| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

হিম (পর্ব-১৬)

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
সেন্ট প্লাসিড স্কুলের গ্যালারিতে বসে ছোট্ট সুধন্য। মাত্র জে এম সেন স্কুল থেকে এসেছে। প্রাণের বন্ধু বাবু আজ স্কুলে আসেনি। অন্যরা টেবিল টেনিস খেলছে, সে যে একা বসে সেদিকে কারো খেয়াল নেই। অবশ্য এই ক্লাস ফোরেই একাকীত্বকে জয় করবার কৌশল উদ্ভাবন করেছে। হাতে বই। এখলাসউদ্দিন আহমেদের ‘এক যে ছিল নেংটি’। বইটা বাবা এনে দিয়েছেন বইঘর থেকে। এখন টিফিন টাইম। তারপরেই সাঈদা টিচারের ক্লাস। হোমওয়ার্ক না করলে তিনি শাস্তি দেন।
ক্লাসের বাইরে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অপমানের বদলে তার আনন্দ হয়। সে আকাশ দেখে। মেঘের নানারকম আকৃতি দেখে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারে।
সদ্য সদ্য পাবলিক লাইব্রেরিতে বানর রাজা সুন উখোনের কান্ড কারখানা পড়ার স্মৃতি ভাসে। ইফতি রাসেল পড়তে দিলো লাওশান পর্বতের মহাপুরুষ। এসবের মধ্যে লেখাপড়া আর হোমওয়ার্ক কারই বা ভালো লাগে! পাশে এসে বসলো জনার্দন দত্ত জনি, তার হাতে নতুন চাচাচৌধুরী। কয়েকদিন আগেই কারেন্ট বুক সেন্টারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খানিকটা পড়ে এসেছে। সাবুর সাথে রাকার এই যুদ্ধ লাগলো বলে। বাবা এইমাসে সাতখানা বই কিনে দিয়েছেন। সব পড়ে ফেলেছে। আর কত বলা যায়! পাবলিক লাইব্রেরিতে টিনটিন আর চাচা চৌধুরী কেন যে রাখে না! তার উপর পুরনো স্কুলের ছোটো শহীদ মিনার, স্কুলের পেছনের বরফ কল আর নুরজাহান শর্মিষ্ঠাদের জন্য তার মন কেমন কেমন করে। কান্না পায়। অপু আর দেবাশীষ আর প্রবীরের সাথে আর দেখা হবে না!  প্রবীরের বাসায় একদিন গিয়েছিলো গেলো বছর, ওর বোন স্নিগ্ধা তখন ওয়ান আর ওরা থ্রিতে। প্রথম দিন দেখেই ওর মা বললেন, এই ছেলে তুমি আমাকে মা ডাকবে, তোমার সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দেবো। ভারি লজ্জা পেয়েছিলো। প্রবীর ভারি সুন্দর মূর্তি বানাতো, নাদা পেট গণেশ আর প্যাঁচা দেখে ওর খুব লোভ হয়েছিলো। পরে প্রবীরকে বলতেই প্যাঁচাটা দিয়ে দিলো। আর ওর বোনের বাক্সভর্তি পুতুল, ফেলে দেয়া কাপড় থেকে বানানো। ওদের মা অবসরে বসে বসে বসে বানান। তৃষাদি প্যাঁচাটা দেখে খুব খুশি হয়ে পড়ার টেবিলে রেখেছে। মজা করে বলেছিলো, মা লক্ষ্মীর প্যাঁচা কি তাঁর বোনকে বলবেন না যাতে আমার রেজাল্ট ভালো করে দেয়! টিফিন ছুটিতে একবার
নুরজাহানেরা দল বেঁধে সুধন্যকে মেরেছিলো, ফাউন্টেন পেনের কালি আর জলরঙ ছিটিয়ে ওর শার্ট রঙিন করে দিয়েছিলো, কমিক্স নিয়ে কি এক ভুল বোঝাবুঝিতে, বাঁচিয়ে ছিলো প্রবীর মাঝখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। টিচাররা পরে বকে দিয়েছিলেন ওদের। আজ গ্যালারিতে বসে মনে পড়ছে ওদের। আসার আগে বলে আসা হলো না।
স্নিগ্ধাকে একদিন বলেছিলো,’তোমার মা আমাদের বিয়ে দেবে বলছে, তুমি রাজি আছো?’, সে কি বুঝে লজ্জা পেয়ে পালালো। জনি ওর হাতের বইটার দিকে তাকাচ্ছিলো বারবার। সুধন্য জিজ্ঞেস করলো, তুই পড়বি? জনি এক গাল হেসে বইটা নিলো। আর তখনই ঘন্টা পড়ে গেলো। লেসলি স্যার ভয়ানক কড়া। এদিক ওদিক হলেই শাস্তি। লাইন ধরে ক্লাস ঢুকে চট করে বইটা লুকিয়ে ফেললো। এমনিতে ক্লাসে অন্য বই আনা যায় না। টিচারের মন আজ ভালো ছিলো। হোমওয়ার্ক না পেয়েও শাস্তি দিলেন না কাউকে, নতুন পড়া ধরলেন। সুধন্য বসে জানালার পাশে। জানালার কিছু দূরের বিল্ডিং এর এক বারান্দার কার্ণিশে কয়েকটা চড়ুই পাখি কথা বলছিলো নিজেদের ভাষায়, খুব চেষ্টা করছিলো ওদের কথা বোঝার। আবার একটা প্রজাপতি উড়ছিলো  চড়ুই পাখিগুলোকে ঘুরে ঘুরে। তখন স্থির বিশ্বাস হলো, ওদের কোনো একটা শলাপরামর্শ হচ্ছে।
 রবার্ট রড্রিকস স্যার নতুন এক মানুষকে নিয়ে ঢুকলেন অনুমতি নিয়ে, মানুষটার কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। খুব অবাক হয়ে গেলো মানুষটার কাজ দেখে হাতের কাগজ ভাঁজ করে লোকটা নানারকম জিনিস বানিয়ে ফেলছে। প্রথমে বানালো একটা হরিণ আর তারপর দুটি বিড়ালের মাথা। ‘বুঝলে ছেলেরা, এটা হলো জাপানি কাগজ ভাঁজের খেলা, একে বলে অরিগামি’। তাঁর হাতে ষোল পাতার এক বই, তিনি পাঁচ টাকায় কয়েক কপি বিক্রি করলেন। সুধন্য একটা নিলো। ভেতরে ফুল, পাখি, উড়োজাহাজ, হ্যাট বানানোর পদ্ধতি। পরের ক্লাসে ব্রাদার র‍্যালফ এলেন।
কানাডিয়ান ভদ্রলোক। তিনি ভাঙা বাংলায় কথা বলেন। সবার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন তিনি। আগের দিন এমন একটি কাগজে মানুষের শরীরের নানা অংশের নাম তীর দিয়ে চিহ্নিত করা ছিলো, শিখে আসতে বলেছিলেন। আজ একইরকম ছবি, কেবল নাম নেই৷ সুধন্য ঠিক ঠিক স্পেলিং করে দুটো বাদে পারলো সব৷ ব্রাদার সবাইকে টফি দিলেন। তৃষাদির জন্য রেখে দিল দুটো৷ দুপুর বারোটার ঘন্টা বাজতেই ওরা দাঁড়িয়ে গুড আফটারনুন ব্রাদার বলে উঠলো। ব্রাদার হঠাৎ সুধন্যের সামনে এসে জানতে চাইলেন, তুমি বড় হলে কি হবে মাই বয়? সুধন্য খানিক চুপ থেকে বললো, ‘আমি জানি না। আমি তো কিছুই ভালো করে পারি না। ‘ ‘কিছু একটা তো পারোই তুমি। ভেবে দেখো না। আমাকে আগামী দিন বলিও তুমি কি পারো?’ একমুখ সাদা দাড়িগোঁফের ফাঁকে ঝকঝকে দাঁত এই বৃদ্ধ মানুষটির। সুদূর কানাডা থেকে শিক্ষাব্রত নিয়ে এসেছেন৷ লাস্ট পিরিয়ড শুরু হলো। ধর্ম ক্লাস। লাস্ট বেঞ্চের ছেলেরা এসময়ে টেবিল ক্রিকেট খেলে। সুধন্য গল্প খুঁজে পায় এ ক্লাসে৷ সেইজন্য ধর্মটিচার তাকে পছন্দ করেন৷ মেঘের অন্য পাশে স্বর্গ বলে কিছু কি আছে? মেঘ যে নানা আকারের দেখা যায় তা কি শুধুই বিজ্ঞান! সে জানে বিজ্ঞান কিন্তু দ্বিধা তার কাটে না, এইটুকু বয়সে কত প্রশ্ন তার মনে! রত্না মাসীকে কতদিন দেখে না, তাঁকে জিজ্ঞেস করলে অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। আজ আবার ব্রাদার জিজ্ঞেস করেছেন, সে কি পারে জানাতে। এই যে নানাকিছু চিন্তা করে, এটা কি কোনোরকম পারা? তার এই চিন্তা করায় কারো তো কোনো উন্নতি হচ্ছে না৷ কেউ তো কিছু পাচ্ছে না। এসব ভাবতে ভাবতে ছুটির ঘন্টা পড়ে গেলো৷ স্কুল থেকে কাছেই বাসা। হেঁটে যাওয়া যায়৷ একটা আইসক্রিম খেতে খেতে যাওয়ার সময় ফুরিয়ে আসে৷ ব্রাদার সুবল রোজারিও হাসিখুশি মানুষ, সামনে পড়ে গেলে মৃদু হাসেন ছাত্রের দিকে তাকিয়ে। স্মরণশক্তি সীমাহীন তাঁর। স্কুলের মেইন গেট দিয়ে বেরোতেই ডাক শুনলো, সুধন্য! ঘুরে তাকাতেই মাসীকে দেখে বিস্মিত হয়। মাসীর হাতে কাপড়ের ব্যাগ। বললেন, ‘তোমার ব্যাগটা আমায় দাও’, ব্যাগটা কিন্তু কিন্তু করে মাসীকে দিলো। এখন নিজেকে বড় বড় লাগে, ছোটোবেলার মত আবদার করা যায় না বলেই মনে হয়। ‘তোমায় অনেকদিন না দেখে মন খারাপ হয়েছিলো। আমার বাসায় যাবে একটু?’ সুধন্য গেলো, এখন মা আর বাবা কেউই বাসায় নেই। বোনেরা আছে এক দূরসম্পর্কের মাসীর দায়িত্বে। মাসীর বড় ছেলেও থাকে। তালা খুলে রত্না মাসী ঘরে ঢুকলেন৷’তোমার জন্যে কয়েকটা বই রেখেছিলাম’, আলমিরা খুলে বইগুলো দেন। রুশ রূপকথার বই সব৷ খেতে দেন তাকে৷ ‘তুমি যদি আমার ছেলে হতে!’ কথাটা বলেই আবার ঘুরিয়ে ফেললেন কথাটা, ‘কাউকে বলো না কথাটা বলেছি, কেমন?’ চামচে কেটে পায়েস খেতে খেতে সে খেয়াল করে এক বছরের বেশি আগে যেখানে যেখানে সে স্টিকার লাগিয়েছে, প্রত্যেকটা একই জায়গায় আছে, কেউ তুলে নেয়নি। মা তো স্টিকার লাগাতেই দেয় না। খালি বকে। ‘স্টিকারগুলো দেখলে তোমার কথা মনে পড়ে’, কণ্ঠ তাঁর ভারি হয়ে আসে কি! খাওয়া হলে মাসী তাঁর মুখ মুছিয়ে দেন৷ রিক্সা করে একেবারে বাসার সামনে নামিয়ে দেন কিন্তু বাসার ভেতরে ঢোকেন না। সুধন্য গেট খুলে ভেতরে ঢোকা পর্যন্ত তৃষ্ণার্তের মতন তাকিয়ে থাকেন৷ তারপর রিক্সা ঘোরাতে বলেন৷ সুধন্য ততক্ষণে অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে। সে জেনে গেছে, চিন্তা করবার ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীর অনেক বড় কাজ হয়। আসার পথে এক বইয়ের দোকান থেকে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘যে গল্পের শেষ নেই’ কিনে দিলেন, বললেন মন দিয়ে বইটা পড়লে অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে৷ তাহলে ব্রাদার র‍্যালফকে বলতে হবে, আমি চিন্তা করতে পারি৷ কিন্তু তিনি হেসে উঠবেন না তো? 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত