Hasan Azizul Huq short story writer

প্রবন্ধ: অধরা বাঙালি সংস্কৃতির খোঁজে । হাসান আজিজুল হক

Reading Time: 9 minutes

‘এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গে ভরা’ – কথাটা খুব লাগসই।  বাঙালি জাতি, বাঙালি সংস্কৃতি এবং ইতিহাস এত বিচিত্র পর্যায়ের ভেতর দিয়ে গিয়েছে যাকে এইরকম একটা বাক্য ছাড়া ঠিক বোঝানো যায় না। আমি বৃহৎবঙ্গের কথা ছেড়ে দিচ্ছি, সেটা কবেকার কথা। বৃহৎবঙ্গ কোনোদিন একসঙ্গে যুক্ত বৃহৎবঙ্গ ছিল কিনা সেটা একটা জরুরি প্রশ্ন। বিশাল বাংলাদেশকে একেক নামে অভিহিত করা হতো। নাম ছিল তাদের বরেন্দ্র, বঙ্গ, সমতট, রাঢ় ইত্যাদি। প্রত্যেকের আলাদা অস্তিত্ব ছিল, স্বতন্ত্র শাসনব্যবস্থা ছিল। যোগাযোগ তখন নিশ্চয়ই এখনকার মতো এত বেশি ছিল না। কাজেই এরা প্রায় সবই ছিল বিচ্ছিন্ন। ফলে, যে বাঙালি সংস্কৃতির কথা বলি সে-সংস্কৃতিকে আদিতে স্থানিক সংস্কৃতি বলা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ার সঙ্গে আমাদের চেনা সংস্কৃতি মেলানো যাবে না; কিংবা বাঁকুড়ার সংস্কৃতির সঙ্গেও আমাদের চেনা সংস্কৃতিকে মেলানো যাবে না। আমাদের বাংলাদেশের কথা বাদ, ওটা আলাদা রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে, কিন্তু ওই দেশের লোকেরাই বলতে পারে না যে, শান্তিপুরের সংস্কৃতির সঙ্গে, ভাষার সঙ্গে কী সম্পর্ক বাঁকুড়ার বা বীরভূমের। সত্যিই তাই, এই বৈচিত্র্যের কোনো শেষ নাই। সেজন্যেই বলছি, বাংলাদেশে সেই অর্থে যেমন বৃহৎবঙ্গ কোনো কালেই ছিল না, তেমনি এক বাঙালি সংস্কৃতি বলেও কিছু ছিল না।

আকবরের সময়ে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা মিলে একটা সুবে বাংলা হয়েছিল। সেটা বহুকাল টিকল। ঔপনিবেশী শাসনেও সেটা অক্ষত ছিল বহুকাল। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ শাসক সেটা ভাঙার চেষ্টা করেছিল কিন্তু তাতে সফল হয় নি। সত্যিকার বিভাজন ঘটলো ১৯৪৭ সালে। ভূগোলে যে-দাগ পড়ল তাতে জমিতে কেমন ফাটল ধরল জানি না, তবে দুই বাংলার সংযুক্ত বাঙালি সংস্কৃতি বলতে যা ছিল সেটা দু-টুকরো হলো। তাতে লাভ-লোকসান কিছু হলো কিনা তার হিসেব আমরা কখনো করি নি। বাঙালি-সংস্কৃতির আধখানা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে – বাকি আর্ধেক নিয়ে বাংলাদেশও বেশ সন্তুষ্ট। হ্রাস-বৃদ্ধির কোনো কথা নেই। অসংজ্ঞায়িত, অস্পষ্ট, কথার কথা, বাঙালি সংস্কৃতি, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি। তাতে জাতীয়তাবাদও আছে। ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটিকে আমি খুব সন্দেহের চোখে দেখে থাকি। এটা যে-কোনো সময়েই খুব আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের সে সামর্থ্য নেই যে একটা আগ্রাসী বাঙালি জাতীয়তাবাদ চালু করবে। আমরা যখন বাঙালি জাতি বলি এবং বাঙালি সংস্কৃতি বলি, তখন একটা জিনিস অনুক্ত থেকে যায় যে, এই বাংলাদেশে তো শুধু বাঙালিরাই বাস করে না। বাংলাদেশের উত্তরাংশে সমতলভূমির বাঙালি আছে, আদিবাসীরা আছে। এ নিয়েও তক্কাতক্কির অবধি নেই যে, এদের আদিবাসী বলা হবে, না এদেরকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলা হবে। তাছাড়া নানা পাহাড়ি জাতি আছে। আমরা যে ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ করি, এ-ব্যাপারে অনেককে আপত্তি করতে দেখেছি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, আদিবাসী, পাহাড়ি জাতি আছে, তাদের সংস্কৃতিকে তো অস্বীকার করা হয়। তখন কী করে মেলানো যাবে? ‘এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গে ভরা’ এই কথাটা তখন বোঝা যায়। একটু আগে যে-সমস্যার কথা বললাম এই সমস্যা তো সব দিক থেকেই উঠে এসেছে, মানে এই বিশাল বাংলাদেশে তা বহুকাল ধরেই চলছে। কাজেই সংস্কৃতির ব্যাপারে আমরা এখনো কোনো ফয়সালা করে উঠতে পারি নি। আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি, আরো বলি বাংলা ভাষা আমাদের জাতিত্ব ও জাতিসত্তার ভিত্তি। এর ভিত্তি ধর্ম নয়, আমরা সবাই বাঙালি জাতি। কোনো সন্দেহ নেই, ‘আমরা সবাই বাঙালি’ এই কথার সঙ্গে ‘সংস্কৃতিগতভাবে আমরা সবাই বাঙালি’ – এই কথাটার কিছু পার্থক্য রয়েছে। বাংলাদেশে যারাই বাস করে তারাই বাঙালি, এই কথাটি বোধহয় বলা চলবে না। কারণ বাংলাদেশে নানা জাতি সংস্কৃতির মানুষের বসবাস রয়েছে। এখন যেমন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলির সংস্কৃতির কথা উঠছে, ঠিক তেমনি করে বলা চলে বরেন্দ্র-সংস্কৃতির বিশিষ্টতার কথা। বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে বোঝা যায় যে, এখানে যেমন ভিন্ন ভাষাভাষী লোক রয়েছে, তেমনি বাংলা ভাষাভাষী লোকদের মধ্যেও বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে একটা প্রবল বিতর্ক রয়েছে। সেই জন্য এখন মূল প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে আমাদের কাছে ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ কী? একে অখন্ড বলা যায় কি না? অখন্ড বললে তাকে কোন অর্থে অখন্ড বলি? স্রেফ ভাষাভিত্তিক একটা জাতি, যে বাংলা বলে সেই বাঙালি, আর তার সংস্কৃতি? ব্যাপারটা অবিকল এক হতে পারে না; যে বাংলা বলে সে বাঙালি হয়ে ধর্মীয় সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করতে পারে, বাঙালি সংস্কৃতিকে আদৌ গুরুত্ব না দিতে পারে। আসলে বাঙালি সংস্কৃতি বলতে কী বুঝি, তা এখনো পরিষ্কার করি নি। এই একটা দিক, আর অন্য আরেকটা দিক হচ্ছে সংস্কৃতি কি অবিকল এক হয়? একটা বিশাল জনপদে স্থানবিশেষে তার পরিচয় বদল হয় না কি?

‘বাঙালি সংস্কৃতি’ এখন একটা মুখ-চলতি কথা। এ-কথা বলার অধিকার এখন আমাদের ইতিহাসেরই অঙ্গ – একাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর। এখনকার পৃথিবীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি বিচিত্র উদাহরণ। আমেরিকান জাতি বলে বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কোনো জাতি নেই। এত বিভিন্ন দেশের, এত বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মানুষ এখানে এসে জীবনযাপন করেছে যে, সাত ভেজালে আসল বলে আর কিছু নেই। আমেরিকান জাতি বলে কিছু নেই। আমেরিকান সংস্কৃতি বলে কিছু নেই। আমেরিকান বলতে জাতিত্ব বোঝায় না, তেমনি জাতীয় সংস্কৃতি বলেও তার কিছুই বোঝায় না। ইউরোপের সব দেশের লোক, আফ্রিকার লোক, আমেরিকার লোক, লাতিন আমেরিকার লোক সব ওই জায়গায় গিয়ে হাজির হয়েছে। তারা ‘আমেরিকান’, এছাড়া কিছু বলবে না এবং সংস্কৃতি নিয়ে এইসব আলোচনার মধ্যেও তারা নেই। কিন্তু সংস্কৃতির প্রশ্নটিকে পাশ কাটানোর কোনো উপায় আমাদের নেই। কারণ আমাদের একটা বিশাল ইতিহাস রয়েছে, সেখানে আমাদের সংস্কৃতির একটা বড় স্থান আছে। কাজেই বাঙালি সংস্কৃতির প্রশ্নের সমাধান আমাদের করতেই হবে। বাংলাদেশের নতুন নাগরিক যারা, তারা তাদের আত্মপরিচয়ের জায়গাটাকে খুব স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছে না। আত্মপরিচয়ের জায়গাটা তাদের শূন্য। কিন্তু কিছুই কোনোদিন শূন্য থাকে না। ভ্যাকুয়াম থাকবে না, ভরবেই। এখন যদি আমাদের পরিবারের মধ্যে, আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থার মধ্যে আমাদের রাষ্ট্রের ভাবনা নিজের জাতিসত্তার পরিচয়টা না থাকে, তাহলে আমাদের সন্তান যারা, তাদের কোনোদিন এই জাতিসত্তা গড়ে উঠবে না। আজ গোটা বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে দেখা যায়, এই বিষয়টা সম্বন্ধে আমরা নিজেরাই বুঝি না। ঠিক কথা বলতে গেলে, বোঝেন না তা নয়, এই প্রশ্নের তোয়াক্কাই করেন না। আমি জানি না এটা অল্প ক্ষতি, না কি বড় ক্ষতি। একটা দেশের মানুষ তার আইডেন্টিটিটা জানে না, এবং গর্ব ও অহংকার করার জায়গা হবে তার বিদেশ, বিদেশি সংস্কৃতি! এর চেয়ে ভয়ংকর কিছু আমি ভাবতে পারি না।

সংস্কৃতি নিয়ে এসব এলেমেলো কথা যে আমি বললাম, তাতে একটা প্রশ্ন পরিষ্কার করে তোলা যায় কি? অখন্ডতা কতদূর পর্যন্ত যায় এবং এটা যদি ঐতিহাসিকভাবে আমরা দেখি, তাহলে ঐতিহাসিকভাবে এই অখন্ডতার কথা তোলা যায় কি না? যদি তুলতে পারি, তাহলে সেগুলোর সাধারণ উপকরণ কী কী, যার ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি এটাই আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বা চিত্র? সংস্কৃতি যে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল সেটা মেনে নিয়েও এখানে এমন কিছু কি পাওয়া যাবে যে আমরা বলতে পারব, এই হচ্ছে একটা সুনির্দিষ্ট সংস্কৃতি। সেটা বার করতে হবে কী করে? যে-জিনিসগুলোর কথা আমরা বলতে পারি, সেগুলো জীবনযাপনের সঙ্গে যুক্ত। তাই জীবনযাপনটা যদি বদলায় এগুলোও বদলে যাবে। তার মানে এগুলোকে যদি সংস্কৃতির অঙ্গ করি তাহলে সেগুলোও বদলে যাবে। যেমন ধরুন মাপের কাঠা, সেটা বেত দিয়ে তৈরি করা, এক কেজির একটু কম। পেতলের কাঠাও আছে কারুকাজ করা। তারপর ধরুন নানান রকম কারুপণ্য যা পৃথিবীর অন্য কোনো জায়গায় নেই। সেদিক থেকে, এই কারুপণ্যের ধরনটা থেকে সংস্কৃতির বিশেষত্ব এখানে যে, এটা বাঙালিরা করে; আরো এরকম বহু জিনিস আছে, যেগুলো বাঙালিরাই করে। তারপরও আমরা তত্ত্বগতভাবে যদি বলি তাহলে বলতে হবে, ‘বাঙালি সংস্কৃতিটা ঠিক কী’ এই প্রশ্নটা আজো আমাদের সামনে আমরা রাখি নি, তার উত্তর খুঁজি নি এবং যেহেতু উত্তর খুঁজি নি সেজন্যই উত্তর পাই নি আর উত্তর পাই নি বলে আমারা এরকম এলোমেলো অবস্থায় রয়ে গেছি। আমরা আস্তে-আস্তে সংস্কৃতিহীন হয়ে গেছি। কোনো সংস্কৃতি নেই মানে সংস্কৃতিহীন। অথচ বুদ্ধিজীবীদের মুখে এত কথা শুনি যারা আমাদের শাসনের দায়িত্বে আসেন, তাঁরা কখনো এই প্রশ্নগুলো অ্যাড্রেস করেন না। তারা অনেক কিছুই অ্যাড্রেস করেন না। বাংলাদেশের সতেরো কোটি মানুষের জন্য রাষ্ট্র কী করছে না করছে এসব জিনিস তো ছেড়েই দিলাম। কিন্তু এর থেকে সূক্ষ্মতর জিনিস এই সংস্কৃতির প্রশ্নটা। এটাকে তারা কোনোদিন গুরুত্বপূর্ণ করেন বলে মনে হয় না। ধরে নেওয়া যাক বাংলাদেশের সংস্কৃতিকেই বাঙালি সংস্কৃতি বললাম। যেসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কথা বললাম, তারাও বাদই থাক। ১৯৭১ সালে যে-বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি, সেই বাংলাদেশকে সামনে রেখে আমরা বাঙালি সংস্কৃতির কথা বলতে চাইছি। কোথায় কীভাবে আমরা সেটাকে ব্যাখ্যা করেছি? আমাদের কাজের ভেতর দিয়ে আমরা কখনো সেটাকে ব্যাখ্যা করেছি কি না? দেশে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, নববই ভাগ, যাদেরকে আমরা গণমানুষ বলে থাকি, আর দশ ভাগ উচ্চবিত্ত উচ্চ-মধ্যবিত্ত মানুষ – এই দুই ভাগের মধ্যে সংস্কৃতিগত কোনো পার্থক্য কি আছে? আবার এই দশভাগের মধ্যেও যারা উচ্চবিত্ত তাদের সঙ্গে কোনো সংস্কৃতিরই সম্পর্ক আছে কি? এদেশে শিল্পবিকাশ ঘটে নি। বিদেশের অর্থে তৈরি পণ্য বিক্রি করা এই আমাদের কাজ, শস্তা শ্রমটা বিক্রি করে দেওয়া। উৎপাদন করছি ঠিকই, পুঁজি বাড়াইনি। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে কি পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করতে পারি? আমরা কি বলতে পারি আমাদের এই সংস্কৃতি আর বিশাল বাংলাদেশের সংস্কৃতি এক? নাকি কোথাও একটা শ্রেণিবিভাজন করতেই হয়? আমাদের সংস্কৃতির কি নিপাট একটাই চেহারা, না কি তার মধ্যেও প্রচুর ভাগ আছে? ভাগগুলো কিসের ভিত্তিতে? উচ্চবিত্তের একটা আলাদা সংস্কৃতি আছে, জনসাধারণের, সাধারণ মানুষের, তাদেরও আলাদা একটা সংস্কৃতি আছে? এগুলো ভিন্ন ভিন্ন কি না? উত্তর যদি হয়, হ্যাঁ, তা-ই তো, ভিন্ন ভিন্নই বটে, এগুলো তো আলাদা। তাহলে কি আমরা বাঙালি সংস্কৃতির কথা একটানে বলতে পারি? বাঙালি সংস্কৃতি যা সবাইকে একই বৃত্তের অন্তর্ভুক্ত করে নি, তাকে এক বাঙালি সংস্কৃতি বলাও যায় না। পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, আমরা নানানভাবে উদ্যাপন করি, বিজয় দিবসের উৎসব করি, তারপরও কি এইসব উৎসব সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে? জনসংস্কৃতি বা গণসংস্কৃতি – সারাদেশ কি তাতে অংশ নিতে পারে?

পহেলা বৈশাখ হচ্ছে নববর্ষের উৎসবের দিন। অথচ গোটা দেশ নিঝুম হয়ে রয়েছে, এবার আমি নিজের চোখে দেখেছি, যারা শিক্ষিত মানুষ, সোজা কথায় ‘অন্নচিন্তা চমৎকারা’ জিনিসটা যাদের নেই তাদেরই দখলে বাঙালি সংস্কৃতি। সবচেয়ে বড় জিনিস হচ্ছে অন্নচিন্তা, এই জিনিসটা যাদের নেই, তারাই উৎসব করতে পারে। দশটা গ্রাম ঘুরে বেড়ালাম। নিশীথরাতের গ্রামগুলো নিঝুম মতো। সংস্কৃতি করবার জন্য সংগতি লাগে? সাধারণ মানুষকে অন্ন-বস্ত্র দিতে পারব না, কৌপীন পরে থাকবে, গৃহ দিতে পারব না, গৃহের দায়িত্বও নেব না। সে নিজে যদি পারে, কোথাও একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে নেবে। তার বাপের বাপের কাছ থেকে যদি এক আশ্রয় টুকরো জমি পায় তো সেটুকুতেই সে থাকবে। এই মানুষটিকে সারাদিন খেটে মজুরি হোক, চাল-ডাল হোক, তাকে নিয়ে আসতে হয় সংসার চালানোর জন্য। এই লোকটিকে কি আপনি বলতে পারবেন, ‘তুমি এত সংস্কৃতিহীন কেন?’ আপনার বলতে লজ্জা হবে? না কি হবে না? অর্ধউলঙ্গ এই মানুষটিকে তখন কি আপনি বলতে পারেন, আপনার সন্তান স্কুলে যায় না কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় না কেন? আপনার সন্তান ঢাকায় যায় না কেন? ওর সংস্কৃতি ওর মাথায় উঠেছে। আমরা যাকে এখন সংস্কৃতি বলছি, সেটা দেশের মধ্যবিত্ত বা বড়জোর নিম্ন-মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি। এর বেশি আমরা এগোতে পারি নি। এদিক থেকে গোটা বাংলাদেশ একটা আদিম জায়গায় পড়ে রয়েছে। আপনি যদি খুশি হয়ে সেটিকে বাঙালি সংস্কৃতি বলেন, আপনি খুশি হোন, আমি খুশি হতে পারব না। আপনি যদি বলেন গরুর গাড়ি, মোষের গাড়ি এগুলো বাঙালি সংস্কৃতি, তাহলে আমি বলব, তাহলে সেই জমিদারকেও ফিরিয়ে নিয়ে আনুন। সবাই মাটিতে বসে আছে, একটা মাত্র চেয়ার খালি। যাত্রা শুরু হচ্ছে না, জমিদারবাবু এসে সেই চেয়ারটায় বসবেন, তাহলে যাত্রা শুরু হবে। আপনি সেই মানুষটাকে, সেই কালটাকে ফিরিয়ে আনতে চান কি? জিনিসটা দাঁড়াল এই, দেশের যে-সম্পদ তার যদি মোটামুটি সমবণ্টন না হয়, তাহলে সমগ্র জনগণের একটা সংস্কৃতি দাঁড়াতে পারে না। নিরন্ন মানুষকে কোনো সংস্কৃতির অধিকারী বলতে পারি না। এটা সম্পূর্ণভাবে মিথ্যে কথা, বাজে কথা, এ-কথা যে বলতে পারে, সংস্কৃতি সম্বন্ধে তার কোনো চিন্তাও নাই। আমরা যে-সমস্ত আলোচনা করি এবং আজকে আমি যে এই বক্তৃতা করছি তাতে বাঙালি সংস্কৃতির উন্নতি হবে না, যা আছে তা-ই থাকবে। উন্নত সংস্কৃতির জন্য উন্নত সমাজ তৈরি করতে হবে। উন্নতির ভাগ দিতে হবে সবাইকে। আমি এই কথাটিই বলার জন্য বলছিলাম যে, সংস্কৃতি কি এক? কুমার সে মাটির জিনিস তৈরি করছে, কামার লাঙল বানাচ্ছে, আমি বুক ফুলিয়ে বললাম, এই আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি। এটা বলা কি এক অর্থে সব পুরাতনকে টিকিয়ে রাখা নয়? প্রাচীনত্বকে ধরে রাখা নয়? আমি কি পারলে এই কামারকে ইঞ্জিন দেব না? সে নিজে ইঞ্জিন দিয়ে যদি তৈরি করতে পারে তো করুক। আমি কি বলতে পারি, আমি ট্রেনে চড়ব না, বাসে চড়ব না, আমাকে গরুর গাড়ি দিতে হবে। আমি কি বলতে পারি, আমার এই স্যানিটারি বাথরুমটা চাই না, আমি মাঠে গিয়ে প্রাতঃকৃত্য সারতে চাই। সেটা কি করতে পারব? সংস্কৃতি এমন একটি ইলাস্টিক জিনিস, এত পরিবর্তনশীল। আমার এই দীর্ঘ বক্তৃতায় বাঙালি সংস্কৃতি চারিত্র্যটাই ধরতে পারছি না। বাঙালি সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য কী? ওই শেষ পর্যন্ত ‘এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গে ভরা’র মতোই। বাঙালি হিসেবে আমার বলতে বাধা কী যে, গোটা পৃথিবীর সংস্কৃতিটাই আমার। আমার পরিচয় হচ্ছে ‘বিশ্ব আমার স্বদেশ, মানুষ আমার স্বজন’। আমাদের বিদ্যালয়ে, আমাদের কলেজে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমাদের পাঠশালায় এ-সম্পর্কে কোনো ধারণা দেওয়া হয়? দেশের প্রাথমিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মতো এলেমেলো পাঠ্য-ব্যবস্থা আমি আর কোথাও দেখি নি। বাস্তবে দেখা যাবে সংস্কৃতিবিহীন অথবা অতিপুরাতন জিনিসগুলোকে কোনো রকমে ধরে রেখে মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। সবাই এখনো পাওয়ার টিলার ব্যবহার করতে পারে না। পাওয়ার টিলার বেশিরভাগই ধার নেওয়া হয়। যার জমি নেই, টাকা নেই, কিচ্ছু নেই, পানি তোলার মেশিনটা তারই। এরকম পরিস্থিতিতে বাঙালি সংস্কৃতির কথা তোলাটা আমার কাছে বে-শরমের কাজ বলে মনে হয়। লোকজনকে এতটা বঞ্চিত রেখে কোনো সংস্কৃতির কথা বলা যায় না। সংস্কৃতির সঙ্গে সমাজের সাধারণ যে-অবস্থা, তার একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। উন্নত সমাজের এক অংশ একটু তলায় পড়ে রয়েছে আর এক অংশ অনেক ওপরে উঠে গেছে। তার নিচে অগণন জনগণের কোনো সংস্কৃতি নাই। কিন্তু এটা কেউ মুখফুটে বলেন না। আমি যে বাঙালি সংস্কৃতির কথা বলছি, সেটা কাদের সংস্কৃতি? এই যে আমার গাড়ি-বাড়ি ব্যবসা-বাণিজ্য বিত্ত-সম্পত্তিই বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিভূ। এটা বুঝতে কার্ল মার্কস লাগে না। চাষার কাছে আবার রবীন্দ্রসংগীত কী? কত বড় অন্যায় কথা আমি বললাম! চাষা তো ঠিক আপনার মতোই মানুষ, আপনি যেভাবে লেখাপড়া করেছেন, সে যদি তেমন লেখাপড়া করত, আপনার মতোই হতো। আপনি যেভাবে রবীন্দ্রসংগীত পছন্দ করেন, সেও তা করত। একবার আমি চেষ্টা করেছিলাম আমার কাজের ছেলেটাকে নিয়ে। তাকে বললাম, রবিউল, ‘তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা’ – যদি কারো স্ত্রী মারা যায়, তার ছবিটা যদি টাঙানো থাকে, যদি তার দিকে তাকিয়ে কেউ বলেন – ‘তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা’, বুঝতে পেরেছিস? ‘আমি কিছু বুঝলাম না।’ এই যে বুঝবে না, সেটা কেন হলো? আপনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন, আমি পরীক্ষা করে দেখেছি। কাজেই আমি নিঃসন্দেহ, বাঙালি সংস্কৃতি বিভক্ত, এমনকি বিভক্ত বাংলাদেশি সংস্কৃতিও। অন্য হিসাব করেও দেখেছি, বাঙালি সংস্কৃতি নানান ভাগে বিভক্ত। এখন বলতে পারি, শতধাবিভক্ত এই বাংলাদেশের সংস্কৃতি। এটা খুব দুঃখজনক, একদিক থেকে স্বাধীন রাষ্ট্রের একধরনের ব্যর্থতা। রাষ্ট্র একটা সংস্কৃতি তৈরি করতে পারছে না। সে এখনো পর্যন্ত নিজেরা যা বুঝছে না সেই কথাটাই বলছে যে, আমরা সবাই বাংলাদেশের সংস্কৃতি ধারণ করি। আমরা মধ্যবিত্তরা সেই ঘোরে থেকে – যেহেতু আমরা শ্রম থেকে মুক্ত – বাঙালি সংস্কৃতির কথাটা চালিয়ে যাচ্ছি। সংস্কৃতি একটা প্রবহমান জিনিস, পরিবর্তিত হয়, পুরনো সংস্কৃতির অনেক অংশ বাদ পড়ে যায়। সেটি অনেকটা জলছাপের মতো, ছাপটা হয়তো থাকতে পারে, আর কিছুই থাকে না। তবু তা সংস্কৃতিরই অংশ। তার ভেতরে অখন্ডতা আপাতভাবে দেখি না,  কিন্তু খুঁজে দেখা যেতে পারে। বাঙালি জনগণ – গোটা বৃহৎবঙ্গের কথা বলছি। তার মধ্যে কোনো কমন বৈশিষ্ট্য আছে কি না, যেটা ঘটে পটে, প্রকাশ পেয়েছে, গৃহ নির্মাণে প্রকাশ পেয়েছে, চাষাবাদে প্রকাশ পেয়েছে, ফসলের প্রকারে কতভাবে প্রকাশ পেয়েছে, কামারের কাজে, কুমারের কাজে, চামারের কাজে। এই সংস্কৃতির বিশেষত্বগুলো বার করতে হবে। পুরনো সাহিত্যে আমরা নিদর্শন খুঁজি বাঙালিরা কেমন ছিল। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’, বোঝা যায়, এখানে গো-পালনের একটা বড় জায়গা ছিল, দুধভাত খাওয়াটা একটা বড় ব্যাপার ছিল এবং সেটা যারা সম্পন্ন তারাই করতে পারত। তাহলে কী সেই বৈশিষ্ট্য যা একজন অবাঙালিকে বাঙালি করে তোলে, তা খুঁজতে হবে। আর খুঁজতে হবে বাঙালি সংস্কৃতির এক অখন্ড চেহারা? বঞ্চিতের সংস্কৃতি, প্রতারিতের সংস্কৃতি, হতদরিদ্রের সংস্কৃতি, যে-কোনোমতে খাদ্য বস্ত্রের সংস্থান করে তার সংস্কৃতি – এসব সংস্কৃতি কি এক? শেষ পর্যন্ত সমাজের চেহারা সমাজের কাঠামো এবং রাষ্ট্রের চরিত্রের সঙ্গে সংস্কৃতির যোগ অবশ্যই থাকে, সেটা এড়িয়ে যাবার করার কোনো উপায় নেই। এটা যখন সোনার বাংলা ছিল, তখনো ছিল, যখন আমরা প্রাচীন বাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতির কথা বলছি তখনো ছিল, এখনো আছে।

 

লেখা, না-লেখা গ্রন্থ থেকে)

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>