দাহ শেষে অস্থিমাংসমজ্জা পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও ধিকিধিকি যে-আগুন জ্বলে ছাইগাদায়, তার মধ্যে কোথায় লুকিয়ে থাকে নাভিকুন্ডলিটি! ঘড়া-ঘড়া জল ঢেলে পুরোপুরি আগুন নিভিয়ে ফেলে শ্মশানবন্ধুরা আর চাঁড়াল, তবু লুকিয়ে থাকে নাভিপিন্ড ভেজা কালো ছাইয়ের আড়ালে। তারপর জাগে। ফিরিয়ে দে আমার তনু, ফিরিয়ে দে, আরো বাঁচব, অস্থিমাংসমজ্জা ফিরিয়ে দে। এই যে জটলা পাকিয়ে আমি রয়েছি আমারই নাভিমূলে।
দুর্গাপদ পাথর বা মাটির চাঙরে আটকে থাকা বেনারসিটা নিয়ে পোঁটলা পাকিয়ে আন্দাজে ছুড়ে দিলো নাভিকুন্ডলির দিকে। ছাড়া পেয়েই সেটা ময়ূরীর মতো পাখা মেলল, দুলতে-দুলতে, ঢেউ দিতে-দিতে, চাঁদের আলোয় ভাসতে-ভাসতে পুরো খুলে ছাইগাদার ওপর বিছিয়ে পড়ল। দু-এক টুকরো কাঠ তখনো ছাইয়ের ভেতর থেকে ফোঁসফাঁস নিশ্বাস ছাড়ছিল। চাঁদ চোখের পাতা ফেলে একটু সময়ের জন্য চোখ বুজেই থাকল। জ্যোৎস্নায় আবার যখন সব একা একা ঝকঝক করতে থাকে, ছাইগাদায় তখন কাঁপন। আস্তে আস্তে উঠে বসছে এক কুমারীকন্যা। কোলের ওপর জড়ো করা লাল নকশি বেনারসি। সেই শাড়ি হাতে উঠে দাঁড়ায় সে, কত সময় নিয়ে গায়ে জড়ায়, আঁচল কাঁধ থেকে ঝুলে পড়ে কিন্তু মাথায় দেয় না এতটুকু ঘোমটা। ঘাড়টা তোলে সাদা রাজহাঁসের মতো। নিজেই এগিয়ে আসে দুর্গাপদদের দলের কাছে। ফিরতে দিলে না তোমরা! আর ফিরব না আমি।
এবার আর কাঁধে বইতে হবে না সাবিত্রীকে। আর সে হাত-পা ছুড়বে না। আর তার শাড়ির আঁচল ভুয়ে লুটোবে না। যে এলো-খোঁপাটা এখন সে বেঁধে নিয়েছে, সেটা আর এলিয়ে পড়বে না। তবে সারামুখে তার আঁকিবুঁকি, সেখানে কিছু জল আছে, কিছু কাজল আছে, কিছু সিঁদুর আছে। টকটকে লাল রঙের কিছু আঁচড়ও আছে; রক্তের না সিঁদুরের, বলা যায় না। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সাবিত্রী, তিনদিকে তারা তিনজন, তিনটে ষন্ডা শুয়োর। একমাত্র সাবিত্রীরই মাথা উঁচু, বাকিরা মাথা নামিয়ে আছে।
অজয় তারা পেরিয়েছে, লাল বালি-কাঁকর পেরিয়ে উঠে পড়েছে উঁচু পাড়ে। ঘাসজমির এলাকাটা পেরুতেই সব আবার ঠিকঠাক হয়। বেহায়া চাঁদটা আবার বেহায়া হয়ে ওঠে, ঠান্ডা কনকনে হাওয়া বইতে থাকে। এখন সাবিত্রী আর একবার বাড়িতে ফেরার জন্যে বায়না ধরতে পারে। যতক্ষণ না সেটা হয়, দুর্গাপদরা ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। সাবিত্রীর দিকে চেয়ে দেখারও সাহস পায় না তারা। তাদের শিশ্নগুলি একেবারে গর্তে ঢুকে পড়েছে। নিরেট তালাবদ্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তারা!
খাসজমিটা শেষ হয় যে কেমন করে! এইখানকার ঘাসের পাতাগুলো তলোয়ারের মতো, তারপর মুথো ঘাস, তারপর বেনা ঘাস। দূর্বা নেই, ওরা বালির ওপর জন্মায় না। ওদের আবার একটু আড়াল দরকার, নির্জনতা দরকার, খানিকটা ভেজা ভেজা মাটি আর ছায়ারও দরকার। তবে যেখানে এসে তারা পৌঁছুলো, সেখানে তখন অজয়ের পাড়ে সবই ঠিকঠাক আছে, বড় গাছগুলোর তলায় দূর্বারা চটের মতো বিছিয়ে রয়েছে, এখনো কোনো পথ তৈরি হয়নি। দুর্গাপদরা বালির ওপর, ঘাসের ওপর, নিজের নিজের ছায়া দেখতে-দেখতে যাচ্ছিল – দূর্বাঘাসের হিম ঠান্ডা জালে পা জড়িয়ে যেতেই হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নেয় বটা, ইদিকে কোনো পথ নেই, যাচ্ছিস কোথা তেলা (দুর্গাপদর ডাকনাম) ?
পথ ধরে যাবি কোথা ? দুর্গাপদই উলটে তাকে জিজ্ঞেস করে। তোর বাড়িতে নিয়ে যাবি ? মাকে বলবি গিয়ে, এই যে বামুনের বে হওয়া মেয়ে এনেছি পেত্যেক রাতে ভোগে লাগানোর জন্যে। খাইয়ে-দাইয়ে ঘরে রেখে দাও।
কী বলচিস কী দুর্গা ? মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে তোর ?
না, মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল, এখন ঠিক হয়েছে। হ্যাঁ রে নচ্ছার পাঁঠা, ওকে নিয়ে কি গাঁয়ে যাওয়া যাবে ? থাক শালারা, এখেনে কুকুরের মতো আঠাকাঠি লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাক সবার সামনে।
তাই তো বটে, তাহলে কী করা যায় বল দিকিনি দুগ্গা – এবার সবুর কথা বলল।
তুমি তো শালা সবুর, মেওয়া খাবার জন্যে বসে আছো ? তোর বাড়িতে নিয়ে যাবি ? যা, নিয়ে যা। আমি বাড়ি যাই। চল্ পথে ফিরি।
আরে বাবা, আমার বাবারও সাধ্যি নই-ই মেয়েমানুষ নিয়ে বাড়িতে যাই। হিঁদু-মোসলমানে দাঙ্গা শুরু হয়ে যাবে।
দূর্বাঘাসের জালপাতা জায়গাটা পেরোনো হলো। এবার অজয়পাড়ের বন শুরু। বড় গাছপালা কম, কখনো একটা পাকুড়, একটা বট বা অর্জুন। ঝোপঝাড়ই বেশি। বনকুলের বন, বঁইচির ঝাড়, আঁকশিকাঁটার জঙ্গল, অনেকটা দূরে অজয়ের বালির চড়া, নিচে কালো স্রোতের ছোট ছোট ঢেউ চকচকে ইস্পাতের মতো ঝলকাচ্ছে।
তাহলে কোথায় নিয়ে ফেলবি এই রাতে ? কোনো গাঁয়ে তো ঢোকা যাবে না।
আর কাজ নেই দুগ্গা – চল ফেরত রেখে আসি – বটা করুণ গলায় ককিয়ে ওঠে।
ঢ্যামনামি পেইচিস ? শ্রীকেষ্টপুরের সব মানুষ জেগে বসে আছে। ঠেঙিয়ে মেরে ফেলবে।
তবে চল, এইখানেই রেখে পালাই।
সাবিত্রী শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। এত নষ্ট শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবো ? সেই লোকটা, তার স্বামী দুকড়ি বাড়িতে এসে বসে আছে, বাড়ি ফিরলেই তো আমাকে ছাড়বে না। আজই আবার এই শরীর শাড়ি-সায়া-ব্লাউজ খসিয়ে মেলে ধরতে হবে, একটি সুতো থাকতে দেবে না গায়ে। ওদের ঘেন্না-পিত্তি কিছু নেই, শরীর পেলেই হলো। শরীরও নেবে আবার ঘেন্নাও করবে। তারপর কালই তাড়িয়ে দেবে বাড়ি থেকে। জন্মেই মাকে খেয়েছি, বাবাটা যে কোনোদিন ছিল, তা-ই মনে পড়ে না। ফিরে যাব, ফিরে যাব, উঃ, আমি ফিরে যাব, যাই। এখুনি যাই। কিন্তু ফিরলেই তো ফেরা হবে না, বাড়িতে থাকলেও তো থাকা হবে না।
বাড়িতে রেখে আয় আমাকে – বাতাস ফুঁড়ে আকাশে পৌঁছুল তীব্র তীক্ষ্ণ চিৎকার। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। একমাত্র সে-ই জানে, কতটা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক চুল তাকে সরাতে পারবে না কেউ। একটু চমকে উঠেছিল বটে দুর্গাপদরা।
এখানে রেখে গেলে দুদিন পরে নয়, কাল থেকেই ইহজীবনের জন্যে জেলের ঘানি টানতে হবে। ফাঁসিও হতে পারে বটা। কী সবুর, ফেলে যাবি নাকি ? তোরা এখান থেকে পালালেই আমি সোজা নানুরের থানায় যাবো। একদম দেরি করব না। দুর্গাপদ এতক্ষণে নিজেকে ফিরে পেয়েছে। বটা, সবুর, ভালো চাস তো ওকে নিয়ে চল এখান থেকে।
কোনদিকে যাবো বল ?
যেদিকে দুচোখ যায় –
চোখ যে কোনোদিকে যাচ্ছে না তেলা।
এখান থেকে বেরিয়ে চল বলছি। হারামজাদারা শুধু মজা মারতে এয়েছো ? মজা মারছো যা দিয়ে, তার তলায় পোঁদের ফুটো দিয়ে আছোলা বাঁশ যাবে জানো না তো! আয়, ওকে নিয়ে আয়।
এই জায়গাটা যাচ্ছেতাই। আটকে গেছে তারা। চিলের নখের মতো বাঁকা বাঁকা কাঁটায় ভরা বঁইচিগাছের জঙ্গল, আঁকশিকাঁটা তো আছেই। বনকুলের জঙ্গলও খুব ঘন। এগোতে গেলেই খানিকটা করে কাপড় ছিঁড়ে নিচ্ছে, মাঝেমধ্যে ঊরু থেকে চামড়াও খিঁচে নিচ্ছে খানিকটা করে। দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সবার চেনা কতকালের পুরনো বিশাল অশ্বত্থগাছটা। রামীচন্ডীদাসের কাপড়-কাচা ঘাট। গাছটাকে বুড়োশিব বলেও ডাকে এখানকার মানুষ। তিন পুরুষ ধরে এখনো যারা বেঁচে আছে, তাদেরও কেউ জন্মাতে দেখেনি গাছটাকে। একরকম আছে চিরকাল। প্রকান্ড গুঁড়িতে শুধুই গেঁটেবাতের মতো বড় বড় গিঁট। এর তলার ঘন ছায়ায় আর রাতের ঘন অন্ধকারে ঘাস জন্মাতে জন্মাতে ক্লান্ত হয়ে এখন আর তারা জন্মায়ই না। তবে এর আশপাশে বঁইচি আর বনকুলের ঝোপের দৌরাত্ম্য নেই। একটু দূরে নরম লতাপাতায় ঢাকা সুড়িপথ নেমে গেছে অজয়ের দিকে।
বুড়োশিবের তলায় বসে ঠিক করা হোক, কী করব এখন এই ডবকা ছুড়িকে নিয়ে।
নিয়ে আয় ওকে – বলে সাবিত্রীর দিকে একবার চেয়ে দেখে দুর্গাপদ। আলগা করে কোনোরকমে পরা শাড়ির একটা আঁচল দুহাতে জড়ো করে বুকের ওপর ধরে দাঁড়িয়ে আছে সাবিত্রী। দুই পা মাটিতে গাঁথা। চাঁদের এত আলো কি ওরই ওপর! একেবারে শক্ত অনড় পাথরের মূর্তি। একটু খাটো, একটু বেশি হৃষ্টপুষ্ট, প্রায় নিখুঁত গোল মুখের ওপর কান পর্যন্ত টানা আয়ত দুটি চোখ। বাঙালি কুমোরের তৈরি জগদ্ধাত্রীর মতোই সে। সোনার বলেই মনে হচ্ছে। তার একটা হাত ধরে টানতে গেল সবুর, চল বামুনের বেটি। একটুও নড়ল না সাবিত্রী।
আবার হ্যাঁচকা টানল সে। শিকড়সুদ্ধ একটু দুলে উঠল, মাটিতে পোঁতা সমর্থ একটা গাছ। একটু ঢালুতে দাঁড়িয়ে ছিল সাবিত্রী – সবুর তাকায় বটার দিকে – এই বটা, ইদিকে আয় তো, ধর ছুড়িটাকে। আহ্লাদী, বাড়ি যাবে!
ওলো, বাড়ি গিয়ে কী করবি ? এঁটো করা মেয়ে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দেবে বাড়ি থেকে। দুজন তার হাত ধরে একসাথে টান দিলো। হাত ছড়িয়ে গেল, জড়ো করা আঁচল খসে পড়ল মুঠো থেকে। একটু এগিয়ে থাকা দুর্গাপদ একবার ফিরে তাকায় ওর দিকে। মেয়ের দুহাত সামনে বাড়ানো। এলো-খোঁপাটা খুলে এক ঢাল কালো চুলের অন্ধকার পটে ফুটে ওঠা দুর্গামূর্তি। কাপড় পরানোর ঠিক আগে। কী যেন ভেসে বেড়াল পঁচিশ বছরের মূর্খ-গোঁয়ার দুর্গাপদর চোখের সামনে। অন্ধকার ঘরের কোণ, মাটিতে মাদুর-পাতা, সোনার কোমল মূর্তি, ছি ছি, কী পাপ দুগ্গা মায়ের উদম দুখানি ঊরু! কত পাপ, কিন্তু চোখ যে সরানো যায় না। আরো কী একটা যেন চিহ্ন থাকতে হয়, সেটা নেই। তাড়াতাড়ি কাপড় পরিয়ে ঢেকে দিক। নিজের মায়ের বুকও মনে পড়ে। এ যে কিছুতেই তেমন নয়। পলক পড়ে না দুর্গাপদর চোখে। কেমন একটা বোবা-ধরা গর্জন করে ছুটে নেমে এলো সে। মেঘ কালো চুলের রাশ ধরে প্রায় ঝুলে পড়ল। শিকড়সুদ্ধ উপড়ে এলো সাবিত্রী। মুখে এখন কোনো কথা নেই কারো, বঁইচি আর বনকুলের কামড়ে পরনের ধুতি-ফতুয়াও ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার। একটা ঘূর্ণিঝড় সাবিত্রীকে উড়িয়ে এনে শিবঅশ্বত্থতলায় ফেলল। এখানে কোনো শয্যা নেই। বালিমাখা বেনারসি পুরো খুলল কি খুলল না, চেয়েও দেখল না দুর্গা, কুন্ডলী খোলা কুচকুচে কালো সাপের মতো চুলের গোছা তার হাতেই ছিল, হ্যাঁচকা টানে মাটিতে সাবিত্রীকে শুইয়ে দিলো সে, হিংস্র চোখে চাইল সবুর আর বটার দিকে আর ভ্রুকুটি-ভরা জ্বলন্ত চোখে একবার চাঁদের দিকে। তারপরই সে অন্ধ হয়ে গেল। এখানে বালির শয্যাও নেই, সাবিত্রীর পিঠের নিচে ধুলো-কাঁকর, পিষে যাচ্ছে দু-চারটে পোকামাকড়, বড় একটা বিষপিঁপড়ে ধারালো কামড় বসাতে বসাতে চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে গেল।
পাশের বনকুলের ঝোপে মরা একটা জোনাকি জ্বলতেই থাকে – সমস্ত শরীরজুড়ে হাজার লক্ষ বল্লম তাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করছে, শুকনো যোনিতে কঠিন পাথর ঘষার টানা যন্ত্রণা। মাতৃজ্ঞানে সংস্কার চলছে দুর্গাপদর। তাকে সাবিত্রীর মাথা ঠুকে দিতে হচ্ছে না। দুহাতে চুল টেনে মাথা মাটিতে ঠেসে ধরতেও হচ্ছে না, দুপাশে নেতিয়ে পড়ে আছে সাবিত্রীর দুটি হাত। কোনো প্রহরণ নেই সেখানে, পা দুটি তোলা ছিল, এখন সে দুখানিও বারবার এলিয়ে পড়ছে। ধরিত্রী হয়ে গেছে সে। কবে হাড়িদিদি বলেছিল, আমি একটা গল্প জানি বামুনদিদি। সবাই জানে। বলব তোমাকে সে-গল্প। তোমার বিয়ে হয়েছে এখন, এ-গল্প তুমি শুনতে পারো।
অজয়ের ওপারে বুড়ো শিবগাছের তলা দিয়ে অজয় পর্যন্ত একটা পথ আছে। লতাপাতায় ঢাকা। ধবধবে সাদা সরু একটা পথ। আছে, দিদি আছে। আমি নিজে একদিন দেখে এসেছি। আজকাল কেউ আর ওদিকে যায় না। তবু পথটা দেখলে তোমার মনে হবে, কারা যেন চিরকাল ওই পথ দিয়ে হাঁটে, আজও কেউ গেছে যেন। অথচ মানুষজন যায়-ই না ওদিক দিয়ে, বুড়োশিবের বারণ আছে, পার্বতী সেখানে আছে যে! পথটা ধরে নেমে গেলেই অজয় – এখানে বালি নেই, জল এসেছে কিনারার ঢাল পর্যন্ত। ওইটা হচ্ছে রামী ধোপানির ঘাট। রজকিনী রামী, না কী জানি বলে লোকে। আসলে ধোপানি, বুঝলে ? সেই মেয়েটা কুমারী ছিল, না বিধবা ছিল – তা কেউ জানে না। তা আইবুড়ি কুমারীই হোক, আর মাঝবয়সী বিধবাই হোক – সে নাকি খুব রূপসী ছিল, কাপড় কাচত এই ঘাটে। দৈনিক আসে, দৈনিক কাপড় কাচে। একবার সুয্যির দিকে তাকায়, বেলা কতটা গড়িয়েছে দেখে নেয়, আবার কাঠের পাটায় কাপড় আছড়ায়।
একদিন এক ডাই ধোয়া কাপড়ের ঝুড়ি কাঁকালে নিয়ে পথ দিয়ে উঠে বুড়ো শিবতলায় এসেছে, তখন দেখতে পেলে খাটো ধুতি-পরা একটা লোক খালি গায়ে বসে রয়েছে গাছের গুঁড়িতে। পশ্চিম দিকে মুখ করা, অঘ্রান মাসের সুয্যি নামছিল আকাশে, তাই দেখছে। লোকটার গায়ের রং কুচকুচে কালো, মোটা একটা নাক। গালের হাড় দুটো উঁচু, তবে চোখজোড়া বেশ বড়। ওকে দেখেই রামী চলে আসছিল কাঁপড়ের ঝুড়ি দুলিয়ে। একবার কী মনে করে ফিরে তাকাল আর সঙ্গে সঙ্গে চোখ পড়ে গেল লোকটার টানা টানা চোখ দুটোর ওপর। কী নাকি ছিল সেই চোখে! হ্যাঁ, দিদি, এমন আবার হয় নাকি ? চোখ তো চোখের মতো, তাতে আবার কী থাকবে! ট্যাঁরা চোখ হলেও না হয় চোখে পড়ে। কী জানি, সেই হলো রামী ধোপানির কাল। বাঁশি-টাশি কিছুই বাজাতে হতো না, তমালগাছেরও কোনো দরকার ছিল না। এইসব শুনেছি তো রাধা-কেষ্টর লীলেখেলায়। ওই যে রামী একবার দেখল লোকটার সেই চোখ দুটো, পেত্যেক দিন সে আসতে লাগল সঞ্জের কোলে কোলে। মানুষটার নাম হচ্ছে গিয়ে চন্ডীদাস। সে নাকি পুঁথিতে কেষ্টঠাকুরের সঙ্গে রাধার লীলে নিয়ে কীসব লিখত। ইশ্কুলের ঠাকুরমশায়ের ঠেয়ে একদিন শুনেছিলাম, তালপাতার ওপর কী করে যে সে কী লিখেছে, তার একটি বন্নও মোছে নাই দিদি। ছিকেষ্ট রাধিকার পালায় গান শোনোনি দিদি ? কীসব গান, শুনলে পরান আকুলি-বিকুলি করে ওঠে। সেসব গান নাকি চন্ডীদাসের নেকা। কত যুগ পেরিয়ে গেল দিদি, যেমনকার নেকা তেমনি আছে, নেকার কালি একটুও মোছে নাই। ভগোমানের লীলে না বুঝলে কি এমন করে লিখতে পারে! এই হারামজাদা সুদখোর শুয়োরের বাচ্চা দুর্গাপদর আর শেষ হচ্ছে না। কেবলই খাবলাচ্ছে। দাঁতে মাংস লেগে আছে, সবটা গিলতেও পারছে না, তবু সে কেবলই খাবলাচ্ছে, নখ দিয়ে ফালা ফালা করে দিচ্ছে সাবিত্রীর দুই বুক। একবার মুখ নিয়ে গেল নাভির তলায়, মাংস বোধহয় তুলেই নিল খানিকটা।
ভগোমানের লীলে দিদি! ভগোমানের, না মানুষের ?
মানুষেরই। ভগোমান যে মানুষের মতন দিদি। তিনি সব যে মানুষের মতন করেন। মানুষের মতো না হলে মানুষ ভগোমানকে মানতে যাবে কেন ? জীবজন্তুর কাছে তিনি তত যেতে চান না, তিনি বড্ড মানুষের গা-লাগা। ভগোমানের খুব নোভ মানুষের মতো হবার।
হাড়িদিদি, কীসব অনাসৃষ্টি কথা তুমি বলছ বলো দিকিনি।
যাত্রার পালায় যেও, কেত্তন শুনো, তাইলে বুঝতে পারবে মানুষের নোভে ভগোমানের নোলা দিয়ে জল গড়াচ্ছে।
এর মধ্যে ষন্ডা মোষটা উঠে গিয়ে ঘাসে মুখ মুছছে। মনে হচ্ছে, এখন সাবিত্রীর ওপর সটান শুয়ে পড়েছে সবুর। সাবিত্রীর শরীরের অনেকটাই এখন খেয়ে-নেওয়া, হু-হু জ্বলছে সর্বাঙ্গ, চামড়া ঢাকা হাড়গোড় পড়ে আছে মাটিতে। সবুর সময় নিচ্ছে অনেকটা, তার যেন তাড়াহুড়ো নেই। বেশ আরেস্তার সঙ্গে খেতে চাইছে, দাঁত-নখ মেলে ধরেনি সে, তার দাঁত এখনো রক্তমাখা হয়নি, ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত ঝরছে না তার জিভ থেকে। যেন সে মর্গের টেবিলে শোয়া একটা গোটা শব পেয়েছে একেবারে নিজের জন্যে। সে একমনে নিজের কাজটাই করছে এখন। সাবিত্রীর শিথানের দিকে অজয়, ওর সিঁথির সোজাসুজি সিঁথির মতোই সাদা সুড়িপথটা : কিছু গন্ধ আসছে, মানুষের বিষ্ঠা আর বনজুঁইয়ের একটা মেশা গন্ধ –
চাঁদের আলো এখানে-সেখানে পড়ে আছে। সাবিত্রী কিন্তু চেয়ে আছে হেমন্তের শেষ বেলার সুয্যির দিকে।
তুমি কি শুধুই পরিধেয় প্রক্ষালন করো ?
না ঠাকুর, আমি পাপ করি, আমি শুধু পাপ করি। পাপের আগুনে আমি দিবারাত্তি পুড়ি ঠাকুর। পাপে ভর্তি আমার শরীর – পাপের ভান্ডার আমার এই শরীর।
আবার সে জিজ্ঞেস করে, রামী, তুমি কি শুধু বস্ত্র ধৌত করো ? পাপ কোথায় থাকে তা কি তুমি জানো ? ঠিক করে বলো তুমি, জানো কোথায় থাকে পাপ আর কাকে বলে পাপ। তোমার শরীরের এই তপ্তকাঞ্চন বর্ণ, এটা তো নেহাত পোশাকি, এ পোশাক একদিন জীর্ণ হবে – শত চেষ্টাতেও তাকে ধুয়ে নিতে পারবে না। শুকিয়ে-কুঁচকে বিবর্ণ হবে। এর তলায় কী কী আছে জানো ? কেবলই আবর্জনা, দূষিত বায়ু আর পচনশীল কৃমিকীট পরিপূর্ণ নশ্বর পদার্থ।
এ তুমি কোনো ভাষায় কথা বলছ, আমি যে মুখ্যু মেয়েমানুষ!
সেই জন্যেই বারে বারে সহজ কথায় শুধুচ্ছি, তুমি কি কেবলই বস্ত্র পরিষ্কার করো। তুমি জানো না, দিনরাত প্রক্ষালন করে চলেছ তোমারই মন, যা বেঁচে আছে বলে শরীর বেঁচে আছে। রামী কথা অত সহজ নয়, মানুষই সবচেয়ে বড়, সে বিধাতা, ঈশ্বর বা ভগবানের চেয়েও বড়। সব মানুষই সৃষ্টি করে, পাপ-পুণ্যও সে সৃষ্টি করে, নিজের হাতে নিজেকে ধ্বংসও করে। তোমার ওই পিঁড়িতে আছড়ে যে বস্ত্র তুমি কাচো, অজয়ের জলে তাকে ধুয়ে পরিষ্কার করো তুমি জানো না, আমি জানি, তোমার মনটিও তাতে শুভ্র ধৌত বস্ত্রের মতোই নিত্য পরিচ্ছন্ন হয়।
হেমন্তের সূর্য নিভল। চাঁদের আলো এখন কটকটে সাদা। বটা ততক্ষণে তার কাজ শেষ করে নেতিয়ে পড়েছে। অতিকষ্টে হাঁপাতে হাঁপাতে সে উঠে দাঁড়াল। এবার কী করতে হবে, তা সে জানে না। দুর্গাপদ ছায়ার অন্ধকারে বসে আছে, সেখান থেকে সে বলে উঠল, কাজ শেষ হয়েছে তোমার পাঁঠা ? উঠে এসো। মেয়েটাকেও উঠিয়ে নিয়ে আয়। এ কথায় উঠে দাঁড়াল বটে বটা, কিন্তু তার চলার শক্তি ফুরিয়েছে। অনেকটা সময় নিয়ে শরীরের কলকব্জাগুলো একটু সচল হলে সাবিত্রী উঠে দাঁড়াল। রক্ত ঝরছে প্রায় সারা শরীর থেকে, ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত দুই ঊরু বেয়ে। কোনোরকমে একটু হেঁট হয়ে মাটি থেকে বেনারসিটা তুলে সাবিত্রীর হাতে দেয় বটা। উলঙ্গিনী আগুন-রঙা শাড়িটা নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ওটা পরে নেওয়ার কোনো চার নেই তার। এখানে শরীর ঢাকা দিয়ে রেখেছে কে ? কে ঢাকা থাকছে এই পিথিমিতে। মরা জোনাকিটা আবার চোখে পড়ল। একটুখানি আলো জ্বলছেই। মরে যাওয়ার পরেও জ্বলছে। কতক্ষণ ধরে সাবিত্রী দাঁড়িয়ে থাকল, জড়ো করা শাড়িটা আস্তে আস্তে মেলল, কোমরে জড়াল, আঁচলটা কুড়িয়ে নিয়ে বুক ঢাকা দিয়ে বাঁ কাঁধে তুলে ঘুরিয়ে এনে ডান কাঁধ থেকে ঝুলিয়ে দিলো।
বাড়ি যাবি এইবার ? দুর্গাপদ শুধোল।
বটার এখনো ভালো করে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ফিরে আসেনি।
সে ভাবল, মন্দ কী ? এটা এখন আপদ, ফাঁকা মৌচাক নিয়ে কী হবে ? মাত্রাছাড়া মধু খেয়ে এখন গা ঢ্যাকঢ্যাক করছে।
বাড়ি যাবি কিনা বল ? দুর্গা আবার জিজ্ঞেস করল। যে এইমাত্র শাড়িটা অঙ্গে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে কে ? সে যে এখন মেয়েমানুষের খোলসও নয়। সাবিত্রী বুঝতেই পারছে না, কী তাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। অনেকটা পরে তার মাথায় এলো, মা থাকলে যেতাম। ছেঁড়াখোঁড়া শকুন-খাওয়া হলেও মা তাকে ঠিক লুকিয়ে ফেলত।
কী কথা বলছিস দুগ্গা। একে এখন আঁস্তাকুড়েও ফেলা যাবে না। দুদিন পরে আবার ঠিক খাই-খাই করে উঠবি। সবুর বলে।
চল তবে কংকোনা।
কংকোনা যাব ?
হ্যাঁ, কংকোনাই যাব – দুর্গাপদ জানাল।
কংকোনায় কোথা যাবি, কোথা রাখবি ওকে ?
আমার বাড়িতে, পথের মাঝখান দিয়েই হাঁটব, শালা ভয়ের নিকুচি করছি!
দুর্গাপদ খুব শক্ত গলায় বলে। অবাক বটার হাঁ-করা মুখ কিছুতেই বন্ধ হচ্ছিল না। চাঁদের আলোয় মুখের ভেতরের অন্ধকার দেখতে পাচ্ছিল সবুর, গর্ত বন্ধ কর শালা। মাথা খারাপ হয়েছে তোর দুগ্গা, নিঘ্ঘাত ফাঁসি যেতে হবে। তোর একার যে হবে তা তো নয়, আমাদের তিনজনেরই ফাঁসি হবে।
কাঁপতে কাঁপতে বটা বলল, মেয়েটাকে মেরে অজয়ের বালিতে পুঁতে রাখলে হয় না দুগ্গা!
তা করলে তো কথাই নেই। ফাঁসিটা দিনকতক পরে হবে, এই যা!
চল কংকোনা – ফের বলল দুগ্গা একটা পা নিজের গাঁ কংকোনার দিকে বাড়িয়ে দিলো, আয়।
কোথা যাচ্ছিস, ওটা কংকোনার পথ নয়। পথ ধরে যাবো না, আমার সঙ্গে সঙ্গে আয়। কাঁটা জঙ্গলের ভেতর দিয়েই এগোল দুর্গাপদ। শালার চাঁদ, এখন ঠিক মাথায় চড়ে বসেছে। সাবিত্রী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর সীমানা পেরিয়ে নরকে পৌঁছে আগুনের কুন্ডে জ্বলতে জ্বলতে, পটপট শব্দে পুড়তে থাকা কালো চোখ দুটি দিয়ে সীমানার ওপার থেকে পৃথিবী দেখছে।
ওপরে উঠেছে, না তলায় নেমেছে ঠিক বুঝতে পারে না – অজয়ের জলের কাছের বালি এখন শীতকালে ঠান্ডা, ভেতরে নিশ্চয়ই ওম আছে, গা কাঁটা দিচ্ছে, বালি খুঁড়ে একটু ভেতরে ঢুকতে পারলেই ঠিক গরম পাবে, মায়ের, হাড়িদিদির কোলের মতো। ধুতি-শাড়ি পিঁড়িতে আছড়ে-আছড়ে ধোবার মতই মন কাচা যায় নাকি হাড়িদিদি ? একবার দুকড়ির চেহারাটা চোখের ওপর ভেসে উঠল। ঘেন্নায়, ধিক্কারে গা গুলিয়ে যাচ্ছে। তার খেঁকুটে চেহারাটা ঠিক যেন লাথি-খাওয়া কুকুর। কেন দেরি করছে দুগ্গারা!
এই চল – সবুর এসে হাত ধরে টানল। দুর্গা একটু এগিয়ে গেছে। পেছন দিকে একবারও ফিরে তাকাচ্ছে না সে। বলির পাঁঠার মতো তার পিছু পিছু হাঁটছে বটা। হাতটা ছেড়ে দিলেও সাবিত্রী, নাকে জানে, উঠে এলো সবুরের সঙ্গে। কিছুতেই বুঝতে পারছে না, হাঁটছে বাতাসে, না মাটিতে। হঠাৎ শুকনো পাতার মতো বাতাসে উড়ে যেতে পারে কিংবা মাটিতেও পড়তে পারে মরা ডালের মতো। যে চলে গিয়েছিল, মাটিতে ফেলে গিয়েছিল একটি শবদেহ, দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল, সৎকারের কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না, শকুন এসে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে তাকে। এতক্ষণে আবার পৃথিবীর সীমানায় ঢুকে সাবিত্রী ঠোঁট কামড়ে ডাকছে তাকে, ফিরে যায়। আবার যখন সীমেনেয় ঢুকেছি, বেঁচে থাকব। ন্যাংটো আমাকে পিথিমি দেখুক, ঝেঁটা মারি নিজের পরানকে। তবু মরব কেন ? ফিরে আয়।
অজয়কে পেছনে রেখে উত্তরমুখো যাচ্ছে তারা। কাঁটা-জঙ্গলের জায়গাটা ফুরাতেই চাইছে না। তবে এপারে বালি কম। অনেক উঁচু এপাড়, মাটি ভালো, ঘাস-বুনোঘাস আছে কিছু, বড় বড় বট-অশ্বত্থ-পাকুড় আছে এদিক-ওদিক। এটুকু পেরিয়েই কংকোনার আউসের জমি। অঘ্রানের প্রথম দিকে আউস ধান কাটা হয়ে গেলেই মাঠে সরষে, তিল, তিসি, মটর, মসুরি, আলু, শিম, বেগুন-কুমড়ো, মুলো-পালং – এসব শাকসবজির চৌকো মাঠটা সরু-মোটা আলে আলে ভরা। পথ নেই, তার দরকারও নেই। ইচ্ছেমতো এলোমেলো যাচ্ছে দুর্গাপদ। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার উপায় নেই, লোহার শেকল দিয়ে সে আটকে ফেলেছে দলটাকে। নিজেও তাতে বাঁধা।
কাজ তো শুরু করা যায়, শেষ করা যায় কেমন করে সে কি কেউ জানে ? শেষ হয়তো হয়ে যায়, কেউ না চাইলেও হয়। দুর্গাপদ ভাবছে, শালা, পাঁঠা যেমন পাঁঠি খোঁজে, পেলেই কাজ শেষ করে নেয়, বোকা পাঁঠার কী সুবিধে – কাজ শেষ তো শেষ, কোনো দায়ধাক্কা নেই, আবার পাঁঠি খোঁজো, না হলে গাছতলায় শুয়ে শুয়ে জাবর কাটো। মানুষের শালা এ-সুবিধে নেই। কাজ একটা শুরু করলেই, ন্যাতার লেগে থাকে – কাঁঠালের আঠার মতো। একটা কাজ হলো তো হাজারটা মানুষ জড়িয়ে পড়ল। হাজার হাজার কেন, লাখ লাখ। কাল হোক, দুদিন পরে হোক, বেরুবেই বেরুবে যে শ্রীকেষ্টপুরের বিবাহিত ব্রাহ্মণকন্যা অপহরণ, আজ এত তারিখ পর্যন্ত কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি, অপরাধীরা কেউ ধরা পড়েনি। ব্যস, দুনিয়ার মানুষ হাপিত্যেশ করে বসে থাকবে, তারপর কী হলো জানার জন্যে। এ শালার আর থামার নয়।
আমরা কজনা পাঁঠা একটা পাঁঠি ঠিক করেছিলাম। কাজ একটু আগে শুরু করতে হয়েছিল, কাজ হলো, একটু জোরজার করতে হলো, চাঁদের আলো পাওয়া গেল, ফাঁকা আমবাগান পাওয়া গেল, যে কাজের জন্য এত, তা-ও হলো। একবার নয়, দুবার, এখন আর একবার করার সাধ্যি নেই। আমরা পাঁঠাগুলো কি একবারও ভেবেছিলাম, এ তো মানুষের পাঁঠি, কাজ শেষ করে ছেড়ে দিলেই হচ্ছে না, তার পরে কী হবে ? আমরা শালা ঠিকঠাক পাঁঠা হতে হতে মানুষ হয়ে গিয়ে কী বিপদেই-না পড়লাম। পাঁঠা ভালো, মানুষ-পাঁঠা মহা জবরজং।
এই ভাবনা, ওই ভাবনা, সরু-সরু অলিগলি, টিকটিকির লেজ, ইঁদুরের লেজ, কুকুরের লেজ! তা-ও আবার ছেঁড়াখোঁড়া।
মোটা সরু আলপথ ভেজা, ঠান্ডা, চাঁদ মাথার ওপর, ছায়া পায়ের তলায়। এদিকে কংকোনা গাঁ এগিয়ে আসছে। গাঁয়ের পথে নামলেই মানুষ বেরিয়ে আসবে। মানুষ-পাঁঠাগুলো হঠাৎ পুরোপুরি মানুষ হয়ে যাবে। দুর্গাপদ ট্যাঁকে হাত দিয়ে দেখল, চাবিটা ঠিকই আছে। সামনে শিমের মাচা – অন্ধকার, ওদিকে বেগুন ক্ষেত, লকলকে পাতার ওপর চাঁদের আলো, ঘাসের ওপর শিশির আলোয় ঠিকরোচ্ছে, মাকড়সার জালের ওপর শিশির, তাতে চাঁদের আলো। হাড়গিলে একটা মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে নাকি! মাথাটা যে অবিকল দেখা যাচ্ছে। মাকড়সার জাল, আলো, ছায়া, শিশির।
দুই ক্ষেতের মাঝখানে এতক্ষণে ভালো করে দেখতে পাওয়া গেল টিনের ঘরটাকে। ক্ষয়-পাওয়া, ধসে-পড়া মাটির দেয়াল, টিনের চাল। একা একটি মাত্র ঘর। মাঠের মাঝখানে এই ঘরটা দুর্গাপদদের। কী কাজে আসে কে জানে। দরকার হলে মাঠের ফসল পাহারা-টাহারা দেওয়ার জন্যে কেউ কখনো হয়তো থাকে এখানে। দুর্গাপদ ঘরের একটিমাত্র দরজার সামনে এসে দাঁড়াল, ট্যাঁক থেকে চাবি বের করে মরচে-ধরা তালাটা বহুকষ্টে খুলে ফেলল। একটা গুমসানো বাতাস, দম-আটকানো একটা গন্ধ আর দু-তিনটে চামচিকে ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। চামচিকেগুলো চাঁদের আলোয় অন্ধকার খুঁজতে-খুঁজতে এলোমেলো উড়ে বেড়াচ্ছে।
সবুর বলল, অ, এই কথা!
সাবিত্রীকে সামনে ঠেলে দিয়ে পিছু পিছু তিনজন ঘরে ঢুকল। ঘরের বাতাস তখনো ভ্যাপসা, চামচিকের বিষ্ঠার ঝাঁজালো গন্ধ-মাখানো। একটা অসাড় ভোঁতা অন্ধকার ঘরজুড়ে আটক আছে। একদিকে একটিমাত্র ছোট চৌখুপি জানলা, বাইরে আলো দেখা যাচ্ছে। চাঁদ উলটো দিকে, ঘরে আলো ঢুকছে না। কিছু নেই এই ঘরে, উঁচু-নিচু মাটির মেঝে। বিড়ি ধরানোর লাইটারটা জ্বালাল দুর্গাপদ। তাতে দেখা গেল না প্রায় কিছুই। অন্ধকারটা শুধু একটুখানি জায়গায় অদ্ভুত বাঁকাচোরা ছায়ায় কাঁপতে লাগল।
এইখানে রাতটা থাকুক – দুর্গাপদই বলল কথাটা। সাবিত্রীকে নয়। সবুর আর বটাকেই বলেছে সে। আলোটা নিভে গেল টুপ করে। সাবিত্রী নিজেই জানে না, সে এদের সঙ্গে হেঁটে এসেছে কি-না, অন্ধকার ঘরে দাঁড়িয়ে কোথায় কাদের সঙ্গে কেন এসেছে ? সে খুব ফিরতে চাইছে, বেঁচে থাকাটা যেন অভ্যেস হয়ে না যায়। একবার চমকে উঠল মাথার ভেতরটা। খোলা দরজাটা কোথায়, তা সে দেখতে পাচ্ছে। দমকা হাওয়ার মতো সে-ও কি ছুটে বেরিয়ে যাবে ? ওইটুকু ভাবনা সরু বিদ্যুৎরেখার মতো তাকে জাগিয়ে দিয়েই অদৃশ্য হয়ে যায়। তাতে তো ফেরা হবে না। আবার তাহলে পিথিমির সীমানা ডিঙিয়ে যেতে হবে।
সবুর বলল, আমি এখন যাই দুগ্গা – সময়মতো আবার দেখা হবে।
হ্যাঁ, যা – বলে দুর্গা হাতড়ে সাবিত্রীকে ঠাহর করে অক্টোপাসের মতো একবার জড়িয়ে ধরল, দুই হাতে দুই বুক ধরে পিষে দিয়েই ছেড়ে দিলো আর ভরা কলসির মতো তার পাছায় ধপধপ করে তিনটে চাপড় মারল। আর কিছুর ইচ্ছে থাকলেও তার সাধ্য ছিল না। সবুরের মনে হয় ইচ্ছে-সাধ্যি দুটোই ছিল, দুর্গাকে তার একটু ভয় হলো। বটার ইচ্ছে-সাধ্যি কোনোটাই ছিল না। সে কতক্ষণে বেরিয়ে যাবে, তা-ই ভাবছে। ভয় এইবার তার কাছে আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে।
আমি এখন যাচ্ছি বলে সবুর বেরিয়ে গেল। থাক এইখানে – দুর্গাপদও দরজার দিকে পা বাড়াল। পেছনে বটা। দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ হলো। খচমচ শব্দে তালাটা আপত্তি করলেও তাকে মুখ টিপে দরজার কড়া ধরে ঝুলতে হলো। তারপর দুর্গাপদ আর বটা মাঠে নেমে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে তাদের কথা আর পায়ের শব্দ।
সাবিত্রী দাঁড়িয়ে ঘরের ঠিক মাঝখানে, সবচেয়ে অন্ধকার জায়গাটায়। খোলা মাঠটা চারপাশ থেকে ছুটে এসে ঘরটাকে চেপে ধরছে। একমাঠ নিস্তব্ধতা এগিয়ে আসছে এখন, গিলছে ঘরটাকে, অথচ দু-একটি শব্দ হয়ে উঠছে ভয়ংকর, বাজ পড়ার মতো; বাতাসে শুকনো পাকা ধানগাছের ঘষাঘষির শব্দ, ঝিঁঝির টানা রি-রি ডাকের মধ্যে অন্য কোনো একটা পোকার তীব্র কিটকিট শব্দ, কোনো একটা পাখির বিচ্ছিরি কর্কশ ডাক, এই ঘরের বাসিন্দা কোনো টিকটিকির টিটকিরি দিয়ে ওঠা। সাবিত্রীর মাথার ওপর যেন দুমদুম ঘা পড়ছে। সে বুঝতেই পারল না, কখন সে দরজা ধাক্কাচ্ছে। মজবুত দরজা বটে, বাইরে থেকে শিকল তোলা, কড়ায় তালা দেওয়া, মাথা কুটে রক্ত ঝরিয়েও লাভ নেই। দরজা ছেড়ে হাত দুই দেয়ালে দিয়ে পুরো ঘরটা একবার সে ঘুরে এলো, হিম ঠান্ডা এবড়োখেবড়ো মাটি, উঁচু-নিচু, বড় বড় ফাটল, একটা-দুটো গর্ত। কারা নিশ্চয়ই শীতঘুম ঘুমুচ্ছে সেখানে। কেন যে পুরো ঘরটা এইভাবে ঘুরে এসে ছোট্ট জানালার কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সাবিত্রী, তা সে জানে না। কখন থেকে খায়নি মনে পড়ল না, জলতেষ্টা পেয়েছে কি না, তা-ও মাথায় এলো না। ওইটুকু জানলায় চোখ রেখেও কিন্তু অনেকটা আকাশ দেখতে পাচ্ছে। ধানের আঁটি জড়ো করা কুঁড়েঘরের মতো দেখতে ঢিপিগুলো তার চোখে পড়ছে। অজয়ের এপাড়ের উঁচু-নিচু বনের কালো দেয়ালও দেখছে সে।
জানলার নিচেই দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ল সাবিত্রী। আবছা আলোয় এতক্ষণে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে সে। দেহ আছে, মনে হয় বেঁচেও আছে। হ্যাঁ, এই যে ফিরেছে সে। মাটিতে বসে আছে। ঠান্ডায় কুঁকড়ে আছে শরীর। বেনারসিটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিতে গিয়ে টের পেল, দু-তিন জায়গায় ফেঁসে গিয়েছে শাড়িটা; টের পেল, ছড়িয়ে বসা পায়ের নিচে দিয়ে কিছু একটা যাচ্ছে শত শত ছোট ছোট পা চালিয়ে। তেঁতুলে-বিছে হতে পারে, কেন্নোও হতে পারে।
সাবিত্রীর ভাবার শক্তি ফিরে এসেছে। বাঘ কিংবা বেড়ালের মতো নখ দিয়ে মাটি ছিঁড়েখুঁড়ে জানলাটা সে নিশ্চয়ই খুলে ফেলতে পারবে। বেরিয়ে যেতে পারবে এই ভয়ংকর আটক থেকে। ফিরে সে যেতে পারে মাঠ পেরিয়ে, অজয় পেরিয়ে, আমবাগান পার হয়ে বাড়িতে। কে আছে সেখানে ? মা নেই, বাবা নেই, হাড়িদিদিই-বা বাড়িতে বসে থাকবে কেন ? দাদা কি ফিরে এসেছে ? কী করতে পারে দাদা ? বাড়িতে যদি থেকেই থাকে, আর কি ঢুকতে দেবে তাকে ? হয়তো তার স্বামী খেঁকুটে লোকটা থাকতে পারে দাওয়ায় বসে, বুকে মাথা ঠেকিয়ে। কী করবে সে তাকে পেলে ? কিছুই করবে না, সকাল হলেই তার বাপ কসাই বামুনটা কানে ধরে তাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেবে। পৃথিবীতে মেয়েমানুষের অভাব, না বউয়ের অভাব ? কত মাগি দুটো ভাতের জন্যে চারপাশে লাট খাচ্ছে। যা কলকেতায়, দুটো পয়সা জোগাড় করতে পারিস কিনা দেখ্গা।
খুব খিদে পেলে আর তখন একটুও কিছু পেটে না পড়লে খিদেটা একসময় ধুঁকতে ধুঁকতে মরে যায়। খিদে থেকে মরা খিদেয় আসতে অনেকটা সময় লাগে। যখন ভয়ানক খিদেয় সাবিত্রীর নাড়ি জ্বলছিল, তখন তাকেই খাওয়া হচ্ছিল ছিঁড়েখুঁড়ে। নিজের খিদে সে টের পাবে কী করে ? মরা-খিদেয় আপনা-আপনি ঘুম আসে, চোখ বন্ধ করতে হয় না। জেগে থেকেই বেশ ঘুমানো যায়।
রাতে যখন ঘুমিয়ে পড়ছিল সাবিত্রী, তখন তার চোখ খোলাই ছিল। সারারাত ধরে সে শুধু ঘুমিয়েই গেছে, দেখে গেছে কী রকম এক পৃথিবী, কী রকম আকাশ আর মাটি, জল আর মানুষ – এই পৃথিবীতে যা কোনোদিন নেই, সে কোনোদিনই দেখেনি। কী-সব ভেসে বেড়াচ্ছিল তার চোখের সামনে, দুই চোখের মধ্যে সাপ্টে লেগে যাচ্ছিল, ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল, আবার বেরিয়ে এসে – উঃ কতদূরে সরে গেল! ঘুমিয়ে সে নিশ্চয়ই পড়েছিল, না হলে অত টকটকে লাল সুয্যিটাকে অজয়ের পুব-দক্ষিণ কোণে আকাশের একেবারে তলা থেকে উঠে আসতে দেখতে পেল কেন ? আলোর চওড়া চওড়া ফিতে আগে দেখল, তারপর কনকনে ঠান্ডা বাতাস ফুঁড়ে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে জানলা দিয়ে ঢুকে ঘরের মেঝেতে সোনালি শান্তির মতো পড়ে রইল। এতক্ষণে গা জুড়োল সাবিত্রীর, উঠে দাঁড়িয়ে একবার সেই সোনার পাতের ওপরে গিয়ে বসল। গা বেয়ে মাথা পেরিয়ে ঘরের পশ্চিমের দেয়াল পর্যন্ত বিছিয়ে রইল। খিদেটা সারারাত যে নেতিয়ে পড়েছিল, এখন একবার জেগে উঠল। কেমন করে জীবন ছেড়ে চলে যাওয়া যায়, বেঁচে-থাকা ছেড়ে দিয়ে মরণের মধ্যে ঢুকে পড়া যায় ? কোনোদিন কি তা হতে পারে ?
দিন এগিয়ে যাচ্ছে, কেউ এদিকে আসে না। রোদ সাদা হচ্ছে, শিশির শুকিয়ে উড়ে যাচ্ছে, মেঝের আলোর পাতটা খুব তাড়াতাড়ি পিছোচ্ছে, এক্ষুনি বেরিয়ে যাবে ঘর থেকে। সাবিত্রী আঁচলে গলাটা জড়িয়ে দুহাত বুকে জড়ো করে স্থির হয়ে বসে আছে। বহুদূরে দুজন মানুষ হেঁট হয়ে ধান কাটছে। ধান বেশিরভাগ কাটা হয়ে গেছে, কোনো কোনো জমিতে ছটা তারপর দুটো, চারটে-দুটো এমনি করে আঁটিগুলো সাজানো আছে। বাঁধা আঁটির মাথাগুলো সারি সারি মানুষের মুন্ডু বলেই মনে হয়। মাঠজুড়ে শুকনো খড়ের মুন্ডু। অনেক জমিতেই সেইসব আঁটি বাঁধা ধান জড়ো করে তিন-চারটে কুঁড়েঘরের মতো ঢিপি করা হয়ে গেছে। গরু-মোষের গাড়ি তাদের মাঝখানে ঢুকিয়ে ধান-বওয়া এবার শুরু হলো বলে। একটা ঢিপির পাশে চুপ করে খানিকক্ষণ বসে থাকলেও আবার বেঁচে ওঠা যায়। ছেড়ে দে, আমাকে ছেড়ে দে, আমি যাই।
দুপুর নাগাদ খিদে নয়, হঠাৎ ভয়ানক তেষ্টা পেল সাবিত্রীর। কতক্ষণ সে জল খায়নি। গলা পর্যন্ত অজয়ের শুকনো বালি, বালি যদি-বা নামছে, শুকনো বাতাস ঢুকছে গলার নালি দিয়ে। খরখর করছে গলা, তার নিচে এক পুকুর জল খাবার এক গর্ত। ভয়ানক পিপাসা সাবিত্রীর, এক দিঘি জল আমি খেয়ে নেব। মা গো, আমাকে জল দাও। দুগ্গারা কি আর আসবে না। এসে যা খুশি করুক। আমাকে শুধু একটু জল দিক। আঁজলা আঁজলা জল খাব। সময় গেলে খিদে যেমন করে মরে, তেষ্টা কিছুতেই মরে না। চোখে ভালো করে দেখতে পাওয়া যায় না, ফাঁকা মাথার মধ্যে কেবলই ধোঁয়া কুন্ডলী পাকাতে থাকে।
শীতের ছোট দিনে সুয্যি সরসর করে পশ্চিমে যায়। পশ্চিমের দেয়ালে কোনো জানলা নেই, ঘরে একটুও আলো আসে না। সকালের মতো আলো আর একবার লাল হতে শুরু করে, সেটা যেন চোখ রগড়ে রগড়ে কাঁদা-লাল, তাতে একটুও শান্তি নেই। আমি আবাগী নরকের কীট, তবু বাহ্ রে সুন্দর পিথিমি। সাবিত্রী ভাবছে, বুকটা চৌচির ফেটে যাবে, মরবে সে কিন্তু সকালের মতো নয়, এখন যে সে মরবে সোজা নরকের পথে, তেমন মৃত্যু যেন পথের কুকুরেরও না হয়। সে অন্তত একটা বটগাছের ছায়ায় শুয়ে মরুক। পুবদিকে দূরের বড় অশ্বত্থগাছটা দেখা যাচ্ছে, তার পাতার ভেতরে ভেতরে অন্ধকার জমে কুচকুচে কালো হয়ে উঠছে। তার তলায় আর ছায়া নেই।
সন্ধের পর গতকালকের পূর্ণিমার চাঁদটা পানসে জ্যোৎস্নায় মাঠ ঢাকা দিলে দরজায় খচমচ শব্দ উঠল। তালা খুলে ঘরে ঢুকল দুর্গা আর বটা। এখন সবুর নেই। দুর্গা সোজা তার কাছে এসে বলল, ওঠ, চল আমাদের সঙ্গে। বন্ধ বাকসোটার ডালা একটুখানি খুলল সাবিত্রীর। ছুরির ফলার মতো একটা সাদা সরু দাগ পড়ল মাথার ভেতর। এই শুয়োরের বাচ্চারা কোথা থেকে এয়েছে ? এরা কি মেয়েমানুষের পেট থেকে জন্মেছে, নাকি কুকুর যেখানে পেচ্ছাব করেছে, সেখানকার মাটি থেকে জন্ম নিয়েছে ? ভাবনার ঢাকনাটা আবার আটকালো। এ রকমই হতে থাকবে এখন। ভাববে, ভাববে না। সাবিত্রী কলের পুতুলের মতো উঠে দাঁড়াল। বটা এগো – বলে দুর্গা এসে তার হাত ধরল। হাতে এখন তার লোহার বালা আর শাঁখা ছাড়া আর অন্য কিছু নেই। কাল অজয় পেরুনোর সময় একবার থেমে দুর্গা আর সবুর তার গলার সীতে-হার, হাতের সোনার চুড়ি, কানের ঝুমকো – সব খুলে নিয়েছিল। তবে আলোয়ানটা পুঁটুলি করে এখনো রাখা আছে মেঝেতে। একটু ঝুঁকে সাবিত্রী সেটা কুড়িয়ে নিল। আর সময় দিলো না দুর্গা। হ্যাঁচকা একটা টানে তাকে ঘরের বাইরে নিয়ে এলো। ঘরে আবার তালা দিয়ে তিনজনে মাঠে নামল।
একটু জল খাব।
সে হবে, চল এখন।
জল দাও, বুক ফেটে যাচ্ছে।
হবে হবে, বলছি তো এখন চল।
জল দাও – সাবিত্রীর গলায় কথাটা ঠিক ফুটল না, হালকা বাতাসের আওয়াজের মতো ভেসে গেল।
জলের কাছে আগে চল, তখন জল দেখিয়ে আনব তোকে।
পথ নেই বললেই চলে। আলগুলো সব সরু সরু – শীতে ঘাস শুকিয়ে গিয়েছে বটে, তবু মানুষের যাতায়াত কম বলে আধশুকনো ময়ূরকণ্ঠী আর দুর্বাঘাসের জালে পা জড়িয়ে যাচ্ছে। সরষের ক্ষেত, মসুরির ক্ষেত, মটরক্ষেতের লতাজঙ্গল –
এগুনোই যাচ্ছে না।
সামনেই চওড়া আলপথটা পাওয়া যাবে না রে দুগ্গা – পেছন থেকে বটা বলে। সাবিত্রী আছে মাঝখানে। চাঁদ চনচন করে আকাশে উঠছে। বড় পথ আলটায় পৌঁছুলে ঝকঝকে সাদা আলোয় চারপাশের পথঘাট-মাঠ, কালো কালো গাঁগুলো নিয়ে গোলাকার আকাশ-পৃথিবী আলগা শূন্যে দুলছে।
আর কিছু নয়, একটু জল খাব। সাবিত্রী দুজনের মাঝখানে। বটা দেখতে পাচ্ছে যেখানে পা পড়ার কথা, সেখানে না পড়ে সাবিত্রীর দুই পা কেবলই উলটোপালটা করছে। পথটা বিধবা যুবতীর সিঁথির মতো সিধে আর সাদা। দুপাশে ঘাসের পাড়। একটু উঁচু হচ্ছে পথ, সেখানে একজোড়া অশ্বত্থগাছ। পাতার বেশ শব্দ হচ্ছে। আসলে ওরা দুভাই জন্মেছে একটা মেঠো পুকুরের উঁচু পাড়ের ঢালে। ঢাল বেয়ে উঠলেই এই পুব পাড়ের মাথা থেকে দেখা গেল পুকুর – অনেক জল, অনেক জল। মাঠের চিতানো পুকুরে এত জল থাকে না। জলটা একেবারে চুপ। বটা আর সাবিত্রী দাঁড়িয়ে পড়ল।
দাঁড়ালি কেন ? দুর্গা ওদের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করে।
বটা আঙুল তুলল – জল।
জল তো কী হবে ?
সাবিত্রী দুই পা মাটিতে ছড়িয়ে বসে। আবার ভাবনার বাকসোটা একটু খোলে, আমি জল দেখেছি!
এই সাবি ছুড়ি, ওঠ। এখন জল খাবে। যেখানে যাচ্ছি, সেখানে গিয়ে এক গামলা জল খাস। অনেকটা পথ এখনো, পৌঁছুতে পৌঁছুতে দুপুর-রাত পেরিয়ে যাবে।
এবার বটা বলে, তুই কি মানুষ রে দুগ্গা ? মানুষ গরু-ছাগলকেও জল দেখায় নিয়ম করে, পথের কুকুরও জল খেতে পায়। মেয়েটা জল-জল করে তালু শুকিয়ে মরছে, সামনেই পুকুরের জল, গরু-মোষের মতো না হয় ওকে খেদিয়ে জলে নামিয়ে দে। কতটা সময় যাবে র্যাল ?
একেবারে দয়ায় গলে যাচ্ছো, না ? এটাকে এনেছিস কী জন্যে ? ভুলে মেরে দিয়েছ না ? হাতে পুলিশের দড়ি আর পোঁদে রুলের গুঁতো পড়বে যখন, তখন টের পাবি। যাও, ওকে জল খাইয়ে আনো।
বাকসোটা আবার একটু খোলে। জল খাব। সারা জীবনে কি জল খেয়েছি ? পুকুরের এই জলটুকুতে কি আমার তেষ্টা মিটবে ? সাবিত্রী কোনোরকমে টলমলে পায়ে উঠে দাঁড়াল। এবার বটা এসে ধরল তাকে। কী আশ্চর্য হাড়িদিদি – সাবিত্রী জলতেষ্টা থেকে একটু সরে গিয়ে ভাবতে পারল, বুঝতেও পারল বটা ওকে তার ডান পাশে নিয়ে নিজের বাঁ হাত দিয়ে ওর বাঁ হাত ধরেছে, ডান হাত দিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরেছে কোমর! পায়ে পায়ে এগুচ্ছে তারা ঢালু বেয়ে। ওই হাত দুটোই পিষে দিয়েছিল তার মাই দুটো। দুখন্ড নরম মাংস ছাড়া আর কি তারা ? দুধভান্ড নয় অন্তত, বোধহয় এত নষ্ট হয়ে গিয়েছে যে হবেও না আর কোনোদিন! জলের কিনারায় পৌঁছে বটা ছেড়ে দিলো তাকে। সাবিত্রী কনকনে ঠান্ডা জলে নামছে, ঘন লতায়-পাতায়, জলের তলার দামে পা জড়িয়ে যাচ্ছে তার। ঠান্ডাটা হাঁটু-ঊরু বেয়ে বুক-গলা পেরিয়ে মাথা অবধি উঠে এলো। এই দামের জঙ্গল পার হলেই টলটলে কালো জল গাছের ছায়ায় ঢাকা। সেখানে পৌঁছুতে হাঁটুর ওপর পর্যন্ত শাড়ি তুলতে হলো। আঁজলা ভরে জল নিল সাবিত্রী। খাবে কেমন করে ? চুমুক দেবে, না মুখ না তুলে শুঁষে নিতে থাকবে, নাকি গরু-মোষের মতো হেঁট হয়ে জলে মুখ ডুবিয়ে সারা পুকুরের জলটা শেষ করে ফেলবে। বটা চুপ করে কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। পুকুর যেমন আছে তেমনি রইল, সাবিত্রী জলপূর্ণ ঘটের মতো ভেসে কিনারায় চলে এলো। এবার বটা আর তাকে ধরল না। দুজনে দুর্গাপদর কাছে পৌঁছুলে বটা বলল, দুগ্গা, এবার আমি যাচ্ছি। পরে দেখা হবে। বটা আর কোনো কথা না বলে আলপথ ধরে নেমে গেল। এত চাঁদের আলো, তবু সে একটুও কোথাও থামল না, চাঁদের আলোয় উবে গেল। সাবিত্রী একা দুর্গার সামনে দাঁড়িয়ে।
চল, পা চালা।
এদিকে গাছপালা প্রায় নেই, শুধুই ধানের জমি। ধান কাটা প্রায় শেষ হয়েছে। বয়ে বাড়িতে নিয়েও গেছে অনেকে। এখন মাঠে এখানে-সেখানে জোড়া করা কুঁড়েঘরের মতো ধানের আঁটি গাদা করা ঢিপি। মনে হয়, আর দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে সব ধানই বয়ে বাড়ি নিয়ে যাওয়া শেষ হবে। ফাঁকা মাঠ : ঘূর্ণি হাওয়ায় অনেক ওপরে উঠে যাওয়া ফিকে নীল আকাশ। ধানচড়ুই আর কাক চিল ফিঙে – এই থাকবে মাঠে। এখন আর হাঁটতে তেমন কষ্ট হচ্ছে না সাবিত্রীর, বড় চওড়া একটা পথ-আল পাওয়া গিয়েছে। সে এখন জল-ভরন্ত। টইটম্বুর।
দাঁড়িয়ে পড়ল দুর্গাপদ, পেছন ফিরে তাকাল সাবিত্রীর দিকে। খাবার পোকাটি দেখতে পেলে নিস্পন্দ টিকটিকি যে স্থির নিষ্ঠুর গা-শিউরানো দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে, ঠিক তেমনি করে। সাবিত্রীর একদিকে জ্যোৎস্নামাখা, অন্যদিকে ছায়া। দুর্গা চেয়েই আছে, যেন নড়ার সাধ্যি নেই। অনেকক্ষণ পরে সে ফিসফিস করে বলল, আর একবার…
সাবিত্রী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ঠিক ভাদ্র মাসের কুকুরের মতো দেখাচ্ছে না দুর্গাকে। টিকটিকির মতোই লাগছে তাকে। তবে কথাটা বলেই কিন্তু চনমনে হয়ে উঠল দুর্গা, আর একবার চাই তোকে। কী জানি আবার কখন কী অবস্থায়, কখন কবে… কুকুরটা বেরিয়ে আসছে… শালা কোথায় যে… কোনো একটা জায়গা নেই যে শোয়াই, মাঝমাঠে একটু সময় নেই যে মেয়েটাকে আর একবার ভালো করে… ভালো করে চারদিকে তাকিয়ে মাঠটাকে একটু পরখ করে নিল সে। গাঁগুলো বেশ দূরেই, খুব ঠান্ডা, তবে বাতাস নেই, চারদিক ভয়ানক চুপ। তা হোক, ভগমান সবাইকেই ন্যাংটো দেখে। এক পা এগিয়ে এসে দুর্গাপদ সাবিত্রীর একটা হাত ধরল, বলল, চ, আর একবার মাত্র…। সে দু-তিনটে জমির পরে একটা ধানের ঢিপ দেখতে পেয়েছে – দুদিকের গাদা করা ধানের মাঝখানে গরু-মোষের গাড়ি ঢোকানোর জায়গাটা বেশ। ক-টা ধানের আঁটি বিছিয়ে নিলেই নরম বিছানায় নতুন ধানের গন্ধ! দুর্গাপদ হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে, পোকা তার পিছু পিছু হাঁটছে। দুই গাদার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায় দুজনে। খুব টনটন করে! বালি আর খড় দিয়ে মুখটা ঠাসা আছে। দুর্গা তো চেয়েই দেখছে না, তাকে এখন চেনা অসম্ভব। দুহাতে ধানের আঁটি টেনে নিয়ে বিছিয়ে ফেলল ঘাসের ওপর, তারপর সে সাবিত্রীর সামনে এলো, ঘুরে পেছনদিকে গেল। দুবার-তিনবার ঘুরল সে সাবিত্রীর চারদিকে। তারপর ওর পেছনে এসে নিজের হেঁটো-ধুতিটা খুলে ছুড়ে দিয়েই সাবিত্রীকে কোমর পর্যন্ত ন্যাংটো করল। তার মুখটা একবার দেখতে চেয়েছিল সাবিত্রী, ঠিক কোন জানোয়ারের মতো দেখায় পুরুষ মানুষের মুখ! পৃথিবীর কোনো জন্তুই নেই এ রকম। আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে জড়িয়ে ধরে দুর্গা, এখন সে ছিঁড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে তার স্তন দুটি, তার পরেই সে সামনের দিকে এলো, খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে চেষ্টা করল, কিন্তু তাতে অস্থিরতা একটুও কমছে না। শেষ পর্যন্ত সাবিত্রীর কাঁধে প্রচন্ড একটা রদ্দা কষে খড়ের বিছানায় শুইয়ে দিলো তাকে। তারপর কতক্ষণ কে জানে, সে জ্বরবিকারের ঘূর্ণির মধ্যে ডুবতে-ভাসতে তলিয়ে যেতে থাকল। তখন আর তার সময় নেই – সুচের মুখে একটা মুহূর্ত শুধু বিঁধে আছে, তলপেট কাঁপিয়ে কখন সব ভাসিয়ে জোয়ার আসবে ? আর চায় না সে, আর দেরি নয়। সাবিত্রী জানে না কতক্ষণ পুড়বে সে, আর কত খুঁড়বে তাকে, আর কতক্ষণ পাথরে চলবে এই র্যাঁদা, কত দিন, কত রাত, কত কোটি বছর! শূন্য হয়ে শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে না কেন সে ?
জন্ম- ফেব্রুয়ারি ২, ১৯৩৯, ছোট গল্পকার এবং কথাসাহিত্যিক। ষাটের দশকে আবির্ভূত এই কথাসাহিত্যিক তাঁর সুঠাম গদ্য এবং মর্মস্পর্শী বর্ণনাভঙ্গির জন্য প্রসিদ্ধ। জীবনসংগ্রামে লিপ্ত মানুষের কথকতা তাঁর গল্প-উপন্যাসের প্রধানতম অনুষঙ্গ। রাঢ়বঙ্গ তাঁর অনেক গল্পের পটভূমি। তিনি বাংলা অ্যাকাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করে। এ ছাড়া ২০১২ খ্রিস্টাব্দে তিনি অসম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সন্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি পান। হাসান আজিজুল হক ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে এক সম্ভ্রান্ত এবং একান্নবর্তী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মোহাম্মদ দোয়া বখশ্, মা জোহরা খাতুন,স্ত্রী শামসুন নাহার বেগম। জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি রাজশাহীতে কাটিয়েছেন। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী সরকারি কলেজে থেকে দর্শনশাস্ত্রে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে একই প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত তিনি রাজশাহী সিটি কলেজ, সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা গার্লস কলেজ এবং দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৪ সাল পর্যন্ত একনাগাড়ে ৩১ বছর অধ্যাপনা করেন।
রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় কলেজের উদ্যমী তরুণ মিসবাহুল আজীমের সম্পাদনায় প্রকাশিত ভাঁজপত্র ‘চারপাতা’য় হাসানের প্রথম লেখা ছাপা হয়। লেখাটির বিষয় ছিল রাজশাহীর আমের মাহাত্ম্য।
খুলনায় এসে তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির উৎসমুখ খুলে গেল প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সন্দীপন’-কে কেন্দ্র করে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে নাজিম মাহমুদ, মুস্তাফিজুর রহমান, জহরলাল রায়, সাধন সরকার, খালেদ রশিদ প্রমুখ সংগ্রামী কয়েক জন তরুণের চেষ্টায় গঠিত হয়েছিল ‘সন্দীপন গোষ্ঠী’। তত দিনে অবশ্য হাসান আজিজুল হক রীতিমতো বিখ্যাত। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’-এর প্রথম গল্প ‘শকুন’-এ সুদখোর মহাজন তথা গ্রামের সমাজের তলদেশ উন্মোচিত করেছিলেন তিনি। প্রায় অর্ধশতাব্দীর গল্পচর্চায় বিষয়, চরিত্র ও নির্মাণকুশলতায় উল্লেখ করার মতো গল্প হাসান আজিজুল হকের অনেক। এ সবের মধ্যে রয়েছে ‘শকুন’, ‘তৃষ্ণা’, ‘উত্তরবসন্তে’, ‘বিমর্ষ রাত্রি, প্রথম প্রহর’, ‘পরবাসী’, ‘আমৃত্যু’ ‘আজীবন’, ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘খাঁচা’, ‘ভূষণের একদিন’, ‘ফেরা’, ‘মন তার শঙ্খিনী’, ‘মাটির তলার মাটি’, ‘শোণিত সেতু’, ‘ঘরগেরস্থি’, ‘সরল হিংসা’, ‘খনন’, ‘সমুখে শান্তির পারাবার’, ‘অচিন পাখি’, ‘মা-মেয়ের সংসার’, ‘বিধবাদের কথা’ ‘সারা দুপুর’ ‘কেউ আসেনি’।
‘আগুনপাখি’ নামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। উপন্যাসটি বর্ষসেরা উপন্যাসের স্বীকৃতি লাভ করে।