আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
ভোর চারটে ছাব্বিশে, পুরী স্টেশন থেকে আমরা অটো ধরলাম। আর এখন হলো এগারোটা ছাব্বিশ, সকাল। এই সাত ঘন্টায় পুরীকে পুরোপুরি আপন মনে হচ্ছে। বাংলা তেরোশ আটান্ন সালে স্বর্গদ্বার ঘাট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময়েও বোধ হয় আমি উপস্থিত ছিলাম। হোটেলে পৌঁছে ঘন্টা তিনেক ঘুম৷ সেই স্বল্পদৈর্ঘ্য ঘুমে পূর্বাকে স্বপ্নে দেখলাম, আমাকে ছেড়ে যাওয়া পূর্বা, সবকিছু ছেড়ে যাওয়া পূর্বা। আর আন্দরকিল্লা এলাকাকে৷ স্বপ্নে ‘কথাকলি’ বইদোকানকে গিফটশপ হয়ে যেতে দেখলাম। অবশ্য আগেই হয়েছে। চট্টগ্রামে কি নিয়ে যেন সমস্যা হয়েছে আর সে ভীড়ে পূর্বাকে হারিয়ে ফেলেছি। তাঁর জন্যে কী গভীর প্রেম ও আকুতি! অথচ বাস্তবে এতোটা নয় যে চলে গেলে শ্বাসকষ্ট হয় (এটা মনগড়া ধারণা ছিলো কেন না চলে যাওয়ার পর সত্যিই মৃত্যুপথযাত্রীর মতো শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো, যদিও ব্যথার ইনবিল্ট ধর্মই হলো সব ব্যথা এক সময়ে সয়ে আসে)।
ঘুমিয়ে উঠে কলকাতা থেকে আনা ‘গৌতম’ বিড়ির (আহা! গৌতমের নামেও বিড়ি বেরিয়ে গেছে।) আধখাওয়া প্যাকেট নিয়ে নীল ট্রাউজার আর আকাশী নীল টি শার্ট পরে বের হলাম। সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হলো, এই সেই পুরী সমুদ্র! উৎপলকুমার বসুকে মনে পড়লো। আর পূর্বার সাথে একান্তে উৎপলের পুরী সিরিজ পড়বার স্মৃতি। ছবি তোলা হলো অনেক। বিসলেরি জলের বোতলের বিজ্ঞাপনী ট্যাগ লাইন ‘কিস টু ড্রিংক’, বিজ্ঞাপন লেখক নিশ্চিতভাবেই বড় কবি, চুমুতে অগস্ত্য মুনির মতো সর্বস্ব গ্রাস করতে না পারলে চুমু কিসের আর! মন্দিরের দেয়ালে অর্ধনেত্র শিব এবং আরো নানা দেবতা (যেমন গণেশের) পাশে বিজ্ঞাপন মেলোড্রামাটিক এবং কবিতাময় লাগলো। তৃষ্ণার্ত হলেই তো আমরা চুমু খাই এবং চুমুর স্বাদ পেলে আবারো তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠি। একজন বেলুনবিক্রেতা দেখে বললাম- ‘আপনার একটা ছবি তুলবো?’, ভুলে গিয়েছিলাম এখানে বাংলা চলে না, তিনি বললেন- ‘মতলব?’, আমি তখন খানিকটা হিন্দি বলার চেষ্টা করলাম- ‘ম্যায়নে আপকো তসবির খিঁচনে চাহাতা হু’। তিনি খানিক দাঁড়ালেন। ‘স্মাইল প্লিজ’ বলতেও তিনি হাসলেন না৷ হাসবেনই বা কেন? আমি তো তাঁর প্রাইভেসিতে হাত দিচ্ছি৷ ছবি তুলতে তুলতে ভাগ্নের কথা মনে হলো, বড়দির বাচ্চা অতি চঞ্চল হয়েছে। চোখের কোণ খানিক ভেজা ভেজা লাগলো। পুরীর সমুদ্র দেখতে যাওয়ার আগে চারটে ছোটো গোল্ডফ্লেক আর দুটো ম্যাচ নিয়েছিলাম। জামাল ভাই ম্যাচ বক্স জমায়, তাঁকে দেয়া যাবে। সমুদ্র দেখতে দেখতে বিড়ি খাওয়ার মধ্যে অবিমিশ্র আনন্দ আছে৷ সময়কে বয়ে যেতে দেয়া। গায়ে খুব হাওয়া লাগে।
স্বর্গদ্বার মহাশ্মশান ঘাট তখন মড়া পোড়াতে ব্যস্ত। এক অতি বৃদ্ধাকে দেখলাম, খুব নিচু হয়ে হাঁটতে যেন মাটির সাথে তাঁর গূঢ় রহস্যময় ভাষার কোনো সংলাপ চলছে। একটি গাঁদা ফুলের ছিন্ন মালাকে দেখলাম ঝাঁট দিয়ে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। খুব মায়া হলো, ছবি তুলে তাকে ধরে রাখলাম। কলকাতার বন্ধু অভিষেক ঠিকই বলেছিলো, কবিতা আসে কথা বলতে। খুব একটা নির্জন না হলেও। অনেক ভোরবেলা একবার হাঁটতে হবে৷ একদিন সূর্যোদয় দেখতে হবে। আমরা উঠেছি শ্রীনিকেতনে। ডবল বেড, ফ্যান, লাইট, ইংলিশ কমোড, শাওয়ার, সর্বক্ষণ জল- একটি কিচেনসহ, অনেকে নিজেরাই রান্না করে খান। রাতে ট্রেনে তিনটে রুটি, ডাল, চিকেনের ঠ্যাংসহ মোট দু টুকরো মাংস এবং কিছু ভাত-সব আলাদা প্যাকেট, বাক্সে; পাতলা আবরণ দেয়া- তার বাদে উপরে বাঙ্কে উঠে মাথার নিচে বালিশ। ভাবলাম, অসীম সুন্দর লাল ব্যাগটিকে, সুরুচি মামীর দেয়া। ঘুম মন্দ হয়নি৷ মুনিয়া বলে ক্লাস ফাইভে পড়া একটি ক্লাস ফাইভে পড়া মেয়ের সাথে বেশ ভালো আলাপ হলো। যদিও সে টিনটিন বা হাঁদাভোঁদা পড়েনি। ভাইজ্যাগ বিশাখাপত্তনম গিয়েছে। তার বাবা তাকে আর মা’কে নিয়ে বেশ ঘুরে বেড়ান ফাঁক পেলেই। বাবাটি একটু দূরে বসে হাসছিলেন, এসব হাসিকেই বলে সাফল্যের হাসি। কাকতালীয় সুযোগে দুম করে দেশের বাইরে বেড়াবার এ সুযোগ নেহায়েত পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা চৌত্রিশের জীবনে৷ মুনিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে মনে হলো, সব ঠিক থাকলে আমার এমন একটি মেয়ে থাকতো- আমিও মেয়ের মা ও ওকে নিয়ে এইভাবে ঘুরতে বেরোতাম। ভূত আছে কি নেই, ট্রেনের স্পিড বাড়ছে না কমছে এসব নিয়ে ফুটফুটে মেয়েটির সাথে ম্যালা আলাপ হলো। মুনিয়ার মা জানালেন, ওদের আদি বাড়ি ফরিদপুর। আমি বাড়ি কাকে বলে অনেকদিন হলো ভুলে গিয়েছি। বাংলাদেশ থেকে দূরে এই ষষ্ঠতম দিনে অনেক শান্ত লাগছে। ঘরে ফেরার পর চারজনে মিলে সমুদ্রস্নানে গেলাম৷ চারজন মানে রঞ্জন দার বাবা মা, আমার দিদিমা আর আমি৷ এই দিদিমাকে আমাকে খুব ভালোবাসতেন ছেলেবেলায়, এখনো৷ মায়ের মামী উনি মূলত। বছর বাইশ তেইশ আগে পৈতৃক গ্রাম থেকে ওপারে চলে গেছেন। দাদুর সাথে প্রচুর ঘুরেছেন, ভারতের কত কত জায়গায় বুড়ো বুড়ি মিলে গেছেন! এই পুরীতেও! দাদুর কথা ভেবে দিদিমণি বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলেন।
পরাণসখা না থাকলে একলা মানুষের কি দশা হতে পারে আমি খানিকটা আঁচ করতে পারি মাত্র৷ পুরীর সমুদ্রতীরের বালি নরম, দু মুঠোতে ধরলে অনেক পুরনো কথা মনে পড়ে। একাধিক দুপুর ও বিকেলের স্মৃতি। মানুষের বেঁচে থাকা মানে তো অজস্র স্মৃতিকে চাপা দিতে দিতে ভেসে উঠতে না দিয়ে টিকে থাকা৷ বালিতে প্রিয় সব মানুষের নাম লিখলাম। পূর্বা। আমার বাবা শুভ্রশঙ্কর, মা সুপ্রভা। মাহবুব ভাই। নূরজাহান ইফতেখার। লিখি আর সমুদ্রের জল এসে ধুইয়ে দেয়৷ বড়ো করে, অনেক বড়ো করে লিখলাম-পূর্বা, সমুদ্র আরেকবার ধুইয়ে দিলো। সত্যিই যদি সে ধুয়ে নিকেশ করতে পারতো! সে মানে পুরীর সমুদ্র। বড়ো বড়ো ঢেউ এসে ভিজিয়ে দেয় আর পায়ের তলা থেকে বালি সরে সরে যায়। অনুভূতিটি অন্যরকম। আশেপাশে আরো কয়েকটি বাঙালি পরিবার ছিলো- তারা খুব হাসছিলো -জলে পড়ে যাচ্ছিলো আবার উঠে দাঁড়াচ্ছিলো৷ একটা ফর্সা যুবতীকে বললাম, ‘দিদি, একটা ছবি তুলে দেবেন?’, দিদিমা, মাসী মেসোকে নিয়ে একসাথে দাঁড়ালাম। তিনি তোলা শেষ হতে ভ্রুভঙ্গি করে খানিক নাচিয়ে সাবটাইটেলরহিত বোঝালেন, হয়ে গেছে। সেই হয়ে যাওয়া বোঝানো স্মরণীয়। তার আগে অবশ্য সস্তা ক্যামেরা হাতে একজন ক্ষয়ে আসা যুবক আমাদের ছবি তুলে দিলেন। আমিই বললাম। হোটেলে এসে ছবি দিয়ে গেলে টাকা। মানুষ উটের পিঠে উঠেও ছবি তুলছে। আমার উটের পিঠে উঠতে ইচ্ছে হলো না। মূলত কোনো প্রাণীর পিঠে চড়তেই আমার ইচ্ছে হয়নি কখনো।
দিদিমার জুতো জলের স্রোত নিয়ে গিয়েছে। স্থির বিশ্বাসে তিনি সেই পুরনো কথাটি বলছেন, সমুদ্র কিছুই নিজের কাছে রাখে না, ফিরিয়ে দেয়৷ এক সময় অজ্ঞাতপরিচয় এক পাটি চপ্পল ভেসে এলো। অনুপস্থিত ছাত্রের রোল কলের স্টাইলে একজন নাম ধরলেন- বলতে চাইলেন, ‘এই জুতো কার?’ তিনি হয়তো সেখানে নেই৷ সমুদ্র প্রেমিকার মতোই, দেয় তবে অন্যকে। সমুদ্রটান প্রেমিকার টানের চেয়েও জোরালো। বিস্কুট খেলাম, আমি তিনটে, দুটো মিষ্টি বাকিটা নোনতা- সুস্বাদু, চা-ও। সমুদ্রপাড়ের এই চারচাকার দোকানেই পরের কয়েকদিন সকালে খাবো। দুপুর বারোটা আঠাশ। ছয় অগাস্ট। দু হাজার ষোল৷
****
লোকজন জমে গিয়েছিলো। তারা ধরাধরি করে সুধন্যকে ঘরে দিয়ে গেলো। এক চকিত শোকের আঘাতে হাত পা মোমের মত গলে গিয়ে রাস্তায় দুমড়ে পড়েছিলো সে৷ দুটো দিন লাগলো ঠিকঠাক হতে৷ পাড়ার ডাক্তার ঠিকঠাক ঘুমোতে বললেন। সিরিয়াস কিছু নয়। বাবাকে খবর দেয়া হয়নি৷ হাসপাতালে শুয়ে চিন্তা করবেন৷ অনিশ্চয় আর বন্ধুরা এ কয়দিন বাই রোটেশন বাবাকে দেখাশোনা করেছে৷ আজ বিকেল থেকে আবার হাসপাতাল যাবে সে। সকালটা ফাঁকা। আধশোয়া হয়ে পুরনো ডাইরি ঘাটছিলো। ঘরে কেবল ছোটোবোন। একটু কমলার রস দিয়ে গেল খানিক আগে৷ একটা সিগারেট ধরালো, দুদিন পর৷ নিজের প্রতি আরেকটু মনোযোগী হতে হবে৷
এইভাবে জ্ঞান হারানো প্রথমবার ঘটলো। ক্লাস ওয়ানে পড়বার সময় পাড়ার যে কাকু প্রথম তার হাতে কমিক্স তুলে দিয়েছিলেন জন্মদিনে নিমন্ত্রিত হয়ে এসে, তিনি যখন লোকজনের কাঁধে চড়ে চলে যান, কেমন লাগে! এই বয়সেও মানুষটা বাজারে কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে দেখা হলে সে-ই ছেলেবেলার মতো গাল টিপে দিতেন। ডিসেম্বরের শেষ দিকে তিনি বাসায় আসবেন-ই। নানারকম বইপত্র নিয়ে৷ আজ বুঝতে পারে, শুধু তাকে নয় পাড়ার সব বাচ্চাকে তিনি ভালোবাসতেন, নিজে নিঃসন্তান ছিলেন বলেই হয়তো। বাবাকে দেখে এসে একবার কাকার বাসায় যেতে হবে, নিজে নিজে ঠিক করে রাখে৷ ছোটো বোন ঘরে ঢুকতে আধখাওয়া সিগারেটটা চিনামাটির কুমিরের মাথার ছাইদানিতে চেপে নেভায়৷ সদ্য মাধ্যমিক পাস করেছে। এইটুকু টুকু হাত পা ছিলো, কোলে নিয়ে কত জায়গাতেই না গেছে এক সময়। খালি প্রশ্ন করতো। সামান্য আটকে যেত কথা-
‘দা-দা, ওটা কি?’ ‘দা-দা এটা কি?’ সারাদিন প্রশ্ন আর একের পর এক বানান করে করে দেয়াল, সাইনবোর্ড পড়ে চলা। আজ বোনকে দেখে মনে হলো, নিজের অতি ব্যক্তিগত নানা মানসিক দুঃখে জর্জরিত থেকে কতদিন বোনেদের সাথে ঠিকমত কথা হয়নি তার৷ ‘দাদা, দুশোটা টাকা দিবি?’ পাশে বসে প্রথম কথা তার। বাসায় নানা কিছু ঘটে চলেছে৷ বাবা অসুস্থ৷ তার ভেতরে আমার কাছেই টাকা চাইলো বোন! ভেবে ভালো লাগলো। মাথার কাছের খোলা জানালা দিয়ে একটু দূরের তিন তলা পড়ো পড়ো দালান দেখায় সে: ‘ওই বাড়ির সুবর্ণা একটু আগে এসে ঘুরে গেছে। তিনদিন ধরে ওদের বাড়িতে নাকি খাবার নেই।’ বলে, বোন চুপ হয়ে যায়৷ সুধন্য বালিশের নিচ থেকে মানিব্যাগ বের করে টাকা দেয়। বাবা যেহেতু হাসপাতালে এখন সংসার খরচের টাকা ওর কাছেই রাখা থাকে৷ ‘আমার খুব ভালো লাগলো রে। কিন্তু তুই সব সময় এমন থাকিস না। নিজের জন্যেও কিছু ভাবিস৷’ বোন কিছু বলে না। মৃদু হাসে। সারা শরীরে তার অব্যক্ত কষ্ট৷ স্কুলের বন্ধু সপরিবারে না খেয়ে৷ তারো আগে বেশ অনেকদিন কখনো শুধু মুড়ি আর চিড়ে। জানালা দিয়ে সুধন্য দেখে হাঁটতে হাঁটতে বোন সুবর্ণাদের বাড়ি যাচ্ছে৷ বোনের জন্য গর্ব হলো তার। আর নিজেদের জন্য উদ্বেগ।
এই তিনবেলা খাওয়ার নিরাপত্তা আর কতদিন! আমার তো আজো কিছু হলো না। ভাবতে ভাবতে সুধন্য নিভিয়ে ফেলা সিগারেট আরেকবার ধরায়। চোখ বন্ধ করে পুরীর কথা ভাবে কিন্তু বার বার মড়া পোড়ানোর গন্ধের স্মৃতিই আসে৷ বেলুনবিক্রেতার মুখটা, মুনিয়ার মুখ, কিছুতেই মনে পড়ে না৷
কবি,কথাসাহিত্যিক