পুনর্পাঠ ছোটগল্প: জননী | হাসান আজিজুল হক
কয়েক বছর আগে আমাদের ফ্ল্যাটবাড়িতে যে মেয়েটি কাজ খুঁজতে আসে, তার রূপ দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। চৌদ্দ পনেরো বছ বয়স হবে তার, গায়ের রং ধপধপে ফর্সা, টানা টানা টলটলে বিশাল দুটি চোখ, ঈষৎ লম্বাটে মুখে টিকলো ছোটো নাক, তাতে সাদা পাথর বসানো এতটুকু একটা নাকফুল।
আমার স্ত্রী তাকে জিগগেস করলো, নাম কি তোর?
আয়েশা।
কাজ করবি?
করবো না ক্যানে?
কি কাজ করবি, শুকনো না ভিজে?
পেলে ভিজে করবো।
থাকবি তো আমাদের বাসায়, রাতে?
সাঁঝবেলায় মায়ের ঠেয়ে যাবো।
তা পারবি না, ভিজে কাজ করলে এই বাসায় থাকতে হবে।
তবে আমি যেচি কাজ করব না–বলে মেয়েটি বেরিয়ে যাবার জন্যে পা তোলে।
বেশ কদিন কাজের লোক নেই বাসায়। আমাদের গরজ বেশি।
স্ত্রী তার পথ আটকে ধরলেন, তুই বাড়ি যাবি কখন?
বননু তো সাঁঝবেলায়–মায়ের ঠেয়ে যাবো।
ঠিক আছে। কাজে লেগে পড় যা।
মেয়েটি কাজে বহাল হলো। মনে মনে একবার ভাবি আগুনের রূপ নিয়ে কে এই মেয়েটি।
বিকেলের দিকে আমার ছোটো ঘরে বসে কাজ করছি। পাশের বাসার বৌ আমার স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করতে করতে জিগগেস করলেন, মেয়েটিকে কাজে লাগালেন?
আমার স্ত্রী কৌতুকব্যস্তে জিগগেস করেন, কেন, কেন, বলুন তো! কোন ব্যাপার আছে নাকি? থাকলে বলুন, ছাড়িয়ে দিই কাজ থেকে।
না, না, তেমন কিছু নয়। আবার যেন তাঁর চাপা হাসির শব্দ পেলাম।
রাতে শোবার ঘরে স্ত্রী বললে, আচ্ছা, এটা কি অসম্ভব নয়?
কেন কি হয়েছে বলো তো?
এই কথা কি বিশ্বাস হয়? বলে স্ত্রী হাসতে শুরু করেন।
কথাটা কি সেটা তো আগে বলবে।
উনি হাসতেই থাকেন। আমি বিরক্ত হয়ে বলি, কথাটা কি বলে তারপর যততখুশি হাসো।
হাসতে হাসতেই স্ত্রী বললে, ওর নাকি এই বয়সেই—এইটুকু বলে আবার হাসি।
অতিষ্ঠ হয়ে বলি, দুত্তেরি।
হাসি তখনো চলছে, ওর মধ্যেই বললে, ওর নাকি এই বয়সেই একটা ছেলে হয়ে গেছে।
দূর তাই হয় নাকি? খবরটা তোমাকে দিল কে?
খবর যে-ই দিক, কথাটা সত্যি।
একটু অস্বাভাবিক বটে, তবে অসম্ভব নয়। মেয়েটির তাহলে বিয়ে হয়েছিলো নিতান্ত অল্প বয়সে আমি বলি আর সকালের পরিষ্কার আলোয় দেখা মেয়েটির মধু রং-এর নরম ত্বক; অসাধারণ দুটি চোখ, প্রতিমার মতো সুডৌল মুখ আমার মনে পড়ে যায়। এসব একবার তহ্নছ হয়ে যাবার পর মেয়েটি আবার গুছিয়ে নিয়েছে। মহাভারতের সত্যবতীর কথা মনে পড়লো, সঙ্গমের পরও তার কুমারীত্ব নষ্ট হয়নি।
স্ত্রী আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে দেখে আমি বলি, বিয়ে হয়েছিলো তাহলে। সেই একই গল্প স্বামী ভাত দেয় না, তাড়িয়ে দিয়েছে, না হয় নিজে গায়েব হয়ে গেছে।
য়ে হয়নি? কি বলছো কি তুমি? তাহলে—
বাচ্চা হতে হলে বিয়ে হতেই হবে কে বললো তোমাকে?
তা বটে! ইস-প্রচণ্ড ক্ষোভে ভিতরটা আমার জ্বলে যেতে থাকে। কি অসঙ্গত, কি বীভৎস।
গণ্ডারের তাজা গোলাপ খাওয়ার মতো। এই রকমই নাকি করে মেয়েটি—অনেকক্ষণ পরে স্ত্রী বললেন।
তাড়িয়ে দেবে কি মেয়েটিকে? আমি জিগগেস করলাম। উপায় কি? জেনেশুনে এরকম একটা মেয়েকে–
লোকভয়ে?
না, ঠিক তা নয়।
ঠিক তাই। কে কি বলবে তাই তো?
তাহলে কি করা যায়?
রেখে দাও মেয়েটিকে। আমাদের নিজেদের মেয়েরও তো ঐরকম বয়স। তাড়িয়ে দিলে ওর কপালে কি ঘটবে আন্দাজ করতে পারছো?
তা তো পারছি।
ওকে কাজে রাখা যদি উচিত মনে করো তাহলে সাহস করো। ও তোমার দয়া ভিক্ষা করছে না কঠিন মেহনত করে তোমার কাছ থেকে রুজিটা পাচ্ছে।
আচ্ছা থাকুক–দ্বিধার সঙ্গে স্ত্রী রাজি হলেন।
মেয়েটির কাজ নিখুঁত। আপনমনে চুপচাপ খেটে যায়। কথা কম বলে কিন্তু যখন বলে খুবই খারাপ শোনায়। গোলাপ কাটার মতো ঘষা কর্কশ কণ্ঠস্বর তার। তবে কথা কম বলে।
মাস দুই গেছে। মেয়েটি যে আসে যায় আমি খেয়ালও করি না। হঠাৎ সেদিন রাতে শোবার আগে স্ত্রী বলেন, ব্যাপারটা লক্ষ করেছ?
কি বলো তো?
না, তোমাদের চোখে অবশ্য পড়ার কথা নয়। মেয়েটির আবার বাচ্চা হবে।
কি? তার মানে। ভীষণ চমকে আমি চিৎকার করে বলি।
হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। মেয়েদের চোখ এই ব্যাপারে ভুল দ্যাখে না। আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম। এখন দ্যাখো।
কি করবে তাহলে? আমার ভিতরটা শুকিয়ে ওঠে, ওটা তো একদম ঠিক কথা নয়—বিয়েটিয়ে হয়নি বলছো।
আবার বিয়ে। বাচ্চা হতে বিয়ে লাগে না।
থাকুক আমার বাড়িতে। আমি রুখে দাঁড়াচ্ছি। যদি পেটে বাচ্চা ধরেই থাকে, এখানেই ওর প্রসব হবে।
বুদ্ধি বটে তোমার। সারা দেশে ঢি ঢি পড়ে যাক আর কি?
পালাবো? ভিতরটা আমার জ্বলে যাচ্ছে পালাবো এই বাস্তব থেকে? যা করা দরকার মনে হচ্ছে, লোকভয়ে তা করতে পারা যাবে না? শোনো, যা হয় হোক, মেয়েটিকে তোমার আশ্রয় দাও। জীবনে অন্তত একবার মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াতে দাও। এই অসহ্য ছুঁচো আর চামচিকের জীবন থেকে অন্তত একবার বেরিয়ে আসি।
মাথা খারাপ হয়েছে? তোমার নিজের বোধহয় ছেলেমেয়ে সংসার বলতে কিছু নেই।
কি বললে? আমাদেরই মেয়ের মতো? খেপে গেলে নাকি? একটা রাস্তার বদস্বভাব মেয়ে, জন্মের পর থেকে পুরুষসঙ্গ করছে
সেই হারামজাদা শুয়োরের দল, পুরুষ শুয়োরদের বুঝি কোন দোষ নেই রাগে চিৎকার করে আমি গলা চিরে ফেলি।
সে তত তোমরাই—স্ত্রী চেঁচিয়ে ওঠেন।
সে তো আমরাই—চকিতে একটা কঠিন সত্য লোহার শাবলের মতো কপালের ঠিক মাঝখানে আঘাত করে। অনেকক্ষণ পরে ধীরে ধীরে আমি বলি, সে তো ঠিকই কিন্তু মেয়েটির দোষ কি?
আমার অত জজিয়ত্রি দরকার নেই–কালই আমি ওকে তাড়াব।
কি আশ্চর্য, একটা ঘোরের মধ্যে আমি বলে ফেলি, একটু সবুর করো, মানুষ আসা দেখতে দাও আমাকে।
কি ভেবে কেমন করে যে এই সস্তা সিনেমার ডায়লগটি বলে ফেলি জানি না। কিন্তু আমার স্ত্রী চুপ করে যায়। মেয়েটা থামে না, সিনেমা চলতে থাকে, মানুষ নিষ্পাপ নিষ্কলংক শিশু আসছে, সুস্থ সতেজ জরায়ু থেকে বেরিয়ে আসবে মানুষ। সমস্ত পৃথিবীর অপেক্ষা তার জন্যে।
যেমন বলেছিলেন, আমার স্ত্রী পরের দিনই মেয়েটিকে তাড়িয়ে দিলেন না। তবে মেয়েটির প্রতি তার ব্যবহার খুবই কঠিন হয়ে উঠলো। ছোটোখাটো ত্রুটির জন্য নির্মম কথা শুনতে হতো তাকে। কিন্তু সে একটি কথারও জবাব দেয় না।
কতোদিন কেটেছে এমন। মাস দুই হতে পারে। শেষে একদিন ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমার স্ত্রী শান্ত নিচু কঠিন গলায় বললেন, ওকে আর রাখা যায় না?
আমি বলি, ঠিক বলেছ—আর একদিনও ওকে রাখা চলে না।
পরের দিন আয়েশা এলে আমার স্ত্রী বলেন, তোকে আর রাখতে পারছি না। নিজের জিনিসপত্র যা আছে নিয়ে চলে যা আমার বাড়ি থেকে। দূর হয়ে যা।
আয়েশা কোনো কথা না বলে নিজের ময়লা একটা শাড়ি, রং-জ্বলা একটা গামছা আর এমনি টুকিটাকি দু-চারটি জিনিস হাতে তুলে নিয়ে আমার স্ত্রীর সামনে এসে দাঁড়ায়, তার সেই আশ্চর্য সুন্দর দুটি চোখ মেলে সে বলে, যেচি, আমার এ মাসের যা পাওনা হয়েছে দিবেন না? স্ত্রী বলেন, এই তোর মাইনে; নে ধর আর এইটা তোকে দিলাম। আর কোনোদিন এদিকে আসবি না। তোকে যেন আর কোনদিন দেখতে না পাই। যা, মরগে উই—তীব্র রাগে কথা কটি বলে তিনি মেয়েটির হাতে একটা একশো টাকার নোট দিয়ে তাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে বাড়ির বাইরে ঠেলে দেন।
আমাদের এদিকে আসে না বটে, তবে ওকে মাঝমাঝে রাস্তার কিনারা ধরে ধীর পায়ে হেঁটে যেতে দেখি, দেখতে পাই গাছে ছায়ায় বসে নিরুদ্বেগে ময়লা আঁচল দিয়ে গাম মুছছে। পৃথিবীকে সে দেবে অমূল্য উপহার, গর্বে তৃপ্তিতে ভরে উঠেছে তার বুক, অবজ্ঞার চোখে সে চেয়ে আছে মানুষের ইর সংসারের দিকে। জানি এসব কিছু নয়, আমিও তৈরি করেছি দুস্পাঠ্য দুজ্ঞেয় অক্ষরমালা, যা কেবল আমিই পড়তে পারি। এইসব অক্ষর কি দাগে-ঢাকা, ক্ষয়-পাওয়া সুদূর অতীতের কোনো শিলালিপিতে ছিলো, নাকি আমিই তৈরি করে নিয়েছি?
দুটোই পাশাপাশি চলতে থাকে। কঠিন কঠোর কল্পনাহীন সত্তাহীন অর্থহীন ক্লান্তিকর বাস্তব আর ঠিক তার পাশে সৃষ্টি হতে থাকে অগ্নিগর্ভ সংকেত, দেখা দেয় সমস্ত পৃথিবীর মানুষের জন্ম দেবে বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এক জননী।
এরপর আবার একদিন আয়েশাকে দেখতে পেলাম বিরাট ধামার মতো পেট নিয়ে পা টেনে টেনে হেঁটে চলেছে। কোনো বাড়িতে তো সে আর এখন ঢুকতে পারছে না। ও কি এখনো ওর মায়ের ঠেয়ে যায়? সেখানে কি ওর ঠাই মিলবে প্রসব হওয়ার জন্যে? নাকি সিঁড়ির নিচে অন্ধকারে এক কুকুরীর সঙ্গে একই যন্ত্রণায় সে কারাবে?
হঠাৎ একদিন দেখি বেশ ঝরঝরে শরীর তার। একটু শীর্ণ হয়েছে। দুই স্ফীত স্তনভার বইতে পারছে না। মরিয়া হয়ে তাকে আমি হাতছানি দিয়ে ডাকি। ক্লান্ত পায়ে হেঁটে সে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমাকে চিনতে পেরেছে এমন কোনো লক্ষণ দেখা গেল না তার মধ্যে। চিনতে পারলেই বা কি? নিস্পৃহ নিরাসক্ত চোখে আমার দিতে চাইলো সে। সেই বিশাল দুটি চোখ একটু গর্তে বসে গেছে। বিচ্ছিরি ব্যাপার, ঠিক তখুনি আমার কান্না এলো–এমন অসম্ভব ভাবপ্রবণতায় নিজের ওপরেই আমি জ্বলে উঠি। গলায় বাষ্প ফেনিয়ে উঠতে উঠতে আবার নিচে নেমে যায়। কেউ যেন শুনতে না পায়, দেখতেও যেন না পায়, আমি এদিক ওদিক চেয়ে দেখে নিচু গলায় ফিসফিশ করে জিজ্ঞেস করি বাচ্চা হয়েছিলো তোর, তার কি হলো রে?
তার সেই নিচু কর্কশ গলায় সে বলে, নাইখো।
কেন, কোথায় দিয়েছিস তাকে? কঠিন গলায় আমি বলি। আমার হঠাৎ রাগ হয়ে যায়।
কিছুমাত্র পরিবর্তন নেই তার মধ্যে। ঠিক আগের কথাটিই আবার বলে, নাইখো।
তিনবারের বার সে গর্ভধারণ করেছে জানতে পেরে আমি বাসায় ফিরে এসে আমার ইউনিভার্সিটিতে পড়া মেয়েটিকে কোলে নিয়ে কাঁদতে থাকি। আমার স্ত্রী কাছে এসে বলেন, ও আবার কি ঢং!
আমি চোখ মুছতে মুছতে বলি, ওকে তো কোনোদিন আদর করি না।
কচি বেলায় হাত মুঠো করে আমার বুকে ঘুমোত, গান শুনতে শুনতে কাঁধে মাথা রাখতে যেন পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে গেছে।
আমার স্ত্রীর চোখেও হঠাৎ জল চলে এলো। মেয়েকে ধমকে উঠে বললেন, যা এখান থেকে। মেয়েটা হকচকিয়ে চলে যায়।
এবার দেখি আয়েশার শরীররটা ভেঙে যাচ্ছে। এ সেই রকমের ভাঙা যাতে মনে হয় ভাঙার ব্যপারটা শেষ হলে শরীরের টুকরোগুলো এদিকে সেদিকে ছড়িয়ে পড়বে। চারদিক থেকে কুড়িয়ে এনে জোড়াতালি দিতে গেলে হয়তো দেখা যাবে পা বা কার হাড় নিয়ে চুষছে একটা কুকুর। কোথাও যায় না সে। গর্ভের অসম্ভব ভার নিয়ে বৃত্তাকার রাস্তা ধরে ধারপায়ে শুধু হেঁটেই চলে। চোখে তার নিস্পৃহ অবজ্ঞা মেশানো দৃষ্টি।
আমার স্ত্রীকে কখনো তার কথা বলি না। আমি হঠাৎ জেগে উঠে দেখেছি আমার মুখের দিকে তিনি অপলক চেয়ে আছেন। আমার চোখ খুলে গেলেই তিনি দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে মুখ ফিরিয়ে নেন?
প্রসবের সময় আসন্ন হয়ে এলে একদিন আয়েশাকে দেখি তার সেই পছন্দের জামগাছের তলায় চিৎ হয়ে নিস্পন্দ শুয়ে আছে বাতাসে ফঁপিয়ে ভোলা মশারির মতো ফুলে ফোলা আছে তার পেট। মাটি রং-এর পাতলা ঘেঁড়া শাড়ি দিয়ে ঢেকে রেখেছে কিন্তু সব ঢাকেনি। এই পেটের বোঝা খালাস হয়ে গেলেই এতটুকু সময় নষ্ট না করে সে তার জরায়ুতে নিযুক্ত করে নেবে আর একটি ডিম্বকোষ। আজ তার এই বিশাল গর্ভগৃহ দেখে মনে হয়, একটিমাত্র সন্তানের জন্য জায়গাটি বড়ো বড়ো—হয়তো ওখানে শত কলসীতে ভরা আছে একশো সন্তান। পিতৃহীন জারজেরা মায়ের হয়ে অধিকার নেবে মাটির।
আর একবার মাত্র আয়েশাকে দেখেছি। তারপরে আর কখনো নয়। একটা ইটের ভাঙা পাঁচিলের উপর সে বসে আছে। পাতলা তামাটে চামড়া দিয়ে আগাগোড়া। মোড়া। কিন্তু চামড়াটা এবার মাপে বড়ো হয়েছে। কনুইয়ের কাছে ময়লা ন্যাকড়ার একফালি ঝুলে আছে—গলার কাছে কয়েকটা ভাজ, বুকের উপর ন্যস্ত আছে একটু। কালো কোঁচকানো দুটো ধারালো ফালি আর বাকি বাড়তিটা ঝুলে আছে তার নিতম্বের নিচে। বাংলাদেশের ম্যাশের মত খাঁজকাটা, ভাজ করা, তীব্র ধারালো। এবার কিছুতেই ওর চোখ দেখতে পাই না। কপালের নিচে দুটি বড়ো বড়ো কালো গর্ত, সেখানটায় এমন অন্ধকার যে কিছু দেখতে পাওয়া গেল না। সরু শীর্ণ হাত তুলে সে আকাশে দাগ কেটে দেয়, তারপর হাত নামিয়ে হিংস্র নখরসহ তার ধাতব আঙুলগুলো দিয়ে কঠিন আক্রোশে মাথা চুলকোতে তাকে।
জন্ম- ফেব্রুয়ারি ২, ১৯৩৯, ছোট গল্পকার এবং কথাসাহিত্যিক। ষাটের দশকে আবির্ভূত এই কথাসাহিত্যিক তাঁর সুঠাম গদ্য এবং মর্মস্পর্শী বর্ণনাভঙ্গির জন্য প্রসিদ্ধ। জীবনসংগ্রামে লিপ্ত মানুষের কথকতা তাঁর গল্প-উপন্যাসের প্রধানতম অনুষঙ্গ। রাঢ়বঙ্গ তাঁর অনেক গল্পের পটভূমি। তিনি বাংলা অ্যাকাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করে। এ ছাড়া ২০১২ খ্রিস্টাব্দে তিনি অসম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সন্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি পান। হাসান আজিজুল হক ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে এক সম্ভ্রান্ত এবং একান্নবর্তী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মোহাম্মদ দোয়া বখশ্, মা জোহরা খাতুন,স্ত্রী শামসুন নাহার বেগম। জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি রাজশাহীতে কাটিয়েছেন। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী সরকারি কলেজে থেকে দর্শনশাস্ত্রে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে একই প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত তিনি রাজশাহী সিটি কলেজ, সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা গার্লস কলেজ এবং দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৪ সাল পর্যন্ত একনাগাড়ে ৩১ বছর অধ্যাপনা করেন।
রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় কলেজের উদ্যমী তরুণ মিসবাহুল আজীমের সম্পাদনায় প্রকাশিত ভাঁজপত্র ‘চারপাতা’য় হাসানের প্রথম লেখা ছাপা হয়। লেখাটির বিষয় ছিল রাজশাহীর আমের মাহাত্ম্য।
খুলনায় এসে তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির উৎসমুখ খুলে গেল প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সন্দীপন’-কে কেন্দ্র করে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে নাজিম মাহমুদ, মুস্তাফিজুর রহমান, জহরলাল রায়, সাধন সরকার, খালেদ রশিদ প্রমুখ সংগ্রামী কয়েক জন তরুণের চেষ্টায় গঠিত হয়েছিল ‘সন্দীপন গোষ্ঠী’। তত দিনে অবশ্য হাসান আজিজুল হক রীতিমতো বিখ্যাত। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’-এর প্রথম গল্প ‘শকুন’-এ সুদখোর মহাজন তথা গ্রামের সমাজের তলদেশ উন্মোচিত করেছিলেন তিনি। প্রায় অর্ধশতাব্দীর গল্পচর্চায় বিষয়, চরিত্র ও নির্মাণকুশলতায় উল্লেখ করার মতো গল্প হাসান আজিজুল হকের অনেক। এ সবের মধ্যে রয়েছে ‘শকুন’, ‘তৃষ্ণা’, ‘উত্তরবসন্তে’, ‘বিমর্ষ রাত্রি, প্রথম প্রহর’, ‘পরবাসী’, ‘আমৃত্যু’ ‘আজীবন’, ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘খাঁচা’, ‘ভূষণের একদিন’, ‘ফেরা’, ‘মন তার শঙ্খিনী’, ‘মাটির তলার মাটি’, ‘শোণিত সেতু’, ‘ঘরগেরস্থি’, ‘সরল হিংসা’, ‘খনন’, ‘সমুখে শান্তির পারাবার’, ‘অচিন পাখি’, ‘মা-মেয়ের সংসার’, ‘বিধবাদের কথা’ ‘সারা দুপুর’ ‘কেউ আসেনি’।
‘আগুনপাখি’ নামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। উপন্যাসটি বর্ষসেরা উপন্যাসের স্বীকৃতি লাভ করে।