আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
মণি, মণি মা মণি – মা আস্তে আস্তে ডেকে যেতে থাকেন, চোখে জল তাঁর। মণীষা ঘুমের অতল থেকে ভেসে ওঠে। মুখের উপর ঝুঁকে থাকা মায়ের মুখ, বুঝতে পারে না মায়ের চোখে জল কেন! আজ তো ক্লাস নাইনের রেজাল্টের দিন। কম্বলের তলা থেকে বেরোতেই ইচ্ছে করে না৷ আর তিনদিন পর বিজয় দিবস। স্কুলে যেতে হবে, গেলে তৃষার সাথে দেখা হবে৷ তৃষা এখন মন দিয়ে ফেলুদা শেষ করছে। পড়া বইগুলো নিয়ে আসবে বলেছে। মণীষার দাদা রথীন্দ্রপ্রসাদ প্রিজনার অফ জেন্ডা আর আইভ্যানহো নিয়ে এসেছে৷ মাত্র চার বছরের বড়ো তবু দাদাগিরি ফলাতে ছাড়ে না। রঙ্গম সিনেমার পাশেই আব্দুর রহমান স্মৃতি পাঠাগার। বাসায় বই নিয়ে যাওয়া যায় না৷ কিন্তু লাইব্রেরিয়ান কাকুকে সে পটিয়ে নিয়ে এসেছে সপ্তাহখানেকের জন্য৷ সাত দিনের পাঁচ দিন বাকি। তৃষার জন্য দুটি বই একদিনই যথেষ্ট৷ উফ! কী দ্রুত পড়তে পারে! আবার একদিন ভাব নিয়ে বলছিলো- ‘আই ডোন্ট রিড ডিয়ার,আই স্ক্যান।’ তারপর দুই বান্ধবীই ফেটে পড়েছিলো হাসিতে।
ছয় বছর হয়ে গেলো পরিচয়ের। ক্লাস থ্রি টু নাইন। দুজনেরই একাডেমিক রেজাল্টের চেয়ে অন্য বইতে ঝোঁক। এই সেদিন কৃষণ চন্দরের লাল মুকুট উপন্যাসটা পড়ে দুজনই কেঁদে ভাসালো। মুক্তধারার বইটা ফুটপাথ থেকে নিয়ে এসেছিলো রথীন দাদা৷ কিন্তু, মা কাঁদছে কেন? মা কিছু বলেন না, খালি কাঁদেন। বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করতে করতে মনে হলো একবার, বাংলায় এবার হাইয়েস্ট থাকবে তো? প্রতি বছর হয় তৃষা হয় মণীষা, বাংলায় হাইয়েস্ট৷ ওরা বাংলায় টপার। এবারই তো, সমাজবিজ্ঞান পরীক্ষার দিন তৃষাকে বিরক্ত করছিলো পেছন থেকে এক মেয়ে, কন্টিনিউ কলম দিয়ে গুঁতিয়ে যাচ্ছে। একবার কেবল ধমক দেয়ার জন্য ঘাড় ফিরিয়েছে, সিস্টার ওকে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। এতো অপমান লাগছিলো ওর নিজের কাছেই! যখন দেখলো, বসতে বলার পরেই তৃষা না বসে খাতা জমা না দিয়েই বেরিয়ে গেলো, মণীষাও আর বসে থাকতে পারল না। প্রাণের বন্ধু বলে কথা! দাঁড়িয়ে পড়ে খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। আধ ঘন্টা বাকি ছিলো পরীক্ষা শেষের৷ হল থেকে বেরিয়ে তৃষাকে পাওয়া গেলো স্কুলের গ্যালারিতে,পেছনের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেছিলো, অসহ্য ক্রোধে তার সারা শরীর মৃদু কাঁপছিলো। মণীষাকে দেখে তার সব প্রতিরোধ চুরমার হলো । বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় বিচূর্ণ। মণীষা শান্ত হয়ে অপেক্ষা করে। রুমাল দিয়ে মুছে দেয় বন্ধুর চোখের জল৷ ‘চল, নিউজফ্রন্ট যাই’- মণীষাই ওকে রিক্সায় তুললো জোর করে। নিউজফ্রন্টে সোভিয়েত বইপত্রের আলাদা র্যাক আছে। দুই বন্ধুর ওতেই বেশি আনন্দ৷ তুর্গেনেভের ‘বাবুদের বাসা’ উপহার পেয়ে তৃষার হালকা লাগতে লাগলো।
দাঁত ব্রাশ করতে করতে চিন্তাটা কেটে গেলো মায়ের গলা শুনে- ‘মণি মা, রেডি হও। গ্রামে যেতে হবে আমাদের। তোমাদের ঠাকুমা মারা গেছেন’। কথাটা কানে আগে এলো না চোখের জল পড়াটা আগে বুঝতে পারলো না মণীষা। গ্রামের বাড়ি গেলে যে ঠাকুমা খেজুরের রস জ্বাল দেয়, সারা সন্ধ্যা বসে পিঠা বানায় আর গ্রীষ্মকালে উঠোনে শুয়ে মহাভারত থেকে একের পর গল্প বলে তিনি চলে গেলেন! চিরসুস্থ একজন মানুষ, গেলো বছরও দেখে এসেছে সটান, সোজা হয়ে হাঁটছেন, উঠোন ঝাঁট দিচ্ছেন, কাউকে হাত লাগাতে দিচ্ছেন না তিনি কেন চলে গেলেন! একদিন, মনে পড়ে মণীষার, বাড়ির পেছনের উঁচু খড়ের গাদার উপর মই দিয়ে উঠে ছোটো কাকা যে লেপ তোষক রোদে দিয়ে গিয়েছেন সেইখানে শুয়ে বই পড়ছিলো আর এদিকে দুপুরের স্নানের সময় হয়ে যাওয়ায় ঠাকুমা তাঁকে খুঁজছিলেন, নিজেই যখন ওখানে দেখলেন, ডেকে নামালেন। স্নান আর খাওয়ার পর বাঁধানো ‘দেশ’ আর ‘অমৃত’ বের করে দিলেন চার ভলিউম, বললেন,’ আজ থেকে এগুলো তোমার৷’ তখন মাত্র সিক্সে সে। তৃষাকে দেখাতে তৃষা উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলো। উচ্ছ্বসিত হয়ে তৃষা বলছিলো,’ এক সময় তাহলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ছাড়াই দেশ বেরোতো!’ এসব যত মনে পড়ছিলো, কান্না চেপে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ছিলো। আজ তৃষা ওকে খুঁজবে খালি, ছোটো একটা চিঠি তাড়াতাড়ি লিখে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে সোনালী দি’কে দিয়ে এলো। সোনালী সিংহ এক ক্লাস সিনিয়র৷ বাবা মা, রথীন আর মণীষাকে কর্ণফুলীর ওপারে যেতে হবে। বাবার বন্ধুর গাড়ি তাদের নদীর পাড়ে নামিয়ে দিয়ে গেলো আর তার বাদে নৌকা। মাঝ নদীতে কয়েকটা শুশুক ডিগবাজি দিলো,সূর্যের আলোর তাদের চকচকে গায়ে অন্যরকম সুন্দর লাগছিলো। জলে বৈঠার শব্দ আর ছোটো এক রেডিওতে সিনেমার গান হচ্ছে৷ নৌকা ওপারে যেতে রিক্সায় উঠতে হলো, দুই রিক্সায় চারজন, বাড়ির একটু আগেই নেমে গেলো ওরা। অনেক মানুষ৷ কান্নার নানা ধরণ মণীষার আজ চোখে পড়ছিলো আলাদা করে। অনেকদিন পর আজকের দিন মনে পড়লে, অন্যমনস্ক হয়ে ভাববে সে, পারিবারিক কান্নার আবহে কেমন করে নিজেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলে মানুষের অত্যন্ত নিজস্ব আচরণ কান্নার ধরণগুলি আলাদা করে খেয়াল করছিলো! সেদিন তার মনের বয়স অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিলো। জীবনের প্রথম মৃত্যু যে কোনো মানুষকে খানিকটা প্রাপ্তমনস্ক করে দেয়। ঠাকুমা উঠোনে শুয়েছিলেন। বুকের উপর ছোটো সাইজের গীতা। একদিন ঠাকুমা বলছিলেন,’ বুঝলি মণি, গীতার চেয়ে গীতবিতান আমার বেশি ভালো লাগে। মনে হয় এই বইটা সাথে করে নিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো।’ মণীষার তখন উত্তর দেয়ার বয়স হয়নি তবু ঠাকুমাকে বলেছিলো,’গীতায় তো দুই বন্ধুর কথাবার্তা সুন্দর। তুমিই তো একদিন আমাকে আর দাদাকে বুঝিয়েছিলে, ঐ যে আজ যা তোমার কাল তা অন্য কারো ছিলো। কি নিয়ে এসেছিলে যে তুমি কাঁদছো?’ ঠাকুমা হেসে উত্তর দিয়েছিলেন,’ সেটা তো ঠিকই আছে রে। কিন্তু গীতবিতানকে আমার মনে হয় সকল ধর্ম বইয়ের নির্যাস৷ গানগুলি শুনতে শুনতে কোন গান পুজা পর্বের আর কোন গান প্রেম পর্বের বোঝাই যায় না।’ খানিক থেমে বলেছিলেন,’ ভালোবাসার পাত্র মানুষ না দেবতা সেই কথা ভাবতে ভাবতে অমন যে রবীন্দ্রনাথ তাঁরও বেলা পড়ে এলো।’ একমাত্র রবীন্দ্রনাথের নামোচ্চারণের সময়েই ঠাকুমা হাত দুটি জড়ো করে উপরের দিকে তাকিয়ে নমস্কার করতেন৷ ঠাকুরমার দুনিয়ার ঈশ্বর বা দেবতা ঐ একজনই। ঠাকুমার প্রিয় বইটা বুকের উপর রাখতে বলবে কি না ভাবতে গিয়ে চুপ করে গেলো। বাবা তাঁর মায়ের মাথার পাশে চুপ করে বসে আছেন৷ চোখে জল নেই৷ ‘ভাস্কর্য’ কথাটি কয়েকদিন আগে প্রথম পড়েছে তৃষার কাছে দেখা ‘ইউরোপের ভাস্কর্য’ বইতে। বাবাকে ভাস্কর্যের মতো লাগছে। কান্নার এই চেহারাটি মণীষার মনে চিরদিনের মতো গেঁথে গেলো।
সেন্ট স্কলাস্টিকায় তৃষা বাবার সাথে এসেছিলো রেজাল্ট নিতে। সোনালী দি চিঠিটা দিলো। তখনই খুলে পড়ে ফেললো -‘ ত্রি, ঠাকুমা মারা গেছেন। স্কুলে আসছি না আজ৷ ফেলুদার বইগুলো যত্ন করে রাখিস। ঠাকুমা আমার রবীন্দ্রনাথকে বড়ো ভালোবাসতেন৷ ভালোবাসা রে- মণি।’ রবীন্দ্রনাথকে কে ভালোবাসে না! রিপোর্ট কার্ড হাতে নিয়ে রিক্সায় বসেও বার বার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলো। এমনকি বাবার লিবার্টিতে যাওয়ার প্রস্তাবও নাকচ করে দিলো। বার বার মণীষার মুখে শোনা ঠাকুমার নানা গল্প মনে পড়ে যাচ্ছিলো। পরে বাবাকে বলতে তিনিও গুম হয়ে গেলেন৷
মাতৃহীন সন্তানের অনুভূতি প্রকৃতই আন্তর্জাতিক।
***
তিতুমীর সেদিন গেলো না। রুখসানা অস্বস্তিতে ভুগলো সারা সন্ধ্যা৷ বার বার জানালা দিয়ে দেখছিলো কেউ আসছে কি না৷ রাত দশটার পর সুপ্রতিম এসে প্রতিদিনের মতোই শাওয়ার নিতে ঢুকলো আর শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে স্টাডি রুমে বসে দিনের পত্রপত্রিকা আর সংগ্রহের জার্নাল নিয়ে বসলো। টেবিলে মাপা তিনটে পেগ তিনটে কাট গ্লাসে আর জল। এসব খাবে, তারপর ডিনার তারপর ঘুম। ভোরে উঠে আবার আরেকটা দিন। রুখসানা ঘরে এসে ঢুকতে তাকালো সুপ্রতিম, একটা গ্লাস নিয়ে পাশে বসলো তার। ‘সু,আমরা কতোদিন কথা বলি না বলো তো!’ শহরের অন্যতম ব্যস্ত ডাক্তার হাসে। ‘আমাদের রুটিনের কারণেই কেউ কারো মুখোমুখি হই না হয়তো’, পত্রিকা রেখে দেয় একপাশে। আবারো একটা বড় বস্তি পুড়ে গেছে শহরের। রুখসানার হাত সুপ্রতিমের মুখে৷ ‘মেডিকেল হোস্টেলের দিনটা মনে পড়ে তোমার? আমাদের প্রথম দিন?’ স্ত্রীর প্রশ্নে ডাক্তার আবার হাসে। ‘আমার মেমোরি তো ভালো, তুমি জানো। সুধন্য বলে একটা ছেলে ছিলো না সাথে?’ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে রুখসানা, মনে হয় তার সারা শরীরে কয়েক হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে উঠেছে। আরো কাছে ঘনিয়ে আসে পরস্পর। প্রস্তুত হয়ে ওঠে পুরুষ, অনেক দিন পর নিজেকে অনুভব করে৷ ঠিক এইসময় এগারোবার শব্দ করে ঘড়ি এগারোটার জানান দিলো। তার রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ফোন বাজলো। নিজেকে বিযুক্ত করে ফোন ধরতেই হলো ডাক্তারকে। অদ্ভুত এক তিক্ততায় সারা শরীর ছেয়ে আছে৷ তলপেটেও মৃদু যন্ত্রণা। অন্য প্রান্তের কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গেলো৷ বিছানা থেকে জানতে চাইলো স্ত্রী৷ ‘আর বলো না কে এক তিতুমীর এক্সিডেন্ট করে অনেকক্ষণ রাস্তায় পড়েছিলো। এখন আইসিইউতে। ক্লিনিকে প্রচুর মানুষ৷ ভালো ক্রিকেটার ছিলো নাকি!’ পোষাক পাল্টে ডাক্তার তৈরি হতে হতে দেখলো স্ত্রী কাঁপছে, চোখে জল, একটুও গলা না কাঁপিয়ে বললো, ‘আমিও যাবো। ‘
রাত সাড়ে তিনটার দিকে তিতুমীরের জ্ঞান ফিরলো। প্রথম শব্দ বেরলো তার মুখে, রুকু আপা। আপা রে! ওখানে কেবল সুপ্রতিম ছিলো আর দুজনের সাথে। সে বেরিয়ে রুখসানাকে ডাকতে গিয়ে দেখলো বেঞ্চিতে হাতের তালুতে মাথা রেখে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে! চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে। বউয়ের জন্য অনেকদিন পর মায়া হলো তার। করিডরে কেউ নেই৷ শুনশান চারপাশ৷ বউয়ের কপালে আলতো চুমু খেতেই জেগে গেলো,’তিতুর জ্ঞান ফিরেছে?’ ‘হ্যাঁ’-সফল ডাক্তার ক্লান্ত হাসে।’ও ওর রুকু আপাকে ডাকছে। ‘ আইসিউর বাইরে কাঁচের দেয়াল থেকে তিতুমীরকে দেখলো রুখসানা। সুপ্রতিম ভাবছিলো, এ দুজনের কথা। এই প্রথম রুখসানা তিতুমীরের কথা বললো না তাকে। বিয়ের পর এতোগুলো বছরে এই প্রথম।
ভোর সাড়ে পাঁচটায় তিতুমীর আহমেদ, প্রতিভাবান ক্রিকেটার, মারা গেলো।
কবি,কথাসাহিত্যিক