Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

হিম (পর্ব-২১)

Reading Time: 4 minutes
সীতা এখন আস্তে আস্তে হাঁটতে পারে। আজ ছাদে উঠেছিলো আড়াই মাস পর। ছাদে আচার রোদে দিয়েছে মা। উনিশ দিন পর উচ্চ মাধ্যমিক শুরু। অস্বস্তি নেই কোনো। সত্যি বলতে এসবকে কখনো গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। টেস্টে সব টেনেটুনে পাস। ওরা মার খাওয়ার পরেও পরিস্থিতির কোনো অদল-বদল ঘটেনি। ধাপে ধাপে অনশন আর মানববন্ধন চলছে। দূরে ধানী জমি। ট্রাক্টরের এক অস্পষ্ট শব্দ শোনা যায়। জিনিসটাকে লাগে খেলনার মতো। বড়ো রাস্তা দেখা যায়। একটু পর পর ম্যাচ বাক্সের চৌকোনা আকৃতির গাড়ি যায়। শামস মমীনের কথা মনে পড়ে মাঝে মাঝে। সেদিনের পুলিশি হামলার ব্যাপারটা প্রায় সব পত্রিকার কম বেশি কভারেজ পেয়েছিলো। কিন্তু ফেসবুক কিংবা ফোনে ও একটু কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করেনি। সীতা একবারই চেষ্টা করেছিলো, বন্ধ পেয়েছে। ফেসবুক একাউন্ট খোলা কিন্তু একটিভিটি নেই। ছাদ থেকে নেমে সারা ঘরে আস্তে আস্তে হাঁটে। বাবা মা দুইজনই কাজে বেরিয়েছেন। হাঁটায় একটু অসুবিধা ছাড়া আর সমস্যা নেই দেখে সে নিজেই বলেছে ওদের। শুরুর কিছুদিন পার্টির ছেলেমেয়েরা এসেছিলো, তারপর আর কেউ আসেনি। শর্মিষ্ঠা দি ফোন করে এইমাত্র। সুধন্যদার বলা একটা কথা মনে পড়ে। কথাটা ঠিক তারও না তারকোভস্কির। কমননেস ইজ মিথ। কথাটা বিশ্বাস করেনি। করতে পারেনি সে। যৌথ খামারের স্বপ্ন তো প্রতিটি সংবেদনশীল মানুষই দেখে, এতোবড় পরিচালক এমন কথা বলেন কেন! পঞ্চাশের দশকে ব্যারিম্যান আন্তর্জাতিক খ্যাতি যখন পাচ্ছেন তখন তারকোভস্কি মাত্র ফিল্ম স্কুলে ভর্তি হচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধের বছর সুইডেনে বাতিল রাশিয়ান ফিল্মের ক্যানের স্তূপ থেকে ব্যারিমান আবিষ্কার করলেন তারকোভস্কিকে। সঙ্গী বন্ধু পরিচালক বেলগ্রেড। মেশিনচালককে ঘুষ দিয়ে দেখতে বসা ফিল্ম আন্দ্রেই রুবলভ। ব্যারিম্যানের মাথা খারাপ হয়ে গেলো, ফিল্মটা দেখে, চোখ লাল সত্ত্বেও আবিষ্কার করলেন, সাব ত ছিলো না তবু বোঝা গেলো কি করে! শরীর আর বেদনার ভাষা কি সাবটাইটেলরহিত আন্তর্জাতিক? যেমন কিনা ক্ষুধা, কান্না আর একলা থেকে যাওয়ার ভাষা? বিদ্রোহের? বিশ মিনিটের জন্য দেখা হয়নি এই দুই মহাশিল্পীর। পাশাপাশি দুটো ধূমকেতুর মতন পরস্পরকে অতিক্রম করে গেছেন তাঁরা। স্যাক্রিফাইস ছবির শুটিং যখন চলছিলো গটল্যান্ডে, ইতিহাস হতে পারতো একদিন, হলো না। পরে ব্যারিম্যান লেখেন কোথাও একটা,ভাষার দূরত্বের কারণেই দেখা করতে যাননি এবং এটা অনুশোচনা হয়েই রয়ে যায় সবসময় কেননা তিনি জীবনবোধের জন্য ভালোবাসতেন তারকোভস্কিকে। এইসব কথা সুধন্য দা-ই বলেছে৷ বলেছে, খুকি তুমি আর্টসে পড়লে ভালো হতো। তোমার মতো সেন্সিটিভ মানুষের জন্য সায়েন্স আসেনি৷ কেউ ভালো কথা বললেও তার রাগ হয়। মনে হয়,তাকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করবার চেষ্টা করছে। কমননেস মিথ হতে পারে না। মানুষ মানুষের পাশে থাকবে এটা তো আদি সত্য। কিন্তু এখন আবার মনে হচ্ছে তারকোভস্কি ঠিক৷  ফোনে মেসেজ এলো৷ এক লাইনের। সুমিত দা মারা গেছেন৷ আরেকবার মেসেজ দেখে সীতা৷ সুধন্য দা পাঠিয়েছেন৷ সে নিজের বিছানায় বসে পড়ে। সুধন্য দাকে ফোন করে। কয়েকবার রিং হয় কেউ ধরে না। অসহায় লাগতে থাকে তার। এই কয়েকদিন আগেও সুমিত দা আর সুধন্য দার সাথে মেসেঞ্জার গ্রুপ খুলেছিলো, আড্ডা দেয়ার জন্যে৷ দাদা কলকাতা যাওয়ার আগেরদিন ইনবক্সে জানতে চেয়েছিলেন জরুরি বই-টই আছে কি না আনানোর? বিয়ে করেছিলেন মাত্র মাস দেড়েক আগে, প্রেমের বিয়ে। ফেসবুকে দেখা যেতো, টোনা টুনি খুব ঘুরে বেড়াচ্ছেন৷ সুধন্য দাকে ভালোবাসতেন খুব৷ বলতেন, ছেলেটার মধ্যে সম্ভাবনা আছে৷ খালি যদি একটু স্থির হতে পারতো সে! স্ত্রীর একটা চিকিৎসা ব্যাপারে গিয়েছিলেন কলকাতা। সিভিয়ার হার্ট এটাক হয়েছিলো রাস্তায়। সারা রাত যমে মানুষে টানাটানি শেষে বেলা একটু গড়ালে চলে গেলেন৷ কাল সারারাত সারা দেশের অন্য অনেক কমরেডের সাথে সীতাও জেগে ছিলো। ভোরের দিকে অবস্থা একটু ভালো শুনে ঘুমাতে গেছে৷ তারপর এই৷  সুধন্যদা ফোন করলো। ভাঙা  গলায় ঠিকমত কথা বলতে পারলো না৷ ‘আমার তো বই হলো না। একটা হাতে লেখা পান্ডুলিপি নিজ হাতে বাঁধাই করেছিলাম তাঁর একটা মতামত নেয়ার জন্য৷ দেয়া হলো না।’ মেসেজ এলো তারপর। কখনো কখনো ফেসবুক মানুষের জলে ভেসে যায়৷ সুমিতদার সাথে যে দুইদিনের পরিচিত সে-ও পোস্ট দিলো। ফোন সুইচড অফ রেখে শুয়ে রইলো সে। 
***
এয়ারপোর্ট থেকে আনা হচ্ছে সুমিত দাকে৷ পার্টির দুই ভাঙা অংশের কর্মীরাই এসেছেন। একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছেন। কথা বলার তীব্র আকুতি৷ কিন্তু বেশিরভাগই জড়তা ভেঙে কথা বলতে পারছেন না৷ জড়তা ইগোর কিংবা মতবাদের৷ সুধন্য এক কোণায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। শহীদ মিনারের সামনে অস্থায়ী মঞ্চে পার্টির একাংশের ব্যানার লাগানো। সুধন্যের কাছে পার্টি মানে অখণ্ড পার্টি। আলাদা দুটি অংশের কারো প্রতিই বিশেষ ভক্তি শ্রদ্ধা নেই তার৷ উল্টোদিকের ফুটপাথে সিরাজ জহিরকে দেখা গেলো। বেশ হ্যাপিমুডে সিএনজি থেকে নেমে একটা সিগারেট ধরালো৷ এককালে বিপ্লবের চূড়ান্ত করে ছেড়েছে সে৷ পার্টি ঠিকমত বিয়ে করতে না দেয়ায় বাপ মায়ের পছন্দে বেশ মোটা টাকা যৌতুক নিয়ে বিয়েটা সেরে ফেলেছে৷ সেখান থেকে একটা অংশ নিতে অবশ্য তৎকালীন পার্টির আটকায়নি৷  সিরাজের তখনকার প্রেমিকা এখনো বিয়ে শাদী করেনি৷ টুপুর এখনো নিয়মিত চাকরি করে আর ফাঁকা সময়ে পার্টির কাজ৷ জহির আজকাল দৈনিকে কলাম লিখছে৷ দেশের নানা জটিল পরিস্থিতির তথ্য ও পরিসংখ্যান নিয়ে বিবরণ। কলামগুলোর ভাষা এতোই এলেবেলে, সুধন্যের হিসি পায়। রিজওয়ানুল করিমের অফিসে প্রুফ কাটতে বসার আগে এই অখাদ্য কলামে চোখ বোলানোর দুর্ভাগ্য হয়। রিজওয়ানুল আবার  কলামগুলো কেটে রাখে, ফাইল বানায়৷ বই হবে নাকি সামনে৷ এনজিওতে কাজ করে কিছু মালকড়ি বাগিয়ে এখন খোকার লেখক হওয়ার সাধ হয়েছে৷ মুখে থুতু জমায় ফেলতে গিয়ে এম্বুলেন্সের শব্দ শুনে আবার গিলে ফেললো৷ মাইকে দাদার আসার কথা ঘোষণা করা হচ্ছে। গাড়ির কাঁচ নামানো হলো। কেউ কেউ ফুল দিচ্ছে, সুমিত দার আবাল্য বন্ধু গাড়ির কাছাকাছি হতেই কেঁদে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় পড়ে যাচ্ছিলো। এখন অন্য অংশে চলে গিয়েছে শেখরময়, সে ধরে ফেললো। অথচ কয়েক মাস আগেই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অংশ অন্যের মাথা ফাটিয়েছে যাদের বুর্জোয়া দল বলতো ঠিক তাদের কায়দায়। সুধন্য গাড়ির দিকে আর গেলো না। তাঁর স্মৃতিতে সুমিত দা অতি জীবিত৷ ঐ ছবিটাই থাক। সে আস্তে আস্তে বাসার দিকে হাঁটতে থাকে। এই যে পার্টিটা ভেঙ্গে গেলো, দুই অংশই পরস্পরকে আর দেশের জনগণকে অসংখ্য মিথ্যে বললো তাতে বিপ্লবের কতদূর উন্নতি হলো! শেষ পর্যন্ত মতবাদই সত্য? ব্যক্তিমানুষের প্রাণের চেয়েও?
***
অনেক দিন গড়িয়ে গিয়েছে তারপর। সুমিত দার ছেলে অসীম আনন্দ এখন হাঁটতে পারে। পার্টি অফিসের এ মাথা ও মাথা দৌড়ায়। ফারহানা ইয়াসমিন ছেলেকে নিয়েই আছেন৷ সুধন্য দার লেখা বড়ো বড়ো মেইলে দেশের সব খবরই পাওয়া যায়৷ রামকিংকরের ভাস্কর্যটা প্রায় দুই ঘন্টা ধরে দেখছিলো সীতা৷ রক্ষণা-বেক্ষণের ব্যবস্থা নেই তাও যা আছে বোঝা যায় তার আদি সৌন্দর্য। ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো হঠাৎ৷ শামস মমীনের সাথে সেই দিনটা তার গতজন্মের বলে মনে হতে লাগলো। ভাস্কর্য আর ভাস্কর্যপ্রতিম তরুণী একসাথে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো। 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>