Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

হিম (পর্ব-২০)

Reading Time: 4 minutes
তৃষা, 
আজ তোমায় দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। এখানে কয়েকদিন ধরে বরফ পড়ে রাস্তাঘাট সব বন্ধ হয়ে আছে৷ প্রথম প্রথম বরফ পড়া দেখতে খুব রোমান্টিক লাগতো। ছেলেবেলায় সিনেমার পর্দায় দেখা বরফ এখন একেবারে চোখের সামনে পড়তে দেখে রোমাঞ্চ হতো।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, আমাদের মামাবাড়িতে একবার শীতে শিলাবৃষ্টি হয়েছিলো। আমরা তুতো ভাইবোনেরা সবাই শিল কুড়িয়েছিলাম। নয়জনের এক দল ছিলো আমাদের। দোতলার ঢালাও বিছানা করা হতো মেঝেতে, একসাথে ঘুমাতাম। আজ এসব মনে পড়ছে আর তোমার সাথে প্রথম দেখাটা। তুমি কলেজ ইউনিফর্মে ইন্টারকলেজ ডিবেটে এলে। আমি চির মুখচোরা, দর্শক আসনে বসে। তোমার বিপক্ষ টিমে আমার বন্ধুরা। তুমি যখন বলতে উঠলে, আমার মনে হলো এর চেয়ে ভালো কিছু কোনোদিন শুনিনি। আমার অবিকল সেই বলাটুকু, বলার ভঙ্গিটুকু মনে আছে। তুমি বসে যাওয়ার পর আমি হাততালিটুকু পর্যন্ত দিতে ভুলে গেলাম। কথা বলতে সংকোচ হচ্ছিলো, একে তো সারামুখ ব্রনে ভরা আমার তার উপর টেস্টে ফেল করায় পরের বছর পরীক্ষায় বসা আমার জন্যে অনিশ্চিত। বলবার মতো কোনো এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজ ছিলো না আমার। এইজন্যে আমার সারা অস্তিত্ব এক অদ্ভুত সংকীর্ণতায় দীন হয়ে থাকতো৷ সেদিন কথা হলো না। আমাদের বিয়ের ছয় বছর পেরিয়ে গিয়েছে, এসব কথা তবু মনে পড়ে। 
তার পরের বছর শীতকালে আবার দেখা হলো। সে বছর নিউ মার্কেটের মণীষা অনেক রুশ বই অল্প দামে ছেড়ে দিচ্ছিলো, আমাকে মাহবুব ভাই নিয়ে গেলো। কিনেও দিলো কয়েকটা। যতই বলি পয়সা নেই। শোনে না। তুমি সেদিন এসেছিলে। বই দেখছিলে একেবারে দোকানের ভেতরের একটা টুলে বসে। নিকোলাই গোগলের ডেড সোলসের ইংরেজি সংস্করণ ছিলো একটা। তোমার পছন্দ করা বইয়ের স্তূপে ছিলো। ঐ বইগুলো তুমি পছন্দ করেছো, খানিকটা দেরিতে আসায় আমরা বুঝতে পারিনি। মাহবুব ভাই বইটি হাতে নিতেই তুমি ঘুরে তাকিয়ে খুব ঠান্ডা স্বরে বললে, এসব আমার পছন্দের বই। মাহবুব ভাই সহজভাবেই বললেন, ফটোকপি করবার জন্যে নিতে পারি কি, আপনি বই দেখতে দেখতে আমার কপি করা হয়ে যাবে। নিচে পরিচিত দোকান আছে।
 একটু উঠে কফি বানিয়ে আনলাম। আজ কাজে যেতে ইচ্ছে করেনি। বাড়ি থেকে দশ
মিনিটের হাঁটা দূরত্বে এক ছোট্ট রেস্তোরায় কাজ নিয়েছি। আগেরটায় পয়সা বেশি হলেও আসা যাওয়ায় চার ঘন্টা বেরিয়ে যেতো। এখানে আমরা মোট চারজন থাকি। কিশোরগঞ্জের এক ছেলে আছে, মাঝরাতে প্রায় জেগে ওঠে আর ফুঁপিয়ে কান্না করে।  আমরা বুঝেও চুপ করে থাকি। মাঝে মাঝে জানো তৃষা, খুব ইচ্ছে করে ওর বিপন্নতার জায়গাটা জানতে। কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয় না।
যা বলছিলাম, তুমি সেদিন রাজি হয়েছিলে আর মাহবুব ভাই আমাকে দেখিয়ে বললেন,
আমার ছোটোভাই রঞ্জন, এখানে থাকুক। আমি এখনই আসছি। আপনার বই নিয়ে পালিয়ে যাবো না কিন্তু। তুমি তখন হেসে ফেললে। অল্প বয়সে মনে হয়েছিলো, এইভাবে রংধনু ফোটে। ঘন্টা খানেক পেরোনোর পরেও মাহবুব ভাই ফিরলেন না। তখন তো আর ফোন ছিলো না, লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম৷ তুমিই তখন প্রথমবারের মতো কথা বললে, তোমার নাম কি? আমি বললাম। তুমিই আমাকে আইসক্রিম খেতে যেতে বললে। আমরা একটু এগিয়ে লিবার্টিতে গিয়ে বসলাম৷ লিবার্টির স্ট্রবেরি ফ্লেভার আইসক্রিম আমার বিশেষ পছন্দের ছিলো। একেবারে কোণায় বসেছি আমরা, তোমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছি। তুমি আমার পড়াশোনার কথা বলতে আমি সত্যিটা বললাম, টেস্টের কারণে ইয়ার ড্রপের কথাটা। তোমায় ইমপ্রেস করার করবার চেষ্টা করিনি। কারণ ইমপ্রেস করবার মতো কিছু ছিলো না। তখনই দেখলাম, কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকছেন মাহবুব ভাই৷ আমার পাশে এসে বসলেন। হাতে দুইখানা ডেড সোলস। হেসে এগিয়ে দিলেন, তোমার কপি। তুমি অবাক হলে, আরেকটা কপি দেখে। তারপর গল্পটা শোনা গেলো৷ ফটোকপির দোকানে ছিলেন মাহবুব ভাইয়ের বন্ধু শহীদুল ভাই৷ উনি একটা ছোটো প্রবন্ধ কপি করাচ্ছিলো। শহীদুল ভাই বললেন, ডেড সোলস কপি করে কি হবে, তিনি কাছেই স্টেশন রোডের এক দোকানে খানিক আগেই দেখে এসেছেন অরিজিনাল। এবার কথাবার্তা ছাড়া বন্ধুর হাত চেপে ধরে ঐ দোকানের দিকে ছুটলেন। তিন কপি ছিলো, মাহবুব ভাই একটা নিয়ে তারপর এখানে আসলেন। মণীষায় শুনেছেন, আমরা এখানে।  হঠাৎ জিভ কেটে বললেন, ইশ রঞ্জন, তোমার জন্যে তো একটা নিতে পারতাম! আমি বলতে চাইনি তবু বলে ফেললাম, ইংরেজি পড়তে আমার কষ্ট হয় দাদা। পারতপক্ষে পড়ি না। মাহবুব ভাই এসব শুনলে নরমালি হেসে ফেলতেন হয়তো তুমি ছিলে বলে  হাসলেন না। বললেন, আমাদের প্রত্যেকেরই দুই একটা অতিরিক্ত ভাষা জানা দরকার। নইলে পৃথিবীর অনেক সুন্দর অধরা থেকে যাবে৷
 তৃতীয় বার দেখা হলো, পাবলিক লাইব্রেরিতে। পড়ছিলে এক মনে। তোমার পাশেই বাচ্চা এক ছেলে চুপচাপ বসেছিলো। আমাকে দেখে চেনা দিলে, হাসলে। খেয়াল করলাম, হাসলে তোমার গজদাঁত দেখা যায়। আমি কীর্তিহাটের কড়চায় ডুবে গেলাম৷ অল্প খানিক সময় পর। তারাশংকরের এই বিশাল উপন্যাস আমার বিশেষ প্রিয়। মাথা তুলে দেখি, তোমরা নেই। কোন ফাঁকে যে দেড় ঘন্টা চলে গেলো! নিচে নামতে তোমাদের দেখলাম। বাচ্চাটা আইসক্রিম খাচ্ছে। তুমি ওর সাথে কথা বলছো। তুমি পরিচয় করিয়ে দিলে, ভাই বলে। কথা এগোতে লাগলো টুকটাক। আমাদের বন্ধুত্ব চলেছিলো প্রায় ছয় বছর। ডি ভি পেয়ে যেতে আর অসুবিধা হলো না। বাবার কিছু জমানো টাকা ছিলো। গেলাম৷ আবার ফিরে এলাম তোমার জন্যে৷ বিয়ে করে আবার ফিরলাম। প্রথম রাতে কি বলেছিলে মনে আছে? কুইজ থাকলো। 
তোমায় বলা হয়নি, মাস খানেক আগে মোমায় গিয়েছিলাম৷ মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট৷ আমার অনেকদিনের শখ ছিলো, ভ্যান গগের স্টারি নাইটস অরিজিনালটা দেখবো। শুক্রবার দুপুরের দিকে গিয়েছিলাম। বেশ নিরিবিলি থাকে তখন। ফিফথ ফ্লোরে পেইন্টিংটা রাখা। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলাম অনেকক্ষণ৷ মনে হচ্ছিলো, একটা অদ্ভুত ট্রান্সফর্মেশন হচ্ছে নিজের ভেতর৷ ছবিটা থেকে কোনো এক ধরণের রশ্মি এসে আমার ভেতরটা এলোমেলো করে দিচ্ছে। একদৃষ্টিতে স্টারি নাইটস দেখলে বাস্তব পৃথিবী ইলিউশনের জগতে চলে যায়৷ নক্ষত্ররাশি নিজের চারদিকে ঘূর্ণিত হয়। আশেপাশে কিছু লোক জমছিলো৷ কিন্তু আমি জনতার মধ্যে নির্জন হয়ে যাচ্ছিলাম৷ পাবলিক লাইব্রেরির চার তলায় ওঠার সময়ে দেয়ালে চেপে ধরে চুমু খাওয়ার সময় আমার ঠিক এমনটাই লাগছিলো। জীবনে প্রথম চুমু কিংবা ভ্যানগগের আসল ছবি দেখার অভিজ্ঞতা একান্তই ব্যক্তিগত। এই ব্যক্তিগতের কোনো সার্বজনীন ব্যাখ্যা হয় না। কেমন করে সেদিন নিজের ঘরে ফিরেছিলাম আজ ভালো করে ভাবলেও ভেবে বের করতে পারি না। ঐ সুনির্দিষ্ট সময়ের স্মৃতি বেমালুম লুপ্ত হয়ে আছে। আমাদের টুনটুনি কেমন আছে? আর সুধন্য? ওর কথা খুব মনে পড়ে। দেখে নিও, ও একদিন কিছু একটা হবে। আজ রাখি, চুমু নিও।’
নিজেদের ফ্ল্যাটে শুয়ে শুয়ে সকালে আসা চিঠিটা মন দিয়ে পড়েছে তৃষা। সে নিশ্চিতভাবেই জানে, রঞ্জন তাকে ভালোবাসে। রঞ্জন সত্যিকার অর্থেই বিরল ধরণের ভালো ছেলে৷ কিন্তু বিয়ের দুই বছর পর এক বৃষ্টির দুপুরের ঘটনাটা মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে অভিশাপ দিতে দিতে পরিবারকে রুলির অভিযোগ দেয়ার কথা সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না। পাশে রঞ্জনের বসে থাকা টুকুও, মাথা নিচু করে। সত্যিই কি রঞ্জন কোনো এক দুর্বল মুহূর্তে ঘুমন্ত রুলির শরীরে… সেদিনের পর রুলি অস্বাভাবিক চুপ হয়ে গেছে৷ পরিবারের সাথে কোনোরকম কথা, কোনো রকম সহজ সম্পর্কে সে আর থাকে না। এমনকি সবাই মিলে ঘুরতে গেলেও সে যায় না৷ তৃষা নিজেও অসংখ্যবার ঠিক কি হয়েছিলো জানতে চেয়েছিলো, রঞ্জন নিরুত্তাপ গলায় বলেছিলো, যা শুনেছো তাই। কিন্তু তৃষার মাথায় এখনো একটা কথা ঘুরপাক খায়, রঞ্জনের মতো একটা সেন্সিটিভ ছেলে এমন ঘটনার পর বিন্দুমাত্র দুঃখ প্রকাশ করলো না কেন! তবে কি ঘটনাটা যেভাবে প্রকাশ্য হয়েছে তার ভেতরে আরো অসংখ্য ভাঁজ রয়ে গেছে? 
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তৃষা রঞ্জনকে লিখতে বসে৷ ‘প্রিয় রঞ্জন, তোমার কুইজের উত্তর আমি জানি৷ কিন্তু বলবো না। তোমার চিঠিতেই আছে উত্তর। তোমার টুনটুনি এখন সারাদিন টুনটুন করে। প্যাত পুত শব্দ করা জুতো পরে যখন হাঁটে বুকটা ভরে যায়। তোমার কথা মনে পড়ে রঞ্জন৷ তোমায় ভালোবাসি, না বেসে পারা যায় না বলে…’
লিখতে থাকে তৃষা৷ কোথাও  একটা পুরনো হিন্দি গান বেজে উঠলো। বাচপান কে…

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>