অ্যাবোর্র্সন শেষে সারা শরীরে জ্বালা নিয়ে বারান্দায় রেলিং ধরে বিকেলের আকাশে চোখ রেখে ঝরে পড়া সময় গুনছে ইভা। এ সময়টাতে চাষ হতো কতো রং, সেই রঙের সুতায় সুতায় হেঁটে ছায়া সরাতে সরাতে এখন দাঁড়িয়ে আছে অ-রঙের মূর্তি নিয়ে। যে মূর্তি ঢেকেছে তার আসতে চাওয়া পূর্ণিমা। ফেসবুকে রিজভীর সাথে আলাপ হতো; আলাপে আলাপে জীবনের সংলাপ এতো সিনেম্যাটিক হবে বুঝতে পারি নাই। আমারে এহন দুবছরের আল্টিমেটাম নিয়া পানসে সময়রে তেল-নুন মাখায়ে গিলুন লাগতাছে। দুবছরের মইধ্যে সন্তান না নিলে আমি আর কখনোই মা হতে পারুম না। মা হবার সাধ ভুইলা পুতুল পাশে রাইখা বড়বেলায় এসে ছেলেবেলার সময় যাপন করন লাগবো। এ করাতে গিয়া আমি মারাও যাইতে পারতাম। যন্ত্র চাইপা আমায় চ্যাপ্টা বানাইছে। ব্রেস্ট থাইকা এহনো দুধ পড়ে। শরীরে ব্যথার স্টোর। গন্ধ হইয়া যাইতে পারত ভগাঙ্কুর। তবুও আমি এই কাজ কইরা তরে দায়মুক্ত করছি। শুয়োর, তুই একবার অ্যাবোর্র্সনে যাইতি, পরীক্ষার চিন্তা, মানুষের মুখ সামলানোর চিন্তা, জীবন পচনের চিন্তা লইয়া একদিন যদি কাটাইতি, তাইলে আজাইরা বকতি না।
নিকু আমার বাসায় এসেছিল, আমায় না পেয়ে তার কলেজ বান্ধবী ইভার সঙ্গে সময় কাটায়; শুনে তার গল্প। গল্প শুনতে শুনতে নিকু, ইভার মুখের দিকে তাকিয়ে তার শিরা-উপশিরা চেক করছিল; মনোযোগের স্তরখুলে খেয়ালে রাখে কষ্ট থেকে আসা কথাগুলো। ইভা বিরতি নিলে নিকু বলে তার গল্প। নিকুর গল্প ভিন্ন, সে ইভার মতো হিসাব কষতে রাজি নয়। সে অন্য টাইপের। সে কাউকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় না। না পাঠালে বন্ধু সংখ্যা বাড়ানোর জন্য টিকস খাটায়। দু-একদিন পরপর নতুন ছবি আপলোড করে। আর অন্যের স্টাটাসে লাইক কমেন্ট করার চেয়ে যে কমেন্ট করে সেখানে লাইক দেয়। কিছু কিসিম আছে তাতে খুশি হয়ে তাকে রিকোয়েস্ট পাঠায়। সে এ্যাকসেপ্ট করে যদি সে দেখতে হ্যান্ডসাম হয়; নইলে ফলোয়ার রাখে। নতুন বন্ধু হয়ে চ্যাটে হেই দিয়ে শুরু করে আর চ্যাট ছাড়তেই চায় না। নিকু : আমিও চালাই একবারে অইরকম আট দশটা পাগলার লগে গপ্প। গপ্পে গপ্পে দেখি আমার আজাইরা সময়গুলা ভালোই কাটে। আমার তো আর কোনো সমস্যা নাই। যখন ভালো লাগে না তখন ফেসবুকে বসি, চ্যাট লাইন অন থাকে, আর অরা বৈশাখের বাতাসের মতো হুমড়ি খায়া পড়ে। কেউ কেউ প্রেমের প্রস্তাব মারে, আবার কেউ কেউ বিয়া করবার চায়, আবার কেউ কেউ খালি কথা শুনবার চায়, আবার কেউ কেউ চ্যাটো সেক্স করবার চায়, কত কিসিম যে তখন জড়া হয়। খালি অগর আজাইরা আজাইরা কথা। এই সব শুনতে শুনতে লাইন কাইটা দেই, তখন বয় ফ্রেন্ডের লগে মজায় থাকি। যখন অয় কাম লয়া ব্যস্ত থাকে তখন আবার আয়া পড়ি ফেসবুকো, মন খুইল্যা, মাথার তার ঢিলা কইরা দিয়া চলে গপ্প, কেবল গপ্প। যখন যারে ভালো লাগে তার লগে টানা মাস খানেক ফেসবুক-ফোনবুকে ভালোই চলে, চালায়া যাই। আবার অরে ভালো লাগলো না আরেকটা আসে কয়দিন পর। এমনে চলতেই থাকে।
ইভা তার গল্প শুনতে শুনতে চলে যায় স্মৃতিতে। স্মৃতিতে স্মৃতিতে ফিরে জমে ওঠা সময়ে, যেখানে সে হাত ধরে হেঁটেছে রিজভীর সঙ্গে। যেদিন দেখা না হতো সেদিন ফেবুতেই হেঁটেছে কত সময়; বৃষ্টিতে ভিজেছে। রিজভি :
হাঁটতে ইচ্ছে করছে, হাঁটবে?
হুম, আসছি, হাত ধরো কিন্তু?
হাঁটতে হাঁটতে. গান গাবে, না কবিতা শোনাবে?
তোমার কথা শুনবো।
তোমার হাত এতো শক্ত কেন? আজ লোশন দাও নাই?
দিছি তো, আলতো করে ধরো।
আঙুলগুলো টিপে দিবে?
আহা এতো নড়ছো ক্যান?
আচ্ছা! একটু দাঁড়াবো?
হুম, আমার দিকে তাকাও! কিছু বলো।
তোমার চোখ এতো অস্পষ্টতায় আচ্ছন্ন কেন? সন্দেহের বিশালতায় এভাবে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছো কেনো? ঈশ্বরী তুমি এমন করছো কেন?
তোমায় দেখছি, ভাবছি, স্বপ্ন নয় তো।
তাই বলো, তো কি দেখলে?
দেখলাম, সত্যি তুমি আর আমি। কি সুন্দর বাতাস তাই না?
হুম বৈশাখী বাতাস….চলো তাহলে আরেকটু হাঁটা যাক….বাতাসে তোমার চুল উড়বে… ও কি যে দেখতে লাগবে…
তুমি এমন করে কারো সাথে হেঁটেছো কখনো?
কি যে বলো এভাবে আর কারো সঙ্গে হাঁটতে যাবো কেন তুমি থাকতে? নীল শাড়ি পরেছ তো….চুলগুলো ছেড়ে দাও অমন খোঁপায় না বেঁধে রেখে..নিছক চুলগুলোকে নির্যাতন করছো কেন? ওদেরও তো সাধ-আহ্লাদ আছে….
তুমি খুলে দাও, দেখো আঁচলটা বাতাসে কেমন উড়ছে।
আচ্ছা এই নাও খুলে দিলাম… ওয়াও তাই তো….আঁচলও আজ বাতাস পাগলা হয়েছে।
আদর করো প্রাণ খুলে।…
ইভা জেগে ওঠে স্মৃতি ছেড়ে। দেখতে পায় বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির শব্দে শব্দে সে আবার হারিয়ে যায়।
কি সুন্দর বৃষ্টি!
ইভার কথায় রিজভি জমায় : টিপটিপ ছন্দে দেখছ কেমন ঝরে যাচ্ছে…গাছগুলো দেখো কেমন নীরবতায় আছে… যেনো তারাও বৃষ্টি সমর্থন দিচ্ছে….
হুম, টিপটিপ বৃষ্টি মৃদু মৃদু গন্ধ, এই আছি এই নাই কোনো ছন্দ।
তোমার চুলগুলো খুলে দাও ভিজে চুবুচুবু হোক…
ওকে, এলোমেলো বাতাসে উড়িয়েছি চুল আমার।
দেখছো বৃষ্টিতে চুলগুলো কেমন সতেজ হয়ে উঠেছে…
হুম প্রাণ ফিরেছে আজ।
লেকে গোসল করবে? এমন বৃষ্টিতে জলে ডুব দিয়ে শুনবো বৃষ্টির টুপটাপ ছন্দ….কি না মজাই হবে…ফিরে পাবো ছেলেবেলা।
হুম, বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর… গাইবো ছেলেবেলার গান।
গান গাইতে গাইতে ইভা ফিরে আসে নিজের কাছে। যেখানে সে একা। পাশের চেয়ারটা শূন্যতায় কাতরাচ্ছে। মানুষের একাকীত্ব বাড়ছে। একা মানুষের ভিড় বেড়েই চলেছে। ভিড়ের মাঝে মানুষ একা একা পথ চলছে। কিন্তু কেউ কারো সঙ্গী হচ্ছে না। হতে পারছে না। শুধু নিজের মাঝে আর্তনাদ করছে।
না, নিকু আর্তনাদে রাজি নয়; ওটা পুরনো ফ্যাশন। সে কয়েকজনের সাথে একই সময়ে কথা বলে। তারা দেখা করতেও ব্যস্ত থাকে; আমাকে বলে সেই গল্প : অই আজাইরা পোলারা আমার লগে দ্যাখা করবার চায়, দ্যাখা করার কি ঝোঁক। তা দেইখা একবার হাইসা বুক ফাটাই, আরেকবার উত্তর করি। অরা আয়ে দ্যাখা করবার আর আমি কি করি জানছ, অগরে সুন্দর কইরা লগে বসাইয়া আমার বয়ফ্রেন্ডের গপ্প জুইড়া দেই। আর দুই একটারে মন্ত্র দিয়া দেই যে, ভুড়ি কমাইবা, নাইলে কিন্তু চলবো না, কয়দিন দৌড়াইবা।
এখন আমারে ক’ তাগর লগে বয়ফ্রেন্ডের কি গপ্প মারছ? ধুর, তার তো ম্যালা গপ্প, কোনটা ছাইড়া কোনটা কই তার ঠিক থাকে না। কিন্তু যে গপ্প বেশি কই সেইটা হইলো তারে যে আদর করি সেই গপ্প। যখন এই গপ্প ছাইড়া দেই তখন দেখি একেকটার মুখ লাল হইয়া যায়। মাথা চক্করও বোধ হয় মারে। আমার হাত ধইরা থাকলে আস্তয় ছাইড়া দেয়। অগর যে জ্বলে সেইটা একবারে পানির মতো ক্লিয়ার বুইঝা যাই। তখন কিন্তু খুব মজা লই।
আবার আরেকটারে কই অয় যে প্রতিদিন সকাল আটটায় আমার লগে দ্যাখা করে সেই গপ্প। ম্যাঘ বৃষ্টি সব মাথায় লইয়া আসে আমার লগে দ্যাখা করবার লাইগ্যা। কই অর লগে আমার ক্যামনে পরিচয় হইলো সেই গপ্প। অরা কিন্তু আমার লগে দ্যাখা করতে খালি হাত লইয়া আসে না, হাতো কিছু না কিছু থাকেই। কেউ চেন দ্যায়, কেউ শাড়ি দ্যায়, কেউ থ্রি পিছ দ্যায়, কেউ মোবাইল দ্যায়, কেউ ঘড়ি দ্যায়, এইসব সুন্দর কইরা লইয়া শুরু কইরা দেই তার গপ্প। কেউ আবার শোক শোক মন লইয়া কবিতা লিখবারও বয়।
শ্রাবণের প্রথম দিন, যে সময় হালকা বাতাস আর মেঘের দুষ্টুমি চলছিল সে সময় নিকুর সঙ্গে আমার গল্প হয়। গল্প হয় বারান্দায়; আমরা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম; পাশের বারান্দায় ছিল ইভা। আমাদের জমানো গল্পে এসে কষ্টের ছিটা দিয়ে যায়। এ আমাদের কাছে ছিটা মনে হলেও তা তার কাছে পূর্ণ বিষাদের চাঁদ। যে চাঁদে চাঁদবুড়ি নেই, গাছ নেই, আছে কেবল সে; সে ও তার যন্ত্রণা। ফোনে ফোনে কবুল, কবুল, কবুল বলে বিয়ে করার পর পূর্ণ মিলন হয়। মিলনে মিলনে সে মা হয়ে উঠবে এ হিসাবে ছিল না। হিসাবটা রসঘন হয় যেদিন সে বুঝতে পারে তার মাসিক বন্ধ হয়ে গেছে। মাথা ঝিম ঝিম করে। পেট উঁচু হতে শুরু করে। ব্রেস্টের আকার বেড়ে যেতে থাকে। এই অঘটনে তার মেজাজ নড়ে যায়; চিন্তার সূত্র পরিবর্তিত হয়। বান্ধবীদের কাপড় খুলে দেখিয়েছে : এই দ্যাখো আমার অবস্থা। কবুল, কবুল, কবুল বলে আমার শরীর চেটে খাবার সাধ পূরণ হলে এখন আর এর দায় কাঁধে নেবার নাম নেই। পেট বাঁধাইতে পারছো, এখন বাপ হইতে পারবা না। খবিশ কুনডাইলের। এই বাটপারি কইরাও সে মসজিদের সামনে দিয়া কেমনে হাঁটে? কয় কী : তুমি তো আর আগের মতো আমারে আদর করতে পারো না। তোমারে আগের মতো ভালো লাগে না। শালারে কেমনে বোঝাই যে তর লাইগাই তো এহন আমার এই ভাঙা চেহারা। গাছটারে চাইটা-পুইটা খাইবা আর তারে সময় দিবা না ঠিক হওনের। আর তুমি আছো রঙে; রঙের কথা কও আগের মতো আদর করতে পারি না। কও : যে তার বাবা-মায়েরে ভালোবাসে না, গুরুত্ব দেয় না, পরে সে আমারে গুরুত্ব দিবো না তা তো বোঝার বাকি নাই। হারামি, তুই কী গুরুত্ব চাস? বাবা-মায়েরে জানাইলে তরে জেলে ঢুকাইতো। তর ক্যাম্পাসে নির্বাচন করার শখ মিটাইতো। আমারে ধুইয়া আরেকটারে লইয়া পাঙ্গি পারার মজা ভালো কইরা বোঝাইতো। তর লাইগাই এই দশা, আর তুই আমারে কথা শোনাস?
এই কথাগুলো বলতে বলতে ইভা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সেদিনের মতো আমরা বিদায় নেই পরস্পরের কাছ থেকে। নিকুর সাথে এরপর দেখা হয় চৌরঙ্গী মোড়ে। হাঁটতে হাঁটতে আমরা টারজানের দিকে আগাই। সঙ্গে ছিল বন্ধু ইমতিয়াজ। সেখানে খোকন ভাইয়ের দোকানে চটপটি খেতে খেতে শোনা হয় নিকুর বাকি গল্প, নিকু : একজন পোলা কি নিয়া যেন পোস্ট দিছিল, অই পোস্টটা ভালো লাগে নাই। পোস্টের কমেন্টো অর আঁত জ্বালানি কিছু কথা লিখছিলাম, হ্যায় পরে আমার ইনবক্সে শ্বাস খরানি কথা লিখছে। সরি কইছে গোটা বিশেক। আর কবিতা লিখছে ২টা। আমারে কাছে পাইবার লাইগ্যা দ্বিতীয় যে কবিতাটা ল্যাখে অইনো ইনায়া-বিনায়া ভালোই লেখছিল। অইটা হইলো ‘অভিমানী মন’ শিরোনামে :
‘অভিমানী মন’ ব্যস্ততার সমস্ত চাদর খুলে দেখতে চাই তোকে, দেখতে চাই তোর সৌজন্যবোধ, তার আগে বল ‘তুই ভালো আছিস?’ ‘আমি কিন্তু ভালো নেই’ বলে রাখলাম, আমার তো আর তোর মতো এত বিস্তর ভূমি নেই, যেখানে সেখানে নিজেকে লুকাতে পারবো, আমার জায়গা জমিন খুবই কম, তাও আবার পেয়েছি উত্তরাধিকার সূত্রে, নিজে কিছু করতে পারিনি।
তুই জোসনা পোহা যদি মন চায়, দেখিস অন্য কাউকে ফির ভাবিস না, সে আবার কষ্ট পাবে, কষ্টের ঋণ যে কত বড় ঋণ তা তোকে বলে বোঝান যাবে না, তা শোধও করা যায় না, ভাবিস না জ্ঞান দিলাম, জ্ঞান দেবার মতো অতো যোগ্যতা এখনো হয়নি।
জোসনা ভালো না লাগলে বৃষ্টিতে ভিজে মনটা একটু হালকা কর, তুই তো ভালো গল্প বলতে পারিস, তোর ভাষায় কাব্য ঝরে, প্রশ্নে সাবলীলতা থাকে, তোর হাসিটা ফোকলা হলেও ভাল লাগে, তুই এসব করতে পারিস, বলছি না সেসবই করতে হবে, তবে একটু ভেবে দেখিস, এতো কঠিন না হলেও পারিস। তোর মনের অলিগলিতে একটু শীতের ছোঁয়া দে, তাতে একটু রস মাখা, দেখবি ভালো লাগবে, আর বেশি কিছু বলতে পারছি না, তুই একটু বুঝে নিস অভিমানী মন, বুঝে নিস।’
অই ব্যাটার এ্যাহন পরীক্ষা চলতাছে, মনে অয় পরীক্ষার বারোটা বাজছে। তয় অরও একটু বুঝুন লাগবো, একটা বিরতি দরকার। ঘন ঘন প্যান প্যান করার চাইতে একটু পাতলা পাতলা প্যান প্যান করা ভালা, তাইলে বিষয়টা আরো গভীর হয়।
আরেকজন ফির আমারে চিঠি লিখছে। অরেও জ্বালাইছিলাম একদিন, কইছিলাম আর তর লগে কথা হইবো না, তুই আস্তা একটা বেয়াদব। আসলে বেয়াদবীর অইরহম কিছুই আছিল না তার আচরণে, তাও কইছি। কেবল অরে কয়দিনের লাইগ্যা সরায়া আরেকটারে অইহানো আনার লাইগ্যা। আরেকজন ইনবক্সে লিখছে :
‘যাও তুমি তার সঙ্গে
বলো কথা ওর সঙ্গে, ফেরাবো না,
তুমি অনেকের তাই তো পেয়েছি তোমায়।’
অর এই জ্ঞানতাত্তি¡ক উক্তি ভালোই লাগছিল, কিন্তু এই ভালো লাগা তার লাইগ্যা আছিল মন্দ। অরে আর ফ্রেন্ডলিস্টে রাখি নাই, সরায়া ফালাইছি।
তার কাছে জানতে চাই সত্যিই কি তার বয়ফ্রেন্ড আছে? যার গল্প শুনতে শুনতে ফেসবুক পোলাদের মতো আমিও বিরক্ত হয়ে গেছি।
নিকু, ক তর বয়ফ্রেন্ড কি আছে? না মিছা মারছ?
সে আজ কোনো ভান না করেই বলে দেয় ভেতরের কথা। কেননা সে ভান করতে করতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
না রে দোস আমার কুনো বয়টয় নাই, মানে বয়ফ্রেন্ড নাই।
তাইলে এতদিন মিছা মারছস? তুই তো নিজেও আজাইরা বনে গেলি।
তার গল্পটি এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু হয়নি। সে মানুষ নিয়ে খেলে, কারণ তার ভেতরে একটা দাগ আছে; যে দাগ সে মুছতে পারে নাই বলে এই খেলায় নেমেছে। সে একজনকে ভালোবেসেছিল ফেসবুকে আলাপ করতে করতে। সে তাকে ভালোবাসার নামে খেলা করেছে, খেলেছে হা ডু ডু, দাড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট, কুতকুত সব-ই। তাকে সব জায়গায় ঘুরাইলেও কোনো রাস্তায় উঠায় নাই। ভালোবাসে, আবার ছাড়ে, কিন্তু স্পষ্ট করে কিছু বলে নাই। কাছে টানে এক হাত পরিমাণ কিন্তু দূরে রাখে সাড়ে পাঁচ হাত। তাকে ঘর থেকে বের করেছে ঠিকই, সে আসে নাই। তার সুন্দর মন, বিবেক, ভালোবাসা ঠকেছে বলেই অন্যকে ঠকানোর খেলায় নামে। নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্যে ফেসবুকে সময় দিতো, কিন্তু এখন আরো বেশি সঙ্গহীনতায় ভোগে। চারপাশে অনেক মানুষ কিন্তু তারা নিকুর কেউ না। সেই মানুষ তার কেউ নয় বলেই সে কারো হয় না; কেবল তাদের কাছ থেকে মজা লুটে।
নিকুর গল্প শেষে ইমতিয়াজ বলা শুরু করে তার কথা। ততক্ষণে টেবিলে চলে আসে টক। টক খেতে খেতে সে বলতে থাকে : শোন দোস, গত মাসে আমার জন্মদিন ছিল, পোলাইপাইনেরা ওয়ালে লিখতে লিখতে ভইরা ফালাইছে। বার্থডে কেক পাঠায়, পাঞ্জাবি পাঠায়, পাঠায় সবই ফেসবুকে। কে কত গর্জিয়াস পাঠাতে পারে, পাঠাইছে। তাতে আমার কোনো লাভ হইছে? ফেবুর পাতা ভরছে, কিন্তু আমার রুমে একটাও আসে নাই। না পাঞ্জাবি, না কেক, না অন্য গিফট। ফাঁসুকি, পুরাই ফাঁসুকি। আগে বাড়িতে সবাই আইসা পড়ত; পার্টি হইতো, কেক কাটতাম, বন্ধুরা বন্ধুর জন্মদিন মনে রাখতাম; কত মজা করতাম। সেদিন মা’রে দেখলাম টিভি ছাইড়া দা মোবাইলের স্কিন খালি উপরে উঠাইতাছে। ক্যাডা কী আপলোড করছে, কী লিখছে তা দেখতাছে। চ্যাট করতাছে। বাবা বারবার কইতাছে বাজার থাইকা কী কী আনুন লাগবো কও। মা কয় যা মন চায় আনো। বাপের যা মন চাইছে তা আনছে। কী যেন আনে নাই, আর লাগাইছে ক্যাচাল। টিভি চলতাছে, চোখ টিভির পর্দায় নাই, আছে ফেবুতে। হেদিন এক বন্ধু আইলো মালেশিয়া থাইকা, যারে আমি ফেবুর আশীর্বাদে খুঁইজা পাইছি, হেয় আমার লগে বইয়া রইছে, কথা কয়, কয় না এমন ভাব লয়া খালি মোবাইলের স্কিন গুতায়, চায়া দেহি ওরেও ফেবু জ্বরে ধরছে।
বান্ধবীরে দেখলাম সেলফি তুলতাছে মুখ ব্যাকায়া ব্যাকায়া, সারাদিনে প্রায় এক হাজার সেলফি তুলবো, আর ভালোগুলা ফেবুতে ছাড়বো। এই বন্ধু, হেই বন্ধু সবার লগেই। পুরানা বয়ফ্রেন্ডেরে দেহানোর লাইগা নতুনডার লগে ছবি তুইলা ছাড়ে; আবার নতুনডারে দেহানোর লাইগা পুরানডার লগে তুলে ছবি। আজাইরা। কয়েকটা জুটি দেহি একজন অন্যের চোখে চোখ রাইখা আছে ওই ছবি ছাড়ছে; কোনোটা বুকে হাত দিয়া আছে; কোনোটা বুকে জড়ায়া আছে; কোনোটা রাতে শুইতে যাইবো সেই ড্রেস পইরা ছাড়ছে ছবি। দেহায় তারা কত কাছাকাছি আছে; পরস্পররে কত ভালোবাসে। আসলে অতোটা না, যতোটা দেহায়। যে কাপলটা বুকে জড়ায়া ছবি ছাড়ছে, অগোর খোঁজ লইয়া দেহি পোলাডা আরেকটার লগে টাঙ্গি মারতাছে। কারণ কী? কারণ অর বউটা খালি ক্যাট ক্যাট করে। খালি হিসাব লয়। প্রেম রোগ নাই, এই রোগে জড়াইতে সে এই মাইয়ার লগে ধানমণ্ডি লেকে। এহন ওর বউ জানতে পায়া ক্ষেইপা তাগোর যত অন্তরঙ্গ ছবি আছিল সবই ছাড়ছে হোম পেজে।
কয়ডারে দেখলাম আমার স্ট্যাটাসে হেই লাইক কমেন্ট দেয়, চ্যাটে আসে; কয় বন্ধু বানাইবার; যেই এ্যাকসেপ্ট করলাম, এরপর থাইকা তারে আর খুঁইজা পাই না; না পাই চ্যাটে, না পাই লাইক-কমেন্টে। একটা পাবলিকরে দেখলাম চ্যাটে কী মজার কথা কয়, কইলাম আমি তো আপনার ওখানে যাচ্ছি; মানে আপনার ক্যাম্পাসে, আপনার গান শুনবো। কী সুন্দর রাজি হইয়া মোবাইল নাম্বার দিলো; যাবার আগে ট্রাই কইরা দেহি নাম্বার বন্ধ। প্রোফাইল পিকচার যোগের একটা গল্প কই। এক নারী তার ছবি কত যতন কইরা; ফটোশপে কাজ কইরা আপলোড করে; দেইখা মনে হয় হেব্বি সুন্দরী। পরে হের লগে একদিন দেখা হয়, দেখি মুখে ব্রণে ভর্তি, কোমড়ের কী সুন্দর গড়নের ছবি, আর দেখি পুরাই ব্রয়লার টাইপ। দেখার কিছু নাই। এই মাইয়া যে কত সংক্ষিপ্ত কইরা ভাষা ব্যবহার করতো। আমি নিজেই ভ্যাবাচ্যাকা খাইতাম পড়বার যায়া।
আর দেখবি আইডির নাম কী একেকটার; ‘মৃতের সঙ্গে বসবাস’, ‘ফড়িং পাখনায় ঘুঘু সুন্দরী’, ‘উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠার লিখন’, ‘রাত জাগা পাখি’, ‘জোসনার আলো’, ‘অপরাজিতা’, ‘চড়–ই পাখি’, ‘হারানো ডাংগুলি’ আরো ম্যালা নাম। একেকটা কইরা লিঙ্ক শেয়ার করে ‘সাকিবের বউ একসঙ্গে চারটি সন্তান জন্ম দিয়ে গিনিস বুকে নাম লেখালেন’; লিঙ্ক ওপেন কইরা দেহি আজাইরা সব প্যাঁচাল, তার বউয়ের গর্ভবতী হওয়ার কোনো চিহ্নই ধরা পড়ে নাই। কয় কী ফিলিং অমুক, ফিলিং তুমুক; ফিলিংসের হাট বসায়।
ওর কথা থামানোই যায় না। এক সময় বামধারার রাজনীতির সক্রিয় সদস্য ছিল। শহীদ মিনারের পাদদেশে মাউথপিস ধরিয়ে দিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একাই বলে গেছে হলের সংকট, খাবারের সংকট, ক্লাসরুম সংকট, স্যার’রা ভালো না পড়ানোর কথা, ইভটিজিংয়ের কথা। সেই প্রাকটিস আজো একই আছে। নড়চড় হয় নাই। রাত হয়ে গেলে নিকুকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমরা ফিরি রুমে। উঠার সময় ছড়া পড়তে থাকি :
‘আমার মাথায় ধরে না
আপনারা ধরাইয়া দেন,
একই মানুষ বিভিন্ন নামে
আইডি খুলে ক্যান।’
‘বন্ধুরা,
হুদাই কেন ট্যাগ করেন?
জলদি সব ব্যাক করেন।
ডিলিট করতি বেলা যায়
লাইক দিবো কুন সুমায়’?
বাসায় ফিরে দেখি পাশের বারান্দায় ইভা কাঁদছে; বলছে : আচ্ছা জীবনটা সিরিয়ালের মতো হয় না কেন? সিরিয়ালের মতো আমি আমার ঘরে কাঁদবো মা অন্য জায়গা থেকে বুঝতে পারবে যে, তার মেয়ে কষ্ট পেয়ে কাঁদছে। আমার মন খারাপ হলে ভাইয়েরা যে যেখানে আছে বুঝে যাবে যে, তাদের বোনের মন খারাপ। মোবাইলে বাজছে : ‘সবকিছু নিয়ে মজা তোমার / মজার ছুরি এফোর-ওফোর হৃদয় করে আমার।’