| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

হিম(পর্ব-২৫)

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
তৃষার মন খারাপ সকাল থেকে। ছোটো ভাইকে একটা ধমক দেয়ায় মুখ কালো করে কোথায় যেন বেরিয়ে গিয়েছে। কাল বিকেলে রঞ্জন আসবে বলে আসেনি৷ ফলে আলিঁয়স ফ্রাসেজের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রাগে দুঃখে টিকিট দুটো ছিঁড়ে ফেলেছে।  ভাইকে ডাকতে পারতো। কাছাকাছি একটা কম্পিউটার শেখার ইন্সটিটিউটে সে কম্পিউটার শেখে৷ ঐ সময় মূলত রঞ্জনের উপর রাগ করেই টিকিট ছিঁড়ে ফেলা। টিউশনির অবশিষ্টটুকু দিয়েই টিকিট দুটো কেটেছিলো। চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি ফিল্ম সোসাইটি আলিঁয়সে থ্রি কালার্স দেখাচ্ছিলো ক্রিস্তফ কিয়েস্লোস্কির। তারপর ভাইকে নিয়ে রিক্সায় বাড়ি ফেরার পথে জুতো ছিঁড়ে গেলো। সুধন্য বাসার সামনে নেমে দিদিকে বলেছিলো, ‘তুই বাসায় ঢুকে যা। আমি জুতো ঠিক করে আসি।’ ওর পকেটে টাকা ছিলো। জুতো ঠিক করে ফেরার সময় বোনেদের জন্যে আইসক্রিম নিয়ে এসেছিলো। বাবা বাসাতেই ছিলেন৷ অফিস যাননি আজ৷ মা অনেকদিন খাটের তলা থেকে হারমোনিয়াম বের করর,ঝেড়ে মুছে কয়েকটা গানও গেয়ে ফেললেন। ছেলেমেয়েরা জানে, আজ ওদের বাবা মায়ের বিবাহ বার্ষিকী ছিলো। রুলি পায়েস বানালো। এমনিতে রান্নাঘরে যেতে চায় না। আজ নিজে থেকেই গেলো। সন্ধ্যেটা অনেক সুন্দর ছিলো, জমজমাট। রাতে ঘুমোবার আগে ফোনে অনেক মিসড কল। রঞ্জনের৷ সে কল ব্যাক করলো না। শেষ রাতে ঘুম ভাঙতে একটা মেসেজ দেখলো-‘তুমি ফোন ধরলে না তাই বলতেই পারলাম না, বাবা চলে গিয়েছেন।’ বাকি রাত ওর আর ঘুম হলো না। চুপচাপ বারান্দায় বসেছিলো। মায়ের বাগানের ফুলেরা ওকে সঙ্গ দিয়ে গেলো। ভোরে বাবা হাঁটতে যেতে ওকে বসে থাকতে দেখলেন। তিনি জানেন, মেয়ে একটি ছেলের সাথে ঘুরে বেড়ায়। ছেলেটি মন্দ নয় বলেই তিনি কিছু বলেননি। এখনো কিছু করে উঠতে না পারলেও একদিন নিশ্চয়ই কিছু একটা করবে কিংবা না করলেও বা কি! সবাইকে কিছু একটা হতেই হবে তার কোনো মানে নেই। ধানক্ষেতের পাশে বসে পাখিদের ওড়াউড়ি দেখবার মতো অবসর আছে, এমন দুই একজন না থাকলে সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হয়। তাছাড়া ছেলেটির বাবা ওনার বাল্যবন্ধু, এক ব্যাচ সিনিয়র ছিলো স্কুলে৷ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বাবা বেরিয়ে গেলেন। মা পাশে এসে বসলেন এক সময়, দুই হাতে দুই চায়ের মগ। মেয়ের পাশে একটা মগ রেখে নিজেরটায় চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,’কি রে রাতে ঘুমোসনি?’ এইবার নিজেকে সামলানো গেলো না। মেয়ের দু’চোখে তীব্র শ্রাবণ। ‘একটা অন্যায় হয়ে গেছে মা। ‘ মেয়ের মুখে পুরো ঘটনা শুনে তিনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। রঞ্জনকে তিনি একাধিকবার দেখেছেন৷ অতি ভদ্র ছেলে। কয়েকবার এসেছে এখানে। এলে মাথা নিচু করে বসে থাকে চুপচাপ। সাথে দু একটা বই আনে। সুধন্য বয়সে ছোটো তাও সমবয়সীদের মতো কথা বলে। ‘একটু বেলা গড়ালে তুই ওর কাছে যা। ‘ মেয়ে আর মা আস্তে আস্তে চা শেষ করলো৷ রুলি প্রচুর ঘুমের ফোলা চোখ নিয়ে ওদের সামনে এসে বসলো। বোনেদের আদুরে মুখ দেখলে মন হালকা হয়ে যায় তৃষার- ভাই তো সোনামানিক, একটিমাত্র। হাতমুখ ধুয়ে নিছক সময় কাটানোর জন্যে একটা হালকা বই নিয়ে বসেছিলো তৃষা। সুধন্য দিদিকে পড়তে দেখে সামনে বসে মিটিমিটি হাসছিলো। দিদি আগে প্রচুর পড়তো। মাঝে রঞ্জনদার সাথে প্রেম হওয়ার পর পড়া বেশ কমেছে৷ ভাইকে হঠাৎ দেখে চমকে গিয়ে ধমক দিয়ে বসলো-‘একটু শব্দ করে আসলে কি হয় সু?’ আরো দু একটা বাক্য। আসলে বইয়ের পাতা থেকে ভাইয়ের মুখ এই তাৎক্ষণিক ট্রাঞ্জিশন ওর মাথা নিতে পারেনি তাই চমকে গিয়েই বকাবাদ্য। ভাই মন খারাপ করে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই নিজের টুকরো টাকরার দিকে তাকাবার সময় পেলো। তাকিয়ে ভয়। মাত্র দু’দিনে এতোটা ভেঙেচুরে গেলো সে! কাল বিকেলে ওখান থেকে চলে আসতে আসতে প্রথমটা শেষ হয়ে গিয়েছিলো থ্রি কালার্সের। আর তখন বিরতিতে কৃষ্ণাঙ্গ শীর্ণকায় এক যুবক বেরিয়ে পরিচয় দিলো নিজের। ‘আপনি তো সুধন্যের দিদি, তাই না? আমি মাহবুব। সুধন্য আসেনি?’ সে মাথা নাড়াতে যুবক বললো,’চলুন না একটু কফি খাই। ‘ খেয়াল করেছে তৃষা। যুবক সিগারেট বের করেছিলো ধরাবে বলে কিন্তু আবার রেখে দিলো৷ বুঝলো সে জুনিয়র কমরেডের দিদিকে সম্মান দেখাচ্ছে৷ সিগারেটের সাথে সম্মানের সম্পর্কের ইতিহাস নিয়ে একটা গবেষণাপত্র হতে পারে। তৃষা আবারো না বোধক মাথা নাড়লে মাহবুব আবার ভেতরে চলে গেলো। এখন স্নান করে নিয়ে বেরিয়ে পড়া দরকার। 
রঞ্জন নিজেদের বাসার গলিতে দাঁড়িয়েছিলো চুপচাপ। ওকে নতুন পোষাকে  দেখে তৃষা কেঁদে ফেললো৷ রিক্সা থেকে নামতে দেখে রঞ্জন এগিয়ে এলো৷ ‘চলো, ঘরে যাই৷ ‘ পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো ওরা। ‘মনে হচ্ছিলো, তুমি আসবে তাই দাঁড়িয়েছিলাম যদি চিনতে না পেরে ফিরে যাও। ‘ মা-ই দরজা খুলে দিলেন৷ তৃষার নাম শুনেছিলেন তিনি ছেলের মুখেই।।রঞ্জনের নিজের ঘরটি সাদামাটা। দেয়ালে কেবল ভ্যান গগের স্টারি নাইট ঝুলছে। আর কোনো বাড়তি জিনিস নেই৷ খাট আর ছোটো এক বইয়ের শেল্ফ। তৃষাকে বসিয়ে রেখে দুটো প্লেটে ফল কেটে আনলো। ‘প্রথমবার আমাদের এখানে এলে -‘ প্লেট এগিয়ে দিলো৷ খানিক চুপচাপ। মুখোমুখি অবস্থা থেকে পাশাপাশি গিয়ে বসলো তৃষা। ‘মায়ের মুখে তোমার নাম শুনে বাবা তোমায় দেখতে চাইতেন৷ দেখলে খুশি হতেন’- রঞ্জনের চোখে শব্দহীন অশ্রু। তৃষা মুছে দিতে গেলো- রঞ্জন আর তৃষার মুখ ইঞ্চিদূরত্বে। পরস্পরকে চুমু খেলো ওরা- কে আগে ওরা জানে না- ভালোবাসা শোক প্রশমিত করতে পারে – এ কথা ভেবে তৃষা বাধা দিলো না। 
রাইফেল স্কয়ারের ডিভিডির দোকান থেকে এক গাদা ডিভিডি নিয়ে বেরোবার মুখেই তানিয়া আফরিনের সাথে দেখা হয়ে গেলো মাহবুবের। তানিয়া চিনতে পারেনি শুরুতে- মাহবুব পরিচয় দিতে সে-ও চিনলো। সে কোন্ স্কুলজীবনের পর আবার দেখা হলো। ওর সাথে ফুটফুটে এক কন্যা। সবে হাঁটতে শিখেছে৷ ‘বিয়ের মাসখানেক পরেই বুঝলাম লোকটার নানা রকম সমস্যা, বুঝলে? আর সহ্য হলো না। ‘ আইসক্রিম খেতে খেতে নির্বিকার বলছিলো তানিয়া,’ কিন্তু ততোদিনে ওর বাচ্চা আমার পেটে৷ ওকে নিষ্ট করতে ইচ্ছে করলো না৷ মানে ওর তো কোনো দোষ নেই৷ ডিভোর্স হয়ে গেলো। ‘ মাহবুব ভালো শ্রোতা। শুনতে পারে টানা। ‘তা তুমি বিয়ে টিয়ে করোনি?’ প্রশ্নে সে, মাহবুব, হাসে। মাথা নাড়ে। ‘দূর আমায় কে বিয়ে করবে? তাছাড়া পার্টি নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকি।’ আইস্ক্রিম শেষ হয়ে আসছে আস্তে। ‘ পাবলিক এড থেকে পাশ করেছি তাও কয়েক বছর হয়ে গেলো। চাকরি বাকরি করতে ইচ্ছে করলো না। ‘ আইস্ক্রিম শেষ হলে ফোন আর ঠিকানা বিনিময় করে ওরা বিদায় নেয়। পিচ্চিটাকে বিশাল এক টেডি বিয়ার উপহার দেয়। 
ঢাকায় মাহবুবের একটা ফ্ল্যাট আছে। এদিকে এলে থাকে। নিরিবিলির দরকার হলে, নিভৃতির দরকার হলে, যখন চায় কেউ খুঁজে না পাক, তখন এখানে এসে চুপচাও কিছুদিন কাটায়। মা আর কদিন আগে দেখা হওয়া তানিয়া বাদে এ ঘরের খবর কেউ জানে না৷ ফোন এলো। ‘হ্যালো’ বলতেই ওদিক থেকে তানিয়ার রিনরিনে স্বর -‘ তোমার কি রং পছন্দ বলো তো-‘ দস্তয়েভস্কির ইডিয়ট বইটা পড়ছিলো সে, এক মুহূর্ত না ভেবে বললো, ‘ বেনীআসহকলা’, ওপাশ থেকে ছদ্মরাগ-‘ ঠিক করে বলো’- অগত্যা মাহবুব বলে-‘লাল,হলুদ আর নীল’- ‘আরে একটা বলো’- ‘হলুদ, তাহলে’- ‘বিশিষ্ট বামপন্থী নেতা লাল বললে না যে’ – জোরে হেসে উঠলো সে-‘ কালার প্রেফারেন্স নিয়ে শিবদাস ঘোষ কিছু বলেননি তো।’ এসব হাসিঠাট্টা করে ঘন্টাখানেক পেরিয়ে গেলো। দুপুরে নিজেই  রান্না করে খেয়ে দেয়ে এক ছোটো ভাইয়ের ইউনিভার্সিটির এসাইনমেন্ট তৈরি করতে গিয়ে সময় কেটে যাচ্ছিলো। এক সময় ছোট্ট ভাতঘুম। মোবাইল ভাইব্রেশনের শব্দে ভাঙলো। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তানিয়া- ‘ দরজা খোলো মাহবুব’- বিস্মিত, উঠে গিয়ে দরজাটা খোলে, আকাশ থেকে যেন এক পরী নেমে এসেছে হলুদ রঙা, তানিয়া আফরিন। হাতে র‍্যাপিং করা প্যাকেট। ‘হ্যাপি বার্থ ডে মাহবুব।’- বিস্ময়ের অবধি রইলো না৷ নিজের মনে ছিলো না,ওকেও বলেনি। জানলো কেমন করে – 
ড্রইং রুমের সোফায় বসেছে দু’জন। ‘তুমি জানলে কেমন করে?’- ‘অনেকদিন আগে স্কুলে পড়ার সময়ে তুমি একবার বলেছিলে- মনে থেকে গিয়েছিলো। ‘ র‍্যাপিং খুলতে পল গগ্যাঁর জার্নাল বেরিয়ে আসে৷ মেয়েটা টেলিপ্যাথি জানে নাকি! হয়তো  মন পড়তে পেরেই বললো-‘ বইটা ভাইয়া পাঠিয়েছে আমেরিকা থেকে আরো কয়েকটা বইয়ের সাথে। আমার পড়া শেষ। ভাবলাম, তোমার ভালো লাগবে। স্কুলে তো নানা জিনিস ভালো লাগতো তোমার।’ আনন্দের আতিশয্যে তানিয়াকে জাপটে ধরে কয়েক পাক ঘুরে নেয় মাহবুব৷ ‘সত্যিই খুব ভালো লাগছে’। ঝুলন্ত কিংবা উড়ন্ত ঐ দশাতেই তানিয়া আর মাহবুবের শরীর আর আত্মা পরস্পরকে খুঁজে পেলো। সূর্য কখন ডুবে গেলো কেউ টের পেলো না। লেখকও না। 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত