গীতরঙ্গ জ্বর সংখ্যা: রোগ নাকি উপসর্গ । সাব্বির আহমেদ
জ্বর কী?
জ্বরের নাম শুনলে অনেকেই ভয়ে আঁতকে ওঠেন। আঁতকে ওঠাই বরং স্বাভাবিক, কারণ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছেন। সাম্প্রতিককালের কোভিড-১৯ এর পাশাপাশি ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়াসহ আরো অনেক রোগই এজন্য দায়ী। জ্বরে আক্রান্ত হলে মূলত শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, এর সাথে অনেকে মাথাব্যথা, খাবারের প্রতি অরুচি ও দুর্বলতাসহ আরো নানা রকম জটিলতায় ভোগেন।
শারীরিক জটিলতা থেকে সৃষ্ট অসুবিধার জন্য আমরা অনেকেই জ্বরকে আমাদের অসুস্থতার জন্য দায়ী করে থাকি। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, জ্বর নিজে কোনো রোগ নয়, বরং অন্য কোনো রোগের উপসর্গ বা লক্ষণ মাত্র। তাদের মতে, জ্বর হচ্ছে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণের বিরুদ্ধে আমাদের শরীরের একটি নিজস্ব রক্ষণাত্মক কৌশল। তবে শুধুমাত্র ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণের কারণেই যে আমরা জ্বরে আক্রান্ত হই তা নয়, বরং ক্যান্সার, টিউমার ও তাপপ্রদাহের কারণেও আমরা জ্বরে আক্রান্ত হতে পারি। এমনকি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে জ্বরের কারণ নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব হওয়ায় ডাক্তাররা প্রত্যেক জ্বরের রোগীকে আলাদাভাবে বিবেচনা করেন।

জ্বর হলে কী হয়?
জ্বর কীভাবে আমাদের শরীরে রক্ষণাত্মক ভূমিকা পালন করে তা নিয়ে আলোচনা করার আগে জ্বরের উপসর্গগুলো সম্পর্কে জানা যাক।
মানুষ উষ্ণ রক্তবিশিষ্ট প্রাণী। আমাদের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা প্রায় ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এখানে কিছু ভিন্নতা দেখা যেতে পারে। কারণ, আমাদের শরীরের তাপমাত্রা অনেকগুলো বিষয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যেমন— বয়স, লিঙ্গ, ও অঞ্চলভেদে শরীরের তাপমাত্রার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এমনকি, দিনের ঠিক কোন সময়ে আপনি শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ করতে চাচ্ছেন তার উপরও তাপমাত্রার পার্থক্য নির্ভর করে। আবার, পুরুষের থেকে নারীদেহের তাপমাত্রা সামান্য বেশি হয়ে থাকে, ঠিক তেমনিভাবে প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষ অপেক্ষা অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুর শরীরের তাপমাত্রা সামান্য বেশি হয়। এমনকি দিনের প্রথমভাগ অপেক্ষা দিনের শেষভাগে অর্থাৎ সন্ধ্যাবেলায় শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকে। এ কারণেই সন্ধ্যার দিকে জ্বর আসার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। যা-ই হোক, এরকম আরো নানা কারণে শরীরের তাপমাত্রা কম বা বেশি হতে পারে। তবে শরীরের তাপমাত্রা যদি স্বাভাবিকের থেকে সামান্য একটুও পরিবর্তন হয়, তবে সেটাকে আমরা জ্বর বলে থাকি। তাছাড়া তাপমাত্রা পরিবর্তনের পাশাপাশি জ্বরের তীব্রতাভেদে আরো বেশ কিছু লক্ষণ দেখা যায়। জ্বরের সময় খাবারের প্রতি অরুচি, বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরানো ইত্যাদি খুবই সাধারণ বিষয়। তাছাড়া জ্বরে আক্রান্ত হলে অনেকেই শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েন।

জ্বরে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায় কেন?
এখন দেখা যাক— আমাদের শরীরের তাপমাত্রা কেন বাড়ে। কিন্তু তার আগে আমাদের দেখব আমাদের শরীরের তাপমাত্রা কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। আমাদের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস নামক অংশটি মূলত আমাদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণজনিত সকল কাজ করে থাকে। এটি বিভিন্ন রকম হরমোন নিঃসরণের মাধ্যমে শরীরকে তাপমাত্রা বাড়ানো বা কমানোর নির্দেশ দেয়। এটি আমাদের শরীরে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে, কারণ আশেপাশের পরিবেশের সাথে আমাদের শরীরের তাপমাত্রার সামঞ্জস্য বজায় রাখতে গিয়ে কখনো কখনো তাপমাত্রা বাড়ানো বা কমানোর প্রয়োজন পড়ে।

যা-ই হোক, আমাদের শরীরে যখন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে, তখন আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত শ্বেত রক্তকণিকাগুলো সেই ভাইরাস অথবা ব্যাকটেরিয়াকে চিহ্নিত করতে পারে এবং তারা একপ্রকার রাসায়নিক নিঃসৃত করে, যাকে ‘পাইরাজেন ক্যাসকেড’ বলা হয়। অর্থাৎ, একপ্রকারের আত্মঘাতী জীবাণু হামলা হয়, যার ফলে অতিরিক্ত রাসায়নিক নিঃসৃত হয়, এবং দ্রুত হাইপোথ্যালামাসকে সতর্ক করা সম্ভব হয়। এই রাসায়নিক সংকেত রক্তের মাধ্যমে দ্রুত আমাদের মস্তিষ্কে পৌঁছায় এবং হাইপোথ্যালামাসকে সতর্ক করে। এরপর, শরীরে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ হাইপোথ্যালামাস বেশ কিছু হরমোন নিঃসরণ করে। নিঃসৃত হরমোনগুলো সাথে সাথে শরীরের তাপমাত্রা বাড়ানোর কাজ শুরু করে দেয়।
কিছু হরমোন আমাদের শরীরের বিভিন্ন পেশী ও রক্তনালীগুলো সংকুচিত করে ফেলে, এর ফলে অল্প পরিমাণ শক্তি নষ্ট হয়। তাছাড়া, কিছু কিছু হরমোন অতিরিক্ত শক্তির জন্য শরীরের বিভিন্ন অংশে জমে থাকা চর্বিকণা পোড়াতে শুরু করে। এভাবে উৎপাদিত অতিরিক্ত শক্তি শরীরের তাপমাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। এই সময় আমরা ঠাণ্ডা অনুভব করতে থাকি এবং শীতে কাঁপতে থাকি। এজন্য অনেকেই বলে থাকেন, “হাড় কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে”। তারপর ধীরে ধীরে শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। আর এরূপ তাপ বৃদ্ধির ফলে দেহের অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা যথেষ্ট গতি লাভ করে। প্রতি ১ ডিগ্রী তাপমাত্রা বাড়াতে আমাদের শরীরের প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি কাজ করতে হয়, যা কারো কারো জন্য ২৫ মিনিট ব্যায়াম করার সমান। তবে তাপমাত্রা যেন অতিরিক্ত বাড়তে না পারে সেজন্য হাইপোথ্যালামাসের বিশেষ কার্যপদ্ধতি আছে। যখন শরীরের তাপমাত্রা অতিরিক্ত হয়ে যায় তখন হাইপোথ্যালামাস পুনরায় বেশ কিছু হরমোন নিঃসরণ করে, যার ফলে রক্তনালী স্ফীত হয়ে যায় এবং সেগুলো ত্বকের খুব কাছ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় আমরা দ্রুত তাপ হারিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসি। তাই অনেক সময় এ কারণেই আমরা বলে থাকি, “ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেল”।

জ্বরের বিরুদ্ধে আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা
হাইপোথ্যালামাসের বদৌলতে বহিরাগত জীবাণুর বিরুদ্ধে আমাদের শরীর যথেষ্ট শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। টি-সেল এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। টি-সেল হচ্ছে একপ্রকারের শ্বেত রক্তকণিকা যা আমাদের শরীরে নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকে। অর্থাৎ, বহিরাগত ভাইরাস অথবা ব্যাকটেরিয়াকে তারা চিহ্নিত করে আক্রমণ করে এবং আমাদের রোগজীবাণু থেকে মুক্ত রাখে। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এই টি-সেলগুলো নিয়মমাফিক রক্তে চলাচল করতে থাকে, কিন্তু যখনই তারা জীবাণুর অস্তিত্ব টের পায় তখনই তাদের গতি বেড়ে যায়। তাছাড়া তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে তারা আরো বেশি সক্রিয় হয়ে পড়ে, কারণ আমাদের দেহের অভ্যন্তরীণ জৈব ঘড়ি স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক দ্রুত চলতে থাকে এবং প্রতিটি কার্যক্রম কম সময়ে সম্পন্ন হয়।
তাপমাত্রা বেড়ে গেলে টি-সেলগুলো দুই ধরনের প্রোটিন নিঃসরণ করে। প্রথমটি হলো ইনটেগ্রিন, এটি টি-সেলের পৃষ্ঠতলে যুক্ত হয় এবং বড় আকারের কমপ্লেক্স তৈরি করতে সক্ষম হয়। এই কমপ্লেক্সগুলোর মাধ্যমে টি-সেলগুলো একটি আরেকটির সাথে যোগাযোগে সমর্থ হয়। দ্বিতীয়ত, টি-সেলগুলো হিট শক প্রোটিন নামক আরেক প্রকার প্রোটিন কণিকা নিঃসরণ করতে থাকে। এই প্রোটিনগুলোর কারণে টি-সেলগুলো খুব দ্রুত রক্তনালিকা দিয়ে চলাচল করতে পারে। কারণ হিট শক প্রোটিন ও ইনটেগ্রিন নিঃসরণ করার ফলে টি-সেলগুলো বেশ আঠালো হয়, আর এ কারণে তারা রক্ত কণিকার তোড়ে ভেসে না গিয়ে রক্তনালিকার দেয়ালে আটকে যায় এবং সহজেই রক্তনালিকার দেয়াল ভেদ করে ইনফেকশনের জায়গায় গিয়ে পৌঁছায়। তাছাড়া, হিট শক প্রোটিনগুলো আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থাকে, যেমন— অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে আমাদের শরীরের কোষগুলো মারা যেতে পারে, হিট শক প্রোটিন কোষগুলোকে অতিরিক্ত তাপমাত্রা থেকে রক্ষা করে। মজার বিষয় হলো, এই হিট শক প্রোটিনগুলো আমাদের শরীরের স্বাভাবিক কোষগুলোকে প্রোটিন উৎপন্ন করতে নিষেধ করে দেয়, কারণ প্রোটিন ছাড়া ভাইরাসগুলো আর নিজেদেরকে রেপ্লিকেট অর্থাৎ তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে না।

এছাড়াও, অনেক সময় ভাইরাসগুলো সহজভাবে কোষের ভেতর ঢুকতে না পেরে কোষের দেয়াল ছিদ্র করে ঢুকে পড়ে, এর ফলে কোষটি নষ্ট হয়। তাই এরূপ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য হিট শক প্রোটিন আমাদের শরীরের কোষগুলোর প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত থাকে। আবার, আমাদের শরীরের নানা জায়গায় লিম্ফ নোড নামক অসংখ্য ছোট ছোট অঙ্গ রয়েছে যেগুলো দেখতে কিছুটা কিডনীর মতো। এই ছোট ছোট অঙ্গগুলো জীবাণুর জন্য একপ্রকার ফাঁদ হিসেবে কাজ করে, কারণ এই লিম্ফ নোডগুলোতে টি-সেলের পাশাপাশি আরো অনেক রকম শ্বেত রক্তকণিকা থাকে যেগুলো জীবাণুগুলোকে মারতে সাহায্য করে। আমাদের গলার দুই পাশের টনসিলগুলোও একপ্রকারের লিম্ফ নোড, তাই যখনই খেয়াল করবেন আপনার শরীরের লিম্ফ নোডগুলো ফুলে আছে, তখনই বুঝতে পারবেন আপনি কোনো জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন এবং আপনার শরীর তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। তবে এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে অবশ্যই অবহেলা না করে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

সিফিলিস রোগের চিকিৎসায় জ্বরের ভূমিকা
বর্তমানের কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। ১৮৫১ সালে জার্মান ডাক্তার কার্ল রাইনহোল্ড প্রায় ২৫,০০০ রোগীর বগলের তাপমাত্রা পরিমাপ করেন, তার পরীক্ষালব্ধ ফলাফল ছিল ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এদিকে আমেরিকার স্ট্যান্ডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন গবেষকের নতুন গবেষণায় দেখা যায় বর্তমান সময়ে আমেরিকার মানুষের শরীরের গড় তাপমাত্রা প্রায় ১ ডিগ্রী ফারেনহাইট কমে ৯৭.৫ ডিগ্রীতে দাঁড়িয়েছে। নতুন এই গবেষণায় অবশ্য এরূপ তাপমাত্রা কমার কোনো সুস্পষ্ট কারণ ব্যাখ্যা করা হয়নি। তবে জলবায়ু পরিবর্তন, ভালো থার্মোমিটারের ব্যবহার, পোশাক-আশাকের ধরন বদল ছাড়াও নানারকম ছোঁয়াচে রোগের নিম্নমুখী ধারাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এ কথা সত্য যে, আমরা প্রায় প্রতিনিয়তই নতুন নতুন জীবাণুর সম্মুখীন হচ্ছি, যেমন— কোভিড-১৯, ইবোলাসহ আরো নানা প্রাণঘাতী ভাইরাস। তবে আশার কথা হলো- চিকিৎসাবিজ্ঞানের যথেষ্ট উন্নতির ফলে আমরা অনেক জীবাণু থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছি।

এছাড়াও ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়ে শরীরের তাপমাত্রা বাড়ানোর বিষয়টি শুধুমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো কোনো গাছ ফাঙ্গাস দ্বারা আক্রান্ত হলে তার পাতার তাপমাত্রা বাড়িয়ে ফেলে। এছাড়াও শীতল রক্ত বিশিষ্ট মাছ ও সরীসৃপও এই দলে অন্তর্ভুক্ত। সম্প্রতি শীতল রক্তবিশিষ্ট একপ্রকার ইগুয়ানাকেও দেখা গেছে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর উত্তপ্ত পাথরের উপর বসে শরীরের তাপমাত্রা বাড়াতে। অর্থাৎ শরীরে জ্বর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আর বিবর্তনের ধারা অনুযায়ী, কোনো জীব কেবল সেই সকল বৈশিষ্ট্যই ধারণ করে, যেগুলো তাদের সেই পরিবেশে সহজভাবে বাঁচতে সাহায্য করে।

এমনকি জ্বরের ফলে আমাদের রোগ ভালো হয়, বিষয়টি একদম নতুন কোনো ধারণাও নয়। তার কারণ প্রাচীন গ্রীক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস বলেছিলেন,
He, who can not be cured by surgery or medicine, can be cured by heat and those, who can not be cured by heat are considered incurable.
অর্থাৎ, যে ব্যাক্তিকে ওষুধ দিয়ে ঠিক করা যায় না, তাকে উষ্ণতা দিয়ে ঠিক করা যায়; আর যাকে উষ্ণতা দিয়েও ঠিক করা যায় না, তার রোগের কোনো চিকিৎসাই নেই। এ থেকে অনুমান করা যায়, প্রাচীনকালেও এ ধরনের চিকিৎসার প্রচলন ছিল। ১৯১৭ সালে বেশ কিছু বিজ্ঞানী সিফিলিস রোগের চিকিৎসার জন্য এক অদ্ভুত পদ্ধতির প্রস্তাব দেন। তারা সিফিলিস রোগে আক্রান্ত শেষ পর্যায়ের রোগীদের শরীরে ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্রবেশ করানোর পরামর্শ দেন। এরূপ চিকিৎসাপদ্ধতির কথা শুনে অনেকেই যে আঁতকে ওঠেননি তা না, তবে বিজ্ঞানীদের ধারণার প্রতি তারা আস্থা রেখেছিলেন, কারণ সেসময় সিফিলিসের কোনো প্রচলিত চিকিৎসা ছিল না। আর তাছাড়া ম্যালেরিয়ার প্রচলিত চিকিৎসা ছিল, তাই তারা পরীক্ষা চালানোর অনুমতি পেয়েছিলেন। এর ফলে সিফিলিসে আক্রান্ত রোগীদের বাছাই করে তাদের ম্যালেরিয়া জীবাণুর সংস্পর্শে রাখা হতো। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলে রোগীরা প্রচণ্ড জ্বরে ভুগত, আর এই জ্বরের ফলে রোগীর শরীরের সিফিলিস ইনফেকশন আস্তে আস্তে ভালো হয়ে যেত। আর সিফিলিস ভালো হয়ে গেলে রোগীকে কুইনিন নামক ওষুধ দেওয়া হতো, এর ফলে রোগীরা ম্যালেরিয়া থেকেও সেরে উঠতেন।

এটি নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী চিকিৎসা ব্যবস্থা হলেও এই পরীক্ষায় শতকরা ১৫ ভাগ রোগী মারা যেত। এই পদ্ধতি আবিষ্কারের কারণে ১৯২৭ সালে অস্ট্রিয়ার বিজ্ঞানী জুলিয়াস ভাগনার-ইয়্যাউরেগকে চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়। পরে অবশ্য পেনিসিলিন আবিষ্কারের ফলে সহজেই সিফিলিস রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব হয়েছে।

জ্বরে আমাদের করণীয়
জ্বরের সবচেয়ে প্রচলিত ওষুধ হলো প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন। এগুলো শরীরের তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে। তবে জ্বরে আক্রান্ত হলে শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে দিয়ে শরীরকে তার কাজ করতে দেওয়া উচিত নাকি তাপমাত্রা বিপদসীমা অতিক্রম করার আগেই ওষুধ খেয়ে তা নিয়ন্ত্রণ করা উচিত, সে বিষয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়ে গেছে। কারণ, অনেকগুলো পরীক্ষার ফলাফল থেকে দেখা যায়, জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর ওষুধ সেবন করলে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে, বেশ কিছু ফলাফল অনুযায়ী, জ্বরের সময় শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বাড়তে দিলে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

তবে এ বিষয়ে আমাদের যথেষ্ট সতর্ক থাকা উচিত, কারণ জ্বর সবসময় সাধারণ ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের আক্রমণ থেকে না-ও হতে পারে, সেক্ষেত্রে শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে দেওয়া বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা আগেই জেনেছি, ডাক্তাররা প্রত্যেক জ্বরের রোগীকে আলাদা আলাদাভাবে বিবেচনা করেন, কারণ অনেক সময় জ্বরের আসল কারণ চিহ্নিত করা যায় না। তাই আমাদের উচিত জ্বরে আক্রান্ত হলে ঘাবড়ে না গিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া এবং সবসময় সতর্ক থাকা। পাশাপাশি ভিটামিনযুক্ত ফলমূল, তরল খাবার, ও প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করা, যা আমাদের দ্রুত আরোগ্য লাভে সাহায্য করতে পারে।
Language: Bangla
Topic: This article is about fever and the physiological process of how it works.
References:
- fever | Definition, Characteristics, & Causes | Britannica
- Why does your body temperature rise when you have a virus such as the flu? | HowStuffWorks
- Fever | Mediline Plus
- The fever paradox | NCBI
- Fevers can have some cool benefits | Science News for Student
Feature image: : What Happens in My Body When I Have a Fever? | Clevelandclinic
