হাসান আজিজুল হকের গল্প : নামহীন গোত্রহীন
আরো পড়ুন: পুনর্পাঠ ছোটগল্প: জননী
লোকটা মুখ ফিরিয়ে আশ্চর্য হয়ে দেখল চাঁদ উঠেছে। সে শহরের প্রশস্ততম রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। চাঁদ খুব তাড়াতাড়ি আকাশে উঠে গেল। সিধে চওড়া রাস্তার বহুদূর পর্যন্ত সে দেখতে পাচ্ছিল। মরুভূমির মাঝখানে অতি প্রাচীন ও জনমানবশূন্য অট্টালিকাশ্রেণীর মতো দেখাচ্ছে এই রাস্তার দুপাশের বাড়িঘর। বিকালের মরা আলোয় মাটি খুঁড়ে উন্মোচিত পুরনো ঘরবাড়ি ভাঙাচোরা, সব ছাদ সমান উঁচু নয়, চওড়া রাস্তা আর চমৎকার জলনিকাশের বন্দোবস্ত, সরু সরু পথ—সব রয়েছে এইরকম দেখাচ্ছিল শহর। সাদা রঙ-করা বাড়িগুলো ধপধপ করছিল—এক-একটা বাড়ি অন্য বাড়ির উপর, রাস্তার উপর ঘনকালো ছায়া ফেলেছিল। কোনো কোনো বাড়ির সামনে দিয়ে লম্বা পাঁচিল চলে গেছে। পাঁচিলের ওপাশে ফুলের গাছ, অযত্নের কাঁটালতা, সাঁতলা-ধরা ইটের খোয়া, কোনো বাড়ির গেটের পাশে লেখা—সাবধান, কুকুর আছে। কিন্তু কুকুরের ঘেউঘেউ শোনা যায়নি। বাড়িগুলোর কোনটা উঁচু, কোনটা নিচু, কোনটা নতুন, রং-করা, কোনোটা পুরনো আর সোঁদা গন্ধওলা ভিজে স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার; বাতাবিলেবুর গাছ, ঘন পাতাবাহার। কিছু-কিছু পোড়ো জায়গা আশেপাশে। এই রাস্তা দিয়ে, এইসব গলিঘুঁজি অতিক্রম করে, কখনও ছায়ার ভিতর দিয়ে, কখনও-বা জ্যোৎস্নায়, মাথা উঁচু করে, সে, অনেক লম্বা, সোজা, মোটা কোট গায়ে, ধুলভরতি বুটজুতো ঘষতে ঘষতে হাঁটতে লাগল। ঠিক যন্ত্রের মতো, তার গতি দ্রুত নয়, ধীর নয়, ঘড়ির কাঁটার মতো অবিচ্ছিন্ন, ক্রমাগত—এইরকম। এইভাবে কখনও হয়তো তার খারাপ লেগে থাকবে, মাটির উপর সে বসে পড়ে পা থেকে জুতোজোড়া খুলে ফেলে। টান দিয়ে মোজা থেকে পা দুটো মুক্ত করে আঃ শব্দ করে আরাম জানায়। পটাপট শব্দে মোজা ঝাড়ে, জুতোজোড়া পিচের রাস্তায় ঠোকে, তারপর হাতে জুত-মোজা নিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা অন্ধকার গলিতে ঢুকে পড়ে। গলিটার আধাআধি যখন পার হয়ে গেছে, তখন বড় রাস্তার দিক থেকে জুতোর আওয়াজ আর কথাবার্তা শুনতে পেল সে। সে শুনতে পায়, শালা বোলো, তুমলোগ জয়বাংলা হো? নেহি—কেউ উত্তর দিল। জরুর জয়বাংলা হো—এই কথার সঙ্গে সঙ্গে একটা ভোঁতা আওয়াজ তার কানে এল। তখন এক বিচিত্র বোধে জুতো হাতে নিয়ে, বগলে ফোলিও ব্যাগ পুরে সে হামাগুড়ি দিয়ে রাস্তার দিকে এগোয়। জ্যোৎস্নায় সে কিছু মানুষ দেখতে পেল। তুম হিন্দু হো? নেহি—আবার কেউ বলল। জরুর তুম হিন্দু হো। জ্যোৎস্নায় সে দেখল আট-দশজন একজনকে গোল হয়ে ঘিরে রেখেছে। মাঝখানের লোকটার খালি গা, পরনে কালো হাফপ্যান্ট। তুমারা ঘর কাঁহা? সে চুপ করে আছে। জয়বাংলা কাঁহা হ্যায়? লোকটা কোনো কথা বলছে না। একজন তার মুখে প্রকাণ্ড একটা ঘুষি বসাল। কালো প্যান্ট-পরা লোকটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। শালা, তুমকো গুলি করেগা। আভি করো—উঠে বসে মুখ মুছতে মুছতে সে বলে। তুম মুক্তিফৌজ নেহি হো শালা, বাঙালি কুত্তা? শালা, মুজিবকা পুজারি। নেহি। তুম হিন্দু নেহি হো? নেহি। লো ভাই, গুলি কর দো। নেহি, নেহি, গুলি নেহি করেগা—দেখো হাম কেয়া করে। কয়েক মিনিট পরে গলি থেকে সে দেখতে পেল সামনের একতলা বাড়ির ছাদের দিকে কালো প্যান্ট-পরা লোকটা উঠে যাচ্ছে। তার মাথা মাটির দিকে। পা দুটো একসঙ্গে বেঁধে একতলার ছাদের লোহার রডে দড়ি আটকে কপিকলের মতো দড়িতে টান দিচ্ছে কয়েকজন সৈন্য। কালো প্যান্ট-পরা লোকটার মাথা মাটি থেকে ফুট-পাঁচেক উঠে গেলে একটি কণ্ঠ বলে, ব্যাস রোখো। কেয়া, তুম জয়বাংলা নেহি হো? নেহি। সেই কণ্ঠ বলল, দো ভাই, দড়ি ছোড় দো। পাঁচ ফুট উপর থেকে প্যান্ট-পরা লোকটার মাথা শরীরের সমস্ত ওজনসহ বাঁধানো মেঝেয় এসে ঠুকে পড়ল। ঠাস করে একটা শব্দ উঠল– প্যান্ট-পরা লোকটা তার বুকের ভিতর থেকে বলল, আ! আবার তার মাথা মাটিছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তুম জয়বাংলা হ্যায় কি নেহি? কালো প্যান্ট-পরা লোকটার গলা থেকে ঘড়ঘড় আওয়াজ বের হয়। সেই আওয়াজটাকেই কথায় পরিণত করে সে বলে, বাঙালি তুমলোগোকো খতম করেগা—আভি ভাগ যাও বাঙাল মুল্লুকসে—কথা শেষ হবার আগেই আবার সেই মাটিতে কাঁচা মাংস থ্যাঁতলানোর আওয়াজ। গলি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আবার টলতে লাগল সে। মাতালের মতো দুলতে দুলতে অন্ধকার ঠেলে গলি ধরে রাস্তার ধার দিয়ে গলি গলি গলি পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত একটি একতলা বাড়ির ছোট মাঠে সে এসে দাঁড়ায়। নিচু একটি পাঁচিল দিয়ে মাঠটুকু ঘেরা, এককোণে একটি স্থলপদ্মের গাছ। সে লালা চওড়া বারান্দায় চুপিচুপি উঠে বসে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মোলায়েম গলায় ডাকল, মমতা আছ? মমতা? কেউ সাড়া দিল না। অনেকবার ডাকল সে। শেসে দরজায় হাত দিতেই দরজা খুলে গেল। ঘরের ভিতর অন্ধকার। সে ঘরে ঢুকে ডাকল, মমতা আছ? মমতা? ছোট ছেলে শোভনকেও ডাকল দু-একবার। ঘর থেকে বেরিয়ে ভিতরের বারান্দায় গেল—কেউ নেই। ওপাশের ঘর দুটোয় ঢুকল; রান্নাঘর, বাথরুমে গেল। এমনভাবে তন্ময় হয়ে সে মমতাকে ডাকছিল যে মনে হলো সে তক্তপোশের উপর হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে জিজ্ঞেস করল, মমতা কই? টেবিলের কোণে হাত বুলিয়ে আলমারির কাছ দিয়ে যেতে যেতে একই প্রশ্ন সে মনে-মনে করেছিল। তারপর ভিতরের উঠোনে নেমে এসে বাড়িটাকে সে দেখছিল। চারদিকে বড় বড় উঁচু বাড়ির চাপে এই বাড়িটাকে কুয়োর মতো মনে হচ্ছিল। অনেক বাড়ির কালো ছায়া বাড়ির উপর পড়েছিল। উঠোনের প্রায় চারভাগের তিনভাগ ঘন অন্ধকারে ঢাকা ছিল। আর শুকনো পাতায় উঠোন পূর্ণ ছিল। সে মড়মড় শব্দ তুলে পায়চারি করছিল। শুকনো পাতায় গোড়ালি পর্যন্ত ডুবিয়ে সে মরা গাছটার কাছে গেল, বুজে-যাওয়া কুয়োটার ভিতর একবার উঁকি দিল। শেষে পুরনো জং-ধরা একটি কোদালে তার হাঁটুতে জোর আঘাত লাগে। লোকটা জুতোজোড়া খুলে ফেলে দিল একদিকে, ছুঁড়ে ফেলল ফোলিও ব্যাগ। কোট, টাই আর শার্ট খুলে ফেলল একে একে। গেঞ্জির ভিতর দিয়ে তার লোমশ বুক ফুলে ফুলে উঠছিল। তার সামান্য পাগলাটে চোখের দৃষ্টি আরও গোলমেলে হয়ে উঠল। সে তার শিরাবহুল পেশল হাতে কোদাল তুলে নিল। দুবার তিনবার নাক আর মুখ থেকে হ্যাঁক হ্যাঁক করে আওয়াজ বের করে উঠোনে কোপ দিল সে। তারপর হেঁট হয়ে একটি পাঁজরের হাড় তুলে নিল হাতে। হাড়টা তলোয়ারের মতো বাঁকা। সেটা তুলে নাকের কাছে নিয়ে গিয়ে গন্ধ শুঁকলো, হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখল। তারপর আবার চলল উঠোন কোপানো। একে একে উঠে আসছে হাতের অস্থি, হাঁটুর লম্বা নলি, শুকনো শাদা খটখটে পায়ের পাতা। সে প্রচণ্ড তেজে কোদাল চালাচ্ছে। কখনও কোদাল রেখে জন্তুর মতো নখ দিয়ে আঁচড়ে যাচ্ছে মাটি। দরদর করে ঘাম ছুটছে তার সমস্ত দেহ থেকে—ঠোঁট চেটে নোনা স্বাদ নিচ্ছে সে। খুঁজতে খুঁজতে একটি ছোট্ট হাত পেয়ে গেল, সেটাকে তুলে আপনমনেই লোকটা বলল, শোভন, শাবাশ। তারপর উঠে এল দীর্ঘ চুলের রাশ, কোমল কণ্ঠাস্থি, ছোট ছোট পাঁজরের হাড়, প্রশস্ত নিতম্বের হাড়— তারপর একটি করোটি। খুলিটা হাতে নিয়ে সে ওঠার চোখের শূন্য গহ্বরের দিকে চেয়ে রইল। তার নিজের চোখ নিয়ে গেল করোটির চোখের গর্তের খুব কাছে, একদৃষ্টে চেয়ে রইল সারি সারি দাঁতের দিকে। ফাঁকা মুখগহ্বরের ভিতরে নিঃশব্দে বিকট হাসি হাসল করোটি। মমতা— লোকটা বলল। বলে সেটা পাশে নামিয়ে রেখে আবার দ্বিগুণ উৎসাহে মাটি খুঁড়তে লেগে গেল। পৃথিবীর ভিতরটা নাড়িভুঁড়িসুদ্ধ সে বাইরে বের করে আনবে।

জন্ম- ফেব্রুয়ারি ২, ১৯৩৯, ছোট গল্পকার এবং কথাসাহিত্যিক। ষাটের দশকে আবির্ভূত এই কথাসাহিত্যিক তাঁর সুঠাম গদ্য এবং মর্মস্পর্শী বর্ণনাভঙ্গির জন্য প্রসিদ্ধ। জীবনসংগ্রামে লিপ্ত মানুষের কথকতা তাঁর গল্প-উপন্যাসের প্রধানতম অনুষঙ্গ। রাঢ়বঙ্গ তাঁর অনেক গল্পের পটভূমি। তিনি বাংলা অ্যাকাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করে। এ ছাড়া ২০১২ খ্রিস্টাব্দে তিনি অসম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সন্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি পান। হাসান আজিজুল হক ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে এক সম্ভ্রান্ত এবং একান্নবর্তী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মোহাম্মদ দোয়া বখশ্, মা জোহরা খাতুন,স্ত্রী শামসুন নাহার বেগম। জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি রাজশাহীতে কাটিয়েছেন। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী সরকারি কলেজে থেকে দর্শনশাস্ত্রে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে একই প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত তিনি রাজশাহী সিটি কলেজ, সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা গার্লস কলেজ এবং দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৪ সাল পর্যন্ত একনাগাড়ে ৩১ বছর অধ্যাপনা করেন।
রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় কলেজের উদ্যমী তরুণ মিসবাহুল আজীমের সম্পাদনায় প্রকাশিত ভাঁজপত্র ‘চারপাতা’য় হাসানের প্রথম লেখা ছাপা হয়। লেখাটির বিষয় ছিল রাজশাহীর আমের মাহাত্ম্য।
খুলনায় এসে তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির উৎসমুখ খুলে গেল প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সন্দীপন’-কে কেন্দ্র করে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে নাজিম মাহমুদ, মুস্তাফিজুর রহমান, জহরলাল রায়, সাধন সরকার, খালেদ রশিদ প্রমুখ সংগ্রামী কয়েক জন তরুণের চেষ্টায় গঠিত হয়েছিল ‘সন্দীপন গোষ্ঠী’। তত দিনে অবশ্য হাসান আজিজুল হক রীতিমতো বিখ্যাত। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’-এর প্রথম গল্প ‘শকুন’-এ সুদখোর মহাজন তথা গ্রামের সমাজের তলদেশ উন্মোচিত করেছিলেন তিনি। প্রায় অর্ধশতাব্দীর গল্পচর্চায় বিষয়, চরিত্র ও নির্মাণকুশলতায় উল্লেখ করার মতো গল্প হাসান আজিজুল হকের অনেক। এ সবের মধ্যে রয়েছে ‘শকুন’, ‘তৃষ্ণা’, ‘উত্তরবসন্তে’, ‘বিমর্ষ রাত্রি, প্রথম প্রহর’, ‘পরবাসী’, ‘আমৃত্যু’ ‘আজীবন’, ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘খাঁচা’, ‘ভূষণের একদিন’, ‘ফেরা’, ‘মন তার শঙ্খিনী’, ‘মাটির তলার মাটি’, ‘শোণিত সেতু’, ‘ঘরগেরস্থি’, ‘সরল হিংসা’, ‘খনন’, ‘সমুখে শান্তির পারাবার’, ‘অচিন পাখি’, ‘মা-মেয়ের সংসার’, ‘বিধবাদের কথা’ ‘সারা দুপুর’ ‘কেউ আসেনি’।
‘আগুনপাখি’ নামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। উপন্যাসটি বর্ষসেরা উপন্যাসের স্বীকৃতি লাভ করে।