আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
কোনো ব্যক্তি মানুষ কি এ বিশাল পৃথিবীতে হিমালয়ের মতো একা হতে পারেন? কিংবা বিশাল মহাসমুদ্রে ভাসতে থাকা কোনো জলযানের মতো যার চতুর্দিকে অসীম জলরাশি? রত্না মজুমদার স্যান্ডেল সারাইয়ের চেষ্টা করছেন।সেলাইয়ের চেষ্টা করতে করতেই গল্প করছিলেন বেতের মোড়ায় বসা বাচ্চাটার সাথে। ছেলেটার কল্পনাশক্তি ভালো। অনেক ক্ষণ নিরবতা নেমে এলে ঐসব চিন্তা পেয়ে বসে। এক ছোটো বাটিতে পায়েস খাচ্ছে ছেলেটা, তারই স্কুলের ছেলে। গোলগাল, আদুরে। বাবা মা দুজনেই চাকরি করেন৷ স্কুল শেষে ওকে নিয়ে যাওয়ার কেউ নেই৷ তাঁদের সাথে কথা বলেই তিনি নিয়ে আসেন স্কুলের দিনগুলোতে নিজের কাছে৷ ছেলেটা শান্ত, মাত্র সাড়ে পাঁচ বছর বয়স। খাওয়া হয়ে গেলে সে খাঁচার পাখিদের সাথে কথা বলে, চার পাঁচ ধরণের পাখি তাঁর সংগ্রহে আর অল্প একটু বারান্দায় কয়েক জাতের ফুল। ফুল আর পাখিদের সাথে একার জীবন বেশ কেটে যায়৷ ‘দিদিমণি, আর একটু খাবো’- ছেলেটা প্রত্যেকবার বাটি বাড়িয়ে দেয়ার সময় তিনি বিস্মিত হন, খুব-ই পরিচ্ছন্ন খাওয়া- নিজে দুপুরে খাবেন বলে তুলে রাখা পায়েস তাকে দিলেন আবার- ‘ খেতে ভালো হয়েছে বাবু?’ ছেলেটা আশ্চর্য হেসে মাথা নাড়ে। তার সারা শরীর চোখসহ হাসে৷ ‘মা বলেন, খাওয়ার সময় লজ্জা না করতে’- এক গাল হেসে সে জানায় – ‘ আরো বলেন রাগ না করতে’ – আবার খাবারে মন দেয় এইটুকু বলে ফেলতে পেরে৷ স্যান্ডেল সেলাই করতে করতে তিনি ভাবেন, রাজু তাঁর নিজের ছেলেও হতে পারতো- এক বিকেলের ভুল সারাজীবনকে ধূসর মরুভূমি করে দিলো, অবশ্য এখন তাঁর সাধনা হচ্ছে, ধূসর ঐ মরুতে ফুল ফোটানো – তাই পাখি, তাই ফুল, তাই শিশুদের স্কুল, সেইজন্যেই জীবনের একমাত্র প্রেমিক পুরুষের কাছাকাছি থাকা, চোখের দেখাটুকু তো ঘটে। রাজু’র মা সুপ্রভা দুপুর দেড়টা দুটো নাগাদ ছেলেটা নিয়ে যান। একটু দূরের একটা মিশনারী স্কুলে তিনি পড়ান। ভোরে ঐ স্কুলের ঘন্টার শব্দেই তাঁর ঘুম ভাঙ্গে। একটার দিকে ছুটি হলে তিনি আসেন, প্রতিদিন সৌজন্য বিনিময় হয়। ‘ আমাদের কত উপকার করছেন দিদি!’ এ ধরণের কথা বারবার বললেও নাগরিক ভদ্রতায় বাসী হয় না- তিনি ভালো করে সুপ্রভাকে দেখেন- কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রং, কোমর ছাপিয়ে যাওয়া চুল, তিনি প্রায়ই চুল খোলা রাখেন। নিজে সাতাশ আর এ তরুণী ছাব্বিশ- কেবল অনুচিত, অভব্য তুলনা চলে আসে মনে মনে, কিছুই বলেন না তবু, কোনো কোনো দিন লেবুর শরবত অথবা ঘরে পাতা দই সাধেন- তিনি কোনোদিন-ই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন না৷ একদিন বলেছিলেন- ‘ বাইরে খেতে ইচ্ছে করে না দিদি, একদিন আসুন না সবাই মিলে কোথাও যাই ‘- নিমন্ত্রণ পেতে ভালো লাগে, গ্রহণে ভয় লাগে। আবার মনে হয়, পৃথিবীটা চলছে বিনিময় প্রথায়। সমাজের কলকব্জা মসৃণ থাকতো কেমন করে যদি এসব দৃশ্য অদৃশ্য বিনিময় সেসবের উপর ঝরে না পড়তো। তাঁর এক ঘরের বাসস্থান, কমন বাথরুম, জলের কষ্ট- স্বনির্বাচিত গরিবি জীবনে আর মায়া বাড়াতে চান না তিনি, এক জীবনের পক্ষে অনেক ভুল হয়ে গেছে। দাদা অনেকবার এসে ঘুরে গেছে, দাদার গাড়িটা এ গলিতে ঢোকে না। গত সাত বছরে অসংখ্য বার এসেছে৷ বাসা পাল্টালেই বের করে ফেলে দাদা খুঁজে খুঁজে। একটাই দাদা তাঁর। টাকাও সাধে এলে, জোর করে গুঁজে দিতে চান, তিনি নেন না। খানিক বসে, বোনের হাতে বানানো এক কাপ চা খেয়ে দাদা চলে যান। যাওয়ার সময় যেন ভুল করে টাকা ফেলে যান৷ বোন সে-ই টাকা খরচ করে না, মৃদু হেসে ব্যাংকে ফেলে দেয়। কখনো দাদা গ্রামাফোনের রেকর্ড নিয়ে আসেন৷ ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক, সে ইস্টার্ন হোক আর ওয়েস্টার্ন, ভাইবোনের ভারি পছন্দ, তাঁদের অল্প বয়সে মরে যাওয়া বাবা মাসের প্রথম কি দ্বিতীয় দিনে দুই তিনখানা বই আর একটি অন্তত গ্রামাফোন রেকর্ড বগলদাবা করে ঘরে ঢুকতেন। আর তখনকার মফস্বলে তাদের নিজেদের বাড়িটার সামনের উঠোনে চাঁদের হাট। অল্প দূরেই নদীর ঢেউয়েদের পরস্পরের সাথে কথা বলার শব্দ আর হয়তো আকাশে বিশাল এক চাঁদ। উঠোনে পাটি পেতে মা, বাবা আর দুই ভাইবোন, বারান্দায় তখনো পর্যন্ত বেঁচে থাকা ঠাকুমা। গ্রামাফোন সচল হলেই মনে হতো পৃথিবীতে যাবতীয় দুঃখই অপ্রাকৃতিক, মানুষের তৈরি করা, সুখ অত্যন্ত প্রাকৃতিক। সুর যেন মায়ের হাতের যত্ন, শৈশবে যেমন কলপাড়ে স্নান করাতেন ভালো করে গা মেজে দিয়ে, তেমনি একেকটা সুরের প্রবাহ আত্মা থেকে ময়লার শেষ টুকরো তুলে ফেলে, গ্লানি আর দৈন্যের কোনো চিহ্নই থাকে না শেষ পর্যন্ত। রাত খানিকটা গভীর হয়। মনে আনন্দ নিয়ে ওরা খেতে বসে। সেদিন, গান শোনার সন্ধ্যের পর ঘুমের মধ্যেও তার ধারাবাহিকতা থেকে যায়। সুন্দর ঘুম আসে৷ একদিন বাবা বলেছিলেন, খাতায় ঘুমের মধ্যে দেখা স্বপ্ন লিখে রাখতে দুজনকেই। পুরো স্কুলবেলা ভাইবোন নিজেদের খাতা পাল্টাপাল্টি পড়েছে। দাদার স্বপ্নে তখনকার নায়িকারা নেমে আসতো। ‘ একদিন তনুজা আমাকে বললেন, এই ছেলে এদিকে আসো, যাও তো এন্টনিকে ডেকে নিয়ে এসো। ভাত খাওয়ার সময় হয়েছে’ – পড়ে তো হাসতে হাসতে আরেকটু হলেই চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিলেন কিশোরী রত্না। অল্প কয়েকদিন আগেই ভাইবোন ‘এন্টনি ফিরিঙ্গী’ দেখে এসেছে সিনেমা হলে। কিছুদিন পর আবার যেমন আরেক হলে ‘ব্যালাড অফ এ সোলজার’ দেখতে যাওয়া হলো বাবার সাথে। ব্যালাডের নায়িকার সাথে কোথাও কি মিল ছিলো তনুজার! নিজস্ব খাতায় নায়িকার ব্যথার জায়গায় নিজেকে দেখে স্থির হয়ে গেলো। মনে আছে, দাদা অনেক ক্ষণ ধরে তাকিয়েছিলেন। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন । এখন, প্রতিদিন ভোরবেলা কর্পোরেশনের কলের সামনে লাইন দিতে গিয়ে যখন পা ব্যথা হয়ে যায় আর স্কুলে যাওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে ভেবে খারাপ লাগে তখন গ্রামাফোনের দিনগুলো মনে পড়ে। যখন এখানে জীবন শুরু করেছিলেন অস্বস্তি হতো, কাছাকাছি সব তাঁর স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বাসা। তাদের কারো কারো বাবামাও লাইনে দাঁড়ান। রত্না জীবনের শুরুর আদরে কাটানো জীবন ভেবে প্রথম প্রথম কষ্ট পেতো। সুপ্রভা সকালে দৌড়াতেন আরো কারো কারো সাথে৷ শরীর সম্পর্কে একটা সচেতনতা ছিলো৷ ‘দিদিমণি, পাখিদের খাঁচায় থাকতে কষ্ট হয় না?’ রাজুর কথায় বাস্তবে ফেরেন। ‘কারো কারো তো হয়ই’- সেলাই থেকে চোখ তুলে বললেন। ‘তাহলে তুমি ওদের আটকে রেখেছো কেন?’ রাজুর প্রশ্ন করার ধরণ সুন্দর, গতজন্মের কাউকে মনে পড়ে যেন – যে জীবনে তিনি আর বিলং করেন না। নাদুসনুদুস চেহারায় এক মাথা ঝোপের মতো চুল। ‘ ওরা তো আমার কথা বোঝে না সোনা, ওদের আমি কতো ভালোবাসি, খাঁচা খুলে দিলে যদি উড়ে যায়!’ – দিদিমণির কথা শুনে বাচ্চাটা ভাবতে বসে, আবার ছেঁড়া স্যান্ডেলটার দিকে আড়চোখে দেখে। ওর মায়ের হয়ত এমন গরিবি নেই৷ নিজেকে এখন আর প্রশ্ন করেন না। কেন না, দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ অগ্রাহ্য করে প্রথম প্রাণের পুরুষকে চোখের দেখা দেখবার জন্যেই এইভাবে থেকে যাওয়া, পুরুষটির জীবনে বিঘ্ন তৈরি না করেই। না, তিনি প্রেমিককে বিশ্বাসঘাতক ভাবেন না৷ প্রত্যেকেরই জীবন বেছে নেয়ার অধিকার আছে। অধিকার আছে সারাজীবন যার সাথে যাপন করবেন সেই মানুষটিকে সমস্ত সুযোগসুবিধাসহ নির্বাচন করবার। তাকে ছেড়ে যাওয়ার জন্যে কোনো অপরাধবোধে ভুগুক প্রেমিক সেটি তিনি চান না, আবার তার নতুন জীবনে কোনো উপগ্রহ হতেও চান না। এটা থেকে যাওয়া। যেভাবে নানা ঋতুর বায়ুপ্রবাহ পৃথিবীতে থেকে যায়। পায়েস শেষ করে বাটিটা মাটিতে রেখে ছেলে এবার বই ঘাটে৷ রাজু আসে বলে তিনি বেশ কিছু বাচ্চাদের বই এনে রেখেছেন৷ এসব বইয়ের সাথে পরিচয় বাবার হাত ধরেই৷ যেদিন অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরতেন সেদিন দুই ভাইবোনকে দুই হাতে ধরে শহরের একমাত্র বইয়ের দোকানে যেতেন৷ শফি কাকু বাবাকে দেখেই হাসতেন। দেব সাহিত্য কুটিরের বই তখন অন্যরকম ছিলো। ছিলো রুশ বইপত্র। বাবা আগে থেকেই বইয়ের কথা বলে রাখতেন৷ আজো ঘিয়ে রঙা কাগজে দেব সাহিত্যের শারদ বার্ষিকীর কথা মনে পড়ে। শুকতারার কথা। এসবের কিছু কিছু এখন এই ছিয়াশি সালেও রয়ে গেছে। প্রচুর ভিউ কার্ড ছিল দাদার সংগ্রহে। নায়ক নায়িকা আর খেলোয়াড়দের। বেশ কিছু দাদা দিয়ে গেছে বোনকে, বলেছে -‘ তোর কাছে বাচ্চাকাচ্চারা আসে, রেখে দে, দেখাবি। ‘ ববি ফিশারকে খুব ভালোবাসতো দাদা৷ খামখেয়ালী দাবার রাজপুত্র৷ এখন দাদা মেতে আছে আর্জেন্টিনা নিয়ে৷ ম্যারাডোনা ছেলেটা তাঁর নিজেরও খুব প্রিয়৷ অবশ্য নিজের ঘরে টেলিভিশন নেই। হেমলতাদের বাসায় সবাই মিলে খেলা দেখে, তাঁর সহকর্মী, তিন মিনিটের দূরত্বে বাসা, তিনিও মাঝে মাঝে জুটে যান৷ ‘আচ্ছা দিদিমণি, হাম্পটি ডাম্পটি সব সময় দেয়ালে বসে থাকে কেন?’- মূলত ভরা ক্লাসে এ প্রশ্ন শুনেই তিনি উপলব্ধি করেন রাজু অন্যদের চেয়ে কল্পনাপ্রবণ৷ কিছু একটা বলে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি কিন্তু ছেলে তো মানে না। আজ যেমন ভিউ কার্ডের মধ্যে একটা ছবি তার ভালো লেগে গেলো। দুজন মানুষ মুখোমুখি দাবা খেলছে। ‘ এটা কি দিদিমণি?’ – প্রশ্নের সাথেই রাজুর ছেলেবেলার এক দিগন্ত খুলে গেলো যা রাজুকে অনেক দিন পর্যন্ত মাতিয়ে রাখবে। আন্তঃস্কুল দাবায় টানা চার বছর সে চ্যাম্পিয়ন থাকবে তারপর। রত্না দি-ই শিখিয়ে দিয়েছিলেন খেলাটা৷ আর রত্না শিখেছিলেন বাবার কাছে৷ ইয়াকভ পেরেলম্যানের ‘অংকের মজার খেলা’ বইটাতে দানবীয় সংখ্যা বোঝানোর সূত্রে দাবার বোর্ড নিয়ে কি সুন্দর এক গল্প-ই না আছে!
সুপ্রভা এসে প্রতিদিনের মতো ছেলেকে নিয়ে গেলেন। মাথায় দাবা সম্পর্কে নতুন জানা কথাগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বেরিয়ে গেলো ভবিষ্যতের ক্ষুদে দাবাড়ু রাজু। আর রত্না মজুমদার কমন স্নানঘরের দিকে চললেন৷ মাপা জল ঢালার সময় মনে পড়লো, শৈশবের সে বাড়ি আর নেই। নদী এখন খুব ক্ষেপে উঠেছিলো। সীমাহীন জলাশয় থেকে একটি সহজ প্রাণ অত্যন্ত সীমিত জলে এসে পড়লে অল্প অল্প করে ফুরিয়ে যেতে থাকে? তার কিন্তু ফুরিয়ে গেলে চলবে না৷ জীবন অনেক বড়ো। জীবন অনেক সুন্দর। আরেক মগ জল ঢালতে পেরে ভালো লাগে৷ আজ ভাগ্যক্রমে চৌবাচ্চায় জল আছে। আবার মনে মনে বলেন, জীবন সুন্দর!
[চলবে]
কবি,কথাসাহিত্যিক