গীতরঙ্গ গুপ্তচর সংখ্যা: গুপ্তচর ছিলেন হেমিংওয়ে । মুহিত হাসান
কিন্তু সোভিয়েত গোয়েন্দাদের সুনজরে কী করে এসেছিলেন হেমিংওয়ের মতো লেখক? এক্ষেত্রে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেছিলো তাঁর লেখা একটি গদ্যরচনাই, জানিয়েছেন রেনল্ডস। ওই গদ্যরচনাটি হেমিংওয়ে লিখেছিলেন, ১৯৩৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার একটি দ্বীপপুঞ্জ এলাকায় প্রলয়ঙ্করী হারিকেন ঝড়ের আঘাতে বেশ কয়েকজন নির্মাণশ্রমিকের নিহত হওয়া নিয়ে। নিহত নির্মাণশ্রমিকরা ঝড়ের সময় সরকারি প্রশাসনের নির্দেশে একটি ব্রিজ বানানোর জন্য ওই দ্বীপপুঞ্জে অবস্থান করছিলেন(তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন থিওডর রুজভেল্ট)। উল্লেখ্য, হেমিংওয়েও ওই দ্বীপপুঞ্জেই থাকতেন। ঝড়ের পর তাঁর ব্যক্তিগত স্পিডবোট ‘পিলার’-এ চড়ে আশেপাশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে দেখেছিলেন, শ্রমিকদের লাশ ভাসছে সাগরের জলে। রেনল্ডসের ধারণা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারের দায়িত্ব পালন করা হেমিংওয়ে ১৯১৮-য় যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর থেকে এমন বীভৎস ঘটনা আর লাশের সারি আর দেখেননি। ফলত এমন পচে যাওয়া লাশের ভাসতে থাকার দৃশ্য আর শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের হৃদয়হীন আচরণ তাঁকে ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল। তাই এই বিরাট বিপর্যয় নিয়ে তাঁর কলম থেকে বেরুলো এক ক্রুদ্ধ-ক্ষিপ্ত গদ্যলেখা। তা ছাপা হলো মার্ক্সবাদী পত্রিকা নিউ মাসেস-এ। উতপ্ত প্রতিবাদী রচনাটি সোভিয়েত গোয়েন্দাদের চোখেও পড়েছিল। তখন সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা বিদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে উদগ্রীব ছিল। কাজেই হেমিংওয়ের সাথে তারা যোগাযোগ স্থাপন করতে আর দেরি করেনি।
এই যোগাযোগ আরো দৃঢ় হয় ১৯৩৭ সালে, যখন হেমিংওয়ে ‘নর্থ আমেরিকান নিউজপেপার এলায়েন্স’-এর তরফে স্পেনে গিয়েছিলেন সেখানকার গৃহযুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতে। তখন আবার হেমিংওয়ের ব্যক্তিগত জীবন নানান চড়াই-উৎরাইবহুল সময় পার করছিল। দ্বিতীয় স্ত্রী পলিনের সাথে সম্পর্কটা ম্লান থেকে ম্লানতর হচ্ছে ধীরে ধীরে। তাঁকে রেখেই উড়াল দিয়েছেন স্পেনের পথে। সাথে নতুন বান্ধবী, সাংবাদিক মার্থা গেইলহর্ন। স্পেনে গিয়ে তাঁরা উঠেছিলেন মাদ্রিদ শহরের গাইলর্ড হোটেলে। সেখানে অবস্থানকালে হেমিংওয়ে প্রায় প্রকাশ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিখ্যাত ব্যক্তি, কমিউনিস্ট আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী, সাংবাদিক ও গুপ্তচরদের সাথে আলাপ করতেন। নিকোলাস রেনল্ডসের ধারণা, হেমিংওয়ে ব্যাপারটি বেশ উপভোগই করতেন। কারণ এমন সব স্থান ও ব্যক্তির সাথে তাঁর সংযোগ ঘটছিল, যা কিনা অন্য সাংবাদিকদের পক্ষে ধরা-ছোঁওয়া অসম্ভব। তিনি রীতিমতো আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের হর্তাকর্তাদের সাথে কথাবার্তা বলার সুযোগ পেয়েছিলেন।
হেমিংওয়ের ফ্যাসিবাদ-বিরোধী মনোভাব ক্রমে যতই চড়ছিল, ততই সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ ও কমিউনিস্টদের কাছে তিনি অধিক আকর্ষণীয় হয়ে উঠছিলেন। এমনিতেও স্পেনের গৃহযুদ্ধ নিয়ে খবর সংগ্রহে আসা সাংবাদিকদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বিখ্যাত ও প্রতিষ্ঠিত। স্পেনে অবস্থানকালেই তিনি কীভাবে জনতন্ত্রী গেরিলাযোদ্ধারা জেনারেল ফ্রাঙ্কোর জাতীয়তাবাদী সেনাবাহিনির(যারা আবার ছিল হিটলারের নাৎসি জার্মানি ও মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট ইতালির মদদপুষ্ট) বিরুদ্ধে লড়ছে, তা জানতে আগ্রহী হন। স্পেনের বেনিমামেট শহরে ‘এনকেভিডি’-র তত্ত্বাবধানে পরিচালিত গেরিলাযোদ্ধাদের একটি গোপন ক্যাম্পও হেমিংওয়ে পরিদর্শন করেন। সেই সময় তাঁর সাথে ছিলেন সোভিয়েত সিক্রেট পুলিশের জেনারেল আলেকজান্ডার অরলভ, যিনি ‘এনকেভিডি’-র হয়েও কাজ করতেন। ওই গোপন ক্যাম্পে তাঁরা দুজন একসাথে সোভিয়েত অস্ত্র চালিয়েছিলেন, মধ্যাহ্নভোজের সময় খানিক ভদকাও পান করেছিলেন। এই সফরের ফলে হেমিংওয়ের পরে কমিউনিস্ট গেরিলাযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে চারদিন কাটানোর ক্ষেত্রে সুবিধা হয়েছিল। ওই সময় ফ্রাঙ্কোর জাতীয়তাবাদী সৈন্যদের বহনকারী একটি ট্রেনের ওপর গেরিলাদের অতর্কিত আক্রমণের ঘটনাও তিনি সচক্ষে দেখেছিলেন। ধারণা করা যায়, তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস For Whom the Bell Tolls-এর প্লট নির্মাণের নেপথ্যে এই ঘটনাটির প্রভাব পড়েছিল। ১৯৩৯-এর জানুয়ারিতে বার্সেলোনার পতন ঘটলো জেনারেল ফ্রাঙ্কোর সেনাবাহিনির কাছে, ওই বছরের মার্চে হেমিংওয়ে বান্ধবী মার্থাকে সাথে নিয়ে চলে গেলেন কিউবাতে। কিউবাতে বসেই তিনি For Whom the Bell Tolls-এর পান্ডুলিপি নির্মাণের কাজ শেষ করলেন। সেপ্টেম্বর মাসে যখন হিটলার পোল্যান্ডে হানা দিচ্ছেন, তখন তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে চূড়ান্তভাবে বিচ্ছেদ ঘটালেন। আর মার্থার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন ১৯৪০-এর নভেম্বরে । মধুচন্দ্রিমা যাপনের জন্য পারি দিলেন নিউ ইয়র্ক শহরে। ওই সময়েই সেখানে সোভিয়েত গোয়েন্দা জ্যাকব গোলোসের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের ‘গুপ্তচর’ও হলেন তখনই। নতুন বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে এক নতুন জগতেও পদার্পণ ঘটলো হেমিংওয়ের!