| 28 মার্চ 2024
Categories
ইতিহাস

হায়া সোফিয়া বদলে দিয়েছিল স্থাপত্যের ইতিহাস

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

মণিদীপা দে

বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য তৈরি হয়েছিল চতুর্থ শতকে।তখন রোমান সাম্রাজ্য বিস্তৃত আকার নিয়েছে, তার প্রশাসন আলগা হতে শুরু করেছে। ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে এই রোমান সাম্রাজ্য প্রশাসনিক দিক থেকে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এ পূর্ব অংশটি লাতিন-রোমান প্রভাবমুক্ত হয়ে গ্রিসের প্রভাবান্বিত হয়ে ওঠে। পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য নামের এ অংশের আলাদা রাজধানীও তৈরি হয়, যার নাম কনস্ট্যান্টিনোপল (পরবর্তীকালে যার নাম পাল্টে হয় ইস্তাম্বুল)। সম্রাট প্রথম কনস্ট্যান্টিন ও সম্রাট প্রথম থিওডোসিয়াসকে এই বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের স্থপতি বলা যায়।

বাইজেন্টাইন স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য হলো গ্রিক ও রোমান স্থাপত্যকলার মেলবন্ধন।এ স্থাপত্যে ব্যাসিলিকা (লম্বা হলঘর—প্রাচীন রোমে আদালত হিসেবে তৈরি হতো। পরে রোমের চার্চে এর ব্যবহার দেখা যায়) এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ (অর্থাৎ গোলাকৃতি বা সমবাহু বহুভুজ) উঠানের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। পরবর্তী পর্যায় এ রকম নকশা থেকেই তৈরি হয় গ্রিক চার্চ,যাতে চতুষ্কোণ উঠান আর তার উপরে গোলাকার ডোম বা গম্বুজ। চতুষ্কোণের ওপর গম্বুজ এমনিতে বসে না, তাই ব্যবহার করা হতো স্কুইঞ্চ পদ্ধতি (যাতে চতুষ্কোণটির কোণ কেটে অষ্টভুজ করে নেয়া হতো) অথবা পেন্ডেন্টিভ (ত্রিকোণাকৃতির সাপোর্ট)। এছাড়া বাইজেন্টাইন স্থাপত্যে দেখা যায় ঠাসবুনোট কাজ—মার্বেলের ওপর ইনলের নকশা, মোজাইক, কখনো কখনো ছাতে সোনার পাতের কাজ। বাইজেন্টাইন স্থাপত্যের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে পূর্ব ইয়োরোপজুড়ে, এমনকি রাশিয়ায়ও। তুর্কির ইস্তাম্বুল শহরের হায়া সোফিয়া এর শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন।

ইতিহাসে আছে এ জায়গায় চার্চ তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন সম্রাট প্রথম কনস্ট্যান্টিন, ৩২৪ খ্রিস্টাব্দে।এটি নির্মাণ করা হয়েছিল কনস্ট্যান্টিনোপলের প্রাচীন একটি পেগান মন্দিরের ওপর। স্থাপত্যটির নির্মাণ শেষ হয় ৩৬০ খ্রিস্টাব্দে, সম্রাট দ্বিতীয় কনস্ট্যান্টিনের সময়ে, তখন এর নাম ছিল ম্যাগনা এক্লেসিয়া। ৪০৪ খ্রিস্টাব্দে আর্চ বিশপ সেন্ট জন ক্রাইসোথমকে যখন তত্কালীন রাজমহিষী এলিয়া ইউডক্সিইয়া তাড়িয়ে দেন, তার তীব্র প্রতিবাদ থেকে এক প্রবল গণঅভ্যুত্থান হয়। সে সময় এ চার্চটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। এটি পুনর্নির্মিত হয় সম্রাট কনস্ট্যান্স ও প্রথম থিওডোসিয়াসের সময় এবং উদ্বোধন হয় ৪১৫ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু বিধি বাম। ৫৩২ খ্রিস্টাব্দে তত্কালীন সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের বিরুদ্ধে কনস্ট্যান্টিনোপলে এক বিরাট গণঅভ্যুত্থান হয়। সেই দাঙ্গায় শহরজুড়ে ভয়ংকর আগুন লাগে, হায়া সোফিয়াও তা থেকে রেহাই পায়নি। দাঙ্গা থেমে যাওয়ার পর সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ান হায়া সোফিয়াকে আবার নতুন করে গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। সম্রাটের নির্দেশ অনুযায়ী জোরকদমে কাজ করে মাত্র ছয় বছরে তৈরি হয় নতুন একটি চার্চ, যার আজকের হায়া সোফিয়া। এই হায়া সোফিয়া প্রায় সম্পূর্ণই নতুন, কেবল পুরনো চার্চের কিছু মার্বেল ব্লক আজও রয়েছে। তার মধ্যে ১২টি ভেড়ার রিলিফের কাজটি স্মরণীয়। এই মার্বেল ব্লকগুলো জার্মান পুরাতত্ত্ববিদ আলফন্স মারিয়া স্নাইডার উদ্ধার করেন।

৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে এটির কাজ শেষ হয়। এ অসামান্য কাজটি করেছিলেন যে দুজন স্থপতি, তাদের নাম ট্রালেস শহরের আথেমিয়াস ও মিলেটাস শহরের ইসোডোরাস। সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানকে সেলাম, তিনি তখনকার রীতি ভেঙে এ দুজন স্থপতির নাম উল্লেখ করে তাদের সম্মান জানিয়েছিলেন।

হায়া সোফিয়ায় আছে একটি সুদীর্ঘ ব্যাসিলিকা (যেটি তৈরি হয়েছিল সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ান দ্বারা নবনির্মাণের সময়) এবং চৌকো প্রার্থনাগৃহ, যার ওপর একটি ১০৫ (মতান্তরে ১০৮) ফুটের গম্বুজ বসানো আছে পেন্ডেন্টিভ এবং দুটি অর্ধগম্বুজের ওপর। ওপর থেকে দেখলে এটি একটি চতুষ্কোণের রূপ নেবে।তিনটি দালানের দুই ধারে মার্বেলের থাম উঠে গেছে গম্বুজটির ভার বহন করতে। গম্বুজটির একেবারে নিচের অংশে সারি সারি জানলা—প্রখর রৌদ্রে তারা অদৃশ্য হয়ে যায়; মনে হয় গম্বুজটি হাওয়ায় ভাসছে।

আলেকজান্দ্রিয়ার গণিতবিদ হেরন বা হেরোর সংখ্যাতত্ত্ব কাজে লাগানো হয়েছিল এই হায়া সোফিয়া নির্মাণ করতে। কোন তত্ত্বটি? পাই = ২২/৭ ! এটি ব্যবহার করে ব্যাসার্ধ থেকে পরিধি বের করা হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, যেহেতু হায়া সোফিয়ার গম্বুজটি একটি চতুষ্কোণের ওপর বসানো, চতুষ্কোণটির কর্ণের দৈর্ঘ্য নিখুঁতভাবে হিসাব করার প্রয়োজন ছিল। কারণ বর্গের কর্ণটিই হলো গম্বুজটির ব্যাস।হায়া সোফিয়ার গম্বুজটি ৩১ মিটারের একটি বর্গের ওপর তৈরি, যাকে তখনকার হিসাবে ৯৯ বাইজেন্টাইন ফুট হিসেবে ধরা হতো। দেখা গেছে স্থপতিরা গম্বুজের ব্যাস ১৪০ বাইজেন্টাইন ফুট বলেছেন, যা অংকের হিসাবে নির্ভুল। যা-ই হোক, অংকের কচকচিতে না গিয়ে সহজ করে এখনকার হিসেবে বলে দি যে হায়া সোফিয়ার মূল গম্বুজ এখনকার হিসাবে ১০৮ ফুট আর উচ্চতা ১৮০ ফুট।

হায়া সোফিয়ার ভাগ্য সত্যিই খারাপ। এত অংক কষে নির্মাণ করা সত্ত্বেও ৫৫৩ ও ৫৫৭ খ্রিস্টাব্দের ভূমিকম্পে মূল গম্বুজ ও পূর্ব দিকের অর্ধগম্বুজটিতে ফাটল ধরে। ৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে মূল গম্বুজটি ভেঙে পড়ে।তত্কালীন সম্রাট তত্ক্ষণাৎ এর মেরামত করার নির্দেশ দেন। এর মেরামতের দায়িত্ব পান ইসোডোরাস জুনিয়র, যিনি মূল স্থপতিদের অন্যতম মিলেটাস শহরের ইসোডোরাসের ভ্রাতষ্পুত্র। ইসোডোরাস জুনিয়রের হাতে গম্বুজটির আকৃতি ৩০ ফুট বাড়ানো হয়। এছাড়া গম্বুজটির মূল স্থাপত্য পাল্টে হয় ‘রিবড ডোম’ এবং হালকা কিন্তু মজবুত জিনিসের ব্যবহার করা হয়। লেবানন থেকে আটটি করিন্থিয়ান স্তম্ভ নিয়ে আসা হয় এর গঠনকে মজবুত করতে। আমরা যে হায়া সোফিয়াকে আজ দেখতে পাই, তার ভিত্তি এই ৫৫৮ খ্রিস্টাব্দের সংশোধিত হায়া সোফিয়া। তত্কালীন কবি পল সেলেন্টিয়াসিস এই হায়া সোফিয়ার পুনর্নির্মাণ নিয়ে একটি দীর্ঘ কবিতা লেখেন।

বাইজেন্টাইন চার্চের এক আশ্চর্য সময় অষ্টম শতক। এ সময় সম্রাট তৃতীয় লিওর হাত ধরে আসে ‘আইকনোক্লাজম’, অর্থাৎ চার্চের গোঁড়া মানসিকতার জন্য মূর্তি ভেঙে ফেলা। হায়া সোফিয়া এর থেকে নিস্তার পায়নি। সমস্ত মূর্তি ও ছবি সরিয়ে ফেলা হয়। প্রায় ১০০ বছর পর নবম শতকে সম্রাট থিওফিলাসের রাজকীয় সিলমোহরের হাত ধরে হায়া সোফিয়ায় আবার মূর্তি-ছবির পুনরাবির্ভাব ঘটে।

হায়া সোফিয়ার চিরশত্রু ভূমিকম্প আবার আঘাত হানে ৮৫৯ ও ৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে, যাতে একটি অর্ধগম্বুজ ভেঙে পড়ে, যার পুনর্নির্মাণ করেন সম্রাট প্রথম বাসিল। ৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ে পশ্চিমের অর্ধগম্বুজ, যার পুনর্নির্মাণ করতে সম্রাট দ্বিতীয় বাসিল ডেকে আনেন ত্রডাক নামের এক আর্মেনীয় স্থপতিকে। ত্রডাক তখন খুবই বিখ্যাত—আর্মেনিয়ার রাজধানী আনিতে তার কাজের অজস্র চিহ্ন দেখা যায়। ত্রডাক গম্বুজটির মেরামত তো করলেনই। এই সঙ্গে তাতে আঁকলেন যিশুর একটি ছবি। মাতা মেরির বিখ্যাত ছবিটিও এই সময়েই আঁকা হয়, যে ছবিতে মেরির দুই পাশে আছেন পিটার ও পল। সম্রাট সপ্তম কনস্ট্যানটাইনের বইয়ে এর বিশদ বিবরণ আছে।

কনস্ট্যান্টিনোপলের ইতিহাসে একটি অন্ধকার অধ্যায় ১২০২-১২০৪, অর্থাৎ চতুর্থ ক্রুসেডের সময়।ক্রুসেডাররা কনস্ট্যান্টিনোপল এবং সেই সঙ্গে হায়া সোফিয়াকে তছনছ করে দিয়ে যায়। ক্রুসেড-পরবর্তী সময় কনস্ট্যান্টিনোপল লাতিন-রোমানদের শাসনে আসে; সম্রাট প্রথম বাল্ডউইন ১২০৪ সালে এর শাসনভার গ্রহণ করেন। অন্যান্য অনেক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি হায়া সোফিয়াকে রাতারাতি রোমান-ক্যাথলিক চার্চে পরিণত করেন। সেই সময়ের আরেক মুখ্য নেতা এনরিকো ডান্ডিলো—যিনি ব্যক্তিগতভাবে হায়া সোফিয়াকে তছনছ করার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন—ঘুমিয়ে আছেন ওই হায়া সোফিয়াতেই। ইতিহাসের আশ্চর্য প্রহসন এই পরাক্রমী বীরের কফিনটি ঠিক কোনটি, তা কেউ আজ ঠিক জানে না। কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে সেই আগ্রাসী সেনানায়কের শেষ চিহ্ন।

১২৬১ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট পালাইয়োলোগাস কনস্ট্যান্টিনোপলের দখল নিয়ে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। সেই সঙ্গে সূচনা করেন পালাইয়োলগান বংশ, যারা কনস্ট্যান্টিনোপলে ১৪৫৩ অবধি রাজত্ব করেছিল।এ সময়ের মধ্যে ১৩১৭ সালে হায়া সোফিয়ার বড় রকম মেরামত করা হয়। সম্রাট দ্বিতীয় আদ্রনিকাস এর ব্যয়ভার বহন করতে পারেননি, শেষে নিজের মৃতা স্ত্রীর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বিষয়-আশয় থেকে এর অর্থের জোগান দেন। ১৩৪৪ খ্রিস্টাব্দে আবার ভূমিকম্পের আঘাতে হায়া সোফিয়ার বড় ক্ষতি হয়, চার্চটি ১৩৫৪ অবধি বন্ধ করে রাখা হয়েছিল।

১৪৫৩-তে এল কনস্ট্যান্টিনোপলে পালাবদলের পালা।তুর্কি আক্রমণে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং শুরু হলো অটোমান সাম্রাজ্য। দ্বিতীয় মেহমেদ হায়া সোফিয়াকে চার্চ থেকে একটি মসজিদে পরিণত করেন। তার সামনে বসে সুদীর্ঘ কাঠের মিনারেট, গম্বুজের ছাত থেকে ঝোলানো হয় বিশাল ঝাড়লণ্ঠন, ভেতরে বসানো হয় মক্কার দিকে মুখ করা মিহরাব ও ধর্মীয় পাঠের জন্যে মিম্বার। পরে একটি লাল মিনারেট বসানো হয় এর দক্ষিণ-পূর্ব কোণে, সম্রাট মেহমেদ বা তার পুত্র দ্বিতীয় বায়েজিদের সময়। দ্বিতীয় বায়েজিদ হায়া সোফিয়ার উত্তর-পূর্ব কোণের সাদা শীর্ণ মিনারেটটি তৈরি করান। পশ্চিম দিকের বাকি দুটি জোড়া মিনারেট সম্ভবত তৈরি হয় আরো পরে, দ্বিতীয় সেলিম অথবা তৃতীয় মুরাদের সময়। এ দুটি তৈরি করেছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থপতি সিনান, ষোড়শ শতাব্দীতে। কম-বেশি ৬০ মিটার উচ্চতার এ চারটি কোনার মিনারেট আজও অক্ষত আছে, নেই শুধু প্রথম নির্মিত কাঠের মিনারেটটি।

আজও দাঁড়িয়ে আছে হায়া সোফিয়া কালের অজস্র চিহ্ন নিয়ে। রাজছত্র ভেঙে পড়েছে, রণ-রক্ত-জয়-পরাজয়ের শেষে তুর্কি আজ স্বাধীন। কামাল আতাতুর্কের হাত ধরে তৈরি হয়েছে নতুন তুর্কি, কনস্ট্যান্টিনোপলের নতুন নাম হয়েছে ইস্তাম্বুল। ইস্তাম্বুল তুর্কির রাজধানী নয় বটে, কিন্তু সর্বাধিক জনপ্রিয় শহর। আর এ শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপত্য হিসেবে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হায়া সোফিয়া।

মণিদীপা দে: ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ভ্রমণবিষয়ক লেখিকা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত