| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প পুনঃপাঠ সাহিত্য

পুনর্পাঠ গল্প : আমৃত্যু আজীবন । হাসান আজিজুল হক

আনুমানিক পঠনকাল: 25 মিনিট

আকাশে হাওয়া ছিল তখন। করমালি দেখছিল মোষের মত কালো মেঘ উঠে আসছে। সে চিৎকার করে ছেলেকে ডাকল, বিষম মেঘ আসতিছে বাজান। দেরি করিসনি আর। বলে সে উঠে গোয়াল ঘরে গিয়ে বলদ দুটোর দিকে একটু মন দিল। ধলা গরুটার লেজ নাচছিল চঞ্চলভাবে। একপাশে খোঁড়া গাইটা শুয়ে খড়ের গাদার ওপর। বিশাল কালো চোখে চেয়ে আছে অন্ধকারের দিকে। ছাইগাদা থেকে উঠে গা ঝাড়ল কুকুরটা, আকাশের দিকে মুখ তুলে জলো বাতাস শুঁকল।
করমালি বেরিয়ে এলো গোয়াল থেকে। উঠোনের ওপর দাঁড়িয়ে বিষণ্ণ বিলের দিকে তাকালো। বিল রুপোর মত ঝকঝক করছে। করমালির কটা চোখ মিইয়ে এলো। ক্যানভাসে আঁকা ছবির মত বিল স্থির- বহু দুরের গ্রামের সবুজ ফ্রেমে আটকানো। সেইখান থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে করমালি এদিক ওদিক খুঁজতেই নিজের পঁচাত্তর বছরের মাকে দেখল। সে একমনে ঝাঁটা বাঁধছে।
এইটুকু সময়মাত্র গেছে। যে সুর্মা রঙের মেঘবাহিনী উঠে আসছিল, তারা এখন আকাশে আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে। করমালি শুনতে পেল গর্জন গড়িয়ে বেড়াচ্ছে শানের মেঝের পিপের মত। দেখল কলো মেঘ ধোঁয়াটে হয়ে টগবগ করে ফুটছে। এই ব্যাপারে অগুণতি বর্ষাকাল এবং সহচর দৃশ্যপটগুলি- অর্থাৎ সাঁতলা বাতাসের ঝড়ো উন্মত্ততা, অতি বলশালী কৃষ্ণকায় মেঘ, পৃথিবীর মত পুরনো বিল এবং গাব-ভেজানো পানির মত কালো অতল জলরাশি, হাঁসেরা, বাড়ন্ত লতাপাতা আর দ্বিপ্রহরের দানবীয় খিদে- এই সব তার পিঙ্গল চোখের তারায় নেচে উঠল। তখন করমালি নিজেকে জাল থেকে ছাড়াতে আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে উঠোনটাকে জরিপ করতে শুরু করে। কিন্তু বেচারার চোখ গিয়ে সেঁটে থাকে মায়ের বেতো বাহাত্তুরে পায়ের বেগুনে হাঁটুটার ওপর। করমালি বিব্রত হয়ে কাঁচা পাকা দাড়িতে আঙুল চালায়। এই সময় গোপনতম সুক্ষ্মতম সমস্ত অস্তি প্রকাশ করে অবিশ্বাস্য শাদা আলো ঝলকে উঠল আর বিকট গর্জন করে উঠল আকাশ আগাগোড়া।
বিদ্যুতের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষণিক অথচ বিদারণকারী স্মৃতি এসে পড়ল। করমালির সামনে তার শৈশব মেলে ধরল মুহূর্তের জন্যে। সে এই ঢালু ভিটের গড়ানে দিকটায় যেখানে ভেঙে পড়ো-পড়ো বৃষ্টি-ছিন্ন মায়ের ঘরটা কোনমতে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে চেয়ে, পুরনো ভেজা গোলপাতা থেকে চুইয়ে পড়া কালো পানির টপাৎ টপাৎ শব্দ শুনে এবং আশ্চর্য এক নিরাসক্ত দৃষ্টি ফিরিয়ে ফিরিয়ে বিচ্ছিন্ন ভিটে, গোয়ালে জাবরকাটা গরু, ছলছলে বিলের ওপর ছিটোনো ছবির মত গ্রাম দেখতে দেখতে শৈশবের দ্যুতিহীন দিনে ডুবে গেল। এক নিষ্ঠুর বৃদ্ধের সঙ্গে বিলে যাওয়া, অচেনা মানুষের জমিতে সকাল বিকেল দুপুর সন্ধ্যে আর অসহ্য খিদে- এই সবের স্মৃতিতে ডুবে গিয়ে সে যখন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তখন ফুটন্ত আকাশ থেকে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি এলো। বিলের ওপর ধোঁয়াটে এবং শুধুই বৃষ্টির শব্দ।
মা মাজা টানতে টানতে ঘরের মধ্যে চলে গেল এবং এতক্ষণে ছেলে রহমালি পেটের ওপর শিরা পরিস্ফুট করে উদ্‌গার তুলতে তুলতে বেরিয়ে এই বিষ্টিটা থামলে যাবানে, বলে আকাশের দিকে চেয়ে রইল। আম আর জাম গাছের মাঝখান দিয়ে, উল্লসিত নৃত্যরত সুপারি বনের ভিতর দিয়ে রহমালির মা বেরিয়ে আসে এইবার। তার হাতে গলে-পড়া একতাল গোবর। হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে মাথা ঢেকে পরম আদরে গোবরপিন্ড নিয়ে ছপছপ শব্দে শিয়ালের মত এগিয়ে আসছে সে। কিন্তু গরুর জন্যে কাটা হলুদ ঘাসের স্তুপের কাছে এসে সে পা পিছলে পড়ে গিয়ে গোবর মুখে মেখে ভিজে, এবং অনবরত বৃষ্টিতে আরও বেশি ভিজে অদ্ভুত হয়ে উঠল। এই পতনে যখন করমালির যখন কিছুই করার নেই, সে বলল, আহারে গোবরটা ফালালি- বলে সম্ভবত সহানুভূতির জন্যেই জ্বালানি রাখার আড়ালটা থেকে উঠোনে বেরিয়ে এসে নিজেও ভিজতে ভিজতে ছেলের উদ্দেশে বলল, আর দেরি করিসনি দিনি বাজান। বিশ বছরের ছেলেটা এর পর আর কোন উপায় না দেখে লাফ দিয়ে উঠোনে নামল এবং চারপাশ খোলা হোগলায় ছাওয়া চাতালে এসে পুরনো টিন, ছোঁড়া মাদুর ইত্যাদির মধ্য থেকে কোদাল দুটো নিয়ে বাপের দিকে এগিয়ে গেল। তার কালো শক্ত শরীরের ওপর এখন বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে এবং সে যতক্ষণে লম্বা লম্বা পা ফেলে বৃষ্টির মধ্যে ধীরে সুস্থে করমালির কাছে হেঁটে এলো ততক্ষণে, দুরূহ দুর্ভেদ্য ধোঁয়ার মত বৃষ্টি-শরীরের আবরণে ঢাকা তার দেহ বেয়ে এই বাংলা কঠোর কোমল এই বাংলাদেশের পদ্মা মেঘনা ধলেশ্বরীর তেতো পোড়া ভিজে হাজার বছরের পুরনো জীবন গানের মত ঝরে পড়তে থাকে।
হাওয়াটা প্রচন্ড বেড়ে ওঠে। এত জোরে বৃষ্টি আসে যে বিলের মধ্যেকার গ্রামগুলো আর নজরেই পড়ে না। রহমালির মা গোবরের আশা পরিত্যাগ করে হাত ধুয়ে একটু আড়ালে গিয়ে ঊর্ধাঙ্গের কাপড় খুলে নিয়ে নিংড়ে পানি বের করছে। করমালি আড়চোখে সেই শীর্ণ কোঁচকানো শরীরের দিকে নজর ফেলে আরও বিব্রত বোধ করল- কিজন্যে সে বউকে খুঁজছিল তাও মনে পড়ল না। তখন ছেলেই মাকে তামাকের কথাটা মনে করিয়ে দিল। রহমালির মনে নেই কখন মায়ের দুধ খেয়েছে। কিন্তু সেই স্মৃতি তার সংস্কারের অন্ধকারে মানিকের মত জ্বলছিল বলে মায়ের খোলা বুক দেখে তার লজ্জা করে না। সে বিলের কালো পানির হিমে ডুব দেয়, যেন হেমন্তের শীত শীত রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে আতার পাতায় বাতাবির পাতায় বৃষ্টির ফোঁটার মত শিশিরের শব্দ শুনছে। কিন্তু করমালি গোয়াল ঘরের হতাশ অন্ধকারের দিকে চোখ ফেরায়। তার আহত বুড়ো গাইটা মৃত্যুর অপেক্ষা করছে সেখানে।
তারা বেরিয়ে আসার পর বৃষ্টি সোজাসুজি অন্ধকার হয়। ধূমল আকাশ গম্ভীর আওয়াজ দেয়, গ্রামের নির্জন হিম পথ সামান্য কেঁপে ওঠে। পথে বৃষ্টি নেই, সেখানে শরীরহীন অন্ধকার নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। দুপাশের কালো আম জাম হিজল সজনে কাঁঠাল থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি জমছে এবং ভুষো কালো কাদা পিঠ বের করে আছে। চলতে গিয়ে ভিজে লতা জড়িয়ে ধরছে পায়ে পায়ে, কখনো চাবুকের মত আঘাত করছে। এইভাবে পাড়টা পার হতে হলো। দূরে দূরে বাড়িগুলো কখনো চোখে পড়ল হেঁট হয়ে নমিত হয়ে আছে। চালগুলো নেমে এসে বুক-সমান মাটির দাওয়ায় এসে ঠেকেছে এবং যেহেতু চারিদিকেই দাওয়া- অতএব বাড়িগেুলোকে বিশালকায় পিঠ-উঁচু কচ্ছপের মত দেখায়। বিলে পৌঁছুনোর তাড়নায় পথ ছেড়ে করমালি বেড়া পার হয়ে বাগানে ঢুকছে। তারপর এই সব বাগান, সুদেহী সুপারি গাছ, খোলা জমি, বিমর্ষ ঘাস এবং গ্রামের কালো সবুজ আবেষ্টনী পেরিয়ে একেবারে হঠাৎই বিলে এসে পড়ল করমালি ছেলে নিয়ে। তখন ওদের চোখের সামনে আকাশ বিল গোটাদশেক পাতিহাঁস এবং বর্ষার বিলের আরও অজস্র খুঁটিনাটি নিয়ে ভয়ঙ্কররকম সবুজ একটা দৃশ্য ফুটে উঠল।
করমালি এখন তার পতিত জমিটাকে পরীক্ষা করছে। যে অংশটা পরিষ্কার করা হয়ে গেছে গতকাল, সেখানে আশশ্যাওড়া, আগাছা দাঁতনগাছের সবুজ পাতা এখন ফিকে হয়ে এসেছে এবং পিটিয়ে বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার জন্যে মাটি কালো হয়ে বসে গেছে। নিবিষ্টমনে এই সব দেখছে করমালি। বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় আর হাওয়া একদম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে বিল থেকে ভয়াবহ স্তব্ধতা উঠে আসছিল। শ্লেটের মত কালো আকাশের নিচে অতল বিলের জলরাশি এখন সম্ভবত শাদা কালো মেটে হাঁস দশটিকে আহ্বান করছিল না; ফলে তারা স্থির ভেসে বেড়াচ্ছিল। আয়নার মত পরিষ্কার পানিতে শুধু আকাশের ছায়াই পড়ে নি, সেখানে জলপিপি এবং অন্যান্য কিছু কিছু জলপ্রিয় পাখির চলাচলও ছিল। আর এই ঝকঝকে আয়নাকে ঘিরে বিভিন্ন আকারের জমিতে কচি ধান থেকে তরল সবুজ গলে গলে পড়ছিল। এরই মধ্যে পানির রং পাল্টাচ্ছিল, কারণ হাওয়া থেমে যাওয়ায় আকাশে কালো মেঘ স্থির হয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ পেল। সেজন্যে আকাশ প্রতীক্ষায় গম্ভীর হয়ে এলো ও স্থির স্ফটিকের মত পানিতে ফিট ফিট শব্দ করে জলপোকাগুলো চলাচল শুরু করল। এই আশ্চর্য শান্তি করমালিকে এমন মোহিত করে যে সে স্বপ্ন দেখতে পারে, তার জমিটা পরিষ্কার হয়ে গেছে- তুলে ফেলা জঙ্গলগুলো থেকে সোঁদা গন্ধ আসছে এবং জমিটা বিলের শামিল হয়েছে। তার তকতকে মেঝে কোদাল দিয়ে লন্ডভন্ড করে নতুন মাটির চাঙরগুলোকে আকাশের দিকে মুখ করে চিৎ করে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপর বৃষ্টি শুষে চাঙরগুলো ভরপুর এবং দুধে ভেজা পাউরুটির মত নরম মিষ্টি মেদুর মাটি। এইভাবে করমালি প্রায় বিনা চেষ্টায় দেখতে পায়, বিলের সঙ্গে লাগোয়া তার নিজের, একেবারে নিজের রক্তের ভিতর থেকে জন্ম দেওয়া আত্মজের মত এক খন্ড জমি কচি ধানে সেজে চোখের ওপর লাফিয়ে উঠল হাওয়ায়। করমালির বুক থেকে তাই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছিল বিল থেকে অনেক উঁচুতে পগারের মত আধ পরিষ্কার জমিটার দিকে চেয়ে। স্বপ্নকে কাজেই মুলতবি রেখে করমালি গতকালের কাটা জঙ্গল আগাছাগুলোকে তুলে জমির কিনারে সাজিয়ে রাখতে বলল রহমালিকে এবং নিজে কোদাল তুলে নিয়ে একমাত্র নারকেল গাছটাকে কেন্দ্র করে যে দুর্ভেদ্য লতাপাতার জালে একটি জটিল ঝোপের সৃষ্টি হয়েছিল তার বিনাশে এগিয়ে গেল। গলা পর্যন্ত উঁচু ঝোপটায় সে প্রায় আগাগোড়া ঢেকে গেল এবং তার কোদালের প্রথম আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে একটি হিস্ স্ শব্দ উঠল।
ব্যাপারটা ঘটল ঠিক এই মুহুর্তে। অন্তত এই তার ধারণা। অবশ্য সে এখন কিছুতেই বলতে পারবে না শব্দটা- যা নাকি কোদাল বা এধরনের কিছু চালানোর সময় অজান্তেই তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে- এই তীব্র শব্দটি আসলে তারই মুখ থেকে বেরিয়েছিল কিনা। কারণ কোদালের চোটটা মাটিতে পড়বার সাথে সাথে, কোপানো চাঙরটা উল্টে চিৎ করে দেবার আগেই করমালি একটা গম্ভীর তীক্ষ্ণ মর্যাদাব্যঞ্জক শিস দেওয়ার মত শব্দ শুনতে পেয়েছিল এবং প্রায় একই সময়ে সোনালি রঙের সাবলীল লতার একটা কুন্ডলীকে বিদ্যুতের মত দ্রুত উল্টোদিকে খুলে যেতে দেখেছিল। তারপরেই নিবিড় কালো রঙের নিকটবর্তী আকাশের পটভূমিতে, রসপূর্ণ উথলানো সবুজ, ছলোছলো সজল বিল, এক কথায় তার বর্তমানের পৃথিবীর সামনে জ্বলন্ত উজ্জ্বল সাপটাকে সে দুলতে দেখল। তার অতীত জীবনের ওপর জন্মপূর্বের অন্ধকার নাম্। পূর্ব স্মৃতির সুতো খুলতে থাকে, জীবন টাল খেতে থাকে দুরন্ত হাওয়ায়, অভাব দুঃখ দারিদ্র্য শ্রমের ভবিষ্যৎ বিলুপ্ত হয়। বর্তমান দৃশ্যপটও আবছা হয়ে আসে এবং সে তার চাষী জীবনের সঞ্চিত সমস্ত মনোযোগ দিয়ে দোদুল্যমান সাপটিকে পাঁচ হাত দূর থেকে দেখতেই থাকে। বিরাট একটা ছাতার মত তার ফণা আর ফণার ওপর যে গোক্ষুর ধপধপ করছে তা যেন শরতের সকালে সূর্যর মত উজ্জ্বল। করমালি তার চোখের দিকে চোখ রাখার চেষ্টা করল কিন্তু এক ধূসর ম্লান ঠান্ডা বিষণ্ন চোখ দুটি সম্পূর্ণ বিনা চেষ্টায় দৃষ্টির প্রতিদন্দ্বিতায় জিতে যায়। ফলে দ্বিতীয়বার করমালি সেদিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস পায় না। সে কি প্রচন্ড ভয় পেয়েছে? কন্ঠরোধ করা শংকা? বুক ভেঙ্গে দেওয়া উদ্বেগ? কিন্তু আশঙ্কা ঘৃণ বিবমিষা ভীতি স্নেহ বা ভালোবাসা কোন পরিচিত মনোভাবই জন্ম নিল না তার মধ্যে। কেবল সে তার ভাগ্যকে নিয়তিকে তার সংগ্রামকে- যে সংগ্রামে অন্ত নেই, উত্তেজনা নেই এবং যে সংগ্রামে বারবার পরাজয় এসে করমালির সাহস দেখে লজ্জা পায়- সেই সংগ্রামকে প্রত্যক্ষ করল। কারণ যে গোক্ষুরটি দুলুনির সঙ্গে সঙ্গে করমালির চোখের ওপর নাগরদোলার মত উঠছে পড়ছে তাতে যেন অসংখ্য জটিল শাদা সুতো জট পাকিয়ে পাকিয়ে করমালির ভাগ্য আর তার বর্তমানকে কেবলই বাঁধছে। অথচ তার গায়ের উজ্জ্বল সোনার রং হেমন্তের হলুদ রোদের মত যেন আকাশজোড়া। এই সময় চিৎকার করে একবার হাঁসগুলো ডেকে উঠল, বিদ্যুৎ চমকে উঠল, ভিজে সবুজ গাছপালা আগাগোড়া উজ্জ্বল হলো, বিলটার সুদূর প্রান্ত এবং সুদৃশ্য জলরাশি দেখা গেল, কাৎ হয়ে যাওয়া দুটি ডিঙি চোখে পড়ল, গ্রাম থেকে অস্পষ্ট অজস্র চিৎকার ভেসে এলো- পাখির মানুষের জীবজন্তুর। কানে শোনার ও চোখে দেখার এই সমস্ত শব্দ ও দৃশ্য মুহুর্তকালের জন্যে অভিজ্ঞতায় ধরা দিয়েই অতলে তলিয়ে গেল।
একটি মাত্র বোধ তীক্ষ্ণ হুলের মত করমালির চেতনায় বিঁধে আছে, যে-বোধের কোন নাম নেই। তখন, তখনো সুললিত ভঙ্গিতে সে দুলে চলেছে। তার অতি চকচকে ধারালো জিভ একটা সকৌতুক ধরনে বারবার বেরিয়ে আসছে। করমালি এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে দুলতে দুলতেই দূরে চলে যাচ্ছে। তারপর তার বিস্ফোরিত চোখের সামনে আশেপাশের বড় বড় গাছগুলোর মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেল ওর মাথা, একটা বড় পুকুরের মত বিরাট হলো তার উজ্জ্বল নিষ্কলঙ্ক ফণা- যেন তার জীবনের সমস্ত কামনার রূপ নিয়ে দেখা দিল তার মাথায় আঁকা গোক্ষুরটি। এইভাবে করমালি নিমেষে আবৃত হলো তার সংসার সাধ বাসনাসহ। তার ফণার নিচে বলশালী অন্ধকারের দাঁত কড়মড় করে ওঠে এবং গ্রামের মানুষের ভেঙে-পড়া, ঘুণধরা অথচ ঈশ্বরের মত অমোঘ সংগ্রামকে গ্রহণ করে এবং মুহুর্তে চিবিয়ে যেন গুঁড়ো করে ফেলে। গোখরো তারপর হঠাৎ কাছে এলো। করমালি কোদালের হাতলে হাত রেখে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কিন্তু সে আস্তে আস্তে মাথা নামিয়ে গম্ভীর নির্ভয় রাজকীয় শালীনতার সঙ্গে চষা জমির ওপর দিয়ে আলটার কোল ঘেঁষে সামান্য পানিতে অঙ্গ ডুবিয়ে নিষ্প্রভ আকাশের আলোয় গেরুয়া তারপর মেটে হতে হতে অদৃশ্য হলো।
করমালি যখন ফেরার কথা ভাবল তখন হাঁসগুলো বিল থেকে উঠে এসে ডাঙায় দাঁড়িয়ে গা ঝাড়ছিল। শুধু ছোট একটা বাচ্চা তখনো ডুবে ডুবে গুগলি তুলছিল পরমানন্দে। করমালি ওদের দিকে তাকাতে আরো দেখল, বিরাট মেটে হাঁসটা এখন পালকের মধ্যে ঠোঁট গুঁজে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই দেখে সে বিলের দিকে চাইল আর প্রচন্ড এক বিশালতার চাপে ভীষণ ভয় পেয়ে রহমালিকে ডাকল তক্ষুণি বাড়ি ফেরার জন্য। রহমালি আপন মনে কাজ করছিল তার দিকে পিছন ফিরে, কাজেই করমালির ক্ষীণ শুকনো আওয়াজ তার কানে যায় নি। ইতিমধ্যে বিলটা তার বুকের ভিতর থেকে ভয়াল রহস্য আকাশের দিকে ছুঁড়ে দেয়। তাই করমালির আহবান রহমালির কানে এখন বাজতেই থাকে, বাজান, শরীরটা বড় খারাপ লাগতিছে- কাজডা এ্যাহন থাক, বিকেল বেলায় করবানে। রহমালি বিস্মিত হয়ে ফিরে তাকায়। কাজ শুরু করার আগেই করমালির কি হয়েছে সে ভেবে পায় না। কিন্তু করমালির মুখের আতঙ্কের ভাষা পড়ে ফেলে রহমালি। তানাকে দেহিছিস রহম- করমালি জিজ্ঞেস করে। কার কতা কচ্ছ? উত্তরে করমালি মন্ত্রের মত বারবার আওড়ায় তানারে দেহিসনি- উরে কপাল! তানারে দেখলিনে- আমার জমিতি রধিষ্ঠান করিছে। কনে ছিলি তুই?
রহমালি এখন বাপকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইছে। করমালি দুর্বোধ্য হয়ে উঠল তার কাছে। আকাশ অন্ধকারে গর্জন করলে, বাতাস বন্ধ হয়ে নিঃসীম অথৈ পানি কালো হয়ে উঠলে যখন অচেনা মাছ পিঠ উঁচিয়ে রেলগাড়ীর মত দৌড় লাগায়- সেই সব মুহুর্তে সবকিছু ভয় আনে রহমালির কাছে। করমালিকে এখন ওর ভয় করছে। কাজেই ওরা এখন কোদাল ঘাড়ে নিয়ে জমি থেকে উঠে আসছে। অল্প পানিতে পায়ের পাতা জাগিয়ে পানি ছিটুতে ছিটুতে বাড়ির পথ ধরেছে। তারপর আবার সেই ছায়াময় অন্ধকার পথ, বিশাল সিক্ত বাগান, বড় বড় ফোঁটায় টপটপ বৃষ্টিশব্দ। কচ্ছপের মত পিঠ-জাগানো বাড়িগুলো পেরিয়ে করমালির উঁচু ভিটে আর শুকনো কলাপাতা ঝোলানো বেড়ার ফাঁক দিয়ে মায়ের ভেঙে-পড়া চালাটা এইবার নজরে আসে। সেইখানে দাঁড়িয়ে আকাশে দু হাত তুলে হাস্যকর অঙ্গভঙ্গ করছিল বুড়ি, তাও দেখতে পায় করমালি। মায়ের হাঁটু দুটি ফুলে ওলকপির মত হয়ে আছে, চেষ্টা করলেও এতটুকু হাঁটবার শক্তি নেই তার। অতদূর থেকে তার ক্ষীণ চিৎকার করমালির কানে আসে না। সে দেখছিল এক জায়গায় দাঁড়িয়ে হাত পা ছোঁড়ায় তাকে একটা বদখত ডাইনির মত মনে হচ্ছে। এই সময় অনেক মানুষকে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। বিশেষ করে করমালির গোয়ালের সামনে একটা ভিড়ই বুঝি জমে উঠেছে। ঠিক তখুনি চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে শুকনো আমসির মত বুক উন্মুক্ত করে প্রায় বিবস্ত্র রহমালির মা চিলের মত তীক্ষ্ণকন্ঠে চেঁচাতে চেঁচাতে এগিয়ে আসে, উরে আল্লারে, আমার কি সব্বোনাশ হইছে রে!
আই- কর্কশ ধমক দিল করমালি, কি হইছে, আ? হইছে কি- এই কথা বলতে বলতেই করমালি গোয়াল ঘরে পৌঁছায় এবং মানুষ তাকে পথ করে দেয় পরম সহানুভূতিতে। সে ভিতরে ঢুকে দেখল, প্রায় সমস্ত গোয়াল জুড়ে দীঘল তরুণ পুরুষ্টু ধলা বলদটা চার পা মেলে নিথর শুয়ে আছে। সে তার সজল কালো চোখ মেলে আছে। তা থেকে পানি গড়িয়ে চোয়াল পর্যন্ত এসেছে আর ধপধপে ফেনা জমে আছে তার মুখের একপাশে। সামনের একটা পা হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে বড় টানটান করুণভাবে সে শুয়ে আছে। করমালি সেদিকে অর্থহীন চোখে চেয়ে থাকে। বুড়ো খোঁড়া গাইটা সরসর শব্দে লেজ নাড়ে। নীল রঙের বিরাট একটা মাছি এসে ধলা গরুটার নিষ্প্রাণতার ওপরে বসে বসে পা ঘষে, করমালির কাঁধের ওপর দিয়ে, বগলের ফাঁকে, তার সামনে, পিছনে, আশেপাশে, উঠোনে অনেক মানুষ বিনাশব্দে নিশ্বাস ফেলে। তাদের চোখের তারা কাঁপে, পাঁজর জির জির করে। ক্ষেত-খামারের কাজ ফেলে কেউ কোদাল কাঁধে বা নিড়ুনি হাতেই চলে এসেছে। অন্যের ক্ষেতে দিনমজুরি থেকে এইমাত্র ফিরে এখন তারা ক্লান্ত- বড় ক্লান্ত, বড় বেশি সহানুভূতিতে আচ্ছন্ন এবং চোখ অন্ধকার করা খিদেয় তাড়িত! পিটুলি গাছে বর্ষার হাওয়া দোলে, ভেসে বেড়ায় এবং নিঃশব্দে অসহ্য হয়ে ওঠে। তখন কেউ ঘোষকের মত আবেগহীন গলায় উচ্চারণ করে, সাপে কাটিছে। এই কথায় সমস্ত বন্ধ-দুয়ার খুলে যায়, শত-সহস্র কন্ঠে যেন অনবরত কথার ঢেউ বইতে থাকে। দ্যাহো তো, লোম টানলি উঠে আসে নাহি। করমালি একজনের হাতের সুন্দর শাদা ঘাসের মত একগুচ্ছ লোমের দিকে চেয়ে থাকে। দেহিছ- ঠিক কইছি, সাপেই কাটিছে। আহারে- কি বলবানে কি করবানে কও দিনি। তারপর মানুষটা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। আর যেহেতু কান্না জিনিসটা ভয়ঙ্কর সংক্রামক, কাজেই যাদের সঙ্গে করমালির সম্পর্কমাত্র নেই শুধু এইছাড়া যে সকালে উঠে কাস্তে হাতে কাজের খোঁজে একসঙ্গে বের হতে হয় এবং কাজ পেলে চাচা ভাইপো ইত্যাদি সম্বোধনে একসঙ্গে বেড়া বাঁধার বা জমি তৈরির কাজ চালিয়ে যেতে হয় বা নিজেদের একছটাক জমি নেই বলে অন্যের জমি ভাগে করার জন্যে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয়- এক কথায় বেঁচে থাকার তিক্ত সংগ্রাম ছাড়া অন্য কোন ঐক্যসূত্র নেই যাদের সঙ্গে সেই তারাও করমালির দূর সম্পর্কের ভাইকে কাঁদতে দেখে চোখ মুছতে থাকে।
এইখানে হঠাৎ কেউ করমালির হৃৎপিন্ডের বোঁটা ধরে হ্যাঁচকা টান দেয়। সে প্রায় ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু পাশের মানুষটা আঁকড়ে ধরে ফেলল তাকে। তার সামনে অন্ধকার শূন্য দিনগুলো ক্রমাগত পাক খেতে থাকল। কারণ এই কথা তার মনে এলো, আমার তো জমি নেই এক ছটাক- মোডে জমি নেই আমার। যেটুন আছে তাতে একটা মাসও চলে না। দামড়া দুডো ছিল তাই পরের জমি আবাদ করে দুডো ধান পাই। এ্যাহন, এ্যাহন আমার ধলা গেল আমি কি করবানে- উরে আমি করবানেটা কি? আমি কি করবানে? আমি কি করবানে? এইভাবে প্রশ্নটা জলো বাতাসের মত ঘুরে ঘুরে আসে, হাতুড়ির মত আঘাত করে ঠাস ঠাস করে, তার হৃৎপিন্ড কখনো গুঁড়িয়ে যায় হামানদিস্তার নিচে বরফের মত, কখনো উল্টোদিকে ধকধক করে লাফাতে থাকে। বাইরে রহমালির মা বিলাপ করে, কি কালসাপে খাইছে রে- ওরে আমারে ক্যান নেলো না? এমন সব কথা সে বলতে থাকে যার কোন অর্থ নেই এবং এই ঘটনার আবেগের দ্বারা স্পর্শিত না হলে যেসব কথায় হাস্যোদ্রেক হতে পারে। শুধু দেখা যায় করমালির মা এখন ধাতস্থ হয়ে পিঁচুটিঅলা চোখে বিমর্ষ বসে আছে। কিন্তু এই দৃশ্যটাকে হঠাৎ অতিমাত্রায় নাটকীয় করে তোলে রহমালি। উৎকটকন্ঠে দু হাতে পাঁজর চেপে প্রাণপণ শক্তিতে সে কেঁদে ওঠে। মনে হয়, ওর ভিতরটা যেন বোঝাই হয়েছিল, বোঝার ভারে তার মুখে রক্ত এসে গিয়েছিল, যেন শিরা ছিঁড়ে পড়ছে আর এখন সে নিজেকে ভারমুক্ত করছে, খালাস করে দিচ্ছে সমস্ত বোঝা। ওর কান্নাটা শুধুই চিৎকার কারণ যন্ত্রণার কোন বোধগম্য ভাষা নেই এবং এজন্যই সম্ভবত রহমালির অবোধ চিৎকার সবকিছুকে যন্ত্রণালিপ্ত করে। সমস্ত বিকেলের আকাশ ভারি হয়ে মানুষগুলোকে চেপে ধরে। মৃত গরুটাও এই যন্ত্রণার সহানুভূতিতে আর একটু হাঁ করে একপাশে তার কালো জিভ এলিয়ে দেয়।
করমালি উঠোনে দাঁড়িয়ে বিলের দিকে চেয়েছিল। খুব তাড়াতাড়ি অন্ধকার নেমে আসছিল বলে বিলের রং কালো হয়ে যাচ্ছিল আর ধানভর্তি ছায়াময় জমিগুলোকে আকাশের গায়ে ধ্যাবড়া ধ্যাবড়া করে লাগানো বাড়তি রঙের মত মনে হচ্ছিল। এক মুহুর্ত পরেই বৃষ্টি নামে। করমালি দাওয়ায় উঠে আসতে আসতেই বিল অন্ধকারে ডুবে যায়। খুঁটিতে ঠেস দিয়ে করমালি ভাবে হাওয়া যেমন বেড়ে উঠল তাতে বৃষ্টি বোধহয় সারারাত চলবে এবং তাতে মায়ের চালাটা কিছুতেই টিকে থাকতে পারে না। সে-ঘর থেকে এখন মিটমিটে আলো আসছে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে করমালি দেখল মা আপন মনে বকছে, আল্লার কাছে কিছু একটা নিবেদন করছে আর তারই ফাঁকে ফাঁকে এটা-ওটা নাড়াচাড়া করছে- টেনে নিয়ে আসছে মোটা কাঁথা, মাটির সরা বসাচ্ছে পানি ঠেকানোর জন্যে। এসব করতে গিয়ে বড় কষ্ট হচ্ছে তার। হাঁটু সোজা করে কিছুতেই দাঁড়াতে পারছে না মা।
রহমালি কি এতক্ষণ ঘরে ছিল? এই অন্ধকারের মধ্যে! রহমালির কথা মনে ছিল না করমালির। সে ধলা বলদটার বদলে রহমালিকে হারাতে প্রস্তুত ছিল। এইজন্যেই যখন সমস্ত ভবিষ্যৎকে সবলে রুদ্ধ করে দিয়ে, অনশন উপবাস এবং উলঙ্গ মৃত্যুকে একমুহুর্তে হাজির করে করমালির বুকের ধন অন্ধকার গোয়ালে শুয়ে আছে তখন আর রহমালির কথা মনে নেই। এখন দেখা গেল সে ঘর থেকে বেরিয়ে আর একটা খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসেছে এবং সম্ভবত অনেকক্ষণ পরে, অন্ধকার আরও ঘন হলে, বাতাসের বেগ আরও বাড়লে আস্তে আস্তে ডাকছে করমালিকে, বাজান।
করমালি শুনতেই পেল না। ছেলেটা তাই আবার একটা প্রচন্ড হৃদয়ভার অনুভব করে। সেজন্যে সে উঠে আসে, করমালির কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায় এবং ফিসফিস করে বলে, তোমার তো ট্যাহা নেই বাজান, ধলা দামড়াটা মরিছে- আর তো গরু কিনতি পারবা না- এবারের ভাগ-চাষডা কি করে করবা? আমরা এবার মারা যাবানেরে বাজান- আচমকা চিৎকার করে করমালি, ছিলা-ছেঁড়া ধনুকের মত উঠে দাঁড়ায় আর আকন্ঠ পিপাসার্তের মত ঠান্ডা পানির লোভেই যেন দু হাত বাড়িয়ে রহমালিকে বুকে টানে, মোডে মারা যাচ্ছি এবার- বর্ষাডা ক্যাবল শুরু হইছে, মালিক শোনবে গরু মরিছে, জমিগুলোন সব কেড়ে নেবেনে। কাল একবার মালিকের বাড়ি যাতাম, ধান চাতাম কিছু। এ্যাহন জমি নিয়ে নেবেনে, ধান পাবনানে এক ছডাক। কালথে কিষেণ দিতি হবে ডেলি। কিষেণের ট্যাহায় চাল কিনি কোন পেরকারে বাঁচতি হবেনে।
গরুটোরে সাপে কাটিল কহন বাজান? মোডে জানতি পারলাম না। এট্টু ওষুধ দিতি পারলাম না। কেউ তো দেহেনি সাপডারে।
করমালি অন্ধকারের দিকে চেয়ে আছে। জোনাকির দিকে চেয়ে আছে। বৃষ্টির দিকে। হাওয়ায় গাছের মাথা দুলছে। অন্ধকার গাছ আকাশ হাওয়া ইত্যাদি পেরিয়ে বিশাল দুর্জ্ঞেয় বিল পড়ে আছে। সে এখন জীবনকে ছুঁড়ে দিল আকাশে এবং আবার লুফে নিয়ে মৃত্যুকে ছুঁড়ে দিল। জীবন বিলের অপার অন্ধকার তলদেশে গিয়ে স্থির হয়, বৈদূর্যমণির মত জ্বলতে থাকে। সে তার বিশাল অতীতকে পর্যবেক্ষণ করে এবং মায়ার মত মাটিতে, ঘাসে বাতাসে ধানে তার সারা দেহ জড়িয়ে থাকে। এই দেশের অনাদি প্রাণ তাকে ঘিরে স্পন্দিত হয়, কাঁপতে থাকে, নাচতে থাকে আর এই ভয়াবহ জীবনাচরণকে কেন্দ্র করে আদিঅন্তহীন বিল স্তব্ধ হয়ে থাকে। জীবনকে তা পাকে পাকে বাঁধে- ব্যক্তিকে এবং মানুষ নামের ধারণাকে, করমালির সংগ্রামকে এবং জীবন সংগ্রামকে। সে লক্ষ লক্ষ মানুষের সংগ্রামের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়ায়, তাকে ব্যর্থ করে, তছনছ করে, ধ্বংস এবং মৃত্যুকে পাঠায়, আবার গভীর মায়ায় মানুষকে জড়ায়, তাকে ভালবাসে। এইজন্যে অবয়বহীন কালো পাহাড়ের মত কখনো তাকে দেখা যায় দিগন্তের কাছে, কখনো প্রায় বুকের ওপর, কখনো সে উৎক্ষিপ্ত হয় আকাশে ঘূর্ণির মত এবং ঘর্ঘর শব্দে মন্থনদন্ডের মত গ্রামগুলোর ওপর নেমে আসে।
রহমালির গরম নিশ্বাস টের পাচ্ছিল করমালি। তার গা ঘেঁসে সে বসে আছে এবং করমালি সেইখানে বসে আবার অনন্য গোখরোটিকে দুলতে দেখতে পায়। যখন রহমালি সাপের কথা বলে, যে-সাপ তার বলদটিকে বিনষ্ট করে দিয়ে গেছে এবং যাকে কেউ দেখতে পায় নি, সে তার ফণা তুলতেই বিলের অভ্যন্তরে মাণিকের মত জ্বলতে থাকা জীবন হঠাৎ নিভে যায়।
করমালি দুর্ভেদ্য রহস্যের একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায়। সে দেখতে পায় বিলের পানি থেকে তার কুচকুচে কালো ঠোঁট দুটি জেগে উঠল, তারপর স্বচ্ছ বিমর্ষ চোখ দুটি আর ধারালো তলোয়ারের মত ছিপছিপে লিকলিকে জিভ এবং সে থুথুর মত নীল বিষ ছিটোলো। তারপরেই অকস্মাৎ বিস্তৃত ফণার মাথাটা শূন্যে লাফিয়ে ওঠে। বিশাল একটা পুকুরের মত ফণা- সেখানে গোক্ষুরটি ধপধপ করছে। সে ধীরে ধীরে হাঁ করলো এইবার, একটা বীভৎস অতল গুহার জন্ম হলো। সেখানে প্রথমে ধলা গরুটা, তার পরে করমালির কামনার রঙে রঙিন নতুন জমিটা আর তার যা কিছু আছে- রহমালি, তার নিজের মা, রহমালির মা এবং ভিটেবাড়ি সবকিছু সেই অন্ধকারে হারিয়ে গেল। এখন ফণাটা হারিয়ে গেছে, গোক্ষুরটি নেই, তার কালো জিভটাও চোখে পড়ছে না- শুধু অন্ধকারের একটা বিকট গহ্বর। করমালি দেখছিল কত ধীরে এবং নিশ্চিত গতিতে গাছপালা মাটি এবং অজস্র সাহসী মানুষসহ গ্রামটি ছোট হতে হতে সেই গহ্বরে প্রবিষ্ট হচ্ছে। সমস্ত কিছু এইভাবে অন্ধকারে হারিয়ে গেলে অজস্র দাঁতের সারি ঝকঝকিয়ে ওঠে এবং বজ্রগর্জনের মত কড়মড় আওয়াজ ওঠে। তারপর ওপর নিচু দু সারি দাঁত আঁটো হয়ে বসে যায়।
আকাশের রং পাল্টাচ্ছিল। পৃথিবীতে একটা বিবর্ণ আলো আসছিল। হাওয়া ধরে গিয়েছিল বলে বৃষ্টিও নেই আর সেজন্যেই বিশ্রী একটা গুমোট গরম পড়েছিল। তখুনি কেউ করমালিকে ডাকছিল। সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না যে কেউ তাকে ডাকছে। কিন্তু বাইরে থেকে একটি কর্কশ গলা তাকে ডেকেই চলেছিল, করমালি আছিস নাহি? ও করমালি! বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল বলে বাইরের মানুষটার চিৎকার গম্ভীর শোনাচ্ছিল। তার হাতের টর্চের আলো ইতস্তত দৌড়ে বেড়াচ্ছিল কখনো বৃষ্টিধোয়া গাছের মাথায়, কখনো এমনি আকাশে উদ্দেশ্যহীন, কখনো-বা করমালির বাড়ির ভিতরে উঠোনে। করমালি এজন্যে উঠল, উঠোন পেরিয়ে বেড়ার কাছে গিয়ে সারসের মত গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কেডা? সে মানুষটাকে আবছা দেখতে না দেখতেই গ্রামের মানুষের বদভ্যাস মাফিক লোকটা তার মুখের ওপর টর্চের আলো ফেলে। করমালি চোখ কুঁচকে আবার জিজ্ঞেস করে, কেডা- কেডা ডাকতিছেন? পরিচয় দেবার প্রয়োজনীয়তা সম্পূর্ণ উপক্ষো করে গম্ভীর গলায় লোকটা বলে, এ্যাট্টা খবর শুনে আসতি হলো তোর কাছে।
এইবারে তাকে চিনতে পারে করমালি, ঠান্ডা ভারি গলায় আহ্বান করে, আসেন। তারা দাওয়ার কাছে আসতেই রহমালি একটা জলচৌকি আর একটা কালিপড়া হারিকেন নিয়ে আসে। তখন লোকটার চেক লুঙ্গি, দামি ময়লা শার্ট, রবারের জুতো, পোড়া কালো-রং এবং মোটা ঘাড়ের ওপর কাঁচাপাকা চুল ইত্যাদি চোখে পড়ে। সে জলচৌকিতে চেপে বসলে করমালি সোজা দাওয়ায় বসে পড়ে এবং হঠাৎ অসহ্য গরম লাগাতে গামছা দিয়ে বাতাস খেতে থাকে। তখন লোকটা ভ্রূ কুঁচকে চোখ একেবারে বন্ধ করে একজন চিন্তানায়কের মত কথা শুরু করে, কি আফশোসের কথা! গরুটা তোর অপঘাতে মরে গেল। তা আবার এই সময়ে! এ্যাট্টা কাঠা জমিও তো আবাদ করতি পারলি নে। কি গজব যে নামিছে মানষের উফর!
করমালি শোনে।
তা কি আর করা যাচ্ছে কও? গরুতো আর বাঁচাতি পারতিছ না!
কি করে পারতিছি আর? করমালি কথা বলে।
তা এ্যাহন কি করবি? গরু কি কিনতিছিস?
আমারে বেচলিও গরুর এ্যাট্টা ঠ্যাং কিনতি পারবনানে।
তাহলি? ঠ্যাং কিনলিও তো আর কাজ হচ্ছে না।
করমালি কাজেই আবার শোনে।
আমি তো আর জোতদার নই কি কস্ করমালি? দক্ষিণি জমিও নেই এক ছডাক। বছরশেষ ধানকডা পালি সোংসারডা চলে। তা তুমি তো আর আবাদ করতি পারতিছ না এবার! তাহলি আমার জমিগুলোর কি হচ্ছে ক।
কি কবানে কন দিনি?
আমি কই কি জমিগুলো এবার ছেড়ে দে। আসছে বছর গরুটরু হলি আবার নিস্ ক্যানো? তোরে ছাড়া জমিতো আর কারে দিচ্ছিনে!
উজ্জ্বল তীক্ষ্ণ খাঁড়াটি ঠিক এই সময়েই নামে। ঐখানে জলচৌকিতে বসে লোকটা করমালির মাথাটা হাড়িকাঠে ঠেসে ধরে। তার চোখে মৃত্যু থিরথির করে কাঁপে। অন্ধকার পাথরের মত বুকে চেপে বসে। সে যেন বিলের অথৈ পানিতে নেমে যাচ্ছে, আর বাতাসের জন্য শেষ চেষ্টায় বলছে, জমিগুলো নিলি আমি বাঁচপোনানে- উপোস করে শুকিয়ে মরে যাবানে।
আরে বিপদ- আবাদ করতিছিস কি করে আমারে ক দিনি।
আবাদ আমি করবানে। দ্যাহেন, ঠিক আবাদ করবানে। করমালি উঠে এসে লোকটার কাছে দাঁড়ায়, লাঙল কেনবানে আমি। ট্যাহা জোগাড় করে লাঙল কিনি আপনের জমি আমি আবাদ করতিছি- এই বলে সে কাকুতি জানাতে থাকে, বর্ষাটা শুরু হইছে ক্যাবল- আর কয়টা দিন দ্যাহেন। তহন না হলি জমি ছেড়ে দেবানে কচ্ছি।
এই হপ্তার মধ্যি আবাদ শুরু না হলি জমি আমি তোর কাছে রাখতি পারব না করমালি। আমাকেও তো বাঁচতি হবে। এই বলে লোকটা উঠে দাঁড়ায়, টর্চ জ্বালিয়ে চারদিক দেখে নিয়ে সাবধানে উঠোনে নামে ও একটু পরেই হারিয়ে যায়।
করমালি ফিকে অন্ধকারের মধ্যে চেয়ে দেখল বিল দিগন্তের কাছে এখন স্থির হয়ে ঝুলছে। তারপর তার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের নিচের দিকটা সামান্য কাঁপল এবং রংহীন অবয়বহীন বিকট একটা অস্তিত্ব এখন দ্রুত আকাশে আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে। কখনো সেটা সমস্ত আকারহীনতাকে অতিক্রম করে সুক্ষ্ম দ্যুতিময় তীরের ফলার মত শূন্যতায় বিঁধে ছিল, কখনো বেঢপ, কল্পনাতীত বৃহৎ হাতির শুঁড়ের মত অষ্পষ্ট নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছিল। নিচে পৃথিবীতে নিশ্চলের মধ্যে মাছের খোলা চোখে অন্ধকার ডুবে ছিল, ধান বেড়ে উঠছিল; কোথাও হয়তো কুমুদ ফুটেছিল আর এই আদিম অফুরন্ত আয়োজনের ভাঁজে ভাঁজে বিশালতা সাজানো ছিল ও অনিঃশেষ প্রাণ ছিল, অমর মৃত্যু ছিল, শ্রেণীবদ্ধ হাতিয়ার হাতে মানুষেরা ছিল এবং মুখোমুখি তাদের শত্রুরাও ছিল।
করমালিকে ডাকল রহমালি, বাজান। বাজান এ্যাহন কি করবা? সে তখন একেবারে শিশু হয়ে গিয়েছিল বলে এই একটা প্রশ্নই বার বার করছিল বোকার মত। ছোটবেলায় পায়ে একবার কাঁটা ফুটে গেলে সেটা টেনে বের করার কথা ভাবতে না পেরে সে শুধুই করমালিকে আকুলভাবে ডেকেছিল। করমালি কোন জবাব দিচ্ছিল না। তখন ছেলেটা চুপিচুপি বলল, বিষণ্ন মেঘস্বরের মত, গ্রীষ্মের দুপুরে চাতকের ফটিক জল চাওয়ার মত, বাজান, এ্যাট্টা কাজ করলি হয় না? ধলার বদলে আমি- আমি লাঙল টানতি পারিনে? একদিকি বুড়ো দামড়াডা আর একদিকি আমি। পারিনে বাজান? জমির মাটি তো মাখনের মত। পারব না আমি কও? আকাশ হাউই-এর মত জ্বলে উঠল। করমালি এইবার দীর্ঘ তপ্ত নিঃশব্দ কাঁদছে। দু হাত মুখের ওপর চাপা দিয়ে। ঘাড় ঝুঁকিয়ে একটা কান্নাই ফিরিয়ে ফিরিয়ে কাঁদছে। সঙ্গীতের সুরের মত বার বার শুরুতে ফিরে আসছে, কি কস তুই বাজান, কি কস?
প্রস্তাবটা করে ফেলার পর রহমালি তীব্র উত্তেজনায় জ্বলতে থাকে। নিজের অজান্তেই সে কখন করমালির জনকে রূপান্তরিত হয়, তালি মরবা নাহি? ট্যাহা আছে তাই গরু কেনবা? জমিগুলো ছেড়ে দিলি কি কলাডা খাবা সারা বছর? জমি আবাদ করতি হবে আর বিলির ধারের আমাদের পগারডায় এবছরই ধান রুতি হবে। বুজিচো?
একটু পরেই রান্নাঘরের কালো ঠান্ডা মাটির মেঝেয় করমালি দু হাঁটুর ওপর মাথা রেখে বসে আছে। রহমালি বাইরে হাতমুখ ধুচ্ছে। কুপির পাশে বসে নতুন বউয়ের মত গাঢ় নীল শাড়ির ঘোমটা দিয়ে অনেক পুরনো তরুণী রহমালির মা ভাত বাড়ছে। মাটির শানকিতে মোটা মোটা লাল ভাত আর দুটো টুকটুকে লাল লংকা করমালির নাড়িতে ঘূর্ণির মত মোচড় দিতে থাকে। সে তখন আর কিছুই মনে রাখতে পারে না। 
মা কনে? ঘুমাইছে নাহি? করমালি জিজ্ঞেস করে।
হ, ঘুমাইছে-
ভাত খাইছে?
না। খাবে এ্যাহন। তোমাদের হলি খাবেনে।
রহমালি হাতমুখ ধুয়ে ফিরে এলে করমালি খেতে শুরু করে।
খেয়ে উঠে রহমালির ঘুম পাচ্ছে। এখন তার ঘোর চলে গেছে। মেঘ কেটে যাওয়া রা্ত্রির আকাশ থেকে ঝরঝরে ঠান্ডা বাতাস পাওয়ায় রহমালি ভরা পেটে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছিল। সে উত্তরের পোঁতার ঘরে গিয়ে চাটাই পেতে শুয়ে পড়ল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার নাক ডাকার শব্দ আসছে। তাই শুনতে শুনতে করমালি উঠোনে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তারপর তারও ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসতে থাকে। সে আর দেরি করতে পারবে না বলে শেষ খবরদারিটুকু করে নিতে চাইল। বাড়ির বাইরে এসে সে ফাঁকা ভিটেটায় দাঁড়ায়। তখন গভীর অরণ্যের স্তব্ধতা গ্রামের পথে পথে, বাগানে এবং বড়ো বড়ো গাছের ডালপালায় ছড়িয়ে পড়েছে। অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছিল এবং কালো শ্লেটের মত আকাশে অজস্র তারাও ফুটেছিল। করমালি হঠাৎ খেয়াল করে সে তার গোয়াল ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ইতিমধ্যে হাঁড়িকুড়ি, থালাবাসন ইত্যাদির শব্দ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং রান্নাঘর চুপচাপ হয়ে এসেছিল। করমালি পায়ে পায়ে গোয়াল ঘরে ঢুকল কিন্তু সেখানে অপরিমিত অন্ধকার ছাড়া প্রথমে আর কিছুই ছিল না। তারপর মুমূর্ষু গাইটা ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে অন্ধকারকে সচকিত করে দেয়। করমালির চোখে তারারা কেঁপে উঠলে সে অন্ধকারকে ফিকে হতে দেখে। একটু দেরি করতেই সেই ফিকে অন্ধকারের মধ্যে বিশাল ছায়ার মত মৃত গরুটি ভেসে ওঠে- ঘাড় তেমনি একদিকে কাৎ করা, পাগুলো ছড়িয়ে পড়া- তেমনি করুণ অসহায় হয়ে সে মাটিকে আশ্রয় করে অন্ধকারে দুলছে। একটু বাতাস দিতেই করমালির মনে হলো পালকের মত হালকা ছায়াটা শূন্যে দুলে উঠল এবং চোখের ওপরেই ক্রমাগত কাঁপতে থাকল। কিন্তু হাওয়া বন্ধ হতেই সে আবার মাটিতে নামে, সুস্থির হয়ে শুয়ে থাকে। করমালি তখন তার পাশে মাটিতে বসে পড়ে। হাত বাড়িয়ে তার শঙ্খের মত শাদা কোমল গলায় হাত রাথে আর সান্ত্বনাহীন কান্না কাঁদে। এইভাবে তার চোখ অন্ধকার হয়ে গেলে ছায়াটা আবার হারিয়ে যায়। তখন পিছনে দরজার ওপর লাল আলো এসে পড়ে এবং গাঢ় নীল রঙের শাড়ি-পরা রহমালির মাকে দেখা যায়। তার হাতের কুপি থেকে গলগল করে ধোঁয়া বেরুচ্ছে এবং সে কুপিটাকে উঁচু করে ধলা গরু আর করমালিকে মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করছে। তার শীর্ণ তোবড়ানো মুখ লালচে আলোয় প্রায় বীভৎস হয়ে উঠেছে। নগ্ন চোখ দুটো কপালের বাইরে চলে আসতে চাইছে। কিন্তু যেভাবে তার কুপি-ধরা হাত উঁচু হয়ে আছে, ঠেলে বেরিয়ে আসা চোখ থেকে বিনত মায়াবী দৃষ্টি চেয়ে আছে তাতে করমালি সরাসরি ভেঙে পড়ে, কি করব কতি পারো রহমের মা? আমি এ্যাহন কি করব?
কাঁদলি বাঁচপে?
না।
তবে কাঁদতিছ ক্যানো?
আমি কি করব বুঝতি পারতিছি নে।
গুমোট গরমের দিনে ঝিরঝির বৃষ্টির মত রহমালির মা সেই অদ্ভুত প্রস্তাব করে, আমারে দিয়ে হয় না? কও। আমি তো দেহিছি দামড়া না থাকলি দুধের গাই দিয়ে আবাদ করিছো জমি। এ্যাহন আমারে দিয়ে পারবা না? রহমালিকে পেটে ধরিছি- তোমার সংসার টানতিছি এতদিন। আমি পারবানে- দেহো তুমি।
করমালির চোখ এখন শুকিয়ে গেছে এবং সে আশ্চর্য বিব্রত বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
সকালের উজ্জ্বল রোদে তাকে বের করে পড়ো মাঠে রেখে আসা হলো। দশ মিনিটের মধ্যে চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া হয়ে যেতে সে টকটকে লাল হয়ে একস্তুপ আগুনের মত জ্বলছিল। করমালি সেখান থেকে সোজা তার গতকালকের জমিতে এসে পৌঁছুল। বিল এই সময় সবকিছু পালটে মোহময় হাসছিল। কারণ সূযের আলো লম্বালম্বি তার ওপর পড়ায় কালো পানির ওপর ধবধবে শাদা ফিতের মত রেখা শুয়েছিল এবং সেটাকে সত্যিকার কোন মাছের পিঠ বলে মনে হচ্ছিল, আর যেখানে সূর্যর আলো শেষ হয়ে সূর্যটাই বিম্বিত, সেখানে গলিত রুপোর মত অপরিমেয় পানি অল্প বাতাসে শিরশির করে কাঁপছিল। সেদিকে চেয়ে করমালির চোখ অস্বস্তিতে করকর করলেও সে বারবার ঐ রুপোরাশির দিকে তাকাতে চাইছিল। কিন্তু কষ্ট অসহ্য হচ্ছিল। তাই সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে করমালি ছোট ধানের চারাভর্তি সবুজ টুকরো টুকরো জমিগুলোর দিকে চাইল। বিশেষ করে বিলের মধ্যে তার নিজস্ব যে একটুকরো জমিতে এখন বিঘত খানেক উঁচু ধান মাঝে মাঝে বাতাসে নেচে নেচে উঠছিল সেদিকে তার অনেকক্ষণ চেয়ে থাকতে ইচ্ছে হল। সে একই সঙ্গে রহমালি আর তার মায়ের কথাও চিন্তা করল। চিন্তা করতে করতে মুহুর্তের মধ্যে সে বিল এবং বিল-সংলগ্ন গ্রামগুলো এবং হাটবাজার ইত্যাদি সবকিছু কল্পনায় ঘুরে এলো। রবিবারের হাটে অসংখ্য মানুষ যাতায়াত করছিল। এই ভিড়ে করমালি দাঁড়িয়ে ছিল। অন্যদিন যে পড়ো জমিটা ভাগাড়ের মত নির্জন হয়ে থাকে- কাক বা চিল ছোটখাট হাড় কিংবা অন্যকিছু নোংরা জিনিশ নিয়ে নাড়াচাড়া করে, মরা বিড়াল বা কুকুরের ওপর শকুন এসে বসে এবং পত্রহীন শিমুলগাছে কিছু কিছু ঘুঘু এসে দুপুরের ক্লান্তিতে ডাকতে থাকে- সেখানে এখন শাদা কালো এবং আরো অনেক বর্ণের, অনেক আকারের অগুণতি গরু মাথা ঝুঁকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের বড় বড় কান খাড়া হয়ে উঠছে কখনো, লেজ নাড়ার সপসপ শব্দ শোনা যাচ্ছে। শরীরের অংশ বিশেষের চামড়া কাঁপিয়ে ছোট কালো রঙের মাছি তাড়াতে দেখা যাচ্ছে তাদের। করমালি বিলের প্রান্তে তার অসমাপ্ত ঝোপজঙ্গল ভরা পগারের মত উঁচু জমিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দালালদের ঘোরাফেরা যেন দেখতে পাচ্ছিল এবং দরাদরি করার চিৎকারও শুনতে পাচ্ছিল। এই সময়ে রহমালি কথা বললে সে চমকে ওঠে। রহমালি বলছিল, বাজান, আজ জমি সবডা সাফ না করতি পারলি এবার আবাদ করতি পারবা না।
বিলের পানি কি এ পর্যন্ত আসবে নে? করমালি জিজ্ঞেস করে। আসতিও পারে- মোডে বর্ষা শুরু হইছে, বিষ্টি তো আশ্বিন মাস পর্যন্ত হবেনে। করমালি নারকেল গাছটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। সেখানে সে নামহীন লতাপাতা ঘাস কাঁটাগাছ ইত্যাদির জঙ্গলের মধ্যে সেই বলিষ্ঠ প্রাচীন প্রাণীটিকে খুঁজতে থাকে। কালো মাটির খাঁজে খাঁজে পানি জমে আছে, তারা সূর্যকে বুকে নিয়ে ঝিকমিক করছে। মাটির মত প্রবীণ, অসংখ্য সময়ের মধ্যে দিয়ে অফুরানভাবে চলে চলে যে বয়েসের ভারে পৃথিবীর মত শক্তিশালী হয়ে গেছে এবং যার ওপর এখন সময় ধীর হাতে শ্যাওলার আস্তরণ পড়ায় সেই অমিত বলশালী অজেয় সর্পটিকে করমালি খুঁজছিল। সে ভালো করেই জানত এখন তাকে না পাওয়া গেলেও যে-কোন সময়ে যে-কোন জায়গায় তার আবির্ভাব ঘটতে পারে। কারণ যে সময়ের নিত্যসঙ্গী তাকে বার বার ফিরে পাওয়া যেতে পারে এবং বার বার হারানোও যেতে পারে। সময়েরর সঙ্গে মিশে আছে বলে সে অস্তিত্বে আছে, আবার সে চেতনা এবং অবচেতনাতেও একই সাথে ক্রিয়াশীল। কাজেই তাকে অতিক্রম করা যায় না, যদিও এই নির্দিষ্ট যে তোমাকে তারই সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত হতে হবে এবং পরাজয়ের হাতে বার বার আঘাত খেয়েও তোমাকে নতুন করে নতুন কৌশলে ও দক্ষতার সঙ্গে সমস্ত অস্ত্র তীক্ষ্ণধার করে নিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এই ব্যাপারের সঙ্গে কাজেই মৃত্যুর প্রশ্নও জড়িত রয়েছে। সম্ভবত তুমি মৃত্যুতেও তারই কাছে প্রত্যাবর্তন করে থাকো। মৃত্যু দুর্জ্ঞেয় বলে তাকেও তোমার দুর্জ্ঞেয় বলে মনে হয় এবং এই কারণে বান এলে, জমিতে নোনা পানি ঢুকলে, সাপে কাটলে, বজ্রপাত হলে, মালিক জমি কেড়ে নিলে তোমার তার কথাই পৌনঃপুনিক মনে হয়। এবং জীবন্তেরও এই কথা মনে হয়, কারণ জীবনেও সে আদিঅন্তহীন। জীবনের প্রবাহের সঙ্গেই সে নিঃশব্দে বয়ে চলেছে।
করমালি একমনে কাজ করছিল। তার শীর্ণ হাতের পেশিগুলো তখন যেন আর মাংসের ছিল না। আদতে সেগুলিকে দেখাচ্ছিল নীলচে ইস্পাতের মত- কারণ করমালির রং কুচকুচে কালো এবং সে প্রচুর পরিমাণে ঘামছিল বলে রোদ তার শরীর থেকে পিছলে পিছলে পড়ছিল। যেহেতু আজ আকাশে মেঘের কণামাত্রও ছিল না অথচ গতকাল প্রায় সারাদিনই বর্ষণ হয়ে গেছে এবং বাতাসে আর্দ্রতা অঅছে প্রচুর পরিমাণে, এজন্যে মাটি থেকে গরম বাষ্প উঠছিল। গুমোট গরমের অন্ত ছিল না। রহমালি তাই প্রায়ই ঝোপের আড়ালে বিড়ি খাবার ছল করে বিশ্রাম নিতে চাইছিল। বিলের পশ্চিম দিকের রুপোর খনিটা অনেকক্ষণ আগেই মাঝখানে চলে এসেছিল। এখন সেটা আস্তে আস্তে পুবদিকে ওদের কাছাকাছি আসছে। করমালি নারকেল গাছের নিচের সামান্য ছায়াটুকুতে দাঁড়িয়ে কোদালের লম্বা বাঁটটা তলপেটে ঠেকিয়ে দম নিচ্ছিল। জমিটার প্রায় সমস্ত জঙ্গলই এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে। রহমালি কাটা জঙ্গলগুলো জমির চারপাশে সাজিয়ে ফেলেছে এবং কিছুটা অংশে কোদাল চালিয়ে প্রায় ছাআঙুল পরিমাণ মাটি উল্টিয়ে চিৎ করে দিতে পেরেছে। করমালি এখন খিদে ও পিপাসায় দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছিল না। তবু তাকে ভাবতে হচ্ছিল কি কি করতে পারে সে। প্রথমত এই নতুন তৈরি জমি থেকে ধান পাওয়ার আশা এ বছর কোনমতেই করা চলে না এবং দ্বিতীয়ত তার নিজের জমি থেকে বারো-চোদ্দ মণের বেশি ধান পাওয়া যেতে পারে না। এইজন্যে জমিগুলো তাকে রাখতেই হবে। কিন্তু কিভাবে রাখা যায় কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিল না করমালি। বাপকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রহমালি ভাবল এখন করমালি নিশ্চয়ই একটা বিড়ি খেতে চাইবে। তাই সে কোঁচড় থেকে বিড়ি দেশলাই নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যায়। করমালি রহমালির দিকেই চেয়ে ছিল এবং তার দিকে চাইতে গিয়ে চোখে রোদ পড়ছিল বলে যখন সে কপালের ওপর হাত দিয়ে আড়াল করেছির চোখ দুটোকে, তখনই তার চোখের ছায়ার নিচে জমিটার একটেরে ছোট্ট শীতল খাঁড়িটায় গোখরোটিকে শুয়ে থাকতে দেখতে পেল। আজ তার উজ্জ্বল রং মেটে মেটে দেখাচ্ছিল। তার ওপর লতাপাতা বাতাসে ঈষৎ কাঁপছিল। তাই রোদ এবং ছায়া সেখানে পাশাপাশি খেলা করছিল। এইজন্যে আজ করমালির তাকে বিচিত্র আঁককাটা অজানা একটি প্রাণী বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে বা বোধ হয় দেখার আগেই করমালি চিনতে একটু দেরি করে নি। এইভাবে শুয়ে শুয়ে সে পৃথিবীর সঙ্গে তার আদি সম্পর্কে ফিরে গিয়েছিল। রহমালি কাছে আসতে করমালি আপন নিয়তিকে দেখানোর মত আঙুল উঁচিয়ে তাকে দেখালো। সে যেন নিজের কপালের অদৃশ্য জটিল অক্ষরগুলো নির্বিকারভাবে রহমালিকে দেখাতে চাইল। রহমালি প্রথমে মাটির সঙ্গে মিশে থাকা জীবটিকে দেখতে পাচ্ছিল না। তারপরে যখন সে তার চোখে পড়ল তার সমস্ত শরীর সামান্য সময়ের জন্যে কেঁপে শক্ত হয়ে এলো। কিন্তু এই অবস্থাটা থাকল অত্যন্ত অল্প সময়েরে জন্যে। বয়সের এবং মানসিক পরিণতির সোজা প্রমাণ হিশেবে যে কঠিন ভোতা ধৈর্য তার কপালে এবং চিবুকে অল্প গজিয়ে ওঠা দাড়ি-গোঁফে এবং ঠোঁটের রেখায় দানা বেঁধে উঠছিল এবং একটি নির্দিষ্ট বাঁধাবাঁধি জীবনের বাসিন্দা হিসেবে স্থপতির মত দক্ষতার সঙ্গে জীবনব্যবস্থা যে-কঠিন ও শান্ত, বিমর্ষ ও কৌতুকবিমুখ সংগ্রামপরায়ণতা তার সর্ব অবয়বে গেঁথে গেঁথে দিচ্ছিল, সে সমস্তই মুহুর্তে ঝরে যায়। কাজেই বিপুল অভিজ্ঞতার গ্রন্থিতে আবদ্ধ যে করমালির চেতনা সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতর হয়ে জীবনের অবশ্য-ঘটনীয়কে গ্রহর করতে পারে তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে রহমালি বাল্যে ফিরে যায়। ঝরণার মত চঞ্চল হয়ে ওঠে তার শরীর। কৌতুকে কাঁপে চোখের তারা। অনভিজ্ঞ শিশু-ঘোটকের মত উদ্দাম দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে সে। অভিজ্ঞতা ও শিক্ষার সমস্ত পারস্পর্য সে হারিয়ে ফেলে এবং অবিমৃষ্যকারীর মত ছুটে গিয়ে তার কোদালটা নিয়ে ফিরে আসে। এ সমস্ত করতে থাকল সে যতক্ষণ, করমালি নির্বিকার দাঁড়িয়ে থেকে লক্ষ করে। সে সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিল যে রোমাঞ্চকর কোনকিছুই ঘটতে পারে না। তবে শোচনীয় শোকাবহ কিছু ঘটে যেতে পারে। কিন্তু সে সম্ভাবনাতেও বিচলিত বোধ করে না করমালি- কারণ তা যদি ঘটেই তবে তার শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। কাল যখন তার সঙ্গে দেখা হলো তখন থেকে। হতে পারে তারও আগে থেকে, তার চেতনায় সমস্ত জীবন ধরে। জীবনের কুটিল কষ্ট অন্ধকারের মধ্যে। আত্মক্ষয়ী সংগ্রামে নিজেকে টিকিয়ে রাখার মধ্যে। এইভাবে জীবনের শুরুতেই- অন্ধকার, খিদে, বাসনা, দলিত কান্নাসমূহ, শূন্যতার গহবর, জমি, মাটি, বিল, লোকালয়, মানুষ- এই সমস্ত ক্রমের ধাপে ধাপে সেই আরম্ভ চলে আসছে- গতকালের করুণ মৃত্যুতে সে ছিল, হয়তো এখনো কোন নতুন মৃ্ত্যুতে সে থাকবে।
রহমালি পা টিপে টিপে এগিয়ে যাচ্ছে। তার শরীর ফুলে উঠেছে। পেশী দৃঢ় হয়েছে। দু হাতে কোদালটাকে উঁচিয়ে মাথার ওপর তুলে সে এখন তার একান্ত কাছে হাজির হয়েছে। কিন্তু সে ঠিক তেমনি করে নিথর শুয়ে। করমালি এদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বিলের দিকে তাকালো। এক্ষুণি বাড়ি যেতে হয় যে! দ্রুত বিকেল নেমে আসছিল। রহমালি তাকে এখন নাগালের মধ্যে পেয়েছে। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য স্থির করছে। তারপর নীলচে আলোর ঝলকানির সঙ্গে কোদাল পড়ল। মাটিতে কোপ পড়ার সেইটুকু সময়ের মধ্যে কানে তালা লাগার মত প্রচন্ড গর্জন এলো- হিস-স-স! বিদ্যুতের চেয়ে দ্রুত কর্মক্ষম গোখরোটি লেজের ওপর ভর দিয়ে বিশাল ফণা তুলে রহমালির প্রায় মাথার ওপর দুলতে লাগলো। ঠান্ডা ধারালো চোখে সে রহমালিকে নিরীক্ষণ করল একটু। তারপর মাথা নামিয়ে একসময়ে অদৃশ্য হলো।
বিস্মিত ভীত করুণ ছেলেটা দাঁড়িয়ে। করমালি কাছে এসে বলছে, কেউ মারতি পারে না। ওরে মারা যায় না কোনদিন।
ব্যাপারটা এইভাবে ঘটল। রহমালি ফিরে এসে তার মাকে আশ্চয সাপটার কথা বলল এবং খেয়ে নিয়ে সকলের বাড়ি বাড়ি কাহিনীটাকে সবিস্তারে বর্ণনা করার জন্যে বেরিয়ে গেল। সে প্রত্যেকের বাড়ি গিয়ে কিভাবে বিষয়টার অবতারণা করেছিল কে জানে! হয়তো একটা জলচৌকি বা চ্যাটাই টেনে নিয়ে বসে পড়ে কিংবা মানুষটাকে উঠোনের একদিকে টেনে নিয়ে গিয়ে ব্যাপারটা বলতে শুরু করেছিল। কিন্তু যা সে মুখে বলেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি বলছিল তার বিস্মিত চোখের সন্ত্রস্ত চাউনি, তার হাতের সমুদ্যত মুদ্রা। সাপটার বর্ণনা দেবার সময় সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, চোখের তারা কৌতুকে ভয়ে নাচিয়ে তার বিশাল আকৃতির মেটে রঙের ফণা, তার বিদ্যুতের মত গতি, নিষ্ঠুর ক্রোধ, সীমাহীন শক্তি আর অপার দয়ার প্রসঙ্গ ক্লান্তিহীনভাবে টেনে আনছিল। চেষ্টা করছিল বর্ণনাটা যাতে সঠিক ও জীবন্ত হয়। এজন্যে সময় এবং পারিপার্শ্বিকের কথাও তুলে ধরার চেষ্টা করেছিল সে। সূর্য, আকাশ, বিল, ধানের জমি, দুপুরের রোদ, ছায়াময় বনভূমি, অল্প কাঁপতে থাকা অতল জলরাশি ইত্যাদি সবকিছুই এক অদ্ভুত গ্রাম্যভাষায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল তার কাহিনির সঙ্গে সঙ্গে। এইরকম অবিশ্বাস্য তৎপরতার ফলে সম্ভবত সন্ধ্যার আগেই সাপটি গ্রামটিকে তার বিশাল শরীর দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বেঁধে ফেলেছিল, কারণ এইভাবেই কিছুমাত্র ব্যস্ত না হয়ে, নিশ্চিতভাবে কাজ করার রীতি তার। সে অত্যন্ত ধীর গতিতে পৃথিবীর বয়েসি গ্রাম্যচেতনায় উপস্থিত হতে জানত, কারণ গ্রামবাসী তার মধ্যেই সংগ্রাম করত, বাঁচত এবং মরত। এজন্যে কখনো সে তাদের তৈরি হতে দিত, কখনো ঝাঁপিয়ে পড়ত অতর্কিতে। এখন রাত্রি আসতে না আসতে সে প্রতিটি মানুষের চেতনায় হাজির হলো। তখন তারা কিছুমাত্র ক্রুদ্ধ না হয়ে কেবলমাত্র তাদের সংকল্পকে সংঘবদ্ধ করতে থাকে, তাদের চেতনাকে বল্লমের ফলার মত তীক্ষ্ণ করে নিয়ে আসে এবং সকাল আসার সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে একসঙ্গে মাঠের কাজে বেরোয়, দিনমজুরের কাজে যায়, যেভাবে একসূত্রে বাঁধা থেকে যাবতীয় সংস্কারের পরিচর্যা করে, গ্রামীণ জীবনের আদিমতাকে টিকিয়ে রাখে, লাঙল, গরু, হাতিয়ার ইত্যাদির বিবর্তন ঘটতে দেয়না- ঠিক সেই একই রকম জোট বাঁধার নমুনায় তারা করমালি এবং রহমালিকে বাড়ি থেকে জমির দিকে ডেকে নিয়ে যায়। দেরি করলি চলবে না নে- ওডারে শ্যাষ করে যে যার কাজে যাবানে। বাড়ির পাশে ও কাল রাখা কাজের কথা না বুজিচো? এই কথায় প্রত্যেকে নীরব থেকে নিজের নিজের হাতিয়ারের দিকে মনোনিবেশ করে। এই দলে প্রবীণদের অনেকেই আসে নি এবং যুবকদের চাইতে কিশোর ও বালক ছিল সংখ্যায় অনেক ভারি। প্রবীণরা হয়েতো করমালির মত ব্যাপারটার নিরর্থকতা বুঝতে পেরেছিল। হঠাৎ ট্যানা দলের মাঝখান থেকে লাঠি উঁচিয়ে চিৎকার করে উঠল, তাহলি এডাই তোমার গরুডা কাটিছে। করমালি ভাবল, যদি সে ইচ্ছা করে থাকে তাহলে হয়তো তাই। কিন্তু সে কথায় নকিব রকিব সরদারদের দুভাই, রউফ জমাদার, সাবু মন্ডল, ওয়াজেদ বিশ্বাসরা সবাই একটু সময়ের জন্যে কেঁপে উঠল।
মনের পিছনে যতক্ষণ সে আবহ সঙ্গীতের মত ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছিল, ততক্ষণে তারা বর্ষা, বিল, জমি ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করছিল। এই সব প্রসঙ্গ তাদের জীবনের অনুষঙ্গ। এই সব কথা তাদের মনে যেমন অনুরণন তুলতো তেমন আর কিছুতেই না। কারণ তাদের বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধারা এসব কথা বার বার বলে যেতো এবং সেজন্যেই সেগুলো গ্রামের পথে, তেঁতুলতলার অন্ধকারে, শান বাঁধানো পুকুরের ঘাটে, সর্বত্র, ওদের ঘরে-বাইরে মিশেছিল এবং বহু বহু বছরের এই দ্রবণের ফলেই তারা নতুন কিছু ভাবতে পারত না, অভিনব বিষয় ও বাক্য ব্যবহার করতে পারত না। কাজেই চাষবাস, ভাগে আবাদ, দুঃখ-কষ্ট, অনটন, বিধিলিপি, হাট-বাজার, ফসল ইত্যাদির আলোচনায় দলটা মগ্ন হয়েছিল এত বেশি যে, জমিতে না পৌঁছুনো পর্যন্ত তারা তার অস্তিত্বের কথা ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু জমিতে পৌঁছেই একটিমাত্র সংকল্পের সূত্রে একসঙ্গে বাঁধা পড়ে তারা যাবতীয় বিষয় নয় শুধু, পরস্পরকেও ভুলে যাচ্ছিল। এ থেকেই বোঝা যায় তার প্রভাব কত গভীর ছিল ওদের মনে। জমিতে নেমে তারা সৈন্যবাহিনীর মত মার্চ করে এগিয়ে গেল, জমি খন্ডটিকে কয়েকবার পারাপার করল। কিন্তু তাকে কোথাও পেল না। তারা তীক্ষ্ণ চোখে ছোট ছোট নালাগুলোর দিকে চেয়ে দেখেছিল। পরিষ্কার জায়গাটা বার বার পরীক্ষা করছিল, তাকে সেখানে শুয়ে থাকতে দেখা যায় কি না পরখ করার জন্যে। যে-ঝোপঝাড়গুলো এখনো কেটে ফেলা হয় নি, সেখানে সে ছায়ার মধ্যে বিশ্রাম করতে পারে ভেবে তারা লতাপাতা সাবধানে ফাঁক করে ঝরা পাতাভর্তি কালো মাটির মেঝেয় উঁকি দিচ্ছিল আর ছেলেরা একনাগাড়ে জমির চারপাশে কাটা জঙ্গলগুলোর ওপর লাঠি চালাচ্ছিল, যাতে যদি সে লুকিয়ে থাকে, বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়। কথাবার্তা সম্পূর্ণ বন্ধ করে একাগ্র মনে হারানো ধনের মত তাকে তারা খুঁজে বেড়াচ্ছিল। এইভাবে খুঁজতে গিয়েই ক্রমে তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল, বিশৃঙ্খলা দেখা দিল তাদের মধ্যে। আলাদা হয়ে গিয়ে কখনও তারা তার ভাবনায় অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল, কখনো এখানে এই সময়ে উপস্থিত হবার কারণ সম্পর্কে সচেতন হয়ে চমকে উঠছিল। সবাই যখন এইভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, করমালি তার কোদাল হাতে নিয়ে এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দলের বিচ্ছিন্নতা চুড়ান্ত হয়ে এলে, কেউ জমির বাইরে গিয়ে ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে থাকলে, বালকরা অনুসন্ধান ছেড়ে দিয়ে খেলা শুরু করলে এবং প্রত্যেকে নিজের সত্তায় ডুব মেরে একদম পৃথক হয়ে গেলে শূন্য থেকে স্তম্ভের মত একটা ঘূর্ণি বাতাস গর্জন করে নিচে নেমে এলো। তখন তাকে দেখা গেল। পিছনে ছায়াময় অন্ধকার গ্রামের পটভূমিতে বিপুল বিলকে সামনে ধারণ করে তার আজকের তেজস্বী ছিমছাম স্বর্ণবর্ণের শরীর অপূর্ব ভঙ্গিতে ওদের আহবান করছিল। আর তার চোখের দিকে চেয়ে, তার সাবলীল দুলুনিতে পিপাসার্ত সঙ্গীত রসিকের মত সেই যুবক, প্রৌঢ় এবং বালক হাতিয়ার হাতে রেখে তার দিকে এগিয়ে আসছিল এবং তাকে ঘিরে ফেলে নিবিষ্টমনে লক্ষ করছিল। সেই সময় করমালি দেখছিল পশ্চিম আকাশে দ্রুত একখন্ড মেঘ পাঠিয়ে দিচ্ছে বিল তার বুকের ভিতর থেকে। মুহুর্তে কালো মেঘখন্ডটি সমস্ত আকাশে ছড়িয়ে পড়ল আর যেমন হয়ে থাকে, সজল ছায়া পৃথিবীর ওপর নেমে এলো, দর্পণের মত স্থির হয়ে এলো সীসে-রঙের আজস্র জলরাশি আর বদলে গেল সাপটির উজ্জ্বল রং। তাকে মাটির মত কালো দেখালো এবং সে তার হালকা তারুণ্য পরিহার করে বিকট বৃহদাকার হয়ে উঠল তখন- বয়সে সময়ের সাথী এবং ওজনে অকল্পনীয়। তখন করমালি চোখ বন্ধ করল। কারণ তার বিশালতার দিকে, বিপুল ফণা এবং শাদা গোক্ষুরটির দিকে আর তাকানো যাচ্ছিল না। সে চোখ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে শব্দ উঠল- বোঁ-ও-ও-হিস। পরমুহুর্তেই নিঃশব্দের কালো ভারি যবনিকা পড়ে। চোখে চেয়ে এখন সে দেখল চোদ্দ বছরের ফর্শা মিষ্টি ছেলে সদেক তার দেহের ভারে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। আহা- তার হাতে শীর্ণ কঞ্চিটা এখনও ধরা। তার সরল পা সিধে মেলা। তার গলার কাছে ক্ষীণ কালো রক্তের ধারা। তাকে ধুলিসাৎ করে সে এখন ফণা গুটিয়ে আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে। তার দেহের ওপর ক্রুদ্ধ সবল হাতের লাঠির আঘাতে কিছুমাত্র ভুক্ষেপ না করে। তার সঙ্গে শেষ মোকাবিলার জন্যে করমালি অটল প্রতিজ্ঞায় ওর কাছে যায়, দৃঢ় হাতে তার শরীরের মাঝ বরাবর কোপ মারে। মুহুর্তে গতি বাড়িয়ে কিন্তু করমালিকে একেবারে হতাশ না করে, যেন দয়া এবং স্নেহবশত সে তাকে লেজের দিক থেকে আট আঙুল পরিমাণ দেহ উপহার দিয়ে যায়।
বিকেলে করমালি একাই গিয়েছিল। রহমালিকে সঙ্গে নিতে সাহস হলো না তার। তবে গোটা ব্যাপারটা ঘটে গেল অতি সহজে। লোকটাকে রাজি করাতে করমালি শুধু বলল, আমার জমিডা তো দেহিছেন। বিলির ওদিকি এমন জমি আর আছে কন দেহি?
করমালি তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, জমিডা ব্যাচপো না আমি। এটুকু জমিই আছে আমার- বেচলি থাকপে কি? ব্যাচপো না আমি। আপনে শ তিনেক ট্যাহা দিয়ে রাখে দ্যান জমিডা। ফসলডাও আপনের। মাঘ মাসে আপনের ট্যাহা দিয়ে দলিল ফেরত নিয়ে নেবানে।
লোকটা সব বুঝে বলল, ট্যাহা নিয়ে কি করবি? জমি দিলি আর কি ট্যাহা শুধতি পারবি?
ট্যাহা না নিলি আপনের জমি রাখপো কি করে? গরু এ্যাট্টা কিনতি হবে। আপনের জমি আবাদ না করলি তো চলবে না।
এরপর দু-এক মিনিটের মধ্যে কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল। করমালি কাজেই খুশি মনে ফিরে আসছিল। সে রাস্তায় নামতেই বৃষ্টি এলো। বৃষ্টি নামলো ঘন হয়ে। বৃষ্টির মধ্যেই সে রহমালিকে মনে মনে গাল দিচ্ছিল চিৎকার করে, হারামজাদা, আমার জমি আমি বেচতিছি, তোর বাপের কি- আঁ? শ্যাষ জমিডাও গেল? গেল তো গেল। কি করবানে? গরু না কিনলি, ভাগে জমি আবাদ করতি না পারলি কলা চোষবা সারা বছর? হারামজাদা! তারপর বৃষ্টিতে করমালি আগাগোড়া ভিজে গেল। এত বেশি ভিজে গেল যে মনটাও তার নরম হয়ে এলো। সে তখন বৃষ্টির শব্দের মধ্যে, আকাশের গর্জনের মধ্যে, বাতাসের স্বননের মধ্যে বলল, বাজান, আমার বাজান, রাগ করিস নি। জমি তো বেচি নি। মাঘ মাসে ট্যাহা কডা দিয়ে তোর জমি এনে দেবানে। বৃষ্টি খুব বেশি হচ্ছিল বলে করমালির চোখের পানি কিছুতেই দাঁড়াতে পারছিল না, ধুয়ে ধুয়ে যাচ্ছিল। এই সময় বিল চোখে পড়ল। দূরে সে তখন বৃষ্টির মধ্যে টগবগ করে ফুটছিল। আকাশ ও পৃথিবীকে একাকার করে দিয়ে বিরাট অগ্ন্যুদগীরণের জন্যে জ্বালাময় সীসে-রঙের ধোঁয়ার পাহাড় তৈরি করছিল বার বার। করমালি তার বাড়ির বাইরে খড়ের গাদার কাছে নারকেল গাছের নিচে এসে পৌঁছুল। রহমালি দেখতে পাচ্ছিল করমালি ভীষণ ভিজে, যেন দু হাত দিয়ে বৃষ্টি সরাতে সরাতে রাস্তা থেকে উঠে নারকেল গাছটার দিকে এগিয়ে আসছে। সেই সময় কটকটে শাদা তীব্র আলো ঝলকে উঠল। এবং বেশ একটু পরে পাহাড় বিদীর্ণ হওয়ার মত হিংস্র আওয়াজ উঠে বিলের দিকে চলে গেল গমগম করে। 
করমালি খড়ের গাদার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁচা-পাকা চুল দাড়ি ভ্রূ চোখের পাপড়ি ইত্যাদি নিশ্চিহ্ন হয়ে কদাকার কিম্ভুত দেখাচ্ছে তাকে। রহমালি বাড়ির বাইরে এসে তাকে বুকে করে বৃষ্টির মধ্যে সবল পায়ে অশ্রুহীন চোখে ভিতরে নিয়ে গিয়ে পরম যত্নে দাওয়ায় শুইয়ে দিয়েছে।
বৃষ্টি এখন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল।

১৯৬৭

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত