্রযুগ সকলের দাবি মেটাতেই তৈরি । হ্যাঁ, টাকার কুমিরদের খুশি করারও ব্যবস্থা তাঁদের হাতে । একটা কলমের দাম ধার্য হয়েছে আড়াই হাজার পাউন্ড (এক পাউন্ড সমান পঁচাত্তর টাকা, হিসাব করে দেখো কত টাকা !) সে কলমের সোনার অঙ্গ, হিরের হৃদয় । সোনায় গড়া হিরে বসানো জড়োয়া কলমের দাম তো হবেই । দামি বল পয়েন্টও আছে বটে ।
আশ্চর্য, সবই আজ অবলুপ্তির পথে । কমপিউটার তাদের জাদুঘরে পাঠাবে বলে যেন প্রতিজ্ঞা করেছে । ফলে আমার মতো আরও কেউ কেউ নিশ্চয় বিপন্ন বোধ করছেন । মানুষের হাত থেকে যদি কেড়ে নেওয়া হয় কলম, যদি হাতের লেখা মুছে যায় চিরকালের জন্য তবে কী আর রইল ? বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন ‘লাঠি তোমার দিন ফুরাইয়াছে’ । কলমের দিনও কি ফুরালো ? হতে পারে । কিন্তু ইতিহাসে ঠাঁই কিন্তু তার পাকা । যাঁরা ওস্তাদ কলমবাজ তাঁদের বলা হলো ‘ক্যালিগ্রাফিস্ট’ বা লিপি-কুশলী । মুঘল দরবারে একদিন তাঁদের কত না খাতির, কত না সম্মান ? শুধু মুঘল কেন, বিশ্বময় সব দরবারেই । আমাদের এই বাংলা-মুলুকেও রাজা জমিদাররা লিপি-কুশলীদের গুণী বলে সম্মান করতেন, তাঁদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতেন । সাধারণ গৃহস্থও লিপিকরদের ডেকে পুথি নকল করাতেন । এখনও পুথি দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায় । “সমানি সম শীর্ষাণি ঘনানি বিরলানি চ ।” সব অক্ষর সমান, প্রতিটি ছত্র সুশৃঙ্খল পরিচ্ছন্ন । এক এক জনের যাকে বলে— মুক্তোর মতো হস্তাক্ষর । অথচ কত সামান্যই না রোজগার করতে ওঁরা ।
চারখণ্ড রামায়ণ কপি করে একজন লেখক অষ্টাদশ শতকে পেয়েছিলেন নগদ সাত টাকা, কিছু কাপড় আর মিঠাই । এক সাহেব লিখে গেছেন উনিশ শতকে বারো আনায় বত্রিশ হাজার অক্ষর লেখানো যেত । তবু পুথির কত না মাহাত্ম্য । তাকে ঘিরে লিপিকরের কত না গর্ব । অনেক পুথিরই— খবরদার ! এ পুথি যেন কেউ চুরি করার চেষ্টা না করে ।
কলমকে বলা হয় তলোয়ারের চেয়েও শক্তিধর । ফাউন্টেন পেনও হয়তো আভাসে ইঙ্গিতে তা-ই বলতে চায় । কেননা, অনুষঙ্গ হিসাবে ‘ব্যারেল’ ‘কার্টিজ’ এসব শব্দ শোনা যায় । কিন্তু কদাচিৎ বারুদের গন্ধ কানে পৌঁছায় । অন্যদিকে ইতিহাসে কিন্তু অনেক পালকের কলমধারীকে সত্যিই কখনও কখনও তলোয়ার হাতে লড়াই করতে হয়েছে ক্রুর কিংবা মিথ্যাচারী প্রতিপক্ষের সঙ্গে । কলকাতার ইতিহাসেও এ ধরনের ‘ডুয়েল’ বা দ্বৈরথের কাহিনি রয়েছে । সুতরাং, যখন দেখি এত পরিবর্তনের মধ্যেও কেউ কলম আঁকড়ে পড়ে আছেন তখন বেশ ভালো লাগে । ভাবতে ভালো লাগে আমাদের কালের অধিকাংশ লেখকই এখনও কলমে লেখেন । অনেক ধরে ধরে টাইপ-রাইটারে লিখে গেছেন মাত্র একজন । তিনি অন্নদাশঙ্কর রায় । গত ক’বছর ধরে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও টাইপ-রাইটার ধরেছেন । অন্যরা প্রায় সবাই লিখছেন কলমে । অবশ্য ফাউন্টেন পেন কিংবা বল-পেনে । সম্ভবত শেষ পর্যন্ত নিবের কলমের মান মর্যাদা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন একমাত্র সত্যজিৎ রায় । তাঁর অনেক সুস্থ সুন্দর নেশার একটি ছিল লিপিশিল্প । তাঁর হাতের লেখার কুশলতার সঙ্গে অন্যান্য শিল্পকর্মের সম্পর্ক থাকা খুবই সম্ভব । কে না জানেন, রবীন্দ্রনাথ বেশি বয়সে যে চিত্রশিল্পী হিসাবে বিশ্বময় সম্মানিত হয়েছিলেন, তার সূচনা কিন্তু হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির পাতায় । অক্ষর কাটাকুটি করতে গিয়ে আনমনে রচিত হয়েছিল ছন্দোবদ্ধ সাদা-কালো ছবি । কমপিউটারও নাকি ছবি আঁকতে পারে । কিন্তু সে ছবি কতখানি যন্ত্রের, আর কতখানি শিল্পীর ?
আমি কালি-খেকো কলমের ভক্ত বটে, কিন্তু তাই বলে ফাউন্টেন পেন বা বল-পেনের সঙ্গে আমার কোনও বিবাদ নেই । কেননা, ইতিমধ্যেই বল-পেনের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছি আমি । মনে মনে সেই ফরাসি কবির মতো বলেছি— ‘তুমি সবল, আমি দুর্বল । তুমি সাহসী, আমি ভীরু । তবু যদি আমাকে হত্যা করতে চাও, আচ্ছা, তবে তা-ই হোক । ধরে নাও আমি মৃত ।’
হ্যাঁ, একবার অন্তত নিবের কলমকে দেখা গেছে খুনির ভূমিকায় । অসাধারণ লেখক, তোমার আমার সকলের প্রিয় ‘কঙ্কাবতী’ ‘ডমরুধর’ -এর স্বনামধন্য লেখক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় মারা গিয়েছিলেন নিজের হাতের কলম হঠাৎ অসাবধানতাবশত বুকে ফুটে গিয়ে । সেই আঘাতেরই পরিণতি নাকি তাঁর মৃত্যু ।
(সম্পাদিত)